ছ-ফুট লম্বা একটি মানুষ
ভূমিকা
তেরশো ছাপ্পান সালে পূজার আনন্দবাজারে সপ্তপদী প্রকাশিত হয়েছিল। আমার সাহিত্যকর্মের রীতি অনুযায়ী ফেলে রেখেছিলাম নূতন করে আবার লিখে বা আবশ্যকীয় মার্জনা করে সংশোধন করে বই হিসেবে বের করব। বিগত ১৫/১৬ বৎসর ধরে কবির সময় থেকে এই রীতি আমার নিয়ম ও নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার জীবনে ও শিক্ষায় এ শক্তি নেই আমি জানি যে, একবার লিখেই কোনো রচনাকে–নিখুঁত দূরের কথা, আমার সাধ্যমত নিখুঁত করতে পারি। কিন্তু সপ্তপদীর সময়ে ঘটনার জটিলতায় তা সম্ভবপর হয় নি। যেমনটি ছিল তেমনটিই ছেপে বইয়ের আকারে বের হয়েছিল। ইচ্ছে ছিল দ্বিতীয় সংস্করণের সময় সংশোধন ও মার্জনা করব, কিন্তু তা-ও সম্ভবপর হয় নি বইখানির চাহিদার জন্য। ছ-বৎসরে আটটি সংস্করণ হয়েছে। প্রকাশকেরা বিলম্ব করতে চান নি, আমাকেও সুযোগ দেন নি। এবার জোর করে সুযোগ নিয়ে মোটামুটি সংশোধন ও মার্জনা করলাম। তাও সম্পূর্ণ হল না। সংসারে অসহিষ্ণু উদ্গ্রীব মানুষের তাগিদে ভারতের জগন্নাথকেও অসম্পূর্ণ থাকতে হয়েছে। হয়ত জগন্নাথকে রূপ দেবার ক্ষমতার দৈন্য মানুষ ওই কাহিনী দিয়ে ঢেকেছে। আমার এ উক্তির মধ্যেও আমার অজ্ঞাতমনের সেই ভানই হয়ত প্ৰকাশ পেল। সে দৈন্য সবার কাছে স্বীকার করে তাদের কাছে হাত জোড় করাই ভাল।
পরিশেষে সপ্তপদী রচনার ইতিহাস বা এই কাহিনীর আসল সত্য নিয়ে একটি নিবন্ধ যা ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে সেটিও পরিশিষ্টে যোগ করে দিলাম। মূল নিবন্ধে। কৃষ্ণের কথাই আছে। রিনার চরিত্র-ও ঠিক কাল্পনিক নয়। সামান্য দেখা কয়েকবার কয়েকটা ঝলক মাত্র। সেটুকু সপ্তপদীর কথা বলবার সময় বলা উচিত বিবেচনায় যোগ করে দিলাম।
০১.
ছ-ফুট লম্বা একটি মানুষ। হয়ত ইঞ্চি দুয়েক বেশিই হবে। দৈর্ঘ্যের অনুপাতে মনে হয় দেহ যেন কিছু শীর্ণ, কিন্তু দুর্বল বা রোগজীর্ণ নয়। কালো রঙ, বাঙলাদেশের কালো রঙ মাজা কালো। প্রশস্ত ললাট, লম্বাটে মুখখানির মধ্যে বড় বড় দুটি বিশ্নদৃষ্টি চোখ। বিষণ্ণতা ছাড়াও কিছু আছে, যা দেখে মনে হয়, লোকটির মন বাইরে থাকলে অনেক দূরে আছে, ভিতরে থাকলে অন্তরের গভীরতম গভীরে মগ্ন।
পাগলা পাদরী। এই নামেই ব্যক্তিটি পরিচিত এ-অঞ্চলে। অঞ্চলের লোকের দোষ নেই, এর চেয়ে ভালভাবে লোকটির স্বরূপ ব্যক্ত করা বোধহয় যায় না। পরনে পাদরীর পোশাক, কিন্তু সে-পোশাক গেরুয়ায় ছোপানো, যা ভারতবর্ষের বৈরাগ্য-ধর্মের চিরন্তন প্রতীক। এ-অঞ্চলের কোনো গির্জার সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট নন। কোনো ধৰ্মও প্রচার করেন না। শুধু চিকিৎসা করে বেড়ান। পাগলা পাদরী খুব ভাল ডাক্তার। বাইসিক্লে চেপে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে রোগী খুঁজে বেড়ান। পথের দু-পাশের লোকদের জিজ্ঞাসা করেন, কী মহাশয়গণ, কেমন আছ গো সব? ভাল তো? সঙ্গে সঙ্গে মুখভরা মিষ্টি হাসি উপচে পড়ে।
হ্যাঁ বাবা, ভাল আছি।
আচ্ছা! আচ্ছা! খুব ভাল। ভাল থাক। মানুষ ভাল থাকলেই ভগবান ভাল থাকেন গো। জয় ভগবান! বলেই এগুতে থাকেন। লম্বা মানুষের পা-দুখানাই বেশি লম্বা; কথা বলবার সময় বাইসিক্ল থেকে নামেন না-পা-দুখানা প্যাডেল থেকে নামিয়ে দেন মাটির উপর; চলবার সময় মাটি থেকে তুলে প্যাডেলে রেখে একটু ঝোঁক দিয়ে চাপ দেন চলতে থাকে বাইসিক্ল। যেকোনো লোকের বাড়িতে কেউ অসুস্থ থাকলে সে পাগলা পাদরীর প্রতীক্ষাতে দাঁড়িয়েই থাকে। কতক্ষণে কখন শোনা যাবে বাইসিক্লের ঘণ্টা, কখন দেখা যাবে সাইক্লের উপর গেরুয়া পোশাক-পরা পাদরীকে। দেখলেই হাত তুলে আগে থেকেই বলে, বাবাসাহেব!।
ছ-ফুট-লম্বা মানুষটি বাইসিক্ল থেকে মাটির উপর পা নামিয়ে দেন। নামতে হয় না। কী খবর? কার কী হল?
জ্বর।
কার?
আমার ছেলের।
চল; দেখি কী হইছে। জ্বরটা কেমন, বাঁকা না সোজা? কী মনে লাগছে বল দেখি?
রোগী দেখেন, দেখেশুনে বাইসিক্লের পিছনে বাধা ওষুধের বাক্স থেকে ওষুধ দেন। কিংবা বলেন, আমার ওখানে গিয়ে ওষুধটো নিয়ে এসো। না হয় বলেন–ইটা বাবু দোকান থেকে আনতে হবে। আমার ভাড়ারে নাই। লিখে দেন কাগজে।
বাঁকুড়া জেলার মধ্য দিয়ে যে-রাস্তাটাপুরীর পথ বলে খ্যাত বিষ্ণুপুরের কোল ঘেঁষে মেদিনীপুর হয়ে চলে গেছে সমুদ্রতট পর্যন্ত, যার সঙ্গে এদিক-ওদিক থেকে কয়েকটা রাস্তাই মিলেছে, তারই ধারে তার মিশন; না, মিশন নয়—আশ্রম।
শালবন আর গেরুয়া মাটির দেশ। মধ্যে মধ্যে পাহাড়িয়া নদী। বীরাবতী-শিলাবতী দারুকেশ্বর, বীরাই-শিলাইদারকা। মধ্যে মধ্যে লালচে পাথর, নুড়ি ছড়ানো অনুর্বর প্রান্তর খানিকটা। এই ধরনের ভূ-প্রকৃতি একটা ঢাল নামার মত নেমে ছড়িয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে। আবার এরই দু-ধারে বাঙলার কোমল ভূমির প্রসার। সেখানে জনসমৃদ্ধ গ্রাম, শস্যক্ষেত্র।
উত্তর ও মধ্যভারতের পার্বত্য ও আরণ্য-ভূমের রেশ উড়িষ্যা ও বিহারের প্রান্তভাগ থেকে বিচিত্র আঁকাবকা ফালির মত ছড়িয়ে পড়ে শেষ হয়েছে ক্রমশ। মেদিনীপুর থেকে বাঁকুড়া জেলার জঙ্গলমহলগুলি ইতিহাসবিখ্যাত। পাথুরে কাকুরে এই আঁকাবাঁকা শালজঙ্গল-অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিতে যে গ্রামগুলি, সেগুলিতে প্রাচীন আমলের সেই মানুষদের বংশধরেরা বাস করে। বাউরি, বান্দী, মেটে, মাল, খয়রা, সাঁওতাল। এদেরই মধ্যে সামন্তযুগে প্রধান হয়ে বসেছিল উত্তর ভারতের ছত্রীরা। সিংহ, রায় প্রভৃতিরা। কয়েকখানা গ্রামের পরে পরে এমনই এক-একটি পরিবার আজ এক-একটি বিবদমান গোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। লেগেই আছে মামলা-মকদ্দমা, দেওয়ানী ফৌজদারি। ঘোর কালো রঙের পীতচক্ষু অভাবশীর্ণ অর্ধনগ্ন মূক মানুষগুলির মধ্যে উজ্জ্বলবর্ণ দীর্ঘাকৃতি উগ্র প্রকৃতির মানুষগুলি বিচিত্রভাবে মিশে রয়েছে। এক-একটি ছত্রীবাড়ির নাম আজও রাজবাড়ি। এ-রাজবাড়ির ভাঙা দেওয়াল, মাটির উঠান, জীর্ণ খড়ের চাল; রাজার পরনে ময়লা জীৰ্ণ কাপড়, খোলা গা, বসে বিড়ি খান, অথবা হুঁকো টানেন; পরস্পরের সঙ্গে কর্কশ কণ্ঠে কটু ভাষায় কলহ করেন। রানী-রাজকন্যা নিজেদের হাতেই রান্নাবান্না করেন, নিজেরাই কখে বয়ে জল আনেন, ধান মেলে দেন পায়ে-পায়ে। উঠান নিকানো, বাসন মাজা, এসব এখনও ওই কালো রঙের মানুষদের বাড়ির মেয়েরা করে। পুরুষেরা জমি চষে, গরু চরায়, জঙ্গল থেকে কাঠ কাটে। কৃচিৎ কদাচিৎ এক-আধ ঘর দলপতি বা লায়েক-বাণীর বাস। আজও আছে। দলপতি লায়েক এদের উপাধি। এরা এককালে ছত্রী সামন্তদের অধীনে ছিল যোদ্ধা। সর্দার। সামন্তদের দেওয়া নিষ্কর জঙ্গলমহলে জঙ্গলে-ঘেরা গ্রামের মধ্যে আপনার জ্ঞাতি-গোষ্ঠী এবং অনুচরদের নিয়ে মদ্য মাংসে, মোটা লাল চালের ভাতে, দুর্দান্ত সাহসে, শিকারে, আর সন্ধ্যায় মাদলের সঙ্গে নাচে গানে জীবনযাপন করত। পাঠান-মোগলের যুদ্ধের কাল থেকে এদের কথা আর প্রবাদ বা কাহিনী নয়, ইতিহাস। মোগলদের শেষ আমলে, মারাঠা অভিযানের সময় এরা রীতিমত লড়াই করেছে। বনে-জঙ্গলে লুকিয়ে গাছের উপর চড়ে তীর ছুঁড়েছে। রাত্রির অন্ধকারে পিছন থেকে এসেছে মেরেছে। তাড়া খেয়ে বাস-বসতি ফেলে নিবিড় জঙ্গলে লুকিয়েছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সময় কোম্পানির ফৌজের সঙ্গেও খণ্ডযুদ্ধ হয়েছে। সামন্ত রাজারা আনুগত্য স্বীকার করার পরও এরা, এই সর্দারেরা, লড়াই করেছে।
বাগদী-সর্দার গোবর্ধন দলপতি যে লড়াই করেছিল কোম্পানির দপ্তরে তার বর্ণনা লিপিবদ্ধ করা আছে। গোবর্ধন দলপতি নিজের অধিকারের সীমানা রক্ষা করেই ক্ষান্ত থাকে নি, কোম্পানির সীমানা কেড়ে নিয়ে দখল করেছিল। তার বাইরে এসেও দিনে-দুপুরে গ্রামের পর গ্রাম লুট করে জ্বালিয়ে, গ্রামের রাস্তায় মানুষের মাথা কেটে টাঙিয়ে দিয়ে গিয়েছিল।
এদেরই এক-আধ ঘরের দেখা আজও মেলে।
সমতলভূমে ব্রাহ্মণ-কায়স্থ-বৈদ্য-নবশাক-প্রধান গ্রামগুলি এদের থেকে একটু দূরে। ওসব গ্রামেও বান্দী, বাউরি, মেটে, মাল আছে। তাদের চেহারা যেন কিছু আলাদা। রক্তের উত্তাপ এবং ঘনত্বেও বোধহয় তফাত আছে।
শালবনে ফুল ফোটার সঙ্গে সঙ্গে অরণ্য এদের আজও হাতছানি দিয়ে ডাকে। শালের সঙ্গে আছে পলাশ আর মহুয়া। পলাশফুলের গুঁড়ো দিয়ে আজও কাপড় রঙ করে এরা; মহুয়া থেকে মদ চোলাই করে। মধ্যে মধ্যে আবগারী পুলিশ হানা দেয় কিন্তু অধিকাংশ সময়েই ধরতে পারে না; বিস্তীর্ণ শালবনের মধ্যে কোথায় যে ঘাটি, সে আবিষ্কার করা প্রায় অসম্ভব। ধরা কৃচিৎ পড়ে। ধরা পড়ে জেল খাটে, কিন্তু সে ওদের কাছে বিশেষ কিছু না। মধ্যে মধ্যে শিকারে বের হয়। অবশ্য সাঁওতালরা এক্ষেত্রে বেশি। কিন্তু এরাও বের হয়ে পড়ে। ময়ূর, বনমোরগ, তিতির, খরগোশ, হরিণ, বরা, ভালুক মেরে পায় বিপুল উল্লাস। বিশেষ করে বরা-ভালুকের উৎপাত হলে মেতে ওঠে এরা। কখনও কখনও বাঘও আসে। তার সঙ্গে লড়াই দেবার মত সাহসের সে দুর্দান্তপনা আজ আর বোধহয় নেই। বাঘ এলে স্থানীয় বন্দুকওয়ালা শিকারিদের খবর দেয়। থানা। মারফত বিষ্ণুপুর শহরে কর্তৃপক্ষের কাছেও খবর পাঠায়। প্রায় দুশ বৎসর ধরে নিরন্তর শাসনে এবং সুকৌশল শোষণে এদের জীবনে সব গর্বই প্রায় চলে গেছে, এবং সাহস-উল্লাসও কিছুটা খর্ব হয়েছে। কারণ বরা-ভালুক মারবার সাহস থাকলেও বাঘ এলে তার সঙ্গে লড়াই করবার জন্য আজ টাঙ্গি-বল্লম-ধনুক-কাঁড় নিয়ে উন্মত্ত আনন্দে আর বেরিয়ে যেতে চায় না। শুধু রোগের হাতে আত্মসমর্পণে এদের ভয় নেই। রোগ হলে কপালে হাত দেয়। যা করে কপাল। ডাকে শুধু—হে ভগবান!
এদের মধ্যেই থাকেন এই পাগলা পাদরী। আজ কয়েক বছর আগে হঠাৎ এখানে আসেন, এসে থেকে গেছেন। এসেছিলেন যেবার, সেবার এখানে অনাবৃষ্টিতে জল ছিল না। শস্য ছিল না—দুর্ভিক্ষ হয়েছিল, তার উপর হয়েছিল মহামারীর প্রাদুর্ভাব। এখানকার মিশনারী সাহেবরা কাগজে দয়ালু পরহিতব্ৰতী চিকিৎসকের সাহায্য চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন তারই উত্তরে তিনি একদিন একটা ব্যাগ আর বিছানা দুই হাতে নিজেই বয়ে এনে হাজির হয়েছিলেন। এবং থেকেই গেছেন সেই অবধি। লোকে বিশ্বাস করে—ভগবান পাঠিয়েছেন।
শালবনের ধারে লালমাটির উপর একখানি ছোট গ্রাম। পাশ দিয়েই চলে গেছে পুরীর পাকা সড়ক। মাইলখানেক উত্তর-পশ্চিমে মোরার গ্রামে ওয়েসলিয়েন চার্চের দোতলা বাড়িটা। নিতান্তই ছোট নগণ্য একখানি গ্রাম। শালবন এখানটায় বিশীর্ণ এবং বিক্ষিপ্ত। গ্রামখানারও বাইরে শালবন যেখান থেকে জমাট বেঁধেছে, সেইখানে—ছোট একখানি বাঙলো বাড়ি; খানতিনেক ঘর। এইটেই তার আস্তানা। সঙ্গীর মধ্যে কয়েকটা পাখি, দুটি গরু এবং একটি দম্পতি। যোসেফ আর সিন্ধু। যোসেফরা অনেককাল আগে ক্রিস্টান হয়েছে। যোসেফলাল সিং। সিন্ধু মাঝিদের মেয়ে। সে ক্রিস্টান নয়। বিবাহও ওদের হয় নি। দুজনে দুজনকে ভালবেসে ঘরবাড়ি আত্মীয়স্বজন সমাজ থেকে চলে এসেছে। আশ্রয় নিয়েছে পাগলা পাদরীর কাছে। যোসেফ খানিকটা ইংরেজি জানে; পাগলা পাদরী তাকে কম্পাউণ্ডারি শিখিয়েছেন, সে কম্পাউণ্ডারি করে আর ছেলেদের পাঠশালায় পণ্ডিতি করে। সিন্ধু পাখিগুলির পরিচর্যা করে এবং বাঙলোরও গৃহিণী সে, রান্নাবান্না ভাড়ার তারই হাতে। আরও একটি সাঁওতাল মেয়ে আছে, নাম ঝুমকি মেঝান। পচিশ-ছাব্বিশ বছরের আশ্চর্য স্বাস্থ্যবতী মেয়ে। এমন সরল দীর্ঘাঙ্গী মেয়ে সচরাচর চোখে পড়ে না।
পাগলা পাদরী ওকে অনেক কষ্টে রক্ষা করেছেন মৃত্যুর মুখ থেকে। ঝুমকির বিয়ে হয়েছিল তিনবার। তিন স্বামীই অল্প দিনের মধ্যে মারা যায়। তারপর সকলের সন্দেহ হয়, ঝুমকি। ডাইনী। সাঁওতালদের সমাজপতিরা মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল ওকে। পাগলা পাদরী খবর পেয়ে বাইসিক্ল চড়ে ঝড়ের বেগে সেখানে গিয়ে অনেক কষ্টে ওকে উদ্ধার করে এনেছেন। ওই গ্রামের সাঁওতাল কর্তাকে তিনি চিকিৎসা করে বাঁচিয়েছিলেন। আরও অনেকেরই চিকিৎসা করেছেন। পাগলা পাদরীর কথা তারা ঠেলতে পারে নি। পাগলা পাদরী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, আর কখনও ঝুমকি কোনো সাঁওতাল গ্রামে যাবে না। সে তার বাড়িতে থাকবে, গরুর সেবা করবে, গাছপালা। লাগাবে।
উকে কেরেস্তান করবি না তো বাবাসাহেব?
না। তারপর হেসে বলেছিল, আমি কি কিরিস্তান মাঝি?
বৃদ্ধ সাঁওতাল সর্দার বলেছিল, কে জানে? ই বুলে তু কিরিস্তান বটিস; আবার কিরিস্তানরা বুলে—কিরিস্তান লয়; তুর জাতই নাইক। তু জানিস তু কী বটিস।
পাগলা পাদরী হা-হা করে হেসেছিলেন। তারপর বলেছিলেন, উরা বলে মাঝি, জাত আমার নাই। তবে মানুষ তো বটি। তুইও মানুষ আমিও মানুষ। ওই মেয়েটাও মানুষ।
তু মানুষ বটে। উ লয়। উ ডাইনী বটে।
আমি তো চিকিৎসা করে তোর এত বড় ভূতে-পাওয়া ব্যামোটা সারালাম,তু বল! উকেও আমি ডাইনী থেকে সারাব রে।
লারবি। তবে তু বলছিস লিয়ে যাবি, লিয়ে যা।
সেই অবধি ঝুমকিও থাকে এখানে। গরুর সেবা করে, বাঙলোতে গাছপালা লাগায়। রাস্তায় ঘাটে বাঙলোর সীমানার বাইরে কদাচিৎ বের হয়। সাঁওতাল পুরুষ-মেয়ের সঙ্গে দেখা হলে ছুটে গিয়ে লুকোয়, যেখানে হোক। তারা যদি আবার বলে, সে তাদের খেয়েছে।
পাগলা পাদরীর ঘরেই হয়ত ঢুকে পড়ে। পাগল মানুষটি চোখ বন্ধ করে ঝোলা ডেকচেয়ারে বসে থাকে, কী ভাবে, সন্তর্পিত পদক্ষেপের শব্দ কানে আসতেই প্রশ্ন করে, কে?।
ফিসফিস করে শঙ্কিত ভঙ্গিতে সে অন্ধকার কোণ থেকে বা আলমারির পাশ থেকে উত্তর দেয়, মেন এয়াং-বাবাসাহেব। ঝুমকি!
বাবাসাহেব মুখ তুলে তার দিকে তাকান, কৃষ্ণাঙ্গী অরণ্যনারীর সাদা জ্বলজ্বলে চোখের দিকে তাকিয়ে, স্বচ্ছ জলতলে নাড়াখাওয়া শ্যাওলার দলের মত ওই দৃষ্টির মধ্যে ওর ভয়ে-কাপা অন্তরকে দেখতে পান। প্রশ্ন করেন, ভয় পেয়েছিস? বাইরে মাঝিরা এসেছে। বুঝি?
সে তার দীর্ঘ সরল হাতখানি অন্য এক দিকে বাড়িয়ে দেখিয়ে দিয়ে বলে, অ্যাঁ-হঁ, আনৃপরম। অর্থাৎ না-না, এই দিকে, এই দিকে।
বাইরে আসে নি, ওই দিকে তারা যাচ্ছে।
বাবাসাহেব অভয় দিয়ে বাইরে আসেন। যারা যায় তাদের সঙ্গে ডেকে আলাপ করেন তাদেরই ভাষায়। অনর্গল বলে যান।
সাধারণত এই জেলার চলিত বাঙলাতেই কথা বলেন। কেউ বুঝতে পারে না যে তিনি এখানকার লোক নন। তারা কেউ কেউ প্রশ্ন করে, হ্যাঁ বাবাসাহেব, আমাদের কথাবার্তা বাকবাঁচালি এমন করে কী করে শিখলেন গো আপুনি?
সাহেব প্ৰসন্ন প্রাণখোলা হাসিতে উতলা বাতাসে শালগাছের মত দুলে ওঠেন; বলেন, তুমাদিগকে যি ভালবাসলাম হে! সেই মন্তরে শিখে লিলম। হুঁ!
তারপর আবার বলেন, তুমি বল ক্যানে, যাকে তুমি ভালবাস, তার মুখটি দেখে তুমি তার পরানের সুখ-দুখটি বুঝতে পার কি না? পার তো! ভালবাসলে পরানের কথাটি মুখ দেখে বোঝা যায়, আর মুখের কথা কানে শুনে শিখা যাবেক, ইটা আর বেশি কথা কী হে? অ্যাঁ? নাকি? তুমিই বল না হে মহাশয়!
একেবারে সুর স্বর উচ্চারণ সব যেন একতারে বাঁধা।
প্রশ্নকর্তার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকে না। তার সারা অন্তর উপলব্ধিতে আপ্লুত হয়ে যায়, আপন মনেই সে ঘাড় নেড়ে সায় দেয়, ঠিক কথা! ঠিক কথা! হ!।
তবে তার ইংরেজি শুনে ভদ্রসমাজের অনেকে সন্দেহ করেন, হয়ত লোকটির কয়েক পুরুষ ধরেই ইংরেজি ভাষা বলে আসছে হয়ত কয়েক পুরুষ ধরেই ক্রিস্টান। হয়ত বা মাদ্রাজী, কারণ নাম রেভারেন্ড কৃষ্ণস্বামী।
চেহারাতেও দক্ষিণের মানুষের সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ছ-ফুট লম্বা, মোটা মোটা হাড়, মেদবর্জিত দেহ, কালো মাজা রঙ, ঘন কালো মোটা ধরনের চুল। দক্ষিণের লোকদের মতই বড় বড় চোখ।
দৃষ্টি কিন্তু বড় বিচিত্র, বলতে হয় আশ্চর্য, অপার্থিব বিষণ্ণ অথচ প্রসন্ন। বর্ষণক্ষান্ত স্বল্পমেঘাবৃত শান্ত স্নিগ্ধ আকাশের মত। ভিতরের নীলাভা মেঘের পাতলা আবরণ ভেদ করে বেরিয়ে আসার মতই লাগে মানুষটির হাসি। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি আর গোঁফের আবরণের মধ্য থেকে যখন সুগঠিত দাঁতগুলি বেরিয়ে পড়ে হাসির প্রসন্নতায়, তখন আশপাশের মানুষগুলির মনের ভিতরটাতেও যেন সেই প্রসন্নতার ছটা গিয়ে ছড়িয়ে পড়ে।