সংসারের শব্দ
রুমানার হাতের চুড়ি রিনিঝিনি বেজে যায় দিনভর। শুভ্র হাতের সুডৌল বলয়ে লাল নীল সবুজ কমলার রংধনুরা খেলা করে সারাদিন। পিরিচের সাথে চায়ের কাপের টুং টাং টোকাটুকি। রান্নাঘরে হাঁড়ি খন্তার খুটখাট। প্রেসার কুকারে কান ঝালাপালা করা বাষ্পীয় শব্দ। রুমানার ঘন চুলের বিনুনি পিঠে ফেলার ধুপধাপ। টিনের চালে বৃষ্টি মেয়ের নূপুরের নিক্কন। ঘরের পাশে গাছের ডালে ভেজা কাকের পাখা ঝাপটানি। দরজায় ফেরিওয়ালা মেয়ের তরকারির ঝাঁপির ওঠানামা। দিনমান কত না শব্দের মিছিল বয়ে যায় রুমানা সৈকতের সংসারে।
সৈকতের মোবাইল থেকে থেকে বেজে ওঠে সারাদিন। বেজে যায় এসএমএস-এর টুং টাং মন্দিরা। একই বার্তা কতবার যে ঘুরে ফিরে আসে, বারবার দিনভর।
– তোমায় আমি কেবলই হারাই। আই মিস ইউ অল ডে ! এভ্রি ডে!
– এতোবার মেসেজ পাঠালে অফিস করবো কেমন করে সোনা? চাকুরী চলে যাবে না?
সৈকতের মৃদু অনুযোগে কাজ হয় না কিছু। রুমানার কণ্ঠে ছলকে ওঠে ঝুর ঝুর হাসি।
– চাকুরী যেন এমন কী মহার্ঘ্য কিছু ? চলে গেলে যাক না।
মুহূর্তে দার্শনিক হয়ে উঠে রুমানা।
– যা কিছু চলে যায় মনে কর তা তোমার ছিলই না কখনো। যে সারাদিন পায়ে পায়ে ঘুরে তার দিকে হেলাফেলায়ও ফিরে চাইবে না দু’একবার? রুমানার কণ্ঠে অভিমান ঝরে পড়ে।
– বেকার হয়ে ঘরে বসলে সংসারের আইন-শৃংখলার অবনতি। চুরি ডাকাতি খামোখাই বেড়ে যাবে যে!
রুমানা জানে দুষ্টু লোকটির কিসের ইঙ্গিত এটা।
– বেশি কাছে পেলে বোরড্ হয়ে যাবে এক সময়।
জবাব যেন তৈরীই থাকে রুমানার ঠোঁটে ।
– বোরড হবোনা গো। তুমি যা ডেলিশাস।
ফ্ল্যাটারিংটা খুব ভাল পারে সৈকত।
– ধ্যাত্ ! কী যে বল।
পাত্তা দিতে নেই এসব কথার।
– ইউ আর সো সুইট, সো প্রেটি।
খুব পটাতে জানে লোকটা !
– মিথ্যা কথা !
ভাল যে রুমানারও লাগে বুঝতে দিতে চায় না সৈকতকে। কী কী যে বলে লোকটা! স্লিম স্নিগ্ধ সেক্সি। ছেলেদের কাছে কত কী যে বদমায়েশী শব্দ থাকে! সৈকত বলে,
– রুমানা তোমার শ্রীময়ী স্নিগ্ধ অবয়ব আমার কবিতার লাইন। শরীর ছন্দে বহতা রুপালি জাহ্নবী। পাড়ে পাড়ে কত কী চড়াই উৎরাই। বেয়ে উঠতে পিছলে পড়ি !
– খালি অসভ্য কথা এই লোকটার মুখে।
– ইরেসিস্টিবল্, ইনট্রিগিং, স্পেল বাউন্ড! নও তুমি বল ?
– এত বকবক করোনা তো।
– ওয়ার্থ আ নোজ ডাইভ। স্ট্রেইট আওয়ে।
– আস তুমি আজ গুন্ডা। চেটেপুটে খাবোনে তোমায়!
এক্সোটিক শব্দের সম্ভার রুমানারও কি কম কিছু ?
– ওভার ইটিংয়ে বদহজম হবে যে প্রেয়সী।
– কেন, হাজমলা নেই তোমার কাছে ?
– আছে তো।
– কী কী দাওয়াই থাকে তোমার কাছে?
– অনেক। ব্যাগফুল এন্ড প্লেন্টি। কিসমিস এ্যাপিটাইজার। খুনসুটি টনিক। নিষ্পেশনী কুইনাইন এবং অতঃপর একটি দুর্বহ হুল। লাষ্ট ডোজ !
– ছিঃ ছি! তুমি যা খাচ্চর হয়েছ না সৈকত!
নিবিড় দাম্পত্যের একান্ত সংলাপে মুখর হয়ে থাকে সৈকত-রুমানার সকাল দুপুর সন্ধ্যা। পরশী শিশুদের হট্টগোলে বিকেল বেলার আদুরে ঘুম ভেঙ্গে গিয়ে খান খান। মেজাজ ভাল থাকে ? প্রায়ই এমন হয়। ঘরের পাশের খালি জায়গাটায় রোজ বিকেলে বসে শিশুদের ক্রিকেট আসর। ঠিক সৈকতের বিকেলের ঘুমের সময়টাতেই। কত আর সহ্য করা যায় ? বাঁদরগুলোকে আজ তাড়াতেই হবে। তেড়ে গেল ঘুম ভাঙ্গা লুঙ্গি গেঞ্জিতেই। বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই ভারী লেন্সের চশমার থলথলে গুল্টি দৌড়ে কাছে চলে আসে।
– সৈকত চাচ্চু, ক্রিকেট খেলবেন আমাদের সাথে? আপনাকেই প্রথমে ব্যাট করতে দেব। আপনি জিতলে সবাই মিলে আপনাকে একটা টি-শার্ট গিফট দেব। আর আমরা জিতলে আপনি আমাদের কেএফসিতে অল ইড ক্যান ইট খাওয়াবেন। ডিল ?
– ডিল!
মূহুর্তে রাগঝাল ভুলে গিয়ে গুল্টির বাড়িয়ে ধরা হাতে চাট্টি মেরে লুঙ্গিতে কোচা দিয়ে ব্যাট বাগিয়ে দাঁড়িয়ে যায় সৈকত। জানালায় রুমানার হাসি হাসি মুখ। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ওয়ার্ল্ড কাপের গ্যালারিতে ডোনা গাঙ্গুলি। পুঁচকেগুলোকে একটা ছক্কা না মারলে সৌরভের কি প্রেস্টিজ বাঁচে ? অনেক মাপজোক করে হেলে দুলে দৌড়ে এসে বল করে গুল্টি। গুল্টির বাউন্সার মাটিতে গোত্তা খেয়ে সোজা কপালে। লাগে বেশ জোরেই। ভাগ্যিস টেনিসের সফট বল। সৈকত কপালে হাত চেপে ওখানেই বসে পড়ে। গুল্টি ভয়ে গুটিয়ে গিয়ে সুরসুর করে টিনের দরজা গলিয়ে পাশের বাড়িতে হাপিস। কপালে হাত দিয়ে যন্ত্রণা চেপে ঘরে ঢুকতেই একেবারে ছিলে কেটে লবণ লাগিয়ে দেয় রুমানা।
– ক’টা বাঁদর তাড়ালে গো ?
এইসব দুঃখ কষ্টের সময় রুমানার এই ফিচফিচে হাসি কী যে জিদ লাগে ! রুমানার সব কিছুই উল্টো। সৈকতের কস্টের সময় হেসে কুটিকুটি। আনন্দের মৌসুমে বিষণ্ণতায় ছেয়ে থাকে মুখ। বলে, তোমার আনন্দে কেন মন খারাপ হয় জানো ? আনন্দ তো খুব অল্প সময় বেঁচে থাকে। একদিন আনন্দ ফুরিয়ে যাওয়া তোমার আনন্দহীন সময়ের কথা ভেবে মন যে খারাপ করে! এমন করে কেন বলে রুমানা?
ফোন বাজছে। রুমানা ফোন ধরে হ্যালো বলেই সৈকতের দিকে বাড়িয়ে দেয়। বলে নাও তোমার ফোন। গুল্টির মা ফোন করেছে। সৈকত ভাই পর্যন্ত বলে হাসির দমকে মহিলা আর কিছুই বলতে পারছেন না। অনেকবার চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত হাসি থামাতে না পেরে গুল্টির মার আর কিছুই বলা হলো না। পাশে কোথাও থেকে গুল্টির চিৎকার ভেসে আসে।
– সৈকত চাচ্চুকে স্যরি বলে দাও আম্মু।
আজকাল রুমানা কেন যে এত কাঁদে ? এখানে সেখানে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে।বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদে। আঁচলে মুখ ঢেকে কাঁদে। রুমানার কি ওর বাবা মায়ের কথা মনে পড়ে? কখনো জানতে চায় না সৈকত। বেশিক্ষণ সিরিয়াসলি কাঁদতেও পারে না রুমানা। চোখে চোখ পড়তেই ফিক করে হেসে দিয়ে চোখ মুছে ফেলে। সৈকত ব্যাপারটা হালকা করে দিতে চায়। ঠাট্টা করে বলে,
– সুক্রন্দসীর কান্না পর্বের এমন দ্রুত সমাপ্তি যে?
দাম্পত্য সান্নিধ্যের বিশেষ মৌসুমে সমর্পিত রুমানার কত কী আকুল আর্তি! কত কি যে চায় রুমানা তখন। দিনের বেলা সেসব আর ওর মনে থাকে না। দুপুরে ঠোঁট ফুলিয়ে কোমরে আঁচল গুঁজে রুমানা যখন সংসারী ঝগড়ার আসর সাজায় সৈকত তখন মনে মনে প্রার্থনায় নতজানু হয়।
– কাল রাতের দ্বিতীয় প্রহরের সমর্পিতা রুমানাকে আমায় ফিরিয়ে দাও ঈশ্বর।
কাল রাতভর সারাক্ষণ রুমানা কত কি যে বকেছে। সেধে সেধে নিজের ছোটবেলার গল্প শুনিয়েছে। ছোটবেলায় বাবা মায়ের সাথে রাঙ্গামাটি বেড়াতে গিয়ে পাহাড়ে পথ হারিয়ে ফেলেছিল। আদিবাসী ছেলেমেয়েরা কীভাবে দল বেঁধে নেচে গেয়ে গেস্ট হাউসে পৌঁছে দিয়েছিল সেই গল্প শুনিয়েছে। এত লাস্যময়ী আর এত উদ্যোগী রুমানাকে আর কখনো দেখেনি সৈকত। এত কেন সেজেছিল রুমানা কাল রাতে? রুমানার সব প্রিয় প্রসাধনী আর পোশাকের মেলা বসেছিল ঘরে। উৎসবের রাত্রি শেষে কাক ভোরে স্নান রুমানার অভ্যাস। সৈকত ভেবেছিল অন্যদিনের মত রুমানার ভেজা চুলের জলের ঝাঁপটায় ঘুম ভাঙবে আজ। রুমানা আজ ওঠেনি। ঘুম ভেঙে সৈকত দেখে ওর পিঠের কাছটি ঘেঁষে গুটি শুটি তখনো ঘুমিয়ে রুমানা।
– উঠবে না রুমানা?
মৃদু কণ্ঠে রুমানাকে ডাকে সৈকত। রুমানার চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। চোখ মেলে হেসে দেয় রুমানা। সামনে হাত বাড়িয়ে দেয়। দুই হাতে সৈকতকে পেঁচিয়ে ওর কোলে মাথা গুঁজে রাখে। মায়ের কাছে ক্ষুদ্র শিশুরা যেমন লুটেপুটে আদর নেয় তেমন। রুমানার গা কী গরম ! কম্বল জড়িয়ে দিয়ে সৈকত বলে,
– ঠিক আছে আরেকটু ঘুমাও তাহলে।
সেদিন অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমালো রুমানা। বিছিনা ছেড়ে উঠতে গিয়ে মাথা ঘুরে খাটের পাশে পড়ে গেল। খুব দ্রুত অসুস্থ হয়ে পড়ল রুমানা। পরপর কয়েকবার বমি করে একসময় একেবারে নির্জীব হয়ে গেল রুমানা। অ্যাম্বুলেন্স ডেকে হাসপাতালে নেয়ার পথে সারাক্ষণ সৈকতের কোলের মধ্যে এলিয়ে পড়ে রইল। অনেকক্ষণ অচেতন থাকার পর হাসপাতালের বেডে একবার চোখ মেলে চাইল। পাশে বসা সৈকতের হাত টেনে নিলো নিজের হাতে।
– অ্যাই এম স্যরি সোনা। আমাকে মাফ করে দাও!
রুমানা কেঁদে ফেলল।
ডাক্তার সুমন সৈকতকে নিজের চেম্বারে ডেকে নিয়ে গেলেন। বললেন,
– ওনার অবস্থা খুব ভাল নয় সৈকত সাহেব। এত অ্যাডভানসড্ স্টেজে নিয়ে এলেন ? এর আগে আর চিকিৎসা করাননি ?
নার্স হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে ডাক্তার সুমনকে বলল শিগগীর আসুন স্যার ! রোগী কোমায় চলে যাচ্ছে।
শহরের নামকরা সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েটি হঠাৎ একদিন কেন এভাবে বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিল সৈকত তা আজও জানেনা। জানতে চায়ত্তনি কোনদিন। রুমানাও কোনদিন বলেনি। সে সময়টায় সৈকতের ছোট বোন ময়ূরীর বিয়ের কথা চলছিল। সেদিন ছেলেপক্ষের ময়ূরীকে দেখতে আসার কথা। ঢাকার বাইরে থেকে আত্মীয়স্বজনরা এসেছেন। সৈকতদের মগবাজারের বাড়িটা আত্মীয়স্বজনে ভরতি। সকালবেলা নাস্তার টেবিলে বসে খালা-মামারা সবাই ময়ূরীর ছোটবেলার সব মজার কথা নিয়ে গল্প করছিল। বাবা মর্নিং ওয়াক সেরে ফিরলেন। খাবার ঘরে ঢুকেই সৈকতের দিকে চেয়ে বললেন,
– একটা মেয়ে তোর সাথে দেখা করতে এসেছে। দ্যাখ তো গিয়ে।
– আমার সাথে কে দেখা করতে আসবে এসময় ?
– গিয়ে দ্যাখ না। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটি।
বাবাকে মনে হল একটু বিরক্ত। সৈকত বেরিয়ে গেল। বারান্দায় গিয়ে দেখে হাতের ব্যাগটা বুকে চেপে গেটের পাশে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রুমানা। সামনে এগিয়ে যায় সৈকত। রুমানা মুখটা ভীষণ শুকনো লাগছে। অগোছালো বেশবাস। অবিন্যস্ত কেশ। চোখের কোলে কালি জমেছে। রুমানা কি অসুস্থ?
– রুমানা আপনি! এ সময় কি মনে করে ?
সৈকতকে দেখে এগিয়ে এসে পাশে দাঁড়ায় রুমানা। রুমানার মুখে একফালি মলিন হাসি।
– আপনার সাথে একটু কথা ছিল সৈকত। কোথাও একটু বসা যাবে?
– অবশ্যই। আসুন ভেতরে এসে বসুন।
রুমানাকে ওদের বসার ঘরের পথ দেখায় সৈকত। সৈকতের কাছাকাছি একটি সোফায় গিয়ে বসে রুমানা। কোন ভনিতা ছাড়াই খুব সহজ করে রুমানা বলল,
– আমি বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি সৈকত।
সৈকত ব্যাপারটাকে একটু তরল করার চেষ্টা করল। ঠাট্টা করে বলল,
– ঘর পালিয়েছেন বুঝি?
রুমানার পরের কথায় সচকিত হলো সৈকত। ব্যাপারটা তো সত্যিই সিরিয়াস। রুমানা তখন বলছিল,
– আপনি ছাড়া আর কারো কথা আমি কখনো ভাবিনি। ওই বাড়িতে আমি আর ফিরব না সৈকত!
সৈকত জানে রুমানা খুব সিরিয়াস মেয়ে। এই সাত সকালে বাড়ি বয়ে তামাশা করতে আসেনি। সামনের সোফায় মাথা নীচু করে বসে আছে। কপাল বেয়ে ছড়িয়ে পড়া চুলের ফাঁক দিয়ে রুমানার ক্লান্ত চোখ দু’টো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল সৈকত। রুমানার ফর্সা শীর্ণ আঙ্গুলগুলো থির থির কাঁপছে। সৈকত ভাবছিল ভার্সিটির মাধ্যাকর্ষণ চৌকস মেধাবী আল্ট্রা আধুনিকা সেই রুমানা কি এই ! অনার্সের প্রথমবর্ষ থেকেই বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল দু’জনের মধ্যে। মনের অনেক গভীরে রুমানার জন্য একটা ভাল লাগা অন্তঃসলিলার মতো তির তির করে বয়ে যেত। রুমানার ফিলিংসটা কখনো বোঝা যেত না। ভালবাসার কথা ওরা কখনো বলেনি কেউ। রুমানার প্রতি কৃতজ্ঞতায় মন ভরে গেল সৈকতের। সৈকত এখন কী করবে ? কিছু তো ওকে করতেই হবে রুমানার জন্য।
– আপনি একটু বসুন রুমানা। আমি আসছি।
সৈকত বাবার স্টাডির দিকে এগিয়ে যায়। সৈকত জানে বাবা এখন ওখানেই আছে। ঘরে ঢুকতেই খবরের কাগজের ওপর থেকে চোখ না সরিয়েই বাবা জানতে চাইলেন,
– মেয়েটা কে? এত সকালে তোর কাছে কেন এসেছে ?
আশৈশব বাবার কঠোর শাসনে বেড়ে ওঠা ক্ষীণ-প্রাণ সৈকত জীবনে এই প্রথমবার বাবার মুখোমুখি হবার সাহস করেছিল।
– রুমানা ভার্সিটিতে আমার সাথে পড়ত। ওদের বাড়িতে মারাত্মক কিছু একটা ঘটেছে। রুমানা বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে। এখন থেকে রুমানা আমাদের এখানেই থাকবে বাবা।
অনুমতি প্রার্থনা নয়। যেন সৈকতের নিজস্ব সিদ্ধান্ত ঘোষণা।
বাবার চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। তিনি সোজা সৈকতের চোখে চোখ রাখলেন। সৈকত ততক্ষণে মরিয়া হয়ে উঠেছে। বাবাকে ওর বলতেই হবে।
– রুমানাকে আমি ভালবাসি বাবা। আমাদের এখানে ছাড়া ওর কোথাও আর যাবার জায়গা নেই।
বাবার কপালে ভাঁজ পড়ল। বিশ্বাস হচ্ছিল না তার চিরদিনের ভীতু বিনয়ী ছেলেটা এতখানি সাহসী হয়ে উঠতে পারে। তার নিজের জীবনে কোন প্রেমের গল্প নেই। ভালবাসার জন্য কি মানুষ এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠতে পাথি? তিনি অনেকক্ষণ অবাক চোখে সৈকতের দিকে তাকিয়ে থাকেন। ক্রমশঃ তার মুখের কঠিন রেখাগুলো মিলিয়ে যায়। তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। সৈকতকে তিনি প্রায় হুকুমের স্বরে বললেন,
– যা, তোর মাকে ডেকে নিয়ে আয়। দরজা ভেজিয়ে দে।
অনেকক্ষণ পর বাবা মাকে সাথে নিয়ে বসার ঘরে ফিরে এল সৈকত। বাবা রুমানার মুখোমুখি সোফায় গিয়ে বসলেন। আম্মা বসলেন রুমানার ঠিক পাশটিতেই। বাবাই প্রথম কথা বললেন,
– সৈকতের কাছে সব শুনলাম আমরা। তোমার বাবা মার সাথে একটু কথা বলা দরকার রুমানা।
– তার প্রয়োজন হবে না আংকেল।
রুমানার কণ্ঠটা খুব দৃঢ় শোনাল। বাবা আপত্তি করে উঠলেন,
– সামাজিকতা বলে যে একটা ব্যাপার আছে সেটাকে তো ইগনোর করা যায় না রুমানা । তাছাড়া তোমার অভিভাবকরা ব্যাপারটা সহজে মেনে নেবেন এটাও তো আশা করা যায় না, তাই না ?
বাবাকে রুমানার প্রতি যথেষ্ট সহানুভুতিশীল শোনায়। তবুও মনে মনে যে তিনি অস্থির বোধ করছেন সেটা সৈকত বুঝতে পারে।
– আমি একজন অ্যাডাল্ট পার্সন আংকেল। নিজেকে ডিফেন্ড করার সব আইনি অধিকার আমার আছে। আমি জানি কোন স্টেপ ওরা নেবে না। সে সাহস ওদের কোনদিনও হবে না।
রুমানার অবিশ্বাস্য দৃঢ়তা দেখে বাবা চুপ হয়ে গেলেন। অনেকক্ষণ ধরে কী যেন ভাবলেন। তারপর সৈকতের দিকে চেয়ে বললেন,
– সৈকত শোন। আয় আমার সাথে।
বাবা সৈকতকে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন। একটু পর ময়ূরী আর সৈকতের খালাত বোন কুমকুম এসে রুমানাকে হাত ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে গেল। দুপুরে মায়ের হাতে একটা চেক দিয়ে বাবা বললেন ব্যাংক থেকে টাকা তুলে রুমানার জন্য যা যা দরকার সব কিনে আন। রুমানাকে নিয়ে মা, কুমকুম আর ময়ূরী শপিংয়ে বেরিয়ে গেল। বিকেলে ছেলে পক্ষ ময়ূরীকে দেখতে এল। ছেলেটা সবে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি পাস করে একটি বিদেশী ফার্মে ফাইন্যান্স ম্যানেজার হয়ে ঢুকেছে। গায়ের রং শ্যামলা হলেও চেহারাটা ভারি মিষ্টি। একটু বেশিই লাজুক। সারাক্ষণ মাথা নিচু করে বসে রইল আর মুচকি মুচকি হাসল। জুম্মনকে বাড়ির সবার একযোগে পছন্দ হয়ে গেল। ছোট বোন পিংকি তো তখনই দুলাভাই দুলাভাই বলে জুম্মনকে অস্থির করে তুলল। ময়ূরীকেও ওদের খুব পছন্দ হল। পাত্র পক্ষ বেশি দেরি করতে রাজি নয়। দুই সপ্তাহের মধ্যেই ময়ূরীর বিয়ে হয়ে গেল। ময়ূরীর বিয়ের দিন মা তার সব গয়না বের করে রুমানাকে বললেন যাও রুমানা এগুলো পরে এসো। বাবার বিশেষ ইচ্ছায় ময়ূরীর সাথে রুমানাকেও বিউটি পার্লার থেকে সাজিয়ে আনা হল।
বিয়ের আসরে কোনটা আসল কনে, রুমানা না ময়ূরী, এ নিয়ে অনেকেই কনফিউজড হয়ে গেল। আত্মীয় স্বজনরা জানতে চাইল মেয়েটি কে। মা বললেন আমাদের এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়া। ময়ূরীর বিয়ের পর মা রুমানাকে কিছুদিন ছোট খালার বাসায় রাখলেন। ছোট খালার বাসা থেকেই সৈকতের সাথে রুমানার একদিন বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের কয়েকদিন আগে ছোট খালু বাবাকে ফোন করে বললেন, দাদা ভাই, আমাদের মেয়েকে বউ করে ঘরে নিতে চাইলে বিয়ের জন্য যা কিছু আনুষ্ঠানিকতা, যেমন দাবি-দাওয়া দেনা-পাওনা দেওযা-থোয়ার ব্যাপারগুলো যেন লাইন মত পালন করা হয়।
রুমানার বাবা-মা আর কোনদিনই রুমানার খোঁজ খবর নিতে এলেন না। সৈকতের মনে হয়, এসব এইতো সেই দিনের কথা। মানুষের জীবন অনিশ্চিত নৌকায় পাল তুলে কত দ্রুত কোথায় কোথায় পৌঁছে যায়। দেয়ালে টাঙ্গানো রুমানার ছবিটার দিকে নির্ণীমেষ তাকিয়ে থাকে সৈকত। কারা যেন ছবিটায় একটা বেলী ফুলের মালা জড়িয়ে দিয়ে গেছে। রুমানার চোখে চোখ পড়ে যায়। রুমানা যেন ঠিক তেমনি চোখ নাচিয়ে হাসে। ছবিও এত সজীব হয়! কখনো মনে হয় এক্ষুনি বুঝি ফ্রেম গলিয়ে হেঁটে এসে সামনে দাঁড়াবে রুমানা। সৈকত ভাবে ছবির রুমানা যদি সত্যি সত্যিই একদিন ফ্রেম থেকে বেরিয়ে আসে। যদি সেই আগের মত হাত টেনে নেয়। আঙ্গুলে আঙ্গুলে জড়িয়ে বলে চলো না গো দু’জনে কোথাও বেড়িয়ে আসি। অথবা একদিন অনেক রাতে ওই ছবিটা যদি হঠাৎ কথা বলে ওঠে!
– এখনো শুতে আসছ না কেন গো ? ঘুমিয়ে পড়ব কিন্তু আমি। ঘুমের মধ্যে ডাকাডাকি চলবে না।
সৈকত রুমানার সংসারের পরিচিত শব্দরা যেন দল বেঁধে কোথায় পালিয়ে গেছে! দেয়াল ঘড়ির কাঁটাগুলো সেই কবে থেকে এককালীন থেমে আছে। বশংবদ ভৃত্যের মত ঘড়িটা আর যখন তখন দিন রাত্রির সময় বলে না। আলমারীর আড়ালে বসতি গড়ে তোলা ক্ষুদ্র সরীসৃপেরা আর নিশুথি রাতে দল বেঁধে পতঙ্গ মৃগয়ায় বেরিয়ে আসেনা। কোন কোন দিন হঠাৎ অনেক রাতে সৈকতের ঘুম ভেঙ্গে যায়। বাড়ীর পাশের কালী মন্দিরের ঝাঁকড়া জাম গাছ থেকে কুক পক্ষীদের নৈশ আকুতির সুর ভেসে আসে। বিছানায় কুন্ডুলি পাকিয়ে ভয়ে গুঁটিয়ে থাকে সৈকত। আজকাল প্রায়ই দুপুর বেলা একটা দাঁড় কাক জানালার পাশ দিয়ে উড়ে যায়, কা কা কা । কী এক অস্থিরতায় সে এ ডালে সে ডালে লাফিয়ে বেড়ায়। জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে থাকে সৈকত। এই জানালায় দাঁড়িয়েই রুমানা কত দিন সৈকতের ঘরে ফেরার অপেক্ষা করেছে। তাড়াতে গিয়েও দাঁড় কাকটিকে আর তাড়ানো হয় না সৈকতের।