সংঘর্ষ
পার্টি অফিস থেকে বেরোতে আজও দেরী হয়ে গেলো । সুমিত সাইকেলের প্যাডেল জোরে জোরে চালাতে থাকে । রাস্তার নিয়ন আলোতে হাতের কব্জি উল্টিয়ে ঘড়ি দেখে নেয় – প্রায় আটটা বাজে । আজ সকালে বেরোনোর সময় তিন বছরের মেয়ে মৌ বার বার বলছিলো- বাবা তাড়াতাড়ি আসবে কিন্তু । আমার জন্মদিনে কোয়ালিটির আইসক্রিম চাই । মিতা আজ সি.এল নিয়েছে । সুমিতকে বলেছিলো- একটা দিন না গেলেও পারতে । সুমিতের গলায় বিরক্তির সুর- রোজ রোজ এক কথা শুনতে ভালো লাগে না । যা সম্ভব নয়, তা জেনেও কেন মিথ্যে আবদার করো । ইদানিং মিতাও মাঝে মাঝে ফুঁসে উঠে । রাখো তোমার সাম্যবাদ, নিজে বাঁচলে বাপের নাম ।
আজকাল সুমিতের নিজেকে বড় অসহায় লাগে । মনে হয়, এই যুদ্ধ আর কতদিন একা একা চালিয়ে যাবে । অথচ এই মিতাই অমিতকে সামনে এগিয়ে দিতো । কলেজ ইলেকশনে সুমিতের সাফল্যের পিছনে মিতার উৎসাহ ছিল সবচেয়ে বেশি । মিতা কলেজ ছাড়ার পর একটি কমার্শিয়াল ব্যাংকে চাকরি পেলো, সুমিত হয়ে গেলো পার্টির হোল টাইম ওয়ার্কার । সুমিতের গলায় ব্যঙ্গ সুর – কোথায় গেলো শোষিত শ্রমিকের সংগ্রাম । একেবারে পুঁজিপতির দালাল হয়ে গেলে । মিতা হেসে উত্তর দিয়েছিলো- আমি পুঁজিপতির একটু ধন আহরণ করবো শোষিত শ্রমিকের জীবন বাঁচাবার জন্য । আর শ্রমিকশ্রেণী সংগ্রাম করবে, উৎপাদনের উপর তার অধিকার কায়েম করবে ।
তারপর দুজনে সাতপাকে বাঁধা পড়লো ও তাঁদের জীবনে মৌ আসলো । মিতা ধীরে ধীরে পিছু হটতে শুরু করলো । ইতিমধ্যে প্রমোশন পেলো । বাড়িতে ফ্রিজ, রঙ্গীন টেলিভশন, গোদরেজের ক্যাববোর্ড । সহকর্মীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হালফ্যাশনের সোফা, ডাইনিং টেবিলও এলো । মাস দুয়েক হলো মিতা শহরতলিতে এক টুকরো জমির বায়না করেছে l এক সময়ের সংগ্রামী শ্রমিক নিজেকে ক্ষুদ্র পুঁজিপতি গড়ে তুলেছে ।
সুমিত নিজেকে ঠিক পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে তুলতে পারে না । পার্টি অফিসে জোর আলোচনা চলে – পূর্ব ইউরোপে কমিউনিস্ট শাসনের পতনের কারণ কি? ফাঁপা অর্থনীতি না শ্রমিকশ্রেণীর এক বিশেষ গোষ্ঠীর সুবিধাভোগ । সুমিত জীবনের সাথে আদর্শের খেই হারিয়ে ফেলে । নিজেকে তো সমাজ থেকে আলাদা করা যায় না । আর নিজেকে বাদ দিয়ে জগৎ বদলানো, অনেকটা জলে না নেমে সাঁতার শিখানোর মতো মূর্খামি ।
বাড়ি ঢোকার সামনে গলির দোকান থেকে সুমিত হাফডজন কোয়ালিটি আইসক্রিম আর এক কেজি ওজনের একটি কেক কিনে নিলো । দাম দিতে গিয়ে সুমিতের মনে হলো – ভারতবর্ষের দরিদ্ররেখার নিচে বাস করা একটি পরিবারের বার্ষিক আয়ের পরিমান যে কত ছিল । হিসেব করতে গিয়ে যেন গুল পাকিয়ে যায় ।
সাইকেলে উঠে মনে পড়ল – আজ টিভি রিচার্জ করার কথা ছিল । মৌ’র মিকিমাউস, টম এন্ড জেরি না দেখলে ঘুম আসে না । হটাৎ সাইকেলের সামনে কিছু পড়লো । ব্যালান্স হারিয়ে সুমিত রাস্তার ধারে গড়িয়ে পড়লো । খুব বেশি ব্যাথা লাগে নি । কান্নার শব্দে মুখ তুলে সুমিত দেখে, ময়লা কাপড় পরা মৌ’ এর বয়সী একটি ভিখারী মেয়ে বিপদজনকভাবে নালার উপরে ঝুকে কি যেন খুঁজছে । কান্না জড়ানো গলায় বলা কথা মনোযোগ দিয়ে শুনার পর সুমিত কিছু বুঝতে পারলো । খুব কষ্টে এক টুকরো রুটি জোগাড় করতে পেরেছিলো । সাইকেলের ধাক্কায় রুটির টুকরো নালায় পড়ে গেছে । রাতে খাওয়ার মতো কিছু নেই । সুমিতের মনে মৌ-এর মুখ ভেসে উঠলো । সাইকেলের ক্যরিয়ার থেকে সুমিত কেক-এর টুকরো এনে মেয়েটির হাতে দিয়ে বললো, এই মুহূর্তে স্থাপিত হোক সমস্ত উৎপাদন ব্যবস্থার উপর শোষিত শ্রমিকের সমবন্টনের অধিকার । কিছু বুঝতে না পেরে মেয়েটি কান্না থামিয়ে সুমিতের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ।