আবদুল মজিদ
এখন বাজছে একটা।
আর এক ঘণ্টার মধ্যে কি রামদিয়া পৌঁছান যাবে? আমার মনে হয় না। হাসান আলিকে জিজ্ঞেস করলাম, আর কত দূর হাসান আলি?
জানি জবাব দেবে না, তবু জিজ্ঞেস করেছি, কারণ এখান থেকে রামদিয়া কত দূর তা জানে শুধু হাসান আলি। ব্যাটা নবাবের নবাব, কথা জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেবে না। দেব নাকি রাইফেলের বাঁট দিয়ে একটা–?
খিদে যা পেয়েছে, বলবার নয়। মনে হচ্ছে এক গামলা ভাত খেয়ে ফেলতে পারি। সেবার তালুকদার সাহেবের বাসায় জবর খাইয়েছিল। হারামজাদা ভীতুর একশেষ। মুক্তিবাহিনী এসেছে শুনে ভয়ে পেচ্ছাব করে দেবার মতো অবস্থা। আরো ব্যাটা বলদ, তুই কি দালাল নাকি রে? তুই ভয় পাস কী জন্যে? সারাক্ষণ হাত জোড় করে হে হে হে, কী বিশ্ৰী। তবে যাই হোক, খাইয়েছিল জবর। একেবারে এক নম্বর খানা। পোলাওটোলাও রোধে এলাহি কারবার। জিতা রাহ ব্যাটা। কইমাছ ভাজার স্বাদ এখনো মুখে লেগে রয়েছে। আমাদের খাওয়ার কি আর ঠিক-ঠিকানা আছে? এক বার দুদিন শুকনো রুটি খেয়ে থাকতে হল, সে রুটিও পয়সার মাল। আবু ভাই বলেছিলেন, খিদে পেলে শুধু খাওয়ার কথা মনে হয়। মহসিন হলে ফিস্ট হল এক বার। জনে জনে ফুল রোষ্ট। সেই সঙ্গে কাবাব, রেজালা আর দৈ-মিষ্টি। খেয়ে কুল পাই না। এমন অবস্থা। বাবুর্চি রাধত ফার্স্ট ক্লাস।
পায়ের কাটাটা জানান দিচ্ছে। ভাঙা শামুকের এমন ধারা প্রথমে ভাবলাম সাপে কামড়াল বুঝি। বর্ষা-বাদলা হচ্ছে সাপের সীজন। এ অঞ্চলে আবার শামুকভাঙা-কেউটের ছড়াছড়ি। ছোবল মেরে শামুক ভেঙে খায়। রাত-বিরাতে এরকম একটা সাপের গায়ে পা দিতে পারলে মন্দ হয় না। বন্দুক নিয়ে তাহলে এ রকম আর ঘুরে বেড়াতে হয় না। নিরবচ্ছিন্ন শান্তি যাকে বলে।
আমার আর ভালো লাগে না, সত্যি। কী হবে দু-একটা টুশ-টাশ করে? মিলিটারি কমছে কই? বন্যার জলের মতো শুধু বাড়ছে। রাজাকার পয়দা হচ্ছে হুঁ— হুঁ করে। যে অবস্থা, এক-দিন দেখব। আমরা কয় জন ছাড়া সবাই রাজাকার হয়ে বসে আছে। আর হবে নাই-বা কেন? প্ৰাণের ভয় নেই? রাজাকার হলে তাও প্ৰাণটা বাঁচে। তাছাড়া মাসের শেষে বাধা বেতন। লুটপাটের ঢালাও বন্দোবস্ত। দেখেশুনে মনে হয়, দূর শালা রাজাকার হয়ে যাই।
কী আরোল তাবোল ভাবছি। সোহরাব সাহেবের মতো মাথাটাই খারাপ হয়ে গেল নাকি? সোহবার সাহেবকে দেখে কে বলবে, তার মাথাটা পুরো ফরটি-নাইন হয়ে বসে আছে। দিব্যি ভালো মানুষ, মাঝে মাঝে শুধু বলবে, ইস, গুলীটা শেষে কপালেই লাগল।
দু মাস ছিল বেচারা মুক্তিবাহিনীতে। সাহসী বেপরোয়া ছেলে। আমগাছ থেকে একবার মিলিটারি জীপে গ্রেনেড মেরে এক জন আর্টিলারি ক্যাপ্টেনই সাবাড়ি করে দিল। দারুণ ছেলে। এক দিন খবর পাওয়া গেল, কোন বাজারে গিয়ে নাকি ধূমসে দিশী মদ গিলে ভাম হয়ে পড়ে আছে। মদের ঝোঁকে ভেউ ভেউ করে কাঁদছে আর বলছে, হায় হায়, ঠিক কপালে গুলী লেগেছে! আবু ভাইয়ের হুঁকুমে জাফর গিয়ে খুব বানোল। দুই রদ খেয়ে নেশা ছুটে গেল, কিন্তু ঐ কথাগুলি আর গেল না। রাতদিন বলত, ইস কী কাণ্ড, শেষ পর্যন্ত ঠিক কপালে গুলী! ঘুম নেই খাওয়া নেই, শুধু এই বুলি। এখন কোথায় আছে কে জানে? চিকিৎসা হচ্ছে কি ঠিকমতো? আমার যদি এ-রকম হয় তবে তো বিপদের কথা।
দাঁড়ান, সবাই দাঁড়ান।
কে কথা বলে? হাসান আলি নাকি? ব্যাটা আবার হুকুম দিতে শুরু করল কবে থেকে? জায়গাটা ঘুপচি অন্ধকার, চারদিকে বুনো ঝোপঝাড়। পচা গোবরের দম আটকান গন্ধ আসছে। হুমায়ূন ভাই বললেন, কী হয়েছে হাসান আলি?
কিছু হয় নাই।
কী হয়েছে তা নিজ চোখেই দেখতে পেলাম। আনিস লম্বালম্বি পড়ে রয়েছে মাটিতে। এত বড়ো একটা জোয়ান চোখের সামনে আছাড় খেয়ে পড়ে গেল, আমি দেখতেও পেলাম না? কী আশ্চর্য! কী ভাবছিলাম। আমি? হাসান আলি ধরাধরি করে তুলল আনিসকে। কাদায়পানিতে সারা শরীর মাখামাখি। হুমায়ূন ভাই অবাক হয়ে বললেন, কী হয়েছে আনিস?
কি জানি, মাথাটা হঠাৎ ঘুরে উঠল।
দেখি তোমার হাত। আরে, এ যে ভীষণ জ্বর। কখন জ্বর উঠল?
কি জানি কখন।
আসি, আশেপাশের কোনো বাড়িতে তোমাকে রেখে যাই।
আমি হাঁটতে পারব।
পারতে হবে না। মজিদ, তুমি ওর হাতটা ধর।
গায়ে হাত দিয়ে দেখি, সত্যি গা পুড়ে যাচ্ছে। বাটা বলদ, বলবি তো শরীর খারাপ।
হাসান আলি বলল, সামনেই মুক্তার সাহেবের বাড়ি। আসেন, সেই বাড়িতেই উঠি।
জাফর বলল, কত দূর হে সেটা?
কাছেই, এক-পোয়া মাইল। জুম্মাঘরের দক্ষিণে।
হাঁটতে হাঁটতে পা ব্যথা হয়ে যায়; জুম্মাঘরও আসে না, এক-পোয়া মাইলেরও ফুরাবার নাম নেই। যতই জিজ্ঞেস করি, কত দূর হাসান আলি? হাসান আলি বলে, ঐ যে দেখা যায়।
মোক্তার সাহেবের বাড়িটি প্রকাণ্ড। গরিব গ্রামের মধ্যে বাড়ির বিশালত্ব চট মরে চোখে পড়ে। বাড়ির সামনে প্রশস্ত পুকুর। তার চারপাশে সারি–বাধা তালগাছ। আমরা বাড়ির উঠোনে দাঁড়াতেই রাজ্যের কুকুর ঘেউ ঘেউ শুরু করল। কী ঝামেলা রে বাবা! বাড়ির ভেতর থেকে কেউ এক জন পরিত্ৰাহি চেঁচাতে লাগল, আসগর মিয়া, আসগর মিয়া, ও আসগর মিয়া।
জাফর তার স্বাভাবসুলভ। উঁচু গলায় ডাকল, বাড়িতে কে আছেন? দরজা খোলেন।
হঠাৎ করে বাড়ির সব শব্দ থেমে গেল। আর কোনো সাড়াশব্দ নেই। জাফর আবার বলল, ভয় নাই, আমরা মুক্তিবাহিনীর লোক। তাও কোনো সাড়াশব্দ নেই। শেষ পর্যন্ত হাসান আলি বলল, গনি চাচা, আমি হাসান। তখনি খুট করে দরজা খুলে গেল। একটি ভয়-পাওয়া মুখ বেরিয়ে এল হারিকেন হাতে।
হাসান আলির কারবার দেখে গা জ্বলে যায়। তার গলা শুনলে যখন দরজা খুলে দেয়, তখন গলাটা একটু আগে শোনালেই হয়। জাফর বলল, বিরক্ত করলাম, কিছু মনে করবেন না। এই ছেলেটার শোওয়ার বন্দোবস্ত করেন। আমাদের ভাত খাওয়াতে পারবেন?
জ্বি জি, নিশ্চয়ই পারব।
আপনার নাম কি?
গনি। আব্দুল গনি।
ডাক্তার আছে এদিকে?
আছে, হোমিওপ্যাথ।
দুত্তোরি হোমিওপ্যাথ।
গনি সাহেব ছাড়া আরো দু জন লোক জড়ো হয়েছে। তারা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছে। আনিস তোষকহীন একটি চৌকিতে শুয়ে পড়েছে। গনি সাহেব বললেন, কী হয়েছে ওনার? গুলী লেগেছে নাকি?
না। আপনি ভেতরে গিয়ে আমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করেন।
জ্বি জ্বি।
বুড়ো ভদ্রলোক ব্যস্তসমস্ত হয়ে চলে গেলেন। দেখতে–দেখতে বাড়ি জেগে উঠল। কত রকম ধ্বনি শোনা যাচ্ছে–আমিনা আমিনা হারিকোনটা কই?, দূর ধূমসী, ঘুমায় কি!
ভাগ্য ভালো, বাড়িটি এক পাশে। পাড়ার লোক সেই কারণেই ভেঙে পড়ল না। গনি সাহেব একধামা মুড়ি আর গুড দিয়ে গেলেন। বললেন, অল্পক্ষণের মধ্যেই রান্না হবে। আনিসকে তুলতে গিয়ে দেখি সে অচৈতন্য। মুখ দিয়ে ফেনা ভাঙছে।
আনিসের শরীর যে এতটা খারাপ, ধারণা করিনি। নৌকায় ওঠার সময় অবশ্যি এক বার বলেছিল বমি বমি লাগছে। কিন্তু এ রকম অসুস্থ হয়ে পড়বে, কে ভেবেছিল? আনিসটা মেয়েমানুষের মতো চাপা।
দেখতে পাচ্ছি, আনিসকে নিয়ে ব্যস্ততা শুরু হয়েছে। হাসান আলি পানি ঢালছে মাথায়। জাফর প্রবল বেগে হাতের তালুতে গরম তেল মালিশ করছে। বাড়ির কর্তা, মোক্তার সাহেব বিপন্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। এতক্ষণ লক্ষ করি নি পেছন থেকে দেখলে মোক্তার সাহেবকে অনেকটা আমার বাবার মতো দেখায়। ঠিক সে-রকম ভয়াট শরীর, প্রশস্ত কাঁধ! আশ্চর্য মিল!
আনিসের জ্ঞান ফিরল অল্পক্ষণেই এবং সে লজ্জিত হয়ে পড়ল। হুমায়ূন ভাই বললেন, নাও, দুধটা খাও আনিস।
দুধ লাগবে না, দুধ লাগবে না।
আহা খাও।
আনিস বিব্রত মুখে দুধের গ্লাসে চুমুক দিল। আনিসকে কিন্তুতকিমাকার দেখাচ্ছে। তার ভেজা মাথা থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে। সারা শরীরে। মুখময় দাঁড়ি— গোঁফের জঙ্গল। তার মধ্যে সরু একটা নাক ঢাকা পড়ে আছে।
জাফর বলল, আনিস থাক এখানে।
হুমায়ূন ভাই বললেন, নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই।
রাত দুটো বাজতে বেশি দেরি নেই। রামদিয়ায় আমাদের জন্যে টুনু মিয়ার দল অপেক্ষা করছে। হুমায়ূন ভাই বললেন, আনিস, কয়টা বাজে দেখ তো।
একটা পঁয়ত্রিশ।
বল কী!
মোক্তার সাহেব, রামদিয়া কত দূর এখান থেকে?
দূর না। দশ মিনিটের পথ।
হাসান আলি বলল, দুইটার আগে পৌঁছাইয়া দিমু। ভূলেই গিয়েছিলাম যে হাসান আলির মতো এক জন করিৎকর্মী লোক আছে আমাদের সঙ্গে। সে নাকি যা বলে, তাই করে। প্রমাণ তো দেখতেই পাচ্ছি।
বাড়ির ভেতরে রান্নাবান্না শুরু হয়েছে, বুঝতে পারছি। চিকণ গলায় কে এক জন মেয়ে ঘনঘন ডাকছে–ও হালিমা, ও হালিমা। সেইসঙ্গে দমকা হাসির আওয়াজ। একটা উৎসব উৎসব ভাব। বেশ লাগছে।
সেরেছে! আনিস দেখি বমি করছে! ব্যাপার কি? চোখ হয়েছে টকটকে লাল। নিঃশ্বাস পড়ছে ঘনঘন। মরেটরে যাবে না তো আবার? দুক্তোরি, কি শুধু আজেবাজে কথা ভাবছি। বুঝতে পারছি, অতিরিক্ত পরিশ্রম আর মানসিক দুশ্চিন্তায় এ রকম হয়েছে। আজ রাতটা রেস্ট নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। একটি ছেলে পাখা করছে আনিসের মাথায়। খুব বাহারে পাখা দেখি! চারিদিকে রঙিন কাপড়ের ঝালর।
জাফরও শুয়েছে লম্বা হয়ে। জাফরের শোওয়া মানেই ঘুম। ঘুম তার সাধা, কোনোমতে বিছানায় মাথাটি রাখতে পারলেই হল। ভাত রান্না হতে-হাতে সে তার সেকেণ্ড রাউণ্ড ঘুম সেরে ফেলবে। ফার্স্ট রাউণ্ড তো নৌকাতেই সেরেছে। জাফরের ঘুম আবার সুরেলা। ফুরুৎফুরুৎ করে নাক ডাকবে। এই কথা বলেছিলাম বলে এক দিন কী রাগ। মারতে আসে আমাকে। বেশ লোক দেখি তুমি। ফুরুৎ ফুরুৎ করে নাক ডাকতে পারবে, আর আমরা বলতেও পারব না? করলে দোষ নয়, বললে দোষ?
ঠিক আমার বাবার মতো। রাত-দিন কারণ্যে-অকারণে চেঁচাচ্ছেন, আর সেও কি চেঁচানি! রাস্তার মোড় থেকে শুনে লোকে খবর নিতে আসে বাসায় কী হয়েছে। মা এক দিন বিরক্ত হয়ে বললেন, কী রাত –দিন চেঁচাও! অমনি বাবার রাগ ধরে গেল। ঘাড়টাড় ফুলিয়ে বিকট চিৎকার, কী, আমি চেঁচাই?
মা সহজ সুরে বললেন, এখন কী করছ, চেঁচাচ্ছ না?
চুপ রাও। একদম চুপ।
বাবার কথা মনে হলেই এই হাসির কথাটা মনে পড়ে। এমন সব ছেলেমানুষী ছিল তাঁর মধ্যে। এক বার খেয়াল হল, আমাদের সবাইকে নিয়ে বেড়াতে যাবেন সীতাকুণ্ড তাঁর এক বন্ধুর বাড়ি। দুমাস ধরে চলল আয়োজন। বাবার ব্যস্ততার সীমা নেই। যাবার দিন এক ঘণ্টা আগে স্টেশনে নিয়ে গেলেন সবাইকে, আর সে কি চেচনি, এটা ফেলে এসেছি ওটা ফেলে এসেছি। টেন এল, সবাই উঠলাম। পাহাড়প্রমাণ মাল তোলা হল। একসময় টেন ছেড়ে দিল, দেখা গেল বাবা উঠতে পারেন নি। প্ৰাণপণে দৌড়াচ্ছেন। হাতের কাছে যে-কোনো একটা কামরায় উঠে পড়লেই হয়, না–তা উঠবেন না। আমরা যে কামরায় উঠেছি, ঠিক সে-কামরায় ওঠা চাই। এক সময় দেখলাম, বাবা হোঁচট খেয়ে পড়েছেন। হুস-হুস করে তাঁর চোখের সামনে দিয়ে টেন চলে যাচ্ছে। আচ্ছা, মৃত মানুষরা কি মানুষের মনের কথা টের পায়? যদি পায়, তা হলে বাবা নিশ্চয়ই আমি কী ভাবছি বুঝতে পারছেন? আচ্ছা ধরা যাক, একটি লোককে সবাই মিলে ফাঁসি দিচ্ছে–তাহলে সেই হতভাগ্য লোকটির চোখে-মুখে কী ফুটে উঠবে? হতাশা, ঘৃণা, ভয়… আমা: মাথাটাই খারাপ হয়ে গেল নাকি? নয়তো এ রকম অর্থহীন চিন্তা কেউ করে? ও কি, আনিস আবার বমি করছে নাকি? জোর করে দুধটা না খাওয়ালেই হত!
মোক্তার সাহেব এসে চুপি চুপি কী বলছেন হুমায়ূন ভাইকে। কে জানে, এর মধ্যেই কী এমন গোপনীয় কথা তৈরী হয়েছে যা কানের কাছে মুখ নিয়ে বলতে হবে! আরে আরে, এই ব্যাপার! এটা আবার কানাকানি বলতে হবে নাকি? বলে হয়, ভাত দেয়া হয়েছে, খেতে আসেন। যত বেকুবের দল।
হাসান আলি বলল, তাড়াতাড়ি করেন, সময় নাই! মাতব্বর কোথাকার সময় নেই–সেটা তোর কাছে জানতে হবে নাকি?
খেতে বসে দেখি খিদে মরে গেছে। তরকারিতে লবণ হয়েছে বেশি হয়েছে, কাদার মতো নরম। চিবাতে হয় না, কৌৎ কোৎ করে গিলে ফেলা যায়, ভালো হল না মোটেই! জাফর বলল, হুঁ নোজ, দিস মে বি আওয়ার লাস্ট মিল। কথায় কথায় ইংরেজি বলা জাফরের স্বভাব। তার ধরন ধারণাও ইংরেজের মলে এই মহা দুর্যোগেও ভোরবেলা উঠেই তার শেভ করা চাই। দুপুরে সাবান মে মেখে গোসল সারা চাই। দিনের মধ্যে দশ বার চিরুনির ব্যবহার হচ্ছে। রূপ যাদের আছে, তারাই রূপ-সচেতন হয়। এবং এত উলঙ্গভাবে হয়, যে বড়ো চোখে লাগে।
আমাদের পাশের বাড়ির রেহানা দশ–এগারো বছর বয়স পর্যন্ত কী চমৎকার মেয়েই না ছিল, কিন্তু যেই তার বয়স তেরো পেরিয়ে গেল, যেই সে বুঝল তার চোখ ধাঁধান রূপ আছে, অমনি সে বদলে গেল। আহাদী ধরনের টেনে টেনে কথা বলা–ম-জি—দ ভা-ই, ঘন ঘন ভ্রূ কোঁচকান। জঘন্য, জঘন্য!
হুমায়ূন ভাই বোধহয় কোনো একটা রসিকতা করলেন। ভ্যাক ভ্যাক করে হাসছে সবাই। আমি অন্যমনস্ক ছিলাম বলে শুনতে পাই নি। এখন সবাই হাসছে, আমি মুখ কালো করে বসে আছি। নিশ্চয়ই বোকা— বোকা লাগছে আমাকে। কে জানে, রসিকতাটা হয়তো আমাকে নিয়েই। সবাই যে-ভাবে তাকাচ্ছে আমার দিকে, তাতে তাই মনে হয়। ও কি, হাসান আলিও হাসছে দেখি।
হাসো বাবা, হাসো। যত ইচ্ছে হাস। কিছুক্ষণ পরই যখন বমবাম করে মটারের শেল ভাঙা শুরু হবে, তখন এত রস আর থাকবে না। কাজেই এই-ই হচ্ছে গোল্ডেন আওয়ার।
পান আনব। পান খাবেন?
জিজ্ঞেস করল কে যেন। আমি মাথা নাড়লাম। পানটান লাগবে না রে বাবা। বিনা পানেই চলবে। মুড নেই। পান, সিগারেট, চা–এসব হচ্ছে মুডের ব্যাপার; মুড না থাকলে বিষের মতো লাগে।
হুমায়ূন ভাই বললেন, আমরা রওনা হচ্ছি। আনিস, তুমি থাক। ফেরবার পথে তোমাকে নিয়ে যাব। তিনি তাহলে ফেরবার চিন্তাও করছেন! ভুলে গেছেন নাকি, মেথিকান্দা মুক্তিবাহিনীর মৃত্যুকূপ। আজ যাত্রা থেকেই অলক্ষণ শুরু হয়েছে। নৌকাও ছাড়ল, বৃষ্টিও নামল। হুমায়ূন ভাই একটা প্রচণ্ড উপকাঁপাত দেখলেন। আনিস হয়ে পড়ল অসুস্থ। শেষটায় কী হবে কে জানে?
বড়ো অস্থির লাগছে। ইয়া মুকাদেমু, ইয়া মুকাদেমু, ইয়া মুকাদেমু-কে যেন বলেছিল যুদ্ধের সময় এই হচ্ছে সবচেয়ে ভালো দোওয়া–যার অর্থ হে অগুসরকারী। এই তোয়া পড়ে শুধু এগিয়ে যাওয়া!
না, বড়ো খারাপ লাগছে। ভালোয় ভালোয় ফিরে এলে আর যাব না। সম্ভব হলে ফিরে যাব মৈমনসিংহ। কিন্তু গিয়ে করবটা কী? মা কোথায় আছেন কে জানে? বাবা বেচারা মরে বেচেছেন। কোনো দায়দায়িত্ব নেই। কিন্তু আমিই—বা কোন দায়িত্ববান সুপুত্রটি? বাবাকে ধরে নিয়ে গেল মিলিটারি, আমিও এলাম পালিয়ে, অথচ নিশ্চিত জানি মায়ের কোনো সহায়-সম্বল নেই। বোনগুলি বোকার বেহদ। ফিরে গিয়ে হয়তো দেখব অল কোয়ায়েট অন দি ওয়েস্টার্ণ ফ্রন্ট। কেউ নেই, সব সাফ হয়ে গেছে। মন্দ হয় না খুব। বাঁধা-বন্ধনহীন বল্লাহারা জীবন। কী আনন্দ!
অবশ্যি এমনও হতে পারে দেশ স্বাধীন হবে। আমি মৈমনসিংহ ফিরে যাব। বাবাকে হয়তো তারা প্ৰাণে মাঠে নি। তিনি জেল থেকে বেরিয়ে আসবেন! আবার আমরা সীতাকুণ্ড যাব। পাহাড়প্রমাণ জিনিসপত্র তোলা হবে ট্রেনে। একসময় ট্রেন ছেড়ে দেবে, দেখব বাবা প্ৰাণপণে দৌড়াচ্ছেন। আহ, চোখে জল আসে কেন?
মোক্তার সাহেব, দোওয়া রাখবেন। খোদা হাফেজ, আনিস।
খোদা হাফেজ। খোদা হাফেজ।