Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » শ্বেত পাথরের থালা || Bani Basu » Page 7

শ্বেত পাথরের থালা || Bani Basu

এ কে বি বলেছিলেন গ্রীষ্মের ছুটিতে নিয়ম করে সপ্তাহে একদিন ওঁর বাড়ি যেতে। শ্রীলাকে আর ওকে। অনুরাধারা বলল—‘দারুণ লাকি তুই কলি, এ কে বি যেসব নোট্‌স্ দেবেন, সাজেশান দেবেন সেগুলো কিন্তু আমাদের সঙ্গে শেয়ার করে নিতে হবে।’

কলি হাসিমুখে বলল—‘দাঁড়া আগে যাই! গ্রীষ্মের ছুটিতে বেরোতে হলে বাবার অনুমতি নিতে হবে। সে এক মহা ফ্যাচাং।’

কথাটা শুনে বাবা চশমার ফাঁক দিয়ে চেয়ে দেখলেন, বললেন—‘বয়স কত?’

কলি থতমত খেয়ে বলল—‘কুড়ি বছর পেরিয়ে গেছে, প্রায় একুশ-হতে চলল।’

—‘কুড়ি বছরের ছোকরা তোমাদের পড়ায়?’ বাবা ভুরু কুঁচকে বললেন—‘কতবার ডবল পোমোশন পেয়েছে? দ্বিতীয় স্যার হরিনাথ নাকি?’

তখন কলি বুঝল, বাবা এ কে বির বয়সের কথা জিজ্ঞেস করছেন। বলল—‘ও, মানে পঞ্চাশ, টঞ্চাশ হবে। আমি কি করে বলব?’

—‘বিবাহিত?’

—‘হ্যাঁ।’ কলি এবার খুব অপমানিত বোধ করছে।

—‘ছেলেপিলে কটি?’

—‘জানি না, ওঁর মেয়ে আমাদের সঙ্গে পড়ে।’

—‘অ, তা যাবে যাও। তবে অত দিগ্‌গজ হয়ে কি হবে?’

আর শোনবার দরকার ছিল না। কলি জামা-কাপড় বদলাতে ছুট্টে চলে গেল।

বৈঠকখানা রোডে থাকেন এ কে বি। দোতলায় উঠে একটা মস্ত ঘর। আপাদমস্তক বইয়ে ঠাসা। শ্রীলা যথারীতি আসেনি। মাস্টারমশাইরা ভালো ছাত্রী বলে তাকে সাহায্য করতে চাইলে কি হবে, শ্রীলার ওসব ভালো লাগে না, বলে—‘ধুৎ, এই কাঠফাটা গরমে আমি রাস্তায় বেরোই আর কি? তার চেয়ে পাখার তলায় একটা জমজমাট গল্পের বই নিয়ে শুলে আখেরে কাজ দেবে।’

শ্ৰীলা নেই দেখে এ কে বি একটু নিরাশ হলেন। বললেন—‘কন্যাটি বড়ই ফাঁকিবাজ। ঠিক আমার কন্যাটির মতোই। সামান্য একটু গাইড্যান্স পেলেই ফার্স্ট ক্লাসটা হয়ে যেত।’ কলির বুকের মধ্যে চমকে ওঠে—পরিমল ঢুকছে। এ কে বি বললেন ‘এসো, এসো।’ স্যারের মেয়ে অরুন্ধতীও এসে বসল অবশ্য।

এ কে বি বললেন—‘দেখ বৎস এবং বৎসাগণ আমার তিন রকম আলাদা আলাদা স্ট্যান্ডার্ডের নোটস আছে। ছাত্র-ছাত্রীর ধারণ ক্ষমতা বুঝে আমি তা দিয়ে থাকি। উপস্থিত আসরে অরুন্ধতী যেমন বি গ্রেডের নোটস পাবার অধিকারী। কিন্তু আমার নিজস্ব কন্যা বলে তাকে কিঞ্চিৎ কডা জিনিস গলাধঃকরণ করতেই হবে।

অরুন্ধতী ঠোঁট গোল করে বলল—‘কে চেয়েছে তোমার এ গ্রেডের নোটস। আমাকে বি গ্রেডই দাও না।’

—‘না, না, না, না।’ এ কে বি মাথা নাড়লেন—‘অত সহজে তুমি পার পাবে না বৎসে। তোমাকে এই ভারি এবং কড়া জিনিসই গ্রহণ করতে হবে। ইহাই তোমার নিয়তি।’

পরিমল হাসছিল, বলল—‘স্যার, তফাতটা কি দেখতে পারি?’

এ কে বি তার কথায় কান না দিয়ে বললেন—‘সি গ্রেড সর্বসাধারণের জন্য, বি গ্রেড, ভাষাজ্ঞান আছে অথচ কনসেপশন নেই এমত ছাত্রকুলের জন্য, এবং বলা বাহুল্য এ গ্রেড—উচ্চাকাঙ্ক্ষী, পরিশ্রমী ও বুদ্ধিমান ছাত্রদের জন্য। কিন্তু একটা কথা, এই নোট্‌স বন্ধুদের মধ্যে বিতরণের জন্য নয়।’

কলির মনে পড়ল অনুরাধার দাবির কথা। এ কে বি তখনও বলছেন—‘কেন, সেকথা আমি আগেই বলেছি, সবাইকার হজমশক্তি এক রকমের নয়। সুতরাং বৎসগণ, সাবধান।’

পরিমলের হাতে একগোছা টাইপকরা কাগজ তুলে দিয়ে এ কে বি চলে গেলেন। পরিমল বলে যাবে, অন্যরা লিখবে, কলিকে কার্বন কপি করতে হচ্ছে। কার্বন কপিটা পরিমল পাবে।

বিকেল তিনটে সাড়ে তিনটে নাগাদ স্যার এসে তলায় দাগ দেওয়া জায়গাগুলো ব্যাখ্যা করে দিলেন। কলি এবং পরিমলকে দুটি বই দিলেন, সেদিনের মতো অধিবেশন শেষ হল।

বই ব্যাগে পুরে দুরুদুরু বুকে কলি উঠে দাঁড়াল। এবার অরুন্ধতী বাড়ির ভেতরে চলে যাবে, স্যার সিঁড়ির মুখ পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে চলে যাবেন। রাস্তায় বেরোবে সে একা পরিমলের সঙ্গে। এরকম পরিস্থিতিতে ভট্টাচার্য- বাড়ির মেয়েরা বোধহয় কোনদিন পড়েনি। রাস্তায় বেরিয়ে সে মুখ নিচু করে নিজের বাড়ির দিকে হাঁটা দিল। পেছন থেকে পরিমল ডাকল—‘শুনুন।’

কলি দাঁড়িয়ে পড়ল, তেমনি পেছন ফিরে। পরিমল বলল—‘আমার ভাগের নোটসগুলো তো দিলেন না!’

—‘ওঃ, ভীষণ ভুল হয়ে গেছে!’ কলি লাল হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি ব্যাগ থেকে সে কার্বন কপিটা বার করল।

—‘আপনি আচ্ছা স্বার্থপর তো!’ পরিমলের গলায় হাসি, —‘অতক্ষণ গোটা নোটটা ডিকটেট করলাম, পুরস্কার স্বরূপও অরিজিন্যালটা পেতে পারি না?’

কলি থতমত খেয়ে গেছে, তাড়াতাড়ি তার হাতের লেখা কপিটা বার করল, আবার। সেটা নিয়ে পরিমল বলল—‘যাক, আপনার হাতের লেখাটা আমার পাওয়া হয়ে গেল। এমনি চাইলে তো আর দিতেন না!’

কলি বলল—‘আমার হাতের লেখা? হাতের লেখা কি হবে? কি করবেন?’ ভীষণ উদ্বিগ্ন তার গলার স্বর, হৃৎকম্প হচ্ছে বোঝাই যাচ্ছে।

—‘যাক গলার স্বরটা ভালো করে শোনা গেল। এই সুবাদে।’ পরিমল বলল ‘হাতের লেখা নিয়ে আর কি করব। হাতের লেখা তো আর খাবার জিনিস নয়! থাকবে আমার ফাইলে, ভালো লাগবে আমার।’

কলি চট করে মুখ তুলে তাকাল, অনুরাধাদের ঠাট্টা-তামাসার কথা মনে পড়ল, তারপর পর পর বাবার মুখ আর সেজদার মুখ। সে হঠাৎ শরীরে তীব্র মোচড় দিয়ে উল্টো দিকে ঘুরল, দৌড়নো সম্ভব নয়। সম্ভব হলে সে দৌড়েই সেখান থেকে চম্পট দিত।

সিংদরজা পেরোলেই বাঁ দিকে বৈঠকখানা, ডানদিকে বাবার সেরেস্তা ঘর। বাবা আজকাল কোর্টে বেরোনো কমিয়ে দিয়েছেন। কলি শুনতে পেল বৈঠকখানায় বাবার বন্ধু হরিহরকাকুর গলা।—‘কি হে কাশীনাথ, আজ তোমার চালে তেমন ফোঁস নেই কেন? বলি পরশুদিনের শোধ নেবে না?’

কাশীনাথ বললেন—‘আমি কি তোমার মতন ক্যাছাখোলা নাকি? দস্তুরমত সংসারী মানুষ। বিষয়-চিন্তা আছে, ছেলেপুলেদের ভবিষ্যৎ চিন্তা আছে।’

কলি আর দাঁড়াল না। তাড়াতাড়ি প্যাসেজ পেরিয়ে উঠোনের দিকে পা চালাল।

বাবার কানে চটির শব্দ ঠিক পৌঁছেছে। চেঁচিয়ে বললেন—‘কে এলি? কলি? এতো দেরি?’

—‘হ্যাঁ বাবা,’ কলির জবাব দূর থেকে এল। এখন বাবার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার সাহস নেই তার। এখনও মুখ লাল, বুকে গুরগুর শব্দ, চোখ ছলছল করছে। বাবার বন্ধু-বান্ধবের সামনে উকিলি জেরার মুখোমুখি হওয়া এখনই সম্ভব নয়।

দাবার নেশার চেয়ে আড্ডার ঝোঁকই কাশীনাথবাবুর বেশি। রবিবারের আড্ডা জোর আড্ডা। অন্যান্য দিন বিকেলের দিকে দু একজন উঁকি দ্যান। যদি যথেষ্ট বন্ধুসমাগম হয় তো দাবার ছক পড়ে। এবং ফাঁকে ফাঁকে গল্পগাছা করতে করতে হঠাৎ বিনা আড়ম্বরে একজন কারুর কিস্তি মাৎ হয়ে যায়।

কাশীনাথবাবুর গলায় গলায় বন্ধু তারাপদবাবু এক টিপ নস্য নিয়ে বললেন—‘একটা জিনিস খুব অন্যায় করছ হে কাশী।’

—‘কি অন্যায় আবার করলুম হে!’

—‘মেজছেলের বিয়েটা দাও! যদ্দুর জানি তোমার বড় মেয়ের কোলে চারটি পর পর ছেলে। বড়র পরই মেজ, তার বয়স তো গড়াচ্ছে!’

—‘বড় মেয়ে আমার খোকার পরে’—কাশীনাথবাবু বললেন—‘মেজর সঙ্গে বড়র বছর ছয়েকের তফাত।’

তারাপদবাবু বললেন—‘তা হলেও তোমার মেজছেলের বিয়ের বয়স হয়েছে স্বীকার করবে তো! এভাবে চললে ছেলে যে তোমার বিবাগী হয়ে যাবে! একজনকে একভাবে হারালে আরেকজনকে যে অন্যভাবে…না, না কাশীনাথ শোক পুষে রাখাটা ঠিক নয়। ওতে সংসারের স্বাস্থ্যহানি হয়। দেখো, যে গেছে সে তো আচ্ছা করে বুকে দুরমুশ পিটেই গেছে। কিন্তু তুমি-আমি যদি সেইটি নিয়েই বাকি জীবন মনমরা হয়ে বসে থাকি তো জীবনের ধর্মকে উপেক্ষা করা হয় হে, জীবন তখন তোমার ওপরে শোধ নেবে। আমার কেসটা থেকেই শিক্ষা নাও না! কোলের ছেলেটি গেল। গিন্নি এমন শোকার্ত হয়ে পড়লেন যে আর বিছানা থেকে উঠতে পারেন না। পাগল-পাগল ভাব। অগত্যা রাণু আমার বড় মেয়ে সংসারের হাল ধরল। বাকি ভাইবোনগুলিকে পড়ানো, শোনানো, আমাদের যত্ন-আত্তি, রুগীর সেবা, মেয়েটার হাড় কালি হয়ে গেল ভায়া। সদাসর্বদা মুখ শুকনো, অল্পবয়সেই যেন সাত গিন্নির এক গিন্নি এমনি চেহারা, এমনি কথাবার্তা। কি বলব কাশী, মেয়েটার বিয়ে দিতে পারলুম না। যেই দেখে বলে এ যে আদ্যিকালের বদ্যিবুড়ি, বয়স লুকুচ্ছেন! মেজ-সেজর বিয়ে হয়ে গেল। ছেলেটার পর্যন্ত দেখেশুনে লাগিয়ে দিলুম। এখন সেই বউয়ে আর তার বড় ননদে বাড়িতে ধুন্ধুমার লেগে আছে। কাক-চিল বসতে পায় না এমনি গলার জোর। গিন্নি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকেন, মাঝে মাঝে বলেন—কি গো এর একটা বিহিত করো, আমি যে আর পারি না। আমি বলি— বিহিত এর হবে না গিন্নি। এ তো তোমারই কীর্তি। একজনের শোক আঁকড়ে রইলে, আরেকটা সন্তান যে জ্যান্ত মরে গেল খেয়াল করলে না। জীবন এইভাবে শোধ নেয় ভায়া। ছাড়ান ছুড়িন নেই।’

কাশীনাথবাবু নিঃশ্বাস ফেলে বললেন—‘কথাটা ঠিকই বলেছ। আমার যে কতদিকে কত জ্বালা। ভাবছিলুম আর ক’টা দিন যাক। বড় বউমা বড্ড মনমরা হয়ে থাকেন, তাঁর চোখের ওপর দিয়ে…’

—‘থাকবে না, মনমরা থাকবে না।’ অচিন্ত্যবাবু বললেন,—‘বাড়িতে একটা উৎসব লেগে গেলে দেখবে ঠিক মেঘ কেটে যাবে।’

—‘তা যাবে কি না জানি না ভায়া। তবে কথা আরও একটা আছে। আমার ছোট মেয়ে ডাগর হয়ে উঠল। খুব পা হয়েছে। এখানে যাচ্ছে, সেখানে যাচ্ছে, —‘বাবা আসি,’ ‘বাবা যাই?’ বললেই কি হয় রে ভাই। আমার অবস্থায়, আমার বয়সে ভাবতে হয় কোথায় যাচ্ছে। কেন যাচ্ছে। ওর বিয়েটা এবার দেওয়া দরকার।’

তারাপদবাবু বললেন—‘ভালো তো! পাঁজি পুঁথি দেখে দুজনের মাথাই একদিনে মুড়িয়ে দাও। এক লক্ষ্মী যাবে তো আরেক লক্ষ্মী আসবে।’ গলা খাটো করে তারাপদবাবু বললেন—‘তা ছাড়াও, তোমার মেয়ের বিয়ের খরচাপাতি উঠবে কি করে যদি ছেলেরটা আগে না দাও।’

—‘সেটা একটা কথা বটে। খোকাটা দুম করে চলে গিয়ে আমাকে বসিয়ে দিয়ে গেছে। অমন সা-জোয়ান রোজগেরে সন্তান। দেখো দিকিনি এই বৃদ্ধ বয়সে কোথায় আরাম করব পায়ের ওপর পা তুলে, তা না ছেলের বউ, তার ছেলে সব দায়িত্ব আমার ঘাড়ে।’ কাশীনাথবাবুর গলা ভারি হয়ে এল।

বন্ধুদের সঙ্গে এই কথাবার্তার জের টেনেই পরদিন দুপুরে গিন্নির কাছে কথাটা পাড়লেন কাশীনাথ।

—‘একবছর তো কবেই পার হয়ে গেছে, এবার মেজর বিয়েটা না দিলে কর্তব্য অবহেলা করা হয়।’

গৃহিণী বললেন—‘এ কথা তো একশবার। তার উপর গাবলুর বোম্বাইয়ে ট্রান্সফার হবার কথা হচ্ছে। সঙ্গে বউ না দিলে তো আতান্তরে পড়বে! কিন্তু আমার দুটো কথা বলবার আছে।’

—‘বলো না কি বলবে!’

—‘এক নম্বর তুমি আগে পাত্রীর করকোষ্ঠী দেখাবে। ওসব জাল, ভুয়ো, বিয়ের জন্যে আগে থেকে তৈরি করানো ঠিকুজি নয়। জন্মসময় চেয়ে নিয়ে আমাদের নিজেদের লোক দিয়ে আমরা করিয়ে নেবো।’

—‘কেন বলো তো! খোকার বেলা তো তুমি এতো ঠিকুজি-ঠিকুজি করোনি?’ গৃহিণী ডিবে থেকে পানের বোঁটায় করে একটু চুন জিভের ডগায় ছুঁইয়ে বললেন—‘সেটাই তো কথা! ঠিকুজি দেখিনি, ভুল করেছি, ও ভুলের চারা নেই। তা নয়ত কোথাও কিছু নেই অমন জ্বলজ্যান্ত ছেলেটা দুম করে চলে যায়! সেদিন কথায় কথায় বউমার হাতখানা সোজা করে ধরেছিলুম, পষ্ট বৈধব্য রেখা! ওসব মেয়েছেলের কপালে হয় গো, কপালে হয়।’

—‘তুমি আবার এসব দেখতে জানলে কবে?’

—‘আরে বাবা, জানতে হয়! মায়ের প্রাণ, ও তুমি বুঝবে না। খোকা গিয়ে থেকে আমি ওর ঠিকুজি নিয়ে গুরুদেবের কাছে ছোটাছুটি করছি। খোকার আশি-একাশি পর্যন্ত পরিষ্কার আয়ু। অপঘাত নেই, আঘাত নেই, কিচ্ছু নেই। গুরুদেবের কাছ থেকেই রেখা-টেখা দেখতে চিনতে শিখছি। আমার বিদ্যেতে ওইটুকু ধরা পড়ল। তারপর জানি না। বউটারই কি কম খোয়ার হল ভাগ্যের হাতে। আহা এই বয়সে…’ গৃহিণী উদাস হয়ে গেলেন। একটু পরে বললেন—‘এবার আগে ঠিকুজি, পরে কথাবার্তা। রূপ গুণ ওসব কিছু নয়, স-ব সংসারে মানিয়ে যায়। বড়র তো রূপ মন্দ ছিল না, সে ধুয়ে কি এখন জল খাচ্ছি। আর নগদ দান সামগ্রী নিয়ে তুমি অমন কচলাকচলি করবে নাকো। কোষ্ঠী যেখানে মিলবে, সেখানেই বিয়ে হবে, এই আমার শেষ কথা।’

—‘নগদ না নিলে তোমার ঘরখরচাই উঠবে কোত্থেকে আর মেয়েটা যে গড়গড়িয়ে এম এ পাশ করতে চলেছে তার বিয়েরই বা কি করবে?’

—‘নেবে না তা তো বলিনি। বলেছি কচলাকচলি চলবে না। তারা যা দিতে পারবে তাই নিতে হবে। আর মেয়ের বিয়ে আমি ছেলের দানসামগ্রী, বরপণ দিয়ে দেবো এমন হা-ঘরে আমাকে পাওনি বাপু। তোমাদের ভট্‌চায্যিদের সে রীত হতে পারে, আদতে চাল-কলার বামুন তো! আমরা মুখুটি। আচায্যি বংশ।’

—কাশীনাথবাবু বললেন—‘এই শুরু হল। তুমি থামাবে এই আমরা আর তোমরার পাঁচালি?’

গিন্নি বললেন—‘তুমি না হয় যা রোজগার করছ সংসারে ঢালছ। ইনসিওরের প্রিমিয়াম দিচ্ছ, কিন্তু আমার সোনার চাঁদ ছেলে? সে তো কিছু কম রোজগার করেনি। আহা সে তো সবটাই তোমার হাতে তুলে দিয়ে গেছে সেই থেকে খরচা করবে।’

কাশীনাথ গম্ভীর গলায় বললেন—‘বউমা তো তাঁর টাকা আলাদা অ্যাকাউন্ট করেছেন। সে পাসবইও তাঁর কাছে। তোমার অংশেরটুকু আমার কাছে আছে এই পর্যন্ত। তা দিয়ে আজকালকার দিনে একটা মেয়ের বিয়ে হয় না।’

গৃহিণী মেঝেতে মাদুর পেতে আধশোয়া হয়ে ছিলেন, উঠে বসলেন —‘বউমার আলাদা ব্যাঙ্ক? বলো কি গো? আগে বলোনি তো?’

কাশীনাথ বললেন—‘এসব গুহ্য কথা। মেয়েমানুষের কানে তোলা মূর্খামি। কথা উঠল তাই বললুম।’

গৃহিণী বললেন—‘দাদার টাকা যদি বোনের বিয়েতে লাগে তো সে তো খুব ভালো কথা, সে আমি বউমাকে বলে ঠিক বার করে নেবোখন। তুমি ছেলের পাত্রী আর মেয়ের পাত্র এক সঙ্গেই দেখ। বউমা কলিকে খুব ভালোবাসে।’

—‘দেখ কদ্দুর কি করতে পারো। আমার তো মনে হয় না বউমা দেবেন। চাইতে গিয়ে ছোট না হতে হয়।’

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress