Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » শ্বেত পাথরের থালা || Bani Basu » Page 5

শ্বেত পাথরের থালা || Bani Basu

কলি আর মিলি, কলিকা আর মল্লিকা দুইজাঠতুতো, খুড়তুত বোন। দুজনের অবস্থার এবং চরিত্রের একটা আপাত-মিল থাকলেও, আসলে কিন্তু সূক্ষ্ম কতকগুলো তফাত আছে। মল্লিকা মাত্রই এক সন্তান, দাদা ছেড়ে তার আর কোনও বোনও নেই সহোদর। তার আবদার পূর্ণ হবে না এমন হতে পারে না। বাড়ির নিয়ম মেনে মিলি যা খুশি চাইতে পারে, যা খুশি করতে পারে। কোনও বাধা নেই। টেস্ট ক্রিকেটের সীজন-টিকিট, গ্র্যান্ড-এ গিয়ে বিদেশী খেলোয়াড়দের অটোগ্রাফ নিয়ে আসা, ক্রিকেট-পাগলদের সঙ্গে পত্র-মিতালি। এমনকি বাবাকে সঙ্গে নিয়ে পলি উমরিগরের সঙ্গে পার্ক স্ট্রিটের রেস্তোরাঁয় কফি খাওয়া এবং তাঁর স্বাক্ষরিত ফটোগ্রাফ জোগাড় করা, এ সমস্তই মিলি তার ইচ্ছেমত করে থাকে। বাবা মা তাকে কিছুতে বাধা দেন না, চাঁদটা নেহাত পেড়ে দেওয়া যায় না, তাই। তবে জ্যাঠাইমার প্রবল প্রতাপ এবং জ্যাঠামশাইয়ের ব্যক্তিত্বের কাছে তার বাবা-মাকে খানিকটা নমনীয় হয়ে থাকতেই হয়। প্লেয়ারদের বাড়িতে ডেকে ভাই-ফোঁটা দেবার ইচ্ছেটা যেমন তার পূর্ণ হয়নি। পত্র-মিতালির চিঠিগুলোও সব জ্যাঠামশাইয়ের হাত-ফেরত হয়ে আসে। জ্যাঠাইমা মায়ের কথাবার্তায়, মতামতে সায় দিয়ে সাউখুরি করাও মিলির একটা তোষামুদে অভ্যাস। এ ভাবে সে জ্যাঠাইমার নেকনজরে থাকবার চেষ্টা করে, নিজের অজান্তেই। যেহেতু মা- বাবার তাকে অদেয় কিছু নেই, তাই তারও যে অন্যদের কিছু দেয় আছে, এখনও পর্যন্ত মিলি সে কথাটা শেখেনি। পরে কি হবে বলা যায় না। তবে তার চেয়ে দু বছরের বড় দিদি কলির তার ওপর বেশ প্রভাব আছে।

কলিও কম আদরের নয়। বড়দি কণিকার বিয়ে হয়ে গেছে বহুকাল, বড়দি থাকেও দূরে, মাদ্রাজে। আসা-যাওয়া খুব কম। চার ভাইয়ের কোলে এক বোন। সেজভাই আবার নিজের মতে ক্রিশ্চান বিয়ে করার অপরাধে বাড়ি থেকে বহিষ্কৃত। তার এবং তার পরিবারের সঙ্গে এ বাড়ির কোনও সম্পর্কই নেই। তার ওপর বড়দা মারা গেছেন হঠাৎ। সবচেয়ে ছোট কলি। তার বাবা মা বলেন বাড়িতে মেয়ে না থাকলে মানায় না। ওরা দুই বোন থাকায় বাড়ির শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে। দুদিকে দুটো বেণী ঝুলিয়ে, ধনেখালি ডুরে শাড়ির আঁচল কোমরে জড়িয়ে কপালে কুমকুমের টিপ দিয়ে দুই বোন বাবা-মা-কাকা-কাকী-দাদাদের চোখের সামনে ঘুরে বেড়ায় দুটো গাঁদা ফুলের তোড়ার মতো। কিন্তু কলির জীবনে শোকের কীট প্রবেশ করেছে। মিলির মতো নির্ভেজাল হাসি-খুশিতে ডগোমগো হয়ে থাকা আর যেন তার আসে না। এক একটা অভিজ্ঞতা তার কিশোরী জীবনে প্রবেশ করে আর তাকে একটু একটু করে বদলে দিয়ে যায়। মিলির থেকে মাত্র দু বছরের বড় হলেও খেলার খবর, সিনেমার পাতা আর অনুরোধের আসরের কাল সে যেন কবেই কাটিয়ে এসেছে। কলির জীবনের প্রথম দুঃখ তার সেজদার বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া। সেজদা লেখাপড়া মন দিয়ে করত না, গান-বাজনা করত, হোটেলে যারা গান-টান গায় তাদের সঙ্গে মিশত। পিয়ানো অ্যাকর্ডিয়ন বাজাত দারুণ সুন্দর। একদম শ্যামবাজারের বাড়ির মতো নয়। কলির জীবনে বৈচিত্র্যের স্বাদ এই সেজদাই এনে দিত। খুব ভাব ছিল তাই। সেজদা মজাদার খাবার জিনিস নিয়ে আসত। বীফ কাবাব, হ্যাম স্যান্ডউইচ। ছাদে গিয়ে দুজনে খেতো। মিলিকে ডাকত না। মিলি একটু লাগানে ভাঙানে স্বভাবের আছে। পেট-আলগা। মায়ের সঙ্গে রোজ রাত্রে শুয়ে শুয়ে ওর গল্প হয়। কোন ছেলে ওর দিকে চেয়ে শিস দিয়েছিল, কবে কে বাসে গা ঘেঁসে বিশ্রীভাবে দাঁড়িয়েছিল—এসব লজ্জার কথাও অনায়াসে মাকে বলে দিতে পারে। বীফ কাবাব, হ্যাম স্যান্ডউইচের কথা ওর পেটে থাকবে না। সেজদা বেচারি নিপাট ভালোমানুষ এক অঙ্কের দিদিমণিকে বিয়ে করল চুপিচুপি। মীরা ইসাবেলা মণ্ডল। প্রথম কলিকেই জানিয়েছিল, কলির সঙ্গেই আলাপ করিয়ে দিয়েছিল একদিন সিনেমা দেখাতে গিয়ে। কে বলবে ক্রিশ্চান। রঙ ময়লা, মিষ্টি মুখ, ঠিক যেন কলির এক দিদি। এতগুলো দাদা আর ওই আহ্লাদি বোন না থেকে এরকম একটা দিদি যদি থাকত তো কাজ দিত। বোনের আদুরেপনা আর বোকামি, দাদাদের খুনসুটি একেক সময় অসহ্য মনে হয় তার। কলি বলেছিল—‘বল না সেজদা, বাড়িতে বলেই দ্যাখ না।’

সেজদা উদাস হয়ে বলেছিল—‘নাথিং ডুয়িং। হোটেলঅলা ওল্ড ম্যান জানতে পারলে, এখুনি আমাকে খড়ম পেটা করে তাড়াবে।’

—‘মা? মা নিশ্চয় বাবাকে বোঝাবে!’

—‘মা? ওরেব্বাবা! সুন্দরবনের রয়্যাল বেঙ্গল টাইগ্রেস। মোর ফেরোসাস দ্যান বস্। তার অমতে বাড়িতে বউ আসবে, আবার ক্রিশ্চান, আবার ছোট জাত! তুই কি পাগল হয়েছিস কলি? একটু গুছিয়ে নিই, একটা বড় হোটেলে কাজ পাবার কথা হচ্ছে। তখন জানিয়ে কেটে পড়ব। তুই মাঝে মাঝে চলে যাবি। ঠিকানাটা তোকে জানিয়ে যাব।’

ঠিকানা জানিয়ে যাওয়া কিন্তু সেজদার আদৌ হয়নি। বেচারি এক রাত্তিরে খবরটা জানিয়েছিল, খাওয়া-দাওয়ার পর, বাবার সেরেস্তায় গিয়ে, বজ্রাহত কাশীনাথ ভট্টাচার্য তাকে সেই মুহূর্তে বাড়ি থেকে বার করে দেন। তখন কলিরা ঘুমিয়ে পড়েছে। সকালবেলা উঠে আর সেজদাকে দেখেনি। নাম উচ্চারণ করলে পর্যন্ত রক্তচক্ষু দেখতে হয়। এখনও।

কলি অপেক্ষা করত, সেজদা হয়ত কলেজে দেখা করতে আসবে। বলে যাবে ঠিকানাটা। কেমন আছে খবরাখবর দেবে, নেবে। কিন্তু সেজদা যেন উবে গেল। কলেজ থেকে ফিরতে ফিরতে কলির মনে পড়ত সেজদার কথাগুলো—‘ইন এনি কেস, দ্যাখ আমায় চলে যেতে হবে। দাদা এঞ্জিনিয়ার। স্টার-পাওয়া ছেলে। মেজদাটাও ঘষটে ঘষটে কস্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট হয়ে যাবে। ভেবলু কিছু না হোক একটা উচ্চশ্রেণীর কেরানিগিরি তো হাঁকড়াবেই! কিম্বা হয়ত বাবার জুনিয়র হয়ে কোর্টে বেরোবে। আমি দ্যাখ আই এস সিটাতে ঠেকে গেলুম। তার ওপর ব্যাঞ্জো, পিয়ানো, অ্যাকর্ডিয়ন এগুলো এমন টানে আমায় আর অন্য কিছু করতেই ইচ্ছে যায় না। হোটেলের অ্যাকর্ডিয়ন-বাদককে তোদের ভট্‌চায্যি বাড়ি টিঁকতে দেবে?’

কলির সুমসৃণ সহজ সরল জীবনে এই প্রথম ধাক্কা। গোড়ায় গোড়ায় লুকিয়ে কাঁদত। মিলিটা ন্যাকা, একদিন গিয়ে কাকিমাকে বলে দিল।

—‘জানো মা, দিদি সেজদার জন্যে কাঁদে।’

—‘এই চুপ চুপ। বড় গিন্নি জানতে পারলে কি বট্‌ঠাকুর টের পেলে আর রক্ষা থাকবে না।’

কলি তখন মিলিকে বলেছিল—‘তুই কি আমার হাসি-কান্নার ওপরও ট্যাক্স বসাবি? এক্সাইজ অফিসার না কি রে তুই?’

মিলি বলেছিল—‘তা নয়। কিন্তু ভেবে দ্যাখ সেজদাও তো আমাদের কথা, আমাদের বংশমর্যাদার কথা ভাবেনি। কোন্ কেরেস্তান রাক্ষুসীকে বিয়ে করে বসে রইল!’

—‘কার কথা রিপিট করছিস রে? মার? কেরেস্তান-রাক্ষুসীটা তো তোর ডিকশনারির না?’

মিলি হেসে ফেলেছিল—‘মা-জ্যাঠাইমা বলাবলি করছিল তো!’

অত দুঃখেও কলির হাসি আসে—‘তুই-ও অমনি অবিকল তুলে নিলি গলায়? পারিসও বাবা।’

তারপরই তাড়াতাড়ি বড়দার বিয়ে হয়ে গেল। বউমণি এল ঘর আলো করে। সে কি রোশনাই! তিনদিন ধরে কি ধুমধামের যজ্ঞি! সারাক্ষণই সবার মুখ চলছে। তপসে মাছের ফ্রাই হচ্ছে, ছোট চুবড়ির এক চুবড়ি নীলকণ্ঠ ঠাকুর ভাইবোনেদের সামনে ধরে দিয়ে গেল, —‘চেখে দ্যাখো তো দাদাদিদিরা নীলকণ্ঠ বামুনের নাম থাকবে কি না!’ রসে টইটম্বুর ভাসছে লালচে কালো পানতুয়া, প্রথম রসটুকু ঢুকতেই গরম গরম আগে কলি-মিলি। মায়েরা সব সময়েই বলে থাকেন—‘পরের বাড়ি চলে যাবে দুদিন পরেই, ওদের আদর-খাতির আলাদা।’ কিন্তু কলি জানে এই সমস্ত আদরের পেছনে একটা ভয়াল ভ্রূকুটি রয়েছে। সে জানে না সচেতনে, কিন্তু তার অন্তরাত্মা জানে এ বাড়ির সন্তান বাবা-মার দ্বারা পরিত্যক্ত হয়ে কোথায় কোথায় চলে যেতে পারে, কেউ খোঁজ রাখার পর্যন্ত দরকার মনে করবে না। বউমণির বিয়ের আসরে সব্বাই জিজ্ঞেস করছে ‘টুবলু কোথায় গেল? টুবলুকে দেখছি না তো?’

—‘চাকরির ইনটারভিউ দিতে গেছে।’

—‘কোথায়?’

—‘বম্বের দিকে।’

সেই চাকরির ইনটারভ্যু সেজদার এখনও চলছে।

তাই মিলি যখন অপরাধীর মতো মুখ করে বলল—‘দিদি একটা কথা শুনবি?’ কলি বলল—‘কি কথা? ছাদে যেতে হবে? ওদের কোনও গোপন কথা থাকলেই ওরা ছাদে যায়। বাড়ির বড়রা কেউ নেহাত দরকার না পড়লে ছাদে যায় না। ছাদে ওদের সমস্ত গোপন কথা নিরাপদ। কলির মনে হল মিলি নিশ্চয়ই সেজদাকে দেখেছে।

ছাদের চিলেকুঠরিতে ঠাকুরঘর। কয়েক ধাপ সিঁড়ি উঠে তারপর। সেই সিঁড়ির ওপর বসে ওরা গল্প করে। শীতের দুপুরে-সকালে পড়া তৈরি করে।

মিলি বলল—‘রাগ করবি না?’

—‘না, কেন? কি করেছিস?’

কলি নিজের এমন কোনও সাম্প্রতিক অন্যায় ভেবে পেল না, যা নিয়ে মিলি নালিশ করলে সে বকুনি খেতে পারে।

মিলি বলল—‘আমি বউমণিকে একটা কথা বলে ফেলেছি, বউমণি বোধহয় খুব কষ্ট পেয়েছে।’

—‘কি বলেছিস?’ কলি উদ্বিগ্ন হয়ে বলল।

—‘আমি বলিনি রে দিদি। আসলে মা, জ্যাঠাইমা সব সময়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে তো।’

—‘কি আলোচনা?’

—‘এই বউমণি রঙিন শাড়ি পরে, গয়না পরে, বিশেষ করে কানের গয়না বিধবাদের পরতে নেই, সংসারের অকল্যাণ হয়।’

—‘তুই এই সব বললি গিয়ে বউমণিকে?’

মিলি ঢোক গিলল—‘না, এতো কথা বলিনি।’

—‘বড়দের পেছন পেছন পাকামি করে ঘোরবার তোর দরকার কি রে মিলি? সমস্ত কথাগুলো গিলবি, কোথায় কতটুকু বলতে হয়, তোকে কি মানায় না মানায় কিচ্ছু বুঝবি না, ছি ছি! ডাক্তার-জ্যাঠা সেদিন কি বলে গিয়েছিলেন খেয়াল আছে? বউমণি ওরকম বিশ্রী সাজলে খোকামণি মরে যেতে পারে, তা জানিস?’

—‘সেটাই বলছিলুম, জ্যাঠাইমা বলছিল খোকামণি স্কুলে চলে গেলে তো বউমা ওসব গয়না-টয়না খুলে রাখলে পারে। একেই তো সংসারের ওপর দিয়ে একটা ঝড় বয়ে গেল, আবার যদি…’

—‘বললি? তুই একথা বললি? মিলি তুই শুধু বোকা নয়। কি অদ্বিতীয় নিষ্ঠুর তা যদি জানতিস। তুই দুদিন পরে বি এস সি দিয়ে গ্র্যাজুয়েট হতে যাচ্ছিস, তোর একটা সাধারণ বুদ্ধি পর্যন্ত নেই? ছি ছি!’

বেশি ছিছিক্কার মিলি আবার সইতে পারে না। ফোঁস করে উঠল —‘লোকে নিন্দে করলে? আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সবাইকে নিয়েই তো ঘর করতে হয় আমাদের।’

—‘মা-কাকিমা সেকেলে লোক। তারা নিজেদের মধ্যে যে-সব আলোচনা করে সেই কথাগুলো তোর বউমণির কাছে গিয়ে না লাগালে ঘুম হচ্ছিল না? ভাব তো মিলি তোর যদি, আমার যদি এমনি হত!’

মিলির হাতে সোনার মকরমুখো বালা, গলায় মটরদানা, কানে তারের কাজ করা মাকড়ি, জ্যোতিষী দেখিয়ে মা তিনখানা আংটি পরিয়ে দিয়েছেন—মুক্তো, চুনী আর গোমেদ। মিলি হঠাৎ কেঁদে ফেলল। বলল—‘আমি খুব খারাপ করেছি না রে দিদি? বউমণি সত্যি কি হয়ে গেছে! আমার কথায় কেমন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল, চোখ দুটো যেন পাগলের মতো, আমি সইতে পারিনি, পালিয়ে এসেছি। সেদিন থেকে সুযোগ খুঁজছি, কখন তোকে বলব।’

মিলি এতো কাঁদতে লাগল যে কলি নিজের চোখের জল মুছে, ওকে সান্ত্বনা দিতে বাধ্য হল। বলল—‘মিলি শোন, যা করে ফেলেছিস, ফেলেছিস। আর কক্ষনো এ ধরনের কথা বউমণির কানে তুলবি না। চল, একদিন আমরা বউমণিকে নিয়ে সিনেমা যাই।’ ‘বলবি?’

মিলি ভয়ে ভয়ে বলল—‘আমি বলতে পারব না দিদি বউমণি বোধহয় আর কোনদিন আমার সঙ্গে কথা বলবে না।’

কলি সান্ত্বনা দিয়ে বলল—‘বউমণি ওরকম মানুষই নয়। ক’টা দিন যাক। আমিই বলব এখন।’

মিলি বলল—‘আগে জ্যাঠাইমাকে জিজ্ঞেস করে নিস।’

অন্যমনস্ক গলায় কলি বলল—‘তা অবশ্য।’ আগে বউদিকে না জিজ্ঞেস করে আগে মাকে জিজ্ঞেস করার কথায় তার মন কেন যেন সায় দিল না। অনুমতি চাওয়ার ব্যাপারটা আগেও ছিল, কিন্তু এখন যেন তার গুরুত্ব আরও বেড়ে গেছে। এটা অনুভব করতে ভালো লাগল না।

দুজনে অনেকক্ষণ ধরে হাত ধরাধরি করে ঠাকুরঘরের সিঁড়ির ধাপে বসে রইল। চুপচাপ। বসন্তের হাওয়া দিচ্ছে হু হু করে। কোথা থেকে নাম-না-জানা ফুলের গন্ধ আসছে। মন কেমন করে। কার জন্যে যেন ভীষণ মন কেমন করে। সে কি বিতাড়িত সেজদা? সে কি অকালমৃত বড়দা সে কি বিধবা শ্রীহীন বউমণি? নাকি অন্য কেউ? কলি বুঝতে পারে না। বুকটা এতো টনটন করতে থাকে যে মনে হয় গলার মধ্যে দিয়ে উপছে বেরিয়ে আসবে। কাদের বাড়ি আবার রেডিও খুলে দিয়েছে। গান হচ্ছে—‘আমি যে গান গেয়েছিলেম, জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়, মনে রেখো।’ ক’টা দিনই বা জীবনের কেটেছে। কলির বয়স কুড়ি। মিলির আঠার বছর তিন-চার মাস। কারুরই অতীত এখনও ভালো করে তৈরি হয়নি। তবু সেই অপরিণত অতীতের দুঃখে, নাকি আসন্ন ভবিষ্যতের আশঙ্কায় দুজনে হাতে হাত জড়াজড়ি করে বসে থাকে। মিলির ভাবটা যেন সব মুশকিলের আসান তার দিদি করে দেবে। এই মুহূর্তে তার মা-বাবার ওপরও ভরসা নেই। তাঁরা অন্য জগতের অন্য ধাতুর লোক। জীবনের সব পথ মা বাবার হাত ধরে হাঁটা যায় না। জীবনের এই ধাপে বরং তার দু বছরের বড় দিদি তার ভাষা বুঝবে, তার ভুলের ক্ষমা জুটিয়ে দেবে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress