Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » শ্বেত পাথরের থালা || Bani Basu » Page 22

শ্বেত পাথরের থালা || Bani Basu

কলেজ ছুটি হবার পর সুজিত, অনিল, প্রিয়ব্রত জোর করে অভিরূপকে কফি হাউসে ধরে নিয়ে গেল। বলল— ‘আরে, এখুনি এখুনি বাড়ি গিয়ে করবে কি? কত গরম গরম আলোচনা শুনবে দেখবে কেমন ভালুকজ্বর এসে যাবে গায়ে।’

কলেজে এমনিতেই অভিরূপ একটু একা হয়ে পড়েছে। ওর বন্ধুরা বেশির ভাগই ডাক্তারি, এঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি বিভিন্ন লাইনে চলে গেছে। কয়েকজন খুব ভাল রেজাল্ট করে ফিজিক্স, ম্যাথমেটিকসে অনার্স নিয়েছে, তাদের নাগাল পাওয়া ভার। সুমনের সঙ্গে একদিন দেখা হতে অভিরূপ বলেও ছিল— ‘সুমন আমাদের স্কুলের অমন গ্রুপটা ভেঙে গেল রে!’

সুমন কাঁধ নাচিয়ে বলেছিল— ‘লাইফ’স লাইক দ্যাট।’ অর্থাৎ অভিরূপের সঙ্গে বন্ধুত্ব ভেঙে যাচ্ছে বলে তার কোনও খেদ নেই। অভিরূপের খুব হতাশাজনক, খুব অপমানকর লাগে সেটা, সেই থেকে সে একলা, খানিকটা মনমরাও। বাড়িতে কোনও জীবন নেই। মার যখন গাড়ি আসে সকালে তখন রূপ চানই করেনি। মা তাড়াহুড়ো করে চলে যায়। একলা একলা খেয়ে নিচে অবনীশবাবুদের ওখানে চাবি রেখে সে কলেজ যায়। কলেজে ক্লাস করতে ভাল লাগে না। স্কুলের কঠোর শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনের পর এই বিশাল কলেজে গরুর গোয়ালের মতো ক্লাসে বসে চশমা-পরা অধ্যাপকের ল’ অফ ডিমিনিশিং রিটার্নস্‌-এর ওপর লেকচার তার আদৌ ভালো লাগে না। বাড়িতে ফিরে চাবি নিয়ে দরজা খুলে ঢুকতে হয়। আরও ঘণ্টাখানেক পরে মা ফেরে। মায়ের আজকাল পদোন্নতি হয়েছে, দায়িত্ব বেড়েছে। কিন্তু রূপের কি বেড়েছে? নিঃসঙ্গতা, হতাশা! এই ভাবে একটা অনার্স ডিগ্রি নিয়েই বা সে কি করবে? আজ নতুন বন্ধুরা জোরজার করায় কফি-হাউসে এসে তার ভালোই লাগল। বেশ একটা লাইফ আছে।

ডানদিকে ঢুকেই পার্টিশন, সেখানে এক সেট টেবিল চেয়ার। রূপ বসতে যাচ্ছিল, সুজিত বললে, ‘ওটা রিজার্ভড, অভিরূপ, আগে বাঢ়ো!’

—‘কে রিজার্ভ করল? তুমি কি করে জানলে?’

‘আরে বাবা, বসো। একটু পরেই চক্ষুকর্ণের বিবাদ-ভঞ্জন হবে।’

যেতে যেতে শুনল একটি ছেলে টেবিলে ঘুসি মেরে রক্তচক্ষু বলছে— ‘আলবৎ হবে।’ এত জোরে ঘুসি মারল যে টেবিলের খালি কাপ ডিসগুলো ঝনঝন করে উঠল। তার উল্টোদিকের ছেলেটি একটুও উত্তেজিত না হয়ে বলল, ‘আলবৎ হবে না। তুমিও বেঁচে থাকবে, আমিও মরে যাব না। কি হবে না হবে দুজনেই দেখতে পাব।’

ওরা কয়েকজন মিলে জানলার দিকে একটা টেবিল অধিকার করে বসতেই প্রিয়ব্রত কনুইয়ের ঠেলা মারল রূপকে, পেছন দিকে ইঙ্গিত করল, রূপ সামান্য একটু মাথা হেলিয়ে দেখল একজন ভালো মানুষ চেহারার চুল পাট করা যুবক। প্রোফেসর বলে মনে হয়। আরেকজন তরুণী।

প্রিয়ব্রত বলল— ‘চিনতে পারলে?’

—‘না তো!’

—‘নাঃ। তুমি না! হোপলেস। আরে বাবা গ্রুপ থিয়েটার-টার দেখ না? সুমিতা দে, আর ভদ্রলোকটি ইউনিভার্সিটির প্রোফেসর। মাস্টারমশাই ছাত্রীর জন্যে ভালো ভালো পালা লিখে দিচ্ছেন, ঐ আর কি। তা জায়গাটা আমরা ওঁদের ড্রামাটিক ডিসকাশনের জন্যে ছেড়ে দিয়েছি। দিস ইজ ডেমোক্র্যাসি ভাই।’

রূপ আজকে বাড়ি ফিরে দেখল উৎকণ্ঠিত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে জানলায়।

—‘কি রে রূপ, আজ ক্লাস হয়েছিল তো?’

—‘হবে না কেন?’

‘স্ট্রাইক-টাইক হাঙ্গামা তো লেগেই আছে, তাই বলছি।’

—‘স্ট্রাইক হলে তো কাগজে দেখতে!’

আসলে মা আজকাল তাকে সোজাসুজি কতকগুলো কথা জিজ্ঞেস করতে ভয় পায়। যেমন— ‘এত দেরি হল কেন?’ বা ‘ক্লাস-টাস ঠিকমতো করছিস তো?’ রেজাল্টটা ভালো হয়নি। অনেক স্বপ্ন ভেঙেছে। মারও যেমন ভেঙেছে, তারও তো তেমন ভেঙেছে! এসব জিজ্ঞেস করলে ভীষণ একটা রাগ এসে যায়। দেরি হল কেন জিজ্ঞেস করলে রূপও বলে—‘তোমার তো রোজ রোজ দেরি হয়, আমাকে কি কৈফিয়ত দাও।’ মা নিভে গিয়ে বলে— ‘জিজ্ঞেস করলেই পারিস! জিজ্ঞেস করলে আমার ভালোই লাগবে।’ ক্লাসের কথা জিজ্ঞেস করতে রূপের ভুরু ভীষণ কুঁচকে যায় বলে—‘আমি কিন্তু আর স্কুলের বাচ্চা নেই মা, আমার পেছনে খবরদারি করাটা ছাড়ো!’

মা কাঁদো-কাঁদো গলায় বলেছিল— ‘তুই আমাকে এভাবে বলবি?’

—‘একজন সাকসেসফুল চাকুরের চলাফেরার সঙ্গে একজন আনসাকসেসফুল স্টুডেন্টের চলাফেরার তফাত হয়ে যায় মা, তুমি বুঝেও বোঝ না। তো আমি কি করব?’

বন্দনা আকাশ থেকে পড়ে। এ কি ধরনের জটিলতা রূপের মধ্যে বেড়ে উঠছে। তার সঙ্গে ছেলের সম্পর্ক সফল চাকুরে আর বিফল ছাত্রের? মা ছেলের নয়? রূপ যত বড় হচ্ছে তার চেহারায় তার ঠাকুমার আদলটা স্পষ্ট হচ্ছে। খানিকটা গোলগাল চেহারা। চকচকে চুল। মসৃণ কপাল। ওকে দেখলে বন্দনার অভিমন্যুর কথা মনে পড়ে না। রূপের জীবনে বাবার স্মৃতি নেই। এখন যেন তার প্রয়োজনও নেই। ছেলের এই বিরক্তি, এই বহির্মুখী মনোভাবের জন্যে কি সে-ই দায়ী? তার খাওয়া-দাওয়া, পড়াশোনার সুব্যবস্থা যতদূর পারে সে করেছে। কিন্তু তা ছাড়া? বন্দনা খুব আত্মগ্লানির সঙ্গে মনে মনে স্বীকার করে চাকরিটা তার অর্থের জন্য একান্ত প্রয়োজন ছিল না। বাড়ি রয়েছে, বাড়ি ভাড়া রয়েছে, কিছু জমা টাকা নিজেরও ছিল, কাকারও ছিল। চাকরিটার জন্য সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চয় অনেকটাই বেড়েছে। কিন্তু এর চেয়ে কমেও সে চালিয়ে নিতে পারত। চাকরিটা আসলে টাকার জন্যে নয়, তার নিজের মানসিক প্রয়োজনের জন্যে। শুদ্ধু ছেলেকে নিয়ে, তাকেই জীবনের সর্বস্ব এবং একমাত্র করে সে বাঁচতে পারেনি। শ্যামবাজারের বাড়ি হলে হয়ত পারত। কিন্তু কাকার কাছে এসে কোথা থেকে একটা নিজস্ব জীবনের জন্য গভীর আকাঙ্ক্ষা তার ভেতরে প্রবিষ্ট হয়ে গিয়েছিল। চাকরির সময়টুকু বাদে বাকি সবটাই সে রূপকে দিতে চেয়েছে। কিন্তু রূপ তার শত চেষ্টা সত্ত্বেও ক্রমেই অপরিচিত হয়ে উঠছে। তার আগ্রহের বস্তুগুলো বন্দনার বড় অচেনা। রূপ খেলাধুলো ভালোবাসত, সব ছেলেই বাসে। কিন্তু ওর যেন সবটাই অতিরিক্ত। রানিং কমেন্টারি শুনবে তো এক মিনিটও রেডিও কান ছাড়া করবে না। বাথরুমে যাবে তা-ও ট্রানজিস্টার চৌবাচ্চার পাড়ে বসান। কার সেঞ্চুরি হতে পনের রান বাকি, রূপের চুল উশকো খুশকো। সে খাবে না। খেলেও ফেলে ছড়িয়ে। রাজনীতি যখন আরম্ভ করল, তখন ক্রিকেট একদম ভুলে গেল। খেলাধুলো? ওসব বাজে ব্যাপার, বুর্জোয়া। এসব দিয়ে নাকি মানুষের মধ্যে বেড়ে ওঠা বিপ্লবের প্রবণতাকে ঠেকিয়ে রাখা হচ্ছে। মিছিল, স্লোগান, সে এক কাণ্ড। তারপর সে যখন আঁকতে আরম্ভ করল, বন্দনার খুব ভালো লেগেছিল। তার ছেলে কত রকম রূপ সৃষ্টি করছে, দেখে বন্দনার মনে আনন্দ, শান্তি এসেছিল। কিন্তু এখন যেন সেই ছবি-আঁকার থেকেও রূপ আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে। বন্দনা ভাবে সে যদি সম্পূর্ণ পুত্র-কেন্দ্রিক জীবনযাপন করত, তাহলেই কি একটি বেড়ে-ওঠা কিশোরের সমস্ত দাবি সে পূরণ করতে পারত! কাকা বেঁচে থাকলে সমস্ত ব্যাপারটাই অন্যরকম হত। অসময়ে চলে গিয়ে তিনি যেন তাদের একেবারে মেরে রেখে গেলেন। বাবাকে মনে না রাখলেই দাদুকে রূপ মনে রেখেছিল। কথায় কথায় তাঁর প্রসঙ্গ আসত। ইদানীং কলেজে ঢুকে সেই দাদুর স্মৃতিও ওর ফিকে হয়ে এসেছে মনে হয়।

সন্ধেবেলা একা-একা বাড়ি ফিরতে ভালো লাগে না বলে সে প্রায়ই বন্ধুবান্ধব নিয়ে ফেরে। হই-চই। আড্ডা। মোড়ের দোকান থেকে চা-খাবার আনিয়ে খায়। বন্দনা এলেই, বন্ধুরা বলে, ‘এবার যাই। মাসিমা ভালো আছেন?’

—‘তোরা ভালো আছিস? শুধু আড্ডা মারলি না পড়াশোনাও করলি কিছু!’

—‘ওঃ মাসিমা, আপনাদের যুগে লোকে পড়াশোনা করত। এখন করতে হয় না, হয়ে যায়।’

—‘যায় বুঝি? আপনাআপনি? হলেই ভালো।’

যেদিন বন্ধু নিয়ে না ফেরে সেদিন ও-ই অন্য কারো বাড়ি যায়। বলাই আছে। কলেজ থেকে সন্ধেবেলা না ফিরলে ভেবো না। সুতরাং অফিস থেকে ফিরে সেই তৃতীয় ঘরে জানলার পাশে একা-একা বসে থাকা।

রাত্রে খাওয়ার সময়ে রূপ বই-টই পত্রিকা হাতে নিয়ে খায়। আপাদমস্তক পত্রিকা আর ছবি-ছড়ানো বিছানার মধ্যে এঁকেবেঁকে ঘুমিয়ে পড়ে। বন্দনার ঘুম আসে না। রূপের ঘর গোছায় অনেক রাত পর্যন্ত। খুব সন্তর্পণে। অন্ধকারে, চাঁদের আলোয়। একটি জিনিসও না ফেলে, এদিক ওদিক না করে যথাসম্ভব গুছিয়ে রাখে। তারপর ঢুল আসতে থাকে, তখন গিয়ে শুয়ে পড়ে। ঘুমের মধ্যে নিঃশ্বাস এমনিতেই দীর্ঘ হয়। বন্দনার গুলো যেন আরও দীর্ঘ।

সুদীপ্তবাবু বলেছিলেন রূপ গ্র্যাজুয়েশনটা করে নিয়ে আর্ট কলেজে ভর্তি হয়ে যাক। কিন্তু রূপ কি চাইছে বোঝার ক্ষমতা নেই বন্দনার। ভীষণ অব্যবস্থিতচিত্ত ছেলে। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মেতে এতদিনের পরিকল্পনাটা যদি ভেস্তে দেয়? কিচ্ছু বলা যায় না।

প্রতি শনিবার সুদীপ্ত সরকার নিয়ম করে আসেন। গল্প করেন, চা খান, কোনও সময়ে রূপ থাকে, কোন সময়ে থাকে না, রূপের ভবিষ্যৎ নিয়ে আগামী শনিবার ওঁর সঙ্গে আলোচনা করতেই হবে ভাবল বন্দনা। রূপ উপস্থিত থাকলেই ভালো, ওর সামনেই তুলবে কথাটা।

শনিবার রূপ কলেজে বেরোবার সময়ে বন্দনা মনে করিয়ে দিল কথাটা— ‘রূপ, গত শনিবারও কিন্তু তুমি ছিলে না। মাস্টারমশাই বলে গেছেন থাকতে।’

রূপ বলল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ এসে যাব ঠিক।’

কিন্তু বিকেল থেকে ভীষণ বৃষ্টি নামল। সুদীপ্তবাবু এলেন কাকভেজা হয়ে। ছাতাটা খুলে নিচের উঠোনে মেলে দিয়ে বললেন— ‘আর দাঁড়িয়ে লাভ নেই। যা ভেজা ভিজেছি। পত্রপাঠ বাড়ি ফিরে যাওয়া উচিত। ওপরে আর উঠব না। সব জলে ভেসে যাবে।’

বন্দনা বলল, ‘আপনার বাড়ি না হলেও এটা একটা বাড়ি তো বটে, এখানেও ভিজে গেলে শুকনো জামাকাপড় পাওয়া যায়। এই বৃষ্টিতে আবার কেউ ফেরত যায় নাকি? এ তো ক্রমশই বাড়ছে!’

সুদীপ্তবাবু বললেন, ‘আমার ছাত্রের জামা আমার গায়ে উঠবে না।’

—‘জানি, আপনাকে ফিটিং জামাকাপড়ই দিচ্ছি। ওপরে আগে আসুন তো!’

আলমারির পাল্লা খুলে তোয়ালে জড়ানো ধুতিগুলো সাবধানে নামাল বন্দনা। ধুতি পাঞ্জাবি চওড়া ধাক্কা দেওয়া শান্তিপুরী জরিপাড়, কাঁচি ধুতি, ফরাসডাঙার নীলচে পাড় দেওয়া ধুতি, সূক্ষ্ম মিলের ধুতি। কিছু কিছু পাটে পাটে কেটে গেছে। হলুদ হয়ে গেছে জায়গায় জায়গায়। বেছে নিয়ে পাল্লা বন্ধ করল। এসব তার কাছে ছিল না। যখন শ্বশুরবাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে, নিজের কিছু শাড়ি আর ছেলের জামাকাপড় ট্রাঙ্ক সুটকেসে ভরে নিয়েছিল। কলি এই ক’বছরে দফায় দফায় তার আলমারির জিনিস তাকে এনে দিয়েছে।

সুদীপ্ত বললেন, ‘এ কি আপনার সব রেডি? আপনি কি মন্ত্র জানেন?’ বলেই জামা-কাপড়-তোয়ালে হাতে সুদীপ্ত চুপ করে গেলেন। আস্তে আস্তে কলঘরের দিকে চলে গেলেন। বন্দনা দালানের জল মুছে চায়ের জল চাপালো।

সুদীপ্ত সরকার মাথায় অভিমন্যুর মতো লম্বা না। তবু আজকাল বেশি ঝুলের পাঞ্জাবি পরার চল হয়েছে বলে চোখে লাগে না। চশমাটা খুলে অনেকক্ষণ ধরে অকারণে চশমার কাঁচ মুছলেন সুদীপ্ত। বন্দনা পটশুদ্ধ চা, নিমকি নামিয়ে রাখছে।

সুদীপ্ত বললেন— ‘বালকটি কোথায় গেল এই বাদলার বিকেলে!’

—‘গেছে তো কোন সকালে। ঠনঠনেতে আজ যা জল দাঁড়াবে— আসবে কি করে, তাই ভাবছি’— বন্দনা বলল।

—‘এরকম হলে কি করে?’

‘বেথুন-রো-এ এক বন্ধুর বাড়ি প্রায়ই তো থেকে যায়। হয়ত তাই থাকবে।’

—‘এরকম থেকে যায় নাকি?’

—‘মাঝে মধ্যে!’

—‘বলে না না-বলে?’

—‘বলেও যায় কখনও, কখনও পারলে ফোন করে দেয়।’

—‘আপনি একা থাকেন?’

—‘আমি তো একাই সুদীপ্তবাবু, ও থাকলেও একা-ই।’

—‘মায়ের প্রতি ওর এর চেয়ে বেশি দায়িত্ববোধ হওয়ার কথা ছিল।’

—‘দায়িত্ববোধ দিয়ে কি হয়? কিছু হয় না।’

—‘ও কি বলছেন? এ বয়সে ছেলেরা একটু এরকম হয়ই। তাই বলে…’

—‘আমি খুব চিন্তিত হয়ে পড়ছি।’

—‘সে তো দেখতেই পাচ্ছি।’

—‘ভীষণ আড্ডাবাজ হয়ে উঠেছে, বন্ধু, বন্ধু, আর বন্ধু।’

—‘সংসারের কিছু-কিছু দায়-দায়িত্ব ওকে দেন না কেন?’

—‘দিতে তো চাই। ও এড়িয়ে যায়। আমি বোধহয় ওকে ঠিকমতো তৈরি করতে পারিনি। কিন্তু কোথায় যে আমার ভুল তাও বুঝতে পারি না।’

—‘ও কি বরাবরই এরকম?’

—‘না তো! একেবারেই না। ছোটবেলায় ভীষণ মা-মা ছিল। এখন ঠিক সেই মাত্রায় বন্ধু-বন্ধু হয়েছে। লেখাপড়া তেমন করে করছে না। ও কি করবে সুদীপ্তবাবু, আপনাকে কিছু বলে?’

—‘আপনি বোধহয় ছোট সমস্যাকে বড় করে দেখছেন।’

—‘ভীষণ ভয় করে আমার। মনে হয় ওর যদি কিছু না হয়। যদি দাঁড়াতে না পারে! ও নিজেও আমাকে দোষ দেবে। পাঁচজনেও দেবে। আমি তো নিজেকে মাফ করতে পারবই না।’

—‘কেন আপনার ত্রুটিটা কোথায়?’

—‘সুদীপ্তবাবু আপনি জানেন না, ওর দাদু-ঠাকুমার আশ্রয় ছেড়ে চলে এসেছিলুম একদিন, সে অবশ্য আমার কাকার ভরসায়। কিন্তু তিনি তো দুম করে চলে গেলেন। ও বাড়িতে থাকলে ওর চারপাশে কত লোক, কত শাসন, কত দায়িত্ব আপনা থেকেই থাকত। এখানে কিছু নেই। কিচ্ছু না।’

—‘শুনুন মিসেস ভট্টাচার্য, এসব দ্বন্দ্বকে প্রশ্রয় দেবেন না। রূপ একেবারেই বোকা ছেলে নয়, ব্রিলিয়ান্ট কি সকলে হয়? কিন্তু ও খুব সহজেই নিজের রাস্তা খুঁজে নেবে। দেখবেন! আপনি ওর জন্যে অত ভাববেন না। আমি কিন্তু ভাবিত হচ্ছি, আপনার জন্যে।’

—‘আমার জন্যে? কেন?’ বন্দনা আকাশ থেকে পড়ল।

‘রূপ এমন একটা বয়সে পৌঁছেছে, নিজের পথ খুঁজে নেবার তাগিদ ওর ভেতর থেকে এখন আপনিই তৈরি হবে। কিছু কিছু ভুলত্রুটি সব মানুষই করে। কিন্তু করে-টরেও ওর দাঁড়িয়ে যাবার অনেক সময় আছে। সমস্যাটা ওকে নিয়ে নয়। আপনাকে নিয়ে। আপনি যে অনেক বেশি অসহায়। এতো একা। এতো বিষণ্ণ, কোথাও যেন আপনার কোনও ভরসা নেই। এভাবে আপনি বেঁচে থাকবেন কি করে? যত দিন যাবে আরও নির্ভরশীল হয়ে পড়বেন ছেলের ওপর আর ছেলে জীবনের স্বাভাবিক নিয়মে ক্রমাগত দূরে সরে যেতে থাকবে।’

—‘আপনি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন?’ বন্দনার চোখে আতঙ্ক। কাঠ-কাঠ শরীর।

—‘আমি ভয় দেখাচ্ছি? মিসেস ভট্টাচার্য আপনি নিজেই তো ভয় পেতে আরম্ভ করেছেন!’

—‘কি করব? কি করা উচিত তাহলে?’

—‘আচ্ছা মিসেস ভট্টাচার্য, দু’জনকে কিছুতেই মনের মধ্যে স্থান দিতে পারেন না, না?’

—‘দু’জনকে?’

—‘যিনি চলে গেছেন তিনি তো চিরদিনই আপনার অন্তরের মধ্যে পাকা আসনে থাকবেনই। কিন্তু তাঁর পাশে যদি কোনদিন কাউকে অন্তত এই ভয়াবহ একাকিত্বের হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্যও স্থান দিতে ইচ্ছে হয়, আমাকে ডাকবেন।’

বন্দনার মাথা নিচু। চোখ সজল, সুদীপ্তবাবু দেখতে পাচ্ছেন না। তিনি বললেন—‘রূপকে আমি নিজের ছেলের মতোই ভালোবাসি। আমার আত্মীয়পরিজন সবই আছে, তবু কেউ নেই। আপনি তো জানেন! আমি বহুদিন থেকে রূপকে এবং আপনাকে আপনজন বলে ভাবতে শুরু করেছি। আপনি হয়ত জানেন না, আপনারা ছাড়া আমারও সত্যি কেউ নেই।’

সুদীপ্তবাবুর ঝাঁকড়া চুল এলোমেলো হয়ে চশমার ওপর পড়েছে। চোখগুলো এমনিতে খুব কালো, এখন আরও কৃষ্ণ আরও গভীর মনে হয়। সিগারেটটা উনি ছাইদানির ওপর নামিয়ে রেখেছেন। ধবধবে ধুতি পাঞ্জাবি পরে আজকে যেন অন্য মানুষ। আপনভোলা শিল্পী নয়। জীবন সম্পর্কে গভীর ভাবে চিন্তিত, ভাবুক। বন্দনা মুখ তুলে তাকাতে পারছে না। চারদিকে হাওয়া এলোমেলো, বর্ষার সন্ধ্যা যেন অতীতস্রাবী। সে যেন আবার এসেছে, হাসছে, তার সঙ্গে, রূপের সঙ্গে, রূপ লুটোপুটি খাচ্ছে, তিনজনের রান্না করছে বন্দনা। অন্নপূর্ণা বলছে, দিদি দাদাবাবু বলে গেছেন রেডি হয়ে থাকতে, একটু পরে ফিরেই বেরোবেন তোমাদের নিয়ে। অনেক যেন রাত। তবু সিগারেটের গন্ধ থমথম করছে ঘরগুলোতে। সে চলে যায়নি। যাবে না। বন্দনার একলার ঘর একলার থাকবে না। এই ভয়, এই সর্বক্ষণের মনখারাপ তার দমকা হাসির চোটে কোথায় উবে যাচ্ছে।

অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে থেকে বন্দনার সাদা সিঁথির দিকে তাকিয়ে সুদীপ্ত বললেন—‘বৃষ্টিটা বোধহয় একটু ধরেছে। আমি এবার যাই। রূপ এলে বলবেন আমি এসেছিলুম, ওকে এক্সপেক্ট করেছিলুম, কাল রবিবার আবার আসব, ও যেন থাকে।’

বন্দনা বলল—‘এখনও বৃষ্টি বেশ পড়ছে, ভেতর থেকে বোঝা যাচ্ছে না। আপনি আর একটু বসুন না। রূপকে আমি বলে রেখেছি। ও হয়ত ফিরবে। তারপর উঠবেন।’

কোমল গলায় সুদীপ্ত বললেন, ‘আপনার ভয় করছে, না?’

—‘হ্যাঁ। এরকম বিশ্রী ভয় আমার আজকাল কেন করে, জানি না।’

আরও ঘণ্টা দুই পরে রূপ বাড়ি ফিরে দেখল, সুদীপ্তকাকু ছাইদানিতে পোড়া সিগারেটের স্তূপ করে ফেলেছেন, টেবিলের ওপর একগাদা পত্রিকা। মা রান্নাঘরে, খিচুড়ির সুবাস বৃষ্টিভেজা হাওয়ায়।

—‘কতক্ষণ এসেছেন? সুদীপ্তকাকু?’

—‘অনেকক্ষণ। তুই তো জানিসই আমি শনিবার আসব।’

—‘শনিবারেই যে আজকাল আমরা ক’জন—এক বন্ধুর বাড়ি পড়তে যাই। বৃষ্টিতে দেরি হয়ে গেল।’

—‘আমি কি ডেটটা পাল্টে ফেলব?’

—‘কি দরকার?’

—‘তোকে পাব কি করে? এ সপ্তাহে কি আঁকলি?’

—‘কিচ্ছু না।’ তাচ্ছিল্যের সুরে বলল রূপ, ‘আচ্ছা সুদীপ্তকাকু এঁকে কি হয় বলুন তো? আমাদের মতো মানুষের পক্ষে আঁকাটা হবি থাকাই ভালো না?’

বন্দনা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে, পার্টিশন ধরে দাঁড়িয়ে উদ্বিগ্ন স্বরে বলল—‘রূপ তুই আর্ট কলেজে যাবি না?’

—‘আচ্ছা মা, আমি যে যামিনী রায় কি অবনীন্দ্রনাথ হব না সেটা কি তুমি এতদিনেও বুঝতে পারনি?’

—‘কিন্তু এতদিনের প্রস্তুতি… এতদিনের আশা…’

সুদীপ্ত বললেন—‘যামিনী রায়, অবনী ঠাকুর, মুকুল দে, কিছুই হবার তোমার দরকার নেই রূপ। আর্টিস্টের এখন অনেক চান্স। আমি নিজেই তোমাকে ইনট্রোডিউস করে দিতে পারব।’

—‘তো আপনি নিজে তো এখনও অন্য চাকরি করছেন, আপনিও তো গেলে পারতেন!’

—‘যাব! হয়ত যাব!’ অন্যমনস্ক গলায় সুদীপ্ত বললেন, ‘তাছাড়াও তো বুঝিস, আমি শিল্পী হিসেবে ফ্রি-লান্‌স্‌ থাকতে চাই। তোর ধরনটা অন্যরকম। ডিফিডেন্ট হবার কিছু নেই।’

রূপ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল— ‘ডিফিডেন্ট আমি হইনি। আসলে সুদীপ্তকাকু আমি ঠিক করে ফেলেছি কমপিটিটিভ পরীক্ষায় বসব। আঁকায় আজকাল সেরকম স্যাটিসফ্যাকশন পাই না।’

বন্দনা রান্নাঘরের প্রান্তে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এইভাবেই রূপ কত যত্নে কত আদরে তার স্বপ্নগুলোকে গড়ে, তার পর নির্মমভাবে ভেঙে দেয়। সত্যি যে সে কি বৃত্তি শেষ পর্যন্ত নেবে সে নিজেও জানে না, এ বিষয়ে এখন বন্দনা নিশ্চিত।

সুদীপ্ত একটু পরে বললেন—‘কমপিটিটিভ পরীক্ষা দিবি সে তো খুব ভাল কথা। বাঃ! তৈরি হচ্ছিস নাকি?’

—‘ওই আর কি। গ্র্যাজুয়েশনটা হয়ে যাক।’

—‘হ্যাঁ, গ্র্যাজুয়েশনটাই তাহলে মন দিয়ে কর।’

বন্দনা বলল— ‘রূপ তুমি জামা-কাপড় বদলে এসো। খাবার দিচ্ছি।’

—‘জামাকাপড় বদলাবার কি আছে? আই অ্যাম অল রাইট। হাত ধুয়ে নিচ্ছি, খাবার দিয়ে দাও।’

সুদীপ্ত উঠছিলেন, বন্দনা বলল—‘আপনি চললেন কোথায়? আপনারও রান্না হয়েছে।’

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress