শ্বেত পাথরের থালা (Shwet Pathorer Thala) : 20
—‘এই যে ভাই শুনছেন? এই যে আপনাকেই বলছি।’
বন্দনা ট্রামের জন্য দাঁড়িয়েছিল। শেডের নিচে প্রচণ্ড ভিড়। পেছন থেকে ডাক শুনে ফিরে দাঁড়াল। ভিড়ের কাঁধের মধ্যে দিয়ে চেনা-চেনা মুখ দেখা যাচ্ছে। তাদের অফিসেরই দু’জন মহিলা। একজনের বন্দনার কাছাকাছি বয়স হবে ডেসপ্যাচে আছেন, নাম খুব সম্ভব অণিমা হালদার। অন্যজন বন্দনার থেকে ছোট, সবে এসেছে, নামটা বন্দনা জানে না। অণিমা হালদার বললেন—‘আর ক’দিন পরই আপনি কার-লিফট পেয়ে যাচ্ছেন, জানেন তো? আপনার বসের সাথে সাথে আপনার পদোন্নতি হচ্ছে।’ বন্দনা জানে না এ বিষয়ে কিছুই। তার চোখে বিস্ময়ের ভাব দেখে অণিমা হালদার একটা অদ্ভুত মুখভঙ্গি করলেন। আশপাশের লোকেরা কৌতূহলী চোখে তাকাচ্ছে। কেন যে এঁরা কথাবার্তায় আব্রু মানেন না। সে আস্তে আস্তে পেছন ফিরে ভিড় থেকে বেরিয়ে এল।
অণিমা হালদার তার হাতটা খপ করে ধরে বললেন—‘আর আপনার নাগাল পাচ্ছি না, একটু আলাপ করে নিই।’
বন্দনা হেসে বলল ‘বেশ তো। সে তো খুব ভালো কথা!’ চারদিকে গিসগিস করছে মানুষের ভিড়। উদ্ভ্রান্ত মুখ বেশির ভাগই। বাড়ি ফেরার তাড়ায়।
অণিমা বললেন—‘সত্যিই ভালো কথা তো! আপনি মেয়েদের সাথে মেশেন তো?’
—‘তার মানে?’
অন্য মেয়েটি বলল—‘কি যে বলেন অণিমাদি। বন্দনাদি আপনার সঙ্গে আমাদের অনেকদিন থেকে আলাপ করবার ইচ্ছে। কিন্তু আপনি পিকনিকে আসবেন না, অ্যানুয়াল ফেট-এ যোগ দেবেন না, খালি মুখ নিচু করে ঘোষাল সাহেবের নোট নেবেন। কি করে আলাপ করব?’
অণিমা হালদার বললেন—‘আমাদের প্রথম প্রথম ধারণা ছিল, কিছু মনে করবেন না ভাই আপনি সাহেবের স্ত্রী, সেইজন্যে আমাদের মতো চুনোপুঁটিদের সাথে মিশবেন না। আমি একটু ঠোঁট কাটা ভাই, মনের কথা পেটে থাকে না।’
বন্দনা বলল—‘ছি ছি এসব কি ভাবছেন? আমি নিজেও তো চুনোপুঁটিই।’
অণিমা বললেন, ‘আমাদের স্ট্যাটাস এক হলে কি হবে, স্বামীদের স্ট্যাটাস দিয়েই এখনও মেয়েদের স্ট্যাটাস ঠিক হয়। আমার স্বামীও কেরানি, আপনার স্বামী ছিলেন অফিসার। কি রে নন্দিতা ঠিক বলিনি?’
—‘আপনি যা বলছেন বলেন না, আমাকে আবার সাক্ষী মানছেন কেন?’ অন্য মেয়েটি বলল।
অণিমা হালদার বললেন—‘বেশ তো তা হলে কেন মেশেন না আমাদের সাথে বলুন।’
বন্দনা ভিড়ের থেকে আরও খানিকটা সরে গিয়ে বলল—‘কোনও কারণ নেই, বিশ্বাস করুন, হয়ে ওঠেনি।’
—‘অনুপম সোমের বেলায় তা হলে হয়ে ওঠে কি করে? সে অফিসার বলে? না পুরুষ বলে?’
বন্দনার কান ঝাঁঝাঁ করছে। ভদ্রমহিলার মুখের কোনও আগল নেই। সে গম্ভীর হয়ে এবার বলল—‘যা বলেন!’
নন্দিতা বলল—‘অনিমাদি, চুপ করেন না। বন্দনাদি, আজ আমি আপনার সাথে আলাপ করবই। আমার বাসা খুব কাছে। বউবাজার, আরপুলি লেন। তিনজনায় যাই, আধঘণ্টার মধ্যে আপনাকে ছেড়ে দেব।’
—‘তখন ফিরব কি করে ট্রাম-বাসের অবস্থা তো দেখছ!’
—‘আমি নিজে আপনাকে সাথে করে ফাঁকা বাসে তুলে দেব।’
বন্দনা বলল— ‘বাড়িতে ভাববে, অন্য দিন হবে।’
অণিমা বললেন—‘কে ভাববে? শাশুড়ি না মা?’
বন্দনা বলল— ‘ছেলে।’
—‘ছেলে ভাববে? ছেলেরা ভাবে মায়েদের কথা? নিজেদের বন্ধু বান্ধবের সাথে আড্ডা সিনেমা-থিয়েটার এই নিয়েই তো মত্ত। বাসার কথা, মায়ের কথা ওদের মনে থাকে? অবশ্য আপনার ছেলে বোধহয় এখনও অত বড় হয়নি!’
বন্দনা নন্দিতার দিকে তাকিয়ে বলল— ‘ভবানীপুরের ট্রাম আসছে। উঠে পড়ি। পরে দেখা হবে।’
ময়দানের সবুজের মধ্যে দিয়ে ট্রাম চলে। বেশ ভিড়। পাখার কাছাকাছি যেতে না পারলেও জানলা ঘেঁষে দাঁড়াতে পেরেছে সে। আর একটা দুটো দেখলে বসা যেত। অণিমা হালদারের সঙ্গে এর চেয়ে বেশি কথা বলতে বাধ্য হবার ভয়ে এখনও বুক ঢিপ ঢিপ করছে। তার শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়স্বজনের মধ্যে কোনও কোনও পিসি-মাসি শ্রেণীর মহিলা ছিলেন এই জাতীয়। বাসি বিয়ের দিন একজন যেমন মন্তব্য করলেন—‘এ যে তালপাতার সেপাই গো। রংটা কটা বটে। তবে কটা না ফ্যাকাশে বলতে পারব না বাপু।’ কিন্তু তাঁদেরও ভব্যতা না থাক একটা মমতা ছিল ধরনধারনে। যিনি তালপাতার সেপাই বলে খুঁত কাড়লেন তিনিই আবার থালাভর্তি খাবারদাবার এনে আদর করে মুখের সামনে ধরলেন—‘একবারে না খেতে পারো, একটু একটু করে খাও মা। নইলে কি সংসারের ধকল সয়!’ কিন্তু এই মহিলা শিক্ষিত, নিশ্চয়ই শিক্ষিত, অথচ ভীষণ অমার্জিত। কথাবার্তার মধ্যে মেয়েলি গ্রাম্যতা দোষ আর পুরুষালি সপ্রতিভতার এমন একটা মিলন হয়েছে যে মিলন একেবারেই সুখের নয়। কাকা ঠিকই বলেছিলেন মেয়েদের পক্ষে স্কুলের চাকরিটাই ভালো। বাড়ির কাছে সেই স্কুলটির কথা মনে করলে এখনও বন্দনার মন কেমন করে। বিশেষ করে ছাত্রীদের কথা ভাবলে। মধুমিতা, আল্পনা, শর্মিষ্ঠা, কি যেন সেই মেয়েটির নাম যে তাকে নিয়মিত ফুল উপহার দিত। চম্পা! পদ্ম! ছাত্রীদের সঙ্গে তার খুব সুন্দর একটা সখ্য জন্মেছিল। সহকর্মিণীদের সঙ্গে ততটা হয়নি। স্টাফরুমে সব সময়ে দলবাজির একটা চোরা স্রোত কাজ করত। নীলিমাদির সঙ্গে গল্প করলে ঊষাদির মুখ গম্ভীর হয়ে যেত। ঊষাদির সঙ্গে বেশি কথা বললে প্রতিমাদি স্টাফরুম থেকে বেরিয়ে যেতেন। বেলা, তপতী, রচনা, মায়া তখন তার সমবয়সী ছিল, নিজেদের গ্রুপের মধ্যে আর কাউকে ঢুকতে দিত না। এগুলোর জন্য তার বেশ সুবিধেই হয়েছিল, আলগা ওপর-ওপর মেলামেশা করলেই চলে যেত। কারুর বাড়ি যেতে হত না, কাউকে বাড়িতে ডাকতেও হত না। অবশ্য মাত্রই দু বছর সে ছিল স্কুলে। আর বেশিদিন থাকলে কি হত বলা যায় না।
অন্যদের দিক থেকে দেখলে তার এই মেলামেশার অনিচ্ছাটা উন্নাসিকতা বলে মনে হতেই পারে। বিশেষ করে অন্য মেয়েদের চোখে। উন্নাসিকতা বলতে ঠিক যা বোঝায় এই বিষণ্ণ গাম্ভীর্য, একা-একা থাকা এর সঙ্গে তার খানিকটা তফাত আছে। সেটা যে ওদের চোখে পড়ে না তা নয়, কিন্তু শব্দ ভাণ্ডার বড় সীমাবদ্ধ। ওই শব্দটার বাইরে আর কোনও শব্দ ওদের অভিধানে নেই। বন্দনা বোঝে তার প্রকৃতি এমনিতেই অন্তর্মুখী। মানুষ তার ভালো লাগে। জীবনস্রোত বয়ে চলেছে, সে নিজেও তার সঙ্গে চলেছে এই চিন্তায় তার ভীষণ স্বস্তি। কিন্তু কোনও ব্যক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে হলে তার প্রতি তাকে খুব বেশি আকৃষ্ট হতে হবে। তার ভালোবাসায় শনির দৃষ্টি আছে। মা মারা গেলেন অল্প বয়সে। দশ বছর মোটে বয়স। বাড়ির আবহাওয়া বদলে গেল। বাবা এমনিতেই তখন উদাসীন, নিস্পৃহ, কাকা যতই মায়ের মতো করে যত্ন করতে চান, তিনি কি পারেন? সেই থেকে বন্দনা গৃহমুখী হয়ে গেল। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি ফিরে বাবা-কাকার মুখ দেখবার তাগিদে একের পর এক বন্ধু হারাতে লাগল। কেই বা কার জন্যে বসে থাকে? সমবেদনা থেকে যায়। কিন্তু কে আর ওই বয়সে অপরের দুঃখের ভাগ নেবার মতো দরদী হয়! এই সব কারণেই কলেজে পড়ার সময়ে সে এতো কম কলেজে গেছে যে নন-কলেজিয়েট হয়ে গিয়েছিল। টাকাকড়ি দিয়ে আবার সে দুর্দশা থেকে মুক্ত হতে হয়। তারপর তো ভট্টাচায্যি বাড়িতে বিয়েই হয়ে গেল। ওই কয়েক বছরই বন্দনার মানুষের সঙ্গে সামাজিক মেলামেশার কাল। শিখছিল জিনিসটা। সম্পূর্ণ হবার আগেই দুম করে সব বদলে গেল। যদিবা কাকার কাছে এসে নিজেকে একটা জীবন্ত মানুষ বলে, একজনের অত্যন্ত প্রিয়জন বলে নিজেকে অনুভব করতে শুরু করেছিল, বিশ্বাসঘাতকের মতো কাকা চলে গেলেন। নিয়তি যেন বারবার তাকে গাছে তুলে দিয়ে মই কেড়ে নিয়েছে। অথচ এই সব সহকর্মিণী তাকে উন্নাসিক ভেবে নিচ্ছেন। উন্নাসিকও নয়। অণিমা হালদার সোজাসুজি বলবেন—ঠ্যাকারে। নাক-উঁচু।
এই রকম মনখারাপ করা বিকেলে বাড়ি ফিরে যার জন্য তাড়াতাড়ি ফিরে আসা তাকে দেখতে না পেলে কেমন লাগে? রূপ নেই। নিচের অবনীশবাবুর স্ত্রীর কাছে চাবি দিয়ে গেছে।
বন্দনা জিজ্ঞেস করল—‘কার সঙ্গে বেরোল?’
—‘কি জানি? বেশ কয়েকটি ছেলে এসেছিল। দুড়দাড় করে ওঠার নামার শব্দ পেলুম।’
—‘অনুপ, সন্দীপ, ওরা?’
‘ওরা কেউ নয়। আমি ভালো করে দেখিনি যদিও।’
বন্দনা বিরক্ত হল। দু-চারজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু আছে। তারা ছাড়া অন্য কারুর সঙ্গে রূপ এরকম বাইরে যাক, সে তা চায় না। কাকা চলে যাবার পর থেকে কিভাবে দু’হাতে আগলে ছেলেকে মানুষ করতে হচ্ছে সেই জানে। আবার আগলানো হচ্ছে সেটা বুঝতে দিলে হবে না। ঢালাও স্বাধীনতার আবহাওয়া, খালি কতকগুলো শৃঙ্খলা তুমি মেনে চলে। এইরকম ভাষায় অনুবাদ করা যায় বন্দনার ছেলে মানুষ করার দর্শনটা। তার ধারণা এতেই কাজ হবে। কিন্তু পিতৃহীন ছেলের ওপর বন্ধুদের প্রভাবটা খুব বেশি। যত বড় হয়, তত বেশি। সেটা ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা দিয়ে বন্দনা বুঝতে পারে। বাড়িতে এই বাড়ের সময়টা একজন পুরুষের সঙ্গের অভাব যে কী দারুণ অভাব! পিতা বা পিতৃকল্প কেউ। তাঁর জোর, তাঁর চরিত্রের আদর্শ, তাঁর পছন্দ-অপছন্দ অলক্ষ্যে কাজ করতে থাকে একটি কিশোরের মানসিক বাড়বৃদ্ধির পেছনে। বাড়িতে পায় না। তাই বাইরে খোঁজে। বন্ধু, বন্ধুর বাবা, মাস্টারমশাই। স্কুলের একজন মাস্টারমশাই তো রূপকে রাজনীতিতে ঢুকিয়ে নিয়েছিলেন আর কি! কোনও দরকার নেই, তবু ওই স্যারের কাছে ওর কোচিং নিতে যাওয়া চাই-ই। বারো-তেরো বছরের ছেলের মুখে তখন শোষক-শোষিত, শ্রেণীশত্রু, বুর্জোয়া, সংগ্রাম, চোখে ঘৃণার আগুন জ্বলছে।
ভীষণ ভয় ধরে গিয়েছিল তার। তার বাবার বংশের কত পুরুষ ধরে চব্বিশ পরগনায় বাস সে জানে না। ভবানীপুরের বাড়ি ঠাকুর্দার কাছ থেকে বাবা-কাকা পেয়েছিলেন। ধনী না-হলেও, অভাবের তাড়না কি জিনিস তারা জানেনি। যুদ্ধের বাজারে তাদের নিচের ভাঁড়ার ঘর ভর্তি থাকত চালের বস্তায়। ন্যায্য দামে সেই চাল পাড়া প্রতিবেশীদের দিয়ে বাবা-মা কতজনের প্রাণ বাঁচিয়েছেন। দুর্ভিক্ষের সময়েও মাকে দেখেছে দু’হাতে ভিখারিদের সাহায্য করতে। সে সময়ে তাদের বাড়িতে ভাতের ফ্যান কখনও ফেলা হত না। কিন্তু শ্রমিক বা চাষী কোনও শ্রেণীর সঙ্গেই তার সাক্ষাৎ পরিচয় নেই। পড়েছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, কিন্তু তাঁর আঁকা মাস্টারমশাইদের জীবনের ট্রাজেডি যতটা পরিচিত মনে হয়েছে, কুবের মাঝির গল্প ততটা হয়নি কোনদিনই। ‘জাগরী’ সে মোটামুটি ধরতে পারে, কিন্তু ‘ঢোঁড়াই-চরিত-মানস’ কয়েকবার চেষ্টা করে রেখে দিয়েছে। বন্দনার সাহিত্য-জগতে রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আছেন আশাপূর্ণা দেবী, প্রতিভা বসু, দুই বিভূতিভূষণ, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘তিথিডোর’ আর ছোট গল্পের বুদ্ধদেব বসু, সুবোধ ঘোষ। রবীন্দ্রনাথের পরে কিছু কিছু প্রেমেন্দ্র মিত্র আর জীবনানন্দ ছাড়া সে মোটে কবিতাই পড়েনি। বাবা ছিলেন হিন্দুস্থানী সঙ্গীতের ভক্ত। কাকা তাছাড়াও রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদ, ডি এল রায়, ভালোবাসতেন খুব। রবীন্দ্রসঙ্গীতের খুব চল ছিল না বাড়িতে। উভয়েই রাজনীতির দিক থেকে শ্যামাপ্রসাদ, সুভাষচন্দ্র, চিত্তরঞ্জন দাশের ভক্ত। কতটা তাঁদের মতবাদের জন্য আর কতটা তাঁদের চরিত্রগুণে বলা শক্ত।
বন্দনার শ্বশুরবাড়িতে আবার আবহাওয়া ছিল একদম অন্যরকম। ওঁরা বাংলা খবরের কাগজ ছাড়া পড়তেন না। শনিবার রেসের খবরের জন্য বিশেষ ইংরেজি কাগজ দরকার হত। ছেলেমেয়েরা রাজনীতির সঙ্গে সংস্রব রাখত না। নেহরু যা বলবেন, সারা বাড়ি মোটামুটি দেশ ও বিদেশ সম্পর্কে সেটাই শেষ কথা বলে মেনে নিত। সাংস্কৃতিক জগতের সঙ্গেও তাঁদের কোনও সম্পর্ক ছিল না। ফৈয়জ খাঁ সম্পর্কে তার শ্বশুর একবার খুব বিশ্রী মন্তব্য করায় তার বাবা ও-বাড়ি যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। গান-বাজনার জগৎটা ওঁদের কাছে ছিল অচ্ছুৎ। মেয়েদের আমোদ-প্রমোদ বলতে মাঝে মধ্যে সিনেমা যাওয়া, রেডিওর অনুরোধের আসর শোনা, বেড়াতে যাওয়া মানে সাঁওতাল পরগনা। সপরিবারে, বিরাট লটবহর নিয়ে।
অভিমন্যু মেকানিক্যাল এঞ্জিনিয়ার। তার নিজের বিষয় নিয়ে সে প্রচুর পড়াশোনা করত। সাহিত্য-শিল্প- সঙ্গীত এসবের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল কম। শ্বশুরমশাই বলতেন, ‘নবেল? ও তো মেয়েরা পড়ে। পড়বেই। শরৎবাবু, রবিবাবু। তুমি আমি ঠেকাতে পারব না।’
অভিমন্যু বলত—‘গল্প কাহিনী উপন্যাসের মধ্যে বন্দনা আমি রস পাই না। জীবনে যা রোজ ঘটছে সেগুলো রেকর্ড করে কি লাভ? একটা পুরো উপন্যাসের জিস্ট কি বলো তো? একজন কি দু’জন জন্মালো, বড় হল, দুজনে প্রেম হল, যে কোনও কারণে মাঝখানটায় গণ্ডগোল। শেষকালে মিলন হল অথবা হল না। এর মধ্যে কে থলে হাতে বাজার করতে গেল, কারা রকে বসে আড্ডা দিল, কোন গিন্নি কার সঙ্গে কি ভাষায় ঝগড়া করল। এসব তো রোজ দেখছি, এ আবার আলাদা করে লেখবার জিনিস নাকি? আর কবিতা? ওরে ব্বাবা, হ্যাঁ রে কলি তুই তো বাংলা-টাংলা পড়িস—
পোড়ে মৌচাক আধিদৈবিক অলাতে
নৈমিত্তিক সব্যসাচীর শলাতে
অপসৃত হয় গুপ্তির জঞ্জাল। মানে কি রে এর?’
কলি বলত, ‘তুমি স্বয়ং কবিকে জিজ্ঞেস করে এস, আমার বিদ্যেতে কুলোবে না।’
বন্দনা বলত—‘তুমি একটু বেরসিক যাই বলো।’
—‘কেন আমি কি হেমন্ত মুখুজ্জের গান ভালোবাসি না! তোমাকে কি আমি সদারঙ্গ মিউজিক কনফারেন্সে নিয়ে যাইনি?’
বালক ছেলের কথাবার্তা শুনে, চাউনি দেখে বন্দনার ভয় ধরে গিয়েছিল। কাকা সবে মারা গেছেন। কেউ নেই যে পরামর্শ করবে। কাকার সঙ্গে যেন পরামর্শ করারও দরকার পড়ত না। তিনি জানতেন এবং বুঝতেন। সব কিছু তাঁর মমতাময় হৃদয় দিয়ে। দুই বাহুর শক্তি দিয়ে ঠিক করে দিতেন। ঈশ্বরের মতন। বন্দনার জগতের ঈশ্বর। ছোট মাপের হতে পারেন, কিন্তু ঈশ্বর যদি হতেই হয় তবে এইরকম। অন্য কোনরকম ঈশ্বরের অস্তিত্বে ভরসা নেই তার। সে সময়ে অফিস থেকে কলিকে ফোন করেছিল।
—‘কি ব্যাপার বউমণি?’
—‘অনেকদিন আসিসনি, কলি।’
—‘সত্যি? আমার কথা তোমার মনে পড়ে?’
—‘মনে পড়ার সুযোগ দিস কোথায়? তার আগেই তো হই হই করে এসে পড়িস।’
—‘এবার আর আসছি না। এই তো দ্যাখো না, দু-সপ্তাহ হল যাইনি।’
—‘তাই তো ভাবছি।’
—‘আজই যাব বউমণি!’
কলি বউমণিকে না দেখে বেশিদিন থাকতে পারে না। কিশোরী বয়সের মুগ্ধ চোখ দিয়ে দেখা প্রথম বউদি। বড় আদরের, বড় ভালোবাসার। বয়সে বড়, বোঝে বেশি, জানে বেশি, কিন্তু বন্ধু। দিদির মতো। কলির মনের মধ্যে বউমণির জায়গা পাকা। তার মনের মধ্যে একটা ভীষণ অনুশোচনাবোধও কাজ করে যায়। বউমণি যখন বাড়ি ছাড়ল, তখন সে প্রাপ্তবয়স্ক, বিবাহিত। অন্যায়ের প্রতিবাদ অবশ্য করেছিল, কিন্তু আর কিছুই পারেনি। একেক সময়ে মনে হয় পঁয়তাল্লিশ নম্বরের জেলখানা থেকে মুক্তি পেয়ে বউমণির ভালোই হয়েছে শেষ পর্যন্ত। সঞ্জয়েরও তাই মত। সঞ্জয়ের বেশির ভাগ মতই অবশ্য কলির মত। সে যাই হোক, সঞ্জয় বলে, ‘ওরে বাবা তোমাদের পঁয়তাল্লিশ নম্বরে জামাইষষ্ঠী খেতে যেতে হবে ভাবলেও আমার হৃৎকম্প হয়। আমরা দুই কাকপক্ষধর নওলকিশোর খেতে বসেছি দু-পাশ থেকে দুই জাঁদরেল শাশুড়ি হাওয়া করছেন, পাখা চলছে বনবন করে, তবু দুগ্গাঠাকুরের মতো হাওয়া খাচ্ছি। জামাইদের যথেষ্ট আদর হবে না নইলে। আর দু দিক থেকে দুই শ্বশুর শ্যেন দৃষ্টিতে দেখছেন জামাইদের জন্যে যে দমকা খরচাটা হয়ে গেল সেটার ঠিকঠাক সদ্গতি হচ্ছে কি না। উরি ব্বাপ্।’
কলি সঞ্জয় দুজনেই এসে গেল সন্ধেবেলা। বন্দনা উৎকণ্ঠিত মুখে জানাল রূপের সমস্যার কথা। সঞ্জয় মুখ গম্ভীর করে বলল—‘স্কুল পাল্টানো ছাড়া কোনও উপায় নেই বউদি।’
—‘সে কি? এতদিনের স্কুল! সেই ছোট্ট থেকে পড়ছে!’
—‘এই বেলা পাল্টে দিন। পাল্টালেও সুবিধে হবে কি না জানি না অবশ্য। আপনি ছাড়লেও কি কমলি ছোড়বে?’
কলি বলল—‘স্কুল ছাড়ানো কি সম্ভব? ও শুনবে কেন? এক কাজ করো না বউমণি, ও অত ভালো আঁকে একজন আঁকা শেখাবার মাস্টারমশাই রেখে দাও। এনগেজ্ড্ থাকবে, পলিটিকসের ভূত ঘাড় থেকে নেমে যাবে।’
সুদীপ্ত সরকারের সেই সূত্রে আগমন এ বাড়িতে। সত্যিই কলির বুদ্ধি আছে। মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে ছবি আঁকতে আঁকতে কবে রূপ শ্রেণী সংগ্রামের কথা ভুলে গেছে।
শূন্য বাড়িতে ঢুকতে কিরকম বুক কেঁপে ওঠে। এতদিন একরকম একলা জীবনযাপন করছে, কলিদের বাদ দিলে সঙ্গীহীনই। চাকরি করছে, জীবনসংগ্রামে ব্যস্ত। একা হাতে ছেলেকে বড় করে তুলছে, তা সত্ত্বেও তার এই ধরনের ব্যক্তিত্বহীন মেয়েলিপনা গেল না। কারুর নির্মম বা অভব্য কথার জবাব দিতে পারে না, সহজে ভেঙে পড়ে, সব সময়েই আশা করতে থাকে বাড়িতে ফিরে কাউকে দেখবে। না দেখলে বুক ভেঙে যায়।
এরকম সাধারণত হয় না। এলেই রূপকে দেখতে পায়। একা কিম্বা বন্ধুদের সঙ্গে। সপ্তাহে দু’দিন সুদীপ্তবাবু আসেন। সোজা অফিস ফেরত চলে আসেন। রূপ যখন বাড়ি ফেরে তখন বন্দনার সবে ধন নীলমণি অন্নপূর্ণাটি থাকেন। সেই রূপকে খেতে দিয়ে বন্দনার চা ফ্লাস্কে রেখে দেয়। রূপকেও বেশিক্ষণ একলা থাকতে হয় না। আজ অনেকদিন পর এরকম শূন্য ঘর। শূন্য ঘর দেখলেই বুক হু-হু করে। দালানে টেবিলের ওপর খাবার ঢাকা, পাশে চায়ের ফ্লাস্ক। মৃদু আলো জ্বলছে। পুরনো দিনের লাল সিমেন্টের চকচকে মেঝে, তার ওপর যেন কয়েক জোড়া জুতোর দাগ। ওরা তো কিছু মানবে না, শুনবেও না। হুড়মুড় করে এসেছে, চলে গেছে বোঝাই যাচ্ছে। বন্দনার কেমন কান্না পেল। সে পর্দা সরিয়ে নিজের শোবার ঘরে ঢুকল। তার একার খাট, একার টেবিল, আলমারিটা বিরাট। বর্মা টিকের আলমারি মায়ের। ওপর দিকে কারুকার্য করা। দু পাল্লাতেই আয়না বসানো। দেয়ালে ক্যালেন্ডার, এরা ভারতবর্ষের বিভিন্ন দুর্গ নিয়ে ক্যালেন্ডার করেছে। এটাতে রুক্ষসুক্ষ সিংহগড় দেখা যাচ্ছে। পশ্চিমের দেয়াল জুড়ে রূপের আঁকা ছবি সাঁওতাল পরগনায় বসন্ত এসেছে। যদিও ছবিতে শিমুল পলাশ তবু সুদীপ্তবাবু ছবির নাম দিয়েছেন ‘মউলের বাস।’ দু ফুট বাই তিন ফুট চটের ওপর তেল রঙে আঁকা এই ছবিতে ফিনিশিং টাচ আছে সুদীপ্ত সরকারের, প্রাইজ পাওয়া ছবি। টেবিলের ওপর দেয়ালে অভিমন্যু-বন্দনার বিয়ের অব্যবহিত পরে তোলা ছবি। কিছু বই টেবিলের ওপর গোছানো রয়েছে। আর কিছু নেই। মাঝখানের দরজা খুলে পাশে রূপের ঘরে ঢুকল বন্দনা। কলির কথায় ছেলের ঘর আলাদা করে দিয়েছে। এটা আগে কাকার ঘর ছিল। বন্দনা ঘুরে ঘুরে দেখল, এ-ও কি রূপের একার ঘর? রূপেরও কি একা-একা লাগে তার মতো! অফিসের বাইরে সব সময়টাই তো সে মনে মনে রূপকে দিয়ে রেখেছে। কিন্তু মায়ের সেই সঙ্গ কি ছেলের সব সময় কাজে লাগে? এ ঘরের দেয়ালে রূপের বাবার একলার ছবি। এটা আগে বন্দনার ঘরে থাকত, ছেলের ঘর আলাদা করে দেবার পর তার বাবার একটা ছবি ঘরে থাকা দরকার মনে করেছিল, তাই এটা এ ঘরে। এক সময়ে এ ছবিতে সব সময়ে টাটকা ফুলের মালা দেওয়া থাকত, আজকাল আর নিত্য হয়ে ওঠে না। আরেক দিককার দেয়ালে সুদীপ্তবাবুর সেই বৃদ্ধার মুখ। টেবিলে ছড়ানো বই, নকশা, অন্য দেয়ালগুলোতে রূপের নিজের আঁকা নানান ছবি। জলরঙের স্টীল লাইফ। জানলা থেকে দেখা গলির দৃশ্য, চারকোণে চারটে সেলোটেপ দিয়ে এঁটে রাখে ও, কিছুদিন পরে নতুন ছবি আঁকে তখন আগেরগুলো টান মেরে ফেলে দেয়। কোনটা কোনটা বন্দনা যত্ন করে তুলে রেখে দেয়, কোনটা কলি আদর করে নিয়ে যায়, বলে ‘কোথা থেকে এ গুণ পেল বলো তো আমাদের বাড়ির ছেলে? কাশীনাথ ভট্টাচার্যের বাড়ির ছেলে ল্যান্ডস্কেপ আঁকছে। যাই বলো বাবা ভাবা যায় না।’
বন্দনার ঘর যেমন খালি খালি, বর্ণহীন, এ ঘর তেমনি ভর্তি। দেয়াল বোঝাই, টেবিল বোঝাই, খাট বোঝাই। রঙচঙে ঘরখানা। না তেমন একাকিত্ব টের পেল না বন্দনা। রূপের জগৎ, জীবন এখনও অবধি পূর্ণ। সে কোনও অভাব টের পায় না। অন্তত তার মায়ের কাছে তাই মনে হল। যে সময়ে কাকা এই ঘরটাতে থাকতেন, এর সাজসজ্জা অন্যরকম ছিল। ঘরটাতে এলেই পুবের জানলার দিকে পেছন করে রাখা একটা অদৃশ্য আর্মচেয়ার দেখতে পায় বন্দনা। একটি কাঁচা পাকা চুলের মাথা তাতে বিকেলের আলো এসে পড়েছে। দু-টি মসৃণ পা, ঝামা দিয়ে ঘষে ঘষে পা দু-টিকে আয়নার মতো ঝকঝকে রাখতেন কাকা। আর্মচেয়ারের হাতলে পা দু-টি দুপুর বেলায় তোলা থাকত। দক্ষিণের দেয়ালে যেখানে এখন নিদন্ত বৃদ্ধার ছবি ঘটা করে দুলছে সেখানে ছিল একটা ছোট্ট বুক র্যাক, তাতে কাকার নিজস্ব পছন্দের বই থাকত। সে বুক র্যাকটা বই সমেত ওপাশের ঘরে সরিয়ে নিয়ে গেছে। আর্মচেয়ারটা বিক্রি হয়ে গেছে। কি হবে স্মৃতি জমিয়ে রেখে! সে ঠাকুর দেবতার ছবির সঙ্গে মৃত স্বামীর ছবি রাখত, ঠাকুরপুজোর ছল করে তাকেই ধূপ, দীপ, ফুল, ভোগ দিত বলে কাকা একদিন রাতে তাকে বড্ড বকেছিলেন। সেই থেকে বন্দনা ঠাকুরপুজোই বন্ধ করে দিয়েছে। সে তো সত্যিই আসলে কৃষ্ণ, লক্ষ্মী, বা ভোলা গিরির পট পুজো করত না। অভিমন্যুর দৃপ্ত সুন্দর মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে থাকত। তাকেই মনে করত। যা কিছু দিত, তাকেই দিত। সকালবেলা জল-বাতাসা দেবার সময়ে কৌটোয় রাখা বড় ফেণী বাতাসা থেকে সাবধানে পিঁপড়ে বেছে দিত। সন্ধেবেলায় উৎকৃষ্ট সন্দেশ আনাত, এক এক দিন এক এক রকম। সে কি পটের অলীক-দর্শন পেচক-বাহন লক্ষ্মী ঠাকুরকে খাওয়ানোর জন্য? কক্ষনো না। তার এই স্মৃতিবিলাস কাকা ভালো চোখে দেখেননি। তাঁর কথা নিয়ে বন্দনা অনেকদিন অনেক রাত ক্রমাগত ভেবেছে। পুরোপুরি মানতে পারেনি, তবু মনে হয়েছে কাকা যা বলেছেন তার মধ্যে সত্যি আছে। সে মনে মনে অভিমন্যু-রূপ দেবতাকে মানস গঙ্গায় বিসর্জন দিয়ে বলেছে—‘তুমি যখন ছিলে, মানুষ ছিলে, চলে গেছ বলে তোমাকে আমি দেবতা বানিয়ে ফেলছিলুম, আর বানাব না। তোমার ছবি সামনে না নিয়েও যদি তোমাকে সহজে মনে রাখতে পারি, তোমার এক সময়ের থাকা এবং এখনকার না-থাকাকে যদি এই বিচিত্র জীবনের ছন্দে সুরে মিলিয়ে নিয়ে চলতে পারি তবেই আমার স্মরণ সত্যিকারের স্মরণ হবে। সেই ভালোবাসাই সত্যি ভালোবাসা। নয়ত সবটাই হয়ে উঠবে সংস্কার সন্মোহ। কাকা ঠিকই বলেছেন।’
তৃতীয় ঘরটা, যেটাতে এখন বাড়ির অপ্রয়োজনীয় অতিরিক্ত জিনিসগুলো আছে, সেই ঘরে এসে বন্দনা জানলার ধারে দাঁড়িয়ে রইল। গলির আলোগুলো জ্বলে উঠেছে শুধু তাদের বাড়ির কাছটা একটা অন্ধকারের বৃত্ত। এখানকার আলোটাই গেছে। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বন্দনার মনে হল তার ভীষণ শরীর খারাপ করছে। আর সে এই একলা জীবন বহন করতে পারছে না। একটা গোটা ছেলের ভার একদম একলা। মেয়ে হলে তবু তাকে চোখে চোখে রাখা যায়। আচ্ছা যেখানেই যাক, অন্তত বলে তো যাবে! নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়তে গিয়ে খেয়াল হল হাত পা মুখ কিছু ধোয়া হয়নি, মাথা ধরে গেছে, চা খাওয়া দরকার। পেটের মধ্যেটা খিদেয় কুলকুল করছে।
অফিসের জামা-কাপড় পাল্টে, হাত মুখ ধুয়ে চায়ের ফ্লাস্ক নিয়ে বসতেই হল, অন্ন বেশ যত্ন করে আলুর চপ ভেজে রেখে গেছে, সেগুলো এখন ঠাণ্ডা হয়ে গেলেও খিদের মুখে বেশ ভালোই লাগছে।
সাড়ে আটটা বেজে গেলে বন্দনার মনে হল সে সত্যিই এবার পাগল হয়ে যাবে। কিছু একটা এক্ষুনি করা দরকার। কাকে ফোন করা যায়? রূপের টেবিলের ডায়েরি থেকে ওর বন্ধু সুমনের ফোন নম্বরটা বার হল। পাশের বাড়ি থেকে ফোন করতে হল। সুমনের ফোন বেজেই যাচ্ছে, বেজেই যাচ্ছে। তখন কলিকে ফোন করল, করেই মনে হল কলিরা কাশ্মীরে বেড়াতে গেছে। তারপর মনে পড়ল আরেকটা নম্বর ২৯-২১৭৬, অনুপম সোমের স্বর।
—‘হ্যাল্লো সোম হিয়ার।’
—‘আমি বন্দনা ভট্টাচার্য।’
—‘কে? বন্দনা … মিসেস ভট্টাচার্য ফোন করছেন? কি সৌভাগ্য? কি ব্যাপার?’
সোমের উচ্ছ্বাস থামিয়ে দিয়ে বন্দনা প্রায় বোজা গলায় বলল—‘অফিস থেকে ফিরে অবধি রূপকে দেখছি না, চাবি নিচে দিয়ে গেছে, নটা বাজছে, কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না।’
ওদিকে কয়েক সেকেন্ডের নীরবতা, তারপর অনুপম বলল, ‘আমি আসছি, চিন্তা করবেন না।’
বন্দনা বাড়ি ফিরে আসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে পাশের বাড়ির ফোনটা বাজল। জানলা দিয়ে ওবাড়ির মেয়েটি ডাকল—‘বন্দনাদি ও বন্দনাদি, রূপ ফোন করছে।’
—‘কোথায়? কোথা থেকে? কি ব্যাপার?’
—‘ওদের স্কুল-হস্টেলের সুপার অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎ মারা গেছেন। হস্টেলের ছেলেদের সঙ্গে ও ওখানে রয়েছে ভাববেন না, ওর আসতে দেরি হবে। শ্মশানে যাবে।’
বন্দনা অবাক হয়ে গেল। নিশ্চিন্ত খানিকটা। কিন্তু ভীষণ অবাক। বছর ষোল বয়স রূপের। সে ক্লাস টেনে পড়ে। জীবনের প্রথম দিকে তার নেশা ছিল ক্রিকেট। তারপরে কিছুদিন রাজনীতি। তারপর আপাতত আঁকা। একটার সঙ্গে আরেকটার কিছুমাত্র মিল নেই। কিন্তু রূপ হঠাৎ শ্মশানে যাবার মতো সিদ্ধান্ত একা-একা নিয়ে নেবে মায়ের সঙ্গে পরামর্শ না করেই, এতো রাত অবধি না বলে কয়ে সে বাড়ির বাইরে, এতই কি বড় হয়ে গেল সে?
খুব লজ্জার সঙ্গে হঠাৎ বন্দনা লক্ষ করল সে খুব স্বার্থপর। একজন মানুষ, ছেলেদের হস্টেল-সুপার, তিনি মারা গেছেন হঠাৎ। তাঁর ছাত্র এই দুঃসময়ে তাঁর শয্যার পাশে গিয়ে দাঁড়াবে, শেষকৃত্যের কর্তব্য করতে যাবে এবং সে ছেলে তারই ছেলে, এ তো খুব আশ্বাসের কথা, গর্বেরও কথা। কিন্তু সে মনে মনে চায় না ছেলে যাক। অন্য ছাত্ররা যাক না। তার রূপ যেন না যায়। যে ছেলের পাঁচ বছর বয়স হতে-না-হতেই বাবাকে পিণ্ডদান করতে হয়েছে সে কেন আবার এসব সংস্রবে যাচ্ছে। গায়ের ভেতরটা শিরশির করছে বন্দনার। রাতে খাওয়া হবে না, কোথায় না কোথায় খাবে, হয়ত কাঁধ দেবে, কাঁধে ব্যথা হবে, কখন ফিরবে, অসময়ে চান …। ছেলে সামাজিক কর্তব্য করছে, পূজনীয় মাস্টারমশাইয়ের জন্যে তার মনে সম্মান, শ্রদ্ধা, দায়িত্ববোধ জন্ম নিয়েছে, যার টানে সে মাকে না জানিয়েই শ্মশানে চলেছে—এ তো একদিক থেকে আনন্দের কথা। অথচ বন্দনা ভাবছে হস্টেলের ছেলেগুলো বেছে বেছে ওকেই ডাকতে এল কেন?