বায়স্কোপ
আমি সেই দিনই প্রতিজ্ঞা করেছিলুম—বঙ্কুর সঙ্গে আর কোথাও যাব না, সিনেমা তো একেবারেই নয়। শীতের শেষ। সবে গরম পড়তে শুরু করেছে। দুপুরের দিকটায় একটু গরম। সকাল বিকেল বেশ ঠাণ্ডা। একটা ভাল পুরনো বই এসেছে। বঙ্কু বলল—‘চল অনেক দিন সিনেমা দেখিনি, ছুটি আছে, দেখে আসি।’ বঙ্কুর কথায় নেচেই আমার কাল হল।
টিকিট সহজেই পাওয়া গেল। একে বাংলা ছবি তায় পুরনো। পাশের একটা হলে রগরগে হিন্দি ছবি হচ্ছে। যত ভিড় সেখানেই। বঙ্কুর সিনেমা দেখার যে এত ফ্যাচাং আমার জানা ছিল না। আমার হাত থেকে একটা টিকিট নিয়ে বলল—‘তুই ভিতরে গিয়ে বস, আমি জল ছেড়ে, পানটান খেয়ে আসছি। তুই তো আর পান খাবি না।’ আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে হন হন করে ল্যাভেটরির দিকে চলে গেল। তেমন একটা শীত নেই তবুও গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে এসেছে। বলল, ‘সাবধানের মার নেই। দেখিসনি সাহেবরা বেশি শীতে কামিজ গায়ে থাকে আর শীত কমে এলেই যত কোট, সোয়েটার গায়ে চাপায়। কেউ দেখে শেখে, কেউ ঠেকে।’ এর আর কী উত্তর দেব।
হলের আলো নিভল, বঙ্কুর পাত্তা নেই। পর্দা সবে উঠছে বঙ্কু হুড়মুড় করে এসে ঢুকল। ঢোকার মুখে অন্ধকারে ঠিক ঠাহর করতে না পেরে এক ভদ্রমহিলার খোঁপা তছনছ করে তাঁর পা মাড়িয়ে একটু ডোন্ট কেয়ার ভাবে এসে, সিটের উপর একটা প্রচণ্ড শব্দ করে বসল। বসেই বলল—কী নরম মাইরি।
—কী নরম রে, ফিস ফিস করে জিগ্যেস করলুম।
বঙ্কু বাজখাই গলায় বলল—ওই যে ভদ্রমহিলার হাত।
—বেশ হয়েছে এখন চুপ কর। তুই যেভাবে এলি তাতে তোকে ধরে পেটানোই উচিত। আমি আর কথা না বাড়িয়ে, গম্ভীর হয়ে পর্দার উপর চোখ রাখলুম।
বঙ্কু একটু আড় হয়ে, নিজের হাতের কনুই দিয়ে হাতল থেকে আমার হাতটা ফেলে দিয়ে, মুখে একটা অদ্ভুত শব্দ করে বলল—রাখ। আমাকে মারনেওয়ালা এখনও মার পেটে জন্মায়নি। বঙ্কু একটু নিচু হয়ে তার দু’পায়ের ফাঁকে পানের পিক্ ফেলল।
একটু বিরক্ত হয়ে বললুম—এটা কী পিক ফেলার জায়গা?
বঙ্কু রেগে গেল—পিকটা ফেলব কোথায়? শালা তোমার কোলে ফেলব?
আমি আর কথা বাড়াতে চাইলুম না। বই তখন আরম্ভ হয়ে গেছে। বঙ্কু পকেট থেকে একটা দেশলাই কাঠি বের করে দাঁত খোঁচাতে লাগল। মনে মনে ভাবলুম, যাক্ বাবা একটা কাজ পেয়েছে যা হোক। এখন কিছুক্ষণ ঠাণ্ডা।
হঠাৎ বঙ্কু কাঠিটা ছুঁড়ে ফেলে দিল। কোথায় পড়ছে দেখার দরকার নেই। তারপর চাদরটা খুলে—‘উঃ শালা কী গরম বলে সোজা উঠে দাঁড়াল। উফ্, পাখা চলছে না কেন, পাখা। ঝোঝুল্যমান পাখাটার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এদিককার সিনেমা হলে এখনও সেই সাবেক পাখার ব্যবস্থা। পাখা বন্ধই ছিল। এমন কিছু গরম পড়েনি যে পাখা চালাতে হবে। বঙ্কু পাখাটার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে রইল—যেন তাকিয়ে থাকলেই পাখাটা চলতে শুরু করবে।
পিছনের সারির দর্শকরা চেঁচাতে লাগলেন—‘আরে মশাই বসুন বসুন। শীতকালে আবার পাখা কী? মকরধ্বজ খেয়েছেন নাকি।
কে কার কথা শোনে, বঙ্কু তখন চেঁচাচ্ছে, ‘পাখাটা চালিয়ে দিন, পাখা, পাখা।’ পাখা শেষে চলল। বঙ্কু বসেই একটা আরামের শব্দ করল—আঃ! তারপর আমাকে উদ্দেশ করে বলল—‘দেখলি শালা, জোর যার মুল্লুক তার।’ বঙ্কুর ওপাশের ভদ্রলোক ধমকে উঠলেন—‘বেশ হয়েছে, এখন দয়া করে চুপ করে বসুন।’ বঙ্কু খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে উঠল—‘রাগছেন কেন সার। আড়াই ঘণ্টার তো মামলা। এটুকু সময় আর পিসফুল কো-একজিসটেন্স চালাতে পারছেন না?’ ভদ্রলোক বললেন—‘দোহাই হাত জোড় করে বলছি চুপ করুন।’
—না না, জোড়হাত করার কী হয়েছে। সামান্য সিনেমা দেখতে এসেও জোড় হাত! এই জোড় হাত করে করেই বাঙালি জাতটা ডুবল। কী বল সুধরে? বলেই সেই অন্ধকারে বঙ্কু আমার দিকে তাকাল।
—বঙ্কু, তোর পায়ে পড়ছি। চুপ কর।
—আচ্ছা যা, ফর ইওর সেক।
কিছু সময়ের জন্য সব ঠাণ্ডা। বঙ্কু চুপচাপ। গভীর মনোযোগ দিয়ে ছবি দেখছি। হঠাৎ পিছনের সারির দর্শকরা গোলমাল শুরু করলেন। কী যেন তাঁরা বলছেন। কিসের একটা অভিযোগ। অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে পাশে তাকিয়ে যা দেখলুম চক্ষুস্থির। বঙ্কু তার সাতহাত চাদরটা সব মাথায় জড়িয়ে বসে আছে। মাথাটা দেখাচ্ছে গন্ধমাদনের চুড়োর মতো।
কানে এল দর্শকদের অভিযোগ—এ কী মশাই! চাদরটা খুলে নিন, আমরা দেখতে পাচ্ছি না। শালা জঙ্গল থেকে এল নাকি? বঙ্কু ক্ষেপে আগুন—আমার চাদর আমি মাথায় জড়াই, যেখানে খুশি জড়াই, কার তাতে কী?
কে একজন বললেন—বার করে দে ব্যাটাকে।
—হ্যা হ্যা, দস্তুর মতো টিকিট কেটে এসেছি।
আমি হাত জোড় করে বললুম—ওরে বঙ্কু, চাদরটা খোল ভাই, তোর পায়ে পড়ছি।
—চাদরটা খোল মাইরি। বঙ্কু আমারই গলার অনুকরণ করে বলল—সাইনোসাইটিস হলে তুমি শালা দেখবে। মাথার উপর পাখা ঘুরছে।
—পাখা তো তুই খোলালি।
—বেশ করেছি। গায়ে হাওয়া লাগবে, মাথাটা বাদ।
—বঙ্কু, আমি তোকে ওষুধ কিনে দেব, দয়া করে চাদরটা খোল। বল, এভাবে সিনেমা দেখা যায়!
ভাল কথায়, মিষ্টি কথায় কাজ হল।
—আচ্ছা যা, ফর ইওর সেক। বঙ্কু চাদরটা খুলে দলা পাকিয়ে কোলে রাখল।
ছবি তখন খুব জমে উঠেছে। সারা হলে টু শব্দ নেই। হঠাৎ বঙ্কু একটা গ্রেভ দার্শনিকের মতো মন্তব্য করল—‘সুধরে, ভগবানের কী খেলা দেখ মাইরি, কেউ টিকিট কেটে কাবলিওলা দেখছে, আবার কারুর বাড়ি দুবেলা সেধে সেধে কাবলিওলা যাচ্ছে।
—আঃ থামুন মশাই। বঙ্কুর ওপাশের ভদ্রলোক বিরক্তি প্রকাশ করলেন।
—ও, বলে বঙ্কু সহজেই চুপ করল দেখে আশ্বস্ত হলুম। হঠাৎ দেখি বঙ্কু দুখানা পা চেয়ারের ওপর তুলে ডেঙ্গো ডাঁটার মতো ছড়িয়ে বসল। একটা হাঁটু আমার থুতনির সামনে আর একটা ওপাশের ভদ্রলোকের।
—বঙ্কু, ভাল হয়ে বস না। ওভাবে কেউ বসে!
—এইটুকু জায়গায় বসা যায় শালা। আর কতক্ষণ বসে আছি বল তো?
—তোর ভাল না লাগে বেরিয়ে যা। আমাদের দেখতে দে। আমি একটু রেগেই বললুম।
—তোমার কথায় শালা! পয়সা দিয়ে টিকিট কেটে এসেছি। মুফতে আসিনি। আমার দিকের হাঁটুটা সে দুবার নাচিয়ে দিল। কথা না বাড়িয়ে ছবিতে মন দিলুম। বঙ্কু কিছুক্ষণ গজগজ করে চুপ করল। কিন্তু কতক্ষণ? পাঁচ মিনিটও বোধহয় হবে না। বঙ্কু লাফিয়ে উঠল—‘সুধরে, ওই দেখ মাইরি নগেন ব্যাটাচ্ছেলে এসেছে, এই নগা, নগা।’ দুসারি দূরবর্তী নগেনকে বঙ্কু ডাকতে লাগল।
—মশাই, বেরিয়ে যান হল থেকে। ওপাশের ভদ্রলোক ভীষণ রেগে গিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। বঙ্কু যেমন বসেছিল তেমনি বসে রইল। বসে বসেই ভদ্রলোককে শাসিয়ে দিল—‘দাঁড়ান মশাই, বেশি বেশি ফ্যাচ ফ্যাচ করবেন না। এই নগা।’ নগেন ঘাড় ফেরাল। বঙ্কু মহা উৎসাহে বলে উঠল—‘কী চাঁদ, একলা একলা খুব সিনেমা মারছ।’
এবার পিছনের দর্শকরাও ক্ষেপে উঠলেন—বেরিয়ে যান, বেরিয়ে যান। বার করে দিন ব্যাটা মাতালকে।
আমি বললাম—‘বঙ্কু খুব সিনেমা দেখেছিস বাবা, বাড়ি যা।’ বঙ্কু বলল-‘আচ্ছা আর একটা কথাও বলব না। তুই দেখ। কী করব বল, নগেন ব্যাটা কীরকম ঘাপ্টি মেরে অন্ধকারে বসে আছে দেখ।’
যাইহোক কিছুক্ষণের জন্য ব্যাপারটা মিটল। সকলে ছবিতে মনোনিবেশ করেছেন। হঠাৎ বঙ্কু একটা বাঘের মতো হাই তুলে হা হা শব্দ করল।
—আবার আরম্ভ করলেন। ওপাশের ভদ্রলোক রেগেই ছিলেন।
—যা বাব্বা হাই তোলারও উপায় নেই। বঙ্কু আমার দিকে কেতরে বসে বেশ সমঝদারের মতো বলল—ছবিটা বেশ মাইরি। মনে মনে হাসলুম, কতই যেন ছবি দেখছে!
কিছুক্ষণ পরেই বঙ্কু বলল—সুধরে, টিকিটটা গুলি মতন করে নগেনকে ছুঁড়ে মারব?
আমি বললুম—চল বাইরে যাই। তুই টিকতে দিবি না।
—না, না, তুই দেখ আমি আর কিছু করব না। একেবারে সাইলেন্ট। কী করব বল, এক জায়গায় এতক্ষণ বসে থাকা যায়।
ফিসফিস করে বললুম—এলি কেন?
—তুই এলি তাই এলুম। তুই বরং আমাকে কয়েকটা পয়সা দে, কিছু খেয়ে আসি, ভীষণ খিদে পেয়েছে।
আমি সঙ্গে সঙ্গে পঞ্চাশ পয়সা দিয়ে বললুম—যা খেয়ে আয়। বাবা বাঁচা গেল।
বঙ্কু উঠে দাঁড়িয়ে দুজনকে অতিক্রম করে খানিকটা গেল। কিন্তু বেরিয়ে গেল না। তৃতীয় ব্যক্তির সামনে গিয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে পড়ল।
—কী হল মশাই! বঙ্কু কোন জবাব দিল না। আবার ফিরে এল। ‘সুধরে, আর চার আনা দে মাইরি।’
তাড়াতাড়ি একটা সিকি বের করে দিলুম। বঙ্কু গটগট করে চেয়ারের সারি পেরিয়ে প্যাসেজে গিয়ে পড়ল। তারপর আবার হুড় হুড় করে ফিরে আসতে লাগল।
—উঃ কী মুশলিক! হল কী মশাই, পিস্টনের মতো একবার করে যাচ্ছেন আর আসছেন? যাবেন যান। আসবেন আসুন।
—এই তো এলুম, বলে বঙ্কু বসে পড়ল।
—সুধরে, পরে একসঙ্গে খাব মাইরি। পয়সাটা আমার কাছেই থাক। কী বলিস?
—আচ্ছা তাই হবে, তুই এখন একটু ধৈর্য ধরে ছবিটা দেখ।
—হ্যাঁ দেখছি। বঙ্কু চুপ করল। এরপর বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে আছে দেখে আড় চোখে একবার তাকালুম। মনে হল, বঙ্কু ছবিতে ডুবে গেছে।
হঠাৎ বঙ্কু খ্যাক খ্যাঁক করে হেসে উঠল। হাসি আর থামে না। ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করলুম—তুই এই দুঃখের দৃশ্যে হাসছিস কেন?
—দূর হাসছি তো অন্য কারণে। নগেন মাইরি কেমন জেন্টলম্যানের মতো বসে আছে দেখ।
দু সারি দূরে নগেন বসে আছে দেখে যদি কারুর হাসি পায় কী বলব। হঠাৎ বঙ্কুর পাশের ভদ্রলোক বিকট শব্দে হেঁচে উঠলেন। বঙ্কু যেন এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল, লাফিয়ে উঠল—‘কী মশাই, হাঁচবার আর জায়গা পেলেন না, না।’ ভদ্রলোক আবার হাঁচলেন। বঙ্কু এবার ভীষণ উত্তেজিত—‘বেরিয়ে যান, বেরিয়ে যান। বাইরে গিয়ে হেঁটে আসুন। এখানে ভাইরাস ছড়াবেন না। নাকের কাছে চাদর চেপে ধরল।’
—কেউ ইচ্ছে করে হাঁচে না মশাই।
—কেউ ইচ্ছে করে হাই তোলে না মশাই। বঙ্কুর সাফ্ জবাব। ঝগড়া আরও কতদূর গড়াত কে জানে। আমি মধ্যস্থতা করলুম।
—বঙ্কু, বেশ তো ছবি দেখছিলি, আবার কেন গোলমাল করছিস। বঙ্কু চুপ করল। চুপ করে কিছুক্ষণ থাকার পরই বলে উঠল—‘যাঃ, মন খিঁচড়ে গেছে। এই নগা কটা বাজল?’ আমার দিকে কাঁচুমাচু মুখ করে বলল—‘সরি, একস্ট্রিমলি সরি, ভুলে গেছি মাইরি।’
এরপর কিছুক্ষণ শান্তিতে আমরা ছবি দেখলুম। হঠাৎ হলের একেবারে বাঁ দিকের শেষের সারিতে একটা ছোট ছেলে ককিয়ে কেঁদে উঠল। বঙ্কু বল—‘ওই দেখ শ্যামের বাঁশি বেজেছে। বাইরে নিয়ে যান। বাইরে নিয়ে যান।’ বললুম—‘বঙ্কু তুই চুপ কর না।’ ছেলেটার কান্না ইতিমধ্যে আরও বেড়ে গেল। বঙ্কু উঠে দাঁড়িয়ে চেয়ার চাপড়ে চেঁচাতে লাগল—‘বাইরে নিয়ে যান দিদি, না, দাদা। দয়া করে বাইরে নিয়ে যান।’
ছেলের চিৎকারে হয়তো তেমন অসুবিধে হত না, কিন্তু বঙ্কু এমন চেল্লাতে শুরু করল যে সবাই সিনেমা দেখার আশা ছেড়ে দিয়ে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে বসে রইলেন।
—দাঁড়া তো, বঙ্কু গটগট করে, এর পা মাড়িয়ে তার পা মাড়িয়ে বীর দর্পে বেরিয়ে গেল। কোথায় গেল, কী করতে গেল, সে একমাত্র বঙ্কুই জানে। তবে নতুন কোনও ঘটনার জন্য মনে মনে প্রস্তুত হয়ে রইলাম। হঠাৎ দেখি বঙ্কু ফিরে আসছে। কিন্তু এ কী? একেবারে ভগ্নদূতের মতো চেহারা। মুখ চুন। মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে অতি সন্তর্পণে আমার পাশে এসে বসল। মুখে একটাও কথা নেই। কিছু জিগ্যেস করতে সাহস হল না।
বই শেষ হল। সবাই উঠে দাঁড়িয়েছেন বেরিয়ে যাবার জন্য। বঙ্কু আর ওঠে না। —‘কী রে ওঠ। ছবি শেষ।’
বঙ্কু হাতে মুখ ঢেকে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে।
—কী হল রে। আমি একটু সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করি।
—কান্নার কী আছে? ওই কাবলিওয়ালা দেশে ফিরে যাবে। সেখানে তার বউ আছে, মেয়ে আছে, ঘর বাড়ি আছে। আখরোট পেস্তা বাদাম হিং সুরমা আছে।
কথা বলতে বলতে হল প্রায় ফাঁকা হয়ে গেছে। চারিদিকে ফটফটে আলো জ্বলছে। আমি দাঁড়িয়ে, বঙ্কু তখনও বসে। আমাদের পেছনের সারিতে এক বয়স্কা মহিলা একটি সুন্দর চেহারার মেয়েকে নিয়ে ছবি দেখতে এসেছিলেন। বঙ্কুর অবস্থা দেখে, ভদ্রমহিলা সামনে ঝুঁকে বললেন—‘আহা বড় কোমল মন। ঠিক আমার মেয়ের মতো, দুটো রুমাল ভিজিয়ে ফেলেছে।’ মার কথা শুনে, মেয়েটি কান্না-লাল বড় বড় দুটো চোখ তুলে বলল—‘যাঃ, তুমিও তো কেঁদেছ।’
ভদ্রমহিলা বঙ্কুর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন—‘ওঠো বাবা ওঠো। ছিঃ, কাঁদতে নেই। দেখেছিস মিলি, তোর চেয়ে নরম মন, এ বাজারে এমন ছেলে দেখা যায় না।’
ঠিক সেই মুহূর্তে বস্তুর উপর আমার হিংসেই হচ্ছিল। ব্যাটা কেমন একটা জাঁদরেল অভিনয় করে ভদ্রমহিলার মন জয় করে নিল। বলা যায় না, ভদ্রমহিলা শেষে বঙ্কুকে না জামাই করে ফেলেন। আহা এমন একটা সুন্দর মেয়ে! তখন আমার নিজের ডুকরে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল।
ভদ্রমহিলা বঙ্কুর মাথায় হাত দিতেই তার কান্না আরও বেড়ে গেল। বঙ্কু মাথা দুলিয়ে ছোট ছেলের মতো ফুঁপিয়ে ফুপিয়ে বলল—‘ওরে আমি কাবলিটার দুঃখে কাঁদছি না। আমার চাকরি চলে গেছে।’
—চাকরি? আমরা সবাই অবাক।
—চাকরি গেল মানে? এটা কী তোর কারখানা?
বঙ্কু চাদরে জল মুছে বলল—আরে না। ওই তো ওই কোণটায় এ্যায়সা গোঁফ বাগিয়ে ম্যানেজার শা—বসেছিল। ওর ছেলেটাই তো চেঁচিয়ে মরছিল। আমি তেড়ে যেতেই অন্ধকার কোণ থেকে সেই গলা শুনলুম—‘কে বঙ্কুবাবু?’ দর্শন না পেলে কী হয়, পয়লা গলার আওয়াজেই মাল চিনে গেছি। শুনেই তো ভির্মি। কাল কারখানায় গেলেই মাইরি ডিসচার্জ নোটিস। সুধরে, এখনও যে পার্মানেন্ট হয়নি রে!
বঙ্কু আবার ফুঁপিয়ে উঠল। ইতিমধ্যে ঝাড়ুদার এসে গেছে। সিনেমার ওপর সে এই সিনেমা দেখার জন্য প্রস্তুত ছিল না। আমরা চারজন সামনে পিছনে হল থেকে বেরিয়ে এলুম। সবার পিছনে সেই মিলি নামের সুন্দর মেয়েটি। ঝাড়ুদার শব্দ করতে করতে সিটগুলো ভাঁজ করছে আর বলছে—একদম দুবলা আদমী হায়। রোনে কা ক্যায়া হুয়া।