দাওয়াই
যতীশবাবু শব্দ একদম সহ্য করতে পারেন না। আগে পারতেন কি না জানি না, এখন কিন্তু একেবারেই পারেন না। কোনওরকম শব্দ, চিৎকার, চেঁচামেচি হলেই যতীশবাবুর কপালে ঠিক নাকের উপর দুটো ভুরুর মাঝখানে খাঁজ দেখা দেয়, মাথার মধ্যে কে যেন হাতুড়ি পেটাতে থাকে, রক্তের চাপ বাড়তে থাকে, চিন্তা এলোমেলো হয়ে যায়, শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত হতে থাকে, হাতের আঙুল মুঠো হয়ে যায়, বহুদূর থেকে একটা পলতের আগুন এগিয়ে আসতে থাকে। যতীশবাবু একটা বোমার মতো প্রথমে একটু ফুল কেটে দড়াম্ করে ফেটে পড়েন।
যতীশবাবুর এমনই বরাত, শব্দ থেকে তাঁর নিষ্কৃতি পাবার কোনও উপায়ই ভগবান রাখেননি। তাঁর বাড়ি বড় রাস্তার ধারে, সব সময় গাড়ির শব্দ, সাইকেল রিকশার প্যাঁক-প্যাঁক লেগেই আছে। যতীশবাবুর স্ত্রীর গলাও সাংঘাতিক। বারান্দা থেকে—‘বিনু’ বলে ছেলেকে ডাকেন যখন পাশের খাটালে খোঁটায় বাঁধা গরু-মোষ লাফিয়ে ওঠে, বাঁটের দুধ শুকিয়ে যায়। স্বামীকে যখন শোবার ঘরে—‘ওগো শুনছ’ বলেন তখন পাড়ার সকলেই শুনে থাকেন। যতীশবাবুর স্ত্রীর সব কিছুই সশব্দে। ঘটি-বাটি রাখা থেকে শুরু করে দরজা বন্ধ করা পর্যন্ত সব কিছুই পিলে চমকে দেয়। একবার যাত্রার আসরে বসে এমন হাততালি দিয়েছিলেন সকলে ভেবেছিলেন মড়মড় করে প্যান্ডেল ভেঙে পড়ছে। ছুটোছুটি, দৌড়োদৌড়ি। পায়ের চাপে বেশ কিছু আহত। তারপর থেকেই যতীশবাবুর স্ত্রীর কী ডিমান্ড! সভাসমিতি হাততালি দিয়ে পণ্ড করাবার জন্য তাঁকে খাতির করে বিরোধীপক্ষরা নিয়ে যেতেন। ঝগড়াতেও যতীশবাবুর স্ত্রীর সঙ্গে এঁটে ওঠা কারুর বাপের সাধ্যে কুলোবে না। মাঝে মাঝে ভাড়াটের স্ত্রীরা বাড়িওলার সঙ্গে ধুম ঝগড়া করার জন্য যতীশবাবুর স্ত্রীকে বায়না দিয়ে যায়। সময় সময় দুর্বল শাশুড়িরাও আসেন ডাকাবুকো বউদের একটু টাইট দেবার জন্য।
যতীশবাবুর এমনই বরাত, বাড়ির পাশে এক টিন-মিস্ত্রি সম্প্রতি এক কারখানা খুলে বসেছে, অষ্টপ্রহর ধাঁইধাপ্পড় করে টিনের কেনেস্তারা হাতুড়ি পিটিয়ে সোজা করছে। এর উপর আছে রেডিও। পাশের বাড়ির গোটাকতক কাঁদুনে ছেলেমেয়ে। সবার উপরে আছে পাশের হিন্দুস্থানী খাটাল। সন্ধে যেই না হল ঢোল আর ঝুমর নিয়ে দলবেঁধে বসে গেল, ঝম ঝম ঝঁয় ঝঁয় করে চলল মাঝ রাত অবধি। কোথা থেকে একঘর মুচি এসে বসেছে—তারা আবার সকলকে ছাড়িয়ে গেছে। তাদের কাছে কী নেই। ক্লারিওনেট আছে, পিকলু আছে, সানাই আছে, ড্রাম আছে। সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে দু পাত্তর দিশি গলায় ঢেলে তাদের ভাব উথলে ওঠে। সব ক’টা যন্ত্র একসঙ্গে বের করে হিন্দি ছবির মতো হিট গান বে-সুরো বাজাতে থাকে। দলের পাণ্ডা হল কালু মুচি। সে ব্যাটা আবার মাঝে মাঝে কেয়াবাৎ, কেয়াবাৎ করে ষাঁড়ের মতো চেঁচাতে থাকে।
যতীশবাবু প্রথমে বাড়ির লোকদের বোঝাতে চাইলেন। স্ত্রীকে একদিন মাঝরাতে ভুঁড়িতে সুড়সুড়ি দিতে দিতে বেশ নরম গলায় বললেন, ‘হ্যাঁ গো, বয়স তো বাড়ছে, এখন একটু চেঁচামেচি কম করলে হয় না! তোমার চিৎকারে বাড়িতে তো নোনা ধরে সব পলেস্তারা ঝরে গেল।’ যতীশবাবুর কথা শুনে যতীশবাবুর স্ত্রী আধশোয়া হয়ে সেই মাঝরাতেই গাঁক গাঁক করে চিৎকার করে উঠলেন, ‘কী বললে, আমি চিৎকার করি, আমি চিৎকার করি?’ যতীশবাবু তাড়াতাড়ি বললেন, ‘না না, তুমি ঘুমোও, আমার ঘাট হয়েছে।’ ‘কী বললে, ঘাট হয়েছে, ঘাট হলেই হল? বললে কেন আমি চিৎকার করি।’ স্ত্রী রণমূর্তি ধরে বিছানায় উঠে বসলেন। পাশের ঘরেই ছেলেমেয়েরা শুয়ে আছে। যতীশবাবু ঝগড়ার ভয়ে তাড়াতাড়ি খাট থেকে নেংটি ইঁদুরের মতো লাফিয়ে পড়ে বাইরের বারান্দায় পালিয়ে গেলেন। বাকি রাতটা সেখানেই ইজিচেয়ারে শুয়ে শুয়ে মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হয়ে কাটালেন। বুঝলেন স্ত্রীকে মেরামত করা তাঁর চোদ্দ পুরুষের কর্ম নয়।
সাতসকালেই মেজ মেয়েটা একটা ঘ্যাড় ঘ্যাড় ট্রানজিস্টারে বিবিধ ভারতী ধরছিল। একে ব্যাটারির জোর কমে এসেছে। যতীশবাবু মেয়েকে ডেকে বললেন, ‘মা, রেডিওটাকে একটু বিশ্রাম দে না। এই শব্দ তোর ভাল লাগছে?’ মেয়ে অম্লান বদনে বলল, ‘কী বলছ বাবা? কিশোর গাইছে।’ বলেই নিজে সুরে সুর মিলিয়ে গাইতে লাগল, হ্যাঁক্কো, হ্যাঁক্কো ঘ্যাঁ ঘ্যাঁ। গাইতে গাইতে গজেন্দ্র গমনে চলে গেল। যতীশবাবু চুকচুক করে দুবার শব্দ করলেন, এর নাম গান! বুঝলেন, মেয়ে আউট অব কনট্রোল।
রাত থেকেই স্ত্রী অগ্নিশর্মা হয়েছিলেন। অন্য দিন তিনি যখন হাঁটতেন ঘরবাড়ি কাঁপত, সেদিন তাঁর গমন পথে ভূমিকম্প শুরু হল। বাথরুমের দরজা বন্ধ হল, দ্রাম। রান্না ঘরে হাতা পড়ল, ঝনঝন। গলা সব সময়েই সপ্তমে। ছেলেমেয়েদের বলল, ‘তোরা সব নিখাকির মতো গলা করতে পারিস না। এটা বাড়ি নয়, গোরস্থান, সব ফিসফিস করে কথা বলবি।’ যতীশবাবু বুঝলেন সবই তাঁকে ঠেস দিয়ে বলা হচ্ছে।
সাতসকালেই থলে হাতে বাজারের পথে বেরিয়ে পড়লেন। দরকার নেই বাবা, বাড়ি তাঁর জন্য নয়। সকলের জন্য কী সব কিছু হয়। রাস্তায় বেরিয়েও শান্তি নেই। একটা কুকুর বেশ শুয়েছিল, হঠাৎ ধড়মড় করে উঠে আকাশের দিকে মুখ তুলে কানফাটানো ঘেউ ঘেউ শুরু করল। যতীশবাবু বললেন, ‘এই কী হচ্ছে কী! ঘুমো ঘুমো’। ফল হল উল্টো। কুকুরটা যতীশবাবুর পেছন পেছন ডাকতে ডাকতে চলল। যতীশবাবু মনে মনে বললেন, ‘বুঝেছি, এ শালা ভগবানের কারসাজি। ভগবান পেছনে লাগলে কী করা যাবে।’ যার স্ত্রী কথা শোনে না, যার মেয়ে কথা শোনে না, তার কথা শুনবে একটা রাস্তার কুকুর!
যতীশবাবুর পাশ দিয়ে একটা রিকশা হুড়মুড় করে চলে গেল, প্যাঁক প্যাঁক প্যাঁক, প্যাঁক প্যাঁক প্যাঁক করে হর্ন বাজাতে বাজাতে। আর একটু হলে তাঁর কাছার আধখানা খাবলে নিয়ে যেত। যতীশবাবু চিৎকার করে রিকশাওলাকে বললেন, ‘অ্যাই, আস্তে যেতে পারিস না, শুধু শুধু হর্ন বাজাচ্ছিস কেন!’ রিকশাওলা ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, ‘ভাল লাগে দাদা’। ইতিমধ্যে আরও চারপাঁচটা রিকশা ওইভাবে সবেগে বেরিয়ে গেল। যতীশবাবু রাস্তার একপাশে নর্দমা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইলেন—‘যা বাবা তোরাই যা, তোদের যা দাপট!’
যতীশবাবু কোনওরকমে বাজার সেরে তাড়াতাড়ি ফিরে এলেন। বাড়ির রেডিও তখন ঘড়ঘড় করছে। স্ত্রী তেমনি অগ্নিশর্মা। বেড়ালটা পায়ে পায়ে ঘুরছে বলে অ্যাইসা এক লাথি হাঁকড়ালেন, সেটা ফুটবলের মতো সোজা বারান্দার রেলিং টপকে রাস্তায় একটা ফেরিওলার ঝুড়িতে গিয়ে পড়ল। অন্য দিন হলে যতীশবাবু একটু গড়িমসি করে, কাপ কতক চা খেয়ে তারপর অফিসের জন্য প্রস্তুত হতেন। সেদিন আর কোনও কথা নয়, যত তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়া যায় ততই শান্তি। দাড়ি পর্যন্ত কামালেন না। কোনও রকমে মাথায় দু ঘটি জল ঢেলে খেতে বসে গেলেন।
খেতে বসে এ কী ব্যাপার! ছোট মেয়ে সুকুকে ডাকলেন। স্ত্রীর সঙ্গে বাক্যালাপ বন্ধ। সকাল থেকেই দেওয়ালের মধ্যস্থতায় ঠারেঠোরে কথা হচ্ছে। সুকুটার বয়স কম বলেই হোক, কিংবা মেয়েটা একটু বাপঘেঁষা বলেই হয়তো এখনও তেমন বিগড়ে যায়নি। যতীশবাবু মেয়েকে বললেন, ‘জিজ্ঞেস কর তো, আমাকে কী গরু ভেবেছে? এই জাবনাটা দেবার মানে কী?’ সুকু দেখল যতীশবাবুর পাতের ডানদিকে বিশাল এক থাবা শাকের তরকারি। যতীশবাবু একে আমাশার রোগী, শাকপাতা দেখলেই তাঁর পেট মুচড়ে ওঠে। স্ত্রী রান্নাঘর থেকে হেঁকে বললেন, ‘খেয়ে নিতে বল। আজ থেকে ওই ব্যবস্থা। শরীরে ভিটামিন কমে গেছে, তাই ওরকম খিটখিটে স্বভাব হয়েছে, আস্তে কথা বললে জোরে শুনছে।’ যতীশবাবু সাময়িকভাবে ভুলে গেলেন, স্ত্রীর সঙ্গে কথা বন্ধ। শাক থালা থেকে মেঝেতে নামিয়ে দিয়ে ভেঙচে উঠলেন, ‘থাক, খুব হয়েছে, আমার চিকিচ্ছে আর আপনাকে দয়া করে করতে হবে না, তার জন্য ডাক্তার আছে, আমি নিজে আছি।’ যতীশবাবুর স্ত্রী রান্নাঘর থেকে মুখ বাড়িয়ে বললেন, ‘সকলেই আছে তবে দাঁত চিরকুটে পড়লে আমাকেই তখন দেখতে হবে, কেউ আসবে না সেবা করার জন্য।’
‘ওরে আমার সেবিকারে, সেবাদাসী’ যতীশবাবু অদ্ভুত গলা করে বললেন, ‘সেবার ছিরি আমার জানা আছে। সেই যেবার আমার জ্বর হল, বললাম মাথাটা একটু টিপে দাও, উনি করলেন কী কপালে দুবার হাত বুলিয়ে বসে বসেই ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোলেন, মোষের বাচ্চার মতো। সেবা! সেবা দেখিও না, সে সব আগেকার যুগের মানুষদের দেখেছি, বাবার জ্বর হল মা সাত রাত ঠায় জেগে।’
এইবার যতীশবাবুর স্ত্রী রান্নাঘর থেকে পুরোপুরি নিজেকে বের করে আনলেন। ছোট মেয়ে সুকু হাঁ করে দাঁড়িয়েছিল, প্রথম ঝলটা তার উপর ঝাড়লেন, ‘তোর কাজ নেই, এখানে দাঁড়িয়ে সার্কাস দেখছিস?’ সুকু সুড়সুড় করে বাইরের ঘরের দিকে পালাল। স্বামীর দিকে ফিরে হাত পা নেড়ে বললেন, ‘যা বলবে আমাকে বলবে, বাপ তুলবে না।’
‘বাপ তুলবে না! বাপ আবার তুললুম কখন? আমার বাবার কথা বললুম।’
‘আজ্ঞে না, তোমার বাবাকে তুমি কাঁধে করে বসে থাকো আমার বয়ে গেছে। মোষের বাচ্চা কাকে বললে, তার মানে আমার বাবা ভঁইস! আমি জানি না, একটু মোটা ছিলেন বলে তোমরা কম হাসাহাসি করেছ? শেষে তিনি এ বাড়িতে আসাই ছেড়ে দিয়েছিলেন।’
যতীশবাবু কথাটা অত ভেবেচিন্তে বলেননি। তিনি একটু বিব্রত হলেন, কিন্তু না, আজ আর সহজে তিনি হারবেন না। কেশে গলাটা ঝেড়ে নিয়ে বেশ জোরের সঙ্গে বললেন, ‘চোরের মন বোঁচকার দিকে, তোমার বাবার চেহারা এতদিনে আমি ভুলেই গেছি, আমি তোমার মতো অত ছোটলোক নই। মোটাকে মোটা বলব, বুড়োকে বুড়ো। ওটা তোমার শিক্ষা, ইওর কালচার।’ ইংরেজিটা এতক্ষণ আসছিল না, তাই যতীশবাবু ঠিক জোর পাচ্ছিলেন না। ‘আজকাল কথায় কথায় ছেলেমেয়েদের সামনে বুড়ো বুড়ো বলো, এমনকী সেদিন একবার মিনসে পর্যন্ত বলেছ, মোস্ট ইনসালটিং। আমি তোমার এই হতচ্ছেদ্দার খাবার খাব না, ভুখা মরেঙ্গে সেও ভী আচ্ছা, তবু এই গঞ্জনা কা তণ্ডুল, সব ভণ্ডুল করকে চলা জায়গা।’ যতীশবাবু হিন্দি দিয়ে তাঁর থিতিয়ে পড়া রাগকে একটু উসকে দিলেন, তারপর হাত দিয়ে ভাত তরকারি সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়ে আসন থেকে উঠে পড়লেন। ওঠা কী অত সোজা! বয়েস তো সত্যিই হচ্ছে। এক জায়গায় অনেকক্ষণ বসে থাকলে উঠতে অসুবিধে হয়। হাঁটুতে বাত। উঠতে গিয়ে একটু টাল খেলেন। ডালের বাটিতে একটু পায়ের ধাক্কা লেগে গেল, খানিকটা ছলকে মেঝেতে পড়ল।
যতীশবাবুকে এত সহজে মুক্তি দেবার মেয়ে তাঁর স্ত্রী নন। দৌড়ে এসে যতীশবাবুর কোমর চেপে আসনে আবার বসিয়ে দিলেন। হাঁটুর জোর কমে গেছে, তার উপর কোমরে সুড়সুড়ি লাগছিল। যতীশবাবু ধপাস করে থেবড়ে বসে পড়লেন। যতীশবাবুর স্ত্রী এবার নিজ মূর্তি ধরলেন, সেই দনুজদলনী চেহারা, ‘পালাচ্ছ কোথায়? না খেয়ে এক পা নড়ো দেখি কেমন তুমি বাপের ব্যাটা! যা ফেলেছ সব আজ গেলাব, পয়সা খুব সস্তা তাই না। রক্ত জল করা পয়সা!’ ভাত যা ছড়িয়ে গিয়েছিল সব থালায় গুছিয়ে দিলেন, শাকের নাদাটা মেঝে থেকে থালায় তুলে দিলেন। যতীশবাবু সঙ্গে সঙ্গে নাদাটা আবার মাটিতে নামিয়ে দিলেন, যতীশবাবুর স্ত্রী আবার তুলে দিলেন, যতীশবাবু আবার নামিয়ে দিলেন, স্ত্রী আবার তুলে দিলেন। কারুর মুখে কোনও কথা নেই। ঝাঁপি খেলার মতো এই খেলা কিছুক্ষণ চলল, শেষে যতীশবাবু ধৈর্য রাখতে না পেরে তরকারির পুরো তালটা স্ত্রীর চাকাপানা মুখে আবীরের মতো মাখিয়ে দিলেন।
ঘটনাটা মুহূর্তে ঘটে গেল। যতীশবাবুর স্ত্রী প্রথমটা ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু পারুলবালাও ছাড়বার পাত্রী নন। স্ত্রীর আক্রমণটা এবার কোন দিক থেকে আসবে বোঝার আগেই পারুলবালা যতীশবাবুর টাকে ডালের বাটিটা উপুড় করে দিলেন। বাটিটা মাথার মাঝখানে ফেজের মতো আটকে রইল হাওয়ার চাপে। সুকু এতক্ষণ বোধহয় দরজার ফাঁক দিয়ে বাবা আর মার কেরামতি দেখছিল। হাসি চাপতে না পেরে খুক খুক করে হেসে উঠল। যতীশবাবু নিজেকে সামলে নিলেন অনেক কষ্টে। ইচ্ছে করছিল হিন্দি ছবির কায়দায় ঘিচুং করে স্ত্রীর থ্যাবড়া নাকে একটু ঘুষি ঝেড়ে দেন। অনেকদিন ধরেই ঘুষিটা ভেতরে জমে আছে। তবে বলা যায় না, পারুলবালা যে টাইপের মেয়ে, ঘ্যাঁ করে কামড়ে দিতে পারে। একবার মানিব্যাগ নিয়ে হাতকাড়াকাড়ির সময় যতীশবাবুর হাতে কামড়ে দিয়েছিল। সামনের দুটো দাঁত হাতে বসে গিয়েছিল। ডাক্তারখানায় দৌড়তে হয়েছিল। ডাক্তার জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘মরে গেছে, না বেঁচে আছে। দিন কতক অবজার্ভ করবেন। যদি দেখেন ঝিমিয়ে পড়ছে তাহলে তলপেটে চোদ্দটা।’ যতীশবাবু প্রথমটা বুঝতে পারেননি, তলপেটে চোদ্দটা শুনে বুঝলেন, তাড়াতাড়ি বললেন, ‘না না, অনেকদিনের পোষা কুকুর, মোস্ট ফেইথফুল।’ ডাক্তার বললেন, ‘দূর মশাই ফেইথফুল, রাবিশ হতে কতক্ষণ! ভাদ্র মাসে কুকুরদের মেটিং সিজন। পেয়ার আছে?’ যতীশবাবু একটু ঢোঁক গিলে বললেন, ‘হ্যাঁ পেয়ার আছে!’
‘কী জাতের কুকুর, পেডিগ্রি?’
যতীশবাবু বললেন, ‘টেরিয়ার ফেরিয়ার হবে, ফক্স কী বুল যা হয় একটা।
ডাক্তারবাবু মারকিউরোক্রোম দিয়ে ছেড়ে দিলেন। হাতের ঘা নিয়ে দিন পনেরো ভুগেছিলেন। পারুলবালার দাঁতে কম বিষ!
যতীশবাবু তাড়াতাড়ি সেই দক্ষযজ্ঞ থেকে উঠে পড়লেন। ভুঁড়ি বেয়ে মুগের ডালের স্রোত কুঁচকি পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। সকালের লাথি খাওয়া বেড়ালটা ইতিমধ্যে কোন ফাঁকে উঠে এসেছে। সে ব্যাটা তক্কেতক্কেই ছিল। এক ফাঁকে মাছের টিকলিটা যতীশবাবুর থালা থেকে তুলে নিয়ে মিটসেফের তলায় গিয়ে ঢুকল। বাথরুম থেকে পারুলবালার গলা শুনলেন, ‘উনুনে এক ঘটি জল ঢেলে দে সুকু, পিণ্ডি আজ আর কাউকে গিলতে হবে না। আমিও ছোট দারোগার মেয়ে, দেখিয়ে দেব কত ধানে কত চাল।’ যতীশবাবু একটু নার্ভাস হয়ে গেলেন, তারপর মনে মনে বললেন, যতীশ তুমি বৃন্দাবন গাঙ্গুলির ছেলে, যাঁর দাপটে তোমার মা আধমরা হয়ে বিয়ের পর মাত্র সাত বছর বেঁচেছিলেন। যাঁর ভয়ে তুমি বিয়ের পর তিন বছর ব্রহ্মচারী হয়ে ছিলে। সেই বৃন্দাবন গাঙ্গুলি যাঁর বাটার-ফ্লাই-গোঁফ-শোভিত তিরিক্ষি মুখ মনে পড়লে তোমার তালু এখনও শুকিয়ে যায়। যতীশবাবু এইভাবে একটু বল সঞ্চয় করলেন তারপর কুরুক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণের মতো নিজেকে সম্বোধন করে বললেন, পার্থ ডোন্ট গেট নার্ভাস, ক্লীব হয়ো না, গাণ্ডীব পাকড়াও, পারুলবালা একটা প্রতিদ্বন্দ্বীই নয়, সে তো মরেই আছে, তুমি শুধু টাঁই করে তীরটা একবার ছেড়ে দাও। প্রথমটা বাথরুমের দরজা খুলতে ভয় পাচ্ছিলেন, পারুলবালা যদি তেড়ে আসে। কিন্তু কতক্ষণ বাথরুমে থাকা যায়। যা থাকে বরাতে। না, ত্রিসীমানায় গৃহিণী নাস্তি। হুঁ হুঁ হুঁ হুঁ বিপদে মোরে রক্ষা করো, হুঁ হুঁ বিপদে মোরে—যতীশবাবু গুন গুন করতে করতে এগোচ্ছিলেন, ‘কী রে, তুই?’ সামনে তাঁর মাসকাবারি রিকশাওয়ালা। ব্যাটা ওপরে উঠে এসেছে। ‘বাবু অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি, আধঘণ্টা ধরে হর্ন দিচ্ছি।’
‘দাঁড়া বাবা এখুনি আসছি।’ যতীশবাবু প্রাণে বাঁচলেন। রিকশাওলা ভজুয়ার সামনে পারুলবালা কিছু করবে না। বাড়ি থেকে বাসস্ট্যান্ড অনেকটা দূরে বলে যতীশবাবু মাসকাবারী রিকশার ব্যবস্থা করেছেন।
সারাদিন অফিসে কাজে তেমন মন বসল না। অনেকদিন পরে এই রকম একটা বিশ্রী গোলমাল হল। আসলে ব্যাপারটা তিল থেকে তাল হয়ে গেল। যতীশবাবু ইদানীং নিজের অপছন্দের কথা তেমন বলেন না। প্রবল প্রতিপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করে মোটামুটি শান্তিতেই দিন কাটছিল। হঠাৎ যে কী হল। তাঁর পরিবারের ধারাই ছিল আস্তে কথা বলা, আস্তে চলা। পিতা বৃন্দাবন গাঙ্গুলি এই সব জিনিসকে আরিস্টোকেসি বলে মনে করতেন। শোনা যায় যতীশবাবুর বাবার বাবা সারাদিনে তিন চারটের বেশি কথা বলতেন না, আর তাও বলতেন এত আস্তে যে, কানে ‘হিয়ারিং এড’ না লাগালে শোনা যেত না। তাঁর সমস্ত কাজটা ছিল খুব আস্তে। ঠাকুমা মারা যাবার সময় স্বামীর হাতে জল চাইলেন। ঠাকুরদা বাটি থেকে চামচে করে গঙ্গা জল এত ধীরে ধীরে দিতে গেলেন যে সে জল ঠাকুমার ঠোঁট অবধি পৌঁছবার আগেই তিনি গঙ্গাযাত্রা করলেন। সকলে বললেন, নিবারণ, একটু তাড়াতাড়ি করা উচিত ছিল, আহা শেষ জলটা বুড়ির কপালে জুটল না! ঠাকুরদা নিবারণ গাঙ্গুলি ফিসফিস করে বলেছিলেন, ‘আমার একটা ধারা আছে, বুঝেছ, তার বাইরে আমি যেতে পারব না।’ সেই বংশের ছেলে যতীশবাবু এখন দারোগার মেয়ের পাল্লায় পড়ে টেকো মাথায় না খেয়ে অফিসের চেয়ারে বসে বিড়ি ফুঁকছেন।
বেলা তিনটে নাগাদ দু’পিস টোস্ট, কাপ কয়েক চা খেয়ে যতীশবাবু একটু ধাতস্থ হলেন। সম্প্রতি অফিসে তাঁর একটি ছোকরা অ্যাসিস্টেন্ট জুটেছে, বেশ চৌকোস ছেলে, আধুনিক জগতের অনেক রকম ঘাঁতঘোঁত জানা আছে। যতীশবাবু ছেলেটিকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, কোথায় গেলে একটা ভাল হর্ন কিনতে পারা যাবে বলো তো?’ ছেলেটি প্রথমে একটু অবাক হয়ে গিয়েছিল। সামলে নিয়ে বলল, ‘কী হর্ন? ইলেকট্রিক না প্যাঁক প্যাঁক?’
যতীশবাৰ বুঝিয়ে দিলেন, ‘সামনের দিকটা ঘোরানো চোঙার মতো আর পিছনে একটা রবারের বল থাকবে, আওয়াজটা বেশ গুরুগম্ভীর চাই, ঠিক প্যাঁক প্যাঁক নয়, ভ্যাঁক ভ্যাঁক’। ছেলেটি বলল, ‘নতুন কিনতে গেলে অনেক দাম পড়বে, মল্লিক বাজারে পুরনো ভাল জিনিস পাওয়া যায়, দাম কম’। যতীশবাবু খুব আশান্বিত হলেন, ‘তুমি আমাকে একটা কিনে দেবে?’ ছেলেটি প্রবীণ মানুষের অনুরোধ ঠেলতে পারল না।
সন্ধের বেশ কিছু পরে যতীশবাবু বেশ বড় সাইজের একটি হর্ন কাগজে মুড়ে বুকের কাছে চেপে ধরে বাস থেকে নামলেন। সোজা বাড়ি ঢুকতে সাহস হচ্ছিল না। বাড়ির আবহাওয়া কী রকম কে জানে! প্রথমে পাড়ার চায়ের দোকানে বসে এককাপ চা খেয়ে একটু শক্তি সঞ্চয় করে নিলেন, তারপর যা থাকে বরাতে বলে গুটি গুটি বাড়ি ঢুকলেন। আবহাওয়া বেশ থমথমে মনে হল। বাইরের ঘরে সুকু পড়ছে। বাবাকে ঢুকতে দেখে সে একটু মুচকি হাসল। বেড়ালটা গুটিসুটি মেরে পাপপাশের ওপর শুয়ে আছে। বেড়ালটাকে দেখে যতীশবাবুর হিংসে হল, আহা তিনি যদি বেড়াল হতেন। মানুষের অনুভূতিই মানুষের দুঃখের কারণ। সকালে অমন একটা লাথি খেয়েও কেমন সুখে ঘুমোচ্ছে। যতীশবাবু এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে পড়লেন। পারুলবালাকে দেখতে না পেলেও বুঝতে পারলেন কোথাও আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে এবং সারাদিন জলস্পর্শ করেনি। সেই ওল্ড ডার্টি ট্রিক! যতীশবাবু গোঁফের ফাঁকে মুচকি হাসলেন। এবারে যতীশচন্দ্র আর মান ভাঙাবার জন্য কোনও চেষ্টা করবে না। অদৃশ্য পারুলবালার উদ্দেশে বললেন, ‘দিস টাইম ইউ উইল সি অ্যানাদার যতীশচন্দ্র।’
টেবিলের ড্রয়ার খুলে যতীশবাবু একটা শক্ত দড়ি বের করলেন। ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সারা ঘরটা একবার ভাল করে দেখে নিলেন। কোন্ জানালাটা! ইয়েস দিস ওয়ান। বারান্দার দিকে দক্ষিণের জানালাটাই ভাল হবে। ফুর ফুর করে হাওয়া আসছে। কাগজের মোড়ক থেকে হর্নটা বের করলেন। তেমন চকচকে নয় তবে সাংঘাতিক আওয়াজ। অফিসের ছোকরাটির এলেম আছে! হর্নটাকে জানালার গ্রিলের সঙ্গে বেশ ভাল করে বাঁধলেন। জীবনটাই হল সাধনা, জীবন সাধনা। ব্যাটা যতীশ, শব্দ তোমার সহ্য হয় না, না? দাঁড়াও, এইবার তোমাকে শব্দসমুদ্রে ভাসিয়ে দেব। তোমার স্পর্শকাতর শ্রবণেন্দ্রিয়কে একেবারে ভোঁতা করে দেব।
অফিসের জামা কাপড় ছেড়ে ফেললেন। কাপড়টাকে লুঙ্গির মতো করে পরে একটা চেয়ার টেনে আনলেন জানালার কাছে। সারা বাড়ি অস্বাভাবিক নিস্তব্ধ। মুচিদের আসর আজ বসেনি। খাটালের কালোয়াতরাও আজ নিস্তব্ধ। বাড়ির রেডিওটাও বিশ্রাম করছে। পাশের বাড়ির বাচ্চাদের কী হয়েছে কে জানে? যতীশবাবু প্রথমে হর্নটার গায়ে একবার হাত বুলোলেন। বাঃ, রবারের থলথলে জিনিসটায় হাত দিতে বেশ ভাল লাগে তো? ও, তাই ব্যাটা রিকশাওয়ালারা কারণে-অকারণে হর্ন বাজায়, বুঝেছি! আচ্ছা প্রথমে কালোয়াতি নয়, কয়েকটা সহজ সরল ফ্ল্যাট শব্দ বের করা যাক। যতীশবাবু হর্ন টিপলেন। প্রথম আওয়াজটা তেমন হল না। ফস করে খানিকটা হাওয়া বেরিয়ে গেল। দ্বিতীয় শব্দটা বেশ জুতসই হল, ভঁঅক। যতীশবাবু বেশ উৎসাহিত হলেন। একটু সরে এলেন কাছে, তারপর বেশ জুতসই করে বসে পরপর কয়েকটা ছাড়লেন ভঁঅক, ভঁঅক, ভঁঅক। তারপর একটু দ্রুত ভঁক ভঁক, ভঁক ভঁক। হাতটা ক্রমশই অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। বাবা, সাধনায় কী না হয়? এবার বেশ খেলিয়ে বাজালেন ভ্যাঁক ভ্যাঁক।
প্রথমেই সুকু দৌড়ে এল। ‘কী হচ্ছে বাবা?’
‘দেখতেই পাচ্ছ। গাড়ি গাড়ি খেলছি’ উত্তর দিতে দিতেই বার কতক বাজিয়ে নিলেন। না বাজিয়ে থাকা যাচ্ছে না, হাত নিসপিস করছে। যতীশবাবুর গলা দিয়ে পুরনো আমলের এক কলি গান বেরিয়ে এল, ‘আজ সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে’ ভ্যাঁক ভ্যাঁক। আজ সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে’ ভ্যাঁক ভ্যাঁক ভ্যাঁক ভ্যাঁক ভ্যাঁক। সুকু অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে ঘরের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে রইল। ঘরে ঢুকতে সাহস হল না। বাবার মাথায় গোলমাল হয়নি তো। যতীশবাবু মেয়েকে বললেন, ‘রেডিওটা চালা না, রেডিওটা! বিবিধভারতী করে দে’ ভ্যাঁক ভ্যাঁক।
পারুলবালা পাশের ঘরেই ছিলেন। সারাদিন অসম্ভব চোখের যন্ত্রণা হয়েছে। মাথা তুলতে পারেননি। শব্দটা শুনেছিলেন। ভেবেছিলেন রাস্তায় হচ্ছে। সুকুর গলা শুনে আস্তে আস্তে উঠে এলেন। মেয়েকে ধরা ধরা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে রে? সুকু বলল, ‘বাবা’, বাকি কথা মুখ দিয়ে বেরোল না, কেঁদে ফেলল। সে ধরেই নিয়েছে বাবা পাগল হয়ে গেছে। পারুলবালা ব্যাপারটা একটু বুঝে নিয়ে ঘরে ঢুকে পড়লেন।
‘এটা কী হচ্ছে?’ যতীশবাবু হর্নের ভাষায় উত্তর দিলেন, ভ্যাঁক ভ্যাঁক।
‘জিজ্ঞেস করছি এটা কী?’ যতীশবাবু এবার বেশ খেলিয়ে বললেন, ভ্যাঁক ভ্যাঁক ভ্যাঁকা ভঁক।
পারুলৰালার মাথায় তখন আগুন জ্বলছে, একে সারাদিন খাওয়া নেই। ‘ও, আজ আবার সিদ্দি গিলে আসা হয়েছে! বুড়ো বয়েসে ভীমরতি!’
যতীশবাবু মাঝেমধ্যে সিদ্ধি খেয়ে থাকেন। পিতা বৃন্দাবন খেতেন, তস্য পিতা নিবারণচন্দ্র খেতেন, ফ্যামিলি ট্র্যাডিশান। যতীশবাবু একবার সত্যনারায়ণ পার্কের কাছে একটা দোকান থেকে তিনগুলি সিদ্ধি আর মালাই খেয়ে ভীষণ কেলেঙ্কারি করেছিলেন। বাসে আসতে আসতে নেশাটা বেশ চড়ে গেল। বাড়ির কাছে এসে তাঁর মনে হল, তিনি যতীশ নন, ভরত। পা থেকে জুতো দুপাটি খুলে মাথায় রাখলেন, শ্রীরামচন্দ্রের পাদুকা বহন করে নিয়ে আসছেন। সেই জুতো দুপাটি মাথায় নিয়ে বাড়ি ঢুকেই পারুলবালাকে বললেন, ‘বউদি, এই দেখে দাদার পাদুকা, আজ থেকে অযোধ্যার সিংহাসনে এই দুপাটি জুতো বসবে।’ সুকুকে বলেছিলেন, ‘লব-কুশ, তোদের বাবাকে দেখে এলাম অশোক বনে মর্তমান খাচ্ছেন। ব্যাটা একদম বখে গেছে।’ তারপর জুতো দুপাটি বুকে নিয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে বুড়ো বয়েসে তোশক ভিজিয়ে ফেলেছিলেন।
পারুলবালা ভাবলেন, সেই কেস। ‘দাঁড়াও মিনসে, তোমার নেশা কী করে ছোটাতে হয় আমি দেখছি। পারুল এখনও মরেনি। এই সুকু, যা তো রান্নাঘরে সেরখানেক তেঁতুল আছে, গুলে নিয়ে আয়।’ যতীশবাবু ঘাবড়ে গেলেও বাজানো বন্ধ করেননি। ইতিমধ্যে কালু মুচির কালোয়াতি শুরু হয়ে গেছে। খাটালওলাদের ঢোলের শব্দও শোনা যাচ্ছে।
পারুলবালা দুমদুম করে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। বেরোতে বেরোতে বললেন, ‘আজও তুমি খাট ভাসাবে ভেবেছ, না। ভাঙখোর, তোমার শয়তানি আমি ভাঙছি।’ যতীশবাবুর হাতের জোর ততক্ষণে কমে এসেছে। হর্ন বাজছে, তবে কেঁপে কেঁপে।
প্রথমে পারুলবালা ঘরে এলেন হাতে এক বালতি জল। যতীশবাবু বাধা দেবারও সময় পেলেন না, পারুলবালা হুড় হুড় করে মাথায় ঢেলে দিলেন, তারপর মেঝেতে সেই থই থই জলের উপর যতীশবাবুকে চিৎ করে ফেলে, একসের তেঁতুল গোলা জল জোর করে খাইয়ে দিলেন।
প্রচণ্ড টকে দাঁত গলে যাবার জোগাড়। খালি পেটে চায়ের সঙ্গে তেঁতুল গোলা জল ঘুলিয়ে উঠল। মেঝেতে শিবনেত্র হয়ে শুয়ে শুয়ে শুনলেন, পারু বলছে, ‘আজ সারারাত ওইখানে থাকবে, নেশাখোরের মরণ, যা করার ওই মেঝেতে করবে। খাটে উঠেছ কী ফেলে দেব। আমার গতরটা সস্তা, না! কাল থেকে স্রেফ বাসভাড়াটা পাবে। দেখি নেশার পয়সা আসে কোথা থেকে।’
যতীশবাবু মেঝেতে শুয়ে শুয়ে খাটের তলা দিয়ে বাইরের ঘরের অনেকটা দেখতে পাচ্ছিলেন। বেড়ালটা পাপপাশে সেভাবে মৌজ করে শুয়ে আছে। বেড়ালে আর যতীশে তফাত কোথায়! দুটোই এ বাড়ির পোষ্য জীব। ঝ্যাঁটা খাও, লাথি খাও, আবার ফিরে এসো। জোড়া জোড়া পা দেখা যাচ্ছে। ও! ছেলে মেয়েরা মজা দেখতে জড়ো হয়েছে, ছি ছি। ঠিক আছে, আজ সারারাত মেঝেতে জলে পড়েই কাটাব। নিমোনিয়া হোক, প্লুরিসি হোক, আমি তাই চাই। পাঁজরটা মেঝেতে জলের উপর ভাল করে ঠেকিয়ে রাখলেন। বেশ শীত করছে। করুক।
মাঝরাতে যতীশবাবু দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, ‘তোমাকে আমি বিধবা করে এর প্রতিশোধ নেব, আমার নাম যতীশচন্দ্র।’ পারুলবালা খাটে পাশ ফিরে শুতে শুতে উত্তর দিলেন, ‘আসুক না যম মুখপোড়া, ঝেঁটিয়ে বিদেয় করব। পারুলবালার শাঁখা খুলবে যমের বাবারও সাধ্যি নেই।’
হর্নটা বিক্রি করে পারুলবালা তিনদিন মনের আনন্দে হিন্দি ছবি দেখলেন।