দুই পিতা
‘ট্যাং’ করে ঘড়িতে একটা শব্দ হল। রাত সাড়ে দশটা। ঘড়িটা অনেক কালের প্রাচীন। পরমেশ্বরের গোঁফ জোড়ার মতোই পুরনো। সস্তা জাপানি ওয়াল ক্লক। মেজাজ অনেকটা পরমেশ্বরের মতো। কোনও ভণিতা না করেই দুম করে সময় ঘোষণা করে। পরমেশ্বরের সব কিছুই প্রাচীন। এখন যে আমকাঠের তক্তপোশের উপর বসে বসে চুমুক দিয়ে তারিয়ে তারিয়ে এক গেলাস দুধ খাচ্ছেন, সেটার বয়স কম হবে না। ইচ্ছে করলেই একটা ভাল খাট কিনতে পারতেন, কেনেননি। টাকাটা ব্যাঙ্কে সুদে বাড়ছে। ঘুমটাই বড় কথা, খাটটা বড় নয়। বিছানাটাও একটা অদ্ভুত সমন্বয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কন্ট্রোলে কেনা মিলিসিয়ার খোলের মধ্যে শিমুল আর কাপাস তুলো ঠেসে ঢোকানো। চাদর একটা বড় বহরের মার্কিন। মশারি এক সময় সাদা ছিল, এখন ধূসর। বেশি টানাটানি সহ্য হবে না বলে ঝলমল করে ঝুলছে। একটা পাশ গোটানো, সেই অংশে পরমেশ্বর বসে আছেন। হাতে ধরা গেলাস। গেলাসে সরওলা গরুর দুধ। গেলাসটাও বহুকালের। পরমেশ্বরের হাতে সব কিছুরই পরমায়ু বেড়ে যায়। এমনকী নিজের জীবনেরও। পরমেশ্বরের সঙ্গে যাঁরা জীবন শুরু করেছিলেন তাঁদের অনেকেই আবার নতুন জন্ম পেয়েছেন।
ঘড়ির শব্দের কোনও ঝঙ্কার নেই। একটা ভারী ধাতব শব্দ। পরমেশ্বর চোখ তুলে তাকালেন। গোঁফের উপর একটু সর জড়িয়ে আছে।—বড্ড দেরি হচ্ছে। কথাটা বললেন একটু দূরে টুলের ওপর বসে-থাকা ছেলেকে লক্ষ করে। ছেলের নাম বঙ্কিম। বঙ্কিম অপরাধীর মতো মুখ করে বসে রইল, বাবার গোঁফের উপর লেগে থাকা সরের দিকে তাকিয়ে। সে জানে সরটা মুখে যাওয়া-আসার পথের উপর এমন একটা অনুভূতিহীন অংশে পাশ কাটিয়ে সরে গেছে, পরমেশ্বরকে না বলে দিলে সরের অংশটা ওইখানেই সারারাত নিরাপদে থেকে যাবে। পরমেশ্বরের মতে সরই হল দুধের সারাংশ। যেদিন দুধে সর পড়ে না, সেদিন তিনি বাড়িতে কোর্ট বসিয়ে ফেলেন। সর কোথায় গেল না জানা পর্যন্ত নিস্তার নেই।
বঙ্কিম আজ অপরাধী। অপরাধীর কথা বলা উচিত নয়, তা না হলে সে গোঁফের উপর সরের কথাটা সবিনয়ে স্মরণ করিয়ে দিতে পারত। বঙ্কিমের অপরাধের সীমা নেই। প্রথম অপরাধ, সে প্রেম করে বিয়ে করেছে। হাফ প্রেম, হাফ সম্বন্ধ। পরমেশ্বরেরই এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মেয়ে। প্রেমটা যখন প্রায় বিপজ্জনক সীমায় এসে ঠেকেছে তখনই সে স্টিয়ারিং ছেড়ে দিয়েছে পরমেশ্বরকে। প্রথমে খেলছিল তারা দুজনে, সেকেন্ড হাফ খেললেন পরমেশ্বর আর পরমেশ্বরের বাল্যবন্ধু। তখন নায়ক নায়িকারা গ্যালারির রুদ্ধশ্বাস দর্শক। গোল হতে হতে হয় না। শেষে পরমেশ্বরের বন্ধু জালে বল জড়িয়ে দিয়ে, ঝাড়া হাত-পা হয়ে বিদেশ চলে গেলেন।
বঙ্কিমের উপর পরমেশ্বরের সেই থেকে রাগ। মূর্খ ছেলে। বিয়ে করলি, করলি, তা বলে এইভাবে! পাওনা গণ্ডা নিয়ে একটু দর কষাকষির স্কোপ রাখলি না। উল্টে বউভাতে ব্যাঙ্ক ব্যালেন্সে হাত পড়ে গেল। নেহাত সবেধন নীলমণি। পরমেশ্বর ব্যাপারটা মেনে নিলেন।
দ্বিতীয় অপরাধ, পরমেশ্বর ছেলেকে সোজাসুজি বলেছিলেন—দ্যাখো বিয়ে করেছ, করেছ, তোমার ইনকাম তেমন ভাল নয়, এখনই যেন সন্তান-সন্ততি না হয়। ছেলেপুলে না বলে শুদ্ধ ভাষা বললেন। পরমেশ্বরের এইটাই বৈশিষ্ট্য। রেগে গেলে বলেন, ব্লাডি বাগার। বঙ্কিমের শ্বশুরমশাই বিয়েটা খুব কম খরচেই সেরেছিলেন। একটি হাতঘড়ি, পাঞ্জাবি-ধুতি, একজোড়া জুতো, কয়েক ভরি সোনা, হাজার খানেক টাকা নগদ। একটা বিছানা। খাট দেননি। কারণ বংশের কোনও এক জামাই খাটে বসে ফুলশয্যার রাতে হুঁকো খেতে গিয়ে পুড়ে মারা গিয়েছিলেন, সেই অপরাধে বঙ্কিমের বরাতে খাট জোটেনি। পরমেশ্বরই ছেলে-বউকে একটা কায়দার খাট কিনে দিয়েছিলেন। পরমেশ্বর ভেবেছিলেন, খাটের শাসনে প্রথম বিয়ের উচ্ছ্বাস ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। হয়েছিলও তাই। বউয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবে কী, সারা রাত শবাসনে শুয়ে থাকত। পাশ ফেরারও উপায় ছিল না। কিন্তু বয়সের এমন দোষ, বছর না ঘুরতেই বঙ্কিম ফাদার হতে চলেছে। এই সেই রাত। ফাদারের সামনে টুলে বসে আছে অপরাধীর মতো মুখ করে। বউ নার্সিংহোমে। খবর আসবে শ্যালকের সাইকেলে। রাত সাড়ে দশটা হয়ে গেল। এখনও কোনও খবর নেই।
তৃতীয় অপরাধ বঙ্কিমের নয়, বঙ্কিমের বউয়ের। দশটার মধ্যে পরমেশ্বর শুয়ে পড়েন। পরমেশ্বরের নিয়মের রাজত্ব আর এক পরমেশ্বরের চেয়ে কম যায় না। তাঁর নিয়মের ঠেলায় স্ত্রী অনেক আগেই চলে গেছেন। বঙ্কিমের ওপরে একটি বোন ছিল, সেও সরে পড়েছে। কেবল বঙ্কিমই আটকা পড়ে গেছে। তাকে খাওয়াদাওয়ার পরে ঘরের মধ্যে গুনে গুনে একশো বার পায়চারি করতে হবে। প্রথম রাতে বাঁ পাশে কাত হয়ে শুতে হবে। মধ্যরাতে চিৎ। শেষ রাতে ডানপাশ। সকালে খালি পেটে এক গেলাস জল। চায়ে চুমুক দেবার সময় শব্দ হবে না, খেতে খেতে চক চক শব্দ করা চলবে না। জোরে হাসা চলবে না, হাসলেও দাঁত দেখা যাবে না। বউয়ের শাড়ির তলা থেকে সায়া বেরুবে না। চলার সময় পায়ের শব্দ শোনা যাবে না। গুন গুন করে গান চলবে না। সিনেমা, যাত্রা, থিয়েটার ঘন ঘন নয়, মাঝে-মধ্যে একটা। খাবার পর শব্দ করে ঢেঁকুর নট অ্যালাউড। সেই পরমেশ্বর আজ পৌনে এগারোটার সময়েও শুতে যাননি, কারণ বঙ্কিম, কারণ বঙ্কিমের বউ। বঙ্কিমের বউ কেন এত দেরি করছে। কেন দশটার আগেই সে একটি প্রাণকে পৃথিবীতে আনতে পারছে না। বঙ্কিমের মনে হল, প্রসবের দায়িত্বটা যদি তার হাতে থাকত তা হলে দশটার আগেই সে কাজটি সমাধা করে তার বাবাকে সন্তুষ্ট করার শেষ চেষ্টা করে দেখত। বঙ্কিমের মনে হল, পরমেশ্বর মনে মনে বলছেন—অপদার্থ।
পরমেশ্বর শুয়ে পড়ছেন না কেন? মনের দিক থেকে সময় সময় তিনি দুর্বল। যতই হোক পুত্রবধূ। যদিও বাক্যালাপ অনেক দিন বন্ধ। বউ হয়ে আসার সাত দিনের মাথাতেই শ্বশুর আর পুত্রবধূতে মুখ দেখাদেখি বন্ধ। পরমেশ্বর অবশ্য বিয়ের রাতেই তাঁর এক আত্মীয়কে বলেছিলেন—এইবার আমাকে একটু রাশ টানতে হবে। একটু কড়া হতে হবে। তা না হলে ডিসিপ্লিন বজায় রাখা যাবে না। বঙ্কিম বিয়ের পিঁড়িতে বসে কথাটা শুনে ফেলেছিল। একে তার পৈতে হারিয়ে গেছে তার উপর বাবার সামনে বিয়ের আসরে বসার লজ্জা, সেই সময় তার বাবার ভবিষ্যৎ চেহারা, সব মিলিয়ে এক মর্মান্তিক পরিস্থিতি। বঙ্কিম সেই ছেলেবেলা থেকেই বাবার ভয়ে কাতর। বন্ধুরা বলত, বাবাতঙ্ক। এর কোনও চিকিৎসা নেই।
বঙ্কিমের ধারণা অসহযোগ আর বয়কট পরমেশ্বরের হাত থেকেই মহাত্মা গান্ধীর হাতে গিয়েছিল। পরমেশ্বর তাঁর বিচিত্র সংসারে অস্ত্র দুটিকে শানিয়ে, এর ধার পরীক্ষা করে বৃহত্তর ক্ষেত্রে প্রয়োগের জন্য গান্ধীজির হাতে যেন তুলে দিয়েছিলেন। মারধোর নয়, রাগারাগি নয়, মুখের উপর একটা ভয়ঙ্কর গাম্ভীর্যের মুখোশ টেনে সংসারের সমস্ত মানুষকে তটস্থ করে একেবারে মৌনী হয়ে গুমোট আকাশের মতো দিনের পর দিন বসে থাকো। বুঝিয়ে দাও পরমেশ্বর অখুশি। এই সময় অপরাধীর মুখোমুখি হলেই একটা অদ্ভুত নাচের ভঙ্গি করে পরমেশ্বর একপাশে সরে যেতেন। পচা মৃতদেহ কিংবা সকালে মেথরের মাথায় বিষ্ঠা দেখলে মানুষের যে প্রতিক্রিয়া হয় সেই রকম একটা ভাব করে তিনি ঘৃণার মাত্রাটা অপরাধীকে বুঝিয়ে দিতেন। বঙ্কিমের বরাতে এই ধরনের ব্যবহার যে কতবার জুটেছে! শেষ জুটেছে বিয়ের ঠিক আগে।
বঙ্কিম ঠিক প্রেম বা বিয়ে কোনওটার জন্যেই প্রস্তুত ছিল না। বঙ্কিমের মা মারা যাবার পর পরমেশ্বরই তার জীবনশিল্পী হতে চেয়েছিলেন। যখন যে ভাবটা পেয়ে বসত সেইভাবেই বঙ্কিমকে চালাতে চাইতেন। নিজে ছিলেন ব্রিটিশ আমলের সরকারি অফিসার। ইংরেজ বলতে অজ্ঞান। কথায় কথায় বলতেন—সাহেবের জাত, ওরা সব দেবতা। আবার চৈতন্যচরিতামৃত পড়তেন, বিবেকানন্দ পড়ে আবৃত্তি করতেন, ঊর্ধ্বরেতা হবার ব্যাপারটা তাকে মুক্ত করেছিল। আবার স্যার সুরেন্দ্রনাথের বাগ্মিতার কথা প্রায়ই বলতেন। বঙ্কিমের ভবিষ্যৎ জীবনের রূপকার হতে চেয়েছিলেন পরমেশ্বর অথচ সেই ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাঁর কোনও সম্যক ধারণা ছিল না। আকাশে মেঘ আর রোদের খেলার মতো বড় বড় জীবন আর ভাবের প্রভাবে তিনি অনবরতই পেণ্ডুলামের মতো দুলতেন। ছেলের নাম রেখেছিলেন বঙ্কিম, কারণ যে পূর্ণিমার বিকেলে তাদের পুরনো বাড়ির স্যাঁতসেঁতে আঁতুড়ে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল সেই বিকেলে পরমেশ্বর বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ পড়ছিলেন। আর বঙ্কিমের মতো এক মহাপুরুষের জন্ম দিয়ে তার ক্ষীণজীবী মা যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন এবং সেই বিকেলেই সূতিকার জীবাণু জন্মনাড়িতে জড়িয়ে নিয়ে মহাপুরুষের তিন বছর বয়সেই পরমেশ্বরের মতো ডাকসাইটে পিতার হাতে ছেলেকে জিম্মা করে দিয়ে সরে পড়েছিলেন। পরমেশ্বর বঙ্কিমের বিয়ের কয়েক বছর আগে ছেলেকে মহান ত্যাগী সন্ন্যাসীর চেহারায় দেখতে চেয়েছিলেন। বঙ্কিম কিন্তু তখন অন্য একসপেরিমেন্টে ব্যস্ত। সে তখন নিজেকে জিতেন্দ্রিয় অবতার ভাবতে শুরু করেছিল। ছেলেদের সঙ্গে যেভাবে সহজে মেশা চলে সেইভাবে মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশার পরীক্ষা চালাচ্ছিল। সবে অধ্যাত্ম রামায়ণ পড়ে মনে মনে আওড়াতে শুরু করেছে—স্ত্রীয়া সমস্তা সকলা জগৎসু। মেয়েরা সব মায়ের মতো। ‘মানুষ’ বলে প্রচণ্ড একটা দার্শনিক প্রবন্ধ লিখে কোনও এক ধর্ম পত্রিকার সন্ন্যাসী সম্পাদককে তাক লাগিয়ে দিয়েছে।
এই পরীক্ষার মুখে বঙ্কিমের পিতৃবন্ধু সপরিবারে বিদেশ থেকে ফিরে এলেন। বঙ্কিম যখন খুব ছোট সেই সময় তাঁরা চাকরির খাতিরে বাইরে চলে গিয়েছিলেন। ছেলেবেলায় বঙ্কিম তার পিতৃবন্ধুর মেয়ের সঙ্গে খেলা করত। সেই সময়কার তোলা একটা গ্রুপ ফটোতে দুটি পরিবারকেই দেখা যায়। বঙ্কিম একেবারে সামনের সারিতে বসে বসে আঙুল চুষছে আর পিছনের চেয়ারে বসে আছেন বঙ্কিমের শাশুড়ি, কোলের কাছে দাঁড়িয়ে আছে তার বউ একটা চোখ একটু বোজানো, জিভটা বেরিয়ে আছে সামনে, বোধহয় ক্যামেরাম্যানকে ভেঙচি কাটছিল। দীর্ঘ পনেরো বছর পরে বাল্যসঙ্গীর সঙ্গে যখন দেখা হল, তখন সে বড়-সড় একেবারে জেন্টল লেডি। বঙ্কিম হল বঙ্কিমদা, বঙ্কিমের বাবা কাকাবাবু। দীর্ঘকাল বাইরে থাকার ফলে জড়তা ঝরে গেছে। শালোয়ার কামিজ পরে। সাইকেল চালায়। বাংলার মধ্যে হিন্দির মিশেল : যেমন টক নয় খাট্টা, মিহি নয় পিনো, ভাল নয় বড়িয়া, মাসি নয় মৌসি, বিড়াল নয় বিল্লি। বঙ্কিমও তখন সেই ছেলেবেলার আঙুল চোষা বাঁদর নয়, বেশ চোখা যুবক, একমাথা ঘন কালো কোঁচকানো চুল, ঘাড়ের কাছে ঢেউ ভাঙা, চোখ দুটো ভাসা ভাসা বড়ই ছিল, ত্রাটক সাধনার ফলে সেই চোখের দৃষ্টি তখন আরও তীক্ষ্ণ, ডিমে তা দেবার সময় পাখির চোখের দৃষ্টির মতো উদাস ফ্যালফেলে, তার উপর সোনালি ফ্রেমের শিল্পী চশমা, নাকটা বেশ খাড়া। ভদ্রমহিলা এই বাঙালি যুবকটির তীক্ষ্ণ চেহারায় যেন প্রথম থেকেই একটু-মজে গেলেন। বঙ্কিমের কিন্তু অন্য ব্যাপার, তার তো তখন নতুন একসপেরিমেন্ট চলেছে। ইন্দ্রিয়কে যে জয় করে ফেলেছে তার কাছে ছেলে আর মেয়ের তফাত কোথায়!
আর ঠিক সেই সময় পরমেশ্বর একটা নাটক করার অদ্ভুত সুযোগ পেয়ে গেলেন। আবার সেই বয়কট। বঙ্কিম বসে বসে বই পড়ছিল। বিকেলটা বই পড়েই কেটে যেত; কিন্তু সেই নিয়তি। কখন কার জানালার গরাদ ধরে হেসে ওঠেন বলতে পারে না। পরমেশ্বর কদিন ধরেই একটু গুমোট ছিলেন। ব্যাপারটা ঠিক কী বোঝা যাচ্ছিল না। মনের এইরকম একটা গুমোট অবস্থায় পরমেশ্বর সকাল বিকেল গঙ্গার ধারে বেড়াতে চলে যান। বাড়িতে যতক্ষণ থাকেন দুমদুম করে গোড়ালির উপর ভর দিয়ে হাঁটেন। মার্কিনের লুঙ্গি বুকের উপর তুলে বাঁধেন। আর মাঝে মাঝে বিকট গলায় তারা তারা বলে চিৎকার করেন। সেই চিৎকারে রাস্তার ছাড়া কুকুর চমকে উঠে জানালার দিকে মুখ তুলে এক ভলক ঘেউ ঘেউ শব্দ ছাড়ে। পরমেশ্বর যথারীতি বেরিয়ে গিয়েছিলেন। বঙ্কিম পড়ছিল, এমন সময় বঙ্কিমের বউ এসে হাজির। পড়া ভণ্ডুল হয়ে গেল। বঙ্কিমদার সঙ্গে বেড়াতে যাবে। দূরে কোথাও নয়, গঙ্গার ধারে। আহা কী সুন্দর চাঁদ উঠেছে!
বঙ্কিম বুক ফুলিয়ে বেরিয়ে পড়ল। গঙ্গার ধারে দু’জনে হাত ধরাধরি করে চলেছে, হঠাৎ উল্টো দিক থেকে পরমেশ্বর এসে পড়লেন। বঙ্কিম ডেসপ্যারেট! ছেলে আর মেয়েতে তার কাছে তখন কোনও তফাত নেই। হাতে হাত ধরাই রইল। পরমেশ্বর তির্যক দৃষ্টিতে একবার তাকিয়েই গম্ভীর মুখে রাস্তার একপাশ দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। আর সেই রাতেই তাঁর মনের আকাশ পুরোপুরি মেঘে ঢেকে গেল। মাঝে-মাঝে তারা তারা গর্জন। বঙ্কিমকে দেখলেই সেই নাচের ভঙ্গি করে সরে যাওয়া। ডেলিকেট ফুট ওয়ার্ক। নিজের বোনকে ডেকে বললেন, বলে দে, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বংশের মুখে চুনকালি মাখাতে হবে না। যা করার বিয়ের পর করুক। মোস্ট আনবিকামিং অফ আওয়ার ফ্যামিলি, ছি ছি ছি ছি, তারা তারা। পরমেশ্বরের বিধবা বোন, বিধবা হবার পর থেকেই পরমেশ্বরের সংসার দেখাশোনা করেন। ভদ্রমহিলা পরমেশ্বরের মেজাজ বোঝেন। পরমেশ্বর জল নিচু বললে তিনি নিচু বলেন, উঁচু বললে উঁচু। আনবিকামিং শব্দটা কীভাবে তাঁর কানে গেল কে জানে। তিনি বললেন, ডেকে আনব ছোড়দা? পরমেশ্বর খেপে গেলেন—ডেকে আনবি, কাকে ডাকবি? ভগবানকে ডাক। সব ভেসে গেল। পরমেশ্বরের সারা জীবনটাই গেল গেল। সমাজ গেল, সংসার গেল, ধর্ম গেল, কর্ম গেল। আসলে কিছুই যায়নি। যাবার মধ্যে তাঁর পরিবারের সকলে একে একে পরপারে চলে গেছেন। আর গেছে তাঁর মাথায় চুল। ঘাড়ের কাছে চামরের মতো এক থুপপি অবশিষ্ট আছে। পরমেশ্বর বললেন—পাঁজি আছে? আমি কালই বিয়ে দেব। ওই ভলাপচুয়াস মহিলার সঙ্গে রাস্তায় রাস্তায় খেলে বেড়ানো! বোন বললেন—ভোল পালটাবে কেন, ও তো এখন শাড়িই পরছে ছোড়দা। পরমশ্বর বললেন, গেট আউট। আসলে ভদ্রমহিলা ইংরেজি বোঝেন না। আর কথায় কথায় ঘুমিয়ে পড়েন। একদিন ভাতের হাঁড়ি থেকে ভাত সেদ্ধ হয়েছে কি না দেখার জন্য হাতা ঢুকিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, জেগেছিলেন ভাত পুড়ে চড়চড়ে হয়ে যাবার পর। আর একদিন একতলা থেকে দোতলায় ওঠার সময় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, তারপর ঘুমন্ত অবস্থায় তিনতলার নেড়া ছাদ থেকে পড়তে পড়তে রক্ষা পেয়েছিলেন। পরমেশ্বরের গেট আউটে তাঁর ঘুম ভেঙে গেল, বললেন চা করে আনব? এই সব উত্তেজনার মুহুর্তে পরমেশ্বর ঘন ঘন চা খেয়ে নার্ভ শক্ত রাখেন। পরমেশ্বর একটু নরম গলায় বললেন—একটু কড়া করে। পরমেশ্বরের ছায়ার মতো এই বোন। বোন না থাকলে তাঁর এক মুহূর্তও চলে না।
বঙ্কিমের কানে যথাসময়ে কথাটা গেল। আর তখনই জেদের বসে সন্ন্যাসী বঙ্কিম প্রেমিক বঙ্কিম হয়ে গেল। বিয়ের কথা সে কোনওদিন ভাবেনি। সন্ন্যাসী হবারই তোড়জোড় করছিল। পরমেশ্বরের কেরামতির ফলে গেরুয়া ছেড়ে সিল্কের পাঞ্জাবি পরে বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়ল। পরমেশ্বরের তখনও অসহযোগ চলছে। সবই করেছেন কিন্তু মুখ কালো। অন্য সময় হলে বঙ্কিম ভিরমি খেত। নিলডাউন হয়ে ক্ষমা চাইত। নেহাত নব বলে বলীয়ান বলে বঙ্কিম খাড়া ছিল। অনেকটা নেশার ঘোরেই পিঁড়িতে বসেছিল। বঙ্কিম তখনও জানত না তার বরাতে কী আছে। পরমেশ্বর বঙ্কিমকে লটকে দিয়ে খাঁচায় পোরা পাখি করে আস্তে আস্তে তার অবাধ্যতার প্রতিশোধ নেবার প্ল্যান করেছিলেন। বিয়ের পর পরমেশ্বর টেরিবল পরমেশ্বর হয়ে ছেলে-বউয়ের জীবনে নেমে এলেন। অসহযোগই তাঁর অস্ত্র।
বউভাতের দিন ঘোষণা করলেন, এটা কামজ বিবাহ। পরমেশ্বর গেঞ্জি গায়ে বেঞ্চিতে বসে বোনকে কথাটা বলেছিলেন, বোন দৌড়ে গিয়ে একটা কামিজ এনে দিলেন। পরমেশ্বর কিছুক্ষণ মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে জামাটা পরে ফেললেন। বেয়াই হলেও বাল্যবন্ধু, কিন্তু তাঁর সঙ্গে এমন ব্যবহার করলেন, ভদ্রলোক খুব ঘাবড়ে গিয়ে মেয়েকে কানে কানে বললেন, সাবধানে থাকিস, শত্রুপুরী । মেয়ে মুচকি হাসল। সে জানত দুর্গে যখন একবার ঢুকেছে তখন শত্রুপক্ষকে ছারখার করা শক্ত হবে না। বঙ্কিম বেচারা হাতে দুব্বো বেঁধে ছাগলের মতো ঘুরছে। পরমেশ্বর শুনিয়ে শুনিয়ে বললেন, যেসব পুরুষের ব্যক্তিত্ব নেই, ম্যাদামারা, তাদের বরাতে অনেক দুঃখ। আসলে পরমেশ্বর বঙ্কিমের মধ্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে পুত্রবধূকে একটু জব্দ করতে চেয়েছিলেন। অত সহজে বুকের ধন কেড়ে নিয়ে সুখে থাকবে তা হচ্ছে না। বঙ্কিম হামারা, তুমহারা নেই।
তিন দিনের দিন পরমেশ্বর আবিষ্কার করলেন, পুত্রবধূর শাড়ির তলা দিয়ে সায়ার লেস বেরিয়ে আছে। বোনের হাত দিয়ে একটা কাঁচি পাঠিয়ে দিয়ে বললেন, কেটে ছোট করতে বল। পুত্রবধূ কাঁচিটা সেলাইয়ের বাকসের মধ্যে পরে রাখল, সায়ার লেস শাড়ির নীচে আরও এক ইঞ্চি বেশি ঝুলল। চতুর্থ দিনে পরমেশ্বরের মাথায় বঙ্কিমের বউয়ের ভিজে শাড়ির জল এক ফোঁটা পড়ল। পরমেশ্বর চান করে উঠোন দিয়ে আসছিলেন, সঙ্গে সঙ্গে আবার গঙ্গায় ফিরে গেলেন। ফিরে এসে আবার শাড়ির তলায় দাঁড়ালেন যদি আবার এক ফোঁটা পড়ে তাহলে আবার দুমদুম করে গঙ্গায় যাবেন। শাড়ি তখন শুকিয়ে এসেছে, দ্বিতীয় ফোঁটা না পড়ায় হতাশ হলেন। ওপরে উঠে এসে বোনকে বললেন—ব্রহ্মতালুতে একনাদা গোবর ঘুঁটে করে লাগিয়ে দে, যা জীবনে হয়নি তাই হল, মেয়েদের শাড়ির জল মাথায় পড়ল, আমার পরমায়ু কমল।
বঙ্কিম স্ত্রীকে বলল—ছি ছি, শাড়ি একটু নিংড়ে দিতে পারো না। বউ বলল কাকাবাবুর কী দরকার ছিল কাপড়ের তলা দিয়ে যাবার। পঞ্চম দিনে বউ মাঝরাতে খিলখিল করে খাট দুলিয়ে হেসে উঠল, পরমেশ্বর সারা রাত দুমদুম করে ছাদে পায়চারি করলেন আর মাঝে মাঝে বুক কাঁপানো জয় মা, জয় মা ডাক ছেড়ে বুঝিয়ে দিলেন তিনি উত্তেজিত।
ষষ্ঠ দিনে বঙ্কিমের বউ সন্ধেবেলা পরমেশ্বরের আহ্নিকের সময় রেডিওতে হিন্দি গানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজের ঘরে টুইস্ট নাচের অভ্যাসটা আর একবার ঝালিয়ে নিল। পরমেশ্বরের আহ্নিক মাথায় উঠল। নিজের ভাঙা ক্যাশবাকস খুলে একটা পোস্টকার্ড বের করে সঙ্গে সঙ্গে বহু দিনের ভুলে যাওয়া এক নিঃসঙ্গ আত্মীয়াকে বর্ধমানে চিঠি লিখতে বসলেন : কল্যাণীয়াসু, জীবনের বাকি কটাদিন তোর আটচালাতেই কাটাতে চাই। একটা গ্ল্যাডস্টোন ব্যাগে সেই রাতেই নিজের সব জিনিস প্যাক করে ফেললেন। সমস্যা হল দাড়ি কামাবার সেটটা নিয়ে। ৩১ সালে সেটটা কিনেছিলেন হোয়াইটওয়ে লেডল থেকে। প্রথমে নিজেই কামাতেন। ৫৬ সালে বঙ্কিমের দাড়ি গজাবার পর সেও এই সেটে কামাত। বাড়িতে আর দ্বিতীয় কোনও আয়োজন নেই। সেটটা ব্যাগে ভরে ফেললে সকালে বঙ্কিমের বিপদ হবে। কিন্তু রক্ত তখন তাঁর ফুটছে। এইরকম মানসিক অবস্থায় তিনি শঙ্করাচার্যের মোহমুদগর আওড়ান—কা তব কান্তা কস্তে পুত্র। সেটটা ব্যাগে ভরে ফেললেন। বঙ্কিমের দাড়ি বঙ্কিম বুঝবে। বঙ্কিমের বউ বুঝবে। বঙ্কিমের জন্য অনেক করেছেন। কলেজে ঢোকবার আগে পর্যন্ত নিজে হাতে কপচে কপচে চুল কেটে দিয়েছেন। চুলকাটার অবশ্য আর একটা গোপন কারণ ছিল। বঙ্কিমকে যতদিন পর্যন্ত পারা যায় সেলুনে যাওয়া থেকে আটকে রাখা। প্রথমত পয়সা বাঁচবে, দ্বিতীয়ত নিজের খুশি মতো ছোট বড় করে চুল ছেঁটে ঘাড়ের শাঁস বের করে চোখের সামনে নবকার্তিক হয়ে ঘুরবে না। সব রেডি করে পরমেশ্বর এস্রাজ নিয়ে বসলেন। এইরকম মারাত্মক দিনে তিনি একটি গানই বাজান—পর কী কখন হয় রে আপন, যতন করিলে পরই রয়।
বঙ্কিম এই সুরের সঙ্গে পরিচিত। সাপ যেমন সাপুড়ের বাঁশির সুর চেনে। বঙ্কিম বউকে জিজ্ঞাসা করল, আজ কি খেল দেখিয়েছ? বউ বলল, ধেই ধেই করে নেচেছি। বঙ্কিম খুব অবাক হয়ে গেল—নেচেছ? তার মানে? তার মানে নেচেছি। কোথায় নেচেছ? বঙ্কিম এতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল, নার্ভাস হয়ে বসে পড়ল! বউ বলল, আজ অবশ্য এই ঘরেই নেচেছি, কাল ভাবছি দালানে নাচব। বঙ্কিম উঠে দাঁড়াল, কে তোমাকে নাচতে বলেছিল? নতুন বউ মাথা নাড়ল, কেউ বলেনি, সবাই এ বাড়ির নাচছে, আমিও নাচলুম। বঙ্কিম অবাক হল—সবাই নাচছে? বউ বলল, তোমার বাবা তো তাথৈ তাথৈ করে নাচছে। আমার সঙ্গে কোনও সময় মুখোমুখি হলে একেবারে ঝম্প নৃত্য। বঙ্কিম চিৎকার করে উঠল—শাট আপ।
বঙ্কিমের চিৎকার পরমেশ্বরের কানে গেল—জয় মা, পৌরুষ জাগছে, শের-কা বাচ্চে। পরমেশ্বর তখন তক্তাপোশের উপর দুম দুম করে পায়ে তাল ঠুকে ঠুকে এস্রাজ জোরে জোরে বাজালেন, ‘আপনার জন সতত আপন।’ বঙ্কিম রেগেমেগে বেরিয়ে গেল। বঙ্কিমেরও রাগ হলে গঙ্গার ধারের বাঁধা বটতলাই গতি। চাঁদ উঠেছিল, হাতের আংটির জ্বলজ্বলে পাথরটার দিকে চোখ পড়ল। আংটিটা বিয়ের আগে তার বউ আদর করে হাতে পরিয়ে দিয়ে বঙ্কিমের সন্ন্যাসী হৃদয়ে প্রেমের তুফান তুলেছিল। বঙ্কিম সেদিন বউয়ের বুকে হাত দিয়ে, চুমু খেয়ে চরিত্র নষ্ট করেছিল।
বাবা বলতেন, বিবেকানন্দের মতো চোখ চাই। বঙ্কিম ড্যাব ড্যাব করে আরশির দিকে তাকিয়ে থেকে থেকে নিজের চোখে সেই চোখ খুঁজত। আংটির দিকে তাকিয়ে বঙ্কিমের রাগ জল হয়ে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল—টর্চার চেম্বার। ভদ্রলোক সারাটা জীবন কেবল অশান্তি করে গেলেন, অশান্তি ইজ হিজ লাইফ ব্রিদ।
পরমেশ্বরের অবশ্য বর্ধমান যাওয়া হল না। সারারাত তিনি ব্যাপারটা ভাবলেন। বর্ধমানের সেই দুস্থা আত্মীয়ার বাড়িতে ভাল বাথরুম নেই, তাছাড়া জীবনে যার খোঁজখবর কখনও করেননি সেখানে হঠাৎ যাওয়াটা কি ঠিক হবে! পরমেশ্বর এই প্রথম প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়েছেন। তিনি ভাবতেও পারেন না সেদিনের মেয়ে, যার অন্নপ্রাশনে কাঁসার থালা দিয়ে পাত পেড়ে খেয়েছিলেন, সেই মেয়ে কিনা তাঁকে কাবু করে দিল। পরমেশ্বর পাশ ফিরে শুলেন। পরমেশ্বরের আর গৃহত্যাগ করা হল না। সকালে ব্যাগ থেকে শেভিংসেট বের করে আলমারির মাথায় যথাস্থানে রেখে দিলেন। তারপর উদাস চোখে কিছুক্ষণ চেয়ারে বসে রইলেন। বয়স যত বাড়ছে চোখের দৃষ্টিটাও যেন কেমন ঘোলাটে হয়ে আসছে। চোখের দিকে তাকালে বোঝা যায় জীবনীশক্তি কমে আসছে। পরমেশ্বরের চোখের দিকে তাকালে মানুষটার জন্য বঙ্কিমের বুকটা কেমন করে ওঠে। সংসারে অ্যাডজাস্ট করতে পারলেন না বলে সারা জীবনই নিঃসঙ্গ। আত্মীয়স্বজন থেকে দূরে। বন্ধুবান্ধব নেই। কিছু আশ্রিতের উপর লাঠি ঘুরিয়ে আর প্রভুত্ব করেই জীবনটাকে পাথর বানালেন। চূর্ণ চূর্ণ হয়ে বালি হতে পারলে হয়তো কিছু পদচিহ্ন থেকে যেত। বঙ্কিম জানে এক সময় সে এই মানুষটির হৃদয়ের অনেকখানি জুড়ে ছিল। এখন পরের মেয়ে এসে তার অধিকার কায়েম করেছে। সেই ঝাপসা ভোরে পরমেশ্বর তাঁর ঘরেই বসে দেয়ালে ঝোলানো স্ত্রীর অস্পষ্ট ছবির দিকে তাকিয়ে রইলেন। সেই ছবি থেকে যেন তাঁর বিবেকের কণ্ঠ শুনতে পেলেন—তুমি অবহেলা করেছ, অত্যাচার করেছ, আমি এখন অনেক দূরে, আমার কোনও দোষ নেই, আমি সংসার চেয়েছি, তুমি সংসার ভেঙেছ।
বঙ্কিম বোধহয় একটু ঝিমিয়ে পড়েছিল। ঘড়ির শব্দে চমকে উঠল। রাত এগারোটা। ফাঁকা রাস্তা দিয়ে খড় খড় করে কয়েকটা কুকুর দৌড়ে গেল। পরমেশ্বর মশারির ভিতর পা গুটিয়ে ধ্যানাসনে বসে বললেন—আর বসে থেকে কী করবি, যা শুয়ে পড়, ও আজও হতে পারে কালও হতে পারে। যাবার সময় আলোটা নিবিয়ে দিয়ে যাস।
বঙ্কিম আলোটা নেবাতে গিয়ে একটু শক খেল। এটাও এ বাড়ির বৈশিষ্ট্য। সবই ডিফেকটিভ। মানুষ থেকে শুরু করে ফিটিংস, আসবাবপত্র এমনকী উটকো বেড়ালটা পর্যন্ত। বঙ্কিমের ঘুম চটকে গেছে। রাস্তার দিকের বারান্দায় বেরিয়ে পরমেশ্বরের ঘরের বাইরে দরজার পাশে হাঁটুর উপর মাথা গুঁজে পিসিমাকে ঘুমোতে দেখল। বঙ্কিমের বড় মায়া হল। পরমেশ্বর রোজ শুতে যাবার পর এই ক্লান্ত পিসিমাকে পরমেশ্বরের কোমর আর পা টিপতে হয় যতক্ষণ না পরমেশ্বরের ঘুম আসে। ভদ্রলোকের সায়েটিকা আছে। টিপে না দিলে যন্ত্রণায় সারারাত ছটফট করেন। বঙ্কিম আঙুল দিয়ে পিসিমাকে একবার খোঁচা দিল। ভদ্রমহিলা চমকে উঠেই জিজ্ঞেস করলেন, ছেলে না মেয়ে। বঙ্কিম বলল কোনও খবর আসেনি। আজ যেন বঙ্কিমস ডে। সারা বাড়িকে তার কেরামতিতে একেবারে এটেনশনের ভঙ্গিতে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। শ্যালক এসে স্ট্যান্ড এট ইজ করাবে। রেলিংয়ে ভর দিয়ে দু’বাহু প্রসারিত পিচের রাস্তার দিকে তাকিয়ে বঙ্কিম মনে মনে বলল, শালা আসছে না কেন!
বঙ্কিমের লজ্জা লজ্জা ভাবটা এতক্ষণে একটু কমে এসেছে। বাবা হবে বেশ করবে, সব বিবাহিত লোকই বাবা হয়। পরমেশ্বরও হয়েছিলেন, সো হোয়াট। কী মুখখুমিই না সে করেছিল। যেদিন তার বউ এসে কথাটা বলল, সেদিন বঙ্কিমের মনে হয়েছিল সেই বুঝি অন্তঃসত্ত্বা হয়েছে। বাবা—বলে এমন একটা করুণ আর্তনাদ করেছিল। বউ বলেছিল, আমার ব্যাপার আমি বুঝব। বঙ্কিম শোনেনি, সন্ধেবেলা বউকে বেপাড়ার ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল, যদি রক্ষা পাবার কোনও রাস্তা বেরোয়। ডাক্তারবাবু একটু অবাক হয়ে বলেছিলেন, পাগলা হয়েছেন, ফাস্ট ইসু মশাই, সেলিব্রেট করুন। বঙ্কিম ফি গুণে দিয়ে বউকে নিয়ে গুটি গুটি বেরিয়ে এসে এক হোমিওর চেম্বারে ঢুকেছিল। ভদ্রলোক একটু বদমেজাজি। পরীক্ষা-টরীক্ষা করে বলেছিলেন, বেড়ে হয়েছে। বঙ্কিম তাঁকে কিছুতেই বোঝাতে পারে না, বেড়ে হলে চলবে না, বাবা মেরে ফেলবেন। বৃদ্ধ ডাক্তার রেগে গিয়ে বলেছিলেন—বিয়ে করা বউ তো, নাকি কুমারী, পরস্ত্রী? বঙ্কিম একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল। বৃদ্ধ বলেছিলেন, অতই যদি ভয় বাবা, একটা বাঁজা মেয়েছেলের দার পরিগ্রহ করলেই পারতে। যাও যাও বয়স আছে, বছরে বছরে হোক। ওসব শ্লোগান-ট্লোগানে কান দিও না। বাবার গলায় নাতিনাতনীর মালা ঝুলিয়ে দাও, বুড়ো দেখবে সংসারে মজে গেছে। বঙ্কিম শেষে অসহায়ের মতো বলেছিল, আমার কী হবে? কী আর হবে? দুধের টিন বগলে বাড়ি আসবে, রাঙা মশারি, অয়েল ক্লথ, সুতো কাঁথা, ভরপুর সংসার জীবন, বাবাজি। বঙ্কিমের বরাতে বাবা হওয়া ঝুলছে, কে খণ্ডাবে। না এলোপ্যাথি, না হোমিওপ্যাথি।
এখন বঙ্কিম ভাবে, কী ছেলেমানুষীই সে করেছিল। নিজের সন্তানকে হত্যা করতে চেয়েছিল। এত রাত পর্যন্ত পরমেশ্বরের বসে থাকার কারণ বঙ্কিম জানে। বঙ্কিমের পিসিমা স্বপ্ন দেখেছেন, বঙ্কিমের দাদু ছেলে হয়ে ফিরে আসছেন। সেই ছ’ ফুট লম্বা বিশাল চেহারার দাদু। যিনি একটা পুরো কাঁঠালের রস পাঁচপপা দুধের ক্ষীরের সঙ্গে মেড়ে খেতেন। যিনি একবার একটা কাবুলীকে ল্যাং মেরে ফেলে দিয়েছিলেন। শেষ জীবনটা বঙ্কিমের বাড়িতেই কাটিয়ে গেছেন, কারণ সংসারে তিনিও বিশেষ সুবিধে করতে পারেননি। পরমেশ্বরের ঘরে ভাঙা তানপুরায় রাম দত্তের গান গাইতেন তারস্বরে। আমার দিন যে আগত দেখি জগত জননী। গানে সুর ছিল না, ভাব ছিল। চোখে জলের ধারা নামত। পরমেশ্বরেরও অল্প বয়সে স্ত্রী মারা গিয়েছিলেন, দাদুরও তাই। মাইলখানেক দূর থেকে সেই গান শোনা যেত। লোকে বলত, একটু পা চালিয়ে যাও বঙ্কিম, বাড়িতে আগুন লেগেছে, ফায়ার ব্রিগেড ডাকতে হতে পারে। সেই দাদু ফিরে আসছেন, ছোট্ট এতটুকু হয়ে। ভাবা যায় না। যাঁর এতখানি ভুঁড়ি ছিল। স্নানের সময় নাভিতেই পোয়াখানেক তেল খেত। মৃত্যুর পরে দাদুর কাঠের সিন্দুক থেকে সেরখানেক সিদ্ধি আর একটা খুলি বেরিয়েছিল। মাঝরাতে তন্ত্রসাধনা করতেন। বঙ্কিমের বউয়ের গর্ভে সেই যোগভ্রষ্ট তান্ত্রিক আবার ফিরে আসছেন।
মধ্যরাতের সেই নির্জন রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টের আলোতে একটা সাইকেলের হ্যান্ডেল চকচক করে উঠল। চলার কাঁপুনিতে বেলটা ঝিন ঝিন করছে। ওই আসছে বঙ্কিমের শ্যালক। অনেকটা ফিলমের হিরোর মতো চেহারা। বঙ্কিম একটা চাপা উত্তেজনা নিয়ে পরমেশ্বরের ঘরে ঢুকল। অন্ধকার ঘরে ঝলমলে মশারির মধ্যে ঝাপসা পরমেশ্বর তখনও ধ্যানাসনে খাড়া বসে। এত বয়সেও পরমেশ্বরের মেরুদণ্ড এতটুকু দোমড়ায়নি। সংসারে যিনি এত স্পষ্ট ছিলেন এখন কী অস্পষ্ট! আথচ কী ভীষণ ঋজু, সৈনিকের মতো। বঙ্কিম বলল—আসছে। পরমেশ্বর প্রথমে কোনও জবাব দিলেন না, তারপর বললেন, আলোটা জ্বাল। আলো জ্বালতে জ্বলতেই বঙ্কিমের শ্যালকের প্রবেশ। বঙ্কিমের চেয়ে বয়সে বছর খানেক বড়। বঙ্কিমের ছেলেবেলার খেলার সাথী।
পরমেশ্বর মশারির বাইরে এলেন, কী খবর?
ছেলে হয়েছে, সাত পাউন্ড ওজন।
নাভিটা দেখেছ? পরমেশ্বরের প্রশ্নে শ্যালক অবাক। লাল মতো ছেলেটাকে সে নার্সের কোলে এক ঝলক দেখেছে। নাভিটা তো দেখা হয়নি। আর দেখবেই বা কী করে! সে জায়গাটা তো ব্যান্ডেজ বাঁধা। অথচ পরমেশ্বর সেই রাতের লক্ষণ মিলিয়ে নিতে চাইছেন। বঙ্কিমের দাদুর নাভির একটা বৈশিষ্ট্য ছিল। অনেকটা পদ্মফুলের মতো।
পরমেশ্বর প্রশ্ন করলেন, হাত-পাগুলো ঠিক আছে?
আজ্ঞে হ্যা, সব ঠিকঠাক আছে, যেখানে যেমনটি থাকার ঠিক সেইরকম আছে।
পরমেশ্বরের ধারণা ছিল, বোধহয় ডিফেকটিভ মেশিন থেকে ডিফেকটিভ প্রোডাকশন বেরোবে।
টাইমটা অ্যাকুরেটলি নোট করেছ তো?
আজ্ঞে হ্যা, ঠিক দশটা পঞ্চান্ন।
সময় সম্পর্কে পরমেশ্বর সারা জীবনই সচেতন। বঙ্কিমের জন্মসময়ের ব্যাপারে ইদানীং তাঁর সন্দেহ দেখা দিয়েছে। কোষ্ঠী বলছে সন্ন্যাস যোগ, অথচ সেই সন্ন্যাসী এখন ফাদার হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে।
পরমেশ্বরের পরের প্রশ্ন একটু দ্বিধা জড়ানো, ছেলের মা? বউমা বলার চেষ্টা একবারই তিনি করেছিলেন, কিন্তু বউমার পরের খেলায় তিনি আর ঘৃণায় মা শব্দটা উচ্চারণ করেননি। ওটা জগৎ মাতাকেই উৎসর্গ করেছিলেন।
শ্যালক বললেন, আজ্ঞে হ্যা, বেশ ভাল আছে। প্রথমে তো গিয়েই ওয়ার্ডে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল তারপর চেপে ধরে ডেলি—কথাটা আর শেষ করলেন না। পরমেশ্বরকে ভদ্রলোক ভয় পান। যে শব্দটা ব্যবহার করছেন সেটা শাস্ত্রসম্মত কি না বুঝতে পারলেন না, শুদ্ধ বাংলাটাও মনে এল না। ফলে কথাটা ঝুলিয়ে দিলেন।
পরমেশ্বর মুখটা এমন করলেন, যেন বঙ্কিমের বউ যে ধরনের মেয়ে তাতে ইচ্ছে করলে রাস্তায় চলতে চলতেই ডেলিভারি করে ফেলতে পারে।
পরমেশ্বর বললেন, ডাক তোর পিসিমাকে। পিসিমাকে ঘরের বাইরে থেকে খুঁচিয়ে তোলা হল।
কি, ছেলে না মেয়ে?
ছেলে।
বলেছিলুম ছোড়দা।
পরমেশ্বর বললেন, ঠিক আছে, তুই বাজা। শাঁখ বাজা।
সেই ফুটো সিঁদুর মাখা শাঁখটা বেরুল। এই শাঁখ বাজিয়ে বঙ্কিমকেও পৃথিবীতে অভ্যর্থনা করা হয়েছিল, এক শীতের বিকেলে। শাঁখটার সবই ভাল, কেবল বাজাবার কৌশল এই পরিবারের দু-এক জনেরই জানা ছিল এবং সেই দক্ষ শিল্পীরা এখন সকলেই গতায়ু। পিসিমা গাল ফুলিয়ে কয়েকবার ফুঁ ফাঁ করলেন। পরমেশ্বর খুবই বিরক্ত, হিন্দুর মেয়ে শাঁখটাও বাজাতে পারিস না। ভায়ের সঙ্গে তর্ক করার সাহস নেই। শাঁখটা কেউই বাজাতে পারে না। বঙ্কিম ছেলেবেলায় মুখেই শাঁখ বাজাত আর ফুটো শাঁখটা প্রথামতো কারুর ঠোঁটের কাছে ধরা থাকত। বঙ্কিমের এখনও সেই টেকনিকটা লাগাবার ইচ্ছে হল ; কিন্তু সাহস হল না। বঙ্কিমের ডাকাবুকো বউ অবশ্য এ সংসারে আসার পর একদিন চ্যালেঞ্জ করে শাঁখটা বাজিয়েছিল ; কিন্তু তাকে এখন পাবে কোথায়। নিজের ছেলের জন্মের শাঁখ কোনও মা কি বাজাতে পারে?
পরমেশ্বর হাল ছেড়ে মশারির ভিতর ঢুকে যাচ্ছিলেন, আর তখনই মধ্যরাতের নিস্তব্ধ জনপদকে সচকিত করে, প্রায় শখানেক বছরের প্রাচীন একটি বাড়ির এলোমেলো প্রকোষ্ঠে কেঁপে কেঁপে তিন বার শাঁখ বেজে উঠল। পরমেশ্বর মশারির ভিতর ঢুকতে ঢুকতে মনে মনে বললেন, তোমার শাঁখ তুমিই বাজাও।