Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » শৈলরহস্য – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay » Page 3

শৈলরহস্য – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay

আমি অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়। এই কাহিনীর শেষাংশ লিখিতেছি। ব্যোমকেশের নামে সহ্যাদ্রি হোটেলের ঠিকানায় চিঠি লিখিয়া ডাকে দিয়াছিলাম ৯ তারিখের সকালে। ১২ তারিখের বিকালবেলা অনুমান তিনটার সময় ব্যোমকেশ আসিয়া উপস্থিত। সবিস্ময়ে বলিলাম‌, ‘একি! আমার চিঠি পেয়েছিলে?’

‘চিঠি পেয়েই এলাম। প্লেনে এসেছি। —তুমি চটপট তৈরি হয়ে নাও‌, এখুনি বেরুতে হবে।’–বলিয়া ব্যোমকেশ ভিতর দিকে চলিয়া গেল।

আধঘণ্টার মধ্যে বাড়ি হইতে বাহির হইলাম। রাস্তায় বাড়ির সামনে পুলিসের ভ্যান দাঁড়াইয়া আছে‌, তাহাতে একজন ইন্সপেক্টর ও কয়েকজন কনস্টেবল। আমরাও ভ্যানে উঠিয়া বসিলাম।

কয়েকদিন আগে যে সময় হৈমবতীর নির্জন গৃহের সম্মুখে উপস্থিত হইয়াছিলাম‌, প্রায় সেই সময় আবার গিয়া পৌঁছিলাম। আজ কিন্তু ভৃত্য মহেশ দরজা খুলিয়া দিতে আসিল না। দরজা খোলাই ছিল। আমরা সদলবলে প্রবেশ করিলাম।

বাড়িতে কেহ নাই; হৈমবতী নাই‌, মহেশ নাই। কেবল আসবাবগুলি পড়িয়া আছে; বাহিরের ঘরে চেয়ার-টেবিল‌, শয়নকক্ষে দু’টি খাট ও লোহার সিন্দুক‌, রান্নাঘরে হাঁড়ি কলসী। লোহার সিন্দুকের কপাট খোলা, তাহার অভ্যন্তর শূন্য। ব্যোমকেশ করুণ হাসিয়া ইন্সপেক্টরের পানে চাহিল,–‘চিড়িয়া উড়েছে।’–

সে রাত্রে নৈশ ভোজন সম্পন্ন করিয়া ব্যোমকেশ ও আমি তক্তপোশের উপর গায়ে আলোয়ান জড়াইয়া বসিয়াছিলাম। সত্যবতী খোকাকে ঘুম পাড়াইয়া আসিয়া ব্যোমকেশের গা ঘেঁষিয়া বসিল। একটা শীতের হাওয়া উঠিয়াছে‌, হাওয়ার জোর ক্রমেই বাড়িতেছে। আমাদের ঘরের দরজা জানোলা সব বন্ধ‌, তবু কোন অদৃশ্য ছিদ্রপথে খুঁচের মত বাতাস প্রবেশ করিয়া গায়ে বিঁধিতেছে।

বলিলাম‌, ‘মহাবলেশ্বরের শীত তুমি খানিকটা সঙ্গে এনেছ দেখছি। আশা করি বিজয় বিশ্বাসের প্রেতটিকেও সঙ্গে আনোনি।’

সত্যবতী ব্যোমকেশের কাছে আর একটু ঘেঁষিয়া বসিল। ব্যোমকেশ আমার পানে একটি সকৌতুক দৃষ্টি হানিয়া বলিল‌, ‘প্ৰেত সম্বন্ধে তোমার ভুল ধারণা এখনও যায়নি।’

বলিলাম‌, ‘প্ৰেত সম্বন্ধে আমার ভুল ধারণা থাকা বিচিত্র নয়‌, কারণ প্রেতের সঙ্গে আমি কখনও রাত্রিবাস করিনি। আচ্ছা ব্যোমকেশ‌, সত্যিই তুমি ভুত বিশ্বাস করা?’

‘যা প্রত্যক্ষ করেছি তা বিশ্বাস করা-না-করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। তুমি ব্যোমকেশ বক্সীর অস্তিত্বে বিশ্বাস কর?’

‘ব্যোমকেশ বক্সীর অস্তিত্বে বিশ্বাস করি। কারণ তাকে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু ভূত তো চোখে দেখিনি‌, বিশ্বাস করি কি করে?’

‘আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে বলছি না। কিন্তু আমি যদি বিশ্বাস করি‌, তুমি আপত্তি করবে কেন?’

কিছুক্ষণ নীরবে ধূমপান করিলাম। ‘আচ্ছা‌, ওকথা যাক। বিশ্বাসে মিলায় কৃষ্ণ‌, তর্কে বহু দূর। কিন্তু তোমার ভূতের এত চেষ্টা সত্ত্বেও কার্যসিদ্ধি হল না।’

‘কে বলে কার্যসিদ্ধি হয়নি? ভূত চেয়েছিল মস্ত একটা ধোঁকার টাটি ভেঙে দিতে। তা সে দিয়েছে।’

‘তার মানে?’

‘মানে কি এখনও কিছুই বোঝোনি?’

‘কেন বুঝব না? প্রথমে অবশ্য আমি হৈমবতীর চরিত্র ভুল বুঝেছিলাম। কিন্তু এখন বুঝেছি হৈমবতী আর মানেক মেহতা মিলে বিজয় বিশ্বাসকে খুন করেছিল। হৈমবতী একটি সাংঘাতিক মেয়েমানুষ।’

‘হৈমবতীর চরিত্র ঠিকই বুঝেছ। কিন্তু ভুতকে এখনও চেনোনি। ভূতের রহস্য আরও সাংঘাতিক।’

সত্যবতী ব্যোমকেশের আরও কাছে সরিয়া গেল‌, হঠাৎ কাঁপিয়া উঠিয়া বলিল‌, ‘আমার শীত করছে।’

‘শীত করছে‌, না ভয় করছে।’ ব্যোমকেশ হাসিয়া নিজের আলোয়ানের অর্ধেকটা তাহার গায়ে জড়াইয়া দিল।

বলিলাম‌, ‘এস এস বঁধু এস‌, আধা আঁচরে বসো। বুড়ো বয়সে লজ্জা করে না!’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তোমাকে আবার লজ্জা কি! তুমি তো অবোধ শিশু।’

সত্যবতী সায় দিয়া বলিল‌, ‘নয়তো কি! যার বিয়ে হয়নি সে তো দুধের ছেলে।’

বলিলাম‌, ‘আচ্ছা আচ্ছা‌, এখন ভূতের কথা হোক। আমি কিছুই বুঝিনি‌, তুমি সব খোলসা করে বল।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আগে তোমাকে দু’ একটা প্রশ্ন করি। মানেক মেহতা বিজয় বিশ্বাসকে খুন করবার জন্যে খাদের ধারে নিয়ে গেল কেন? বিজয় বিশ্বাস বা গেল কেন?’

চিন্তা করিয়া বলিলাম‌, ‘জানি না।’

‘দ্বিতীয় প্রশ্ন। বিজয় বিশ্বাসের নামে ব্যাঙ্কে হাজার দুই টাকা ছিল। হোটেল বিক্রি হবার আগেই সে টাকা বার করে নিয়েছিল কেন?’

‘জানি না।’

‘তৃতীয় প্রশ্ন। তুমি যখন হৈমবতীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলে‌, তখন শীতের সন্ধ্যে হয়-হয়। চাকর যখন বলল হৈমবতী স্নান করছেন‌, তখন তোমার খাটকা লাগল না?’

না। মানে-খেয়াল করিনি।’

‘চতুর্থ প্রশ্ন। চাকরটাকে সন্দেহ হয়নি?’

‘না। চাকরটাকে সন্দেহ করার কোনও কারণ হয়নি। সে পূর্ববঙ্গের লোক‌, মাত্র কয়েকদিন হৈমবতীর চাকরিতে ঢুকেছিল। অবশ্য একথা যদি সত্যিই হয় যে সে লোহার সিন্দুক খোলবার চেষ্টা করছিল—‘

‘অজিত‌, তোমার সরলতা সত্যিই মর্মস্পশী। চাকরটা সিন্দুক খোলবার উদ্যোগ করেছিল বটে‌, কিন্তু চুরি করবার জন্যে নয়। —মহাবলেশ্বরে দু’জন লোক খুন করবার ষড়যন্ত্র করেছিল‌, তার মধ্যে একজন হচ্ছে হৈমবতী। অন্য লোকটি কে?’

‘মানেক মেহতা ছাড়া আর কে হতে পারে?’

ব্যোমকেশ কুটিল হাসিয়া বলিল‌, ‘ঐখানেই ধাপ্পা-প্রচণ্ড ধাপ্পা! হৈমবতী ষড়যন্ত্র করেছিল তার স্বামীর সঙ্গে‌, মানেক মেহতার সঙ্গে নয়। হৈমবতীর আর যে দোষই থাক‌, সে পতিব্রতা নারী‌, তাতে সন্দেহ নেই।’

হতবুদ্ধি হইয়া বলিলাম‌, ‘কী বলছ তুমি’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘যা বলছি মন দিয়ে শোনো।–হোমজি যখন আমাকে গল্পটা বললেন তখন আমার মনে বিশেষ দাগ কাটেনি। তবু একটা খটকা লেগেছিল; মানেক মেহতা বিজয় বিশ্বাসকে খুন করবার জন্যে খাদের ধারে নিয়ে গেল কেন? বিজয় শীত-কাতুরে লোক ছিল‌, সে-ই বা গেল কেন?

‘তারপর ভূতের উৎপাত শুরু হল। দায়ে পড়ে অনুসন্ধান শুরু করলাম। খটকা ক্রমে সন্দেহে পরিণত হতে লাগল। তারপর ওয়ার্ডরোবের মধ্যে পেলাম একটুকরো বাদামী কাগজে একটা ঠিকানা; বাংলা অক্ষরে লেখা কলকাতার উপকণ্ঠের একটা ঠিকানা। আমার মনের অন্ধকার একটু একটু করে দূর হতে লাগল।

‘তোমাকে লম্বা চিঠি লিখলাম। তারপর তোমার উত্তর যখন পেলাম তখন আর কোনও সংশয় রইল না। আপ্টে সাহেবকে সব কথা বললাম। তিনি তখনও ঠ্যাং নিয়ে পড়ে আছেন‌, কিন্তু তখনই কলকাতার পুলিসকে টেলিগ্রাম করলেন এবং আমার প্লেনে আসার ব্যবস্থা করে

‘হৈমবতী আর বিজয় বিশ্বাসকে ধরা গেল না বটে‌, কিন্তু প্রেতের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে‌, আসল অপরাধী কারা তা জানা গেছে। বলা বাহুল্য‌, যে প্ৰেতটা নাছোড়বান্দা হয়ে আমাকে ধরেছিল। সে মানেক মেহতা।’

সত্যবতী বলিল‌, ‘সত্যি কি হয়েছিল বল না গো!’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘সত্যি কি হয়েছিল তা জানে কেবল হৈমবতী আর বিজয় বিশ্বাস। আমি মোটামুটি যা আন্দাজ করেছি‌, তাই তোমাদের বলছি।’

সিগারেট ধরাইয়া ব্যোমকেশ বলিতে আরম্ভ করিল।–’মানেক মেহতা ছিল নামকটা বদমাশ‌, আর বিজয় বিশ্বাস ছিল ভিজে বেড়াল। একদা কি করিয়া মিলন হল দোঁহে। দু’জনে মিলে হোটেল খুলল। মেহতার টাকা‌, বিশ্বাসদের মেহনত।

‘স্ত্রী-পুরুষে হোটেল চালাচ্ছে‌, হোটেল বেশ জাঁকিয়ে উঠল। প্রতি বছর ত্রিশ চল্লিশ হাজার টাকা লাভ হয়। মেহতা মাঝে মাঝে এসে নিজের ভাগের টাকা নিয়ে যায়। বিজয় বিশ্বাস নিজের ভাগের টাকা মহাবলেশ্বরের ব্যাঙ্কে বেশি রাখে না‌, বোধ হয় স্ত্রীর নামে অন্য কোথাও রাখে। হয়তো কলকাতারই কোনও ব্যাঙ্কে হৈমবতীর নামে পঞ্চাশ-ষাট হাজার টাকা জমা আছে‌, ওরা দু’জনে ছাড়া আর কেউ তার সন্ধান জানে না।

‘এইভাবে বেশ চলছিল‌, গত বছর মানেক মেহতা বিপদে পড়ে গেল। তার বে-আইনী সোনার চালান ধরা পড়ে গেল। তাকে পুলিস জড়াতে পারল না বটে‌, কিন্তু অত সোনা মারা যাওয়ায় সে একেবারে সর্বস্বাস্ত হয়েছিল। তখন তার একমাত্র মূলধন-হোটেল; মানেক মেহতা ঠিক করল সে হোটেল বিক্রি করবে। তার নগদ টাকা চাই।

‘এখন প্রশ্ন হচ্ছে‌, হোটেল বিক্রির টাকা কে পাবে। একলা মেহতা পাবে‌, না‌, বিজয় বিশ্বাসেরও বখরা আছে? ওদের পার্টনারশিপের দলিল আমি দেখিনি। অনুমান করা যেতে পারে যে মানেক মেহতা যখন হোটেল কেনার টাকা দিয়েছিল‌, তখন হোটেল বিক্রির টাকাটাও পুরোপুরি তারই প্ৰাপ্য। আমার বিশ্বাস‌, মেহতা সব টাকাই দাবি করেছিল।

‘হৈমবতী আর বিজয় বিশ্বাস ঠিক করল। সব টাকা ওরাই নেবে। ওদের পূর্ব ইতিহাস কিছু জানা যায় না‌, কিন্তু ওদের প্রকৃতি যে স্বভাবতাই অপরাধপ্রবণ তাতে আর সন্দেহ নেই। দু’জনে মিলে পরামর্শ করল। মানেক মেহতা পুলিসের নজরলাগা দাগী লোক‌, তার ঘাড়ে অপরাধের ভার চাপিয়ে দেওয়া সহজ। স্বামী-স্ত্রী মিলে নিপুণভাবে প্ল্যান গড়ে তুলল।

‘কলকাতার উপকণ্ঠে তখন কি ভাবে ওরা বাসা ঠিক করেছিল‌, আমি জানি না। হয়তো কলকাতার কোনও পরিচিত লোকের মারফত বাসা ঠিক করেছিল। হৈমবতী বাসার ঠিকানা কাগজে লিখে ওয়ার্ডরোবের মধ্যে ওঁজে রেখেছিল‌, পাছে ঠিকানা ভুলে যায়। পরে অবশ্য ঠিকানা তাদের মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল‌, তাই হৈমবতী যাবার সময় বাদামী কাগজের টুকরোটা ওয়ার্ডরোবেই ফেলে যায়। কাঠের ওয়ার্ডরোবে বাদামী কাগজের টুকরোটা বোধহয় চোখে পড়েনি। ঐ একটি মারাত্মক ভুল হৈমবতী করেছিল।

‘যাহোক‌, নির্দিষ্ট রাত্রে মানেক মেহতা চুপিচুপি এসে হাজির। হোটেলে একটিও অতিথি নেই। চাকরানীটাকে হৈমবতী নিশ্চয় ঘুমের ওষুধ খাইয়েছিল। হোটেলে ছিল কেবল হৈমবতী আর বিজয় বিশ্বাস।

‘মানেক মেহতাকে ওরা হোটেলের অফিস-ঘরেই খুন করেছিল। এমনভাবে খুন করেছিল যাতে রক্তপাত না হয়। তারপর ছদ্মবেশ ধারণের পালা। বিজয় বিশ্বাস মানেক মেহতার গা থেকে জামা কাপড় খুলে নিজে পরিল‌, নিজের জামা কাপড় গলাবন্ধ মানেক মেহতাকে পরিয়ে দিল। তারপর দু’জনে লাশ নিয়ে গিয়ে খাদের মধ্যে ফেলে দিল। কিছুদিন থেকে এক ব্যাঘ্র-দম্পতি এসে খাদে বাসা নিয়েছিল‌, সুতরাং লাশের যে কিছুই থাকবে না তা বিশ্বাস-দম্পতি জানত। ব্যাঘ্র-দম্পতির কথা বিবেচনা করেই তারা প্ল্যান করেছিল।

‘আসল কাজ শেষ হলে বিজয় বিশ্বাস সমস্ত টাকাকড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। নিষুতি শীতের রাত্রি‌, কেউ তাকে দেখল না। মানেক মেহতা শহরের বাইরে রাস্তার ধারে মোটর রেখে এসেছিল‌, সেই মোটরে চড়ে বিজয় বিশ্বাস উধাও হয়ে গেল।

‘হৈমবতী ঘাঁটি আগলে রইল। বুকের পটা আছে। ওই মেয়েমানুষটির। তারপর যা যা ঘটেছিল সবই প্রকাশ্য ব্যাপার। একমাত্র সাক্ষী হৈমবতী‌, সে যা বলল পুলিস তাই বিশ্বাস করল। বিশ্বাস না করার কোনও ছিল না‌, মানেক মেহতার চরিত্র পুলিস জানত।

‘কয়েকদিন পরে সহ্যাদ্রি হোটেল হোমজির হাতে তুলে দিয়ে শোকসন্তপ্তা বিধবা হৈমবতী মহাবলেশ্বর থেকে চলে গেল। ইতিমধ্যে বিজয় বিশ্বাস কলকাতার বাসায় এসে আড্ডা গেড়েছিল‌, হৈমবতীও এসে জুটল।

‘কিন্তু তারা ভারি হুঁশিয়ার লোক‌, একেবারে নিশ্চিন্ত হয়নি‌, সাবধানে ছিল; তাই মহাবলেশ্বরের চিঠি পেয়ে অজিত যখন দেখা করতে গেল। তখন হৈমবতী চমকে উঠল বটে। কিন্তু ঘাবড়ালো না। হৈমবতীর তখন বোধ হয় বিধবার সাজ ছিল না‌, সে বিধবা সাজতে গেল। চাকর অজিতকে বাইরের ঘরে বসাল। অজিত যদি এত সরল না হত‌, তাহলে ওর খটকা লাগত; শীতের সন্ধ্যাবেলা মেয়েরা গা ধুতে পারে‌, চুল ভিজিয়ে স্নান করে না।

‘যাহোক‌, হৈমবতী যখন এল তখন তার সদ্যস্নাত চেহারা দেখে অজিত মুগ্ধ হয়ে গেল। সে হৈমন্বতীকে আমার নাম বলল; হৈমবতীর ব্যাপার বুঝতে তিলার্ধ দেরি হল না। অজিত আমার নামটাকে যতখানি অখ্যাত মনে করে‌, ততখানি অখ্যাত নয়। আমার নাম‌, অজিতের কল্যাণেই নামটা সকলের জানা হয়ে গেছে। কিন্তু সে যাক। বিকাশ ওদিকে জানোলা দিয়ে শোবার ঘরে দুটো খাট আর লোহার সিন্দুক দেখে নিয়েছিল। অজিতের চিঠিতে ওটাই ছিল সবচেয়ে জরুরী কথা। চিঠি পড়ে কিছুই আর জানতে বাকি রইল না।

‘কিন্তু ওদের ধরা গেল না। সে রাত্রে অজিত পিছন ফিরবার সঙ্গে সঙ্গেই বোধ হয় হৈমবতী লোহার সিন্দুক থেকে টাকাকড়ি নিয়ে অদৃশ্য হয়েছিল। এখন তারা কোথায়‌, কোন ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে কে বলতে পারে। হয়তো তারা কোনও দিনই ধরা পড়বে না‌, হয়তো ধরা পড়বে। না পড়ার সম্ভাবনাই বেশি। পঁয়ত্ৰিশ কোটি নর-নারীর বাসভূমি এই ভারতবর্ষ—’

কিছুক্ষণ তিনজনে চুপ করিয়া বসিয়া রহিলাম। বাহিরে যে হাওয়া উঠিয়াছিল তাহা থামিয়া গিয়াছে। ঘড়িতে দশটা বাজিল।

রআমি বলিলাম‌, ‘সব সমস্যার তো সমাধান হল‌, কিন্তু একটা কথা বুঝলুম না। বিজয় বিশ্বাস ও বাড়িতে থাকতো না কেন? কোথায় থাকত? চাকরাটা ওদের সম্বন্ধে কি কিছুই সন্দেহ করেনি?’

ব্যোমকেশ গভীর নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল‌, ‘হা ভগবান‌, তাও বোঝোনি? চাকরটাই বিজয় বিশ্বাস।’

Pages: 1 2 3

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress