Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » শেষ দৃশ্য || Atin Bandyopadhyay

শেষ দৃশ্য || Atin Bandyopadhyay

হরিদ্বার থেকে কোনো একদিন ওরা রওনা হয়েছিল—ওরা অন্তত তাই বলে। প্রয়াগ বারাণসীর পথ ধরে গঙ্গার ধারে ধারে ওরা ডেরা বেঁধেছিল। রাজা হরিশ্চন্দ্রের নাম ওরা জানে—তিনি গঙ্গাপুত্র। সে নাম স্মরণ করার সময় ওরা মাটি ছুঁয়ে প্রণাম করে। তার চেয়ে বেশি ওদের জানা নেই। এরা বলবে তখন, না জানে বাবু কাঁহাসে আয়া, লেকিন জানে, হামরা সব আছে গঙ্গা—পুত্তুর। বলবে হরিদ্বারসে কোলকত্তা—তেমন হাজার চটান খুঁজে পাবেন। চটানে হামরা ঘাটের কাঁথা কাপড়ে ডেরা বেঁধেছি। ঘাটের দুচার পয়সায় হামলোগ নসিবকে ঢুঁড়েছি।

চটানে পাশাপাশি কুঁড়েঘর অনেকগুলো। কুঁড়েঘরগুলোর কোনোটায় চাল আছে, বেড়া আছে, দরজা আছে। চাল—ঘাটের ছেঁড়া তোষক এবং কাঁথার, বেড়া—ফালি বাঁশের। কিছু কিছু ঘরের চাল আছে, কিছু ঘরের বেড়া নেই, দরজা নেই। শুধু মেঝের ওপর ফালি বাঁশের মাচান। মাচানের নিচে রাজ্যের হাঁড়ি—কলসি। দরজার বদলে কোনো ঘরে ছেঁড়া কাঁথা ঝুলছে। ছেঁড়া কাঁথাটাই দরজার মতো কাজ করছে। ছেঁড়া কাঁথাটা তেলচিটে নোংরা। কোথাও পোড়া—চিতার আগুনের দাগ। তবু এটাই ওদের দরজার আব্রু, মনের আব্রু, চটানের ভালোবাসার আব্রু। চটানের উঠোনে শুয়োরের খোঁয়াড়, মোরগের ঘর, কুকুরের আস্তানা। ঘরে ঘরে অভাব অনটন মারধোর। আবার ভাব ভালোবাসার কথা। ঘরে ঘরে হল্লা চিৎকার—নাচন কোঁদন। তখন আসেন ঘাটোয়ারিবাবু। তিনি সালিসি সাজেন, বিচার করেন। চটানের মা—বাপ তিনি।

চটানের সঙ্গেই ঘাট—অফিস। এখানে মড়ার নামধাম লেখানো হয়। একটা কাউন্টার আছে—ঘাটোয়ারিবাবু সেখানে একটা কালো চেয়ারে বসে থাকেন সারাদিন। রাতে পাশের তক্তপোশে চুপচাপ শুয়ে থাকেন। ঘরে কতকগুলি ছবি টাঙানো আছে। এই শহরের বনেদি লোকগুলোর ছবি। তারা মরল—তিনি তাদের ছবি রাখলেন। এই ছবিগুলো দেখে কোনোদিন রাত কাটিয়ে দেন অথবা কোনোদিন ঘুমিয়ে পড়েন। ঘাট—অফিস পার হলে বারান্দা। ঘাটের কিছু কাঁথা—কাপড় ইতস্তত ছড়ানো। দুটো কুকুর শীতে কাতরাচ্ছে পাশে। ডোমেদের ছেলেপিলেরা কুকুর দুটোকে সরিয়ে দিয়ে নিজেরা দিব্যি আরামে ঘুমোচ্ছে।

তখন চটানে শীতের রোদ নেমেছে। শীতের ভোরে কাকের শব্দ, কুকুরের শব্দ, মোরগের শব্দ পাশাপাশি কোথাও। পাশাপাশি দুটো ঘরের ফাঁকে একটা শুয়োর পড়ে আছে। ঘোঁৎঘোঁৎ আওয়াজ করছে শুয়োরটা। দুটো বাচ্চা শুয়োর শীতে কাঁদছে।

হরীতকী দরজায় বসে সব দেখছিল। অন্য ঘরে গোমানি ডোম খকখক কাশছে। হরীতকীর কোমরে ব্যথা, তবু বসে বসে সব দেখছিল। কাশির জন্য গোমানি ডোমের গোঁফ কাঁপছে। চোখ দুটো জ্বলছে—জবাফুলের মতো লাগছে। কাঁপতে কাঁপতে মুখ থুবড়ে পড়ছে মাচানের ওপর। হরীতকীর কোমরে ব্যথা, তবু এসব দেখছিল।

গোমানি এদিকে ওদিকে তাকাল। বেলা দেখল। শীতের বেলা—রোদে তাপ নেই, তাপ থাকলে ঘাটের তোষক বালিশ ছেড়ে চটানের উঠোনে কিংবা ঘাট—অফিসের বারান্দায় গিয়ে বসতে পারত। হরীতকী দরজায় বসে এমন সব কিছুই অনুমান করছে। হরীতকী দরজায় বসে রয়েছে এক মালসা গরম জলের জন্যে। দুখিয়ার বৌ ঘাটের পোড়া কাঠে গরম জল করতে গেছে। একটু দেরি হবে—সে ভাবল এত সাধারণ কথা। গোমানির চোখ দুটো কাশির জন্য চোখ থেকে বার হয়ে আসতে চাইল। আবার ভিতরের দিকে পালাতে চাইল। সে দেখল বসে বসে। কোমরে ভীষণ ব্যথা। কোমরটা ধরে টিপল হরীতকী। ব্যথার উপশম খুঁজল। কোমরে চাপ ধরে আছে। সে দাঁড়াল, বাঁশে হেলান দিয়ে উঁকি দিল বাইরে। দুখিয়ার বৌ মংলি আসছে, হাতে গরম জলের মালসা। হরীতকী এত খুশি যে কিছু বলতে পারল না। মালসাটা টেনে নিয়ে পর্দার মতো কাঁথার আব্রু ফেলে দিয়ে গা ধুতে লাগল।

গোমানি মুখ তুলে হরীতকীর খুশি—খুশি ভাবটুকু লক্ষ্য করে বিরক্ত হল। সঙ্গে সঙ্গে শরীরে চটানের নেমকহারাম উত্তাপ জমতে থাকল। রাগ হল ওর। খিস্তি করতে ইচ্ছা হল—মাগি জাত একটা জাত! ওয়ার আবার, ধম্ম ওয়ার আবার স্বভাব! মাগির বাচ্চাটা হয়েছে শ্মশানে—হবে না! মাগির নেই জাতের ঠিক, নেই ধম্মের ভয়—চতুরাকে মদ খাইয়ে খুন করেছে—ও শ্মশানে বাচ্চা বিয়োবে না তো কী হাসপাতালে বিয়োবে! কিন্তু বলতে পারল না। শরীর দুর্বল—শীতের ব্যামোতে ওকে জব্দ করেছে। তা ছাড়া কাল না খেয়ে থাকার জন্য শরীরটা বেজান হয়ে আছে। ভুখা শরীর হল্লা করতে দিচ্ছে না। সেজন্য শরীরে আরও কাঁথা—কাপড় জড়িয়ে পাশের কিছু পোঁটলা—পুঁটলি ঠেলতে থাকল। বলল, উঠ নেলি, সকাল হো গিয়া।

কিছু কাঁথা—কাপড়ের ভিতর থেকে নেলি ধড়ফড় করে উঠে বসল। নেলির মুখটা শুকনো থাকত—যদি না রাতে এত গভীর ঘুমোত। শ্যামলা রঙের শরীর, এক মাথা চুল। চুলগুলো মুখ ঢেকে রেখেছে। চোখ অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চোখে বিরক্তির চিহ্ন। আরও ঘুমোনোর ইচ্ছে। অথচ সে কিছু বলছে না, আড়মোড়া ভাঙছে শরীরের। চোখ রগড়াচ্ছে। চুলগুলো জড়ো করে তালুতে খোঁপা বাঁধছে এবং মাচান থেকে নামার সময় বলছে, ক্যান ডাকলি বাপ? খোয়াব এয়েছিল, তু ডাকলি ক্যান!

গোমানি কাশল ক’বার। ওর উত্তর দিতে সেজন্য দেরি হচ্ছে, অথচ মেয়েটা নেমে যাচ্ছে—চলে যাচ্ছে। সে দম নিতে পারছে না। কথা বলতে পারছে না। ওর জ্বলন্ত চোখ একবার ভিতরে, একবার বাইরে দেখছে। কোনোরকমে লেপ—তোষকের ভিতর থেকে কচ্ছপের মতো গলাটাকে বার করছে। তবু যেন কোনোরকমে—ভুখ লাগিছে।

নেলি চলে যাচ্ছে। চলে যেতে যেতে থামল। আঁচলটা টেনে কাঁধে ফেলল। চোখ টান করে, ঘাড় কাত করে তাকাল বাপের দিকে। তারপর ফের চলতে চলতে উঠোনে নেমে গেল। নিচে নেমে শুয়োরের বাচ্চা দুটোকে ছেড়ে দিল—টঙ—এ কবুতর ছিল, তাও উড়িয়ে দিল। শেষে বসুমতীকে প্রণাম করল দুহাত ঠেকিয়ে।

এমন অবস্থায় গোমানির রাগ না বেড়ে যায় না। নেলি কথা বলছে না, খেতে দেবে কী দেবে না—তাও কিছু বলছে না। বড় বাড় বাড়ছে মেয়েটা। সে ডাকল, হে শুয়োরের ছা, তুকে কী বলিছে হাম? যেছিস কুথা।

যেছি—মরতে। নেলি সাফ জবাব দিল। সাফ সাফ কথা বলল। সে ফের মাচানে উঠে গেল এবং একটা কাঁথা শরীরে জড়িয়ে নিল। রোদের তাপ বাড়ছে একটু একটু করে। উঠোনের ওপর দাঁড়িয়ে সে তা ধরতে পারছে। কবুতরগুলো উড়ে উড়ে চালে, মাঠে ময়দানের ঝাউগাছটায় বসল। সে দেখল কবুতরগুলো পরস্পর ঠোঁট কামড়াচ্ছে—। ঝাউগাছের ডাল ধরে রোদ নিচে নামছে—সে দেখল। একটা পোয়াতি মাদি শুয়োর কাঠগোলায় শুয়ে আছে—সে দেখল। সে এখন ওর গঙ্গা যমুনাকে খুঁজছে! এই ভোরে ওরা কোথায় গেল! সে গলা ছেড়ে ডাকল, গ….ঙ্গা….যমু…..না, কুথা গেলি এবেনে তুরা।

গোমানি কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল মাচানে। বুকটা ওর ভেঙে যাচ্ছে উঠতে। নেলির ভাবসাবগুলো ওকে উন্মাদ করে দেবার মতো। সে কাশতে কাশতে বলল, দেখ নেলি, তুর এ ভাবসাব হামার ভালো লাগে না। যা বুলবি সাফ সাফ বুলবি—লয়তো ঘাটের মড়া মুখে ঠেসে ধরবে।

নেলি তখন ওর কুকুর দুটোকে আদর করছিল। ওরা ওর গায়ের ওপর লাফিয়ে উঠছে। সে শুনতে পাচ্ছে—বাপের গলায় গরল। সেও গরল তুলল গলায়—কিয়া বাত তুম বলেহ! ঘাটের মড়া ঠেসে ধরবে! ধর, ধরে যদি খানা মিলেত জরুর ধরবে।

হরীতকী শরীর পরিষ্কার করে ফেল দরজায় বসে সব দেখছে। শ্মশানে বিয়ানো বাচ্চাটা কাঁদছে ওর কোলে। সে এই সব দেখতে দেখতে ষাট সোহাগ করল, নেলি ওর ঘরের দিকেই আসছে। কুকুর দুটো তখন উঠোনের মাটি শুঁকছে। হরীতকী বাচ্চাটাকে রোদে রেখে দিল। তখন ঝাড়ো ডোমের ঘরে কী নিয়ে বচসা হচ্ছে। শিবমন্দিরের পথ ধরে শহর থেকে যাত্রী নামছে তখন। ওদের কোলাহল এই চটানে ভেসে আসছে। নেলি সেই সব কোলাহল শুনতে শুনতে হরীতকীর দরজায় এসে হাজির হল। পিসির বেটি রয়েছে—বেটির পাশে বসল। নাক নেড়ে আদর করল।

হরীতকী বলল, কিরে ভোর না হতেই বাপের সাথ ঝগড়া বাঁধালি?

হেঁ বাঁধিয়েছি ত। নেলি জবাব দিতে গিয়ে ঘাড়টা কাত করে দিল। হরীতকী ধমক দিল নেলিকে। ওকে শাসন করারও ইচ্ছা। —যা যা ঘরে যা। বাপকে দুটো রেঁধে দেগা। হাসপাতাল থেকে পুলিশ এলে ওকে ফের ভুখা যেতে হবে।

নেলি চুপচাপ ঘাড় গুঁজে পিসির বেটির পাশে কিছুক্ষণ বসে থাকল। তারপর কী ভেবে পিসিকে জবাব দিতে গিয়ে ভেঙে পড়ল—তু বল পিসি, হামি ওয়াকে কী রেঁধে দি। ঘরে কিছু না আছে। গিল রাতে ভুখা থাকতে হল। বুললাম তু যা, এক আধ রুপেয়া ধার লিয়ে চাল দাল কিছু লিয়ে আয়। গিল ঠিক, টাকায় আট আনা সুদে ধার ভি লিল, কিন্তুক কিছু চাল দাল লিল না। পারে সব কুচ রেখে দিল। পিসি, হামি ওয়াকে কী রেঁধে দি বুল।

এই সব কথা শুনে হরীতকী নেলিকে এড়িয়ে যেতে চাইল। এই সাত সকালে গোমানি ডোমের জন্য দরদ উত্থলে ওঠায় নিজের উপরই সে বিরক্ত হল। সেজন্য হরীতকী কোনো জবাব দিল না। পিসির বেটির পাশে বসে মাটিতে নেলি আঁচড় কাটছে। ঘাটের কাঠ এসেছে গরুর গাড়িতে। দূরে কুকুরের আওয়াজ, মোরগ, শুয়োর, কবুতরের শব্দ নেলির দেহমনকে কেমন মাতাল করে রেখেছে যেন। সে নড়তে পারছে না পর্যন্ত। গোমানি কাশছে! বসে বসে নেলি গোমানির গালাগাল খাচ্ছে। সে তখন মাতালের মতো উঠে দাঁড়াল। কুকুর দুটোকে নিয়ে গঙ্গায় নেমে গেল। কিন্তু ভুখা শরীর নিয়ে ওর চলতে খুব কষ্ট হচ্ছে।

শীতের গঙ্গা। জল নেই—হুহু করে বাতাস আসছে উত্তর থেকে। নেলির একমাথা চুলের খোঁপা খসে গেছে। ওর পাঁশুটে চুল বাতাসে উড়ছে। ঘাটে মড়া আসেনি। শ্মশানটা সেজন্য খাঁ খাঁ করছে। শ্মশানের চালাঘর ফাঁকা। কুকুরগুলো সেখানে জটলা পাকাচ্ছে। নেলির উপোসী শরীরটা চলছে না। ও ক্রমশ নিচে নেমে যাচ্ছে। যাত্রীদের ঘাট থেকে সে একটু দূরে দাঁড়াল। কুকুর দুটো ওর দুপাশে। কুকুর দুটোর মাঝখানে দাঁড়িয়ে সে আকাশ দেখল, উত্তরের হাওয়া গায়ে মাখাল এবং হিসেব রাখল যাত্রীরা কটা তামার পয়সা জলে ফেলছে।

চটান থেকে নামছে গেরু, সোনাচাঁদের ছেলে টুনুয়া, ঝাড়ো ডোমের বেটা লখি। গেরু নেলির পাশে এসে দাঁড়াল। নেলির গঙ্গা যমুনাকে আদর করল। ওরা যাত্রীদের অপেক্ষায় আছে। যাত্রীরা উঠবে ওরা নামবে। যাত্রীদের পয়সা, সোনাদানা, ডুবে ডুবে তুলবে।

গেরু বলল, নেলি তু এত সকাল সকাল!

তুভি ত এসেছিস রে। সকাল সকাল হামি একলা না আছি।

লেকিন তুর বাপ চিল্লাতে শুরু করেছে। বুলছে ও মাগি কাঁহা গ্যাল!

বুলছে ত বুলছে। লেকিন তুর নসিব ত ভাঙেনি।

লখি, টুনুয়া ততক্ষণ সবুর করতে পারল না। ওরা সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে সন্তর্পণে নেমে পড়েছে। যাত্রীদের চোখেও ওরা ধরা পড়ছে না। টুনুয়া একটা ডুব দিল। টুনুয়া, লখি একসঙ্গে ডুব দিল। ওরা ডুব দিয়ে যাত্রীদের ভিতরেই ভেসে উঠছে। ওরাও যাত্রী হয়ে গেছে। নেলি গেরু এই সব দেখতে পেয়ে লাফিয়ে জলে পড়ল। শীতের জলে ডুব দিয়ে যাত্রীদের ভিতর হারিয়ে গেল।

যাত্রীরা সব উঠে যাচ্ছে। ওরা ডুব দিয়ে সাঁতার কাটছে এবং গঙ্গার বুক থেকে মাটি, কাঁকর, বালি খড়কুটো সব তুলে আনছে। গেরু অনেকক্ষণ ডুব দিয়ে থাকতে পারে। বালির ওপর মাছের মতো খুঁটে খুঁটে চলতে পারে—নেলি জলের ভিতর থেকে সব দেখতে পাচ্ছে। জলের ভিতর দিয়ে গেরুর পেশী বড় মজবুত লাগছে। কোমরটা সরু লাগছে। বুকের পেশীগুলো শক্ত মনে হচ্ছে। গেরু অনেকক্ষণ জলের নিচে ডুব দিয়ে থাকতে পারে। মাছ হয়ে ভাসতে পারে। গেরুর নসিব ভালো—সে একটা একটা দুটো পয়সা পেল। তামার পয়সা। সে এক আনা পেল। নেলিও ডুব দিয়ে দিয়ে জল কাটছে। আঁচলটা বুক থেকে নেমে মাছের পাখার মতো কাঁপছে। নেলি জলের নিচে দেখল গেরু পয়সা খুঁজছে আর ওর দিকে যেন তাকাচ্ছে। নেলি এসময় এক আনা পেল, গেরু রে, তু আরও দেখ, যত পারিস দেখ। নেলি ডুব দিয়ে দিয়ে চোখ লাল করছে যদি নসিব খোলে। যদি সোনাদানা উঠে আসে আবর্জনার সঙ্গে। দাঁতে দাঁতে ঠেকল। সে ডুব দিল। এত করেও সে যখন পাচ্ছে না, যখন লখি, টুনুয়া সোনাদানা পেল যখন সকলে খুশি হয়ে উঠে যাচ্ছে, তখন নেলি গাল দিল—ডাক ঠাকুর তোর মুখে আগুন।

জল থেকে নেলি উঠে এল। গেরু উঠে এল। উত্তরের হাওয়া আরও বাড়ছে। নেলি শরীর সামলে নিল এবং বলতে ইচ্ছা হল, গিল কাল হামি ভুখা থাকলে গেরু। তুর চারঠো পয়সা হামারে দিয়ে দে। দু আনায় মুড়ি পিঁয়াজি কিনেলি। দুটো হামি খাই, দুটো বাপ ভি খাক। কিন্তু নেলি বলতে পারল না—জলের নিচে যে ইচ্ছার রঙে ডুবেছিল, উপরে উঠে সেই ইচ্ছাই ওকে বলতে দিল না। গেরুর দিকে তাকাল এবং নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে দৌড়ে উপরে উঠতে থাকল। বলতে থাকল যেন—গেরুরে, তু বহুত জোয়ান হয়ে উঠেছিস। উপরে উঠে টুনুয়াকে ডাকাল, এ টুনুয়া শোন। টুনুয়া কাছে এলে বলল, চারঠো পয়সা ধার দিবি। কাল হামি ভুখা থাকল, বাপ ভুখা থাকল।

টুনুয়ার কাছ থেকে চারটা পয়সা নিয়ে ফের ছুটতে থাকল নেলি। কাপড়ের আঁচলে পয়সা দু আনা শক্ত করে বেঁধে শিবমন্দিরের পথে উঠতে থাকল। আকাশটা পরিষ্কার। প্রচণ্ড শীত যেন আকাশ থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে নামছে। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কাপড় নিংড়াল নেলি। দুপুর হচ্ছে অথচ রোদের উত্তাপ বাড়ছে না। নেলি গায়েপিঠে উত্তাপ নিয়ে শরীরে উত্তাপ জমাতে পারল না। সে বিরক্ত হয়ে চটানের দিকে নেমে গেল। ঝাড়ো ডোম গাওয়াল করতে বের হচ্ছে—লাঠির দুপাশে ডালা—কুলো ঝুলছে। সোনাচাঁদ শহরের কুকুর বেড়াল ফেলতে মিউনিসিপাল অফিসে যাচ্ছে। দুখিয়া হল্লা করছে চটানে। নেলি চটানে না ঢুকে পুরোনো অশ্বত্থের নিচে দাঁড়িয়ে শুনল সব। দুখিয়া নালিশ দিচ্ছে গোমানিকে—তেরে বেটি চোর গোমানি। তেরে বেটি চোর। সাবধান করে দিস বেটিকে।

পুরোনো অশ্বত্থের নিচে দাঁড়িয়ে নেলি বুঝল বাপ উত্তর করছে না। এখানে দাঁড়িয়ে অন্তত কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। বাপের চেহারা এ সময় কেমন দেখাচ্ছে এই ভেবে নেলি মুষড়ে পড়ল। ভাবল, এখন চটানে উঠে গেলে বাপ হয়তো চেলা কাঠ নিয়ে তেড়ে আসবে। বলবে, হারাম তু চটানসে নিকাল। নেলি সুতরাং নড়ল না। আরও কিছু কথাবার্তা না শুনে সে নড়তে পারছে না। বাপের আওয়াজ কানে আসার আশায় পুরোনো অশ্বত্থের নিচে দাঁড়িয়ে থাকল। শীতে কাঁপল। কারণ আওয়াজ শুনলেই সে বুঝতে পারবে বাপের রাগ চেলাকাঠের না দু দণ্ড গালমন্দের। নেলি শুনল তখন বাপ বলছে—চোর! মেরে বেটি চোর!

হা জরুর চোর। তেরে বেটি চুরি করে লিছে ঘাটের কাপড়। বে হুদা হামার ডাক হল। তু কিছু করে না লিস ত পাঁচ জনকো হাম জরুর সালিসি মানে।

তু সালিসি না মানে দুখিয়া। ও আর ঘাটসে কিছু লেবে না। আমি ওয়াকে বারণ করে দেব।

নেলি বাপের এইসব কথাগুলো শুনে নিশ্চিন্ত হল। চটানে উঠে গিয়ে মাচান থেকে কাঁথা—বালিশের ভিতর থেকে একটা শাড়ি বের করল। ভিজে শাড়িটা এবং কাঁথাটা চালের ওপর ফেলে দিল। এ সময় হরীতকী দরজা থেকে মুখ বের করে দেখল দুখিয়া নেই—চলে গেছে। নেলি কাপড় ছাড়ছে, কাপড়ে বুক ঢাকতে চায় না। হাঁটু ঢাকতে চায় না। তবু নেলি কাপড়টা টেনেটুনে সব শরীরে পেঁচিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এই সব দেখে হরীতকীর কষ্ট হল এবং হাতমুখ নেড়ে ভিতরের কষ্টটাকে উগরে দিল—চামার! চামার! ছোটলোক!

গোমানি কাঁথা—কাপড়ের ভিতর থেকে সম্মতি জানাল, ছোটলোক—হা ছোটলোক বটে।

হরিতকির মনের ঝাল যেন মিটছে না।—ঘাটের কাপড় না বুলে লিয়েছে ত ওয়ার জান গেছে!

হা তাই বটে।

চুরি করে লিছে ঘাটের কাপড়! এর নাম চুরি! আর বুলি গোমানি বেটিকে কাপড় দেওয়ার মুরদও নাই তোমার। ঘাট থেকে চুরি করে তবে ওয়ার পিনতে হয়।

নেলি পুরোনো অশ্বত্থের নিচে দাঁড়িয়ে বাপের শেষ জবাবটাও শুনে গেল। —নাই আমার, হা নাই যা বুলছ।

নেলি চটান পার হয়ে শিবমন্দিরের পথ ধরল। সে শরীর ঢেকে গা বাঁচিয়ে হাঁটছে। সে জানে কেউ ওকে ছোঁবে না। সে জানে ছুঁয়ে দিলে ওরা স্নান করবে গঙ্গায় এবং নেলির চোদ্দপুরুষকে উদ্ধার করবে। নেলি রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটল। বাবুদের দেখে আলগা হয়ে দাঁড়াল। নর্দমার পাশে দাঁড়িয়ে শরীর আলগা করে দিল। জড়োসড়ো হয়ে সকলকে পথ খুলে দিল।

নেলি রামকান্তর দোকানে এসেও আলগা হয়ে দাঁড়াল।

রামকান্ত বলল—তোর বাপ চটানে আছে না হাসপাতালে গেছে?

চটানেই আছে। মাচানে পড়ে গোঙাচ্ছে।

ধারে টাকা নিল, টাকাও দিল না, সুদের নামও করল না।

করবে। হাতে টাকা হলে বাপ দিয়ে দিবে।

এবার গলা খাটো করল রামকান্ত। জোঁকের মতো গলা লম্বা করে দিল। এবং ফিসফিস করে বলল, হরীতকীর বাচ্চাটা মেয়ে না ছেলেরে?

মেয়ে বাচ্চা দি লিছে পিসি।

তুই বাচ্চা দিবিনে? তোর বাচ্চা দিতে শখ যায় না?

নেলি বাবুর মুখ দেখে অর্থ ধরতে পারল। সে চোখ ঢাকল। মুখ কুঁচকাল। কিন্তু কিছু প্রকাশ করল না। রামকান্ত সুদের মহাজন—নেলি রামকান্তকে ঘাঁটাতে সাহস করল না। অথচ চোখে—মুখে অস্বাভাবিক ভাব নেলির। বিরক্তিতে চোখ দুটো জ্বলছে। তবু সে এতটুকু রাগ দেখাল না। নরম গলায় ঢুলে ঢুলে বলল, কী যে বুলছে বাবু!

এমন কথা শুনে অনেক দিন পর রামকান্ত প্রাণ খুলে হাসল। কী যে বুলছে বাবু! নেলির মা ফুলনও এ—গলায় এমনি করে বলত। এমনি করেই চোখমুখে অস্বাভাবিক ভাব ফুটিয়ে তুলত। তখন ফুলনের মুখটা আরও মিষ্টি লাগত। তখন ফুলনের ভরা কোটালের যৌবন। নেলিকে প্রশ্ন করার মতো সেদিন ফুলনকেও প্রশ্ন করেছিল—ঝাড়ো ডোমের বাচ্চাটা মেয়ে না ছেলে? ডোমের বৌ বাচ্চা কেমন দিলে। তুই বাচ্চা দিবিনে, তোর মা হতে শখ হয় না?

তারপর একদিন চটানে শুনতে পেয়েছিল গোমানির পোয়াতি বৌর কান্না। মাচানের নিচে ফুলন উপুড় হয়ে পড়ে আছে। মেটে হাঁড়ি—কলসিগুলো নিচে থেকে সরিয়ে রেখেছে গোমানি। ঘাটের কাঁথায়—কাপড়ে মাচানের চারদিক ঢেকে দেওয়া হয়েছে। মাচানের ওপর গোমানি নিশ্চিন্তে বিড়ি টানছে। সুদের মহাজন রামকান্ত চটানে এসে অপেক্ষা করছে। এ সময় গোমানির টাকার দরকার হতে পারে। টাকা দেওয়ার জন্য বসে রয়েছে সে। গোমানি তখন মাচানের ওপর ফকির দরবেশের মতো। গোমানি তখন ঈশ্বরকে ডেকে বলছে, দুনিয়া আজব জায়গা। এখানের জনম—মরণ রহস্য আমরা ছোট মানুষ হয়ে কী করে জানব। ওর আসমান ওর জমিন—ও ঠিক টেনেটুনে খালাস করবেই। মাঝে মাঝে গোমানি মাচানের নিচে উঁকি মারছিল আর দেখছিল—খালাস পাচ্ছে কী পাচ্ছে না, এবং ঝাড়ো ডোমের বৌকে বলছিল—ভাবি, টেনে নামাস না। ওকে আপনি নামতে দে।

সেই মেয়ে এখন এত বড় হয়েছে, সেই মেয়ে এখন কাপড় সামলে হাঁটে। সেই মেয়েকে সে অযথা এখানে দাঁড় করিয়ে রাখতে চায়।

নেলি কিছু মুড়ি কিনল। কিছু পেঁয়াজি কিনল।

নেলি চটানে ফিরে এসে দেখল মাচানে তেমনি উপুড় হয়ে পড়ে আছে বাপ। বালিশের ভিতর মুখগুঁজে পড়ে আছে। হাত পা কুঁকড়ে রেখেছে। শরীরটা শুকনো লাউডগার মতো। গোমানি নেতিয়ে আছে মাচানে। মানুষটার পেটে রাজ্যের খিদে। নড়তে পারছে না—এ—পাশ ও—পাশ হতে কষ্ট।

নেলি সন্তর্পণে উঠোন পার হয়ে উঠল। মাচানে বসল। ধীরে ধীরে বাপের শরীর থেকে কাঁথা—কাপড় সরিয়ে ডাকল—বাপ, উঠরে বাপ। খা। দুটো দানা মুখে দেনেসে তাগদ হবে শরীরে। হাসপাতাল সে আজ জরুর সিপাই আওগে। তু খা লে।

গোমানি উঠে বসল। ওর পাতলা আমশি ঠোঁটে হাসি ফুটল। শেষে অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে মুড়ির ঠোঙাটা জোর করেই যেন নেলির হাত থেকে কেড়ে নিল। তারপর মুঠো মুঠো মুড়ি কুমিরের মতো হাঁ করে মুখটায় ঠেলে দিতে থাকল এবং মুড়ি খেতে খেতেই গোমানি বলল—খুব তাল মুড়ি আছে। দুটো মুড়কি লিলে ভালো হত রে। লয় তো কিছু বেগুনি, ফুলরি।

লিয়েছি। এক আনার পিঁয়াজি ভি লিয়েছি। দ্যাখ কেমন গরম গরম আছে।

বাপের এই খুশি—খুশি ভাবটুকু নেলির ভালো লাগছে। নেলি আঁচলে গিঁট খুলে পেঁয়াজির ঠোঁঙাটা ওর হাতে দিল। —দেখ কেমন গরম গরম লিয়েছি। তুর চারঠো হামার চারঠো। মুড়ি সবটা খেয়ে লিস না আবার। হামার লাগি রাখিস। ভুখ হামর ভি লাগিছে।

নেলিকে খুশি—খুশি দেখে বিড়ি খাওয়ার জন্য গোমানি চারটা পয়সা চাইল। —চরঠো পয়সা জায়দা হবে?

নেলি ঘাড় নাড়ল। তারপর বাপের দিকে চেয়ে বলল—না।

গোমানির দাঁত না থাকায় কথা খুব অস্পষ্ট। মুখভর্তি মুড়ি থাকার জন্য কথা আরও অস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মুড়িগুলো মাড়ি দিয়ে চিবুচ্ছে আর বলছে, চারঠো পয়সা জায়দা হোবে না বুলছিস। তবে চার পয়সার বিড়ি কিনে লিতাম।

নেলি দেখছে বাপ মুড়ি প্রায় শেষ করে এনেছে। একবার ওর কথা ভাবছে না। যেন সব মুড়ি, সবকটা পেঁয়াজি শেষ করে দেবে। যেন গোমানি একাই খাবে সব। বাপের এই অবিবেচনার জন্য নেলি বিরক্তিতে ভেঙে পড়ল। না হবে না। পয়সা হামার নেই। পয়সা পাব কুথা? দুচার পয়সা তু হামারে দিস?

তব তু এ—পয়সা কাঁহা পেলি? বুল শুয়োরের ছা, তু কুথা পেলি। গোমানি গলাটাকে ওঠাতে নামাতে থাকল।

পয়সা হামি কামিয়েছি। এ—মুড়ির পিণ্ডি যে তু গিললি সে হামার রোজগারের। লজ্জা না লাগে তোর মেয়েমানুষের রোজগার খেতে। পোড়া কাঠ খেতে পারিস না ঘাটের। পোড়া মানুষ চিবিয়ে খেতে পারিস না! নেলির মুখে গরল উঠল।

খুন! খুন করে দেব। গোমানি কাঁথা—কাপড় ছেড়ে উঠে পড়ল। কোমর থেকে লুঙ্গিটা খুলে যাচ্ছিল, সেটা কোনোরকমে ধরে ফেলল। এক হাতে কোমরের লুঙ্গিটা চেপে ধরে মাচান থেকে লাফ দিয়ে নামল। সে মুখ থুবড়ে পড়তে পড়তে বেঁচে গেল। মাচানের নিচে গলা বাড়িয়ে সে খুঁজছে দা—টা। মুড়ির ঠোঙা এক হাতে—সেটা ছাড়ছে না। মাচানের নিচে থেকে গলাটা ফের কচ্ছপের মতো বের করে ধরল। কচ্ছপের মতো চোখ করে সে নেলিকে দেখছে—খুন করে দেব বেইমানের ছা! আমি না তোর বাপ!

নেলি ভেংচে উঠল। হাত পা নেড়ে বলল, বাপরে! হামার বাপ! বাপের মুরদ দেখলে বাঁচিনে!

গোমানি ওর ভোঁতা দা—টাকে মাচানের নিচে খুঁজে বেড়াচ্ছে। হাঁড়ি টেনে কলসি টেনে দা—টা খুঁজছে। দা—টা ওর এ—মুহূর্তে চাই—ই। খুন সে যেন করবেই। নেলিকে খুন না করে জলগ্রহণ করবে না—এমন ভাব চোখে—মুখে। নেলি কিন্তু নড়ছে না। মেঝেতে দাঁড়িয়ে বাপের কাণ্ড দেখছে। আর যখন দা পেয়ে গোমানি ওর সামনে দা—টাকে ঘোরাতে ঘোরাতে চিৎকার করল—খুন, খুন, আজ খুন হবে লিশ্চয়, তখন নেলি গলার স্বরটা শক্ত করল এবং পরে কোমল করে বলল, চুপ কর, চুপ কর। অমন করে ছোটলোকের মতো চিল্লাস না। যা খাচ্ছিস তাই খা, পয়সা না থাকলে দি কোত্থেকে!

গোমানি দেখল ঠোঙায় মুড়ি প্রায় নেই। সুতরাং সে নেলির মুখে ঠোঙাটা ছুঁড়ে দিল। —আর খাব না। তুর গতরের রোজগার হামার লাগে না।

গোমানি ফের মাচানে উঠে কাঁথা—কাপড় গায়ে দিয়ে বসে থাকল। যেন সে এ—মাচান থেকে আর উঠবে না, নড়বে না। অনড় হয়ে বসে থাকবে। হাসপাতালে যাবে না। কোথাও যাবে না। কোথাও না। নেলি হাঁটু গেড়ে মাটি থেকে একটা করে মুড়ি কোঁচড়ে তুলছিল তখন। একটা দুটো করে মুখে মুড়ি ফেলছিল। এই দুঃসহ দুঃখে বাপের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছে না। ক্ষোভে চোখ থেকে জল বের হচ্ছে। ওর কান্না পাচ্ছে। এবং এ—সময়ই নেলির গেরুর মুখ মনে পড়ছে। জোয়ান শরীরটার কথা মনে পড়ছে। কৈলাস ডোমের বেটা দিন দিন চটানে মরদ হয়ে উঠছে। বাপের মতো কসরত দেখাতে শিখেছে। বল্লম ছুঁড়ে গাছ এফোঁড়—ওফোঁড় করে দিচ্ছে। আকাশ ফুটো করে দেওয়ারও ইচ্ছা যেন গেরুর।

মাচানে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকল গোমানি। রাগ পড়তে শুরু করেছে। কিন্তু নেলির হাবভাব দেখে মনটা ওর ফের বিগড়ে গেল। নেলি পিঁয়াজি খাচ্ছে—আহা পিঁয়াজি খাচ্ছে—যেন কিছু খায় না। যেন গোমানিকে দেখিয়ে দেখিয়ে খাওয়া হচ্ছে। যেন বলছে খেতে খেতে তোর কামাই খাচ্ছি নারে, আমার মুরদের কামাই খাচ্ছি। তবে এত ডর কীসের।

থুঃ থুঃ! গোমানি থুথু ছিটাল। —না আর খাব না। তোর গতরের রোজগার হামার লাগে না। যেন পারলে এক্ষুনি উগরে দেয় সব। বাপের এইসব কাণ্ড দেখে নেলি খিলখিল করে হেসে উঠল। না হেসে পারল না। না হাসতে পারলে খালি পেটে খিল ধরে যাবে যেন। উঠোনে নেমেও সে হাসল। পাগলের মতো হাসতে থাকল। মুখে বাপের থুথু লেগে আছে, মুড়ির কুচি লেগে আছে—সব মিলে ভীষণ একটা দুর্গন্ধ। নেলি হাতমুখ ধুল মালসার জলে। ফের হাসতে গিয়ে দেখল সামনে দাঁড়িয়ে সিপাহি। নেলি ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল। ছুটে এসে ঘরে ঢুকল সে।

হরীতকী গোমানির এই সব কাণ্ড দেখে বলেছিল—তুমি একটা বাপই বটে গোমানি।

হে বাপই বটে! গোমানি মাচানে বসে জবাব দিয়েছিল।

এটা বহুত আচ্ছা কাজ হল না। মেয়েটা ভি না খেয়ে রয়েছে, ওয়াকে তুমি খেতে দিলা না।

গোমানি একটা কোঁত গিলল।

গোমানির সওয়াল শুনল নেলি। সিপাহি উঠোন পার হয়ে গোমানির খোলা ঘরটার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ওর জুতোর শব্দে মুখ তুলল গোমানি। সিপাহিকে দেখে খুব ভালোমানুষ হয়ে গেল। যেন এতক্ষণ চটানে কিছুই হয়নি। সে হাসল পুলিশ দেখে।

নেলি সিপাহিকে একটা পিঁড়ি দিল বসতে।

সিপাহি বলল—হে গোমানি চলেহ।

হা জি চলতে রহেহ। গোমানি কাঁথা বালিশের নিচে এখন গামছাটা খুঁজছে। —কাঁহাসে লাশ এল?

মধুপুরসে। সিপাহি পিঁড়ি টেনে বসল উঠোনে।

গোমানি কাঁথার ভিতর থেকে গামছা টেনে বের করল। —খুনের লাশ না গলায় দড়ির লাশ। মাথায় কাপড় দিয়ে ফেট্টি বাঁধার সময় এই ধরনের একটা প্রশ্ন করল সিপাহিকে।

সিপাহি দেখে গোমানির শরীরের সব জড়তা ভেঙে যাচ্ছে।

নেহি, পানীসে ডুবল জোয়ান মেয়ে।

পেটে বাচ্চা আছে জরুর।

সে বাত ত গোমানি তুম জানবে।

গোমানি গামছা কোমরে বেঁধে উঠোনে নামল। চালাঘরে দুটো মোরগ ডাকছে। একদল কাক হল্লা করছে পুরোনো অশ্বত্থ গাছে। চটান ছাড়িয়ে একটা দেওয়াল অতিক্রম করে বড় বাড়ির দোতলায় রেডিয়ো বাজছে। উড়োজাহাজের শব্দ আকাশে। ঝাড়ো ডোমের বৌ চেলাকাঠ ভাঙছে ওর মেজোবেটার পিঠে। গোরুর গাড়িগুলো চটান থেকে নেমে যাচ্ছে! ঘাটোয়ারিবাবু চেয়ারে বসে কাগজ পড়ছেন। ঘাটে মড়া আসেনি। কাউন্টারের সামনে কোনো লোক দাঁড়িয়ে নেই। আকন্দ গাছের ডাল বেয়ে রোদ উঠে যাচ্ছে। গোমানি চটান ছেড়ে শিবমন্দিরের পথে পড়ল।

গোমানিকে চলে যেতে দেখে নেলি ডাকল—বাপ!

ফের পিছু ডাকলি!

ঘরে কিছু লেই বাপ! ও বেলায় খাবি কী? তু জলদি আওগে ত।

আওগে। আওগে। খাব, ঠিক খেয়ে লিব। লেকিন তু কোথাও যাস না। দিনকাল বহুত খারাপ। গোমানি শিবমন্দিরের পথ ছাড়িয়ে বড় রাস্তায় পড়ল।

নেলি চলতে থাকল। সঙ্গে গঙ্গা যমুনা চলছে। চটানে নেলিকে ধমক দেওয়ার মতো আর কেউ নেই। সে এখন একটু ঘুরবে ফিরবে। সে এখন পাশাপাশি সব চালাঘরগুলোতে উঁকি দেবে। ওদের রান্নার কথা শুনবে, ঘরে ঘরে শুধাবে ওরা বিকেলে কী খাবে। সে—সব শুনে সে বিষণ্ণ হবে। পেটের যন্ত্রণাটা তখন আরও বাড়বে।

নিজের কথা ভাববার সময় গঙ্গা যমুনার কথা মনে হল। গঙ্গা যমুনাকে এখনও পর্যন্ত কিছু খাওয়াতে পারল না। গঙ্গা যমুনা পায়ে পায়ে ঘুরছে, খেতে চাইছে। আজ এখনও ঘাটে মড়া আসেনি। রাতের বুড়ো মানুষটার নাভিটা নিশ্চয়ই কচ্ছপেরা শেষ করে দিয়েছে। গঙ্গা যমুনা বিরক্ত করছে ত করছেই। নেলি অগত্যা বলল, লে—লে—খেয়ে লে। হামার গতরটা খেয়ে লে। এই শুনে কুকুর দুটো কী বুঝে ছুটতে থাকল। নেলিও ছুটল কুকুর দুটোর পিছনে। গঙ্গার পাড় ধরে ওরা ছুটছে। নেলির ইচ্ছা, এ—সময় গেরু আসুক, ওরা একসঙ্গে ঘাটবন্দরে উঠুক। তারপর আরও দূরে আরও দূরে। সেখানে বুড়ো মানুষটার জন্যে আতপ চাউল সিদ্ধ হচ্ছে, কিছু তন্ত্র—মন্ত্র হচ্ছে তারপর ডেলা ভাতগুলোতে কিছু কালো তিল মিশিয়ে বুড়ো মানুষটার বেটারা গঙ্গার জলে ভাসাবে। নেলি সব খবর রাখে। নেলি সেই উদ্দেশ্যেই আপাতত হাঁটতে থাকল।

নেলি লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটছে। কুকুর দুটোও লাফাচ্ছে। নেলির চুল উড়ল উত্তুরে হাওয়ায়। কাপড় উড়ল। এখানে সেখানে ঝোপ, ঝাড়, জঙ্গল। এখানে সেখানে উঁচুনিচু মাটি। নেলি লাফিয়ে লাফিয়ে যাচ্ছে।

কতবার ঘুরে গেছে এ—অঞ্চলে নেলি। কতবার লখি এল, টুনুয়া এল। গেরু, গঙ্গা, যমুনা এল। কতবার সে একা এসেছে। কুকুর দুটো ওকে পাহারা দিয়েছে। জলকলের সেই অদ্ভুত শব্দটা সে কতবার শুনল। কতবার শুনেছে। আজও নেলি কান পেতে শুনল। মাটি এখানে কুমিরের পিঠের মতো অমসৃণ। ঝোপ—ঝাপ সবুজ কাঁটার জঙ্গল দুধারে, দু মানুষ সমান উঁচু বনফুলের ঝোপ। দু—একটা গিরগিটি লাফিয়ে পড়ল ওদের উপর। দু—একজন মানুষ শহর থেকে ফিরছে। আকাশে চিল উড়ছে—দূরে দূরে আসশ্যাওড়ার জঙ্গল। সোনা—ব্যাঙের ঢিবি মাঝে মাঝে। দুটো একটা খরগোশের গর্ত—গঙ্গা যমুনা নাক দিয়ে গর্তগুলো শুঁকছে।

নেলি পথের মোড়ে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল। সে জানে বুড়ো মানুষের বেটারা ওই পথে গঙ্গায় নেমে আসবে। হাতে ওদের নতুন মালসা থাকবে। মালসায় আতপ চালের ভাতগুলো ডেলা ডেলা থাকবে। বুনো ঘাস থাকবে উপরে। নেলি এখানে দাঁড়িয়ে ঝোপ—জঙ্গল অতিক্রম করে দূরে পুরোনো বড় বাড়িটা দেখতে পাচ্ছে—বুড়ো মানুষটা গত রাতে এ—বাড়ি থেকেই ঘাটে গেছে। যমুনাকে দিয়ে বুড়োর খাটো কাপড়টা সে রাতে চুরি করিয়েছে। দুখিয়া বলছে, নেলি চোর। বলেছে, নেলি বেইমানি কিয়া। হাম জরুর সালিসি মানে,—তু বলিছে, হাম শুন লিছে। চামার! চামার!

নেলি এই পথের ওপর দাঁড়িয়ে দুখিয়াকে গাল দিতে থাকল। ….ঘাটের ডাক লিয়েছিস বুলে মাথা কিনে লিয়েছিস! একটা খাটো কাপড় লিয়েছি, ওয়ার লাগি জান গেছে। হাম সালিসি মানে! সালিসি! কে শুনে লিবে রে তুর সালিসি। কোন শুনে লিবে। হামি বলবে না কিছু তু ভেবে লিছিস। নেমকহারাম! বেইমান! নেলি এখন সেই কাপড়টাই পরে আছে বলে ওর যেন যন্ত্রণা হতে থাকল এবং গলায় গরল উঠতে থাকল।

কুকুর দুটো ওর পায়ে পায়ে ঘুরছে। সে এ—সময় কুকুর দুটোকে সালিস দিল—শুনে লে দুধিয়া কী বাত বুলছে। হামি চোর, তু চোর—এ বাত বুলছে। তুরা হামার সালিসি থাকল।

নেলি এবার কুকুর দুটোকে হাত জড়িয়ে আদর করল। জলের নিচে দেখা গেরুর শরীরটা ওর মনে পড়ল। —গেরু, তু বহুত আচ্ছা আছে। তু একদফে বড় হয়ে ঘাটের ডাক লিবি। ঘাটের কাঁথা—তোষক সব লিবি। দুখিয়ার মাথায় লাঠি ভাঙবি। হামি বহুত খুশি হবে। তু আওর হামি, হামি আওর তু। নেলি এই নিঃসঙ্গ পথে দাঁড়িয়ে অভুক্ত শরীরে স্বপ্ন দেখল। এখন চিলের ছায়াটা জলের ওপর ভাসছে। জলের ওপর নিজের ছায়া দেখল, গেরুর ছায়া এবং বুঝল নেলি এখন বড় হয়েছে। হঠাৎ এই ভরদুপুরে শরীরটার দিকে চেয়ে ওর কেমন ভয় করল। ও ছুটতে থাকল। ও ছুটছে ফের। হঠাৎ কী এক রহস্যকে ধরতে পেরে নেলি ভয়ে ভয়ে চটানে উঠে এল। চটানে উঠেই শুনল শিবমন্দিরের পথে হরিধ্বনি দিচ্ছে। ঘাটে মড়া নামানো হচ্ছে।

নেলি বুঝতে পারছে মড়াটা বড়ঘরের। বাবু মানুষদের কাঁধে খাটুলী। নেলি এই বাবু মানুষদের গঙ্গার পারে কতদিন দেখেছে। কতদিন দেখেছে। কতদিন সে দিদিমণিদের আলগা হয়ে পথ করে দিয়েছে। কতদিন এই সব বাবুভাইদের ধমক খেয়ে চটানে ফিরে এসেছে! ওরা এখন সিঁড়ি ধরে নেমে ঘাটের দিকে যাচ্ছে। দুখিয়া ছুটছে চটান থেকে। —আহারে মরদ হামার। ছুটছে ত ছুটছেই। তুর বৌটা কুথারে? বৌটাকে সাথে লিয়ে লে! একা ছুটলে আছাড় পড়বি। নেলি রসিকতা করতে চাইল দুখিয়াকে।

এখন চটানের মাগি মরদরা অফিসের বারান্দায় সব জমা হয়েছে। ওরা এখন কাঠ বইবে ঘাটে। ঘাটোয়ারিবাবু কাউন্টারে বসে পত্রিকা পড়ছেন। চোখ তুলছেন না অথচ বুঝতে পারছেন কোথায় কী হচ্ছে। তিনি জানেন দুখিয়া ঘাটে ছুটে গেছে। মড়ার কাঁথা—কাপড় আগলাচ্ছে। মড়ার নাকে কানে গহনা আছে কিনা দেখছে। তিনি জানেন হরীতকী আজ কাঠ বইতে আসবে না, সোনাচাঁদ আসবে না। কৈলাস আসবে না। গোমানি চটানে থাকলে আসত। নেলি আসবে, গেরু, লখি, টুনুয়া, ঝাড়ো ডোমের সব বেটারা, পারলে বৌটা পর্যন্ত। মণ পিছু দু আনা পাবে—চার মণে আট আনা। আনা আনা ভাগ বসাবে—না পেলে মারধোর করবে। চাটনে নাচন—কোঁদন শুরু হবে ফের।

এ—ছাড়া তিনি কাউন্টারে মুখ না তুলেই বুঝতেই পারেন কে সেখানে দাঁড়াল। কার ছায়া পড়ল। তিনি সব বুঝতে পারেন।

তিনি প্রশ্ন করলেন, কোত্থেকে মড়া এল? কার মড়া?

মড়া সেনবাবুদের।

কী হয়ে মরল?

দু দিনের জ্বরে।

বেশ, বেশ। কী নাম? মেয়েছেলে না বেটাছেলে?

ঘাটোয়ারিবাবু এবার মুখ তোলেন। রেজিস্ট্রিখাতা বের করে লাল কালিতে প্রথমে নখে নিব ঘষলেন। রেজিস্ট্রিখাতা থেকে কয়েকটা নাম উচ্চারণ করলেন। ওটা ওঁর স্বভাব। তিনি বললেন, কৃষ্ণপক্ষে যশোদানন্দন গেল, আহা যশোদানন্দন! তুমি তবে মরেছ। বেশ করেছ। কাজের কাজ করেছ। হীরামতি গেল নিতাই পাঠক গেল—এবারের নামটি কী যেন বললেন?

সুচিত্রা গুপ্তা।

বেশ, বেশ সুচিত্রা গুপ্তা। বয়স?

আঠারো।

কাঁচা গেল দেখছি। কী হয়ে মরল যেন?

দু দিনের জ্বরে।

তা হলে দু দিনের জ্বরে লোক এখনও মরছে। বেশ, বেশ। হরি ওঁ। ঘাটোয়ারিবাবু রসিদ লেখার আগে বললেন, হাসপাতাল থেকে এল?

না।

ডেথ—সার্টিফিকেট থাকলে দেখাতে পারতেন।

নেই।

তবে থাক। বেশ, বেশ। পরম ব্রহ্মনারায়ণ। রসিদটা কাউন্টারে ফেলে দিয়ে এই সব কথাগুলো বললেন।

তারপর ঘাটোয়ারিবাবু বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। শীতের নদী বালিয়াড়িতে নেমে গেছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে শ্মশান দেখা যাচ্ছে না। শ্মশান বালিয়াড়িতে নেমে গেছে, সুতরাং শ্মশান দেখতে হলে ঘাটে নামতে হবে। নদীর ধারে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। ঘাটোয়ারিবাবু কিছু দেখতে পাচ্ছেন না। ঘাট থেকে মানুষের কান্না ভেসে আসছে। তিনি তাড়াতাড়ি ইচ্ছা করেই যেন ডাকলেন এ গেরু, তোর বাপকে ডাক। কৈলাসকে কাঠ দিতে বল। তোরা ঘাটে কাঠ দিয়ে আয়। মড়াটা তাড়াতাড়ি জ্বলে যাক।

সেই সময় নেলি শুনতে পেল মড়াটার নাকে কানে গহনা আছে। গলায় গহনা আছে। দুখিয়া লাঠি নিয়ে পাহারা দিচ্ছে। মংলি চিতা সাজানোর আট আনা পয়সা নিয়ে বচসা করছে। চিতা সাজানোর কাজ হরীতকীর। না থাকলে মংলি। মংলি বচসা করছে, আওর জায়দা লাগবে।

নেলি চটান থেকে ঘাটে গিয়ে দাঁড়াল। এখানে অনেক মানুষের ভিড়। চারপাশের লোকগুলো খুব কাঁদছে। নেলি ভিড়ের ভিতর গলাটা বাড়িয়ে দিল। মড়াটা দেখল। ওর হাতের কানের গহনা দেখল। গলার গহনা দেখল। গহনা সহ পুড়িয়ে দেওয়া হবে বলে দুখিয়া পাহারায় আছে; কয়লা ধুয়ে কেউ গহনা চুরি করে না নেয়, অথবা ওর নসিবে কেউ যেন ভাগ না বসায়। নেলি মনে মনে বাপের ওপর রাগ করল। বাপ এক দফে ডাক নিল না ঘাটের। নসিব খুলার চেষ্টা কভি না করল। নেলির বলতে ইচ্ছে হল, তু বুড়বক আছে বাপ। দুখিয়ার নসিব দেখে নেলির পেটের যন্ত্রণা আরও বাড়ছে।

যেমন বেঁটেখাটো দুখিয়া, তেমন জংলি মরদ। মরদ মাগি সমান—কথায়, বচসায় নাচনে কোঁদনে সব কিছুতে। নেলি হাতের কানের গহনা দেখে দুখিয়া—মংলিকে দেখল চেয়ে। নেলি মংলিকে দেখে গাল দিল। কী লুকঝুক নতুন চাদরের লাগি! মংলির কদর্য মুখটা নেলিকে যেন ঘাটে বিব্রত করে মারছে। বিরক্ত করে মারছে। এবং সঙ্গে সঙ্গে বদলা নেওয়ার ইচ্ছায় গঙ্গা যমুনাকে লেলিয়ে দেবার এক তীব্র হিংসায় জ্বলে পুড়ে সে খাক হতে থাকল। মংলির চোখ তুলে নেওয়ার জন্য গঙ্গা যমুনা ওর একমাত্র ভরসা—ওয়ার মরদ বুলে কিনা হামি চোর! হামি চোর আছে। চোর আছে ত ঠিক আছে। চোর যখন আছে তখন ঘাটের গহনা ভি চুরি করে লিব। হেঁ লিব। জরুর লিব। নেলি মনে মনে এই সব বলে যেন শপথ নিল। —লিব। লিব। লিব। এ—ঘাট এখন ভালো লাগছে না। চটান ভালো লাগছে না। শ্মশানটার চারপাশে ঘুরে ঘুরে অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। নিজের বাপের কথা মনে হল। বাপ হয়তো এখন হাসপাতালে লাশটার পেট চিরছে। নেলি ঘুরে ঘুরে উপরে উঠে এল। উপরে কাঠ বইতে হবে। কাঠ ফেলতে হবে ঘাটে। সুতরাং নেলি চটানে উঠে গেল। চটানে যাকে দেখল বলল—দুখিয়ার নসিব খুলে গেল। মংলির ভি নসিব। বহুত সোনাদানা ঘাটে এয়েছে। কয়লা ধুয়ে দুখিয়া সব গহনা লিয়ে লিবে। ডোমের কোনো বেটা—বেটিকে দুখিয়া ঘাটে কিছু ঢুঁড়তে দেবে না।

নেলি চটানে উঠে কয়েকটা কাঠ নিল কাঁধে। হরীতকীর দরজার পাশ দিয়ে ঘাটে নামার সময় ডাকল—পিসি!

হরীতকী দরজা থেকে মুখ বার করে জবাব দিল—বুল।

তু ঘাটে যাবি না পিসি? বহুত পয়সায়ালা ঘরের জোয়ান বেটি ঘাটে এয়েছে। বেটি কী খুবসুরৎ, তু যাবিনে ঘাটে?

না, যাব না।

ক্যানে যাবি না তু পিসি?

শরীর দিচ্ছে না। দুখিয়ার জবরদস্তি হামার ভালো লাগে না। ওয়ার ঘাটে হামি থুথু ফেলি। ভোরে তু ত চোর বনে গেলি। ও নালিশ দিল গোমানিকে, তু চোর। তু ওয়ার কাঁথা—কাপড় চুরি করে লিচ্ছিস।

এইসব শুনে নেলির কোমরটা দুলে উঠতে শুরু করেছে। মংলিকে বিদ্রুপ করার জন্য সাপের মতো জিভটা লকলকিয়ে উঠল। —মংলিটা বুলে কী পিসি! বুলে যা ঘাট অফিসে যা, ঘাটোয়ারিবাবুকে বুলে ভালো ভালো কাঠ লে। বিছানার চাদরটার লাগি কী লুকঝুক! লতুন চাদর, আহা মাটার কী সর্বনাশ পিসি! মংলি বুলছে চাদর, তোশক, বালিশে আগুন ধরাতে দেবে না। হাতের কানের গহনা ভি লেবে। অত ভালো লয় পিসি। তু কী বলিস?

হরীতকী জবাব দিল না বলে ফের বলল—পিসি!

বুল।

একজোড়া গহনা হলে হামি কতদিন খেয়ে লিব দেখে লিস। বাপকে কত বুললাম তু ঘাটের ডাক লে এক দফে। দেখে লিবি তখন কত সুখ হামাদের। কত গহনা! এক দফে যদি লিত পিসি!

তুর বাপ পচাই খাবে না ও কাম করবে? দুরোজ আগে দেখলাম মাচানের নিচে বসে ওত ইসপিরিট খাচ্ছে। হাসপাতালসে চুরি করে ইসপিরিট লিচ্ছে। তুর বাপ মরবে। জলদি ও পার পাবে দেখে লিবি। খাবে না, দাবে না—পেট ওয়ার জরুর পচবে।

খড়ম পায়ে তখন ঘাটোয়ারিবাবু ঢুকছেন চটানে। খড়মের শব্দ শোনা যাচ্ছে। হরীতকী তাড়াতাড়ি কাপড় সামলে বসল। বাচ্চাটাকে কোলে নিল। আদর করল। নেলি তখন চটান থেকে সরে পড়ার চেষ্টা করছে। ঘাটোয়ারিবাবু ওকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে বকবে। কাজে ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে এ—কথা বলবে। কিন্তু নেলি দু কদম সরে না যেতেই তিনি ডাকলেন—কাজে খুব ফাঁকি দিচ্ছিসরে।

না বাবু। বাবু, ওরা গহনা পুড়িয়ে দেবে না লিয়ে যাবে? নেলির ইচ্ছা গহনা ওরা নিয়ে যাক। গহনা না পুড়িয়ে শুধু মানুষটা পুড়িয়ে দিক। দুখিয়ার নসিবে আগুন লাগুক।

ঘাটোয়ারিবাবু ধমক দিলেন নেলিকে—তার আমি কী জানিরে ডোমের মেয়ে! আমি কী মড়ার মালিক! কী কথা বলেগো মেয়েটা! কাজে যা কাজে যা। যা করছিস তাই কর। গহনা গহনা করিস না। গহনা দিয়ে কিছু হয় না। তারপর ঘাটোয়ারিবাবু চারদিকে চাইলেন—তখন নেলি গঙ্গায় নেমে যাচ্ছে। কাঠ সাজাচ্ছে ঝাড়ো। সোনাচাঁদ অফিস থেকে ফিরে এসেছে। ঝাড়ো ডোমের বৌ বাঁশের পাতি তুলছে বঁটিতে। কৈলাসের শেষ বৌটা মানুষের কঙ্কাল সিদ্ধ করছে সোডার জলে। ঘাটোয়ারিবাবু এইসব দেখতে দেখতে হরীতকীর দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। দরজার ওপর ঝুঁকে বললেন, বাচ্চাটাকে দেখা। একবার দেখা। বাচ্চাটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, শেষ পর্যন্ত শ্মশানেই বাচ্চা বিয়োলি! বাচ্চাটা বাঁচবে অনেকদিন।

ঘাটোয়ারিবাবুর কথা শুনে হরীতকীর চোখ দুটো ভার হয়ে উঠল। ওঁর বসার জন্যে পিঁড়ি বের করল, পেতে দিল। তিনি বসলেন। হরীতকী বলল, কী আর করব বাবু। ঘাটে কাঠ দিতে গিয়ে গিল রাতে বেটি হামার হয়ে গেল। তারপর কী ভেবে হরীতকী, বাবুর সামনে ওকে শুইয়ে দিল। কুঁকড়ে আছে বাচ্চাটা। রোদের উত্তাপে আর কাঁদছে না। চোখ দুটো ঠিক মেলতে পারছে না। বুড়ো বয়সের এই বাচ্চা হরীতকীর খুব দরদের। হরীতকী খুব খুশি হয়েছে। হরীতকী অপলক চেয়ে থাকল।

ষাটোয়ারিবাবু ভাবলেন চতুরা বেঁচে থাকলে দু হাঁড়ি পচাই গিলত আজ। খুশিতে ডগমগ করত। হরীতকীর দিকে চেয়ে বললেন, কাল কাঠ না বইলেই পারতিস। চিতা না সাজালেই হত। তারপর তিনি ফিসফিস করে বললেন, যাক সবই ঈশ্বরের ইচ্ছা। এবার তাহলে তুই সং সাজলি হরীতকী! তিনি এই বলে উঠে পড়লেন।

হরীতকী ডাকল—বাবু—

কিছু বলবি আমাকে?

হরীতকীর চোখ দুটো লজ্জায় ভারী হয়ে উঠছে। তবু সে না বলে যেন থাকতে পারল না—বাবু বাচ্চাটা কেমন দেখলি?

ঘাটোয়ারিবাবু নিস্পৃহ জবাব দিলেন—ভালো।

কার মতো হবে বুলত?

তোর মতো।

না তোর মতো হবে দেখে লিস। হরীতকী ঘাটোয়ারিবাবুর দিকে চেয়ে হাসল। তিনি কিন্তু হাসলেন না। তিনি হরীতকীর মুখ দেখলেন। চোখ, মুখ, শরীর, দেখলেন হরীতকীর। চোখে এক ধরনের ইচ্ছার প্রকাশ—যা ঘাটোয়ারিবাবুকে কিছু কিছু ঘটনার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। যেন বলতে চাইছে—আ যা বাবু কাঁহা ভি চল যাই। যেন বলতে চায়—এ—চটান ছোড় দে।

তিনি মুখের ভাবটুকু উদাস করতে চাইলেন। অথবা কেমন অসহায় মনে হল ঘাটোয়ারিবাবুকে। তিনি বললেন, আমার মতো হলে তুই খুশি হবি, কিন্তু লোকে তা হবে না। চতুরার মতো হলেও ভালো হয়। লোকে চতুরার ছা বলেই জানুক। চতুরার মতোই ও দেখতে হোক। সংসারের সং সাজতে আমার আর ইচ্ছে নেই।

হরীতকীর চোখেমুখে গরল উঠতে চাইল!—সংসারের সং সাজতে তুকে বুলেছি! আর বুলব না। পেটটাকে লিয়ে এতদিন ভয় ছিল। পেটটা খালাস হয়ে হামাকে খালাস দিল। হামাকে লিয়ে তোকে আর কোথাও যেতে হোবে না। কোথাও আর পালাতে বুলব না। হামার নসিব লিয়ে হামি বেটি কে সাথ এ—চটানেই পড়ে থাকবে। লেকিন তুকে বুলবে না—আ যা বাবু—কাঁহা ভি চল যাই। কভি বুলবে না এ—চটান ছোড় দে।

যে রোদটা অশ্বত্থ গাছের ডাল ধরে নিচে নেমেছিল সেই রোদ এখন অশ্বত্থ গাছের ডাল বেয়ে উপরে উঠছে। ঝাড়ো ডোম দাওয়ায় বসে তামাক টানছে। হরীতকী বাচ্চা দিয়েছে বলে ঝাড়ো ডোমের ঘর থেকে ঘাটোয়ারিবাবুর খাবার গেছে। অফিসঘরের কোনায় টিনের থালায় কিছু ভাত, ডাল, শাকসবজি। ঘাটোয়ারিবাবু কিছুক্ষণ গীতা পাঠ করেন এই সময়, জানালায় বসে কিছু সময় মা গঙ্গা দর্শন করেন। তারপর তিনি কিছু আহার করেন। এই সময় ডোমেদের ছোট ছোট ছেলেরা অফিসঘরটার চারপাশে ঘুর ঘুর করবে—কখন তিনি ডাকবেন সেই আশায় অপেক্ষা করবে—যেদিন ডাকবেন না জানালা দিয়ে ওরা উঁকি মারবে অথবা হাত পাতবে। তিনি বলবেন—এখন হবে না। যা।

কৈলাস ওর ঘরে শুয়ে আছে। মাচানে ঠ্যাং ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। ওর শেষ পক্ষের বৌ ঠান্ডাভাত খাচ্ছে। সঙ্গে দুটো কাঁচা পেঁয়াজ নিয়েছে, দুটো কাঁচা লংকা নিয়েছে। পিঠে রোদ দিয়ে খাচ্ছে। সে পিঠ চুলকাল। চোখ কোঁচকাল। কাঁচা লংকার জন্য জল পড়ছে চোখ থেকে। নেলি ঘরের ভিতর থেকে বেড়ার ফাঁক দিয়ে সব দেখছে। সেও শুয়ে আছে মাচানে। শরীরে কাঁথা—কাপড় টেনে উপুড় হয়ে দুটো হাতের ওপর চিবুক রেখে গেরুর সৎমার খাওয়া দেখছে। বেড়ার ফাঁক দিয়ে গঙ্গা যমুনাও নেলির মতো চোখ মুখ নিয়ে বসে আছে। নেলির কষ্ট হতে থাকল। নিজে খেতে পারল না, গঙ্গা যমুনাকে খেতে দিতে পারল না। এ সময় ঘাটোয়ারিবাবু খেতে বসবেন। সে তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল এবং ধীরে ধীরে অফিসঘরের দিকে হাঁটতে থাকল। জানলার পাশে এবং সিঁড়ির ওপর সে দেখল লখি, টুনুয়ার ছোট দুটো ভাই ঝাড়ো ডোমের ছোট দুটো বেটি বসে আছে। নেলিও ওদের পাশে বসল। গঙ্গা যমুনাও বসল। সিঁড়ির ওপর বসে ওরা সকলে খাওয়ার গল্প করল।

আজ কিন্তু ঘাটোয়ারিবাবু কাউকে ডেকে ভাতের দলা দিলেন না। তিনি নিজেই সবটুকু চেটেপুটে খেয়ে নিলেন। ঝাড়োর বৌ ভাত যতটা পেরেছে কম দিয়েছে। জল খাওয়ার সময় তিনি হাসলেন। ভাবলেন, পেটে কিল মেরে কথা বের করে শুনেছি, কিন্তু ঝাড়োর বৌ যে দেখছি পেটে কিল মেরে ভাত বের করবে। ঘরের ভিতর কুলকুচা করার সময় তিনি বললেন, তোরা যা। দাঁড়িয়ে থাকিস না। আজ আমারই পেট ভরল না। তোরা যা। অথচ তিনি জল খেয়ে ঢেকুর তোলার চেষ্টা করলেন।

নেলি ভাবছে ফের গঙ্গায় গিয়ে নামে। ফের সেই হাতের গলার গহনা দেখে! মংলির চোখটা গঙ্গা যমুনাকে দিয়ে উপড়ে আনে। কিংবা ইচ্ছা হচ্ছে হাতের গলার গহনা আগুনে কেমন গলছে সেই দেখার। সোনা গলে গলে যেন ছাই হয়ে যায়। কিন্তু ছাই হবে না ভেবেই ওর যত দুঃখ এখন। সেজন্য গঙ্গায় নামতে পর্যন্ত ইচ্ছা হল না। রাগে দুঃখে, ভয়ে এবং পেটের যন্ত্রণায় দুটো চোখ ক্রমশ বসে যাচ্ছে। ক্রমশ নেলি দুর্বল হয়ে পড়ছে। শরীরটা নিয়ে আর চটানে ঘুরতে ফিরতে পারছে না। নেলি সেজন্য মাচানেই ফিরে এল। মাচানে শুয়ে শুয়ে বাপের জন্যে অপেক্ষা করবে। বাপ যদি ধারদেনা করে কিছু চাল ডাল নিয়ে আসে, যদি বাপ রাতের মতো কিছু ব্যবস্থা করে ফেরে এই ভেবে দুর্বল শরীর নিয়ে কোনোরকমে মাচানের কাছে এল। মালসায় কিছু জল ঢালল এবং ঢকঢক করে এক মালসা জল খেল। তারপর মাচানে উঠে বালিশ টেনে কাঁথা—কাপড়ের ভিতর শরীর গলিয়ে দিল। কাঁথার নিচে নেলি এখন কিছু যেন ভাবছে অথবা যেন ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করছে।

বেলা পড়ে আসছে। শীতের বেলা। ঝাউগাছের ও পাশে সূর্য ক্রমশ বাঁশবনের অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে। ঘাটে আগুন উঠছে না। চিতার আগুন যত নিভে আসছে দুখিয়া তত বেশি উত্তেজনা অনুভব করছে। মংলি ঘাট থেকে ফিরছে—ওর মাথায় নতুন তোশক চাদর। হরীতকীর ঘরের পাশ দিয়ে একটু ঘুরেই সে গেল। যেন সকলকে দেখিয়ে যেতে চায়। নেলি ইচ্ছা করেই কাঁথার নিচে মুখ লুকিয়ে ফেলল। কাঁথা কাপড়ের ভিতর থেকে উঁকি মেরে তোশক চাদর দেখল না। ঝিম মেরে কাঁথা—কাপড়ের নিচে পড়ে থাকল।

আর এ—অসময় লাফাতে লাফাতে এল গেরু। গলায় কালো কারে তাবিজ। পুরুষ্টু মরদের মতো গজাতে আরম্ভ করেছে গোঁফ। কালো গেঞ্জি গায়ে—হাতে বল্লম—ওকে দুর্ধর্ষ মনে হচ্ছিল। বল্লমটা কাঁথা—কাপড়ের উপরেই যেন ছুঁড়ে দেবে। নেলির চুল মাচানের পাশে ঝুলছে। গেরু বুঝতে পারছে নেলি মাচানে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। নেলিকে সে ডাকল—এই নেলি,—নে—লি, নেলি—বা তু ত আচ্ছা আছে। অবেলায় এক ঘুম দিয়ে লিচ্ছিস।

নেলি কাঁথা—কাপড় ছেড়ে উঠল না অথবা ওঠার ইচ্ছা প্রকাশ করল না, কিংবা ইচ্ছা থাকলেও উঠতে পারল না, শুয়ে থাকার ইচ্ছা কেবল—ঘুম ঘুম ভাব শরীরে। অথচ ঘুম আসছে না। রাজ্যের চিন্তা এসে নেলিকে জড়িয়ে ধরেছে—গেরু কবে চটানে সত্যি মরদ হয়ে উঠবে, গেরু কবে বুলবে আ যা নেলি, কাঁহা ভি চল যাই, কবে অন্য চটানে উঠে গিয়ে ওরা ঘর বাঁধতে পারবে। দু হাতের ওপর চিবুক রেখে গেরুর দিকে নেলি শুধু চেয়ে থাকল। কাঁথা—কাপড় ছেড়ে কিছুতেই উঠছে না কিংবা কথার জবাব দিচ্ছে না।

গেরু নেলিকে বলল, হামি ফরাসডাঙায় যাচ্ছি! বাপ হামাকে আজ থেকে লিয়ে লিল।

তুর বাপ হামাকে লিবে? তবে হামিও সঙ্গে যাই।

গেরু প্রচণ্ডভাবে হেসে উঠল। বল্লমটা শক্ত করে ধরল। কোমর থেকে গামছা খুলে মুখ মুছে বলল, কী যে বুলছিস তু নেলি। তু যাবি ফরাসডাঙায়। তু যাবি মুর্দার কঙ্কাল তুলতে! তু যে ডরে মরে ভূত হো যাবিরে নেলি, ভূত হো যাবি!

নেলির গলার স্বরটা সহজ এবং সুরেলা হল—হামি বুঝি পারে না ভাবছিস!

গেরুর এখন কথায় ঢিলেঢালা চাল—কেইসে তু পারে? এ তো কাঠ বইয়ে দেয়ার কাজ না আছে। এ বহুত তন্তর—মন্তরের কাজ আছে, বহুত তন্তর—মন্তর লাগে।

নেলি গেরুর মুখের কাছে হাতটা ঘুরিয়ে আনল। হে রে, রাখ তোর তন্তর—মন্তর। হামি ভি বহুত তন্তর—মন্তর জানে।

লেকিন তাবিজ—ওবিজ লাগে নেলি। বাপ মেরে তিন তিনটা তাবিজ দিল। পুনঃপদের মাদুলি, মহাশক্তি কবচ বাণ, আউর মহাশক্তি কোমর বাণ। এ ঝাড়ফুক লয়, জাদুমন্তর লয়—এ আছে জড়িবুটির কারবার। দ্রব্যগুণ। ডান পুকুসে টান মেরে তোষক করে, পির পরিতে নজর দেয়, বাণ মোর এ—মাদুলি দেহে লিলে আসন পাবে দেহ। এ—তু কাঁহাসে লিবি আর কাঁহাসে দিবি।

গেরু কথাগুলো নেচে নেচে বলল—অনেকটা বাপ কৈলাসের মতো। কৈলাস যেমন করে কোর্ট—কাছারির ময়দানে একদা হেকিমি দানরির ব্যবসার সময় সকল মক্কেলদের তাবিজের গুণাগুণ ব্যাখ্যা করত, তেমনি গেরু আজ নেলিকে তাবিজের দ্রব্যগুণ ব্যাখ্যা করল।

নেলি এবার কাঁথা—কাপড় ছেড়ে উঠে বসল মাচানে। দু হাতের ওপর ভর করে বসল। চুলগুলো মুখের ওপর এসে পড়েছে। শরীরটা যেন ঝুঁকছে মাচারে বাইরে। যেন এখুনি টলে পড়বে শরীরটা। নেলি তবু বলল, হামারা কোনো জড়িবুটি লাগে না গেরু। লেকিন হামি মেয়েমানুষ লয় ত হাম ভি যেতরে মুর্দার কঙ্কাল তুলতে। চটানে ভুখা থেকে হামি নেহি মরগে। নেলি এ—সময় মুখটা ক্রমশ নিচের দিকে নুইয়ে দিচ্ছে।

তু ভুখা আছে নেলি! গেরু বল্লামটা নিচে রাখল। পাশাপাশি বসল সে। কিছুক্ষণ সে চুপ করে বসে থাকল। নেলিকে সে এ—চটানে আরও অনেকদিন ভুখা থাকতে দেখেছে, কিন্তু আজ যেন অন্যভাবে নেলির উপোসি শরীরটা দেখল। নেলি ভুখা আছে চটানে, এই ভেবে ওর খুব কষ্ট হতে থাকল। অথচ নেলিকে কিছু বলতে পারছে না এ—সময়ে। অন্য দিনের মতো নেলিকে জড়িয়ে ধরে কথা বলতে পারল না। কিংবা জড়িয়ে ধরতে ভয় হচ্ছে। সে সংশয়ের চোখে চারিদিকে একবার চেয়ে সহসা নেলির মুখটা তুলে ধরতেই দেখল, নেলি কাঁদছে! ভুখা থেকে নেলি আজ চটানে গেরুর সামনে কেঁদে দিল। —নেলি তু ভুখা আছে! পুনরাবৃত্তি করল গেরু। তারপর বল্লামটা তুলে চলে যাওয়ার সময় বলল হামার কাছে একটা পয়সা ভি নেই। থাকলে তুকে দিয়ে দিতাম। সাত সতের খেলে লখির কাছে সব পয়সা কটা হেরে গেছি।

গেরুর এসব কথা শুনে নেলি বিরক্তিতে ফেটে পড়ল। মনে মনে বলল, হেরে গেরু তু হামার বুঝি বাপ। তু পয়সা দিবি, সে পয়সায় হামি খেয়ে লিব! এই সব ভেবে নেলির নিজের মনেই সরম এল। গেরু ওর কে! গেরু ওর পাশে একটু বসতে পারল না! গেরু এ—সময় পয়সা নেই বলে, অথবা নেলি আরও কষ্টের কথা শুনাবে বলে চলে গেল! ছিঃ মরণ হামার? তু হামার কে! তু হামার বাপ আছে না বেটা আছে। তু হামার কোন আছে, তুর কাছে কেন্দে ভিখ লিব!

নেলি ফের শুয়ে পড়ল। এই ঘরে শুয়ে পুরোনো অশ্বত্থ ডালে কাকের শব্দ পেল। সে বুঝতে পারছে চোখ বুজে—সন্ধ্যা হতে দেরি নেই। এই সময়ে সব কাকেরা এই পুরোনো অশ্বত্থে ফিরে আসে। সে চোখ না খুলে বসুন্ধরার সব সুখ দুঃখকে বোঝবার চেষ্টা করল। তখন এল গেরু। সন্তর্পণে ফিরে এল। মরদের মতো সে ওর পাশে দাঁড়াল। বলল, দু—চারমাস তু সবুর কর। ফরাসডাঙার কায়দা—কানুন শিখেলি, তারপর তু আর হামি অন্য চটানে উঠে যাব। হয় কাটোয়ায় লয়তো নবাবগঞ্জে। তু আর তখন ভুখা থাকবিনে।

কাঁথা—কাপড়ের নিচে থেকে নেলি জবাব দিচ্ছে, দুদিন ভি হামার তর সইবে না। চটানে ভুখা থেকে হাম নেই মরেগে। কাঁথা—কাপড়ের আঁধারে নেলির বাঁচার ইচ্ছা একান্ত।

লেকিন হাম কিছু শিখলাম না, না দানরি, না হেকিমি। রাহুচণ্ডালের হাড় ভি নেই যে হেকিমি দানরি ব্যবসা করে খাব। বাপ লিয়ে যাচ্ছে আজ, এই পয়লা ফরাসডাঙায় মুর্দার কঙ্কাল তুলতে যাচ্ছি—বাপের ব্যবসা শিখে লিচ্ছি।

নেলির কপালে কতকগুলো রেখা ফুটে উঠল তখন। রেখাগুলো কপালের উপরেই নাচছে। মনে মনে সে যেন কোনো বাঁচার কৌশলকে আয়ত্ত করছে। সে কাঁথা—কাপড়ের ভিতর থেকে মুখ বার করে বলল, হাম ভি কিছু শিখে লিব, হাম ভি কিছু জরুর কামাব।

কাঁহাসে কামাবি?

ঘাটসে। ঘাটের ডাক দুখিয়ার। সেখানে বড় লোকের বেটির শরীর আগুনে খাচ্ছে। গহনা পুড়ছে। দুখিয়ার ডাক যখন, সব গহনা ও জরুর কয়লা ধুয়ে লেবে। যদি কিছু পড়ে থাকে, পহর রাতে হামি লিব।

নেলির কথা শুনে গেরু চোখ টান টান করল। বলল, তু একলা ভয় পাবিনে যেতে? তখন মড়া জ্বলবে না ঘাটে।

নেলি পাশ ফিরে শুল। বলল, কীসের ভয়! কিসকো ভয়!

লেকিন দশ লোক যদি দশ কথা বুলে?

বুলে বলবে। দশ লোক ত দশ কথা বুলছেই। বাপকে ওরা বুলছে রাতে নেলি কাঁহা ভাগে, তু নজর না রাখে গোমানি! মেয়েটা তুর দিন দিন ডাইনি বনে যাচ্ছে। তু বাপ হয়ে নজর না রাখে। খাটো কাপড়টা নেলির বুক থেকে সরে যাচ্ছিল—নেলি অন্যমনস্কভাবে কাপড়টা দিয়ে শরীরটা ঢেকে দিল। —দু রাত ধরে বাপ নজর রাখছে, হামি যেতে পেছি না কোথাও খেতে পেছি না কিছু। রোজ ভুখা থেকে মর গিলাম গেরু।

গেরু সেই কষ্ট ভাবটা মনে মনে অনুভব করতে পারছে। সে বলল, ফরাসডাঙায় যাবার সময় হয়ে গিল। কাল সবেরে আওগে। কাল সবেরে তু আর হাম জরুর খাওগে। এই বলে গেরু বল্লমটা তুলে নেলির ঘর থেকে নেমে চটানে অদৃশ্য হয়ে গেল।

নেলির কিছু করার নেই এখন। শুধু মাচানে বসে থাকা, বাপের জন্য অপেক্ষা করা। মাচানে বসেই সে হরিধ্বনি শুনতে পেল। বড়লোকের বেটারা মেয়েমানুষটাকে ঘাটে রেখে ঘরে ফিরে যাচ্ছে। পোড়া কয়লায় মেয়েটার শরীর পুড়ে ছাই হয়েছে। গহনাগুলো ছাই হয়নি। গহনাগুলো কয়লার সঙ্গে লেগে আছে। দুখিয়া হয়তো এখন নদী থেকে কলসি কলসি জল তুলছে। জল ঢালছে শ্মশানে। বালতিতে সব পোড়া কয়লা তুলে জলে ধুয়ে নিচ্ছে। সোনাদানা সংগ্রহ করছে। নেলির ইচ্ছা—অনেক ইচ্ছা এখন। বালতি থেকে কী করে সোনাদানা দুখিয়া তুলছে—সে দেখার ইচ্ছা। কিংবা গহনার দু—এক অণু চুরি করার ইচ্ছা। চুরি করে গহনা বেচে কিছু খাওয়ার ইচ্ছা। এতগুলো ইচ্ছার তাড়নায় সে জড়বৎ হয়ে বসে থাকল মাচানে। অথবা সে জানে ঘাটে গেলে দুখিয়া এবং ওর বৌ ওকে এ—সময় তেড়ে মারতে আসবে। ডোমের কোনো মেয়ে মরদকে সে এ—সময় ঘাটে নামতে দেবে না। সেজন্য মাচানে বসে থাকা ছাড়া কোনো গত্যন্তর থাকল না নেলির।

রাত নামছে চটানে। অশ্বত্থ গাছটার কাকগুলো শেষবারের মতো হইচই করে ডালে ডালে বসে গেল। গঙ্গার ঢাল থেকে শুয়োরের পাল নিয়ে ফিরে এসেছে বাবুচাঁদ। খোঁয়াড়ে শুয়োরগুলো ঢুকিয়ে দিয়ে সে ওর ছোট কুঠরিটায় ঢুকে গেল। ঘাটোয়ারিবাবু এ—সময় জপতপ নিয়ে বসেছেন অফিসঘরে। ঝাড়ো ডোমের ঘরে এখন সকলে পচাই খাচ্ছে। কৈলাসের ঘরে শেষ পক্ষের বৌটা পচাই গিলছে। গেরু এবং কৈলাস চলেছে—কাঁধে মদের ভাঁড়, হাতে বল্লম। ওরা চটান থেকে নেমে যাচ্ছে। ওরা ফরাসডাঙায় যাচ্ছে বেওয়ারিশ মড়ার তল্লাসে। অন্ধকার মাচানে শুয়ে নেলি সব ধরতে পারছে। নেলি জানে এ—সময়টাই একমাত্র সময় যখন চটানে পচাইর ঝাঁজ ওঠে। সে জানে চটানে এখন হৈ—হল্লা হবে। নাচনকোঁদন হবে। লখি, টুনুয়া পচাই গিলে মাতলামি করবে চটানে। ওরা এসে নেলির ঘরেও করতে পারে। কিংবা কৈলাসের শেষ পক্ষের বৌটার কাছে। লখি, টুনুয়া এখন হল্লা রসিকতা করবে। সিনেমার হালকা গান গাইবে। তখন কৈলাসের বৌটা পর্যন্ত মাতলামি করবে এইসব ভেবে নেলির ইচ্ছে হচ্ছে একটু পচাই গিলতে। বাপ এলে বাপের সঙ্গে একটু মাতলামি করতে। চটানের এমন পরিবেশে নেলির মনেও মাতলামির শখ জাগল।

প্রচণ্ড শীতের হাওয়া চটানের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। গায়ে শীত লাগতেই নেলির মনে হল কিছু পোড়াকাঠ এনে মাচানের নিচে রাখতে হবে এবং ভোররাতে যখন বাপ আর বেটিতে ঠান্ডায় কাঁথা—কাপড়ের নিচে ঘুম যেতে পারবে না, এবং বাপ খকখক করে কেবল কাশবে, তখন নেলি মাচানের পাশে পোড়াকাঠের আগুন জ্বালবে। সেজন্য নেলি ঘাট থেকে পোড়াকাঠ এনে উঠোনে রোজ তুলে রাখে, পোড়াকাঠে ভাত হয়, পোড়াকাঠের উত্তাপ নেয়। নেলি কিছু কাঠ তুলে আনার জন্যে মাচান থেকে উঠোনে নামল এবং পোড়াকাঠের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কাঠ কম কম মনে হচ্ছে। নেলির চোখ মুখ দুটোই জ্বলে উঠল, নেলির উপোসি দেহ থেকে গরল উঠতে থাকল, মর, মর—ঘাটে গিয়ে মর। হামার কাঠ ছুরি করে মরছিস ক্যানে! নেলি দুটো হাত উপরে তুলে সমস্ত দুনিয়াকে শাপ—শাপান্ত করতে থাকল—ডাক ঠাকুর, তু দেখে লে সব। তোর দুনিয়ায় হামি ভুখা আছি। হামার কাঠ চুরি করে লিছে। তুর কাছে নালিশ থাকল বাপ! তারপর নেলি কয়েকটা কাঠ ঘরে তুলল এবং মাচানের নিচে রেখে দিল। বলল, ভোর রাতে আগুন জ্বালব, ও ভি মানুষের সহ্য লয়।

নেলি শুয়োরের বাচ্চা দুটোকে খেদিয়ে খেদিয়ে ঘরে তুলল। পলো দিয়ে ওদের ঢেকে রাখল। টঙের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়ার আগে উঁকি মেরে দেখল সবগুলো ঢুকেছে কিনা। কাজগুলো সব শেষ করে নেলি লম্ফ জ্বালাল ঘরে। বাপ আভি তক এল না—মনে মনে এ কথাগুলো আওড়াল। বাপ এলে দুটো চাল দাল লিশ্চয়ই লিয়ে আসবে আজ—নেলি বাপের জন্য অপেক্ষা করতে থাকল। বাপ এলে দুটো ভাত ফুটিয়ে দেবে বাপকে, নিজেও দুটো খাবে। গঙ্গা যমুনাকেও ভাগ দেবে। শিবমন্দিরের পথটায় এসে নেলি এমন সবই ভাবছে তখন। গঙ্গা যমুনাও দু পাশে দাঁড়িয়ে গোমানি ডোমের অপেক্ষায় থাকল।

শিবমন্দিরের পথ ধরে বাবুদের মেয়েরা শরীরে ঠান্ডা মেখে ফিরছে। ওরা লাফাল। ওরা লাফিয়ে লাফিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে। নেলি দেখল—দেখছে। সুখ, সুখ—সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। নেলিও এমন সুখের ইচ্ছায় লাফাতে চাইল। শরীর দিচ্ছে না। শরীর দিলে সে সত্যি যেন লাফাত। গঙ্গা যমুনাকে নিয়ে অন্যত্র চলে যেত। সুখের রাজত্বে কিংবা গেরুর জগতে। নেলি গঙ্গা যমুনাকে শুনিয়ে যেন বলল, গেরু হামার মরদ হবে। তখন তুরা ভুখা থাকবিনে। তুরা পেট ভরে খেতে পেলে নাচন—কোঁদন করতে পারবি বাবুদের বেটা—বেটির মতো। তুগো কোনো দুখ হাম রাখবে না। তুরা হামার বেটা—বেটির লাখান। সে কুকুর দুটোকে জড়িয়ে ধরল। আদর করল। সুখ জানাল।

তখন গোমানি ডোম ফিরছে। শিবমন্দিরের পথেই ফিরছে। আঁধার ঘন হয়ে উঠেছে এ পথটায়। গ্যাসপোস্টে আলো জ্বলছে। কোনো কোনো ঘরে হারমোনিয়াম বাজছে। ঘুঙুর বাজছে—নাচ গান হচ্ছে। হাসি—মস্করা, হালকা গান হচ্ছে। দু—একটা ঘাটের কুকুর নর্দমার ময়লা খাচ্ছে। তখন কিছু কিছু লোক গলি পথে হারিয়ে যাচ্ছে। ওদের পরনে, ধুতি, গিলে করা পাঞ্জাবি। দুটো একটা মানুষ প্যান্ট পরে আলো আঁধারের দিকে হাঁটছে। তখন গোমানি ফিরছে টলতে টলতে। গালাগাল দিচ্ছে এই পথের বাসিন্দাদের। মুখে যা এল তাই বলে খিস্তি করল। শেষে একটা হালকা গানের সুর গলা বেয়ে উঠতে থাকল। নেলি বুঝল, গঙ্গা যমুনা বুঝল—বাপ চটানে ফিরছে।

গোমানি বলল, কোনরে? গঙ্গা যমুনা? নেলি?

নেলি বাপকে দেখে দাঁড়াল। গঙ্গা যমুনাও দাঁড়াল। গোমানি টলতে টলতে ফিরছে। —তুরা ইখানে বসে?

নেলি দেখল বাপের হাত খালি—কাঁধ খালি। গামছায় একটা ছোট্ট পুঁটলি ঝুলছে। নেলির জানতে বাকি নেই পুঁটলিতে কী আছে। রাগে দুঃখে নেলি কোনো কথা বলতে পারল না। বাপ খালি পেটে আজও মদ গিলে এসেছে। এই সব দেখে নেলি অত্যন্ত ক্লান্ত গলায় বলল, আ যা বাপ!

হরীতকীর ঘরের সামনে আসতেই গোমানি দাঁড়িয়ে পড়ল। ভোরের সব কথাগুলো ওর মনে পড়ছে—হরীতকী ভোরে ওকে গালমন্দ দিয়েছে। বলেছে, গোমানি, তুমি একটা বাপই বটে! গোমানি হরীতকীর বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে খিস্তি করার আগে সামান্য হাঁটু দুটো একটু সামনের দিকে, কোমরটা একটু পিছনের দিকে দিয়ে দু পায়ের ওপর ভর করে দাঁড়াল। সে দাঁড়াতে পারছে না, তবু জোর করে দাঁড়াল। মাঝে মাঝে বড় বড় হাই তুলছে। সে যেন কী ভাবল—যেন কী বলতে হবে। যেন—তার মনে পড়ছে না। বিরক্তিতে সে পা দুটোকে বেতো রুগির মতো কয়েক বার কাঁপাল। কয়েক বার ভাঁটা ভাঁটা চোখ দিয়ে আশেপাশে কিছু খুঁজল যেন। তারপরই সব ঘটনাটা মনে পড়ায় বলল, মাগি জাত একটা জাত—ওয়ার আবার স্বভাব, ওয়ার আবার ধম্ম! মাগির বাচ্চা হয়েছে শ্মশানে—হবে না! মাগির নেই জাতের ভয়, নেই ধম্মের ভয়—চতুরাকে মদ খাইয়ে খুন করলে। ও শ্মশানে বাচ্চা বিয়োবে না ত হাসপাতালে বিয়োবে। যে খিস্তিটা ভোর থেকে মনে মনে গোমানি ডোম আওড়াচ্ছিল—মদ খেতে পেয়ে সে সবটা এবার উগরে দিল! —থু! এতেও শান্তি নেই, গোমানি হরীতকীর দরজার ওপর থুথু ছিটাল।

এই সব দেখে নেলি বাপের কাছে ছুটে গেল। সে বাপের হাত ধরে টানছে। এমনি হয়তো পিসি দরজা খুলে বের হয়ে অনর্থ বাধাবে। বাপের চুল ধরে টানবে। বাপের শুকনো দেহটা নিয়ে টানা—হ্যাঁচড়া করবে। বাপ হয়তো না পেরে পিসির পা কামড়ে ধরবে। বাপকে তাই টেনে নিয়ে যেতে যেতে ধমক দিল, বাপ, ফের তু ভুখা থেকে মদ গিলেছিস! ইসপিরিট খাচ্ছিস!

হে মদ গিলেছি ত! ইসপিরিট খাচ্ছি ত! গোমানি এবার জোর করে হাতটা নেলির হাত থেকে টেনে নিল!

ভুখা থেকে ইসপিরিট খেলে যে মরবি বাপ!

হাম মরোগে তু বুলছিস? হাম বাঁচোগে নেই!

হে তু মরোগে বাপ!

হাম নেহি মরোগে, নেহি মরোগে। তু মরবে নেলি। রাগে চোখ দুটো চিংড়ি মাছের মতো বাইরে বের হয়ে পড়তে চাইল। —গোমানি মরোগে! কোন বুলবে এ কথা। গোমানি নেলির পেটে লাথি বসিয়ে দিল। তারপর বলল, কোন শালে বুলবে একথা গোমানি মরোগে!

নেলির ইচ্ছা হল এই মুহূর্তে ঘাটের পোড়া কাঠ তুলে বাপের মাথায় বাড়ি মারে। ইচ্ছে হল বাপকে চেপে ধরে মাটিতে। কিন্তু বাপ তখন এত বড় বড় হাই তুলছে এবং বাপের পেটটা এত বেশি নিচে নেমে গেছে যে সে সব দেখে ওর ইচ্ছাগুলোর রঙ অন্যরকম হয়ে যেতে বাধ্য হল। সে অন্যরকম জবাব দিল, হাসপাতালে খুনের লাশ কেটে তু ভি নরক হলি বাপ। খালি পেটে তু হামারে লাথি মারলি? এ আচ্ছা কাজ হল তুর!

গোমানি টলতে টলতে নেলির সাপের মতো বাঁকানো শরীরটা দেখল। যেন ফুলন আবার চটানে ফিরে এয়েছে। যেন নেলি ফুলনের মতোই শাসন করছে বাপকে। গোমানি এবার কাছে এগিয়ে ধরতে চাইল নেলিকে, কিন্তু পা দুটো টলছে বলে এগোতে পারছে না। সে এবার দু পায়ের ওপর শক্ত হয়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করল। এবং নেলিকে দেখে দেখে সে তার স্ত্রীর কথা ভাবল। স্ত্রীর কথা রোজ এইসময় তার মনে হওয়া মাত্র সে ঝিমিয়ে আসে। নেলি আজ ওর মার মতোই যেন বললে, হাসপাতালের লাশ কেটে তু ভি মরক হলি। গোমানি এইসব ভেবে দাঁড়াতে পারছে না। সে ঘরের মেঝেতে বসে পড়ল। সেই ফুলনের চোখ দুটো নেলির চোখে, নাক, সেই মুখ, সেই গড়ন। নেলির পেটে লাথি মেরে সে এখন খুব দুঃখ পাচ্ছে। গলার গামছা নিচে রাখল। পুঁটলি খুলল। গামছার পুঁটলিতে স্পিরিটের বোতল, কিছু চালভাজা, কিছু পেঁয়াজি।

গোমানি কাঁপা হাতে চাল ভাজা এবং পেঁয়াজিগুলো নাড়তে থাকল। নেলির দিকে চেয়ে বলল, নেলি তুর মায়ী কী বুলত, তু তখন ছোট, খুব ছোট। বুলত খুনের লাশ কেটে তু ভি নরক হলি। বুলত কত কথা, কত তরাস তখন তুর মায়ীর।

গোমানির মাথার ভিতর ঘোরদৌড় হচ্ছে। সে জন্য সে বেশিক্ষণ ফুলনকে মনে রাখতে পারল না। সে এসময়ে নেলিকে পেঁয়াজি এবং চালভাজার সঙ্গে বোতলটা এগিয়ে দিল। —দ্যাখ, তুর লাগি কী লিয়ে এয়েছি। খা, খা। দুটো খেয়ে লে। কিন্তু নেলি খেল না বলে গোমানি বিরক্ত হয়ে চড়া গলায় হেঁকে উঠল, লে আও, লে আও বুলছি মাটির গেলাস। মদ খানেসে দুনিয়া ঠান্ডা হোতা হ্যায়, আওর তু ত নেলি।

নেলি বাপের কথায় জবাব দিল না। এমনকি বাপের দিকে মুখ তুলে তাকাল না পর্যন্ত। একমুঠো চালভাজা, দুটো পেঁয়াজি তুলে নিল। ওগুলো খেয়ে এক মালসা জল খেয়ে বাপের কাছে এল ফের। বলল, মাচানে চল, ঘুমোবি।

নেলির মিষ্টি কথায় গোমানি খুব খুশি হল। মাথার ভিতর ঘোরদৌড়টা এখনও টগবগ করে ফুটছে। সে বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে উঠল—নেলি, তু বেড়ে কথা বুলেছিস। হামি বাঁচোগে নেই। তুর মাভি বুলত হামি বাঁচোগে নেই। লেকিন মা শীতলার কৃপায় তুর মায়ী জলদি জলদি পার পেল। তুকেও কৃপা করেছিল, লেকিন তু বেঁচে গেলি। একটু হেসে গোমানি কিছু মনে করার যেন চেষ্টা করল। তারপর বলতে থাকল—তা তু বুলতে পারিস হামি ইসপিরিট খাই ক্যানে, তুকে ভুখা রাখি ক্যানে, হামি থাকি ক্যানে, সব বুলতে পারিস। লেকিন বাত কী আছে তু জানে, খুনের লাশ, গলায় দড়ির লাশ, সকল লাশের পেট মাথা চিরে হামার মাথা ঠিক থাকে নারে, মাথাটা হামার গরম হয়ে উঠে। হামি পাগল বনে যাই। মদ খানেসে দেমাক ঠান্ডা হয়ে যায়। মদ পিনেসে দুনিয়া ঠান্ডা হোতা হ্যায়, আওর তু ত নেলি। খা, খা লে। স্পিরিটের বোতলটা গোমানি নেলির মুখের সামনে তুলে ধরল।

বাপ, বাপ, আর পারিনে! নেলি কান্না—কান্না গলায় চিৎকার করে উঠল। —তু আর বাপ জ্বালাসনে। নেলি গোমানির হাত ধরে টানতে থাকল। চটানের সব লোক তখন ঘুমিয়ে পড়েছে। একমাত্র ঝাড়োর বৌ জেগে। বাঁশের পাতি তুলছে বসে বসে। ঘরে একটা লম্ফ জ্বলছে। নেলি এসময় বাপকে কোলে তুলে নিল। বলল, আ যা বাপ, তু আর জ্বালাসনে, হামার বহুত নিদ আতা বাপ। নেলি বাপকে তুলে মাচানে শুইয়ে দিল, এবং কাঁথা—কাপড় দিয়ে ঢেকে জোরে চেপে রাখল বাপের শরীরটাকে। ঠান্ডায় গোমানির শরীরটা বরফ হয়ে ছিল, এখন উত্তাপ সঞ্চার হচ্ছে।

রাত ঘন হচ্ছে। গভীর হচ্ছে।

বাপের পাশে শুয়ে রয়েছে নেলি। ওর ঘুম আসছে না।

আসবে না। শ্মশানের সব ছবিটা সে দেখতে পাচ্ছে। কটা কুকুর কয়েকটা কচ্ছপ ঘোরাফেরা করছে সেখানে। কয়েকটা শেয়ালের আর্তনাদ অথবা ইতস্তত জোনাকির আলো। রাত যত ঘন হবে জোনাকির আলো তত বেশি ভূতুড়ে মনে হবে, তত বেশি শরীরটা ছমছম করবে। অথচ নেলি ভয় পাওয়ার মতো করে হাঁটবে না। কিংবা ওকে দেখে মনে হবে না যে সে কোনো ভয় পাচ্ছে। বরং ওকে দেখলেই ভয় পাওয়ার কথা। কুকুর দুটোর জ্বলন্ত চোখ দেখে ভয় পাওয়ার কথা!

প্রথম দিকে দু একবার গোমানি জোর করে উঠে বসবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু নেলি উঠতে দেয়নি। জোর করে চেপে রেখেছে। কাঁথা চেপে গোমানির ওপর বসে রয়েছে। এখন গোমানি হাঁ করে ঘুমোচ্ছে। নেলি লম্ফর আলোটা তুলে আনল। বাপের মুখ দেখল। মুখ ভয়ানক কুৎসিত—মুখে কূট গন্ধ। ভিতরের দুটো কষ্টি কালো দাঁত শ্বাসের সঙ্গে নড়ছে। আরও ভিতরের আলজিবটা সে দেখতে পেল। আলজিবটা নড়ছে না—সুতরাং বাপ প্রচণ্ড ঘুমোচ্ছে। মুখের ভিতরটা স্পিরিট খেয়ে খেয়ে কালো হয়ে গেছে। যেন ভোঁতা হয়ে গেছে। বাপের জন্য নেলির অদ্ভুত রকমের কষ্ট হতে থাকল।

মাচান থেকে নেলি সন্তর্পণে নামল। মেঝেতে গঙ্গা যমুনা মুখ গুঁজে পড়েছিল। জ্বলজ্বলে দুটো চোখ দিয়ে ওরা ওকে দেখল। নেলি ইশারা করলে চুপি চুপি ওরা উঠে এল। চুপি চুপি ওরা উঠোনে নামল। উঠোনে দুটো মালসা—কবুতরগুলো মালসায় জল খায় বিকেলে। সে মালসা দুটো হাতে নিল। একটা পোড়া হাঁড়ি নিল। নেলির চোখে দুঃসহ সংশয়। ভয়, দুখিয়া বেড়ার ফাঁক দিয়ে ওকে দেখে চিৎকার করে না ওঠে। চিৎকার করে না বলে—ডাইনি মাগি কাঁহা যাচ্ছে দ্যাখ। সে উঠোনের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ভালোভাবে সব দেখে নিল। কেউ জেগে নেই। কেউ না। এমনকি ঝাড়োর বৌ পর্যন্ত ঘুমিয়ে পড়েছে। একমাত্র ঘাটোয়ারিবাবুর ঘরে আলো জ্বলছে। এত রাতেও ঘাটোয়ারিবাবু জানালার ধারে বসে রয়েছেন, চেয়ারে বসে কিছু যেন করছেন না—অথচ বসে আছেন। নেলি কুকুর দুটোকে ফের ইশারা করলে! শিবমন্দিরের এবং বাবলার ঘন বন পার হয়ে সে ধীরে ধীরে শ্মশানের চালা ঘরটায় হাজির হল! এখানে সারারাত লন্ঠন জ্বলে। ঘাটোয়ারিবাবু জ্বালিয়ে দেন। বৃষ্টি—বাদলার রাতে আলো নিভে যায়। শীতের রাতে হাওয়া খুব না থাকলে নিবু—নিবু করে সারারাত জ্বলে। শ্মশানকে আরও ভয়াবহ করে তোলে। নেলি সেই হারিকেনটা খুলে নিল এবং পলতেটা বাড়িয়ে গঙ্গার ঢালে নেমে গেল।

দুখিয়ার বৌ ঘরে ধড়ফড় করে উঠে বসল। ওর ঘরটা চটানের শেষ মাথায়। শিবমন্দিরের পথে নামতে সে দেখল যেন, স্পষ্ট দেখল যেন, নেলি চটান থেকে নেমে গেল। নেলির কুকুর দুটোও। মংলি তাড়াতাড়ি দুখিয়াকে ঠেলে তুলে দিল। বলল, দ্যাখ, দ্যাখ ডাইনি মাগি আঁধার রেতে পালাচ্ছে।

দুখিয়া উঠে প্রথমেই হারিকেনের আলোটা উসকে দিল। হারিকেনটা নিয়ে ধীরে ধীরে বাইরে এসে দাঁড়াল। হারিকেনটা উপরে তুলে নেলি কাছে কোথাও আছে কিনা দেখল। না দেখে সে হাজির হল গোমানির ঘরে। গোমানি নাক ডাকিয়ে ঘুমচ্ছে—বেটা হাড় হাভাতে! দুখিয়া গাল দিল মনে মনে। —বেটা ইসপিরিট খোর। প্রথমে সে মাচানের কাছে গিয়ে নাড়া দিল—গোমানি গোমানি, অঃ গোমানি! হারে উঠ। উঠে তামাশা দেখে লে। জোয়ান বেটির তামাশা। বেটি ত তর ভাগলবারে। তুর বেটির ঘাড়ে ভূত সোয়ার হো গিয়ারে গোমানি! বেটি তুর ডাইনি বন গিয়া।

গোমানি কাঁথা—কাপড় ঠেলে উঠে বসল। কিন্তু ব্যাপারটা ধরতে পারছে না। মাথাটা এখনও ঝিমঝিম করছে। এখনও শরীরটা ক্লান্ত, ভারী—ভারী। কে কী বলছে ঠিকমতো শুনতে পাচ্ছে না—বুঝতে পারছে না। সুতরাং সে ফ্যালফ্যাল করে দুখিয়ার দিকে চেয়ে থাকল।

হামারে দেখে তুর হবেটা কী? নেলি আঁধার রাতে কাঁহা গ্যাল দ্যাখ। দু চারঠো আখেরের কাজ কাম কর।

কাঁহা গ্যাল।

কাঁহা ভি গ্যাল।

তু না জানিস?

হাম না জানে?

চটানের কৈ না জানে?

দুখিয়া ঠোঁট উলটে বিদ্রূপ করল, কোন জানে!

গোমানি এবার মরিয়া হয়ে ডাকতে থাকল, হরীতকী, হরীতকী!

হরীতকী শুয়েছিল। ঘুমিয়েছিল। গোমানির চিৎকারে সে জাগল। বসল এবং দুয়ার খুলে বের হয়ে দেখল দুখিয়া, ওর বৌ মংলি এবং গোমানি চটানে হইচই বাধিয়ে দিয়েছে। হরীতকীকে দেখে গোমানি ওর কাছে ছুটে গেল। বলল, তু জানে নেলি এ—আঁধার রাতে কাঁহা গ্যাল? জানে তু?

হাম না জানে গোমানি।

তু না জানে, দুখিয়া না জানে, কৈ না জানে, তব কোন জানে? কোন!

গোমানির মাথায় এখন আর তেমন ঘোড়দৌড় হচ্ছে না। এতক্ষণে শরীরটা হালকা বোধ হচ্ছে যেন। তবু সে জোরে কথা বলতে পারল না। শরীর দুর্বল। সে বুঝতে পারল—সে কত অসহায়। এজন্য দুখিয়া, হরীতকীর দিকে চেয়ে নেলির অনুসন্ধানের প্রত্যাশা করল। যদি ওরা কিছু বলতে পারে, অথবা ঢুঁড়ে এসে খবর দেয় নেলিকে পাওয়া গেছে, নেলি মালসা করে ডাল, ভাত, মাছ, মাংস আনতে যায়নি। যদি ওরা বলে নেলির ভিতর ডাইনি হওয়ার মতো লক্ষণ আপাতত প্রকাশ হচ্ছে না। যদি বলে নেলিকে পাওয়া গেছে—তু চিন্তা না করে গোমানি। কিন্তু ওরা নড়ল না, কিছু বলল না। ওরা দাঁড়িয়ে থেকে গোমানির অথর্ব শরীরটা দেখল শুধু।

এতটা অথর্ব বুঝেই দুখিয়া বলতে বুঝি সাহস করল, হামি ত তুর বেটির জন্য পাহারাদার না আছে। তুর বেটি কাঁহা গ্যাল ও হামাদের বুলতেই হবে। বেটি তুর আচ্ছা লয় গোমানি। ওকে থোড়া সমজে রাখ।

উঠোনের অন্যপাশ থেকে মংলি বলল, তু দুখি, চলে আয়। গোমানির বেটি আঁধার রেতে কাঁহা গেছে ও গোমানি বুঝবে। তু ওকে ভালাই করিস ত ও বুঝবে মন্দ। লয়ত ওয়ার বেটি রাতে কাঁহাসে ভাত দাল মাছ মাংস লিয়ে আসে। —এক দফে ও বুলবে না ওয়াকে। হাপুস হাপুস শুধু গিলবে।

ও বাত ঠিক লয় বৌ, গোমানির বেটি মন্দ কাজ করে বেড়াবে, পহর রাতে ডাইনি সেজে ঘোরাঘোরি করবে, ও কথা ঠিক লয়। চটানে ঝাড়ো ডোম আছে, সর্দার আছে, ঘাটোয়ারিবাবু আছে, পাঁচজনার পাশ জরুর নালিশ দিতে হবে। হয় গোমানি থাকবে চটানে, লয় তো হামি থাকবে। চটানে দিন দিন বেজাত অজাত হয়ে উঠছে। বহুত বেইমানি আচ্ছা লয় গোমানি।

গোমানির মন পাথরের মতো ভারী হয়ে উঠছে। হাসপাতালের খুনের লাশ কাটার সময় যেমন সে ক্রমশ নিষ্ঠুর হয়ে উঠত, সে এখন সেরকম নৃশংস। চোখ দুটো ফের চিংড়ি মাছের মতো ঝুলে পড়তে চাইল মুখ থেকে। সে দুখিয়ার মুখের ওপর গিয়ে ফেটে পড়ল, বেইমানি কোন কিয়া? হাম!

না, তেরে বেটি। হারামি আছে ও। হামার বেটি হোত তু।

জবাই করতি।

জরুর।

হাম ভি করে জবাই। যেন নেলিকে জবাই করে চটানে সসম্মানে বেঁচে থাকা গোমানির একমাত্র পথ। নেলির জন্যই যেন সে এত ছোট হয়ে গেছে। এত দুর্বল হয়ে আছে চটানে। এবং নেলিকে জবাই করলে চটানের সকলে যদি খুশি হয়—তবে আজ সে তাই করবে। তাই করে সকলকে খুশি করবে। এই ধরনের কিছু ভাব গোমানির মনে বারবার চাপ দিচ্ছে। সে মাচানের নিচে থেকে দা—টা খুঁজে বের করল এবং দুখিয়ার সামনে গিয়ে জবাই—এর কসরত দেখাল। তারপর চিৎকার করে উঠল—নেলিরে, তু আজ চটানে জবাই হ যাবি।

ঘাটোয়ারিবাবুর ঘুম আসছিল না। তিনি ঘুমোতে পারছিলেন না, শরীরে কম্বল জড়িয়ে চেয়ারে বসে ছিলেন। বসে থাকতে থাকতে কখন একটু ঘুম লেগে এসেছিল টের পান নি। গোমানির উৎকট চিৎকারে তাঁর ঘুম ভেঙে গেল। তিনি ঘুমোলেন না। তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। গঙ্গাপুত্তুরের দল ঘোর হামলা বাধিয়েছে। ফের চটানে খুনোখুনি আরম্ভ হয়েছে। তিনি জানেন এইসব লোকেরা সমস্ত রাত আর তাকে ঘুমোতে দেবে না। গালমন্দ, খিস্তি, হামলা, মারধোর তিনি না গেলে সারারাত ধরে চলতে থাকবে। সেজন্য কম্বল গায়ে খড়ম পায়ে তিনি চটানে নেমে গেলেন।

ঘাটোয়ারিবাবু চটানে ঢুকেই ধমকে উঠলেন গোমানিকে, এই শুয়োরের বাচ্চা হারামজাদা গঙ্গাপুত্তুরের দল, তোদের জন্যে রাতে ঘুম যেতে পারব না পর্যন্ত। তোদের দিনরাত খুনোখুনি লেগেই আছে। এ কিরে বাবা! এ যেন হনুমানের রাজত্ব। বেটারা সব হনুমানের দালাল দেখছি। কী হচ্ছে এইসব। হৈ—হল্লা চিৎকার! এই শুয়োরের বাচ্চা গোমানি, কাকে খুন করবি—তোর কোন শত্রুকে?

ঘাটোয়ারিবাবুকে দেখেই গোমানি কেমন নিস্তেজ হয়ে পড়ল। খুন হো যাবি, জবাই হো যাবি বলে আর চিৎকার করল না। এখন সে যথেষ্ট ভালো মানুষ। এখন সে চটানের কোনো ঘটনারই সাক্ষী হিসাবে থাকতে যেন নারাজ। কিছু ঘটেছে যেন এও মিথ্যা। কিন্তু ঘাটোয়ারিবাবু ঘরে উঠে এলে খুব বিষণ্ণ গলায় বলল, বাবু, নেলি চটানসে ভেগে গেল আঁধার রেতে। বাবু, হামি কী করব? মেয়েটা হামাকে ফাঁকি দিল বাবু।

গোমানির শরীরটার দিকে চেয়ে ঘাটোয়ারিবাবুর মনটা ভিজে উঠল। তিনি বললেন, ও তো প্রায় রাতেই যায় রে! আজ প্রথম গেল ভাবছিস!

গোমানি দা—টা মাচানের নিচে রেখে দিল। —লেকিন কাঁহা যায় হাম ত না জানে বাবু!

ঘাটোয়ারিবাবু এখন উপদেশ দেওয়ার মতো করে কথা বলছেন। —তবে চুপ করে থাক। চুপ করে শুয়ে থাক। খুনোখুনি করবি কাকে? খুন ত বেটা তুই নিজেই হয়ে আছিস। মদ খেয়ে দিনরাত পড়ে থাকবি, মেয়েটাকে খেতে দিবিনে। মা—মরা মেয়েটা সারা দিন রাত খেতে না পেয়ে এঘর—ওঘর করবে, না খেতে পেয়ে মেয়েটা কাঁদবে—আর আঁধার রাতে ভেগে গেল ত হুঁশ হল—মেয়েটা কাঁহা যায় হাম ত না জানে বাবু। শালা শুয়োর—হারামজাদা গঙ্গাপুত্তুর! শুয়ে থাক হনুমানের দালাল কোথাকার! শেষে তিনি দুখিয়ার দিকে চেয়ে বললেন, এই দুখিয়া, বেটা সুদখোর, তুই আবার এখানে কেন?

ভয়ে ভয়ে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকল মংলি। দুখিয়া আমতা আমতা করতে থাকল প্রথমে, পরে কিছু বলার চেষ্টা করল। কিন্তু ঘাটোয়ারিবাবুর চোখের দিকে চেয়ে কিছু বলতে সাহস করল না। হরীতকী তখন দুখিয়ার দিকে আড়ে ঠারে চাইল। ব্যঙ্গ করল। রসিকতা করতে চাইল—জানে না বাবু উইত উবকার করতে এল নেলির।

হো উবকার করতে চেয়েছে। একটা তির্যক গলা ভেসে আসছে দুখিয়ার ঘর থেকে। মংলি ঘরে বসে হরীতকীকে উপলক্ষ্য করে কথাগুলো বলছে। ঘরে বসে বসেই হাত—পা নাড়ছে এবং চোখমুখ টেনে হরীতকীর জবাব দিচ্ছে।

দুখিয়া ভালোমানুষের মতো কথা বলল এবার। —শুয়ে পড় গোমানি। কী আর করবি—সব নসিব। কাঁহাতক আর বসে থাকবি বেটির লাগি—শুয়ে পড়। বেটি তুর কামাই করে ফিরতে বহুত রাত হবে। যেন দুখিয়া এখন কত ভালোমানুষ হয়ে গেছে, যেন গোমানির দুঃখে সে খুব কষ্ট পাচ্ছে। গোমানির মেয়েটা ফিরতে রাত হবে বলে যেন ওরও ঘুমোবার অসুবিধা। সে এবার ঘাটোয়ারিবাবুর দিকে চেয়ে বলল, কী বাবু, হামি ঠিক বুলছি না, ও এখন শুয়ে পড়ুক।

ঘাটোয়ারিবাবু কোনো জবাব দিতে পারলেন না দুখিয়াকে। নেলির কামাই করে ফিরতে রাত হবে কথাটা দুখিয়ার গলায় নষ্ট ঠেকল। তিনি হরীতকীর দিকে চাইলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে অন্য মানুষ হয়ে কী এক অন্য ভাবনার ভিতর ডুবে চটান থেকে উঠে গেলেন। দুখিয়া এ—সব দেখে হাসল। হরীতকীর দিকে চেয়ে চোখ টানল। তারপর বেশ বড় বড় পা ফেলে নিজের ঘরের দিকে যাওয়ার সময় বলল—তুর মেয়েটা চটানে দিন দিন ডাইনি বনে যাচ্ছে। ও কী হরীতকীর লাখান একটা বাচ্চা দিয়ে লিবে চটানে। গোমানিকে উদ্দেশ করে কথাগুলো বলল দুখিয়া। গোমানি শুনল। চোখ তুলে হরীতকীকে দেখে বড় বড় পা ফেলে সেও ঘরে ঢুকে গেল। যেন হরীতকীকেই ওরা সবাই শাসন করে গেল—নেলিকে নয়।

হরীতকীর তখন ইচ্ছে হল বলতে, হে দিয়েছি ত, হে দি লিছি বাচ্চা। তেরে বহুকা মাফিক হামি কী পোড়াকাঠ যে আগুন দিলে ভি জ্বলবে না। তাজা কাঠ আছি—আগুন গিলেছি, বাচ্চা দে লিছি। এ—লাজ না খোঁটার কথা আছে। হরীতকী, মংলিকে উদ্দেশ করে সারারাত ধরে গালমন্দ দেওয়ার কথা ভাবল। কিন্তু কিছু বলল না। এই নিশুতি রাতে চিল্লাতে শুরু করলে ফের ঘাটোয়ারিবাবু ছুটে আসবেন এবং তিনি দুখিয়া—মংলির এমন সব ইশারাতে সরম পাবেন। সেইজন্যই আঁধার রাতে কোনো গরল না ঢেলে হরীতকী নিজের ঘরে গিয়ে বাচ্চাকে চেপে ধরল এবং সমস্ত দুঃখ ভুলে আদর করল, শনিয়া, তু মেরে লাল।

কাঁথা—কাপড়ে শরীর ঢেকে গোমানি বেশিক্ষণ মাচানে বসে থাকতে পারল না। লম্ফটা দুবার দপদপ করে জ্বলে শেষে নিভে গেল। ঘরটা অন্ধকার হয়ে উঠল। গলা বেয়ে ফের কাশি উঠছে। খকখক করে ক’বার কেশে সে উপুড় হয়ে শুল। হেঁপো রুগির মতো কিছু কাঁথা বালিশ এনে বুকের নিচে ঠেসে দিল। কাশি দম বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করল। মাঝে মাঝে কোনো শব্দ হলেই কাঁথা—কাপড় থেকে মুখ বের করে দেখল—নেলি এসেছে কিনা! এল না! নিচে বাচ্চা শুয়োর দুটোর শব্দ। ফের মুখ বের করল—নেলি আসেনি। নিচে অথবা টং—এ কবুতরের শব্দ। এ—আঁধার রাতে নেলি কোথায় গেল! কাঁহা গেল মেয়েটা। ওর কষ্ট হতে থাকল। এ—সময় ওর ফুলনের ওপর রাগ হল। ফুলনের মৃত্যুর উপর। ফুলন মরে খুব অপরাধ করেছে এমন একটা ভাব কাজ করছে ওর মনে। ফুলন বেঁচে থাকলে এসব হাঙ্গামা ওকে পোয়াতে হত না। এইজন্য সে মাঝে মাঝে মেয়ে এবং মার ওপর খুব রেগে উঠছিল। তখন গোমানির চোখে মুখে কেমন বেপরোয়া ভাব। চোখ দুটো আঁধারেও কেমন ঘোলা ঘোলা। নেলি ফিরছে না—বড় কষ্ট হচ্ছে ওর। চটানে নিশুতি রাত নেমেছে। বরফের মতো ঠান্ডা নেমেছে। নেলি এই ঠান্ডায়, এই শীতে কিনা জানি করছে! চটানে এখন আর কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। শ্যাওড়া গাছে ঝিঁঝিপোকা ডাকছে। ঘাটে মড়া নেই। দূরে কয়েকটা কুকুর আর্তনাদ করছে। সে অনেকগুলো শেয়ালের ডাক শুনল বাবলার ঘন বনে। শীতের ঠান্ডায় মুরগিগুলো ডিমে তা দিতে দিতে চিৎকার করছে কৈলাসের ঘরে। কৈলাসের ঘরে ওর তৃতীয় পক্ষের বৌটা একা। বৌটা মদ খেয়ে পেট ঢাক করে চিত হয়ে ঘুমোচ্ছে। শুয়ে শুয়ে এটা সে আন্দাজ করল। এ—সময়ই উঠে পড়ে নেলিকে ঢুঁড়তে যাওয়ার ইচ্ছা হল গোমানির। এক ফাঁকে একটা নজর দিয়ে আসবে কৈলাসের ঘরে এই ওর বাসনা। অথচ উঠতে গিয়ে দেখছে শরীরটা ওর যেন পাথর হয়ে গেছে।

ঘাটোয়ারিবাবু যখন চটানে নেমেছিলেন, নেলি তখন গঙ্গার ঢালু বেয়ে নামছিল। গঙ্গা যমুনা আগে আগে যাচ্ছিল। ওরা ঘেউঘেউ করছে। বাবলার ঘন বনে কটা শেয়াল ডাকছে সেজন্য। গঙ্গা যমুনা মাটির গন্ধ নিতে নিতে নিচে গিয়ে নামল।

নেলি সেই তাজা চিতাটা খুঁজছে। খুঁজে বের করবার চেষ্টা করছে। এখানে ইতস্তত কাঠ, কয়লা, ভাঙা কলসি, ছেঁড়া তোশক, বালিশের তুলো মাটির সঙ্গে মিলেমিশে আছে। নেলি ওগুলোর ওপর দিয়েই হেঁটে গেল। হারিকেনের আলোয় সে ঠিক ধরতে পারছে না কোথায় তাজা চিতাটাকে সে রেখে এল। সে খুঁজছে। খুঁজছে। নদীর বালিয়াড়িতে সে এসে নামল। একটা কাঁচা বাঁশ দেখল। নদীর চরে বাঁশটা এখনও পোঁতা আছে। সে বুঝল কচ্ছপেরা এখনও এসে এখানে ভেড়েনি। সে তাড়াতাড়ি বাঁশটা তুলে আনল জল থেকে এবং বাঁশের ডগায় মাংসপিণ্ডটাকে দু’ভাগ করে গঙ্গা যমুনাকে খাওয়াল। তারপর ফের গঙ্গার ঢালু বেয়ে উপরে উঠে সেই তাজা চিতাটাকে খোঁজা—যেখানে দুখিয়ার নসিব খুলেছে।

এই ভর নিশুতি রাতে প্রেতের মতো দুটো কুকুরকে নিয়ে নেলি তাজা চিতাটা খুঁজছে। নেলির মনে হল তখন কে যেন দূরে শহরের দিকে ছুটছে। নেলি হাসল—ভয় পেয়ে এমন হয়। নেলি তারপরই চিতাটা খুঁজে পেল। এ—সময় নেলির মনটা আনন্দে ভরে গেল। ভয়ানক আনন্দে সে পুলকিত হল। আঁধার রাতে আকাশটায় কত নক্ষত্র, আর এই নিচের পৃথিবীতে কত সুখ—দুঃখ। কত বেদনা। নেলি এমন করে ভাবতে জানে না—কিন্তু মনের ভিতর গহনা পাওয়ার আশা এবং এই সুখানুভূতি ওর অনুভবে ঘা দিচ্ছে এবং তারই প্রকাশ যেন আকাশটায় অনেক নক্ষত্রের নিচে পৃথিবীর অনেক সুখ—দুঃখের মতো।

সে আশার ডিমে তা দিচ্ছে। আহা কাল সে খাবে, কাল সে পেট ভরে ভাত দিয়ে লিবে বাপকে। আহা গঙ্গা যমুনারে! নেলি এখন এই ‘আহা’র জগৎ ধরে দুখিয়ার ধোওয়া কয়লাগুলো হাঁড়িতে ভরছে, জলে ধুয়ে নিচ্ছে—এই ‘আহা’র জগৎ ধরে জল ফেলে দিয়ে কয়লার তলানি খুঁজছে। লন্ঠনের আলোয় তলানি দেখার আগে উত্তেজনায় অধীর হচ্ছে। চোখে মুখে কত সুখের উত্তেজনা। গহনা পেলে কাল গেরুকে খেতে বলবে। গহনা বেচে চাল, ডাল, একটু মাছ নেবে। বাপ মাছ খেতে ভালোবাসে। গেরুর জন্য একটু শুয়োরের মাংস অথবা চর্বি। গেরু শুয়োরের চর্বি খেতে ভালোবাসে।

নেলি তলানি খুঁজল। একটা আঙুল দিয়ে তলানির ছোট ছোট অণুর মতো টুকরোগুলোকে ঘষল। সব জলের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। কিছুই শক্ত ঠেকছে না। পিতল কাঁসা কিংবা লোহার মতো সোনার মতো ঠেকছে না। অণুর মতো ঠেকছে না। দুখিয়া কয়লা ধুয়ে কালি পর্যন্ত তুলে নিয়ে গেছে। নেলি সব কয়লাগুলো জলে ধুলো এবং মালসাতে জলের তলানি খুঁজল—কিচ্ছু নেই। সে নিরাশ হচ্ছে। ওর চোখ দুটোতে ফের দুঃসহ যন্ত্রণা। ফের সে ইচ্ছে করে মাতাল হয়ে উঠেছে। সে ডাক দিল—দোহাই ডাক ঠাকুর, দোহাই তুর।

সে এবার কয়লা ফেলে শ্মশানের ভিজা মাটিগুলো তুলল হাঁড়িতে। যদি কিছু গয়না গলে মাটির সঙ্গে মিশে থাকে।

নেলি আবার আশার ডিমে তা দিতে দিতে জলে মাটি গুলল। জল ফেলে তলানি ঢালল মালসাতে। দু মালসায় তলানি জল ঢেলে জলটা আরও কমাল।

তারপর! এগুলো সে কী দেখছে—এত গহনা! এত টুকরো গহনা! চোখ ওর উজ্জল হয়ে উঠল। চোখ ওর আনন্দে জলে ভরে উঠল। এত! এত সোনার সব টুকরো! সব অণু। নেলি হারিকেনটা আরও কাছে নিয়ে গেল। টুকরোগুলো সব ঝিকমিক করছে। মালসাটি বুকের কাছে চেপে ধরল। —দোহাই ডাক ঠাকুর, দোহাই তুর। হামারে থোড়া শক্তি দে। সে একটা আঙুল দিয়ে নেড়ে নেড়ে দেখতে চাইল। আঙুলটা পর্যন্ত কাঁপছে। তবু যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় করে একটা অণুর স্পর্শ আঙুলে পেতে গিয়ে দেখল সেগুলো জলের সঙ্গে গুলে যেতে চাইছে।

নেলি আর পারছে না। সে আঙুল দিয়ে ফের চাপ দিল। ওরা ভেঙে যাচ্ছে। জলের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। নেলি আর পারছে না। আর পারছে না। ডাক ঠাকুর তু হামার সাথ বেইমানি মত কর। পেটের দুঃসহ যন্ত্রণা, শরীরটার দুঃসহ যন্ত্রণা, এইসব যুবতী মেয়ের পোড়া অণুবৎ হাড়ের টুকরো ওকে পাগল করে দিচ্ছে।

নেলি পাগলের মতো প্রেতের মতো সমস্ত রাত এইখানে পড়ে থাকল। এবং ভোর রাতের দিকে নেলি পাগলের মতোই অর্থাৎ ডাইনির মতো হয়ে—চোখ দুটো ফোলা ফোলা চুলগুলো খাড়া খাড়া করে চটানে উঠে গেল। গোমানি রাগে দুঃখে ওর কোমরে কয়েকটা লাথি মেরেছিল—অথচ নেলি কিছু বলেনি, চুপচাপ মাচানে গিয়ে হাত—পা ছড়িয়ে চোখ দুটো স্থির করে—কাঁথা—বালিশের নিচে আশ্রয় খুঁজেছিল এবং ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিল।

Pages: 1 2
Pages ( 1 of 2 ): 1 2পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *