হাসপাতালের ডাক্তার
০১.
হাসপাতালের ডাক্তার বলেছিলেন, একদম নড়াচড়া নয়। পাঁচ হপ্তা পর প্লাস্টার খোলা হবে।
সেদিন তার বেড-এর পাশে ওরা সবাই ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল।
শ্রীকান্তদা বলেছিল, কোনও মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় শরীরে অত আঘাত নিয়ে অতটা ছুটে যাওয়া! ওটা আমার কথা নয়, ডাক্তারবাবুই বললেন। পাঁজরে, পেটে, মাথায়, কোথায় না মেরেছে, হাত দুটোর অবস্থা তো—
ভবানীসার বলেছিলেন, তোমার পক্ষে এখন কথা বলা তো সম্ভব নয়, পরেই নয় বলব। মনের জোর এবার তোমায় সারিয়ে তুলবে।
শচীনকাকু একটা খোলা ছাড়ানো সিদ্ধ ডিম বার করে মুখের দিকে এগিয়ে দিচ্ছিল। তখন সাগরমামি ছোট্ট একটা ধমক দেয়, খাবে কী, চিবিয়ে কিছু খাওয়ার ক্ষমতা কি ওর আছে?
ডিমটারে কী কইরবেন? ননী বলেছিল। আমারে দ্যান, ক্ষুধা লাগচে। ডিমটা শচীনকাকুর হাত থেকে তুলে নিয়ে, কামড় বসাতে গিয়ে থমকে গেছল ননী। নাহ, আগে ওস্তাদরে ফিট কইরা তুলি, তারপর ভাগ কইরাই খামু। অ নিতুদা, অরে কবে বাড়ি লইয়া যাইতে পারুম?
ডাক্তার তো বললেন, দিন দশেকের আগে নয়।
অঃ। তারপর ফিট হইতে হইতে আরও তিন-চার মাস এইডা কোনও সময়ই না। তারপর মুখের কাছে ঝুকে ননী বলেছিল, তোর বস্তাফস্তা, দড়িদড়া, গ্লাভস সব তদ্দিনে আবার রেডি হইয়া যাইবি।
প্লাস্টারের বাইরে যতটুকু শরীর, তাতে হাত বুলাতে বুলোতে মা বলেছিল, ছোট থেকেই বাড়ন্ত গড়ন। বেশি বয়সি ভেবে সবাই ওর সঙ্গে বড়দের মতো ব্যবহার করেছে, ওর মনটা যে বাচ্চা রয়ে গেছে সেটা আর কেউ ভেবে দেখেনি।
চোখ দুটো এধার-ওধার ঘুরিয়ে শিবা সকলের মুখের দিকে তাকাচ্ছিল। ঘাড় ঘোরাবার ক্ষমতা ছিল না। তখন তাকে দেখাচ্ছিল মাথা থেকে কোমর পর্যন্ত প্লাস্টারে মোড়া মমির মতো।
সেই সময় তার মনে হচ্ছিল, যন্ত্রণা তার শরীরে নয়, সেটা যেন, যারা তার বেড ঘিরে দাঁড়িয়ে, তাদেরই মনে। সবার চোখ ব্যথায় ঘন, নরম, ছলছল হয়ে রয়েছে। তখন তার মনে হয়েছিল, একটা নাড়ির বাঁধন যেন রয়েছে তার সঙ্গে দেবদাস পাঠক রোডের দু ধারের মানুষদের, তার সঙ্গে পূর্বপল্লি কলোনির প্রতিবেশীদের। ওদের চাহনিতে কী একটা যেন রয়েছে, শিবা সেটা ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারছিল না। শুধু মনে হচ্ছিল সে আবার নতুন করে যেন জন্মাচ্ছে। এইবার সে কেঁদে উঠবে। মায়ের পেট থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় বাচ্চা যেমন করে কেঁদে ওঠে, সেই ভাবে কান্না তার গলায় উঠে আসছিল। সে তখন মনে মনে বলেছিল, আমি ফিরব, ফিরে আসব, আবার আমি রিং-এ উঠব।
.
০২.
অ শিবা, ওঠ ওঠ।
কাঁধ ধরে মা নাড়া দিল যাকে, সে শুধু উউউ বলে পাশ ফিরল।
ওঠ বাবা। নিতু কখন উঠে বেরিয়ে গেছে, দেরি করিসনি আর।
হুউউ।
আরও মিনিট পাঁচেক শুয়ে থেকে শিবা প্রায় লাফিয়েই উঠে পড়ল। ছ্যাঁচা বাঁশের দেয়ালের ঘর। দেয়ালের ফাঁকগুলোয় জোনাকির মতো বিন্দু বিন্দু আলো থেকে সে অনুমান করার চেষ্টা করল সূর্য কতটা উঠেছে। তার মনে হল এখন সাড়ে ছটার বেশিই হবে। অবশ্যই তা হলে দেরি হয়ে গেছে।
ওদের একটাই ঘর। তাতে দুই ভাই আর মা থাকে। ঘরটা লম্বায় দশ হাত, চওড়ায় আট হাত। মেঝেয় একসময় সিমেন্টের একটা আস্তরণ ছিল, এখন সবটাই প্রায় চটা ওঠা। ঝাঁট দিলে চুন-সুরকির গুঁড়ো ওঠে। দেয়ালগুলোয় একটি করে দু হাত লম্বা জানলা। দড়িতে ঝুলছে জামা-প্যান্ট ইত্যাদি। চন্দনের ও সিঁদুরের দাগ লাগা লক্ষ্মীর পট যে দেয়ালে, তার বিপরীত দেয়ালে আঁটা শীর্ণকায় একটি লোকের আবক্ষ বাঁধানো ফোটো।
ছবিটা শিবার মৃত বাবা দয়ালচাঁদ আইচ-এর। লম্বাটে মুখ, পাতাকাটা চুল, আয়ত চোখ দুটিতে আত্মবিশ্বাস ও জেদ প্রকাশ পাচ্ছে। স্কুলে পড়ার সময় বিয়াল্লিশের ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দিয়ে আট মাস জেল খাটেন। বড় ছেলের নাম নেতাজি ও মেজো ছেলের নাম শিবাজি রেখেছিলেন সংগ্রামী মানসিকতাকে শ্রদ্ধা জানাতে। তার পরের দুটি ছেলে, যারা অল্পবয়সে কলেরায় মারা যায়, তাদের নামের সঙ্গে কোনও দেশবরেণ্যর স্মৃতি আর তিনি জড়াননি। তারা শুধুই দিলীপ আর নীলেশ। প্রায় ভিখারি অবস্থায়, তিক্ত, ভগ্ন হৃদয়ে, বিনা চিকিৎসায় তিনি যক্ষ্মা রোগে মারা যান এই ঘরেই। জমিদার মুখুজ্যেদের পোড়ো জমি তাঁরই নেতৃত্বে জবরদখল করে গড়ে উঠেছে পূর্বপল্লি, নামকরণ দয়াল আইচেরই।
ঘরের কোণে একটা বেঞ্চ। তার ওপর গোল করে পাকানো দুটো মাদুর মোড়া কাঁথা ও বালিশ। শিবা তার নিজের শয্যা অর্থাৎ কাঁথা-মাদুর ওই দুটির ওপর রেখে দিল। একটা টেবিল ঘরের অন্য দেয়াল ঘেঁষে। সেখান থেকে গুঁড়ো মাজনের কৌটোটা তুলে ঢাকনা খুলেই শিবা হৃ কোঁচকাল। চেঁচিয়ে বলল, মা, নিতুদা মাজন শেষ করে রেখে গেছে। এখন কী করি?
ঘরের বাইরে চার হাত চওড়া মাটির দাওয়া। টালির চালটা তার ওপর এত ঝুঁকে পড়েছে যে, মাথা নামিয়ে বাইরে থেকে দাওয়ায় উঠতে হয়। দাওয়ার এক প্রান্তে ইটের কোমর-উঁচু দেয়ালে ঘেরা অংশটা রান্নার জায়গা। করুণা তখন উনুনে কয়লা সাজাচ্ছিলেন। চেঁচিয়ে বললেন, কী আবার করবি, ছাই দিয়ে মেজে নে।
না। শিবা বিরক্ত মুখে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল, ওতে দাঁত খারাপ হয়ে যায়।
দাওয়া থেকে নেমে ডান দিকে প্রায় কুড়ি হাত দূরের তাদেরটার মতোই আর একটা টালির ঘরের কাছে এসে দাঁড়াল।
মামি আছ না কি?
কেন রে শিবা? ঘরের ভেতর থেকে সাগরমামি সাড়া দিল।
তোমার কাছে মাজন আছে, সাদা মাজন? আমাদের ফুরিয়ে গেছে।
দাঁড়া দিচ্ছি।
সাগরমামি ঘর থেকে বেরিয়ে এল, হাতে লাল প্লাস্টিকের একটা কৌটো। পেছনে। তার স্বামী শক্তি দাস।
এইসব মাজনটাজনে দাঁত মাজিস না, এতে দাঁত শক্ত হয় না। শক্তি দাসের হাতে নিমের দাঁতন। সেটা চিবোতে শুরু করল। এই যে নিমের রস, এটা শুধু দাঁতেরই নয়, লিভারের পক্ষেও ভাল।
সাগরমামি কড়া চোখে একবার স্বামীর মুখে তাকিয়ে কৌটোটা শিবার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, আধ ঘণ্টা ধরে নিমের কাঠি চিবোতে গেলে মেয়েদের চলে না।
তুমি ঢেলে দাও। শিবা বাঁ হাতের তালু মেলে ধরল। কৌটোর ঢাকনা খুলে ঝাঁকিয়ে মাজন বার করতে গিয়ে সাগরমামি থমকে গেল।
তোর আঙুলটা তো এখনও বাঁকা রয়ে গেছে!
শিবার বাঁ হাতের তর্জনীটা দু আঙুলে ধরে সাগরমামি নাড়ানাড়ি করে দেখতে লাগল।
আগে আরও বাঁকা ছিল। শিবা বলল।
ব্যথা করে?
না, একদমই না। শিবা হাসল।
কতদিন হল বল তো?
সাড়ে তিন বছর তো হবেই।
কৌটোটা ঝাঁকিয়ে তালুতে মাজন ঢেলে সাগরমামি বলল, তবু ভাল, বড়রকমের কোনও অঙ্গহানি হয়নি। যা মার তোকে মেরেছিল, ভাবলে এখনও শিউরে উঠি।
ওদের টার্গেট ছিল শিবার দুটো হাত। আর যাতে না ঘুসি ছুড়তে পারে সেজন্য অকেজো করে দেওয়াই ছিল উদ্দেশ্য। শক্তি দাস বহুবার বলা এবং শোনা কথাগুলোরই পুনরাবৃত্তি করল। শুধু নতুন একটা কথা যোগ করল, শিবার ইন্ডিয়া চ্যাম্পিয়ান হওয়ার সাধটা আর পূরণ হল না। ওই একবারই যা ফাইনালে—
শিবা তখন ডান হাতের তর্জনীতে মাজন লাগিয়ে দাঁতে ঘষতে শুরু করে দিয়েছে। ঘষা বন্ধ রেখে শক্তি দাসের দিকে একবার তাকাল। কিছুই বলল না। চাউনি থেকেও বোঝা গেল না ব্যাপারটা নিয়ে সে কখনও ভেবেছে কি না।
না শিবা না, ঘুসোঘুসিতে আর যাসনি। সাগরমামির আন্তরিকতা তার চোখে ফুটে উঠল। এ বড় মারাত্মক খেলা। তুই এইই ভাল আছিস। গরিবের ছেলে গতর খাটিয়ে কাজকম্মো করে খেতে হবে, ঘুসোঘুসি গুণ্ডা-বদমাশরা করুক।
আহ্হা, শিবা গুণ্ডা হওয়ার জন্য ঘুসি চালাবে না কি? এর নাম বক্সিং, রীতিমতো শিক্ষা করতে হয়, ট্রেনিং করতে হয়। লড়াই হয় মোটা কাছি দিয়ে ঘেরা উঁচু একটা দালানের মতো জায়গায়…সেদিন শ্রীকান্তদার ঘরে টিভিতে দেখলে না, দুজনে লড়ছিল। হাতে পরা ছিল বস্তার মতো দুটো গ্লাভস। ওটা পরে ঘুসি মারলে তেমন লাগে না।
লাগে না তো, ঘুসি খেয়ে একজন দড়াম করে চিতপটাং হয়ে আর উঠল না কেন? বাজে বকা তোমার একটা ওব্যেস। লাগে কি লাগে না তা আর আমায় বোঝাতে এসো না।
সাগরমামির মুখঝামটা ভোরবেলায় আরম্ভ হলে সেটা রোদ চড়ার সঙ্গে সঙ্গে একই তেজে চড়বে। শক্তি দাস দীর্ঘকালের অভিজ্ঞতা থেকে অর্জিত তার এই জ্ঞানটুকু এবার বিজ্ঞতা সহকারে প্রয়োগ করল।
দড়াম করে চিতপাত হল কেন, সেটা তোমার মতো বুদ্ধিমতীকে কি বুঝিতে দিতে হবে? একজনের ঘুসির জোর বেশি, আর-একজনের শরীরে ক্ষমতা কম, ব্যস। শিবার শরীরের ক্ষমতা আমার থেকে বেশি, এই আমি যদি এখন ওকে ঘুসি মারি— শক্তি দাস দাঁতনটা দাঁতে চেপে দু হাতের ঘুসি পাকাল। সাগরমামির চোখও সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফারিত হল।
তার মানে? তুমি ওকে ঘুসি মারবে নাকি? খবদ্দার বলছি, এই সেদিন অত ঝড় বয়ে গেল ওর শরীরের ওপর দিয়ে, ছেলের অখনও গায়ের ব্যথা মরেনি।
না, না, মামি, এতদিন হয়ে গেল, ব্যথাট্যথা কিছু নেই, একদম ফিট। শিবা তাড়াতাড়ি তার শারীরিক ক্ষমতা সম্পর্কে ভুল ধারণাটা ভেঙে দেওয়ার জন্য আর-একটু যোগ করল, দুবার ডেকচিভরা আলুর দম ঘাড়ে নিয়ে এক মাইল যেতে হয়, বালতি বালতি জল টিউকল থেকে বয়ে আনতে হয়, প্লেট, গ্লাস ধুতে হয়, খদ্দেরকে দেখতে হয়, এসব কি শরীরে ক্ষমতা না থাকলে করা যায়?
পূর্বপল্লি আর দেবদাস পাঠক রোডের বহু লোকের মনে ধারণা তৈরি হয়ে গেছে, শিবার শরীরে আগের মতো আর জোর নেই। সাধুর লোকেরা যেভাবে মেরে রাস্তায় ফেলে রেখে দিয়েছিল, তারপর তো শক্তি ফিরে পাওয়া কোনওভাবেই সম্ভব নয়। বক্সার হিসেবে ও তো শেষ হয়েই গেছে। সবাই ওকে একটু করুণার চক্ষেই দেখে। এজন্য সে অস্বস্তি বোধ তো করেই, মনে মনে রেগেও ওঠে। গায়ে জোর নেই, এটা তার কাছে লজ্জার ব্যাপার।
দাওয়ায় জলভরা বালতিতে প্লাস্টিকের মগ ভাসছে। শিবা মগে জল নিয়ে মুখ ধুয়ে চলে যাওয়ার জন্য দুপা গিয়েই দাঁড়িয়ে পড়ল। মামি, এখানকার গুণ্ডা-মাস্তানরা ঘুমোঘুসি করে না, তাই তাদের গায়ের জোর থাকারও দরকার হয়। বোমা, পিস্তল, পাইপগান আর চার-পাঁচজনে চেপে ধরে একজনকে ছোরা মারার জন্য কি এক্সাইজ করার দরকার হয়?
সাধুর শরীরে কিন্তু প্রচণ্ড জোর আছে, একসময় ও এক্সাইজ করত। শক্তি দাসের চোখে, স্বরে সমীহ ও ভয় ফুটে উঠল।
দপ করে উঠেই শিবার চোখের মণি দুটো স্থির হয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড। পুরনো সিনেমার বিবর্ণ ছবির মতো একসার ঘটনা ও মানুষ তার মাথার মধ্যে ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল। সে ধীরে ধীরে মাথাটা দু-তিনবার নেড়ে স্বীকার করল কথাটা। হ্যাঁ, সাধুর শরীরে ক্ষমতা আছে, ওয়েটলিফটার ছিল। শিবা কথা না বলে চলে গেল।
শিবার গায়েও জোর আছে। সাগরমামি নরম গলায় বলল শিবার ঘাড় আর পিঠের দিকে তাকিয়ে।
জোর বলে জোর! ওর একটা ঘুসিতেই সাধু চিতপটাং হয়েছিল, তখন তো ওর বয়স মাত্র সতেরো! শক্তি দাস প্রায় চার বছর ধরে তার জমিয়ে রাখা বিস্ময় থেকে খানিকটা ব্যয় করে ভারমুক্ত হল। এখন সে বিত্তান্ত কাউকে বললে তো ভাববে গাঁজায় দম দিয়ে গপ্পো ফাঁদছি!
কাউকে বলার দরকার কী? যেমন দাঁতন করছ তাই করো, শিবা যেমন আছে তেমনই থাক। নিঃসন্তান সাগরমামি স্বামীর দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে ঘরের মধ্যে যাওয়ার সময় বলল, সাধ টাধ পূরণ করার ইচ্ছেটা আর ওর মধ্যে চাগিয়ে তুলো না।
চাগিয়ে কি আর তুলতে হয়, এসব ব্যাপার আপনা থেকেই হয়ে যায়। দাঁতনকাঠিটা চিবোতে চিবোতে শক্তি দাস আপন মনে বলল, ঘুসিটা কি আর আগে থেকে ভেবেচিন্তে তারপর মেরেছিল? ওটা না মারলে শিবা কোনওদিন কি বক্সার হতে পারত? ঘর থেকে স্ত্রীকে বেরিয়ে আসতে দেখে শক্তি দাস এবার জোরে জোরে দাঁতন ঘষতে শুরু করে দিল।
যে বৃত্তান্তর কথা শক্তি দাস উল্লেখ করল, সেটা লোকের মুখে মুখে পল্লবিত হয়ে এখন কিংবদন্তির চেহারা নিয়েছে। এই অঞ্চলে নবাগত কাউকে সে কাহিনী বললে সত্যিই সে বিশ্বাস করবে না।
দোর্দণ্ড প্রতাপশালী সাধন ঘোষ, যে এখন অনেকের কাছে সাধনবাবু বা সাধুদা, কয়েক বছর আগে সে কিন্তু সবার কাছে পরিচিত ছিল সাধু গুণ্ডা নামে। তখন বোমা, ছোরা, পাইপগান নিয়ে রাহাজানি, গুণ্ডামি, ট্রাক থেকে মাল লুট ছাড়াও, দাঙ্গা বাধানো, ধর্মঘট ভাঙা, ভাড়াটে তোলা, ভোটের বুথ দখল করা, বস্তিতে আগুন দেওয়া, রাস্তার বাজার থেকে তোলা আদায়, এমনকী স্কুলের পরীক্ষায় টোকাটুকির ব্যবস্থা ইত্যাদি নানা ব্যাপারে সাধুর কর্মক্ষেত্র বিস্তৃত ছিল।
গত তিন বছর ধরে সে একটা কালীপুজো করছে ধুমধামিয়ে। তার পাড়া মিলনপল্লি থেকে বি টি রোড পর্যন্ত সাতদিন আলোর বন্যায় ভেসে যায়। সর্বত্র লোডশেডিং হলেও সাধুর কালীপুজোয় হয় না। পুজোয় সে পঞ্চাশজন গরিবকে বস্ত্র বিতরণ করে। এম. পি, এম. এল এ, ফুটবলার, ফিল্মস্টাররা আসে, গানের ফাংশন হয়, গুণিজন সংবর্ধনা হয়, যাত্রা হয়, তিন দিন সিনেমা দেখানো হয়। এলাকায় সাধু খুবই জনপ্রিয়। বহু লোক ওকে ভক্তিশ্রদ্ধাও করে। বছরে একটি দরিদ্র পরিবারের মেয়ের বিয়ের যাবতীয় খরচ সে দেয়। এজন্য কেউ কেউ তাকে রবিনহুডের সঙ্গে তুলনা করে।
কিন্তু চার বছর আগে সাধু যখন ভয়াবহ গুণ্ডা হিসেবেই পরিচিত অর্থাৎ যখনও সে বাবু হয়ে ওঠেনি, সেই আমলের একটা সন্ধ্যায় ঘটনাটা ঘটেছিল।
শিবা তাকে ঘুসিটা মেরেছিল।
.
০৩.
দশ কিলোগ্রাম আলু, তারই দম। রাত্রে সমান মাপে আধখানা করে আলুগুলো কেটে সিদ্ধ করে রাখেন তারাময়ী। ভোরবেলায় কয়লার উনুন ধরিয়ে তিনি আলুর দম তৈরি করতে বসেন। নিতুর নির্দেশ মতোই ঝোলটা বেশি, ঝালটাও বেশি, এমন একটা দম তাঁকে তৈরি করতে হয় যাতে রসুনের গন্ধটা যেন নাকে লাগে। জুট মিলের। মজুররা এমন জলখাবারই পছন্দ করে যেটা দামে সস্তা, খেতেও বেশ! পাউরুটি কোয়ার্টার পাউন্ড আর আলুর দম দুটুকরো দেড় টাকা। ওরা ঝোলটাই বেশি করে চায়। একটার সময় টিফিনের ভোঁ বাজলে নিতু আর শিবার দম ফেলার সময় হয় না। দশ কিলো আলুর দম আর কুড়ি থেকে পঁচিশ পাউন্ড পাউরুটি আধ ঘণ্টায় উড়ে যায়। এইসঙ্গে আছে চা আর ওমলেট।
বি টি রোড থেকে প্রায় এক মাইল পশ্চিমে গঙ্গার ধারে, পার্কি জুট মিল-এর কাছে ফিডার রোডের মোড়ে সাত-আটটি চায়ের ও খাবারের দোকানের একটি হল নিতুর। তিন বছর আগে সে শুধু আলুর দমের ডেকচি, থলিভরা পাউরুটি, জলের বালতি ও কয়েকটি চায়ের প্লেট নিয়ে খোলা আকাশের নীচে তার ব্যবসা শুরু করেছিল। এখন বাঁশের খুঁটিতে লম্বায় ও চওড়ায় চার হাত করে পলিথিন চাদরের চালা, ইট আর মাটি দিয়ে তৈরি কোমর সমান উঁচু কয়লার উনুন, যাতে চা, ওমলেট ও রুটি সেঁকা হয়। বালতি এখন তিনটে। কাচের গ্লাস ও প্লেট দু ডজন করে।
নিতুর প্রথম কাজ সকালে এসে উনুন ধরানো, সাইকেল ভ্যানে বেকারি থেকে পাউরুটি দিয়ে গেলে সেগুলো চার টুকরো করা, চায়ের জল গরম করা ইত্যাদি। তার আগে অবশ্য গ্লাস, প্লেট, অ্যালুমিনিয়ামের মগ, সসপ্যান, চা তৈরির সরঞ্জাম, ঘুটে কয়লা ইত্যাদি যেসব জিনিস রাত্রে বাড়ি ফেরার আগে অধীরের সাইকেল গ্যারাজের এককোণে রেখে দেয়, সেগুলো নিয়ে আসে। রাখার জন্য মাসে চল্লিশ টাকা ভাড়া দিতে হয়। এই অধীর নন্দীই নিতুকে এখানে খাবার বিক্রির জন্য বসার ব্যবস্থা করে দিয়েছে জুট মিলের ইউনিয়ন, থানার মেজোবাবু আর মিউনিসিপ্যালিটির স্থানীয় কমিশনারের সঙ্গে ব্যবস্থা করে। তবে সেজন্য সে শর্ত দিয়েছিল, যখন গ্যারাজে থাকব না, তখন নজর রাখবি চুরি টুরি যেন না যায়, আর ঝামেলা টামেলা হলে দৌড়ে আসবি। তুই না তুই না, শিবা যেন এসে দাঁড়ায়।
শর্তের কথা শুনে শিবা ক্ষুব্ধ হয়ে নিতুকে বলেছিল, আমাকে ভেবেছে কী, গুণ্ডা? আমি গিয়ে মারামারি করব?
আহ্হ্, এটা একটা মাথাগরম করার মতো কথা নাকি? ভাইকে ঠাণ্ডা করার জন্য নিতু বলে। ওখানে পা রাখার মতো একটা সুযোগ প্রথমে দরকার। অধীরদা যা বলে, শুনে যাওয়া আর ঘাড় নাড়া। ঝামেলা যদি হয়ই, মিটমাট করে দিবি। মারপিটই করতে হবে এমন কোনও কথা আছে কি? মনে রাখিস আমাদেরও ওখানে ব্যবসা চালাতে হবে। মারপিট একদম নয়।
নিতু গম্ভীর ও কড়া স্বরে শেষ বাক্যটি বলে দিল। শিবা মাথা নিচু করে শুনে বিড়বিড়িয়ে বলে, আমার সম্পর্কে কী যে ধারণা লোকের!
ওই যে সাধুকে ঘুসি মেরেছিলি, লোকে সেটাই মনে করে রেখে দিয়েছে, নিতু বলেছিল।
তারপর, সাধুরা যে আমায় মেরে ছমাস বিছানায় শুইয়ে রাখল—সেটা আর লোকেরা মনে রাখল না।
নিতু ম্লান হেসে বলেছিল, লোকেরা বীরত্বকেই মনে রাখতে চায়, কাপুরুষত্বকে নয়। একের সঙ্গে এক মুখোমুখি লড়াইটাই হল বীরের ধর্ম, কাজ। তুই সেটাই করেছিলি।
শিবা তখন আড়চোখে তারাময়ীর দিকে তাকিয়ে দেখেছিল, মায়ের চোখ জ্বলজ্বল করছে বড় ছেলের কথা শুনে, আর চাহনি ধরে হালকা মেঘের মতো ছায়ারা ভেসে আসছে তার দিকে।
প্রতিদিন সকালে শিবার প্রথম কাজ, তারাময়ীর রাঁধা আলুর দমের অর্ধেকটারও বেশি একটা বিশাল ডেকচিতে ঘাড়ে নিয়ে এক মাইল হেঁটে সাতটার মধ্যে দোকানে হাজির হওয়া। যাওয়ার পথে ডিম ব্যবসায়ী:সতু বাঁড়ুজ্যের দোকান থেকে থলিটা এক হাতে তুলে নেয়, যাতে থাকে পঞ্চাশটা ডিম। তারপর সে খালি ডেকচি নিয়ে দুপুরে ফিরে এসে আবার বাকি আলুর দমটা নিয়ে যায় সন্ধ্যার খদ্দেরদের জন্য।
নিতুর দোকানের আলুর দমের চাহিদা আছে, কেননা তারাময়ীর রান্নার হাতটি অসাধারণ। কিন্তু উনুন থেকে রান্না নামাবার পর প্রতিদিনই তিনি বুকে অতি ক্ষীণ একটা কাঁপুনি বোধ করেন এই ভেবে—ঠিকমতো হয়েছে তো?
আজও তিনি প্রতিদিনের মতো ডাকলেন, শিবা আয়।
স্নান করে এসে শিবা ঘরে চুল আঁচড়াচ্ছিল। অস্ফুটে উড় বলে এমন গলায়, যা তারাময়ীর কানে পৌঁছল না।
বাটিতে আলুর দমের ঝোল নিয়ে তিনি ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালেন। শিবা ঘরে আছিস? ঘরের মধ্যে উঁকি দিয়ে চুল আঁচড়ানোয় ব্যস্ত শিবাকে দেখে বললেন, ঘরে ঢুকব না, হাত বাড়া, ধর তাড়াতাড়ি।
বন্ধ হয়ে গেল চুল আঁচড়ানো। শিবার সারা দেহ শক্ত হয়ে গেল। ঠিক এই কথাগুলো, প্রায় এই কথাগুলোই ঠিক এইরকম স্বরেই তো মা বলেছিল…কত বছর
আগে…কত বছর? মা তখন রাঁধুনির কাজ করত জমিদার মুখুজ্যেবাড়িতে।
ঝোলের বাটিটা হাতে নিয়ে শিবা তারাময়ীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। উৎকণ্ঠিত মুখ। ঠিক এইরকমই তখন দেখাত মাকে।
খেয়ে বল, ঠিক হয়েছে কি না, নুন কম হয়েছে? ঝাল?
ঝোলে চুমুক দিয়ে কয়েক সেকেন্ড পর শিবা মাথা নেড়ে জানাল, ঠিক আছে।
তখনই কিন্তু শিবার মাথার মধ্যে সামান্য গোলমাল ঘটে গেল। আলুর দমের ডেকচিটা মাথায় নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সে মুখজ্যেবাড়ির বাগানের পাঁচিলের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। পাঁচিল শেষ হওয়ার পর বাঁ দিকে দেবদাস পাঠক রোড, যেটা গিয়ে মিশেছে বি টি রোডে।
পাঁচিলে একটা জায়গা ভাঙা। শিবা ডেকচি মাথায় দাঁড়িয়ে পড়ল। মুখুজ্যেদের রান্নাঘরটা এই ভাঙা জায়গাটা দিয়ে দেখা যাচ্ছে। জানলাটায় তারের জাল লাগানো। আগে তো জাল ছিল না! শিবার মাথার মধ্যে শুরু হওয়া গোলমালটা রূপান্তরিত হল ঘূর্ণিঝড়ে। সাঁ সাঁ করে দশটা বছর পিছিয়ে গিয়ে তার স্মৃতি আছড়ে পড়ল রান্নাঘরের ওই জানলাটার কাছে।
.
উনুনের ঠিক পেছনেই জানলাটা। জানলার বাইরেই আবর্জনার স্তৃপ আর কাঁচা নর্দমা। সে দাঁড়িয়ে ছিল দেয়াল ঘেঁসে। ওধারে লোহার ফটক। বাগানটা ঝোপঝাড়ে ভরা। একটা কাঁঠাল আর গোটা-তিনেক আমগাছ ছাড়া বাগান বলার মতো আর কোনও বড় গাছ নেই। পাঁচিলের ভাঙা জায়গাটা দিয়ে সে প্রতিদিন ঢুকত। রান্নাঘরের জানলার পাশে কাদা-প্যাচপ্যাচে জমিতে নিঃসাড়ে দাঁড়িয়ে সে অপেক্ষা করত। তখন বারবার দুধারে তাকিয়ে দেখত কেউ তাকে দেখে ফেলল কি না। কোনও কোনওদিন আধঘণ্টাও দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে, যদি রান্নাঘরে গিন্নিমা কিংবা ভৃত্য হরিহর হাজির থাকত। যখন কাদায় পায়ের পাতা ডুবিয়ে কাঠের মতো দাঁড়িয়ে থেকে সে অপেক্ষা করত, রান্নাঘর থেকে তখন ভারী সুন্দর রান্নার গন্ধ ভেসে আসত। জিরে, পাঁচফোড়ন, গরমমশলা, কখনও বা রসুন বা পেঁয়াজ। এইসব জিনিস দিয়ে রাঁধা খাবার তাদের বাড়িতে হত না।
গন্ধটা নাক দিয়ে শরীরে মধ্যে পাঠিয়ে সে নিশ্বাস বন্ধ করে রাখত। তখন সারা শরীরে একটা ঝিমঝিমে ভাব তৈরি হত। বারবার ঢোক গিলে চেষ্টা করত গন্ধটাকে পাকস্থলিতে চালান করার। তখন পেট জুড়ে একটা ব্যথা ছড়িয়ে যেত। ফুটন্ত মাছের ঝোলের বা ডালের বগবগ শব্দও সে শুনতে পেয়েছে কোনও-কোনওদিন। একটা বড় থালা দিয়ে মা কড়াইয়ের মুখ ঢেকে দিলে শব্দটা বন্ধ হয়ে যেত, গন্ধটাও আর পাওয়া যেত না। এক-একদিন সে ভাবত, মাকে বলবে কড়াইটা ঢেকে না দিতে। ওই রান্নার শব্দ আর গন্ধর জন্যই তো সে সারাদিন জানলাটার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে পারত।
বিরাট কড়ায় আঠারো জনের রান্না হয়। মা নামাতে পারত না, হরিহরকে ডাকতে হত কড়া নামাবার জন্য। তখন সে কল্পনা করত, মুখুজ্যেবাড়ির ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাওয়ার আগে দালানে সার দিয়ে খেতে বসেছে। গরম গরম ভাত, ডাল, তরকারি, মাছের ঝোল। সবই তার মায়ের হাতে রাঁধা। ওই সারির মধ্যে রয়েছে রঞ্জুও। সেজোবাবুর ছেলে রঞ্জন, তারই বয়সি। ধবধবে ফরসা গায়ের রং। বি টি রোড থেকে স্কুলবাসে ওঠার জন্য সে হরিহরের সঙ্গে হেঁটে যেত। পিঠে বইয়ের ব্যাগ নিয়ে রঞ্জুর হাঁটা দেখতে তার খুব ভাল লাগত।
রান্নাঘরের জানলার ধারে দাঁড়িয়ে ওদের খাওয়ার দৃশ্য সে কল্পনায় দেখত। খেতে-খেতে রঞ্জুর মুখে তৃপ্তির ভাব ফুটে উঠছে, এটাই সে ভেবে নিত। রঞ্জুর তৃপ্তিকে নিজের তৃপ্তি করে নেওয়ার জন্য সে মনে মনে চেষ্টা করলেই তখন পাকস্থলিটা ঘুলিয়ে উঠে মুখে জল জমা হত। কিন্তু কান তার সজাগ থাকত একটা কথা শোনার জন্য, শিবা, হাত বাড়া।
জানলার গরাদের ফাঁক দিয়ে মায়ের হাতটা বেরিয়ে আসত। শালপাতা অথবা কাগজে মোড়া ভাত, ডাল, তরকারির একটা মণ্ড থাকত তার মধ্যে। সেটা হাতে নিয়েই বিদ্যুদ্বেগে সে জানলা থেকে সরে গিয়ে ভাঙা পাঁচিল টপকে বাড়ির দিকে। ছুটত। মণ্ডটা থেকে গরম ভাপ তালু বেয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে যেত তখন।
দিলু আর নিলু ঘরের কাছাকাছিই অপেক্ষা করত। তাকে দেখামাত্রই মেজদা এসে গেছে বলে ছুটে আসত। তাকে ঘিরে ওরা দাওয়ায় উবু হয়ে বসত। জাদুকর যেভাবে টুপির মধ্য থেকে খরগোশ বার করে সেইভাবে সে শালপাতা বা কাগজের মোড়কটা খুলত। ভাত, চচ্চড়ি বা সিদ্ধ ডাল, এইরকম কিছুই বেরিয়ে আসত। দিলু বা নিলু, কেউ একজন ই ই ই বলে আওয়াজ করে উঠত।
কিন্তু একদিন তারা ধরা পড়ে গেল।
নিশ্চয় কেউ তাদের লক্ষ করেছিল। হাতেনাতে ধরার জন্য তক্কে তক্কে ছিল। মা। শিবা আছিস বলে ডাকতেই সে জানলার সামনে এসে হাত বাড়ায়। মা শালপাতার মোড়কটা যখন হাতে দিয়েছে তখন সে দেখতে পায়, রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে গিন্নিমা তাকিয়ে রয়েছে।
সে ছুটে পালাতে যেতেই একেবারে হরিহরের মুখোমুখি। তার চুলের মুঠি ধরে হরিহর টেনে আনল বাড়ির মধ্যে। সে দেখতে পেল গিন্নিমার পা জড়িয়ে ধরে মা কী। একটা কথা বলার চেষ্টা করছে। গিন্নিমাকে গালে হাত দিয়ে বলতে শুনেছিল, বলো কী! এগারো বছর মাত্র বয়স দেখে তো মনে হয় যোলো-সতেরো।
সত্যি বলছি মা, ও বাচ্চা ছেলে, ওকে মারবেন না। দোষ আমারই, আমিই চুরি করে ওকে দিয়েছি। ওর কোনও দোষ নেই। পেটের জ্বালায় বাচ্চা ছেলেগুলো ছটফটায়, মাথার ঠিক রাখতে পারিনি মা। ওদের উপোসি মুখ চোখ দিয়ে আর দেখতে পারি না।
তখন সে মায়ের চোখ দুটো দেখেছিল। ভয়, নিদারুণ একটা ভয় সেই চোখে। চাকরিটা চলে যাবে। ষােলো বছরের বড় ছেলে নিতু চার টাকা রোজ-এ কারখানায় কাজ করে। তার রোজগারের টাকায় পাঁচটা পেট চালানো মানে একবেলা দুমুঠো ভাতও নয়, হয়তো এইজন্যই ভয় কিংবা এগারো বছরের ছেলে চোরের মার খাবে। বা পুলিশের হাতে যাবে, হয়তো সেইজন্যও।
শিবা তার জীবনের প্রথম ভয়কে দেখেছিল মার চোখে। তখন বয়স এগারো। সেই প্রথম শুনেছিল তার শরীরের আকারটি বড়, অন্তত পাঁচ-ছ বছর টপকিয়ে তার শরীর এগিয়ে রয়েছে। মায়ের সেই ভীত চাহনি একজোড়া গরম লোহার শিকের মতো সঙ্গে সঙ্গে তার চেতনায় গেঁথে গেছল। তার যন্ত্রণা কখন যে নিঃসাড়ে শিরা-উপশিরা দিয়ে পেশিতে ছড়িয়ে গেছল, সে টের পায়নি। হরিহর একটা প্রচণ্ড থাপ্পড়ে তাকে যখন উঠোনে ফেলে দেয়, সে কোনও ব্যথা বোধ করেনি। তার সর্বাঙ্গ মায়ের চাহনি থেকে পাওয়া ভয় আর লজ্জায় অসাড় হয়ে ছিল। সে তখনই জেনে যায় ভয় একটা অদ্ভুত ব্যাপার। এর মধ্যে ডুবে থাকার সময় খুব জোরে আঘাত এলেও দেহ তা শুষে নেয়।
এর কিছুদিন পর বিয়েবাড়ির বাসি খাবার খেয়েছিল ওরা তিনভাই। চাকর ফেলে দিচ্ছিল, শিবাই চেয়ে এনে, রেলপুকুরের ধারে লুকিয়ে ডেকে নিয়ে গিয়ে দিলু-নিলুকেও খেতে দেয় সন্ধ্যায়। পরদিন সকালে ওদের দুজনের ভেদবমি শুরু হতেই সে ভয়ে কথা বলতে পারেনি। দিলু-নিলু রাত্রে মারা যায় বিনা চিকিৎসায়। সে রক্ষা পেল কী করে, তাই নিয়ে অনেক ভেবেও কোনও কারণ খুঁজে পায়নি। কলেরাকেও তার শরীর শুষে নিয়েছিল।
.
সিনেমা চলতে চলতে হঠাৎ ফিল্মের রিল ছিঁড়ে যাওয়ার মতো, অতীতে ফিরে গিয়ে পুরনো একটা ঘটনা দেখা বন্ধ হল ননীর ডাক শুনে।
চাইরবার চিল্লালাম ওস্তাদ ওস্তাদ কইরা, মনডা কি ডেচকির মদ্যে আলুর দমের সাথেই ঢাকনা দিয়া রাখলা? ধীরে প্যাডেল করতে করতে ননী শিবার পাশাপাশি সাইকেল রিকশাটাকে চালিয়ে যেতে যেতে বলল।
শিবা ত্যারচা চোখে ননীর মুখটা একবার দেখে নিয়ে বলল, শুধু একটা আলু, ঝোল পাবি না।
এইডা কি একটা কথা হইল! এক মাইল পথ..না, না, এহান থিকা আধা মাইলই…কিনা একডা মাত্তর আলু, তাও ঝোল নয়!
ডেকচি মাথায় শিবা দাঁড়িয়ে পড়ল, সঙ্গে সঙ্গে ননীর সাইকেল রিকশাও।
তোর সঙ্গে কথাই ছিল মাইল পিছু দুটো আলু আর ঝোল। আধ মাইল তো আমি হেঁটেই চলে এসেছি, বাকিটাও হেঁটে চলে যাব। শিবা রাগত স্বরে বলল।
হেই ওস্তাদ, একটু লেট কইরা ফ্যালাইচি, সেজন্য এভাবে ফাইন কইরো না। কাইল রাতে একটা খুচরা অ্যাকসিডেন্ট কইরা এমন মাইর খাইচি…ওঠো, ওঠো, যাইতে-যাইতে কমু। সাইকেলের সিট থেকে নেমে ননী ব্যস্তভাবে শিবার মাথার ডেকচিতে হাত লাগাল। উচ্চতায় সে প্রায় শিবারই সমান, ছফুট। কিন্তু প্রস্থে, দুজনে পাশাপাশি দাঁড়ালে মনে হবে বটগাছের পাশে সুপুরি গাছ।
ননী ঢ্যাঙা, লিকলিকে, ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। পরনে একটা ঢলঢলে সবুজ গেঞ্জি, যার বুকে ইংরেজিতে হলুদ অক্ষরে লেখা আই লাভ ইউ। জিক্স-এর প্যান্টটা দু বছর আগে শিবারই দেওয়া, হাঁটুর ওপর নীল কাপড়ের তাপ্পি, পায়ে হাওয়াই চটি, পেছনে ওলটানো চুল, যার প্রান্তভাগ পায়রার ছড়ানো লেজের মতো। ননী বয়সে শিবার থেকে এক বছরের ছোট। ওর বাবা রাধেশ্যাম রিকশা চালাত, হাঁপানির জন্য আর পারে না। বউ আর দুই মেয়ের সঙ্গে বাড়িতে বসে এখন ঠোঙা বানায়।
ননীর শরীর দেখে বোঝা যায় না তার মধ্যে কতটা ক্ষমতা, সহনশীলতা লুকোনো। আছে। দুশো কিলোগ্রাম ওজনের চালের বস্তার বা একটি সুপুষ্ট পরিবারের ভার, দেড় বা দুই মাইল সে রিকশায় চাপিয়ে সহজেই নিয়ে যায়। অকল্পনীয় তার কলিজার শক্তি। আর ঠিক ততটাই তার দুর্বলতা শিবা সম্পর্কে। যেদিন শিবা ঘুসি মেরে সাধুর চোয়াল ভেঙে দিয়েছিল, তার শাগরেদ দেবুর মুখ ফাটিয়ে দিয়েছিল, সেদিন ওই দুজনের বাড়ি ফেরার মতো শরীরের জোর ছিল না। সাধু একটা রিকশা ডেকে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিল ইশারায়, চোয়াল নাড়াবার মতো অবস্থা তখন তার ছিল না। রাধেশ্যাম পাগলের মতো চিৎকার করছিল, অহনো ভগমান আচে, বুঝলা আচে। দীন-দুঃখীর ডাকে অহনো সাড়া দ্যায়। আমার পোলাপনগুলার সেই শুকনা মুখ—
সাধু ও দেবুর প্রচণ্ড মার খাওয়া দেখে আনন্দে রাধেশ্যামের ভগবানের কাছে। কৃতজ্ঞতা জানানোর কারণও ছিল। একবার সাধু তার রিকশায় চড়ে ভাড়া দেয়নি। না দেওয়াটাই তার রীতি। যেমন মিষ্টির দোকানে খেয়ে, লন্ড্রিতে কাপড় কাচিয়ে বা হকারের কাছ থেকে ম্যাগাজিন নিয়ে টাকা না দেওয়াটাও তার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। রাধেশ্যাম সেদিন ভাড়া না পেয়ে চিৎকার করে প্রতিবাদ করেছিল। তাইতে বহু লোকের সামনেই সাধুর ছেলেরা তার রিকশার একটা চাকা খুলে নিয়ে যায়। কেউ বাধা দিতে এগিয়ে আসেনি, বরং রাধেশ্যাম যে চেঁচামেচি করে পাড়ার শান্তি বিপন্ন করল, এজন্য তারা খুবই ক্ষুব্ধ হয়। পনেরো টাকা জরিমানা দিয়ে সাত দিন পর সে চাকাটা ফেরত পায়, আর সেজন্য তাকে কর্জ করতে আর সুদে-আসলে ধার শুধতে দিতে হয় মোট পঁচিশ টাকা। সাতটা দিন তার আধপেটার সংসারকে সিকিপেটা থাকতে হয়েছিল।
শিবার হাতে সাধু আর দেবু বেদম মার খাওয়ার পর রিকশা চেয়েছিল। হেঁটে ফেরার মতো অবস্থা তাদের ছিল না। তখন রাধেশ্যামের গাল বেয়ে জল ঝরছিল আর বলছিল, সাক্ষাৎ শিবরে আইজ চক্ষে দ্যাখতাসি… তখন ননী তার বাবার হাত ধরে শান্ত স্বরে বলেছিল, বাবা তুমি চুপ করো, এই দুভারে রিকশায় কইরা আমিই পৌছাইয়া দিমু।তারপর সে আরও ঠাণ্ডা শক্ত গলায় বলেছিল, রিকশাডারে সোজা বনোয়ারির নাদার গর্তে লইয়া ফ্যালামু। বনোয়ারি গোয়ালার আটটা গোরু-মোষের খাটালের কিনারে গভীর একটা গর্ত আছে, সেখানে গোবর জমানো হয়, দুহপ্তা অন্তর বিক্রির জন্য। ননী অবশ্য রিকশাটাকে সেই গর্তে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়নি, কারণ সাধু তার রিকশায় উঠতে অস্বীকার করেছিল।
.
আলুর দমের ডেকচিটা রিকশার পাদানিতে সাবধানে রেখে শিবা বলল, হয়েছিল কী? মার খেলি কেন?
কইতাছি। ননী রিকশার সিট তুলে ঢাকনা লাগানো একটা প্লাস্টিকের কৌটো বার করে বলল, একডা না, তোমারে ওস্তাদ কই, তুমি দুইডাও দাও। ইজ্জত বাঁচনের ব্যাপার কিনা।
শিবা প্রথমে একটা, পরে আর-একটা আলুর খণ্ড কৌটোয় রেখে আড়চোখে তাকাল। ননী তখন গভীর মনোযোগে টায়ারের হাওয়া পরীক্ষায় ব্যস্ত। উৎকণ্ঠায় ভুরু কোঁচকানো। শিবা তৃতীয় খণ্ডটি কৌটোয় রাখতেই ননীর ভুরু সমান হয়ে প্রায় উদাসীনতার পর্যায়ে চলে গেল। নাহ্, হাওয়া ঠিকই— বলতে বলতে কৌটোয় ঢাকনা এঁটে সিটের নীচে রেখে দিল।
প্যাডেল করতে করতে ননী বলল, বাসি রুটি দিয়া আলুর দম, বুঝলা ওস্তাদ, অ্যামন খাওয়া হয়ের—
বুঝেছি। ডিম নিতে যাব, তাড়াতাড়ি চালা।..বল এবার, কেন মার খেলি?
কাল সন্ধ্যায় ব্যালঘরিয়ায় গ্যাছিলাম একডা ফ্যামিলিরে লইয়া…। এর পর ননী যা বলল তার সংক্ষিপ্তসার: লোডশেডিংয়ের জন্য সরু রাস্তায় কতটা কিনার দিয়ে গেলে নালায় পড়বে না তাই নিয়ে সে খুবই ভাবিত ছিল। ফলে রাস্তার ধারে রাখা স্কুটারটা সে দেখতে পায়নি। রিকশার চাকার ধাক্কায় স্কুটারটা জমিতে পড়ে যায়। ব্যস, হইহই করে কয়েকটা লোক ছুটে এসে তাকে পিটোতে শুরু করে। যাই হোক, চড়চাপাটি, লাথি-ঘুসি খাওয়ার পর ননী আবিষ্কার করল এবং এইটিই মোক্ষম আঘাত, তার সওয়ার ফ্যামিলিটি অন্ধকারে ইতিমধ্যে মিলিয়ে গেছে। আসল মারডা ওস্তাদ অরাই মাইরা গেল। ছয়-ছয়ডা ট্যাহা…। ননী আফশোসে মাথা নাড়ল।
অ্যাই, অ্যাই, দাঁড়া, দাঁড়া।
ননী ব্রেক কষে মাথা ঘুরিয়ে দেখল শিবা রাস্তার ওধার দিয়ে হেঁটে যাওয়া, কালো সালোয়ার ও হলুদ কামিজ পরা, সাদা চুন্নি গায়ে এক তরুণীর দিকে কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে। ননী চিনতে পাচ্ছিস ওকে?
তীক্ষ্ণ নজরে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে ননী বলল, হেই মাইয়াডা না? ভবানীসারের কোচিংয়ে আইয়া পড়ত!
হ্যাঁ। লালবাগান বক্সিং জিমন্যাশিয়ামেরই গায়ে একটা জিমন্যাস্টিক ক্লাবে ও প্র্যাক্টিস করত। লালবাগান পার্কের গেটের কাছে একদিন ওর সঙ্গে দেখা হতে বলেছিলুম, তুমি আর ভবানী-সারের কাছে পড়তে যাও না কেন? বলেছিল, ওটা গুণ্ডাদের জায়গা। আমি বললুম, গুণ্ডারা ভীষণ মার খেয়ে প্রতিজ্ঞা করে গেছে ও পাড়ায় আর আসবে না।
ক্যারা মারচিল সেডা কি কইচিলা?
ধেত, নিজের ঢাক নিজে পেটায় নাকি, লোকে হাসবে।
পিডায়, পিড়ায়, তা না করলি অহনকার দিনে বড় হওন যায় না।
ননী আবার প্যাডেল করতে শুরু করল।
ও কিন্তু ভবানীসারের কোচিংয়ে আর আসেনি। বোম্বাইয়ে ন্যাশনালে লড়তে গিয়ে আবার ওকে দেখেছিলুম। ভেবেছিলুম কোনও জিমন্যাস্টিক টুর্নামেন্টে বুঝি নামতে এসেছে। অ-ম্মা, দেখি স্টেডিয়ামে ক্রিকেট খেলছে! খেলাটা ছিল বেঙ্গল রাজস্থান। তারপর চৌপট্টিতে দেখলুম টিমের কয়েকটা মেয়ের সঙ্গে ভেলপুরি খেতে এসেছে। তখন ওকে আবার বলেছিলুম, কোচিংয়ে যাও না কেন, গুণ্ডার ভয় তো আর নেই। কিন্তু কথাটায় কোনও গা করল না, এড়িয়ে গেল।
জিমন্যাস্টিক ছাইড়্যা কিরকেট! এর পর সারের কোচিংয়ে যখন আর গ্যাল না তাইলে তো পড়াডাও ছাড়ছে!
রোজারিওর সঙ্গে আমার ফাইনালের লড়াইটা দেখতে ওরা কয়েকজন গেছল।
তাই কও! বক্সিংয়ের ওরা বোঝেডা কী?
না বুঝুক, হারা-জেতাটা তো বোঝে। দুয়ো শুনতে শুনতে ড্রেসিংরুমে ফিরে যাওয়ার সময় ওকে দেখেছিলুম, চোখে চোখ পড়তেই মুখটা ঘুরিয়ে নিয়েছিল।
শিবার স্বরে বিষাদের ছোঁয়াটুকু ননীর কানে ঠেকল। সে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো নরম গলায় বলল, হাইর্যা গ্যালে না সবাই মুখ ফিরাইয়া লয়, এইডাই নিয়ম। দ্যাহনা জিতলা পরে কত না সংবর্ধনা, কত না পুরস্কার…
তখন শিবা মুখ ঘুরিয়ে পেছনের রাস্তা দেখছিল, ননীর কথাগুলো তার কানে গেল না। মেয়েটি হাঁটতে হাঁটতে বাঁ দিকে জোনাকি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কস নামে স্টোভ ও হ্যারিকেন তৈরির কারখানা যাওয়ার রাস্তায় বেঁকে গেল। শিবা অবাক হয়ে ভাবল, এত সকালে মেয়েটি এই রাস্তায় কেন, এখানেই থাকে নাকি! কই এতদিনে একবারও তো তার চোখে পড়েনি? রিকশাটা তো ওর বেশি দূর দিয়ে যায়নি, একবার মুখ ফিরিয়ে তাকিয়েও ছিল অথচ তাকে চিনতে পারল না! তার চেহারাটা তিন-চার বছরে কি খুব বদলে গেছে?
ব্রেক কষার ঝাঁকুনিতে শিবা সামনে তাকিয়ে দেখল ননীর চোখ তার মুখে আটকে রয়েছে। বুকের কাছে দুই মুঠি জড়ো করা।
শিবা, তুই আবার শুরু কর, আবার তুই রিংয়ে নাম একবারটি। ননীর কণ্ঠে মিনতি, চোখ দুটি ভিক্ষাপ্রার্থীর মতো, মায়ের কিরা, বক্সিংয়ের কিরা, এই রিকশার কিরা..তুই চ্যাম্পিয়ান হইবিই। আমার মন কইত্যাচে,…কথাডা শোন। এইসব আলুর দম টম বেচা বন্ধ কইরা তুই প্র্যাক্টিসে নাইমা পড়। যহন তুই প্র্যাক্টিস করবি, তোর হইয়া নিতুদার লগে আমি কাম করুম। রোজারিওর লগে হাইরাচিস, জেতা লড়াই হাইরাচিস, কী দুখ্য যে পাইচিলাম, পুরবো পল্লির হগ্নলে—
ননীর চোখে জলের আবরণ ছড়িয়ে রয়েছে। শিবার বুকের মধ্যে একটা ভয় চমকে উঠল। ননী যখন ওস্তাদ না ডেকে শিবা, আর তুমির বদলে তুই বলে, শিবা বুঝতে পারে আবেগে, উত্তেজনায় ননী তখন গভীরভাবে আন্তরিক, অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে সে কথা বলছে। ওর মুখে শিবা ডাকটা তার কাছে অত্যন্ত দামি, বুকের মধ্যে গরম লোহার শিকের মতো সেঁধিয়ে যায়। ওই ডাকে, অনেকটা মায়ের চোখে দেখা জীবনের প্রথম ভয়টাই তাকে পাইয়ে দেয়। সে জানে ননী অতি সরল, অতি সৎ। সব বিরোধিতা এদের কাছে নুয়ে পড়ে। মুখটা নামিয়ে শিবা বলল, চল, দেরি হয়ে যাচ্ছে।
.
০৪.
দেবদাস পাঠক রোডে বটকেষ্টর চায়ের দোকানে এক সময় শিবা কাজ করত। রাতে বাড়ি না ফিরে সে দোকানেই ঘুমোত। ভোরে উনুন ধরানো থেকে রাত প্রায়। দশটা পর্যন্ত প্রধানত খদ্দেরদের চা দেওয়াই তার কাজ। অবশ্য, তারই ফাঁকে ওমলেট, টোস্ট আর ঘুগনিও সরবরাহ করতে হয়। দোকানে দোকানে চা দিয়ে আসার জন্য পাঁচ আঙুলে পাঁচটা গ্লাস ধরে ঘণ্টায় ঘণ্টায় তাকে বেরোতে হলেই। ভবানীসারের কোচিংয়ে একবার তখন উঁকি দিত।
যতীন্দ্রকিশোর হাই স্কুলে ক্লাস সেভেনে শিবা চার মাস পড়ার পর মাইনে বাকি পড়ায় নাম কাটা যায়। পূর্বপল্লির শচীন বটকেষ্টর দোকানের রাঁধুনি। শিবাকে সে-ই কাজটা জুটিয়ে দেয়। দুবেলা ভাত আর কুড়ি টাকা বেতন। প্রথমদিকে সে রাত্রে বাড়ি ফিরে যেত। কেউটে সাপের তাড়া খাওয়ার পর নিতুই বারণ করে বাড়ি না ফিরতে। মাসে এক দিন যেত বেতনের টাকাটা দাদার হাতে দিয়ে আসার জন্য। দাদা দুটো টাকা তার হাতে দিয়ে বলত, তোর হাতখরচ।
একটা টেবলে মৌরির বাটি আর খাতা নিয়ে বটকেষ্ট বসে থাকে সারাদিন, দুপুরে ঘণ্টা তিনেকের জন্য বাড়ি যায়। কোথায় কটা চা বা ওমলেট যাচ্ছে তাই দেখে আর খাতায় লেখে। কোনও কিছু দিতে দেরি হলে খদ্দেরদের আগে বটকেষ্টই তাড়া লাগায়—শিবা, অ শিবা, আধঘণ্টা আগে যে ক্যাসেটের দোকান দুটো চা বলেছে অথবা ডাক্তারবাবু যে মামলেট চাইল, কখন দিয়ে আসবি? দু-তিন মিনিটকে বটকেষ্ট আধঘণ্টা বলে।
ভবানীসারের সঙ্গে শিবার সম্পর্কটা ছিল একটু অন্যরকমের। শান্ত, নির্বিরোধী, গম্ভীর প্রকৃতির ভবানীচরণ মাইতি পঁচিশ বছর যতীন্দ্রকিশোরে অঙ্কের শিক্ষকতা করছেন। ছোটখাটো শীর্ণ চেহারা, মাথায় টাক, কাচের গ্লাসের তলার মতো চশমার লেন্স দুটি পুরু, চশমা ছাড়া প্রায় অন্ধ। খদ্দর ছাড়া পরেন না। হাঁটেন মিলিটারির মতো থুতনি তুলে, সটান দেহে। বয়স প্রায় পঞ্চাশ।
সকাল-সন্ধ্যায় কয়েকটি ছেলে ও একটি মেয়ে পড়তে আসে। ভবানীসারের কোচিংয়ের খ্যাতি অনেক দূর পর্যন্ত ছড়ানো। সিঁথি, বরানগর, বেলঘরিয়া থেকে পড়ুয়ারা আসে, কিন্তু তিনি দশটির বেশি নেন না। তার মধ্যে দুজনকে পড়ান বিনা দক্ষিণায়, যেহেতু তারা গরিব এবং অঙ্কের মাথাটা দারুণ।
কোচিংয়ের একটি দেয়ালে ব্ল্যাকবোের্ড ঝোলানো। তার ওপরে স্বামী বিবেকানন্দের রঙিন একটি বাঁধানো ছবি। পড়ুয়ারা বসে মেঝেয় শতরঞ্চিতে। শিবা
স্কুলে ভবানীসারের কাছে কখনও পড়েনি। উনি শুধু উঁচু ক্লাসে অঙ্ক এবং প্রয়োজনে ইংরেজি পড়ান।
শিবা বুঝতে পারত না, এই লোকটি কেন তাকে আকর্ষণ করে। রাশভারী, কম কথা বলা, গম্ভীর, কিন্তু একটা ছেলেমানুষিও আছে। কোচিংঘরের পাশের দরজা দিয়ে তিন হাত গলিতে বেরিয়ে পেছনে গেলেই সারের সংসার, কোচিংঘর ও সংসারের মধ্যে কোনও দরজা-জানলা নেই, স্ত্রী সুপ্রভা শুধু সেখানে। একমাত্র ছেলেটি পিকনিক করতে গিয়ে পুকুরে ডুবে মারা গেছে। ভবানীসার স্ত্রীকে ভয় পান। সুপ্রভা মুখরা এবং বাজে খরচ একদমই বরদাস্ত করেন না। তাঁর ধারণায়, সকাল-সন্ধ্যা এককাপ করে চা, ব্যস, এর বেশি খাওয়ার দরকার নেই। দুকাপের বেশি হলেই সেটা বাজে খরচের তালিকায় পড়ে, তবে অনেক কাকুতিমিনতির পর সারাদিনে তিন কাপ বরাদ্দ করেছেন। ভবানীসার গঞ্জনাকে ভয় পান। অথচ চা তাঁর কাছে খুবই জরুরি পানীয়। আধঘণ্টা অন্তর গলাটা না ভেজাতে পারলে, অঙ্ক ব্যাপারটা তাঁর কাছে নীরস কিছু সংখ্যা ছাড়া আর কিছু মনে হয় না।
একদিন শিবা চা দিতে ঢুকেছিল কোচিংঘরে। দরজায় দাঁড়িয়ে ভবানীসার তখন কথা বলছিলেন স্ত্রীর সঙ্গে। পড়ুয়াদের জনা দুই সবেমাত্র এসেছে। শিবার হাতে চায়ের গ্লাস দেখে সুপ্রভা ভুরু কুঁচকে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলেন, কী ব্যাপার? চা খাচ্ছ? ফ্যাকাশে মুখে ভবানীসার মাথা নেড়ে বলে ওঠেন, চা খাব আমি! পাগল নাকি! শিবা কোচিংয়ে পড়তে চায়, আমি বলেছি চায়ের দোকানের কাজ ছাড়লে, স্কুলে ভর্তি হলে, তবেই পড়াব। কিন্তু কাজটা ছেড়ে দেওয়াও তো ওর পক্ষে সম্ভব নয়। এখানে-ওখানে দেওয়ার জন্য চা নিয়ে যাতায়াতের পথে রোজই একবার এসে ধরাধরি করে। যত বলি হবে না, স্কুলের ছাত্র ছাড়া পড়াই না, তবু শোনে না। এই দেখো, সকালে একবার এসেছিল, আবার এখন এসেছে। উফ কী যে নাছোড়বান্দা ছেলে। শিবা, বলেছি তো তোমাকে—এখন তুমি যাও, পরে ভেবে দেখব।
শিবা প্রথমে হকচকিয়ে গেছল। কিন্তু ভবানীসারের মতো লোক যখন এইভাবে ঝাড়া মিথ্যা কথা বলে যাচ্ছেন, তখন নিশ্চয় কোনও কারণ আছে। তার প্রাথমিক অনুভূতি বলল—বিপদে পড়েছেন, এখনই সারকে সার্পোট করো।
সঙ্গে সঙ্গে চায়ের গ্লাস সমেত হাত দুটো বুকের কাছে তুলে কাঁচুমাচু মুখে সে বলল, আপনি রোজই বলেন পরে ভেবে দেখব। কিন্তু কখনওই আমার কথা ভাবেন না। তারপর একটু রাগ দেখিয়ে বলল, ঠিক আছে, আমি গরিব, আপনাকে মাইনে দিতে পারব না তাই আমাকে ভর্তি করতে চান না। ঠিক আছে, আর কখনও আপনাকে বলতে আসব না। এই বলেই সে আর দাঁড়িয়ে থাকেনি।
আধঘণ্টা পর বটকেষ্টর দোকানের সামনে এসে ভবানীসার হাতছানি দিয়ে শিবাকে ডাকেন।
তুমি যে এত বুদ্ধিমান, তা তো জানতাম না। খুব বাঁচা বাঁচিয়েছ। ব্যাপারটা কী জানো, পারিবারিক শান্তি বজায় রেখে তো চলতে হবে।ভবানীসার তারপর দৈনিক তিন কাপ বরাদ্দের কথা বলে শিবার কাছে পরামর্শ চেয়েছিলেন, কী করে একটু চা খাওয়া যায় বলো তো?
শিবার পরামর্শ মতোই তিনি প্রতি এক ঘণ্টা অন্তর কোচিংঘরের বাইরে এসে ডান হাতটা তুলে দাঁড়ান, যেভাবে ক্রিকেট আম্পায়াররা আউটের সঙ্কেত দেন। এইভাবে সঙ্কেতের অর্থ: অনর্থ হবে না, চা দিয়ে যাও। শিবাও এক ঘণ্টা অন্তর দোকান থেকে বেরিয়ে প্রায় পঞ্চাশ মিটার দূরে তাকিয়ে দেখে, হাত তুলে কোনও লোক স্ত্রীকে চলাফেরার সময় পেশিগুলো অজগরের মতো ওর শরীরে নড়াচড়া করে। ওর পাশব শরীরে সব থেকে বেমানান মুখটি। গ্রিক দেবতার মতো মুখের আদল, শিশুর মতো চাহনি। বেঁটেখাটো সাধুর ডান পা-টি জন্ম থেকেই একটু ছোট।
এই পাড়ায় সাধু বহুদিন আসেনি, তাই অনেকের চোখ তার দিকে। দোকানে যারা এক গ্লাস চা নিয়ে সারা সন্ধ্যা বসে থাকে, তারা উঠে চলে গেছে। রাস্তা দিয়ে যেতে। যেতে অনেকেই সাধুর দিকে একবার তাকিয়েই চলার বেগ বাড়িয়ে দিচ্ছে। দেবদাস রোডে ছমছমে একটা ভাব।
সাধু আঙুল নেড়ে শিবাকে ডাকে, শুনে যা।
ফ্যালফ্যাল চোখে শিবা শুধু তাকিয়ে থাকে। রোগাটে, লম্বা সাধুর সঙ্গীটি তিরিক্ষে স্বরে বলল, অ্যাই ব্যাটা, শুনতে পাসনি নাকি?
শিবা তাড়াতাড়ি এগিয়ে আসে।
মাস্টারটাকে চা দিতে গেছলি? সাধু শান্ত গলায় জানতে চায়।
হ্যাঁ।
ঘরে এখন কে আছে?
শিবা জবাব দেওয়ার আগেই বটকেষ্ট বলে ওঠে, কে আবার থাকবে, কয়েকটা ছেলে আর একটা মেয়ে…ওরে শিবা যা যা দৌড়ে যা, গ্যারেজে চা দিয়ে আয়।
আঙুলের ডগায় তিনটে গ্লাস ধরে শিবা বেরিয়ে গেল। গ্রেট বেঙ্গল অটো রিপেয়ারিং-এর হেড মেকানিক শ্রীকান্ত দাস ব্যাটারির খোলের ওপর বসে মোটরের চাকায় ব্রেক শু্য লাগাচ্ছে। গ্যারেজের মালিক দুর্লভ চক্রবর্তী আর ঘিয়ে রঙের প্যান্ট ও নীল টি শার্ট পরা, কাঁচাপাকা চুলের কৃষ্ণকায় দোহারা গড়নের একটি লোক দাঁড়িয়ে লক্ষ করছে তার কাজ।
চায়ের গ্লাসে চুমুক দিয়েই শ্রীকান্ত বলল, আহহ্ ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, যা গরম করে নিয়ে আয়। দুর্লভও গ্লাসের চা ফেরত দিল। দুগ্লাস চা ফিরিয়ে এনে শিবা দেখল সাধু ও তার সঙ্গীটি নেই। তার বুকের মধ্যে কেন জানি ছ্যাঁত করে উঠল। ভবানীসারের কোচিংয়ের দিকে তাকিয়ে রাস্তায় ওদের দেখতে পেল না। তা হলে ওরা গেল কোথায়?
চা আবার গরম করে গ্যারেজে পৌঁছে দিয়ে ফেরার সময় তার মনে হল কোচিংটা একবার দেখে এলে কেমন হয়!
তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মুহূর্তটি কখন এসেছিল, এই নিয়ে শিবা পরে যখনই ভেবেছে, ভাবতে ভাবতে সে এই জায়গাটাই পৌঁছেছে। একবার দেখে আসার ইচ্ছাটা তার মনের মধ্যে তৈরি না হলে সেদিন কোচিংঘরের জানলায় এসে দাঁড়াত না। না দাঁড়ালে সে দেখতে পেত না সেই দৃশ্য।
.
০৫.
দুটো আলুর দম, রুটি।
হুকুমের স্বরে কথাটা বলে তোক দুটি দুপা সরে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুরু করল। নিতু দুটো ডিশ ওদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিজের কাজে মন দিল। শিবা বালতি থেকে জল নিয়ে এঁটো ডিশ ধুচ্ছিল। একবার মাত্র তোক দুটির মুখের দিকে তাকাল। নতুন খদ্দের, আগে কখনও এদের সে দেখেনি।
সদর দরজাটা আটকে দিলে বেরোবার আর কোনও রাস্তা নেই। তার আগে টেলিফোন লাইনটা কেটে দেওয়া।
ঘেরাও কদ্দিন চলবে?
যদ্দিন না রিজাইন করবে। আরে বাবা, ইলেকট্রিসিটি বন্ধ, জলের লাইন বন্ধ, বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ। বউ আর একটা বাচ্চা নিয়ে কদিন ঘরে বসে থাকবে? বাচ্চাটাকে খাওয়াতে হবে না?
উদ্ধার করতে পুলিশ এলে, তখন?
আসবে না, ওসব ব্যবস্থা করা আছে। এই বলে লোকটি ঝোল মাখানো পাউরুটি চিবোতে চিবোতে বলল, ঝোলটা বেড়ে করেছে। আর-এক প্লেট খাব।
আমাকেও আর-একটা দিতে বল।
শিবা কথাগুলো শুনল বটে, মাথামুণ্ডু কিছু বুঝল না। আলুর দমের প্রশংসা শুনলে তার ভালই লাগে। লোক দুটো কুলিমজুর ধরনের নয়, কথার উচ্চারণ থেকেই শিবা সেটা বুঝতে পারল।
জুট মিলে রাতের শিফটে কাজ করতে যাওয়ার আগে চা খাচ্ছিল কয়েকজন। একজন নিতুকে বলল, জোনাকিতে লকআউট হচ্ছে, শুনেছ নাকি?
না।
নিতু তার দোকান ছাড়া আর কোনও ব্যাপারে মাথা ঘামায় না, কৌতূহলও দেখায় না। ভোর থেকে রাত, শুধু খেটে যাওয়া। ব্যবসাটা বড় করা ছাড়া তার জীবনে আর কোনও লক্ষ্য নেই। একসময় সে ছোটখাটো একটা কারখানায় কাজ করত। মজুরি আর বোনাস বৃদ্ধি সহ এগারো দফা দাবি নিয়ে যে ধর্মঘট হয়, সে তার অন্যতম নেতা ছিল। সাধুর ছেলেদের দিয়ে পিটিয়ে মালিক গোরাবাবু ধর্মঘট ভেঙে দেয়। ধর্মঘটি নেতাদের বেশিরভাগই বন্ডে সই করে কাজে ফিরে যায়। নিতু যায়নি। শ্রমিক আন্দোলন কথাটা শুনলেই এখন তার ঠোঁট মুচড়ে ওঠে, বিদ্রুপে না ঘৃণায়, সেটা বলা শক্ত।
আমার কানেও অমন একটা কথা এসেছে। আর-একজন বলল, ছেলে বলছিল, ওর এক বন্ধুর কাকা ওখানে কাজ করে, তার কাছেই শুনেছে। মালিক কারখানাটা তুলে দিয়ে ওখানে ফ্ল্যাটবাড়ি বানাবে। কিন্তু ছোকরা ম্যানেজার নাকি বেঁকে বসেছে। বলছে, কারখানা তুলে দেওয়া চলবে না। কোয়ার্টারও সে ছাড়বে না। রগড় জমেছে ভাল। ম্যানেজারের সঙ্গে মালিকের লড়াই বেধে গেছে!
শুনতে শুনতে দুপুরে সেই দুটো লোকের কথোপকথন শিবার মনে পড়ে গেল। তার জ দুটো তখন একবার শুধু কুঁচকে উঠল। রাতে বাড়ি ফেরার সময় সে জোনাকির মোড়ে থমকে দাঁড়াল। প্রায় দুশো মিটার দূরে কারখানার উঁচু পাঁচিল আর টিনের চালার কিছুটা দেখা যাচ্ছে। ভেতরে কাঠের থাম্বায় ইলেকট্রিক বালব জ্বলছে। মানুষজন নেই। রাস্তার দু ধারে একতলা পাকা বাড়ি এবং মাটির বাড়ি। রাস্তায় আলো নেই।
দুদিন পর সকালে শিবা ডেকচি ঘাড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ননীকে খুঁজল। দেখতে না পেয়ে হেঁটেই রওনা দিল। জোনাকির মোড়ের কাছে এসে ওপারের বাস স্টপে চোখ পড়তে তার চলা থেমে গেল।
সেই মেয়েটি, বোধহয় বাসের জন্যই দাঁড়িয়ে। এত সকালে, এখানে! শিবা ইতস্তত করে, কৌতূহল আর না চাপতে পেরে রাস্তা পার হল।
চিনতে পারো?
বড় ডেকচি ঘাড়ে বসানো একটি তরুণ হঠাৎ সামনে এসে হাসিমুখে কথাটা বলায় মেয়েটি প্রথমে থতমত হয়ে পড়ল। চোখ কুঁচকে চেনার চেষ্টা করতে করতে অবশেষে মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল। দুই মুঠো তুলে বলল, বক্সার না?
শিবা মাথা কাত করল, দুদিন আগেও তোমাকে দেখেছি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছ। এখানেই থাকো নাকি?
এখানে দিদি-জামাইবাবু থাকে। এই ভেতর দিকে জোনাকি নামে স্টোভ আর হারিকেনের যে ফ্যাক্টরিটা আছে, দেখেছ কি, জামাইবাবু তার ম্যানেজার। ওদের কোয়ার্টারটা ফ্যাক্টরির মধ্যেই একপাশে।
দেখিনি, তবে জানি ওই রাস্তাটার ভেতর দিকে একটা আছে। শিবা ডেকচিটা ঘাড় বদল করল।
কী আছে এতে?
আলুর দম। দাদা একটা দোকান দিয়েছে ফিডার রোডের মোড়ে, খদ্দের সব পার্কিক্স জুট মিলের। আমি সাহায্য করি দাদাকে। বাড়িতে মা তৈরি করে, এখন আমি নিয়ে যাচ্ছি।
তোমরা তো সেই ভবানীসারের কোচিংয়ের কাছাকাছিই থাকো, না?
হ্যাঁ। তুমি তো আর পড়তে গেলে না।
নাহ। বাবা মারা গেলেন, একটু অসুবিধায় পড়ে গেলাম আমরা, খরচ টরচ কমাতে হল।
একটা শ্যামবাজারগামী বাস এসে দাঁড়াল। দুটো দরজায় যাত্রী ঝুলছে। শিবা বলল, সকালে বাসে খুব ভিড় হয়। আটটায় যাদের হাজিরা, তারা এই সময়ই যায় তো।
মেয়েটা হতাশ চোখে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলল, অসম্ভব। আমার দ্বারা হবে না। কলেজে যেতে আজও দেরি হবে।
এখান থেকে কলেজে যাবে! কোথায় কলেজ?
এখান থেকে প্রথমে যাব বাড়ি, পাইকপাড়ার মোড়ে। চান-খাওয়া সেরে সেখান থেকে মণীন্দ্রচন্দ্র কলেজ।
দিদির বাড়িতে তা হলে বেড়াতে এসেছ?
মেয়েটি হেসে ফেলল। দিদি সবে জডিস থেকে উঠেছে, আবার ওর দুবছরের ছেলেটার হয়েছে জ্বর। জামাইবাবু তো ফ্যাক্টরির নানা গোলমাল নিয়ে সারাদিনই ওখানে। দেখাশোনা, সাহায্য করার জন্য নিজেদের একজন কারও তো থাকা দরকার, তাই আমি আসি, মাও আসে।
আর-একটা বাস এল। এটাতে আরও ভিড়। মেয়েটা এবার ওঠার চেষ্টা করতে দরজার দিকে এগোল। সেই সময় শিবার নজরে এল খালি রিকশা নিয়ে ননী ফিডার রোডের দিকেই চলেছে, বোধহয় তারই সন্ধানে। হর্গের দ্যাবতাদেরও জোটে না এমন খাদ্য ননী হারাতে রাজি নয়।
মেয়েটিকে হাতধরে টেনে শিবা দাঁড় করাল। উঠো না, উঠো না, তোমার যাওয়ার ব্যবস্থা করছি..ননী। শিবা চিৎকার করল, অ্যাই নইই।
মুখ ঘুরিয়ে দেখেই, ব্রেক কষে ননী হাত তুলল। রাস্তা পার হয়ে সে আসামাত্র শিবা বলল, একে এখুনি ডানলপে নিয়ে গিয়ে বাসে তুলে দে। তুমি এর রিকশায় চলে যাও। ডানলপ ব্রিজ থেকে বাস ছাড়ে, বসে যেতে পারবে। ননী ফুল স্পিডে যাবি,…অ্যাঁ! শিবা হতভম্ব হয়ে তাকাল। বরাভয় দানের মতো ননী হাতটা বুকের। কাছে রেখে পাঁচটা আঙুল নাড়াচ্ছে।
বেশি নয়, পাঁচটা। ননীর মুখে বুদ্ধের প্রশান্তি ও সৌম্যতা।
না, না, রিকশা আমার দরকার নেই, পাঁচ টাকা দিয়ে এইটুকু পথ যাওয়ার কোনও মানে হয় না। মেয়েটি শশব্যস্তে বলল।
দাঁড়াও তুমি, ব্যাপারটা টাকার নয়। এই বলে দ্রুতপায়ে শিবা রিকশার কাছে এল। পাঁচ কী রে, অ্যাঁ! চারটে দোব।
উহু, চারটার কাম নয়, পাঁচটা।
এইটুকু তো পথ। শিবা গলা চেপে ধমকাল।
দূরত্বটা তো বড় কথা নয়, দুবার প্যাডেল মাইরলেই তো ডানলপ পৌচায়ে যামু। কামের গুরুত্বটাই হইল আসল কথা। হক্কালবেলায় বিউটিফুল একডা মাইয়ারে রিকশায় একা বসাইয়া বি টি রোড ধইরা যাওয়া…এতে কত যে রিক্স, কত যে ডেঞ্জার, তা…তুমি বুঝবা না..না, না, পাঁচটাই।
ঠিক আছে। দাঁতে দাঁত চেপে শিবা রাজি হল। হাতছানি দিয়ে সে মেয়েটিকে ডেকে এনে বলল, উঠে পড়ো। এর নাম ননী। আমার বন্ধু, উপকার করতে খুব ভালবাসে। সকালে প্রথম প্যাসেঞ্জারের কাছ থেকে ও ভাড়া নেয় না, তাই না রে ননী? ঠিকমতো বাসের সিটে ওকে বসিয়ে দিবি।
দ্যাহো ওস্তাদ, পরশুও শুনচি, অহনও শুইনলাম, ওকে, ওকে কইরা ওনাকে বইলত্যাচ, ক্যান, ওনার কি কোনও নাম নাই? হ্যাঁ দিদি, আপনার নাম কী?।
মিতা, পারমিতা দাস। তোমার নাম তো শুনলামই, আর তোমার নামটাও জানি।
শিবা অবাক হয়ে বলল, জানো! কী করে?
বোম্বাইয়ে, মনে আছে, তোমার লড়াই দেখতে গেছলাম! গ্যালারি থেকে চিকার হচ্ছিল, কিল শিবা, কিল কিল কিল, নকআউট শিবা, নকআউট। তুমি অবশ্য পারোনি।
মিতার কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শিবার মুখ থেকে চোখ সরিয়ে ননী প্যাডেল শুরু করে দিল। সে দেখেছে, শিবার মুখটা যন্ত্রণায় আর লজ্জায় ফ্যাকাশে হয়ে আসছে।
.
তখন সন্ধ্যা নেমেছে। ফিডার রোডের মোড় জমজমাট। রাস্তায় সওদা রাখা ফেরিওলাদের চিৎকার, সাইকেল রিকশার ভেঁপু, আনাজপাতির বাজার থেকে। হাঁকাহাঁকি, এরই মাঝে খিদে পাওয়া মানুষদের তাড়া। শিবা আর নিতুর দম ফেলার সময় নেই। তারই মধ্যে শিবা দেখতে পেল মিতাকে।
বিভ্রান্তের মতো ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে এপার-ওধার তাকাচ্ছে। দুচোখে উদ্বেগ। শিবা হাত তুলল, যদি দেখতে পায়। পায়নি, তবে দাঁড়িয়ে থাকা এক চানামটরওলার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করছে। শিবা নিশ্চিত, তাকেই খুঁজছে, নয়তো এখানে ওর আসার আর কোনও কারণ তো থাকতে পারে না।
এই যে, তোমাকেই খুঁজছি শিবা, ভীষণ বিপদে পড়ে গেছি। ননী বলেছিল কোনও দরকার টরকার হলে তোমাকে বলতে। মিতা নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে, পারছে না। দিদি, জামাইবাবু ওদের বাচ্চাটা…।
কী হয়েছে? শিবা হাত ধরে মিতাকে সরিয়ে আনল দোকানের সামনে থেকে। নিতু অবাক হয়ে দেখছে।
কোয়ার্টারে ওদের আটকে রেখে দিয়েছে, ঘেরাও, ধর্মঘট, অবরোধ যাই বলো না কেন, স্রেফ বন্দি হয়ে আছে। টেলিফোন লাইন কেটে দিয়েছে। কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না, বেরোতেও না। বিকেলে এসে ঢুকতে গিয়ে ফ্যাক্টরির গেটেই ওরা আমায় আটকে দিল।
ওরা কারা?
যারা দুপুর থেকে ধর্মঘট শুরু করে গেটের সামনে বসে পড়েছে। আমার পক্ষে তো কাউকেই চেনা সম্ভব নয়। একজন আমার দিকে তেড়ে এসে বলল, মালিকের দালালকে তো বটেই, তার আত্মীয়-স্বজনকেও ধোলাই দেওয়া হবে। ওখানেই শুনলাম, যতক্ষণ না জামাইবাবু রেজিগনেশন লেটারে সই করছে, ততক্ষণ কোয়ার্টারের মধ্যে ফ্যামিলি সমেত তাকে আটকে রাখা হবে, বাইরের সঙ্গে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া হবে। টেলিফোন, ইলেকট্রিক, জল, সব কিছুর কানেকশন কাট-অফ করে দেবে। রেশন, ওষুধ, দুধ, এসব কিছুই পাবে না। খাবার জলটুকুও না। শিবা, তা হলে ওরা বাঁচবে কী করে, ওরা তো মরে যাবে! মিতা দুহাতের মুঠো ঝাঁকাল। তার চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসার মতো অবস্থায়।
আগে তুমি একটু শান্ত হয়ে দাঁড়াও দেখি। হাতের কাজ সেরে নিই। শিবাকে বিচলিত দেখাল। দুদিন আগে দুটো লোক খেতে খেতে যা বলছিল, সেই কথাগুলোই তো ঘটেছে।
এইসব শুনে কি কেউ শান্ত থাকতে পারে? আমি পেট্রল পাম্প থেকে কোয়ার্টারে টেলিফোন করি, লাইন ডেড। ভাবছি থানায় যাব।
যেতে পারো, কিন্তু কোনও কাজ হবে না। পুলিশ তোমার জামাইবাবুকে উদ্ধার করতে যাবে না, ব্যবস্থা করা আছে।
বলছ কী!
শিবা জবাব না দিয়ে নিতুর কাছে এল। দাদা, এর নাম মিতা। ভবানীসারের কোচিংয়ে পড়ত। ওর জামাইবাবু জোনাকির ম্যানেজার। আজ দুপুর থেকে তাকে ফ্যামিলি সমেত কোয়ার্টারে আটকে রেখে ধর্মঘট শুরু করেছে। আমি একটু দেখে আসব ব্যাপারটা, তুমি ততক্ষণ চালিয়ে নিয়ো।
ধর্মঘট! তুই কী করবি ওখানে? ও তো আপনিই ভেঙে যাবে—তোকে আর ঝামেলায় জড়াতে হবে না। নিতু বিরক্ত স্বরে ভাইকে বারণ করল।
তবু একবার দেখে আসি। একটা দুবছরের ছেলে বন্দি থাকবে, দুধ পাবে না, জল পাবে না, তা কি হতে পারে!
বসার টুলটা মিতার সামনে রেখে শিবা বলল, তুমি এখন বসে থাকো। জোনাকি থেকে আমি একবার ঘুরে আসি, কোয়ার্টারটা কোথায়?
গেট দিয়ে ঢুকে বাঁ দিকে একটা ফাঁকা জমির পরেই একতলা গোলাপি রঙের বাড়ি। বেরোবার একটাই দরজা। গেটের কাছ থেকে দেখা যায়। আমি দেখেছি, গোটাকতক লোক কোয়ার্টারের সামনে হাত তুলে তুলে স্লোগান দিচ্ছে।
কিছুক্ষণ পরে শিবা ঢিলেঢালা ভঙ্গিতে হাঁটতে হাঁটতে জোনাকির গেটের কাছে পৌঁছল। জনা পঁচিশ লোক সেখানে। গেটের সামনে চৌকি। তার পেছনে লাল শালুর কাপড়ে শ্রমিক ইউনিয়নের নাম লেখা। খুঁটিয়ে সে লোকগুলির মুখ দেখল, কিন্তু একজনকেও তার চেনা লাগল না। পরিবেশটা শান্ত, ধর্মঘট হলে যে চাঞ্চল্য উত্তেজনা থাকে, তার কিছুই নেই। পাঁচিলের গায়ে হাতে-লেখা কয়েকটা পোস্টার। অনেকেই ভাঁড়ে চা খাচ্ছে। দুটো বড় বালব থেকে আলো ছড়িয়ে রয়েছে।
শিবা গেট পর্যন্ত চলে গেল। কেউ তাকে লক্ষ করল না। লোহার চাদরের গেট, পাল্লা দুটো আধ-খোলা। কিছু ধর্মঘটী ভেতরেও রয়েছে। তীক্ষ্ণ নজরে সে বাঁ দিকটায় চোখ পাঠাল। কাঠের থাম্বায় ফ্যাক্টরির ইলেকট্রিক আলো জ্বলছে। ফাঁকা জায়গায় বড় বড় ঘাস, কিছু ভাঙা প্যাকিং বাক্সের কাঠ, টিনের স্ক্র্যাপ, তার পেছনে একতলা আবছা একটা বাড়ি। জানলাগুলো বন্ধ, সদর দরজাটাও। বাড়ির মধ্যে কোনও আলো জ্বলছে। বলে তার মনে হল না। কয়েকটা লোক বন্ধ দরজার সামনে বসে শালপাতা থেকে কিছু খাচ্ছে। বাড়ির পেছন দিকে কী রয়েছে বোঝা গেল না। দেড় মানুষ সমান উঁচু পাঁচিল দিয়ে ফ্যাক্টরি এলাকাটা ঘেরা। পাঁচিলের ধারে গোটা পাঁচেক কৃষ্ণচূড়া গাছ।
অ্যাই এখানে কী চাই, য়্যা? ভেতরে কী দেখছ? চৌকিতে আধশোয়া একটি লোক চোখ কুঁচকে কর্কশ স্বরে বলল।
ননীকে খুঁজছি। শিবার নিরীহ মুখ থেকে ব্যস্ত স্বরে কথা বেরোল।
কে ননী? কোথায় কাজ করে?
কোথায় করে! শিবা ফাঁপরে পড়ল বটে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে একটা স্টোভকে সে মনে মনে দেখে নিল।
বলেছিল রঙের কাজ করে। আলুর দম আর রুটির দাম পাব, মাসকাবারে দেবে বলেছিল। ধর্মঘট চললে তো আমার টাকা—হ্যাঁ দাদা কদ্দিন চলবে বলতে পারেন? শিবার মুখে দুর্ভাবনা ছড়িয়ে পড়ল।
লোকটির চোখ এবার স্বাভাবিক হয়ে এল। কত টাকা খেয়েছে? দেখতে কেমন?
সাতাশ টাকার। দেখতে খুব রোগা, কালো, আমার মতোই লম্বা। একটা গেঞ্জি পরে, তার বুকে লেখা—আই লাভ ইউ।
লোকটা খিকখিক করে হেসে উঠল। ভালবাসে যখন, ও টাকা মার যাবে না, দুদিন পরে এসে খোঁজ নিয়ো।
তখন ফ্যাক্টরি খুলে যাবে?
তা আমি কী করে বলব। সবই নির্ভর করছে ওদের মরজির ওপর। দাবিগুলো মেনে নিলে আমরাও ধর্মঘট তুলে নেব।
দাবি নিয়ে কী কথা হচ্ছে তুলসীদা? এগিয়ে এল এক গাঁটাগোট্টা অল্পবয়সি, বুকে পিন দিয়ে আঁটা কাগজের ব্যাজ। শিবার মনে হল, একে কোথায় যেন সে দেখেছে। মনে মনে সে খোঁজাখুঁজি শুরু করল। আলো আজ বন্ধ হয়েছে, কাল জলও বন্ধ হবে। কার মরজির ওপর দাবি মেটানো হবে সেটা কি অন্য লোক ঠিক করে দেবে? হাতের খেটোটা তক্তায় ঠুকে লোকটা কটমটিয়ে এবার শিবার দিকে। তাকাল। আমরা ঠিক করে দেব।
এবার শিবার নজরে পড়ল দুহাত করে লম্বা কয়েকটা ঘেঁটো আর লোহার রড চৌকির পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা। দুটো লোক ফ্যাক্টরির ভেতর থেকে বেরিয়ে এল।
একটা শতরঞ্চি কি মাদুর হবে তুলসীদা?
কেন, ঘুমোবি নাকি? বুকে ব্যাজ আটা বলল। কথা বলার ভঙ্গিটা শিবাকে মনে পড়িয়ে দিল একে সে দেখেছে ছায়াবাণী সিনেমা হলের সামনে। লোকটা টিকিট কালোবাজারিদের সর্দার।
ঘুমোব না তো কী! সারারাত জেগে বসে থাকার দরকার কী? সদর দরজাটায় তালা মেরে দিয়েছি, বেরোবার আর তো পথ নেই।
অ্যাই তোমার আর কী এখানে দরকার, যাও, যাও, কেটে পড়ো। ননীটনি বলে এখানে কেউ নেই। তুলসীদা উঠে বসল।
অনিচ্ছুক পায়ে ফিরে যেতে যেতে শিবা বলল, তা হলে কাল সকালে একবার আসব।
তাই এসো।
সাইকেলে রিকশায় বসে ছিল ননী। শিবাকে দেখে নেমে পড়ল।
বুইজল্যা শুইনল্যা কী, ব্যাপারডা ক্যামন ঠ্যাকল?
বলছি। মিতা বাড়ি চলে গেছে?
হ। বাসে তুইল্যা দিয়ে কইয়া দিচি, দুজনায় মিল্যা রাত্রে ভাবনাচিন্তা কইর্যা একডা উপায় বাইর করবই। কাইল হয়ালে ভবানীছারের কোচিংয়ে যেন আসে।
শিবা রিকশায় উঠে বসে বলল, চল, যেতে যেতে বলছি। একটা প্ল্যান করতে হবে। ননী তুই এখানকার পথগুলো সব চিনিস? জোনাকির পেছন দিকে পাঁচিলের ধার দিয়ে রাস্তাটা কোথায় গেছে জানিস?
সব জানি না, তয় কিছু কিছু জানি।
দাঁড়া, দাঁড়া, এটা কিছু কিছু জানলে হবে না, ভাল করে জানা চাই। এখুনি তুই একটা চক্কোর দিয়ে ঘুরে দেখে আয় তো, পেছন দিয়ে বি টি রোডে বেরোবার কোনও পথ আছে কি না। আমি ওদের সামনে দিয়ে এখন যাব না, তুই যা।
ওস্তাদ, তোমার মতলব কী?
বলছি। ভেতর থেকে কৃষ্ণচূড়া গাছের কোনও ডাল পাঁচিলের বাইরে বেরিয়ে আছে কি না দেখছি। গেটের সামনে দুটো বালব ছাড়া বাইরে সব অন্ধকার, তবু। দেখবি রাস্তায় আলোটালো আছে কি না। যা, চট করে ঘুরে আয়, আমি এখানে। দাঁড়িয়ে আছি। তারপর গ্যারেজে যাব, ওখানে মোটা মোটা দড়ি দেখেছি একধারে। পড়ে আছে। হাত পাঁচেক লম্বা একটা নিতে হবে। তারপর—।