Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » শিকড়ের খোঁজে || Mallik Kumar Saha

শিকড়ের খোঁজে || Mallik Kumar Saha

শিকড়ের খোঁজে

আসা যাওয়া দুই ঘন্টার পথ। বৃদ্ধা মাতা মায়াদেবী ও দশ বছরের পুত্র বাদলকে সঙ্গে লইয়া মাধববাবু হাটিয়া রওনা দিলেন দরগার মেলার উদ্দেশ্যে। মটর গাড়ীর আশায় থাকিলে বৈকাল হইয়া যাইবে। তাই কষ্ট করিয়া হইলেও মধ্যাহ্নের পূর্বেই সেইখানে উপস্থিত হইতে পারিলে পবিত্র বেদীতে অর্ঘ্য নিবেদন সহজ হইবে। অন্যথা লম্বা লাইন-এ দাঁড়াইয়া প্রহর কাটাইতে হইবে। কিছুটা পাকা সড়ক থাকিলেও বাকীটা পাথর ও কাঁচা মাটিতে ঠাসা। মাকে লইয়া হন্‌হন্ করিয়া হাটিয়া যাওয়া প্রায় অসম্ভব। একদিকে যেমন মাথার উপর সূর্যের প্রখর উত্তাপ আবার একটু অমনোযোগী হইলেই পায়ে চোখা পাথর ফুটিবার ভয়। তার মধ্যে গাছের ছায়ায় দুইতিন জায়গায় একটু বসিয়া বিশ্রাম না লইলে শরীর যে আর চলিবে না।

বৈশাখ মাসের প্রথম রবিবার ছাড়িয়া দিয়া পরপর তিন রবিবারে এই মেলা হইয়া থাকে। পীরবাবা শাহকামাল বাবাজীর দরগার প্রতি হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের এক আস্থা জড়াইয়া আছে। প্রায় ষাটটি সিঁড়ি আরোহন করিয়া ছোট্ট এক মালভূমির উপর প্রকৃতির অপূর্ব সৌন্দর্যে বেষ্টিত আস্থার এই কেন্দ্রটি। ইহার পশ্চাৎ ভাগে পাকা বেদীতে বেষ্টিত আছে শিববেশে এক প্রস্তরখন্ড। হিন্দুপ্ৰাণা ভক্তবৃন্দ ইহাতে দুধকলা, ধূপকাঠি, মোমবাতী অর্পণ করিয়া মাথা টেকিয়া থাকেন। বৃদ্ধা মায়াদেবী এই সুদীর্ঘ তিন মাইল পাহাড়ী পথ অতিক্রম করিয়া দরগার পাদদেশে এক প্রস্ফুটিত মনোহর পদ্মফুলের সরোবরের ধারে আসিয়া স্বহস্তে কয়েকটি পদ্মপত্র ছিড়িয়া তাহাদের একটিতে নৈবেদ্য সাজাইয়া গঙ্গাকে অর্পণ করিয়া কিছুক্ষণ ইষ্ট দেবতার নিকট প্রার্থনা জানাইলেন। তারপর ধীরে ধীরে সিঁড়ি উঠিয়া সেই পবিত্র দরগাতে অর্ঘ্য নিবেদন করিয়া উহার চারিদিক প্রদক্ষিণ করিয়া শিবলিঙ্গটিকে প্রণাম করিলেন।

মধ্যাহ্ন হইয়া আসিলে মায়াদেবী পুত্র ও নাতীকে লইয়া অনতিদূরে এক আম্রবৃক্ষের নীচে পদ্মপত্র বিছাইয়া তাহাতে গুর, মুড়ি, দুগ্ধ ও কলা মিশ্রণ করিয়া তিনজনে ভোজন সাড়িয়া লইল। ইতোমধ্যে পাহাড়ের গা জড়াইয়া অগনিত লোকের ভীড় জমিয়া স্থানটিকে কোলাহলময় করিয়া তুলিল। তন্মধ্যে বহুসংখ্যক সাধু ও ফকির আধ্যাত্মিক জ্ঞানের বিষয় লইয়া গান বাঁধিয়াছে। এহেন ভক্তি ও জ্ঞানের দুর্লভ মিলন এই তীর্থক্ষেত্রকে স্বাভাবিকভাবেই আকর্ষণের প্রাণকেন্দ্র করিয়াছে। এই টিলার পশ্চিম পারে আছে এক বিস্তর খাই, যাহার নিম্নভাগে অনুরূপ সহস্র লোকের ভীড় জমিয়াছে। এই দুই ভূমি খন্ডকে একদা জিঞ্জিরাম নদী পৃথক করিয়া রাখিয়াছিল বটে কিন্তু আজ তাহার বক্ষদেশ পলিমাটিতে পূর্ণ এবং প্রচন্ড খড়ায় ফাটল ধরিয়াছে। নয়ন ভরিয়া সেই ভূভাগকে উপভোগ করা যায়, কিন্তু তাহাতে পা রাখিবার অনুমতিটুকু পর্যন্ত নাই। মাঝে এক সুদৃঢ় কাঁটা তারের বেড়া গড়িয়া মায়াদেবীর হৃদয়কে দুইকুলে ভাগ করিয়া দিয়াছে— একুল আর ওকূল।

দীর্ঘ ত্রিশ বৎসর পার হইয়াছে দেশ ত্যাগের। মায়াদেবী আজ পর্যন্ত সেই দেশের মায়া কাটাইয়া উঠিতে পারে নাই। হঠাৎ পুত্রের হাতটি চাপিয়া ধরিয়া বলিল, “হ্যাঁ রে মাধব, আমারে একবার দেশের বাড়ী লইয়া যাইতে পারবি? কতকাল হইয়া গেল পূর্বপুরুষের ভিটা মাটিতে পা পরে নাই। গেরামটারে দেখতে না পাইয়া আমার মনের অবস্থা ঐ শুকনা নদীর চড়ের মতো চড়চড় হইয়া গেছে। পোদ্দার গো দালান বাড়ী, দুগ্‌গা মণ্ডপ, সাহেব বাড়ী, কুমোদিনী হাসপাতালের চত্ত্বর, মহাদেব বাড়ী, বালিয়াটির জমিদার বাড়ী— এই সকলের কথা কেমন কইরা ভুলুম। একবার আমারে ঐ দেশের বাড়ী রাইখা আয়, আমি সকলের লগে বইসা দুইদণ্ড প্রাণ ভইরা কথা কই।”

এই সকল ভাবনা যে শুধু মায়াদেবীর মনে ভাসিত তাহা নহে, মাধবের মনেও একই বীণার তান বাজিয়া উঠিত। বাল্যকালে সকাল বেলায় গ্রামের সঙ্গীদের সঙ্গে লইয়া খালি পায়ে কাঁদা মাটিতে পূর্ণ কয়েক মাইল পথ হাটিয়া ‘ভাতগ্রাম স্কুলে যাইবার উৎসাহ, ছুটির পথে হলুদ সাগরে ভাসা চাষাদের সরিষার ক্ষেত হইতে ফুল তুলিয়া আনা, স্কুল বন্ধের দিনে বন্ধুদের সঙ্গে বরশি লইয়া নদীতে মাছ ধরিবার আনন্দ অনুরূপভাবে স্মৃতির পাতায় ভাসে। মাধব মায়ের পানে চাহিয়া বলিল, “ইচ্ছা তো আমারও হয় যে দেশের মাটি একবার হইলেও দেখে আসি । কিন্তু উপায় করা যে বড় কঠিন। কাগজপত্রের বড় ঝামেলা। সীমানার কড়া সুরক্ষা এড়িয়ে দেশের বাড়ী পৌঁছান এক প্রকার অসম্ভব।”

মায়াদেবী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিল, “সকলই বুঝলাম, প্রাণ থাকতে দেশের বাড়ী আর যাওয়া হইব না । আচ্ছা মাধব, ঐ পারের লোকেরাও কি এই পারে আসতে পারব না ? এই পারে আহনের লাইগে তা গো মন কি পুড়ে না ? “

মাধব মায়ের সবরকম প্রশ্নের উত্তর দিয়া মাকে শান্ত করিলেন। তবুও দুইজনের মনের আশা মনেই সুপ্ত হইয়া রহিল।

কয়েকদশক কাল অতীত হইয়া গেলেও মায়ের শেষ স্বপ্নটি অপূর্ণই রহিয়া গেল। তিনি স্বর্গবাসী হইলেন। মায়ের স্বপ্ন অনুধাবন করিয়া মাধববাবু নিজেও আশি বৎসরে পা রাখিলেন। নিস্তেজ শরীরে তাহার দুই চোখের স্বপ্ন ধূসর বর্ণের রূপ নিল। সেই দিনের ছোট্ট বাদল আজ স্বাবলম্বী হইয়া একদিন বাবাকে বলিল, “চল না বাবা, তোমাদের দেশের বাড়ী ঘুরে আসি। সেই ছোটবেলা থেকে কতই না গল্প শুনেছি—

মাধববাবু বলে উঠলেন, “এই অচল শরীরে আমার আর কোথাও যাওয়া সম্ভব হয়ে উঠবে না। চোখের দৃষ্টিও ঝাপসা হয়ে গেছে। তুমি বরং ঘুরে এসে আমাকে গল্প শুনিও। এতদিন তোমাকে শুনিয়েছি— একবার নাহয় তোমার মুখেই শুনলাম!” বহু প্রতীক্ষার পর একদিন বাদল ভারতবর্ষের সীমানা পার করিয়া মীর্জাপুর সপ্তপুরুষের ভিটায় আসিয়া উপস্থিত। কাকীমা ও ভাইদের আপ্যায়নে সাত পুরুষের মাটি অত্যধিক আপন বলিয়া মনে হইল। ক্ষণকালেই পরিজনেরা বাদলকে ঘিরিয়া আহ্লাদ সাগরে ভাসিল।

জায়গাটি নূতন হইলেও বাদলের কাছে একেবারে অচেনা বলিয়া মনে হইল না। পোদ্দার বাড়ী, সাহেব বাড়ীর নাম ঠাকুরমার মুখে সে বহুবার শুনিয়াছে। আজ চোখের সম্মুখে জীবন্ত পাইয়া কল্পনার বাঁধ ভাঙ্গিয়া বাস্তবতার প্রজ্জ্বলিত প্রদীপ দীপ্তমান। স্বর্ণ ও রোপ্য নির্মিত অলংকারে আভূষিতা মা দুর্গার পবিত্র মণ্ডপ, যাত্রা গানের উদ্দেশ্য কল্পে তৈরী সুবৃহৎ প্রাঙ্গন ও সুবিশাল সজ্জাগৃহ, অতিযত্নে সংরক্ষিত বাইচ খেলার সুবৃহৎ নৌকা ও ধামরার পবিত্র রথ, রণদা প্রসাদ নাট মন্দির — একে একে সকলই ঠাকুরমা বর্ণিত অবিকল রূপ চক্ষুপাণে ধরা দিল। ভারী বর্ষায় নদী ভরিয়া গেলে পারাবারের সুবিধার্থে ঘাটপারে ছোট্ট ডিঙ্গাটি আজও অতিযত্নে বাঁধা পড়িয়া আছে। আধুনিক চিকিৎসার প্রতীক হিসাবে খেয়া পারের সুপ্রষ্ঠিত “কুমোদিনী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র” আজও বীরের মতো অহরহ দুঃস্থ রোগীর সেবায় চিরসচেতন।

গুটি গুটি পায়ে গ্রামের কচি কচি ছেলে মেয়েরা দক্ষিণ দিকের আঁকা বাঁকা পথে সরিসা ক্ষেত্রের ভিতর দিয়া যে স্কুলে পড়িতে যায় সেই সরিষাদাইর প্রাথমিক বিদ্যালয়টিতে ছিল মাধববাবুর হাতে খড়ি। সরিষা ফুলের বাগানে যেমন মৌমাছিরা গুঞ্জন রবে মধু খাইয়া থাকে, মাধববাবুও এই বিদ্যালয়ে বিদ্যারূপ মধু পান করিয়াছে ।

এক সকাল বেলায় একজন প্রৌঢ়া বাড়ীর উঠানে আসিয়া বাদলের খোঁজে হাক ছাড়িলে সে ঘর হইতে বাহির হইয়া তাহার সম্মুখে উপস্থিত হইল। বৃদ্ধার বয়স যে সাত দশক পার হইয়াছে তাহাতে ভুল নাই। বয়সের ছাপ পড়িয়া মুখের চামড়া খানিকটা কুচকাইয়া গেলেও কোমরটি এখনও বেশ সোজা এবং চোখে চশমার দরকার হয় নাই। বৃদ্ধা বাদলের মুখে স্থির দৃষ্টি রাখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমিই আমাগো হেই মাধবের পুলা? কতকাল পার হইয়া গেছে, এতদিন পরে দেশের বাড়ীর কথা মনে হইল? বাপের শরীর কেমন আছে? চলাফেরা করিতে পারে?”

বাদলের মুখে সকল প্রকার উত্তর শুনিয়া বৃদ্ধা বেশ খুশিই হইলেন বটে। কিন্তু খুব সহজে তাহাকে ছাড়িয়াও দিলেন না। একটু হাসিয়া বলিলেন, “সম্পর্কে আমি তোমার ‘মঙ্গলী’ পিসি হই। বাপেরে যাইয়া কইও ‘মুংলা’ পিসির কথা। তোমার বাপে আমারে ‘মুংলা’ বইলা খেপাইত।” শাড়ীর আচলে যেভাবে টাকা পয়সা বাঁধিয়া রাখা হয়, তেমনি আজ সাত দশকের প্রৌঢ়া ছেলেবেলার সেই কথাগুলি বাদলকে বলিবার জন্যই হয়তো মনের কোন গোপন কোটরে অতি যত্ন করিয়া রাখিয়াছিল।

দুপুর গড়াইয়া আসিলেও পাড়া পরসির বাড়ী যাওয়া বন্ধ হইল না। সকল গৃহের দ্বার যেন বাদলের অপেক্ষায় উন্মুক্ত ছিল। খোলাদ্বারে খোলামনে অতীতের সহিত নবীনের যে আত্মীয়তার মেল বন্ধন ঘটিল তাহা যে কখনও ভুলিবার কথা নয়। বাদল বুঝিতে পারিল কেনই বা তাহার ঠাকুরমা ও বাবা দেশের মাটির গন্ধ ভুলিতে পারে নাই। চোখেও ঠাকুরমার মনের স্মৃতিতে সবকিছুই ছিল স্পষ্ট। বাহ্যিক আড়ম্বরটুকু বিশেষভাবে প্রকাশ না পাইলেও দুই দেশের আত্মীক সম্পর্কের শিকড় অতিশয় দৃঢ়।

স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করিয়া বাবার কাছে বসিয়া সকল কিছু অবিকল ভাবে তুলিয়া ধরায় তাহার বৃদ্ধ দুই চোখের কোণে দুইফোঁটা অশ্রু চলিয়া আসিল। বাদল বাবার হাতে কাগজে মোড়ানো কিছু উপহার দিয়া বলিল, “বাবা নিজের হাতেই খুলে দেখ। তোমার জন্যই এনেছি।”

কোন কথা না বলিয়া মাধববাবু ধীরে ধীরে কাগজের পোটলা খুলিয়া দেখিতে পাইলেন ‘একমুঠ মাটি’। আশ্চর্য হইয়া বলিলেন, “এ যে দেখছি মাটি।” বাদল বলিল, “সাতপুরুষের ভিটের এক মুঠো মাটি।”

স্তম্ভিত মাধববাবু কিছুক্ষণ সেই মাটির দিকে স্থির দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিলেন।চোখের পলক পড়িল না।তারপর সেই মাটির এক চিমটি তুলিয়া লইয়া নিজ কপালে তিলক কাটিলেন। সঙ্গে সঙ্গে দুই চক্ষু বাহিয়া অনর্গল অশ্রু ঝড়িতে লাগিল। বুঝিলেন,শৈশবের লীলাভূমির এই স্পর্শটুকুই তাহার শেষ স্পর্শ ! তিনি মুখ তুলিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ” হ্যাঁ রে বাদল,আর কি পেলি শিকড় খুঁড়ে ?”

বাদল বলিল, ” আত্মীয়তার সুমিষ্ট গন্ধ! “

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *