অভিজিৎ
রিকশায় ফিরতে ফিরতে গণেশকাকা আমাকে স্তোকবাক্য শোনাচ্ছিলেন, ইস্কুলে একটা গণ্ডগোল চলছে। পুরনো হেডমিসট্রেস নাকি রিজাইন করবে। যদি করে তবে হেডমিসট্রেস হবেন অসীমা দিদিমণি। চাকরিটা তোরই হবে। পারিজাতবাবু হচ্ছেন অসীমা দিদিমণির হাতের মুঠোর লোক। ওঁর সঙ্গে বিয়ে কিনা।
আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, অসীমা দিদিমণির বিয়ে নাকি?
হ্যাঁ। সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে।
আমি চুপ করে রইলাম। অসীমা দিদিমণি দেখতে ভাল নয়, বড্ড রোগাও। বিয়ের ব্যাপারে সেটা হয়তো কোনও বাধা হবে না। কিন্তু ভদ্রমহিলার মুখে যে গভীর বিষণ্ণতা সেটা ওর হবু স্বামী সহ্য করবে কী করে!
আমি গণেশকাকাকে বললাম, চাকরি হলে হল, আপনি বেশি ধরাধরি করতে যাবেন না।
গণেশকাকার এই দোষটা আছে। দোকানদারি করে করে কেমন যেন আত্মসম্মানবোধ বিসর্জন দিয়ে বসে আছে। সকলের সঙ্গেই বড্ড বেশি হাত কচলে কথা বলেন। সরকারি অফিসারস্টফিসারদের একেবারে দেবতার মতো খাতির দেন। এতটা বিনয় ব্যক্তিত্বহীনতারই নামান্তর। আর এত সব তেল-টেল দিয়ে চাকরি পেতে আমার ঘেন্না করে।
গণেশকাকা বললেন, আরে যুগটাই তো পড়েছে ওরকম। ধরাধরি না করলে কি কিছু হয়? ধরাধরি, ঘুষ এসবই তো আজকাল আইন হয়ে গেছে।
আমি সন্দিহান হয়ে বললাম, ঘুষও দিচ্ছেন নাকি?
গণেশকাকা অপ্রতিভ হেসে বললেন, আরে না, না। ঘুষ দিতে হয়নি। মাঝে মাঝে একটু দই কি মিষ্টি দিয়ে পয়সা নিইনি আর কি।
কবে দিয়েছেন?
গণেশকাকার একটা সুবিধে,কথা চেপে রাখতে পারেন না। খুব লজ্জা পেয়ে মাথাটাথা চুলকে বললেন, গতকালই দুসের দই আর পঁচিশটা রসগোরা পাঠিয়েছিলাম।
অসীমাদি নিলেন?
নিয়েছে। তবে বলেছে দাম নিতে হবে। তা সে দেখা যাবে। তোর চাকরিটা যদি হয়ে যায় তো ওটুকু খরচ কি আর গায়ে লাগবে?
আমি একটু হেসে বললাম, আমাকে এখানে চাকরিতে ঢুকিয়ে আপনার লাভ কী?
গণেশকাকা এ কথার জবাব দিলেন না। বললেন, পারিজাতবাবুকে হাত করতে পারলে সবচেয়ে ভাল হত। কিন্তু লোকটা মহা ধুরন্ধর।
আমি আর কথা বললাম না। দোকানে নেমে সাইকেলটা নিয়ে শহরে চক্কর দিতে বেরিয়ে পড়লাম। গণেশকাকা মিষ্টি খেয়ে যেতে বললেন। খেলাম না।
এ শহর আমার অনেক দিনের চেনা। রাস্তাগুলো সরু এবং ভাঙা। মলিন ও জীর্ণ সব বাড়িঘর। কোথাও বেশ ঘন কচুবন, আগাছা বা জঙ্গল। সরকারি দফতর কয়েকটা হয়েছে বটে, আর কিছু সরকারি কোয়ার্টার। আর তেমন কোনও উন্নতি বা পরিবর্তন চোখে পড়ে না। যদি চাকরি পাই তা হলে এই শহরে এসে চাকরি করতে আমার কেমন লাগবে? কেমন লাগবে উডুবিতে দাদুর কাছে থাকতে? বোধহয় খুব ভাল লাগবে না।
শহর ছাড়িয়ে আমি গাঁয়ের পথ ধরলাম। জলভারনত মেঘ গুমগুম করছে। চড়াৎ চড়াৎ করে আকাশ ঝলসে দিচ্ছে বিদ্যুৎ। আমি সাইকেলের স্পিড বাড়িয়ে দিলাম। বহুকাল সাইকেল চালিয়ে অভ্যাস নেই। রাস্তাও খারাপ। পায়ের ডিম আর কুঁচকিতে টান লাগছে। তবু বৃষ্টিকে হারিয়ে পৌঁছে গেলাম বাড়িতে। আমি দাওয়ায় উঠতে না উঠতেই ঝপাং করে নেমে এল বিস্ফোরিত মেঘ থেকে জলপ্রপাতের মতো বৃষ্টি।
দাদু দরজা খুলে দিলেন মুখে বিরক্তি নিয়ে।
ঘরে ঢুকতেই বললেন, এখানে কেরোসিন পাওয়া যায় না। বাতিটাতি বেশি জ্বেলল না। রাতেও কি ওবাড়ি খাবে?
আমি সামান্য একটু ভিজেছি। রুমালে মাথা মুছতে মুছতে বললাম, এখন তো সবে সন্ধে। দেখা যাক।
পারুলের মা এসেছিল। বলে গেল তুমি এলেই যেন পাঠিয়ে দিই।
আচ্ছা। দুপুরে একটু ঘুম হয়েছে?
আমার? না, আমার আর ঘুম কই?
জামাকাপড় পাল্টে আমি চৌকিতে বসি। টিনের চালে বৃষ্টির কান ঝালাপালা শব্দ। এক সময়ে হয়তো এই শব্দ আমার প্রিয় ছিল। কিন্তু এখন নেই। এখন ভয় করে। মনে হয়, বুঝি সব ভেঙে পড়ে যাবে।
একটু চায়ের জন্য ভিতরটা আঁকুপাঁকু করছে। কিন্তু দাদুর চায়ের কোনও পাট নেই। পারুলদের বাড়ি গেলে হয়। কিন্তু এই বৃষ্টিতে বেরোলেই ভিজে যাব।
চুপচাপ শুয়ে চোখ বুজে রইলাম। চোখ বুজতেই অসীমা দিদিমণির মুখটা মনে পড়ল। কীসের এত দুঃখ ভদ্রমহিলার? যে লোকটা ওকে বিয়ে করবে সেই পারিজাতই বা কেমন লোক? শুনেছি, লোকটার মেলা টাকা, অনেক ক্ষমতা! সে কেন একে বিয়ে করতে চায়?
হঠাৎ চড়াক করে আর একটা কথা মনে পড়ে গেল। আমাদের ভিটে কিনতে যে লোকটা এসেছিল সেনা পারিজাতবাবুরই লোক।
আমি উঠে দাদুর ঘরে গেলাম।
দাদু একটা কাঁথা চাপা দিয়ে বসে আছেন। ঘরটা অন্ধকার। একটা সরু মোম জ্বলছে কুলুঙ্গিতে। সেই আলোয় দাদু একটা কাগজের পুরিয়া খুলে কী যেন দেখার চেষ্টা করছেন মন দিয়ে।
আচ্ছা দাদু, এই জমিটা যে কিনতে চায় তার নাম পারিজাত না?
হ্যাঁ। কেন?
লোকটা শিবপ্রসাদ স্কুলের সেক্রেটারি।
তা হবে।
সেই স্কুলেই আমার চাকরি হওয়ার কথা চলছে।
দাদু তার পুরিয়া থেকে চোখ না তুলেই বলেন, তাই নাকি? চাকরি কি হয়ে গেছে?
না, কথা চলছে।
দাদু পুরিয়াটার ওপর আরও ঝুঁকে পড়ে বললেন, আগের দিনে আর কোনও চাকরি না হোক মাস্টারিটা পাওয়া যেত। আজকাল শুনি, মাস্টারি পেতেও নাকি অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়।
তুমি কি জমিটা ওকে বেচবে বলে কথা দিয়েছ?
না। তুমিই তো বিকেলে বলে গেলে, এখানে থেকে মাস্টারি করতে তোমার সুবিধে হবে।
আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলি, বলেছিলাম। কিন্তু তখন জানতাম না যে, পারিজাতবাবুই সেক্রেটারি।
দাদু পুরিয়া থেকে চোখ তুলে আমার দিকে চেয়ে বললেন, তাতে তফাতটা কী হল?
ভাবছিলাম পারিজাতবাবুর সঙ্গে একটা ডিল করা যায় কি না।
কীসের ডিল?
ধরো যদি বলা যায় যে, জমিটা তুমি ওঁকেই বেচবে যদি চাকরিটা আমার হয়।
দাদুর চোখে মোমবাতির আলোতেও সন্দেহের ছায়া দেখতে পেলাম। বললেন, তাতে আমার লাভ কী? তোমাকে চাকরি দিলে ও কি বাজার-দরে জমি কিনবে ভেবেছ? এক মোচড়ে দাম অর্ধেকে নামিয়ে দেবে।
তা বটে। আমি হতাশ গলায় বলি।
পারিজাতকে তুমি চেনো না। বরং কাউকে মুরুব্বি ধরো।
ধরাধরি করতে পারব না। তার চেয়ে বিজনেস ডিল করা অনেক সম্মানজনক।
মাইনে কত দেবে খোঁজ করেছ?
না। তবে আজকাল মাস্টারির মাইনে খারাপ নয়।
কত শুনি।
সাত-আটশো হবে।
দাদু চোখ কপালে তুলে বলেন, বলো কী। মাস্টাররা তো তা হলে জাতে উঠে গেছে।
তা উঠেছে। কিন্তু টাকার দাম পড়ে গেছে দাদু।
দাদু একটু চুপ করে থেকে গালের হরতুকি মাড়িতে চিবোলেন। লালায় অনেকক্ষণ ভিজে হরতুকিটার এতক্ষণে কাদার মতো নরম হয়ে যাওয়ার কথা। চিবোতে চিবোতে বললেন, জমি বেচলে তোমার চাকরি হবে। এ বড় অদ্ভুত ব্যবস্থা। চাকরি না হয় হল, কিন্তু আমি থাকব কোথায়?
বাসা ভাড়া নেব।
ফের ভাড়া বাসা? জন্মে ভাড়াটে থাকিনি বাপু, এই শেষ বয়সে পারব না।
ওরা তো বলেছে, আপনি যতদিন বাঁচবেন ততদিন ঘরটুকু আর কুয়োতলা নেবে না।
সেটা কথার কথা। একবার রেজিস্ট্রি হয়ে গেলে তখন কে কার কড়ি ধারে? লোক-লস্কর নিয়ে এসে পাঁজাকোলা করে তুলে বের করে দিলেই বা মারে কে?
লোকটা কি খারাপ নাকি?
ভাল লোক আর কোথায় পাবে একালে? সব পাজি।
আমি একটু দমে গেলাম। বললাম, চাকরি একটা আমার দরকার দাদু। বাড়ির অবস্থা খুব খারাপ।
খারাপ তো হবেই। পেটের ভাতের যোগাড় রেখে তার পরই বাবুগিরি করতে তোমাদের কলকাতায় যাওয়া উচিত ছিল। তা তো করলে না। আমি একা মানুষ, জমি-জিরেত সামলাতে পারলাম না। লোকবল থাকলে আজ খেতের ধান কটা গোলায় ভোলা যেত।
পুরনো তর্ক। এ নিয়ে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। তবে একসময়ে আমি একটা উগ্র রাজনৈতিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে একটা জিনিস শিখেছি। ভূমির সঙ্গে, কর্ষণের সঙ্গে যে-মানুষের গভীর সংযোগ নেই সে কখনও দেশকে ভালবাসতে পারে না।
মউডুবিকে এখন আর গ্রাম বলা ঠিক হবে না। শহরের কাছ-ঘেঁষা গঞ্জ। কিন্তু আমি এমন এমন লক্ষ্মীছাড়া গ্রাম দেখেছি যেখানে পানীয় জল নেই, ডাক্তার ওষুধ হেলথ সেন্টার নেই, রাস্তা নেই, খাবার নেই। কিছু লোক ধুকছে আর ধুকছে। অথচ, গোটা দেশটারই শক্তির উৎস ওই গ্রাম, ওইসব কৃষিক্ষেত্র ও গোচারণভূমি। কিন্তু এই আজব রাজনীতির দেশের শাসকরা যে ডালে বসে আছে সেই ডালটিই বে-খেয়ালে কেটে ফেলছে।
আমি আর দেশোদ্ধারের কথা ভাবি না। এখন আমার সম্মানজনক শর্তে একটা চাকরি চাই।
কড়ে আঙুলের চেয়েও সরু এবং মাত্র দুআঙুল লম্বা একটা মোম আমার হাতে দিয়ে দাদু বললেন, জ্বেলে নাও গে। বর্ষার দিন, পোকামাকড় ঘরে ঢোকে। একটু দেখেশুনে নিয়ে ঘরখানা। কেউ থাকে না, সাপখোপ বাসা করেছে কি না তাই বা কে জানে!
ঘরে এসে মোমটা না জ্বালিয়ে আমি অন্ধকারেই বসে রইলাম। বাইরের মাঠে জল জমে গেছে, বৃষ্টির শব্দ থেকেই বুঝতে পারছি। প্রবল স্বরে ব্যাং ডাকছে। রাত সাড়ে নটার দিকে বৃষ্টি থেমে গেল এবং গণেশকাকা লণ্ঠন হাতে আমাকে নিতে এলেন।
চল, তোর মাসি ভাত নিয়ে বসে আছে।
আমি একটু রাগ করে বললাম, রোজ কি দুবেলাই ওবাড়ি পাত পাড়তে হবে নাকি?
সে তোর মাসির সঙ্গে বোঝ গিয়ে।
জল ভেঙে ছপ ছপ করে হাঁটতে হাঁটতে গণেশকাকা মৃদু স্বরে বললেন, একটা খবর আছে।
কী খবর?
দোকান থেকে আসবার সময় অসীমা দিদিমণির বাড়ি হয়ে এলাম।
আবার গেলেন কেন?
সন্ধেবেলায় যে দুজনে কথা হয় রোজ।
কাদের কথা হয়?
অসীমা দিদিমণি আর পারিজাতবাবুর।
ও আমাকে নিয়েও কথা হয়েছে নাকি?
হয়েছে। তবে জহরবাবুর মেয়ে প্রতিমাও ওই পোস্টের একজন ক্যানডিস্টে। প্রতিমাকেই প্রায় সিলেক্ট করে রেখেছিলেন পারিজাতবাবু। অসীম দিদিমণি তোর কথা বলাতে উনি ভেবে দেখবেন বলেছেন।
তা হলে ভেবে দেখতে থাকুন।
তোকে কাল একবার পারিজাতকার সঙ্গে দেখা করতে হবে।
জহরুবাব কে?
তুই চিনবি না।
খুব নিডি লোক নাকি?
নিডি কে নয় এই বাজারে? যার লাখ টাকা আছে সেও ঘ্যান ঘ্যান করে।
জহরবাবু কি সে ধরনের লোক।
তা বলছি না। ছা-পোষা লোকই। সামান্য মাস-মাইনে, গোটা চারেক মেয়ে।
তা হলে তো মেয়ের চাকরিটা ওঁর দরকার।
তা বটে, তবে তোর দরকার আরও বেশি।
সেও ঠিক কথা। তবু আমি বলব, জহুকুর মেয়ের চাকরি হওয়াটা যদি বেশি দরকার বলে মনে করেন তবে আমি সরে দাঁড়ব।
তোকে বেশি পাকামি করতে হবে না তো।
আমি চুপ করে গেলাম।
.
সারা রাত বৃষ্টি হয়েছে। সকালবেলাটাও মেঘল, স্নান, নিস্তেজ। তবে বৃষ্টি নেই। জলকাদায় রাস্তা প্রায় নিশ্চিহ্ন৷ সেই অদৃশ্য রাস্তায় সাইকেল চালিয়ে শহরে চলেছি। পদে পদে সাইকেল গর্তে পড়ে লাফিয়ে উঠছে। হ্যান্ডেল বেঁকে যা একিলিক। কয়েক জায়গায় রাস্তার ওপর দিয়ে তোড়ে বয়ে যাচ্ছে জল। এত জল কোথা থেকে তো ঠিক বুঝতে পারছি না। রাস্তার দুদিকে মাটি প্রায় দেখাই যাচ্ছেনা। জলে জলময়।
বড় একটা গর্তে পড়ে সাইকেল কাত হয়ে গেল। ঝপ করে আমার পা পড়ল হাঁটুভর ঘোলা জলে। জু রাস্তা আর দূরে নয়। জলে সাইকেল চালানোর ঝুঁকি না নিয়ে আমি সাইকেল ঠেলে নিয়ে বড় রাস্তায় উঠে পড়লাম। দরমার বেড়ওয়ালা দোকানগুলো খুব অল্পই আজ খুলেছে। অন্তত দুটো দোকান মুখ থুবড়ে পড়েছে। কিছু লোক পোটলা-পুঁটলি নিয়ে জড়ো হয়েছে বড় রাস্তার ওপর। দূরে আরও কিছু লোককে জল ভেঙে মার ওপর দিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে। তাদের মাথায় বাক্স-প্যাটরা।
বৃষ্টিটা এবার বেশ জোরালো। আমাদের উঠোন কাল রাত থেকেই জলে ডুবে আছে। সামনের বাগানটুকুতেও ঘাস দেখা যাচ্ছে না।
গণেশকাকার দোকানে পৌঁছোতেই উনি বললেন, দিদিমণির আজ শরীরটা ভাল নেই। খবর পাঠিয়েছেন। তুই একা গিয়ে পারিজাবাবুর সঙ্গে দেখা করতে পারবি না?
আমি একটু হেসে বললাম, পারব না কেন? লোকটা তো আর বাঘ-ভাল্লুক নয়।
গণেকাকা একটা ভাজকরা কাগজ পকেট থেকে বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন, এই হাতচিঠিটা পাঠিয়ে দিয়েছেন অসীমা দিদিমণি। এটা নিয়ে পারিজাতবাবুর হাতে দিস। সিহীৰুদের বাড়ি, চিনিস তো?
চিনি। ফেরার সময় আমার সঙ্গে দেখা করে যাস।
সিংহীবাবুদের বাড়ি আমি শুধু চিনিই নয়, ওবাড়ির একটি ছেলে সুশীলের সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্ব ছিল। পুরো সামন্ততান্ত্রিক পরিবার। এক সময়ে খুবই বড় অবস্থা ছিল। আমরা জ্ঞানবয়সে যখন সিহবাবুদের বাগানে ফল পাড়তে যেতাম তখনই টের পেতাম ওদের অবস্থা পড়তির দিকে। বাড়িতে কলি ফেরানো হয় না, বাগানের শ্রীছদ নেই, চাকরবাকরের সংখ্যা কমে আসছে এবং সিংহীবাড়ির বাবুরা রিক্সা-টিক্সাতেও চড়ছে। আগে ওদের গাড়িটাড়ি ছিল। মন্তু এই বাড়িটার মেরামত এবং রক্ষার খরচ ওরা কুলিয়ে উঠতে পারছিল না। সামন্তদের হটিয়ে অর্থনীতি নিজেদের হাতে নিতে তখন এগিয়ে আসছে নয়া পুঁজিপতিরা। এরা ব্যবসায়ী, ঠিকাদার বা ছোটখাটো শিল্পপতি। সামন্তরা সমাজের অর্থনৈতিক পরিবর্তনের ধরনটা বুঝতে পারেনি। আলস্য, আত্মসুখ ও পরিবেশ-উদাসীন হওয়ায় তাদের পতন অনিবার্য ছিলই। একদল শোষণকারীর হাত থেকে অর্থনীতি গেল অন্য একদল শোষ্ণণকারীর হাতে।
সিংহীবাবুদের বাড়ি এখন পারিজাতবাবু কিনে নিয়েছে। নেওয়াটাই স্বাভাবিক। যতদূর জানি পারিজাতবাবু নয়া ধনতন্ত্রের শরিক। তিনি সিংহী ম্যানসন কেনায় বোধহয় সিংহীবাবুরাও বেঁচেছে। অতবড় জগদল বাড়িটা ছিল তাদের বুকে জগদ্দল এক ভারের মতো।
আমি আশা করেছিলাম নয়া ধনতন্ত্রের এই প্রতিনিধি সিংহীবাড়িকে আবার নতুন করে ঘষে মেজে চকচকে করে তুলেছেন। কিন্তু তা নয়। অবাক হয়ে দেখি বাড়িটা যেমন ছিল তেমনই আছে। বাগান আগাছায় ভর্তি। বাড়ির কলি ফেরানো হয়নি। ফাটা ভাঙা অংশগুলি যেমনকে তেমন রয়ে গেছে। ফটক হা হা করছে খোলা।
ভিতরে মোরামের রাস্তায় পড়তেই ভিতর থেকে দুটো অভিজাত কুকুরের গমগমে ডাক শুনতে পেলাম। একটু ভয় হল, ছাড় নেই তো কুকুর দুটো?
রাস্তার ওপরে এসে পড়েছে কাঞ্চন গাছের শাখাপ্রশাখা। সাদা ফুলে ফেঁপে আছে গাছটা। রাস্তার দুধারে ফুলের কিছু গাছ নজরে পড়ল। ফটক খোলা, গরু ছাগল ঢুকে যেয়ে যেতে পারে তো। নাকি বড়লোকের বাড়িতে ঢুকতে গরু ছাগলও ভয় পায় আজকাল?
গাড়িবারান্দার তলায় সাইকেল থেকে নেমে সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠলাম। কেউ কোথাও নেই। কোনও শব্দও শোনা যাচ্ছে না। শুধু ভিতরবাড়িতে কুকুরের গমগমে গলা আর একবার শোনা গেল।
বড়লোকদের মুখোমুখি হতে আমার কোনও অস্বস্তি কাজ করে না। কারণ আমি এ দেশের বড়লোকদের আকণ্ঠ ঘৃণা করি। একটু নেড়েচেড়ে দেখার জন্য পারিজাতবাবু যে আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন এতে আমি মজাই পাচ্ছি। আমি ওর সামনে অবশ্যই ভাল মানুষ সেজে থাকা এবং শিক্ষকোচিত গুড়ি গুডি আচরণ করব। কিন্তু লোকটা জানবেও না, আমাকে চাকরি দেওয়া মানে নিজের চেয়ারের নীচে একটি টাইম বোমা স্থাপন করা। চাকরি পেলে আমি ধৈর্য ধরে কনফার্মেশন পর্যন্ত অপেক্ষা করব। আর তারপর আমার যাবতীয় শানানো ঘৃণা ও আক্রোশ নানা আন্দোলন, বিক্ষোভ ইত্যাদি হয়ে ফেটে পড়বে। শিবপ্রসাদ হাই স্কুলে গণ্ডগোল চলছে, আমি জানি। কীরকম গণ্ডগোল তা জানি না। আর গণেশকাকার কাছে শুনেছি, পারিজাত লোক ভাল নয়। দাদুও সেই কথাই বলেন। সুতরাং আমার ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা মোটামুটি ঠিকই হয়ে গেছে।
সদর দরজায় খানিকক্ষণ কড়া নাড়লাম। দরজা হাট করে খোলা, কিন্তু লোক নেই। আহাম্মকের মতো দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আর কী করার থাকতে পারে?
খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক চেয়ে দেখতে লাগলাম। বাগানের দক্ষিণ দিকে একটা দোলনা ছিল। লোহার স্ট্যান্ডে লাগানো শেকলের দোলনা। ছেলেবেলায় অনেক চড়েছি সেটায়। এখন আর দোলনাটা নেই। পাথরে তৈরি একটা ছোট্ট ফোয়ারা ছিল গাড়িবারান্দার সামনেই। সেটা আছে বটে, কিন্তু গতানো গাছে এমন ঢেকে গেছে যে, বোঝাই যায় না। উত্তর দিকে একটা কাশীর পেয়ারাগাছ ছিল। কিন্তু বারান্দা থেকে বোঝা গেল না, গাছটা আছে কি নেই। কারণ ওদিকটায় আরও বড় বড় গাছ কয়েকটা হয়েছে।
যুবকের মতো খানিকক্ষণ হা করে এইসব দেখতে দেখতে হঠাৎ পিছনে একটা মৃদু চটির শব্দে মুখ ঘোরালাম। খুব চমকিলি চেহারার একটা মেয়ে। বেশ চটক আছে চেহারায়, যেমনটা বড়লোকদের থাকেই। জন্মগত চেহারা তেমন দেখনসই না হলেও বড়লোকের মেয়েরা সেটাকেই মেজে ঘসে কতটা সুন্দর করে তুলতে পারে।
মেয়েটা আমার দিকে খুব ভ্রু কুঁচকে এবং অবহেলার দৃষ্টিতে তাকাল বলে আমার মনে হল। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করল না। বারান্দা পর্যন্ত এলও না মেয়েটা। বাইরের হলঘর থেকে ডানহাতি আর একটা ঘরে গিয়ে ঢুকল।
আমি একটু বেশি সকালে পৌঁছে গেছি। আর একটু পরে আসাই বোধহয় উচিত ছিল। কিন্তু এরকম হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকাটাও আমার ভাল লাগার কথা নয়।
আমি সোজা হলঘরে ঢুকে পড়লাম এবং মেয়েটা যে ঘরে ঢুকেছে সেই ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বললাম, শুনছেন?
মেয়েটা একটা ডেসকের ড্রয়ার খুলে নিচু হয়ে কিছু একটা দেখছিল। সেই অবস্থাতেই আমার দিকে একটা তীক্ষ্ণ চাউনি ছুঁড়ে দিয়ে বলল, দাদা এখনও ফেরেনি। বারান্দায় বেঞ্চ আছে, অপেক্ষা করুন।
আমার একটু রাগ হল। তা গরিবদের তো চট করে রাগ হয়েই থাকে। সেটা চাপা দিয়ে বললাম, উনি কোথায় গেছেন?
মর্নিং ওয়াক করতে।
কখন ফিরবেন তার কি কোনও ঠিক নেই?
আমি অত জানি না। দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করতে পারেন।
মেয়েটার কথাবার্তা অভদ্র, আচরণে অহংকার। আমি বললাম, দারোয়ানকে তো দেখলাম না।
আছে। খুঁজে দেখুন।
মেয়েটা যা খুঁজছিল তা বোধহয় পেয়ে গেল। সটান এগিয়ে এসে আমার পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় একটা বেশ সুগন্ধ পেলাম তার গা থেকে। নাভির নীচে পরা শাড়ি, খুব সংক্ষিপ্ত ব্লাউজে মেয়েটিকে বেশ দেখাল। আমাকে একটু তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করল বটে, কিন্তু বউনিটা খুব খারাপ হয়েছে বলে মনে হল না আমার। সকালবেলাতেই একটা সুন্দর মুখ বা একটা সুন্দর ফিগার দেখতে পাওয়াও ভাগ্যের ব্যাপার।
ভিতরে ভিতরে সবসময়ে এক ধরনের ফ্রাষ্ট্রেশন কাজ করে বলেই বোধহয় আমি আজকাল মেয়েদের নিয়ে বেশি কল্পনা করি না। পারুলের সঙ্গে একটা প্রেম-ট্রেম ঘটেনি আমার। প্রেম-ট্রেম করেও তো লাভ নেই। বেকার মানুষ, বাড়িতে হাঁড়ির হাল, সুতরাং একটা মেয়েকে তুলে আনতে তাকেও কষ্ট দেওয়া, নিজেরাও কষ্ট পাওয়া। তবে প্রেম না করলেও কোনও মেয়ে আমাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করলে আজও মন খিঁচড়ে যায়। বহুদিন বাদে এই মেয়েটা আমার মনে একটা খিচ ধরাল। তবু বউনিটা খারাপ হয়নি।
আমি সিঁড়ি দিয়ে নেমে গাড়িবারান্দার তলায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে অগত্যা আমার সাইকেলের বেলটা ক্রিং ক্রিং করে বাজাতে লাগলাম। এভাবে যদি খানিকটা ডিসটার্ব করা যায় এদের এক নিজের উপস্থিতির জানান দেওয়া যায়।
কাজ হল। সিংহীদের বাগানে কয়েকটা কুঞ্জবন আছে। তার ভিতরে লোহার বেঞ্চি পাতা বড়লোকদের কত খেয়ালই না থাকে। এরকমই একটা কুঞ্জবন থেকে হঠাৎ খাকি পোশাক পর একটা লোক বেরিয়ে আমার দিকে আসতে লাগল।
লোকটা দারোয়ান সন্দেহ নেই। বুঝলাম, পারিজাতবাবুর বাগানে গোরু ছাগল ঢোকে না কেন প্রকাশ্যে দারোয়ান না থাকলেও আড়ালে বসে নজরদারি করার লোক ঠিকই আছে।
লোকটা আমার কাছে এসে বলল, কাকে চাইছেন?
পারিজাতবাবু কোথায়?
লোকটা একটু বিরক্ত হয়ে বলল, উনি এখন জগিং করছেন। আপনি একটু পরে আসুন।
কখন আসবেন তার কিছু ঠিক আছে?
উনি বাগানেই জগিং করছেন।
এই বাগানেই?
হ্যাঁ, কিন্তু এখন দেখা হবে না।
দারোয়ানরা যদিও আমার প্রায় সমশ্রেণির লোক বু কেন জানি এই শ্রেণিটাকে আমি পছন্দ করি না। দারোয়ান মানেই তো বড়লোকের ধনমানের প্রহরী। তার মানে কর্তাভজা। মালিক হাসলে এরাও হাসে, মালিক গম্ভীর হলে এদের মন খারাপ হয়ে যায়।
আমি নির্বিকার মুখে বললাম, উনি আমার আত্মীয়।
লোকটা খুব ইমপ্রেসড হল না। বড়লোকদের গরিব আত্মীয় থাকতেই পারে, কিন্তু তাদের বেশি লাই দেওয়ার নিয়ম নেই। আমার আকার এবং প্রকার লোকটার পছন্দও হচ্ছিল না। বলল, অপেক্ষা করুন। উনি এসে যাবেন।
লোকটা আবার কুঞ্জবনে ফিরে গিয়ে লুকিয়ে নজর রাখতে লাগল।
সিংহীদের বাগানটা বিরাট। হেসেখেলে বিচারেকহবে। আমি পায়ে পায়ে ঘাসজমি ধরে হটতে লাগলাম।
প্রথম দর্শনে মনে হয়েছিল, সিংহীদের বাগান বা বাড়ির কোনওরকম সংস্কারই বুঝি পারিজাতবাবু করেননি। কিন্তু তা ঠিক নয়। অন্তত একটা সংস্কার তিনি করেছেন। সংস্কার কিংবা সংযোজন। বাগানের চারধারে পাঁচিল ঘেঁষে একটা সরু মোরামের রাস্তা তিনি বানিয়েছেন। সম্ভবত জগিং করার জন্যই।
ধৈর্য ধরে সেই মোরামের রাস্তার ধারে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতেই লোকটাকে দেখা গেল। পিছনের পুকুরের ধারে কলাকোপের পাশ দিয়ে বাঁকু নিয়ে লোকটা এগিয়ে আসছিল। সাদা হাফ প্যান্ট আর তোয়ালের গেঞ্জি পরা, পায়ে কেডস। কেশ পাকানো শক্ত চেহারা। সন্দেহ নেই লোকটা স্বাস্থ্যসচেন। তা হবে নাই বা কেন? দেদার টাকা, দেদার ভোগ্যবস্তু, দেদার স্তাবক। এত সব ভোগ করতে হলে স্বাস্থ্য তো চাই-ই।
লোকটা কাছাকাছি আসতেই আমি মোরামের রাস্তায় উঠে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পথ আটকালাম।
কিন্তু লোকটা ভারী একয়ে। দাড়িয়াবা খেলার খেলুড়ির মতো সাঁ করে আমাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল এবং হাফধরা গলায় পেঁচাল, চলে আসুন। রান বয়, রান।
বুঝলাম এই স্বাস্থ্য-পাগল, দৌড়-মাতাল লোকটাকেনাগালে পেতে হলে ওটাই একমাত্র উপায়। কী যেন হয়ে গেল আমার মধ্যে। বোধহয় সেটা সাময়িক পাগলামিই। আমি লোটার পিছু পিছু দৌড়তে লাগলাম।
অবশ্য জগিং জিনিসটা ঠিক দৌড় নয়। দৌড় একহটার মাঝামাঝি। দৌড়-পায়ে হাঁটা আর কি।
লোকটা ঘাড় বেঁকিয়ে আমাকে একবার দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী নাম?
অভিজিৎ গাঙ্গুলি।
কী দরকার?
ইস্কুলের অঙ্কের ভেকেলিটার জন্য অসীমা দিদিমণি আমাকে পাঠিয়েছেন।
ও হোঃ, তুমিই অসীমার লোক তা হলে?
হ্যাঁ।
অসীমা বলেছিল আমাকে। মাস্টারি করতে চাও কেন?
চাকরি দরকার তাই।
এই অল্প বয়সে মাস্টারি করতে ভাল লাগবে।
আর কী করব?
মাস্টারির চাকরিতে অ্যাডভেঞ্চার নেই, থ্রিল নেই, টাকা নেই।
জানি।
অন্য কিছু করতে ইচ্ছে হয় না?
আর কী?
বিপ্লব করো, তছনছ করো, ওলটপালট করে দাও সব কিছু।
স্কোপ নেই। পুলিশে ধরবে।
ধরুক না। সেটাও তো একটা অভিজ্ঞতা।
আমার বাড়িতে বড় অভাব।
কীরকম অভাব?
খুব অভাব।
ভাতের বদলে কখনও আটাগোলা খেয়েছ?
না তো?
ঘাস খেয়েছ কখনও?
না।
মেটে আলু খেতে কীরকম হয় জানো?
না।
কাপড় নেই বলে কোনওদিন গায়ে মাদুর জড়িয়ে লজ্জা নিবারণ করতে হয়েছে?
না।
খড়ের বিছানায় শুয়েছ কখনও?
না।
তা হলে কেমন অভাব তোমাদের?
এ ছাড়াও তো অভাব আছে।
তুমি দারিদ্র্যের স্বরূপই এখনও দেখোনি।
আপনি দেখেছেন?
আমি দারিদ্র্যসীমার ওপারের লোক। এক্কেরের শেকড়ের কাছাকাছি থেকে উঠে আসতে হয়েছে। বড় কষ্ট।
আপনি হাঁফাচ্ছেন। এবার থামুন।
আরও দুরাউন্ড। তারপর থাম। ভেবো না আমি হাঁফিয়ে পড়েছি।
কিন্তু আপনি তো হাঁকাচ্ছেন।
ওটা কিছু নয়। দৌড়োতে তোমার কেমন লাগে?
ভাল নয়। আমি বহুকাল দৌড়োইনি।
আর আমি চিরটাকাল কেবল দৌড়োচ্ছি।
তাই নাকি? দৌড়োচ্ছন কেন?
দৌড়ে আসলে পালাচ্ছি।
আমি অবাক হয়ে বললাম, পালাচ্ছেন কেন?
পালাচ্ছি দারিদ্র্য থেকে, ক্ষুদ্রতা থেকে। রানিং বিয়ন্ড টাইম, বিয়ন্ড পভারটি, বিয়ভ এভরিবডি এলস। বুঝলে?
না, ভাল বুঝলাম না।
তুমি যথেষ্ট গরিব নও। যথার্থ গরিবও নও। হলে বুঝতে।
পালানোই কি গরিবের ধর্ম?
গরিবদের কোনও ধর্ম নেই, কোনও নিয়ম নেই। কেউ পালায়, কেউ নেতিয়ে পড়ে থাকে, কেউ রুখে উঠতে চায়।
সুন্দর একটি কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় এসে পড়িআমরা। বন্য একটি গোলাপ গাছের ডাল আমার জামা টেনে ধরে এবং ছেড়ে দেয়। লোকটাকে পিছন থেকে ল্যাং মেরে ফেলে দেওয়ার একটা লোভ সংবরণ করে আমি বললাম, আপনি কি পলাতক।
লোকটা ঘাড় বেঁকিয়ে আর একবার আমাকে দেখে বলল, সামনে একটা নালা আছে। সাবধান।
নালাটা আমরা দুজনেই সাফল্যের সঙ্গে অতিক্রম করার পর লোকটা বলে, আমি দৌড়োতে ভালবাসি। ছেলেবেলা থেকেই আমার ইচ্ছে, দৌড়োতে দৌড়োতে নিজেকেও ছাড়িয়ে যাই। বুঝলে?
না। এসব বোধহয় দার্শনিক কথাবার্তা!
লোকটা উদাস গলায় বলল, তা বলতে পারো। দানিকতা তোমার ভাল লাগে না?
লাগে। তবে উদ্ভট দার্শনিকতা নয়।
উদ্ভট হবে কেন? বরং খুব সাধারণ দার্শনিকতা।
কীরকম?
নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার মানে গ্রেট সাকসেসেস অ্যান্ড গ্রেটার সাকসেসেস। নিজের যতটা সামর্থ্য আছে বলে তুমি ভাবো তার চেয়েও ঢের বেশি সামর্থ্য অর্জন করতে থাকাই হচ্ছে নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়া।
আমি খুব সাবধানে একটা ফুলগাছের কাঁটাওলা ডাল এড়িয়ে দৌড়োতে দৌড়োতে বললাম, তাও বুঝলাম না।
লোকটা হাঁফাতে হাঁফাতেই একটা দীর্ঘশ্বাসের মতো শব্দকরল। হাঁফাতে হাঁফাতে দীর্ঘশ্বাস ছাড়া খুব শক্ত কাজ। কেননা হাঁফানোর সময় সবকটা শসই দীর্ঘ হতে বাধ্য। কিন্তু লোকটা তার মধ্যেও একটা দীর্ঘতর শ্বাসের শব্দ কী করে বের করল সেইটেই রহস্য।
আমরা একটা পুকুরের ধার ধরে দৌড়াচ্ছি। চমৎকার করুন। মেলা টেকিশাক হয়ে আছে। জলের কাছ ঘেঁষে কলমির জঙ্গল। জলে শাপলাফুল। বাঁধানো ঘাট শ্যাওলায় ছেয়ে গেছে। বর্ষার জল কোথাও কোথাও পুকুরের পাড় উপচে যোরামের রাস্তা ভাসিয়ে বয়ে যাচ্ছে। লোকটা এবং আমি তার ওপর দিয়ে ছপ ছপ করে দৌড়োতে থাকি।
দৌড়োতে দৌড়োতে লোকটা বলে, পোস্টটার জন্য আর একজন ক্যান্ডিডেট আছে। তোমার কোয়ালিফিকেশন কী?
বি এসসি অনার্স।
মেয়েটারও বোধহয় তাই। তবে সে আবার বি এড
বি এড হওয়া কিছু শক্ত নয়।
তাই নাকি? বলে লোকটা ফের ঘাড় ঘুরিয়ে আমাকে একটু দেখে নিয়ে বলে, পৃথিবীর কোন কাজটা তোমার কাছে সবচেয়ে শক্ত মনে হয়?
বেঁচে থাকা।
তুমিও তো দেখছি দার্শনিক কিছু কম নও।
এটা দর্শন-টর্শন নয়। বেঁচে থাকাটাই ভারী শক্ত, বিশেষত আমাদের মতো গরিবদের পক্ষে।
কিন্তু আগেই প্রমাণ হয়ে গেছে তুমি জেনুইন গরিব নও।
লোকটাকে পেছন থেকে ল্যাং মারার আর একটা লোভ সংবরণ করে আমি বললাম, কীরকম গরিব আপনার পছন্দ?
গরিবদের আমি পছন্দ করি কে বলল?
করেন না?
তাও বলছি না। তবে একটা লোক গরিব বলেই তাকে পছন্দ করতে হবে এমন কোনও শর্ত আমি মানি না। গরিব হওয়া খুব খারাপ।
আমার হাত পা রাগে একটু নিশপিশ করে উঠল। বললাম, আপনিও তো একদিন গরিব ছিলেন করে। তাদের প্রতি আপনার সিমপ্যাথি থাকা উচিত।
লোকটা কলাগাছের ঝোপটা ডাইনে ফেলে এগোতে এগোতে বলল, আমি গরিব অবস্থায় চোর, মিথ্যাবাদী, নিমকহারাম, পরশ্রীকাতর এবং ধান্দাবাজ ছিলাম।
আমার একবার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হল, এখনও কি তাই নন? চেপে গেলাম।
কি আশ্চর্য, লোকটা নিজেই বলল, হয়তো এখনও আমি তাই-ই আছি। তবে এসব দোষের উৎস এই দারিদ্র্য।
আমি বললাম, বড়লোকেরা আরও বেশি মিথ্যেবাদী, আরও বড় চোর, আরও পরশ্রীকাতর এবং ধান্দাবাজ হয়।
এটাই শেষ রাউন্ড, বুঝলে। এই রাউন্ডে আমি একটু জোরে দৌড়োই।
আমি ধৈর্য হারিয়ে বলি, আপনি রাউন্ডটা শেষ করুন, আমি বরং গাড়ি বারান্দার তলায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি।
আর, না না। তুমি তো জানো না দূরপাল্লার দৌড়বাজরা কীরকম নিঃসঙ্গ আর একা। তাদের আনন্দ নেই, উপভোগ নেই, বিশ্রাম নেই, বন্ধু নেই, প্রেম নেই, আছে শুধু দৌড় আর দৌড়।
আপনি এত দৌড়ন কেন? অলিম্পিক যাবেন নাকি?
দূর বোকা ছেলে। দৌড়ের অর্থ এখানে অন্য। আমি যে জীবনযাপন করি সেটাই এক দূরপাল্লার দৌড়।
তা না হয় হল, কিন্তু আনন্দ, বিশ্রাম, বন্ধু বা প্রেম নেই কেন?
খসে পড়ে যে। যতই তুমি দৌড়োতে থাকবে ততই ওসব খসে পড়তে থাকবে। কোনও কিছুই রেসঙ্গে তাল মিলিয়ে চলবে না। ক্রমে তুমি একা হয়ে যাবে, ভীষণ একা। ভারী ক্লান্ত বোধ হবে, কিন্তু থামলে চলবে না।
ও, ফের সেই দার্শনিকতা।
লোকটা ফের একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বলল, তোমাকে আমার বেশ ভাল লাগছে। বেশ ভাল।
ধন্যবাদ।
তোমাকেও ধন্যবাদ। শেষ দুটো রাউন্ড আমাকে সঙ্গ দিয়েছ বলে।
আজকাল চাকরির জন্য লোকে সব কিছু করতে পারে।
সামান্য একটা মাস্টারির জন্য?
মাস্টারি আপনার কাছে সামান্য মনে হলেও, আমার কাছে অসামান্য।
আমার এক সময়ে মনে হত আখের গুড়ের চেয়ে ভাল খাদ্য বুঝি আর কিছু নেই। এসো, এবার একটু জোরে দৌড়েই।
দাঁতে দাঁত চেপে আমি গোঁয়ার লোকটার সঙ্গে প্রায় সমান তালে দৌড়োত লাগলাম। হ্যাঁ, লোকটা গোঁয়ার, একরোখা, খ্যাপাটে, নিষ্ঠুর ও উচ্চাভিলাষী। এ লোকটাকে আমার খুব খারাপ লাগছিল না।
শেষ রাউন্ডটা জোরে দৌড়োতে হল বলে লোকটার দমে টান পড়েছিল বোধহয়। বেশি কথাটথা বললনা। দমে আমারও টান পড়েছিল। লোকটা কথা না বলায় বাঁচলাম।
ঘেমে হেদিয়ে হাঁ করে শ্বাস নিতে নিতে যখন দুজনে গাড়ি বারান্দার তলায় পৌঁছোলাম তখন দেখি বারান্দায় একজন ভদ্রলোক ও একটি যুবতী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ভদ্রলোক বিগলিত হাসি হেসে বলল, সকালে উঠে দৌড়োনো খুব ভাল অভ্যাস। সেই জন্যই না আপমার স্বাস্থ্যটি এমন ডগমগে।
লোকটা হাঁফাতে হাফাতেই আমাকে চোখ টিপে চাপা গলায় বলল, এসে গেছে। কমপিটিটার।
মেয়েদের দিকে তাকানোর কোনও মানেই আজকাল আর আমি খুঁজে পাই না। তবে অভ্যাসবশে তাকাই। গোৰু কি পূর্ণিমার চাঁদের সৌন্দর্য উপভোগ করে? যতদূর জানি করে না। তবে তাকায়, আমিও আজকাল গোরুর মতো নির্বিকার চোখে মেয়েদের দেখি। তবে লোকটা কমপিটিটার বলায় আমি গোরুর চেয়ে আর একটু তীক্ষ্ণ চোখে মেয়েটির দিকে তাকালাম।
আগের দিনে গল্প উপন্যাসে নায়িকা বা স্ত্রীলোকের রূপ বর্ণনার একটা রীতি ছিল। আর তাতে কী বাড়াবাড়িই না থাকত! আজও পৃথিবীতে মেয়েদের রূপ একটা মস্ত বড় আলোচ্য বিষয়। এ থেকেই বোঝা যায়, মেয়েদের অস্তিত্বটা এখনও অনেকটাই শরীরকেন্দ্রিক। তাদের অন্যবিধ গুণাবলীকে এখনও পুরুষশাসিত সমাজ তেমন আমল দিচ্ছে না। তা এই মেয়েটির রূপ তেমন কিছু নয়। ফ্যালনাও বলছি না। একটু শ্যামলা ঘেঁষা রং। মুখখানায় লাবণ্য আছে। বেশ লেঢলে মাঝারি গড়ন, মাঝারি দৈর্ঘ্য। পরনে একটা সবুজ ডুরে শাড়ি। গলায় বড় বড় লাল পাথরে মালা, ফুল, কপালে টিপ। হাতে দু গাছা বালা। সাজপোশাক থেকেই মনে হয়, তেমন আধুনিক করে নয়। মুখ-চোখও ভারী লাজুক আর সপ্রতিভ। একটু ভয়-ভয় ভাবও আছে। আমার চোখে চোখ পড়তেই তাড়াতাড়ি অন্যদিকে তাকাল। এইসব মেয়ের কাছে অপরিচিত যুবা মানেই সম্ভাব্য ধাকারী বা মহিলালোভী পেশাদার প্রেমিক।
লোকটা হাফাতে হাফাতেই বলল, আরে সাতসকালেই জহরবাবু যে!
প্রতিমাকে নিয়ে এলাম। আপনি বলেছিলেন একবার নিয়ে আসতে।
ভালই করেছেন। ঘরে গিয়ে বন। আমি ধরাচূড়া ছেড়ে আসছি। বলেই লোকটা আমার দিকে চেয়ে চোখ টিপে বলল, তুমিও যাও। কমপিটিটারটিকে ভাল করে মাপজোক করে দেখো। হাই কমপিটিশন।
লোকটা দৌড়োত দৌড়োতে ভিতরে ঢুকে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেল।
না, স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি পারিজাত নামক এই ধনতান্ত্রিক, শ্রেণিশত্রু শোষক ও উচ্চাভিলাষী লোকটিকে আমি তেমন অপছন্দ করতে পারছি না। লোকটি পাজি সন্দেহ নেই। শয়তান তো বটেই। অসাধুও নিশ্চয়ই। তবু লোকটার মধ্যে বেঁচে থাকার একটা স্পন্দন আছে। সেই স্পন্দন টের পাওয়া যায়।
জহরবাবু হাত কচলে বললেন, আপনি কি ওঁর কেউ হন?
আমি মাথা নেড়ে বললাম, না।
একসঙ্গে প্রাতঃভ্রমণ করছিলেন। দেখে মনে হল খুব ঘনিষ্ঠ।
আমিও যে চাকরিটার একজন উমেদার সেটা ওঁকে বলা ঠিক হবে কি না বুঝতে না পেরে একটু দোনোমোনো করলাম। তবে লুকিয়ে লাভও নেই। বলে দিলেই বরং ল্যাঠা চুকে যায়। তাই একটু হেসে বললাম, প্রাতঃভ্রমণ করছিলাম না। দৌড়োতে দৌড়োতে উনি আমার ইন্টারভিউ নিচ্ছিলেন।
বলেন কী! কীসের ইন্টারভিউ?
শিবপ্রসাদ স্কুলে অঙ্কের মাস্টারির।
ওঃ। বলে বিনীত, অমায়িক ও হাস্যময় জহরবাবু সহসা ভীষণ গম্ভীর হয়ে গেলেন।
আমিও চাকরির ক্যান্ডিডেট জেনে প্রতিমা চকিতে আমার দিকে একটু দৃকপাত করল। সুযোগ পেলে সেও হয়তো তার এই কমপিটিটারকে একটু মাপজোক করত, কিন্তু জহরবাবু মেয়েকে সেই সুযোগ দিলেন না। অত্যন্ত বিরক্ত মুখে তিনি মেয়েকে চল, চল, বসিগে। যত সব উটকো ঝামেলা… বলে প্রায় হাত ধরে টেনে বাইরের ঘরে ঢুকে পড়লেন। লক্ষ করলাম, জহরবাবু মাকে মাঝে ঘর থেকে খুনির চোখে আমাকে দেখছেন এবং মেয়ের সঙ্গে অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে নিচু স্বরে একটা জরুরি আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। আলোচ্য বিষয় যে আমি তাতে সন্দেহ নেই।
বিপজ্জনক ঘরটিতে আর ঢুকলাম না। দৌড়োনোর পর আমার শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগছিল। আমি সিংহীদের বাগানটায় পায়চারি করতে করতে পাখির ডাক শুনতে লাগলাম।
প্রায় আধঘণ্টা পর পারিজাত নামল। পরনে পাজামা-পাঞ্জাবি, ঠোঁটে একটু বেসুরো শিস। আমাকে হাতছানি দিয়ে ডেকে নিচুস্বরে বলল, কমপিটিটারকে দেখলে?
দেখলাম। তবে আলাপ হয়নি।
কী মনে হল? পারবে কমপিটিশনে?
শুধু চোখে দেখেই কি তা বলা যায়?
তা হলে চল। ফেস হার। মুখোমুখি বসে ষ্ট্যাটেজি ঠিক করো। হাই কমপিটিশন।
লোকটা মজার সন্দেহ নেই। আগেই বলেছি লোকটাকে আমি তেমন অপছন্দ করতে পারছি না। কিন্তু প্রতিমার সঙ্গে কমপিটিশনে নামতেও আমার রুচিতে বাঁধছে। আমি চাকরিটার উমেদার শুনে ওর বাবা এমন রিঅ্যাক্ট করল যে, পুরো ব্যাপারটার ওপরেই আমার ঘেন্না ধরে গেছে।
আমি বিরসমুখে বললাম, হাই কপিটি যে তা বেশ টের পাচ্ছি। তবে সেই কমপিটিশনে আমার নামবার ইচ্ছে নেই। চাকরি আপনি ওকেই দিন।
কেন বলো তো? মেয়েটাকে দেখে কি তোমার মন নরম হয়ে গেছে?
আমি একটু রাগের গলায় বলি, মোটেইনয়। আমি ক্যান্ডিডেট শুনে মেয়েটার বাবা আমার সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করেছে।
লোকটা হাসল। বলল, আরে দূর! তুমি বড় বেশি সেন্টিমেন্টাল। আসলে জহরবাবু খুব সরল লোক। সরল লোকেরা নিজেদের মনের ভাব গোপন করতে পারে না। তোমাকে কী বলেছে?
আমি বললাম, কিছু বলেনি। কিন্তু অপমানজনক ভাবভঙ্গি করেছে।
ওঃ, এই কথা? লোকটা খুব উদারভাবে হেসে বলে, আমি যে সমাজে জন্মেছি এবং বড় হয়েছি সেই সমাজে মিনিমাম গালাগালি কী ছিল জানো? শুয়োরের বাচ্চা। লোকের সঙ্গে লোকের আন্ডারস্ট্যান্ডিং শুরুই হত শুয়োরের বাচ্চা দিয়ে। সেই থেকেই অপমান-টপমানের বোধ আমার নষ্ট হয়ে গেছে। অপমানবোধ থাকা মানেই একটা ঠা, ওটা যত শিগগির চুকিয়ে ফেলতে পারো ততই মঙ্গল।
আমি তো আপনার সমাজে মানুষ হইনি।
সেই জন্যই তো বলছিলাম তুমি যথেষ্ট গরিবনও। এসো, এসো, ছেলেমানুষি কোরো না।
বেশ গম্ভীর মুখে এবং যথেষ্ট অনিচ্ছার সঙ্গে আমি লোকটার পিছু পিছু ঘরে ঢুকি। জহরবাবু তাড়াতাড়ি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, ঠিক যেভাবে ক্লাসে মাস্টারমশাই ঢুকলে ছাত্ররা উঠে দাঁড়ায়। অবিকল মাস্টারমশাইয়ের গলায় লেকটা জহরবাবুকে বলল, বসুন, বসুন।
জহরবাবু বসলেন। আমার দিকে না তাকানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করছিলেন তিনি। কিন্তু কৌতূহল যাবে কোথায়? কাজেই মাঝে মাঝে আমার চোখে চোখ পড়ে যাচ্ছে। পরিষ্কার খুনির চোখ। প্রতিমার চোখেও যথেষ্ট অনিশ্চয়তা, সংশয় ও দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে। আমি ভারী অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম।
জহরবাবু খুব বিগলিত মুখে লোকটাকে বলতে লাগলেন, আপনাকে বহুদিন ধরেই জীবনীটা লিখে ফেলতে বলছি, একদম গা করছেনা।
লোকটা উদাস গলায় বলে, কী হবে লিখে?
জহরবাবু ব্যস্ত হয়ে বললেন, হবে হবে। আমার মতো গরিবরা দেশের সর্বহারারা আপনার জীবনী পড়ে লড়াই করতে শিখবে। আশা পাবে, ভরসা পাবে, শক্তি পাবে।
আমার তো অত সময় নেই।
জহরবাবু তাড়াতাড়ি বললেন, তা জানি। আর সেইজন্যই প্রতিমাকে নিয়ে এলাম, ওর হাতের লেখা খুবই সুন্দর। গোটা গোটা ছাপার অক্ষরের মতো, বানান-টানান ভুল করে না, লেখেও তাড়াতাড়ি। তাই বলছিলাম, ইস্কুলের কাজটুকু করেই চলে আসবেন। আপনি নিজের জীবনের কথা বলে যানে, ও বসে বসে ডিকটেশন নেবে।
লোকটা আমার দিকে চেয়ে চোখ টিপল। একটু চাপা গলায় বলল, হাই কমপিটিশন। বিডিং শুরু হয়ে গেছে। বি অ্যালার্ট।
আমি কুঁচকে রইলাম।
লোকটা জহরবাবুর দিকে চেয়ে বলল, জীবনীটা ছাপবে কে?
আমরাই ছাপব, দরকার হলে চাঁদা তুলব।
লোকটা হঠাৎ হাঃ হাঃ করে হেসে উঠে বলল, কিন্তু একটা মুশকিল আছে। আমি যে সমাজে মানুষ সে সমাজে অনেক নোংরামি, অনেক কলঙ্ক, অনেক লজ্জা। জীবনী লিখতে গেলে সেসব কথাও এসে পড়বে। খুবই খারাপ খারাপ কথা, সেসব লিখতে প্রতিমার মতো ভদ্র এবং যুবতী একটি মেয়ের অসুবিয়ে হবে না?
জহবাবু একটা ঢোক গিলে আমার দিকে তাকালেন। নারদীয় চোখ। যেনবা কথাটা আমিই পারিজাতকে প্রম্পট করেছি। তারপর বললেন, তাতে কী? পারবে। পারবি না প্রতিমা?
প্রতিমা পারবে কি না বোঝা গেল না। বাইরে হঠাৎ আবার তুমুল বৃষ্টি নেমেছে। প্রতিমা সেই দিকে চেয়ে ছিল।