শতধারায় বয়ে যায় (Shotodharay Boye Jai) : 02
০৬.
ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটে আশু দত্তদের সেই যে বিনয় পৌঁছে দিয়ে এসেছিল, তারপর দুটো দিন পেরিয়ে গেল।
সুবিশাল এই মহানগরের জনারণ্যে ঝিনুক হারিয়ে গেছে। বিনয় প্রায় নিশ্চিত, তাকে আর কখনও খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবু বুকের ভেতরে অদৃশ্য কোনও কুঠুরিতে অতি ক্ষীণ একটু আশা এখনও ধুকপুক করে। তাই সকাল হলেই চা খেয়ে বেরিয়ে পড়ে সে। ট্রাম রাস্তা, বাস রাস্তা ছাড়াও সরু সরু অলিগলিতে উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়ায়। চারপাশের প্রতিটি মানুষকে লক্ষ করে, যদি অলৌকিক কোনও ভোজবাজিতে ঝিনুকের দেখা মেলে। তারপর চলে যায় থানায়। থানা থেকে ফিরে কোনওরকমে চান-খাওয়া সেরে মুহ্যমানের মতো কিছুক্ষণ বিছানায় পড়ে থাকে। বেলা একটু পড়লে আবার রাস্তায় রাস্তায় ছোটাছুটি। খোঁজাখুঁজি।
এই দুদিনও তার হেরফের ঘটেনি। কিন্তু বৃথাই এই অনুসন্ধান। রাত্রিবেলা যখন সে বাড়ি ফেরে তার যাবতীয় উদ্যম আর জীবনীশক্তি শেষ হয়ে যায়। ক্লান্ত, বিপর্যস্ত, হতোদ্যম বিনয়কে দেখলে তখন কষ্টই হয়।
আজও সকালে চা খাওয়া শেষ হলে ঘর থেকে বেরুতে যাবে, বাধা পড়ল। দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে খগেন। সে ডাকল, দাদাবাবু
মুখ ফিরিয়ে তাকায় বিনয়, কিছু বলবে?
বড়বাবু আপনাকে একবার ওপরে যেতি বলেছেন।
বিনয়ের ঘর দোতলায়। অবনীমোহন থাকেন তেতলায়, মাত্র চোদ্দ ফুট উঁচুতে। একই বাড়িতে কদিন ধরে তারা আছে। কিন্তু দুজনের দেখাসাক্ষাৎ, কথাবার্তা খুব কমই হয়েছে। অবনীমোহন ভোর থেকে তার জপতপ, পুজো এবং ধর্মগ্রন্থ নিয়ে মগ্ন থাকেন। ইহকালের সুখদুঃখ বা অন্য সব সমস্যা সম্পর্কে তিনি প্রায় উদাসীন। আর বিনয়ের ধ্যানজ্ঞান ঝিনুক। এই মেয়েটার চিন্তায় চিন্তায় সারাক্ষণ সে আচ্ছন্ন। দুজনের কক্ষপথ আলাদা। মাঝখানে লক্ষ কোটি যোজনের ব্যবধান। তারা যেন ভিন্ন দুই গ্রহের মানুষ। পরস্পরের সম্পূর্ণ অচেনা।
এ-বাড়িতে আসার পর নিজের থেকে অবনীমোহন কখনও তাকে ডেকে পাঠাননি। হঠাৎ কী এমন হতে পারে, বোঝা যাচ্ছে না। বেশ অবাকই হল বিনয়। জিজ্ঞেস করল, কেন ডেকেছেন, জানো?
খগেন মাথা নাড়ে, না।
ঠিক আছে, তুমি যাও।
খগেন চলে গেল। এবেলা আর বেরুনো হল না। কিছুটা কৌতূহল এবং খানিক সংশয় নিয়ে তেতলায় বাবার ঘরে চলে এল বিনয়।
এর ভেতর স্নান হয়ে গেছে অবনীমোহনের। ভাজকরা ধবধবে থান-ধুতি লুঙ্গির মতো করে পরা। তার ওপর খদ্দরের হাফ-হাতা পাঞ্জাবি এবং গরম শাল। বিছানায় শিরদাঁড়া টান টান করে বসে আছেন। সামনে নিচু ডেস্কের ওপর কোনও সগ্রন্থ খোলা রয়েছে। গীতা কিংবা উপনিষদ। খুব সম্ভব সেটাই পড়ছিলেন।
পায়ের শব্দে মুখ তুলে তাকালেন অবনীমোহন। বইটা বন্ধ করে বললেন, ওখান থেকে একটা চেয়ার এনে বোস।
ডানপাশের দেওয়াল ঘেঁষে খানচারেক চেয়ার সারি দিয়ে দাঁড় করানো। তার একটা খাটের কাছে টেনে এনে নিঃশব্দে বসে পড়ল বিনয়।
অবনীমোহন কয়েক পলক ছেলেকে লক্ষ করলেন। তারপর বললেন, শুধু শুধু রাস্তায় ঘোরাঘুরি করে শরীর নষ্ট করছিস কেন? যে নিজের ইচ্ছায় চলে গেছে তাকে ফিরে পাওয়া অসম্ভব।
বিনয় চমকে উঠল। জাগতিক ব্যাপারে অবনীমোহন তাহলে একেবারে নিস্পৃহ নন। ছেলের গতিবিধির ওপর তার নজর আছে। উত্তর না দিয়ে চুপচাপ বসে থাকে সে।
অবনীমোহন বলতে লাগলেন, যা ঘটে গেছে তা নিয়ে মন খারাপ করে যদি সারাক্ষণ কাটাস, জীবনে দাঁড়াবি কীভাবে? এমন করে চলতে পারে না। ভবিষ্যতের কথাও তো ভাবতে হবে।
এবারও জবাব দিল না বিনয়।
অবনীমোহন খানিক ভেবে জিজ্ঞেস করলেন, অফিসে তোকে কবে জয়েন করতে হবে যেন?
বিনয় মনে মনে হিসেব করে বলল, দিনকয়েক পর।
একটু নীরবতা।
তারপর অবনীমোহন বললেন, যদি ঠিক করে থাকিস, এ-বেলা বেরুবি, ঘুরে আয়। ও-বেলা কিন্তু বাড়িতে থাকবি।
বিনয় বলল, কোনও দরকার আছে?
হ্যাঁ। বিকেলে সুধা সুনীতি আনন্দ আর হিরণকে আসতে বলেছি। আমার লইয়ারও আসবেন। আর এই বাড়ি যিনি কিনবেন তিনিও আসছেন। সেইসময় তোর থাকা দরকার।
বিনয় হতচকিত। পাকিস্তান থেকে আসার পর যেদিন অবনীমোহনের সঙ্গে প্রথম দেখা হল তখনই তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন, বাড়িটা বিক্রি করে দেবেন। ব্যবসার জন্য বাজার থেকে প্রচুর লোন নিয়েছিলেন। ব্যবসা ফেল পড়ায় সিকি পয়সাও ফেরত দিতে পারেননি। ঋণের টাকা সুদে আসলে বিপুল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বাড়ি ছাড়া তার অন্য সম্বল নেই। এটা বেচে তাবৎ ধারদেনা শোধ করতে চান। ঋণমুক্ত হতে না পারলে মরেও তিন স্বস্তি পাবেন না। এ-সব সবিস্তারে বললেও বিনয়ের স্মৃতি থেকে পুরোটাই মুছে গিয়েছিল। ঝিনুক নিরুদ্দেশ হবার পর সে এমনই দিশেহারা, যে অন্য কিছু ভাবার, অন্য দিকে তাকাবার সময় পায়নি।
এই মুহূর্তে অবনীমোহনের কথা শুনতে শুনতে বিনয়ের মনে হল, মাথার ওপর আকাশ ভেঙেচুরে খান খান হয়ে নেমে আসছে। বাড়ি বিক্রির তারিখটা যে নিঃশব্দে ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছে, আজ বাবার ঘরে আসার আগে সে টেরও পায়নি। কী বলবে, কী করবে, ভেবে পেল না বিনয়।
অবনীমোহন বললেন, কথা হয়ে গেল। এখন তুই যেতে পারিস।
বিনয় উঠে দাঁড়ালো। তারপর দোতলায় নিজের ঘরটিতে এসে পশ্চিম দিকের চওড়া জানালাটার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল।
এখান থেকে খানিক দূরে রসা রোডের একটা অংশ চোখে পড়ে। মহানগরের ব্যস্ততা এখনও সেভাবে শুরু হয়নি। লোকজন কিছু কিছু দেখা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ট্রাম বাস এবং অন্য যানবাহনও। ক্কচিৎ জৈদকা কোম্পানির ছাদখোলা দু-একটা দোতলা বাসও। মানুষ বা গাড়িঘোড়া কারওই যেন বিশেষ তাড়া নেই। ঢিলেঢালা, অলস ভঙ্গিতে তারা চলে যাচ্ছে। কাল রাতে ঘন হয়ে কুয়াশা পড়েছিল, এখন তার চিহ্নমাত্র নেই। ভোরের দিকে যে ঠাণ্ডা, হিমেল হাওয়া বইছিল তার তাপাঙ্ক একটু একটু করে বাড়ছে। অনেক উঁচুতে আকাশের নীল ছুঁয়ে ছুঁয়ে কটা পাখি উড়ছিল। কী পাখি ওগুলো? কী তাদের নাম? শঙ্খচিল কি?
তাকিয়েই আছে বিনয়। কিন্তু এই টুকরো টুকরো চলমান দৃশ্যাবলী তার মাথায় একেবারেই দাগ কাটছে না। সব কেমন যেন ছাড়া ছাড়া, অসংলগ্ন, অর্থহীন। একে ঝিনুকের চিন্তাটা তার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে পাষাণভারের মতো চেপে বসে আছে। তার ওপর আরেকটা সমস্যা বিশাল আকার নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো। অবনীমোহন এ-বাড়ি বিক্রি করে দিলে কোথায় থাকবে সে? বিনয় জানে, সুধার দরজা চিরকালই তার জন্য খোলা। ঝিনুক নেই, সুনীতিদের কাছে গিয়ে থাকলে হেমনলিনী আপত্তি করবেন না। বরং যথেষ্ট সমাদর করে কাছে টেনে নেবেন। কিন্তু বোনেদের শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেওয়াটা কি আদৌ সম্মানজনক?
অস্থির, ব্যাকুল বিনয় অনেকক্ষণ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বিছানায় গিয়ে শুয়ে শুয়ে শূন্য চোখে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে।
সকালটা কখন দুপুর হয়ে গেছে, ঠাণ্ডা নরম ভাবটা কেটে গিয়ে বোদ কখন ঝকঝকে হয়ে উঠেছে, খেয়াল করেনি বিনয়। সকালের দিকের আলস্য গা থেকে ঝেড়ে ফেলে শহর জুড়ে এখন তুমুল ব্যস্ততা। ট্রাম রাস্তা ধরে উধশ্বাসে ছুটে চলেছে রকমারি যানবাহন। রাস্তায় প্রচুর মানুষ। জানালা দিয়ে ভেসে আসছে নানা ধরনের মিশ্র আওয়াজ। গাড়িঘোড়ার, মানুষের কলরোলের। সবই তীব্র। কর্কশ। চড়া তারে বাঁধা।
হঠাৎ খগেনের গলা কানে এল, দাদাবাবু, অনেক বেলা হয়েছে। চান করে খেয়ে নিন।
চমকে ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসে বিনয়। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে খগেন। সামনের দেওয়ালের দিকে বিনয়ের নজর চলে যায়। ওয়েস্ট-এন্ড ওয়াচ কোম্পানির একটা গোলাকার ঘড়ি সেখানে আটকানো। এখন একটা বেজে তেত্রিশ।
বিনয় একটু লজ্জা পেল। কেননা তার খাওয়া না হলে খগেন খাবে না। তার জন্যই লোকটা এত বেলা পর্যন্ত অপেক্ষা করছে। খাট থেকে নামতে নামতে ব্যস্তভাবে সে বলল, তুমি যাও। আমি পাঁচ মিনিটের ভেতর চলে আসছি। একটা ঘরে-পরার পাজামা আর শার্ট নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল সে।
গুরুদেবের কাছে দীক্ষা নেবার পর নিরামিষ আহার শুরু করেছেন অবনীমোহন। এ-বাড়িতে এসে তা-ই খাচ্ছে বিনয়। তার জন্য আলাদা করে মাছ মাংসের ব্যবস্থা হোক, এটা সে চায়নি। খগেনের বাড়তি খাটনি হবে, ভাবতে সঙ্কোচ হয়েছে।
বিনয়ের মনে হয়, এখানে সে যেন একজন উটকো অতিথি। কেউ তাকে ডেকে আনেনি, নিজের থেকেই এসে হাজির হয়েছে। ঝিনুক নিরুদ্দেশ হবার পর কদিন একটু বিচলিত হয়েছিলেন অবনীমোহন। বিনয়কে সঙ্গে নিয়ে থানায় পর্যন্ত ছুটে গিয়েছিলেন। তারপর আবার যে-কে সে-ই। আগের মতোই নিরাসক্ত। পার্থিব সমস্ত ব্যাপারেই উদাসীন। নিজের চারপাশে শক্ত একটা বলয়। তৈরি করে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছেন। বিনয় কী খাচ্ছে না খাচ্ছে, তার কোনওরকম অসুবিধা হচ্ছে কিনা, এ-সব নিয়ে খোঁজটোজও নেন না।
স্নান সেরে একতলা থেকে খাওয়াদাওয়া চুকিয়ে ফের নিজের ঘরে ফিরে এসে শুয়ে পড়ল বিনয়। দিবানিদ্রার অভ্যাস নেই তার। ঘড়ির কাঁটা আজ বড় বেশি মন্থর। সময় যেন কাটতেই চায় না। বিছানায় ছটফট করতে লাগল সে।
০৭.
কখন সাড়ে চারটে বেজে গিয়েছিল, কখন বাতাসে হিম মিশতে শুরু করেছে আর কখনই বা রোদ ঝলমলে ভাবটা হারিয়ে মলিন হয়ে গেছে, বিনয় খেয়াল করেনি।
খগেন এসে আবার দরজার সামনে দাঁড়ায়। বলল, সব্বাই বড়বাবুর ঘরে এসি গেচেন, আপনারে যেতি বললেন–
যাচ্ছি
তেতলায় এসে বিনয় দেখতে পেল, অবনীমোহন যথারীতি তার খাটে বসে আছেন। কাছাকাছি মেঝেতে খানকয়েক চেয়ার সাজানো রয়েছে। সেখানে বসে আছে সুধা হিরণ সুনীতি এবং আনন্দ। কয়েকটা চেয়ার এখনও ফাঁকা।
বিনয় দোতলায় যে ঘরখানায় থাকে সেখান থেকে ওপরে-নিচে ওঠানামার সিঁড়ি চোখে পড়ে না। তাই কখন সুধা সুনীতিরা তেতলায় উঠে এসেছে, সে টের পায়নি। ফাঁকা চেয়ারগুলোর একটার দিকে আঙুল বাড়িয়ে অবনীমোহন বিনয়কে বসতে বললেন। নীরবে বসে পড়ল সে। ওবেলা অবনীমোহন জানিয়েছিলেন তার অ্যাডভোকেট এবং এ-বাড়ি যিনি কিনবেন তাকেও আসতে বলেছেন। কিন্তু এখনও তারা এসে পৌঁছননি।
কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর কী ভেবে অবনীমোহন সুধা সুনীতিদের বললেন, এ-বাড়ি বিক্রির সিদ্ধান্ত যে আমি নিয়েছি, বিনুকে তা আগেই জানিয়ে দিয়েছি। আজ এখানে আসার পর তোমাদেরও শুনিয়েছি।
কেউ উত্তর দিল না।
বাড়ি বেচার কারণটা বিনয়কে বিশদভাবে আগেই বার দুই বলেছেন অবনীমোহন। এবার দুই মেয়ে ও দুই জামাইকেও বললেন। অঋণী হয়েই তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে চান। ঋণগ্রস্ত অবস্থায় মৃত্যুর কথা তিনি ভাবতেই পারেন না। তার কাছে সেটা নরকযন্ত্রণার সমান।
এবারও মেয়ে জামাইরা চুপ করে থাকে।
অবনীমোহন থামেননি, আমার ধারদেনার পরিমাণ বিরাশি হাজার টাকা। এই বাড়ির দাম পাচ্ছি। এক লাখ পনেরো হাজার। ঋণ মিটিয়ে আমার হাতে থাকছে তেত্রিশ হাজার। প্রথমে ভেবেছিলাম, এই টাকা নিয়ে আমি গুরুদেবের আশ্রমে চলে যাব। পরে মত বদলেছি।
খাটের সামনে বসে শ্রোতারা উন্মুখ তাকিয়ে থাকে।
অবনীমোহন বলতে লাগলেন, গৃহী জীবনের কোনও কিছু নিয়ে আমি আশ্রমে যেতে চাই না। এখানকার সব পেছনে ফেলে রেখে খালি হাতে চলে যাব। আমার ইচ্ছা, ওই বাড়তি টাকাটা সুধা সুনীতি আর বিনুকে সমান তিন ভাগে ভাগ করে দিই। তোমরা কী বল?
সুধা বলল, ওই টাকার আমার দরকার নেই। আমার ভাগেরটা তুমি বিনুকে দিও।
সুনীতিও তার মনোভাব জানিয়ে দেয়। সেও টাকা নেবে না। তার ভাগেরটাও যেন বিনয়কেই দেওয়া হয়। হিরণ এবং আনন্দর এ-ব্যাপারে আন্তরিক সায় আছে। শ্বশুরের কাছে তাদের আদৌ কোনও প্রত্যাশা নেই। বরং পুরো তেত্রিশ হাজার টাকা পাওয়া গেলে বিনয় অনেকখানি নিশ্চিন্ত হতে পারবে। ওই টাকাটা তার ভবিষ্যতের পক্ষে বড় রকমের বল-ভরসা।
অবনীমোহন খুব সম্ভব খুশিই হলেন। বললেন, বেশ, তা-ই হবে। বিনুর নামে একটা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলে টাকাটা আমি জমা করে দেব।
বিনয় বাবার দিকে তাকিয়ে ছিল। পলকহীন। সে মুহূর্তের জন্যেও ভুলতে পারে না, অবনীমোহনের জন্য ঝিনুক নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। মেয়েটা আদৌ বেঁচে আছে কি না, কে জানে। যদি বেঁচেও থাকে, তার জীবন আরও গ্লানিকর, আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে কি না, কে বলবে। বাবার প্রতি তার কত যে ক্রোধ, কত যে অভিমান, কত যে ক্ষোভ! বিনয় চাপা ধরনের মানুষ। ভেতরে যে তুমুল আলোড়ন চলছে তা ফেটে বেরিয়ে আসতে দেয় না। নীরস গলায় সে বলে, আমি ছোটদি বড়দির ভাগের টাকা চাই না। আমাকে যা দিতে চেয়েছেন তাও নেব না।
অবনীমোহন হকচকিয়ে যান। নম্র, মৃদুভাষী বিনয় যে মুখের ওপর এত স্পষ্ট করে না বলে দিতে পারে, ভাবা যায়নি। বিহুলের মতো কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন তিনি। ছেলের এই প্রত্যাখ্যান তাকে ভীষণ নাড়া দিয়েছে। ঢোক গিলে বললেন, টাকাটা নিলে তোর সুবিধে হতো। অর্থ একটা বড় শক্তি।
আনন্দদা আমাকে একটা চাকরি জোগাড় করে দিয়েছেন। আশা করি, তাতেই চলে যাবে। ওই তেত্রিশ হাজার না পেলেও অসুবিধেয় পড়ব না।
বিনয় তার সংকল্পে এতটাই অনড় যে কী বলবেন, অবনীমোহন ঠিক করে উঠতে পারলেন না।
সুধা হঠাৎ বলে ওঠে, বাবা, তুমি তো বাড়ি বেচে চলে যাচ্ছ। বিনু কোথায় থাকবে?
অবনীমোহনের উত্তর দেওয়া হল না। দুজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন, ভেতরে আসতে পারি?
অবনীমোহন ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, আসুন, আসুন– বিনয়ের পাশে যে ফাঁকা চেয়ারগুলো পড়ে ছিল সেখানে তাদের বসানো হল। একজন বেশ লম্বা, ধারালো ফলার মতো মেদহীন স্বাস্থ্য। রীতিমতো সুপুরুষ। পরনে নিখুঁত বিলেতি স্যুট। তার সঙ্গীটির উচ্চতা মাঝারি। ভারী চেহারা। গোলাকার মুখ, শরীরে প্রচুর অনাবশ্যক চর্বি। পরনে ধুতি, সার্জের পাঞ্জাবির ওপর গলাবন্ধ লং কোট, মাথায় পাগড়ি। কপালে এবং কানের লতিতে চন্দনের বড় টিপ। ধুতি পরার ধরন, চন্দন এবং পাগড়ি চিনিয়ে দেয়, লোকটা মারোয়াড়ি।
অবনীমোহন ছেলেমেয়েদের সঙ্গে দুজনের পরিচয় করিয়ে দিলেন। স্যুট-পরাটি হাইকোর্টের নাম করা অ্যাডভোকেট। নাম অজিতেশ লাহিড়ি। তিনিই বাড়ি বিক্রির দলিল তৈরি এবং রেজিস্ট্রির ব্যবস্থা করবেন। ধুতিওল্লা রাধেশ্যাম জালান। বড়বাজারে তার গদি। নানা ধরনের ব্যবসা করেন। যেটুকু আন্দাজ করা গেল, লোকটার অঢেল টাকা।
অজিতেশ জিজ্ঞেস করলেন, বাড়ি বিক্রির বিষয়ে আপনার ছেলেমেয়ে জামাইদের মতামত নিয়েছেন?
রাধেশ্যামরা কয়েক পুরুষ কলকাতার বাসিন্দা। সামান্য টান থাকলেও বাংলাটা নির্ভুল বলেন। তারও একই জিজ্ঞাস্য, ছেলেমেয়েরা খুশি মনে বাড়ি বিক্রিতে রাজি হয়েছে কি না। বাবার সিদ্ধান্তের জন্য পরে যেন তারা আপশোষ না করে। কারও মনে দুঃখ দিয়ে তিনি সম্পত্তি খরিদ করতে চান না।
অবনীমোহন বললেন, না, কারও কোনও আপত্তি নেই। ওদের সঙ্গে আমি কথা বলেছি। লাহিড়ি সাহেব আপনি দলিল তৈরি করুন। রাধেশ্যামজি, আপনার কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে।
রাধেশ্যাম বললেন, হাঁ হাঁ, বলুন কী অনুরোধ।
দলিল রেজিস্ট্রি হয়ে গেলেই আমি চলে যাব। আমার ছেলে বিনুর কথা আপনাকে সবই বলেছি। সবে পাকিস্তান থেকে এসেছে। ওর থাকার একটা ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত দয়া করে যদি ওকে কিছুদিন এখানে থাকতে দেন–
যতদিন ইচ্ছা ছোটবাবুজি এ-বাড়িতে থাকবেন। এক বছর, দুবছর–আমার আপত্তি নেই।
অবনীমোহন বললেন, কী বলে যে আপনাকে কৃতজ্ঞতা– তার কথা শেষ হবার আগেই প্রায় চেঁচিয়ে উঠল বিনয়, না না, বাবা চলে গেলে আমি আর এক মুহূর্তও এ-বাড়িতে থাকব না। নিজের বাবাই যখন ফেলে রেখে চলে যাচ্ছেন, অনাত্মীয়, অচেনা একটা মানুষের করুণা তার প্রয়োজন নেই।
ঘরের ভেতর অপার স্তব্ধতা নেমে আসে। সবাই ভীষণ অস্বস্তি বোধ করছিল। একসময় রাধেশ্যাম বললেন, ঠিক আছে ছোটবাবুজি, আপনার যেমন ইচ্ছা। এখন চলি– তিনি উঠে পড়লেন।
দেখাদেখি অজিতেশ লাহিড়িও চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।
রাধেশ্যাম জালান এবং অজিতেশ লাহিড়ি চলে যাবার পর বিব্রতভাবে অবনীমোহন বললেন,একটা ব্যবস্থা করেছিলাম, তুই রাজি হলি না। আমি আর কদিনই বা কলকাতায় আছি। তারপর কোথায় থাকবি?
বিনয় রুক্ষ স্বরে বলতে যাচ্ছিল, তার সম্বন্ধে অবনীমোহনকে চিন্তা করতে হবে না। ধর্মকর্ম আর গুরুদেব নিয়ে যিনি মত্ত, অন্যের দুঃখ কষ্ট, সুবিধা অসুবিধা নিয়ে তার বিচলিত না হলেও চলবে। কিন্তু কী ভেবে থমকে গেল। উদাসীন মুখে শুধু বলল, দেখি—
হঠাৎ আনন্দ বলে ওঠে, এই নিয়ে আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না। বিনু আমাদের কাছে থাকবে। বিডন স্ট্রিট থেকে ওর অফিস খুব দূরে নয়, হেঁটেই চলে যাওয়া যায়।
চকিতে হেমনলিনীর চেহারা চোখের সামনে ফুটে ওঠে। কী নিষ্ঠুরভাবেই না ওই মহিলা একরকম গলাধাক্কা দিয়ে ঝিনুককে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। সে যে কী মানসিক পীড়ন! ঝিনুকের সেই চরম লাঞ্ছনা এবং অপমান এই তো সেদিনের ঘটনা। পলকের জন্যও সে-সব ভুলতে পারে না বিনয়। সারাক্ষণ সেগুলো তার মাথায় যেন শেল বেঁধাতে থাকে। মুখ কঠোর হয়ে ওঠে তার। খুব ঠাণ্ডা গলায় সে বলে, আপনাদের বাড়িতে থাকার কথা বলবেন না আনন্দদা। আমি ওখানে কিছুতেই যাব না।
বিনয়ের অনিচ্ছার কারণটা বুঝতে পারে আনন্দ। ঝিনুকের অসম্মানে সবচেয়ে বেশি ক্লেশ আর যাতনা যে ভোগ করেছে সে বিনয়। মুখ কালো হয়ে যায় আনন্দর। কিছু একটা উত্তর দিতে চেষ্টা করে কিন্তু গলায় স্বর ফোটে না।
আনন্দর ডান পাশে ছিল সুনীতি। ঝিনুকের প্রতি হেমনলিনীর আচরণে সেও কম কষ্ট পায়নি। বিষণ্ণ দৃষ্টিতে একবার বিনয়ের দিকে তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নেয়। সে জানে তার এই ভাইটি ভীষণ জেদি। শত অনুরোধেও সে তার শ্বশুরবাড়িতে আর কখনও যাবে না।
বিনয়ের গা ঘেঁষে বসে ছিল সুধা। সে বলল, ঠিক আছে, বিনুকে আমার কাছেই নিয়ে যাব।
ছোটদি আর হিরণের প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই বিনয়ের। অপার মমতায় ওরা ঝিনুককে কাছে টেনে নিয়েছিল। লাঞ্ছিত মেয়েটা ভয়ে গ্লানিতে আতঙ্কে কুঁকড়ে থাকত। সুধাদের কাছে এসে স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল সে। কতকাল পর সহজভাবে শ্বাস নিতে পারছিল। ত্রাসের বেড়াজাল ছিঁড়ে খুশিতে তখন সে ভরপুর। চঞ্চল পাখির মতো তখন সে ডানা মেলতে শুরু করেছে। সারাক্ষণ তার কলকলানি, গান বাজনা সিনেমা থিয়েটার–সব ব্যাপারেই তার অফুরান কৌতূহল, অনন্ত প্রশ্ন। তার ভয়ার্ত মলিন মুখে ফিরে এসেছিল ঝলমলে হাসি। কত যত্নে, কত মায়ায় সুধারা ঝিনুকের দুঃখের স্মৃতিগুলোকে যে মুছে দিয়েছিল।
ছোটদির কথার জবাব দেয় না বিনয়। নীরব থেকে বুঝিয়ে দিল সুধাদের কাছে থাকতে তার আপত্তি নেই। সেখানে সে স্বাচ্ছন্দ্যই বোধ করবে। দিবারাত্রি হেমনলিনীর মুখ অন্তত দেখতে হবে না। তবু একটু দ্বিধা সূক্ষ্মভাবে মাথার ভেতর কোথায় যেন খোঁচা দিতে থাকে। সুধারা খুব যত্ন করেই তাদের কাছে রাখবে। কিন্তু চিরকাল তত বোন-ভগ্নীপতির বাড়িতে থাকা যায় না। সে ভেবে নিল, অবনীমোহন চলে যাবার পর আপাতত কিছুদিন সুধাদের কাছেই কাটাবে। তারপর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আলাদা ব্যবস্থা করে নেবে।
ঘরের ভেতর নৈঃশব্দ্য নেমে এসেছিল।
এবার অবনীমোহন বললেন, তখন ওই তেত্রিশ হাজার টাকার বিষয়ে আলোচনা করতে করতে অন্য কথা এসে গেল। তোমরা কেউ তো টাকাটা নিতে রাজি না। কিন্তু ওটার বন্দোবস্ত করা দরকার। আমি একটা কথা ভেবেছি।
কেউ কোনও প্রশ্ন করল না। উৎসুক চোখে তাকিয়ে রইল।
অবনীমোহন থামেননি, এখন হয়তো তোমাদের আপত্তি রয়েছে। পরে মত বদলেও যেতে পারে। চিন্তা করে দেখলাম টাকাটা তোমাদের তিনজনের নামে ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খুলে রেখে যাব। পরে তোমরা যা ভাল বুঝবে তা-ই কোরো।
আনন্দ নিচু গলায় বলল, ঠিক আছে, আপনার যখন সেরকম ইচ্ছে তাই করুন।
অবনীমোহন বললেন, আমার আরও কিছু কথা আছে।
বলুন–
তোমরা জানো, যুদ্ধের আমলে রাজদিয়ায় মজিদ মিঞার কাছ থেকে তিরিশ কানি ধান-জমি কিনে চাষবাস শুরু করেছিলাম। তারপর তো কনট্রাক্টরি করতে আসামে গেলাম। সুধা-সুনীতির বিয়ের সময় মাঝখানে একবারই মাত্র রাজদিয়ায় যাওয়া হয়েছিল। যুদ্ধ থামলে সোজা চলে এলাম কলকাতায়
অবনীমোহনের বক্তব্য ঠিক ধরতে পারছিল না আনন্দরা। তারা তাকিয়েই থাকে।
অবনীমোহন সবিস্তার জানালেন, কবছর আসামে এবং পরে কলকাতায় কাটানোর কারণে রাজদিয়ার জমিজমা কী অবস্থায় আছে, সে-সম্বন্ধে তাঁর ধারণা নেই। তাছাড়া যৌবনের শুরু থেকে ঊর্ধ্বশ্বাসে একবার এদিকে একবার সেদিকে দৌড়তে দৌড়তে হঠাৎ গতিপথ পুরোপুরি বদলে গেল। জীবনে কত কী-ই তো করেছেন! অধ্যাপনা। ব্যবসা। কন্ট্রাক্টরি। চাষবাস। কিন্তু কোনও কিছুই দীর্ঘকাল তাঁকে আটকে রাখতে পারেনি। এটা ছেড়ে ওটা, ওটা ছেড়ে সেটা, সেটা ছেড়ে অন্য একটা এভাবেই কেটে গেছে জীবনের বেশির ভাগটাই। লম্বা দৌড়ের পর পরমায়ুর শেষ মাথায় পৌঁছে স্থিত হয়েছেন অবনীমোহন। এখন তার একটাই পথ, একটাই গন্তব্য। ধর্ম, গুরুদেব এবং তার আশ্রম। গৃহী জীবনের সমস্ত চিন্তা পেছনে ফেলে তিনি কলকাতা থেকে চলে যেতে চান। বাড়ি বিক্রি, ঋণশোধ–সব ব্যবস্থাই হয়ে গেছে। বিনয় চাকরি পেয়েছে। সেদিক থেকে তার দুর্ভাবনার অবসান ঘটেছে। বাকি শুধু রাজদিয়ার ওই তিরিশ কানি জমি।
অবনীমোহন বিনয়কে জিজ্ঞেস করলেন, আমি আসামে চলে যাবার পর আমাদের জমিগুলো কি এমনিই পড়ে থাকত?
বিনয় বলল, না, তোক দিয়ে নিজের জমিজমার সঙ্গে দাদু ওগুলোও চাষ করাতেন। এ কবছর ধান-পাট বিক্রি করে বেশ কিছু টাকা পাওয়া গেছে। সে-সব দাদুর কাছে আছে।
পাকিস্তানে যা চলছে ওই টাকা ইন্ডিয়ায় নিয়ে আসা এখন অসম্ভব। সে যাক, আমি অন্য একটা কথা ভাবছিলাম।
বিনয় দুচোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকায়।
অবনীমোহন বললেন, জমিগুলোর দলিল টলিল কার কাছে রয়েছে? তুই কি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিস?
না। ওগুলো দাদুর কাছেই আছে। বিনয় জানায়, যে অবস্থায় তাকে পাকিস্তান ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে, দলিলের কথা তখন মাথায় আসেনি। হেমনাথও সেই সময় এমনই বিচলিত, এতটাই আতঙ্কগ্রস্ত যে অন্য কোনও দিকে তার লক্ষ্য ছিল না। সীমান্ত পেরিয়ে ঝিনুককে নিয়ে নিরাপদে কীভাবে ঘাতকবাহিনীর নজর এড়িয়ে বিনয় ইন্ডিয়ায় পৌঁছবে, সেটাই ছিল একমাত্র চিন্তা। যদি মনে করে হেমনাথ জমিজমার দলিলগুলো সঙ্গে দিতেন, বিপদ শতগুণ বেড়ে যেত। কেননা, পাকিস্তান বর্ডারে ওগুলো ছিনিয়ে নেওয়া হতো।
অবনীমোহন স্বস্তিবোধ করেন, মামাবাবুর কাছে রয়েছে। এ একরকম ভালই হয়েছে। পাকিস্তানে যা চলছে, দলিল কেড়ে নিলে জমিগুলো খুব সম্ভব হাতছাড়া হয়ে যেত। একটু থেমে বললেন, খবরের কাগজে পড়ি, গায়ের জোরে ওখানে মাইনোরিটিদের প্রপার্টি দখল করে নেওয়া হচ্ছে। দলিলগুলো আছে, এটুকুই যা সান্ত্বনা।
বিষয় সম্পত্তি সম্পর্কে অনেক আগেই যিনি মোহমুক্ত হয়েছেন, গৃহী জীবনের সমস্ত স্মৃতি পেছনে ফেলে যিনি চিরকালের মতো গুরুর আশ্রমে যাবার জন্য পা বাড়িয়ে দিয়েছেন, পাকিস্তানের কয়েক কানি জমির ব্যাপারে তিনি যে কেন এত চিন্তিত, কারণটা ঠিক ধরা যাচ্ছে না।
অবনীমোহন অবশ্য সব বিশদ করে বুঝিয়ে দিলেন। আপাতত রাজদিয়ার জমিগুলো হেমনাথের রক্ষণাবেক্ষণে যেমন আছে তেমনই থাক। পরে পাকিস্তানের অবস্থা যদি আদৌ ফেরে, সুদিন আসে, বিনয়, হিরণ এবং আনন্দ দেশে গিয়ে বা হেমনাথকে চিঠি লিখে তার পরামর্শমতো ওগুলোর ব্যবস্থা। করতে পারে। অবনীমোহন বলতে লাগলেন, তিনজনের পক্ষে একসঙ্গে যদি যাওয়া সম্ভব না হয়, আমি এমনভাবে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিয়ে যাব, যাতে যে-কেউ গিয়ে জমি বিক্রি করে আসতে পারবে। অবশ্য এতে পাকিস্তানে কাজ হবে কি না জানি না। তবে একটা কথা মনে রেখো, কেউ প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে রাজদিয়ায় যাবে না।
বিনয়রা উত্তর দিল না। ছেলেমেয়ে এবং জামাইদের মুখ দেখে অবনীমোহনের মনে হয় না, সুদূর রাজদিয়ার এক টুকরো ভূখণ্ড নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ আছে।
০৮.
সেই যে হিমঋতুর এক বিকেলে পারিবারিক সভা বসেছিল, তারপর পলকে যেন চারটি দিন কেটে গেল। এর মধ্যে রাধেশ্যাম জালানের নামে বাড়ি রেজিস্ট্রি হয়ে গেছে। বিনয়ের নামে রাজদিয়ার জমিজমা সম্পর্কে পাওয়ার অফ অ্যাটর্নির বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন অবনীমোহন। তারপরও একটা সমস্যা দেখা দিয়েছিল। ভবানীপুরের তেতলা বাড়িটা জুড়ে সেকেলে ভারী ভারী প্রচুর আসবাব। সবই মেহগনি কাঠের। কত কাল ধরে কত যত্নে তিনি আর সুরমা এ-সব তৈরি করিয়েছিলেন! কত সুখস্মৃতি যে ওগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে।
অবনীমোহনের ইচ্ছা ছিল, সুধা আর সুনীতি ভাগ করে আপাতত আসবাবগুলো নিক। পরে। বিনয় বিয়ে-টিয়ে করে ঘর-সংসার পাতলে সে যদি এইসব খাট আলমারি থেকে কিছু পছন্দ টছন্দ। করে নিতে চায়, দুই বোন তা দিয়ে দেবে।
এই বিলি-ব্যবস্থায় প্রচণ্ড আপত্তি বিনয়ের। বাবার প্রতি তার তীব্র অভিমান। হেমনলিনীর মতো তিনিও ঝিনুকের সঙ্গে যে নির্দয় আচরণ করেছেন তাতে তার কোনও কিছুই সে নেবে না। একটি কপর্দকও নয়। অবশ্য অবনীমোহনের মুখের ওপর সে-কথা না বললেও, সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে।
সুধা এবং সুনীতিরও প্ৰরল অনিচ্ছা। যে-অবনীমোহন তাদের ত্যাগ করে চলে যাচ্ছেন তার টাকা পয়সা বা অন্য কোনও কিছুর ভগ্নাংশও তারা ছুঁতে চায় না। তাছাড়া, সুধার ভাড়া বাড়িটা দোতলা হলেও বেশ ছোট। তার নিজেরই নানা জিনিসে বোঝাই। এর ভেতর বড় বড় খাট আলমারি নিয়ে কোথায় তুলবে? সুনীতি অবশ্য সে সমস্যা নেই। তাদের বিশাল বাড়ি। কিন্তু আনন্দ, বিশেষ করে হেমনলিনী চান না, ছেলের শ্বশুরবাড়ির পুরানো, ব্যবহার-করা আসবাব তাঁর বাড়িতে ঢুকুক। শেষ পর্যন্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও তিনি রাজি হয়েছেন। একতলার দুটো ফাঁকা ঘরে কিছুদিনের জন্য ওগুলো গাদাগাদি করে রাখা হবে। আনন্দদের বাড়িতে মালপত্র পাঠিয়েও দেওয়া হয়েছে।
যাবতীয় আয়োজন শেষ। খগেন এবং অবনীমোহনের টিকেট কাটা হয়ে গেছে। আজ তারা সন্ধের ট্রেনে হরিদ্বার চলে যাবেন।
বিনয় আপাতত ভবানীপুরের বাড়িতেই আছে। বিকেলে আনন্দ সুনীতি সুধা আর হিরণ চলে এল। তারা সবাই অবনীমোহনের সঙ্গে হাওড়ায় গিয়ে তাদের ট্রেনে তুলে দিয়ে আসবে। অবনীমোহনের ইচ্ছা ছিল না। কষ্ট করে কারও স্টেশনে যাবার দরকার নেই। কিন্তু তার আপত্তিতে কেউ কান দেয়নি।
রাধেশ্যাম জালানকে আসতে বলেছিলেন অবনীমোহন। তিনিও এসে গেছেন। বাড়ির চাবি তার হাতে দিয়ে খগেনকে দিয়ে দুটো ট্যাক্সি ডাকানো হল। মালপত্র সামান্যই। একটা মাঝারি চামড়ার সুটকেসে অবনীমোহনের খানকতক জামাকাপড়, কটি ধর্মগ্রন্থ এবং টুকিটাকি ছোটখাটো জিনিস। আর আছে হোল্ড-অলে বাঁধা বিছানা। খগেনেরও গোটা দুই পুঁটলি হয়েছে। সব একটা ট্যাক্সির ডিকিতে ভরা হলে সেটায় উঠলেন অবনীমোহন। পেছনের সিটে তার দুপাশে বসেছে সুধা আর সুনীতি। সামনের সিটে ড্রাইভারের পাশে বিনয়। দ্বিতীয় ট্যাক্সিটায় আনন্দ, হিরণ এবং খগেন।
ছেলেবেলা থেকেই সুধার বড় বেশি আবেগ। অবনীমোহন সব মায়া, সব বন্ধনের গিটগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে চিরকালের মতো চলে যাচ্ছেন। ট্যাক্সিতে ওঠার পর থেকে অঝোরে কেঁদে চলেছে সুধা। কান্নার দমকে সারা শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে বুক। সুনীতির স্বভাবটা চাপা ধরনের। সেও কাঁদছে, কিন্তু শব্দহীন। চোখ দুটো ফোলা ফোলা, টকটকে লাল এবং সজল।
বিনয় উইন্ডস্ক্রিনের বাইরে রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিল। নিমেষের জন্যও পেছন ফিরে দেখছিল না। অবনীমোহনের প্রতি তার সুতীব্র ক্ষোভ। বুকের ভেতর কত যে অভিযোগ পুঞ্জীভূত হয়ে আছে। কিন্তু এই মুহূর্তে সে-সব উধাও। জগতে এই মানুষটির সঙ্গে তার সম্পর্ক সব চেয়ে নিবিড়। এরই রক্ত তার শিরায় শিরায় বয়ে চলেছে। এরকম নিকটজন আরও একজন ছিলেনমা। তিনি তো রাজদিয়ায় চিতাভস্মে কবেই বিলীন হয়ে গেছেন। বাবার সঙ্গে এ-জীবনে আর হয়তো কখনও দেখা হবে না।
বিনয় পুরুষমানুষ। সুধার মতো হাউ হাউ করে কাঁদতে পারে না। কিন্তু বুকের ভেতর থেকে কান্না উথলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ঠোঁটে ঠোঁট টিপে প্রাণপণে সেটা রুখে দিচ্ছিল সে।
অবনীমোহন মেরুদণ্ড টান টান করে স্থির হয়ে বসে আছেন। চিরবিদায়ের আগে মেয়েদের কান্না বা বিনয়ের থমথমে চেহারা তাকে কতখানি চঞ্চল করেছে, বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। আবেগহীন সুরে মাঝে মাঝে তিনি বলে উঠছেন, কেঁদো না, কেঁদো না।
পৌনে ছটায় ট্রেন। মিনিট কুড়ি আগেই হাওড়ায় পৌঁছে গেলেন অবনীমোহনরা। রিজার্ভ করা বার্থ খুঁজে বার করতে বেশি সময় লাগল না।
সুধা-সুনীতি হোল্ড-অল খুলে যত্ন করে বিছানা পেতে অবনীমোহনকে বসালো। হিরণ আর আনন্দ তার সুটকেস এবং অন্য টুকিটাকি জিনিস বাঙ্কে রেখে দিল।
অবনীমোহনের সামনের বার্থটা খগেনের। সে তার পোঁটলা দুটো বাঙ্কের মাথায় রেখে একধারে দাঁড়িয়ে আছে। সুধারা তার বার্থে বসে পড়ল।
ধরা ধরা গলায় সুনীতি খগেনকে বলল, তুমি তো বাবার সঙ্গে থাকবে
খগেন ঘাড় কাত করল, হ্যাঁ বড়দি
দেখো, বাবার যেন কোনওরকম অসুবিধে না হয়–
খগেন জানায়, না, হবে না। পাঁচ বছর সে অবনীমোহনের সঙ্গে আছে। ছায়ার মতো। সেবাযত্নের কখনও ত্রুটি হয়নি। ভবিষ্যতেও হবে না।
হিরণ অবনীমোহনকে বলল, একেবারে ভুলে গিয়েছিলাম। আপনার হরিদ্বারের ঠিকানাটা নেওয়া হয়নি। পকেট থেকে কলম আর এক টুকরো কাগজ বার করল সে।
অবনীমোহন জিজ্ঞেস করলেন, ঠিকানা নিতে চাইছ কেন?
হিরণ থতিয়ে গেল, কোনও দরকার হলে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব। সেই জন্যে
অবনীমোহন বললেন, হরিদ্বারের ঠিকানা নিয়ে লাভ নেই। কতদিন সেখানে থাকব, জানি না। গুরুদেব হয়তো কনখল কি উত্তরকাশীর আশ্রমে পাঠিয়ে দেবেন। তেমন বুঝলে আমিই তোমাদের চিঠি লিখব।
বিনয় বাবাকে লক্ষ করছিল। মনে হল, অবনীমোহন তাদের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে দিতে চান, চিরতরে। ঠিকানা না দেবার কারণ সেটাই। তাছাড়া তার ধারণা, বাবা বললেন বটে, কিন্তু কোনওদিনই হয়তো চিঠি লিখবেন না।
ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে এসেছিল। অবনীমোহন বললেন, আর বসে থেকো না, তোমরা গাড়ি থেকে নেমে যাও।
প্ল্যাটফর্মে নেমে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থাকে সবাই। বিষণ্ণ। নীরব। চোখেমুখে সীমাহীন ব্যাকুলতা।
একসময় গার্ডের হুইসিল শোনা গেল। কয়লার ইঞ্জিন তীক্ষ্ণ সিটি বাজিয়ে সারা স্টেশন চকিত– করে স্টার্ট দিল। ধীর গতিতে বিশাল সরীসৃপের মতো ট্রেনটা প্ল্যাটফর্ম পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে লাগল।
যতক্ষণ অবনীমোহনকে দেখা যায়, হাত নাড়তে থাকে সুধারা। অবনীমোহনও জানালার পাশে বসে হাত নাড়ছিলেন। খানিক পরে দূরে সবুজ আলো জ্বালিয়ে যে ডিসটান্ট সিগনালগুলো নতমস্তকে দাঁড়িয়ে আছে, সেগুলোর পাশ দিয়ে ট্রেনটা অন্ধকারে উধাও হয়ে গেল। অবনীমোহনের জীবনের নানা পর্ব শেষ। এবার অন্তিম পর্বের দিকে তাঁর চিরতরে প্রস্থান।
ট্রেন মিলিয়ে যাবার পরও প্ল্যাটফর্মে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল বিনয়রা। তারপর ভারী গলায় হিরণ বলল, এবার ফেরা যাক।
আগেই ঠিক করা আছে, স্টেশন থেকেই হিরণ আর সুধা বিনয়কে সোজা তাদের টালিগঞ্জের বাড়িতে নিয়ে যাবে। আনন্দ আর সুনীতি চলে যাবে বিডন স্ট্রিটে।
স্টেশনের ঠিক বাইরে একধারে ট্যাক্সি স্ট্যান্ড। তার গা ঘেঁষে আলাদা আলাদা ঘোড়ার গাড়ি আর রিকশার জটলা।
আনন্দ সুধাদের বলল, তোমাদের অনেক দূর যেতে হবে। একটা ট্যাক্সি নাও। তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাবে।
হিরণ বলল, তাই ভেবে রেখেছি। আপনারা?
আমরা ঘোড়ার গাড়ি নেব। হ্যারিসন রোড আর সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ ধরে গেলে বিডন স্ট্রিটে। যেতে বেশিক্ষণ লাগবে না। চল, আগে তোমাদের ট্যাক্সি ধরিয়ে দিই ।
স্ট্যান্ডে লাইন দিয়ে ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে ছিল। তার একটায় সুধাদের তুলে দিয়ে বিব্রতভাবে আনন্দ বলল, বিনু, বলার মুখ নেই তবু একটা অনুরোধ করছি। যদি কখনও তোমার ইচ্ছে হয়, আমাদের বাড়ি চলে এস।
বিনয় উত্তর দিল না। আনন্দকে সে আগেই জানিয়ে দিয়েছে, ওদের বাড়িতে আর কখনও যাবে না। সেই সিদ্ধান্ত তড়িঘড়ি বদলাবার কোনও কারণ নেই।
ট্যাক্সি ছেড়ে দিলে আনন্দরা ঘোড়ার গাড়ির আস্তানার দিকে চলে গেল।
০৯.
এবার সুধাদের বাড়ি আসার পর বিনয়ের কোনও ব্যাপারেই যেন চাড় নেই। শরীর আর মন জুড়ে বিচিত্র এক জড়তা। শুধু তা-ই না, সেই সঙ্গে অসীম ক্লান্তি। চরম অবসাদ। মা তো কবেই চলে গেছেন। ঝিনুক নিরুদ্দেশ। এরা দুজনে জীবনের অনেকখানি অংশ ফাঁকা করে দিয়ে গেছে। অবনীমোহনের প্রতি তার প্রবল বিতৃষ্ণা। তবু তিনি হরিদ্বারে চলে যাবার পর আর-এক দিকে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। এই মানুষটার সঙ্গে অনেকগুলো বছর যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু তিনি যে শিরায় স্নায়ুতে, সমস্ত অস্তিত্বে, শত বন্ধনে জড়িয়ে ছিলেন, এখন সেটা টের পাওয়া যাচ্ছে।
একে একে প্রিয়জনেরা দূরে সরে যাচ্ছে। মা। বাবা। ঝিনুক। বাকি রয়েছে দুই দিদি। কিন্তু তারাও তো অন্যের স্ত্রী। বিনয়ের প্রতি তাদের অপার মায়া, গভীর সহানুভূতি। তবু অস্বীকার করার উপায় নেই, তারাও অনেকটাই পর হয়ে গেছে। সুনীতির মাথার ওপর রয়েছেন হেমনলিনী। তার দাপট, তার কর্তৃত্বের কাছে সারাক্ষণ সে তটস্থ হয়ে থাকে। শ্বশুরবাড়িতে সুনীতির ক্ষমতা আর কতটুকু! ইচ্ছা থাকলেও সে কি ঝিনুককে বাড়িতে রাখতে পেরেছে? সুধা অবশ্য দুহাত দিয়ে ঝিনুককে আগলে রেখেছিল। কিন্তু তার দাদাশ্বশুর আর জেঠশাশুড়ি বাড়িতে থাকলে কতটা কী করতে পারত, বলা মুশকিল। এই যে হিরণরা তাকে এভাবে এখানে নিয়ে এসেছে, পাটনা থেকে দ্বারিক দত্তরা ফিরে এলে তারা এটা কতখানি ভাল চোখে দেখবেন, কে জানে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেলে তাদের স্বত্ব বাপের বাড়ির লোকজনদের হাতছাড়া হয়ে যায়। অবশ্য অফিসে জয়েন করার পর সাত দিনও সে এখানে থাকবে না। অন্যের করুণার ওপর নির্ভর করতে হবে ভাবলেই ভীষণ অস্বস্তি হয় বিনয়ের।
অবনীমোহন পুরানো সব বন্ধন ছিঁড়ে গুরুর আশ্রমে চলে যাবেন, আগেই তা স্থির হয়ে ছিল। এটা আকস্মিক কোনও ঘটনা নয়। তবু সত্যিই যখন তিনি চলে গেলেন সেই ধাক্কাটা তীব্রভাবে নাড়া দিয়ে গেছে হিরণ এবং সুধাকেও।
সুধা চিরকালই চুলবুলে। সদা চঞ্চল। সারাক্ষণ চারপাশে কলরোল তুলে হাওয়ায় উড়তে থাকে। হিরণও খুব আমুদে। হাসিখুশি। কখনও কখনও হুল্লোড়বাজ। কিন্তু ওরাও কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছে। বাড়ির আবহাওয়া ম্রিয়মাণ। মলিন। বিষাদ-মাখানো।
কিন্তু শোক, দুঃখ বা মানসিক আঘাতের তীব্রতা চিরস্থায়ী হয় না। ধীরে ধীরে জাগতিক নিয়মেই তার উপশম ঘটে।
তিনদিনের দিন সকালবেলা চা খেয়ে, বাসি জামাকাপড় পালটে বিনয় বলল, হিরণদা, ছোটদি, আমি একটু বেরুচ্ছি।
মাঝখানের দুটো দিন শুয়ে বসে, অস্থিরভাবে পায়চারি করে বা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে অন্যমনস্কর মতো আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে কাটিয়ে দিয়েছে বিনয়। কিন্তু দোতলার কটা কুঠুরির ভেতর আটকে থাকতে আজ আর ভাল লাগছে না। বড় বেশি একঘেয়ে মনে হচ্ছে। ভীষণ ক্লান্তিকর।
সুধা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, কোথায় যাবি?
বিনয় বলল, এই একটু ঘুরে টুরে আসি।
সুধা কী বলতে যাচ্ছিল, তাকে থামিয়ে দিল হিরণ, ঘুরেই আসুক। মন খারাপ করে ঘরে বসে থাকার মানে হয় না।
সুধা বলল, বেশি দেরি করিস না।
আচ্ছা–
ট্রাম রাস্তায় এসে ফুটপাথ ধরে টালিগঞ্জ রেল ব্রিজের দিকে হাঁটতে লাগল বিনয়। বিশেষ কোনও গন্তব্য নেই। কেমন যেন দূরমনস্ক। লক্ষ্যহীন।
ঝিনুক নিখোঁজ হবার পর কটা দিন উদভ্রান্তের মতো এই শহরের বড় বড় রাস্তা এবং জিলিপির প্যাঁচ-লাগা অগুনতি অলিগলিতে ছুটে বেড়িয়েছে বিনয়। তার উদ্যম প্রায় শেষ। উদ্দীপনা স্তিমিত। আশাও প্রায় বিলীন। ক্রমশ সে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, ঝিনুককে আর কখনও পাওয়া যাবে না। বৃথাই কলকাতার পথে পথে ঘুরে জীবনীশক্তিকে ক্ষয় করে ফেলা।
হাঁটতে হাঁটতে কখন সাদার্ন অ্যাভেনিউর কাছাকাছি চলে এসেছে, খেয়াল নেই। আচমকা রামরতন গাঙ্গুলির মুখটা মনে পড়ে গেল। জামতলির বৃদ্ধ, শ্রদ্ধেয় মাস্টারমশাইটি প্রায় সমস্ত জীবন জাতিগঠনের কাজে কাটিয়ে দিয়েছেন। শেষ বয়সে শরীর যখন অশক্ত, জরার ভারে পিঠ নুয়ে পড়েছে, সেই সময় এক কাপড়ে পাকিস্তান থেকে তাঁকে ভয়ে আতঙ্কে পূর্বপুরুষের বাসভূমি ছেড়ে ইন্ডিয়ার দিকে পা বাড়াতে হয়েছিল। সম্পূর্ণ নিঃস্ব। মাথার ওপর পাষাণভারের মতো বৃদ্ধা স্ত্রী, এক বিধবা এবং দুই তরুণী মেয়ে। তখন সারাক্ষণ মৃত্যুভয়। জলেস্থলে ঘাতকবাহিনী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এই বুঝি মারণাস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল! এই বুঝি দুই যুবতী মেয়েকে কেড়ে নিয়ে গেল!
রাজদিয়ার আশু দত্তর সঙ্গে রামরতনের অনেকটাই মিল। তবে রামরতনের সমস্যা অনেক জটিল। তার স্ত্রী আছেন, তিন মেয়ে আছে। সেদিক থেকে আশু দত্ত প্রায় ঝাড়া হাত-পা। বৃদ্ধা অথর্ব মা ছাড়া তাঁর কেউ নেই।
তারপাশার স্টিমারঘাটে রামরতনদের সঙ্গে বিনয়ের প্রথম আলাপ। স্টিমারের ডেকে গাদাগাদি ভিড়ে শয়ে শয়ে সর্বস্ব খোয়ানো শরণার্থীর সঙ্গে তারা এসেছিল গোয়ালন্দে। তারপর কলকাতার ট্রেন ধরেছিল। কিন্তু পাকিস্তানের সীমান্ত পেরিয়ে ইন্ডিয়ায় পৌঁছনো আর হল না। জীবন্ত রামরতন আসতে পারেননি, এসেছিল তার নিষ্প্রাণ শরীর। পথেই তার যাবতীয় যন্ত্রণা আর দুর্ভাবনার অবসান ঘটে গেছে।
শিয়ালদায় রামরতনের ভাইপো বিমলকে বিনয় কথা দিয়েছিল, খুব শিগগিরই একদিন তাদের বাড়ি যাবে। কিন্তু শোকাতুর মানুষগুলোর কথা ভাবার মতো সময়ই পাওয়া যায়নি। কলকাতায় পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে কত কিছুই না ঘটে গেল। সুনীতিদের বাড়ি গিয়ে ঝিনুকের চরম লাঞ্ছনা, সুধাদের কাছে আশ্রয় পাওয়া, খবরের কাগজে আনন্দর চাকরি জোগাড় করে দেওয়া, তীর্থস্থান থেকে অবনীমোহনের ফিরে আসা, ভবানীপুরের বাড়ি বিক্রি, ঝিনুকের প্রতি অবনীমোহনের হৃদয়হীন আচরণ, জনমদুখিনী মেয়েটার নিখোঁজ হওয়া, চিরকালের মতো অবনীমোহনের গুরুর আশ্রমে চলে যাওয়া। একের পর এক ঘটনা। একের পর এক সংকট। এ-সবের বাইরে তার চিন্তায় আর কিছুই ছিল না।
অঘ্রানের এই সকালে নরম শীতল রোদে যখন চারদিক ভরে আছে, উত্তুরে হাওয়ার দাপট টের পাওয়া যাচ্ছে প্রতি মুহূর্তে, সেই সময় রামরতনের স্ত্রী এবং তার মেয়েদের জন্য এক ধরনের আকুলতা অনুভব করে বিনয়।
এখনও অফিস টাইমের ভিড় শুরু হয়নি। ট্রাম বাস বেশ ফাঁকা ফাঁকা। রাস্তার ওপারে গিয়ে একটা দোতলা বাসে উঠে পড়ল বিনয়। ওটার দৌড় বালিগঞ্জ থেকে শ্যামবাজার।
বিমলদের ঠিকানা তার স্পষ্ট মনে আছে। তিরিশ নম্বর মদন বড়াল লেন। রামরতন গোয়ালন্দগামী স্টিমারের ডেকে পাশাপাশি বসে বিশদভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, শ্যামবাজারে চিত্রা সিনেমার পাশ দিয়ে মিনিট দুই হাঁটলেই বাঁ দিকের গলিটাই মদন বড়াল লেন।
দোতলা বাসটা আধ ঘণ্টার মধ্যে চিত্রা সিনেমার সামনে বিনয়কে পৌঁছে দিল। তারপর বিমলদের বাড়িটা খুঁজে বার করতে বেশিক্ষণ লাগল না।
এলাকাটা পুরানো এবং ঘিঞ্জি। গায়ে গায়ে সব বাড়ি। সবই সাদামাঠা, কারুকার্যহীন। কোথাও পাঁচ ইঞ্চি জায়গা ফাঁকা নেই। তবে আশেপাশে কোনও বস্তি টস্তি চোখে পড়ছে না।
বিমলদের বাড়িটা তেতলা। সদর দরজা হাট করে খোলা। রাস্তা থেকেই টের পাওয়া যায়, ভেতরে প্রচুর লোকজন। তাদের চলাফেরা, টুকরো টুকরো কথাবার্তা এবং বাসনকোসনের আওয়াজ ভেসে আসছে। সূর্যোদয় হয়েছে অনেক আগেই। আনকোরা একটা দিন। ঘর-গেরস্থালির ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে।
বিনয় গলার স্বর উঁচুতে তুলে ডাকতে লাগল, বিমলবাবু–বিমলবাবু–
খানিক পরে দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো বিমল নয়, রামরতনের মাঝবয়সী বিধবা মেয়ে বাসন্তী। বিনয়কে দেখে চকিতে তার চোখেমুখে চাপা আলোর মতো কিছু খেলে যায়। ব্যগ্র সুরে সে বলে, রোজই ভাবি আপনে আইবেন। কিন্তুক আহেন আর না। মায় (মা), আমি আর আমার দুই বইনে। রাস্তার দিকে তাকাইয়া থাকি। পরে ভাবলাম, পথের আলাপ। কে আর কারে মনে রাখে। চোখের আবডাল হইলে সগলে ভুইলা যায়—
তারপাশা থেকে কলকাতায় আসার সময় দেড় দিনেরও বেশি সময় তাদের একসঙ্গে কেটেছে। বিনয়ের মনে হয়েছিল, মহিলা স্বল্পভাষী। সারাক্ষণই বিমর্ষ। ম্রিয়মাণ। কিন্তু আজ প্রচুর কথা বলছে। বেশ অবাকই হল সে। বিব্রতভাবে কিছু একটা কৈফিয়ৎ দিতে চেষ্টা করে, কিন্তু তার আগেই হয়তো বাসন্তীর খেয়াল হয়, বিনয়কে বাড়ির বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। ব্যস্তভাবে বলল, আহেন, ভিতরে আসেন। আপনেরে আমাগো বড় দরকার–
বাসন্তীর পিছু পিছু বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে সামান্য অস্বস্তি বোধ করে বিনয়। বিমল বাসন্তীর খুড়তুতো ভাই। নিজের পরিজনেরা থাকতে কেন তাকেই ওদের প্রয়োজন, কেন তার জন্য ওরা অপেক্ষা করে আছে, কে জানে।
১০.
সদর দরজা পেরুলেই মস্ত চাতাল। কোনও এক কালে, হয়তো পঞ্চাশ কি ষাট বছর আগে, ওটা যত্ন করে বাঁধানো হয়েছিল। চাকলা চাকলা সিমেন্ট উঠে এখন এবড়ো খেবড়ো, নানা জায়গায় ইট বেরিয়ে পড়েছে।
চাতালটার একধারে তিনটে এজমালি জলের কল। দুটো পরিষ্কার, জীবাণুমুক্ত জলের। টালার মস্ত ট্যাঙ্ক থেকে ওই জলটা দিনে তিনবার সাপ্লাই করা হয়। সকালে, দুপুরে এবং বিকেলে। খাওয়া, স্নান, রান্নাবান্না–সব এই জল দিয়ে। তৃতীয় কলটা গঙ্গাজলের। দিনরাত ওটা পাওয়া যায়। সরবরাহে কোনও ছেদ নেই। এই জলটা ঘর ধোওয়া, বাসন মাজা ইত্যাদি মোটা কাজের জন্য ভীষণ জরুরি। মাসখানেকের মতো কলকাতায় কাটানোর ফলে এই শহরের ওয়াটার সাপ্লাই সম্বন্ধে মোটামুটি একটা ধারণা হয়ে গেছে বিনয়ের।
সে জানে, সকালের দিকটায় এই মহানগরের লোকজনের ভীষণ ব্যস্ততা। তখন বাড়ির গিন্নিদের রান্নার তাড়া। ছেলেমেয়েদের স্কুল-কলেজে যাবার তাড়া। বাড়ির কর্তাদের অফিসে যাবার তাড়া। যাদের দোকান বা অন্য ব্যবসাপত্তর আছে তাদের বেরুবার তাড়া।
ভেতরে পা দিয়েই বিনয় আঁচ করে নিল, গোটা তেতলা বাড়িটা আগাপাশতলা ভাড়াটেতে ঠাসা। কলতলায় এখন মেলা বসে গেছে। বড় বড় টিনের বালতি, গামলা, ডেকচি নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে অনেকে। বিশেষ করে নানা বয়সের মেয়েরা। কিশোরী, যুবতী এবং মাঝবয়সী গিন্নিবান্নিরা তো আছেই, বেশ কজন পুরুষকেও দেখা গেল। কে আগে জল নেবে, কার বেরুবার বেশি তাড়া, এই নিয়ে রীতিমতো বচসাও চলছে। ওদিকে তিনটে পায়খানার সামনেও লাইন। কয়েকজন জলের বালতি এবং মগ নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে নিম্নগামী বেগ সামলাচ্ছে। বাসন্তী যে একটি অচেনা যুবককে বাড়িতে নিয়ে এসেছে, এই মুহূর্তে তার দিকে কারও লক্ষ্য নেই।
ঘরে ঘরে কয়লার উনুন ধরানো হয়েছে। চারপাশে শুধু ধোঁয়া আর ধোঁয়া। একতলায়, দোতলায়, তেতলায়–সর্বত্র।
চাতালটা ঘিরে সারি সারি ঘর। সেগুলোর সামনে দিয়ে টানা, চওড়া বারান্দা।
চাতালের আধাআধি পেরিয়ে ডান পাশে যেতে যেতে বাসন্তী ডাকতে লাগল, মা মা, দ্যাখো ক্যাঠা (কে) আইছে।
কোণের দিকের একটা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন রামরতনের স্ত্রী। তার দিকে চোখ পড়তেই বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠে বিনয়ের। হৃৎস্পন্দন পলকের জন্য থমকে যায়। শিয়ালদা স্টেশনে শেষ তাকে দেখেছে সে। স্বামীর মৃতদেহ আগলে অঝোরে কাঁদছিলেন। তখনও তার পাকা চুলের সিঁথিতে ডগড়গে সিঁদুরের টান। কপালে মস্ত সিদুরের টিপ। হাতে ধবধবে শাখা, লাল পলা আর রুপো-বাঁধানো লোহা। পরনে লাল-পাড় শাড়ি। আর এখন? সিঁদুর নেই। শাখা নেই। লোহা নেই। গায়ে সাদা ফ্যাটফেটে সেমিজ আর থান। কদিনে বৃদ্ধা আমূল বদলে গেছেন। যেন অচেনা এক বিষাদপ্রতিমা। তার এই চেহারা চোখে শেল বেঁধাতে থাকে বিনয়ের।
তাকে দেখে হঠাৎ যেন একটু উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠেন রামতরনের স্ত্রী, আসো বাবা, আসো,
পাশের একটা ঘর থেকে ছায়া আর মায়াও বেরিয়ে এসেছিল। কেমন যেন জড়সড়, ত্রস্ত। চকিতের জন্য বিনয়ের মনে হয়, ওরা কি এখানে ভাল নেই? লক্ষ করল, তাকে দেখে দুই তরুণীর মুখে ক্ষীণ আভা ফুটে উঠেছে।
বিনয় খুব অবাকই হয়। বাসন্তী জানিয়েছে ছায়া-মায়া এবং তাদের মা বিমলের বাসায় আসার পর থেকে তার জন্য অধীরভাবে দিন গুনে যাচ্ছে। ভাবনায় আবছা একটা ছায়া পড়ে। এই চার রমণীর তার কাছে কি কোনও প্রত্যাশা আছে?
একটা ছোট ঘরে বিনয়কে এনে বসানো হয়। খুবই সাধারণ সাজসজ্জা। খানচারেক সস্তা চেয়ার, একটা নিচু চৌকো টেবল, সেকেলে ধাঁচের কাঁচের আলমারিতে বঙ্কিমচন্দ্র রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্র এবং আধুনিক লেখকদের কিছু বই, দেওয়ালে ইংরেজি-বাংলা মেশানো বড় মাপের ক্যালেন্ডার, একধারে সুজনি-ঢাকা সরু তক্তপোশ, মাথার ওপর লম্বা উঁটিওলা মান্ধাতার আমলের ফ্যান।
বাসন্তীরা দাঁড়িয়ে আছে। বিনয় বলল, আমি তো বসে পড়লাম। আপনারাও বসুন–
অনেক বলার পর রামরতনের স্ত্রীই শুধু কুণ্ঠিতভাবে একটা চেয়ারে বসলেন। মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বললেন, যা, বিনয়ের লেইগা চা কইরা লইয়া আয়–
বিনয় আপত্তি করতে যাচ্ছিল, তার আগেই ছায়া মায়া ছুটে বেরিয়ে গেছে।
এদিক সেদিক তাকিয়ে বিনয় জিজ্ঞেস করল, আপনারাই শুধু রয়েছেন। বিমলবাবুকে তো দেখছি না। তিনি কোথায়?
বৃদ্ধা বললেন, বিমল গ্যাছে র্যাশনের দোকানে। র্যাশন তুইলা, বাজার কইরা ফিরব। আইজ হ্যায় (সে) অফিস যাইব না। অর (ওর) বউ হের (তার) পোলামাইয়া লইয়া সখের বাজারে বাপের বাড়িত গ্যাছে। আইজ আর ফিরব না।
কথায় কথায় জানা গেল, উত্তর কলকাতার এই পুরানো, বয়স্ক বাড়িটায় সবসুদ্ধ পনেরোটি ভাড়াটে পরিবারের বাস। পরিবার পিছু আড়াই খানা করে ঘর, এক ফালি রান্নার জায়গা আর সামনের দিকের বারান্দার একটা অংশ। সবার সমান ভাড়া। মাসে সাঁইত্রিশ টাকা। বাড়িওলা এ বাড়িতে থাকে না। বেলেঘাটায় তার আরও একটা বাড়ি আছে, সেখানেই থাকে, আর মাসের পাঁচ তারিখে একবার এসে এখানকার ভাড়া আদায় করে নিয়ে যায়। যুদ্ধের আগে থেকে এ-বাড়িতে আছে বিমল। তার এক ছেলে, এক মেয়ে।
রামরতনের স্ত্রী আরও জানান, বিমলের শ্বশুরদের আদি বাড়ি ফরিদপুরের গোপালগঞ্জে। যুদ্ধের ঠিক পরে পরে দেশের পাট চুকিয়ে শ্বশুর সখের বাজারে বাড়ি করেছেন। বুদ্ধিমান মানুষ। অত্যন্ত দূরদর্শী। তখনই আঁচ করেছিলেন, ভবিষ্যতে কলকাতা ছাড়া গতি নেই। সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিলেন তিনি।
বিমলদের এই ভাড়াটে বাড়ি বা তার শ্বশুর সম্পর্কে বৃদ্ধা কেন যে সাতকাহন করে এত কথা বলছেন, বোঝা যাচ্ছে না। নিশ্চয়ই এ-সব শোনাবার জন্য তারা বিনয়ের জন্য প্রতীক্ষা করে ছিলেন না।
ছায়া আর মায়া চা এবং একটা প্লেটে খুব সস্তা বেকারির খানকতক নোনতা বিস্কুট নিয়ে এসেছিল। বিনয় শুধু চায়ের কাপটাই তুলে নিল।
রামরতনের স্ত্রী বললেন, পাকিস্থান থিকা আইনের সময় কইছিলা, তুমার দুই বইন আর বাবা কইলকাতায় আছেন। কার কাছে উঠছ?
এ-শহরে আসার পর যা ঘটে গেছে, সে-সব বাদ দিয়ে সংক্ষেপে বিনয় শুধু বলল, ছোটদির বাড়িতে আছি।
বাবা থাকতে বোনের কাছে কেন থাকে, এ-নিয়ে আর কোনও প্রশ্ন করলেন না বৃদ্ধা। বললেন, চাকরি বাকরি কিছু পাইছ?
বিনয় জানায়, খবরের কাগজে ছোটখাটো একটা কাজ জুটেছে।
রামরতনের স্ত্রী বললেন, ভাল, খুব ভাল। বউমা ক্যামন আছে?
আফজল হোসেন থেকে হরিন্দ কেঁড়াদার, এবং আরও অনেকেই ধরে নিয়েছে ঝিনুক তার স্ত্রী। রামরতনরাও হুবহু তাই ভেবেছেন। অনাত্মীয় অবিবাহিত এক তরুণীকে সঙ্গে নিয়ে কোনও যুবক যে একা একা চলে আসতে পারে, এমনটা কেউ চিন্তাও করতে পারে না। বুকের ভেতর দমাদ্দম হাতুড়ির ঘা পড়তে লাগল বিনয়ের। ঝিনুকের প্রসঙ্গ যে উঠতে পারে, এখানে আসার আগে ঘুণাক্ষরেও তার মাথায় আসেনি।
ধাক্কাটা সামলাতে খানিক সময় লাগল বিনয়ের। সবার ধারণায় স্থির হয়ে যেটা বসে গেছে, এখন আর তা অস্বীকার করা যায় না। তাই বলা গেল না ঝিনুক তার স্ত্রী নয়। এমনকি ঝিনুক যে চিরকালের মতো নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে, তাও জানাতে পারল না বিনয়। ঝাপসা গলায় শুধু বলল, ভালই আছে
একটু চুপচাপ।
তারপর অনুযোগের সুরে রামরতনের স্ত্রী বললেন, তুমার পথ চাইয়া থাইকা থাইকা এক সোময় মনে হইছিল, আমাগো কথা বুঝিন ভুইলাই গ্যাছ। এই জীবনে আর দেখা হইব না। অথচ তুমারে আমাগো যে কত দরকার।
লহমায় বিনয়ের স্নায়ুমণ্ডলী সজাগ হয়ে উঠল। এতক্ষণ যা চলছিল সেগুলো নেহাতই কথার কথা। অনাবশ্যক। অসংলগ্ন। এবার আসল প্রসঙ্গটা উঠবে। বাসন্তী তার ইঙ্গিত আগেই দিয়েছিল। দরকারের কথা সেও বলেছে।
হাত থেকে চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে সোজাসুজি রামরতনের স্ত্রীর দিকে তাকায় বিনয়।
বৃদ্ধা বলতে লাগলেন, বড় ভাল দিনে আইছ। বিমল কি হের (তার) বউ বাড়ি থাকলে পরান খুইলা কথা কইতে পারতাম না।
বিনয় চকিত হয়ে ওঠে। রামরতুনের স্ত্রী কী এমন বলতে চান যা তার ঘনিষ্ঠ পরিজনদের সামনে বলা অসম্ভব?
বৃদ্ধা থামেননি, তুমার মনখান যে কত বড়, মানুষখান যে তুমি ক্যামন, দ্যাশ থিকা আইনের সোময় বুঝতে পারছি। তুমাগো নিজেগোই কত বিপদ, তবু হের (তার) মইদ্যে আমাগো দুই ডানা (ডানা) দিয়া আগলাইয়া পাকিস্থান থিকা ইন্ডিয়ায় লইয়া আইছ। নিজের চৌখে তো দেখছি তুমার মাউসা (মেসো) মশয়রে বাঁচানের লেইগা কী চ্যাষ্টা, কী যত্নই না করছ, আপন জনেরাও হেয়া (তা) করে না।
বিব্রত মুখে বিনয় বলে, এ-সব বলে আমাকে লজ্জা দেবেন না। মানুষের জন্যে মানুষ এটুকু করেই।
বৃদ্ধা জোরে জোরে মাথা নাড়ালেন, কেও করে না বাবা। এক দেখলাম নাসেররে। হ্যায় (সে) পাশে না খাইলে ছায়া আর মায়ারে কি রক্ষা করতে পারতাম? রাইক্ষসেরা অগো (ওদের) কাইড়া লইয়া যাইত। হ্যায় কয়জন জুয়ান পোলারে লইয়া পরি (পাহারা) দিয়া দিয়া তারপাশায় আইনা গোয়ালন্দর ইস্টিমারে তুইলা দিল। নাসেরের পর দেখলাম তুমারে। আমাগো লেইগা কী না করছ! তুমরা দুইজন হইলা সত্যকারের মানুষ। একটু থেমে ফের শুরু করলেন, পাকিস্থান হওনের পর তুমাগো লাখান আমন আর কেওরে দেখলাম না।
সামনাসামনি বসে একটানা প্রশংসা শুনতে শুনতে ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল বিনয়ের। তারই মধ্যে ভাবছিল বৃদ্ধার এত গুণগানের পেছনে গভীর কোনও উদ্দেশ্য আছে।
রামরতনের স্ত্রী কিছুক্ষণ নীরবে বসে রইলেন। তারপর একটু ইতস্তত করে বললেন, বিমল কিছুক্ষণের মইদ্যে র্যাশন বাজার সাইরা ফিরা আসব। হের (তার) আগেই কথাখান সাইরা লই।
উত্তর না দিয়ে তাকিয়েই থাকে বিনয়।
বৃদ্ধা বলতে লাগলেন, মাইয়াগো লইয়া এই বাড়িতে আমরা বড় অশান্তিতে আছি বাবা। পাকিস্থান থিকা আইনের পর বিমলরা খুব যত্ন করত। সারাক্ষণ কাছে কাছে থাকত। তুমার মাউসামশয়ের ছাদ্ধশান্তি ভাল কইরাই করছে। পাঁচজন বামন, শ্মশানবন্ধু আর এই বাড়ির ভাড়াইটাগো পাকা ফলার খাওয়াইছে। কিন্তুক হের পরই অগো, বিশেষ কইরা বিমলের বউ দীপ্তির মতিগতি বদলাইয়া গেল। আমাগো লগে ভাল কইরা কথা কয় না, দিনরাইত মুখ ভার। নিজের মনে গজর গজর করে। আমরা য্যান বোঝা হইয়া অগো কান্ধে চাপছি।
মোটামুটি এরকমই আন্দাজ করেছিল বিনয়। কিন্তু এই পারিবারিক তিক্ততা সম্পর্কে সে কী-ই বা বলতে পারে। তার অস্বাচ্ছন্দ্য বাড়তেই থাকে।
গলার স্বর এবার উঁচুতে তুললেন রামরতনের স্ত্রী, এই বিমলের লেইগা কী না করছি আমরা। ও যহন চাইর পাঁচ বচ্ছরের পোলা হেই সোময় আতশা (আচমকা) কয়দিন আগে-পরে অর (ওর) মায়-বাবায় মইরা গেল। হেই থিকা কোলে-পিঠে কইরা অরে আমরা বড় কইরা তুলছি। মেট্রিক (ম্যাট্রিক পাস করনের পর তুমার মাউসামশয় বিমলরে কইলকাতার কলেজে ভর্তি কইরা, হুস্টেলে রাইখা পড়াইছে। কারে কারে য্যান চিঠি লেইখা চাকরির ব্যবস্তা কইরা দিছে। হেই বিমলের বউ চায় না আমরা এইখানে থাকি। পারলে ঘেটি ধইরা বাইর কইরা দ্যায়। কিন্তুক তিন মাইয়া লইয়া কই যামু আমি? টাকাপয়সার জোর নাই, মাথা গোজনের জাগা (জায়গা) নাই, হের উপুর তুমার মাউসামশয় মারা যাওনে অত বড় শোকটা পাইলাম। পাকিস্থানে বস্যের মাইয়াগো (যুবতী) লইয়া কী বিপদে যে আছিলাম! ইন্ডিয়ায় আইয়া ভাবলাম, বুঝিন বাইচা গ্যাছি। কিন্তুক এইখানে আর-এক বিপদ। কী যে করুম!
সদ্য স্বামী হারিয়েছেন রামরতনের স্ত্রী। শোকাতুরা বৃদ্ধা সেই দুঃখ আর বিহ্বলতা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তার আগেই মাথার ওপর আকাশ শতখান হয়ে ভেঙে পড়েছে। যে নিরাপত্তা আর আশ্রয়ের আশায় পরিজনদের কাছে ছুটে এসেছিলেন সেটা পুরোপুরি ধূলিসাৎ। নিজের এবং তিন মেয়ের জন্য তার এখন অনন্ত দুর্ভাবনা। বিনয়ের হঠাৎ মনে হল, তার সঙ্গে এই বৃদ্ধাদের কোথাও একটা মিল আছে। সেও ঝিনুককে নিয়ে সুনীতির শ্বশুরবাড়ি এবং নিজের বাবার কাছে গিয়েছিল। সুধারা ছাড়া কেউ তার সঙ্গে সদয় ব্যবহার করেনি। ঝিনুকের কারণে বিনয়কেও কম অসম্মান আর লাঞ্ছনা ভোগ করতে হয়নি। রামরতনের স্ত্রী এবং তাঁর তিন মেয়ের জন্য ভীষণ কষ্ট হতে থাকে বিনয়ের। বৃদ্ধা যেন খোঁচা দিয়ে দিয়ে তার বুকের ভেতর থেকে ঝিনুককে বার করে এনেছেন। চিরদুঃখী মেয়েটার সঙ্গে তারা যেন একাকার হয়ে গেছেন।
বিনয় ভারী গলায় জিজ্ঞেস করল, বিমলবাবু নিজে কী বলেন?
বৃদ্ধা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, ও আর কী কইব! পোলাপান কালের হেই বিমল কি আর আছে! কী ভাল আছিল। কত সরল, কত সাদাসিধা! তুমার মাউসামশয় আর আমারে ছাড়া পিরথিমীর আর কেওরে জানত না। আমরাই আছিলাম অর সব। হেই মানুষ কত বদলাইয়া গ্যাছে। অর বউ আমাগো দুঃখু দ্যায়। ও দেইখাও দ্যাখে না। মুখ বুইজা থাকে। বউর মুখের উপুর কথা কওনের বুকের পাটা কি অর আছে! রামরতনের স্ত্রীর কণ্ঠস্বরে তীব্র অভিমান। পুঞ্জীভূত যাবতীয় ক্ষোভ তিনি উগরে দিতে থাকেন।
আচমকা অন্য একটা চিন্তা বিনয়কে কিছুটা আনমনা করে তোলে। চোদ্দ ঘর ভাড়াটের সঙ্গে বিমল যে প্রাচীন, বিবর্ণ বাড়িটায় থাকে সেটা দেখলে মনে হয় না, সে বড় মাপের কোনও চাকরি বাকরি করে। তেমন রোজগার হলে এমন জায়গায়, এত লোকজনের সঙ্গে গাদাগাদি করে পড়ে থাকত না। নিশ্চয়ই অনেক ভাল বাড়িতে থাকত। সেখানে চাকচিক্য থাকত ঢের বেশি। পরিবেশ হতো অন্যরকম। মনে হয়, বিমল যা মাইনে পায় তাতে তার সংসার মোটামুটি চলে যায়। তার ওপর চার চারটে মানুষের ভার বহন করতে তার নিদারুণ কষ্ট হচ্ছে। যে জেঠাইমা সযত্নে, অসীম মমতায় তাকে মানুষ করে তুলেছেন, হঠাৎ তারা দেশের সর্বস্ব খুইয়ে চলে আসার পর প্রাথমিক আবেগটুকু দ্রুত ফিকে হয়ে যাচ্ছে। বিরাট আকারে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে পর্বতপ্রমাণ সমস্যা। স্থূল এবং জৈবিক। এতগুলো মানুষের চলবে কী করে? রোজকার চাল ডাল জুটবে কোত্থেকে? দুচারদিনের ব্যাপার নয়। বৃদ্ধারা যদ্দিন বাঁচবেন ততদিনই তাদের টানতে হবে। তাছাড়া, দুই অবিবাহিত মেয়ে আছে রামরতনের। তাদের বিয়ের প্রশ্ন আছে। এসব দায়িত্ব এখন বিমলের কাঁধে। ক্রমশ অবস্থা এমন দুঃসহ হয়ে উঠবে যে বিমলদের কাছে এই অতি প্রিয়জনেরাও অত্যন্ত অবাঞ্ছিত হয়ে যাবেন। এ এক অদ্ভুত সংকট। বিনয় ভাবল, এখানে না এলেই বোধ হয় ভাল হতো।
বৃদ্ধা এবার বললেন, শুনতে আছি, পাকিস্থান থিকা যারা আইছে গরমেন্ট তাগো লেইগা কেম্পে (ক্যাম্পে থাকনের ব্যাবোস্তা করছে। রিফুজিগো খাওনের থাকনের সগল দায় সরকারের। আমাগো বডার (বর্ডার) স্লিপ আছে। তুমি কি বাবা খোঁজখবর লইয়া কুনো কেম্পে আমাগো থাকনের বন্দোবস্ত কইরা দিতে পারবা?
বিনয় চমকে উঠল। কতখানি মানসিক নির্যাতন ভোগ করলে রামরতনের স্ত্রীর মতো একজন বৃদ্ধা, কলকাতা সম্বন্ধে যাঁর স্পষ্ট ধারণাই নেই, হয়তো জামতলি গাঁয়ের বাইরে দূরে কোথাও তার যাওয়া হয়নি–এমন একটা দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কিন্তু শরণার্থী শিবির নামে পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তুদের জন্য রাতারাতি যে-সব ক্যাম্প খাড়া করা হয়েছে, সেগুলো কেমন, কে জানে। কলকাতায় আসার পর কোনও ক্যাম্পেই বিনয়ের যাওয়া হয়নি। যাওয়ার প্রশ্নই ছিল না। তবে যুগল ছাড়াও অনেকের মুখেই শুনেছে, ক্যাম্পগুলোর বেশির ভাগই নরককুণ্ড। সেগুলোর পরিবেশ, আবহাওয়া জঘন্য। দমবন্ধ করা। কদর্য। নিতান্ত নিরুপায় না হলে কেউ সেখানে এক মুহূর্তও থাকতে চায় না। যারাই পারছে, দলে দলে বেরিয়ে গিয়ে বনবাদাড়, জলা জায়গা আর ফাঁকা পোড়ো জমিতে জবরদখল কলোনি বসাচ্ছে। মুকুন্দপুরে ছিন্নমূল মানুষের তেমন এক উপনিবেশ নিজের চোখেই দুআড়াই সপ্তাহ আগে দেখে এসেছে বিনয়। এমনকি পুরো একটা দিনও বিলের ধারে যুগলদের কাঁচা বাঁশের বেড়ার ঘরে কাটিয়েছিল।
বিনয় জানায়, রিফিউজি ক্যাম্প সম্বন্ধে সে বিশেষ কিছুই জানে না। যে-সব খবর কানে এসেছে তার আধাআধিও যদি ঠিক হয়, তাহলে সম্ভ্রান্ত ভদ্র পরিবারের মানুষজনের শাগ্য বাসস্থান সেগুলো নয়। বিশদভাবে তা বুঝিয়ে দিয়ে সে বলল, ক্যাম্পে না যাওয়াই ভাল ।সমা। আপনার কম বয়সের মেয়েরা আছে– পরিষ্কার একটা ইঙ্গিত দিয়ে থেমে গেল সে। আসলে বিনয়ের মাথায় চকিতের জন্য শিয়ালদা স্টেশনের সেই দৃশ্যটি ঝিলিক দিয়ে গেল। একটা আড়কাঠি পতিতপাবনের সদ্য যুবতী মেয়েকে ফুসলে নিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিল, আর পতিতপাবন প্রচণ্ড আক্রোশে লোকটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে গলা টিপে স্টেশনের পাথুরে চত্বরে তাকে আছড়ে ফেলেছিল। অনেকে মিলে টানাটানি করে ছাড়িয়ে না দিলে লোক্টা খুনই হয়ে যেত। এইরকম মেয়ে-শিকারি কি আর ক্যাম্পগুলোর চারপাশে হানা দিচ্ছে না? নিশ্চয়ই দিচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা অসহায় হিন্দু মেয়েদের নিয়ে। লুটের বাজার এখন রমরমিয়ে চলছে। সুযোগ পেলেই তারা ছোঁ মেরে রামরতনের মেয়েদের তুলে নিয়ে যাবে। যে ঘাতক আর লুটেরা বাহিনীর ভয়ে রামরতনরা পাকিস্তান থেকে চলে এসেছিলেন, সীমান্তের এপারেও তেমন হাঙররা থিক থিক করছে। অশক্ত, দুর্বল বৃদ্ধার সাধ্য কী, তাদের হাত থেকে যুবতী দুই মেয়েকে রক্ষা করেন।
বিনয়ের ইঙ্গিতটা ধরতে পেরেছিলেন রামরতনের স্ত্রী। একেবারে মুষড়ে পড়েন তিনি। বিনয় লক্ষ করে, ছায়া, মায়া এবং বাসন্তীও ভেতরে ভেতরে ধসে পড়েছে।
সারি সারি হতাশ, করুণ, কাতর মুখচ্ছবি। মা আর তিন মেয়ে হয়তো ভেবেছিল, হয়তো নিজেদের মধ্যে গোপনে পরামর্শও করেছিল, ক্যাম্পে গেলে সরকারি দাক্ষিণ্যে থাকতে পারবে। বিমলদের বাড়ির অসহনীয় পরিবেশ থেকে সেটাই খুব সম্ভব ছিল তাদের পরিত্রাণের একমাত্র উপায়। অন্তত সেই রকমই মনে হয়েছিল চার মা-মেয়ের।
শুকনো গলায় রামরতনের স্ত্রী বললেন, তুমি তাইলে কেম্পে যাইতে না কর?
ঘুরিয়ে উত্তরটা দিল বিনয়, না যাওয়াই ভাল—
কিন্তুক
উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বিনয়।
একটু চিন্তা করে বৃদ্ধা এবার বললেন, আমাগো জামতলিতে মাইয়াগো ইস্কুল নাই। কিন্তুক তুমার মাউসামশয় ছায়া আর মায়ারে বাড়িতে অনেক দূর পড়াইছে। পেরাইভেটে (প্রাইভেটে) ছায়া-মায়া দুইজনেরই মেট্রিক দেওনের কথা আছিল। বিয়াও ঠিক হইয়া গেছিল ছায়ার। মেট্রিক পরীক্ষার পরই বিয়াটা হইত। পাত্র ঢাকা শহরে থাকত। ভাল পোলা। এম. এ পাস। বড় চাকরি করত। মাইষে ভাবে এক, হয় আর-এক। হেই বচ্ছরই বাধল দাঙ্গা। মুসলমানেরা কয় পাকিস্থান চাই। চাইর দিকে আগুন আর রক্তগঙ্গা। হেই দাঙ্গায় পাত্র তার মা বাপ ভাই বইন সুদ্ধা ঢাকায় খুন হইয়া গেল। ছায়া-মায়ার পরীক্ষাও দেওয়া হইল না। সগলই অদ্দিষ্ট বাবা। বুকের অতল স্তর ভেদ করে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে রামরতনের স্ত্রীর। দুচোখ জলে ভরে যেতে থাকে।
ক্যাম্পে যাবার প্রসঙ্গ থেকে সরে গিয়ে বৃদ্ধা কেন যে ছায়া-মায়ার ম্যাট্রিক পরীক্ষা আর ছায়ার বিয়ের কথায় চলে এলেন, বোঝা যাচ্ছে না। নিজের অজান্তেই বিনয়ের চোখ ছায়ার দিকে ঘুরে। যায়। নতমুখে সে দাঁড়িয়ে আছে। পরীক্ষা যে দেওয়া হয়নি, স্থির হয়ে-যাওয়া বিয়ের পাত্র যে খুন হয়ে গেছে–এ-সব যেন তারই অপরাধ। মেয়েটার জন্য বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে ওঠে বিনয়ের।
বেশ কিছুক্ষণ পর ধরা গলায় রামরতনের স্ত্রী বললেন, হুনছি গরমেন্ট রিফুজিগো ম্যালা (অনেক) সুযুগ সুবিদা চাকরি বাকরি দিতে আছে। ছায়া-মায়ার হাতে মেট্রিকের ছাপ নাই, কিন্তুক হেই তরি (সেই পর্যন্ত) তো পড়ছে। অরা যদিন কাজকম্ম পাইত, রোজগারপাতি করতে পারত, আমরা ভিন্ন বাসা ভাড়া কইরা উইঠা যাইতাম। ছায়া-মায়া সম্বন্ধে এত কথা কেন বৃদ্ধা বলছেন, এতক্ষণে তার কাটা ধরা গেল।
রামরতনের স্ত্রী বলতে লাগলেন, কইলকাতায় তো শুনি মাইয়ারা আফিসে গিয়া কাম করে। তুমার বাবার, দুই ভগ্নীপতির তো কত বড় বড় মাইষের লগে জানাশুনা। তেনাগো কইয়া ছায়া মায়ার এট্টা গতি কইরা দিতে পার?
এতদিন তার জন্য কেন যে ব্যাকুলভাবে রামরতনের স্ত্রী এবং তার মেয়েরা অপেক্ষা করছিল, তাও স্পষ্ট হয়ে যায়। পথের আলাপ। তারপাশা থেকে গোয়ালন্দ, গোয়ালন্দ থেকে শিয়ালদা স্টেশন। মাত্র দুটো দিন তারা একসঙ্গে কাটিয়েছে। এটা ঠিক, বিনয় ওদের জন্য অনেক করেছে। তারপাশায় নাসের আলি তার ওপর রামরতনদের কলকাতায় পৌঁছে দেবার যে বিরাট দায়িত্ব দিয়েছিলেন তা সাধ্যমতো পালন করে গেছে বিনয়। সঙ্গে সদাত্রস্ত ঝিনুক, সে আবার পুরোপুরি স্বাভাবিকও নয়। তাকে সামলে স্টিমার এবং ট্রেনের দমবন্ধ-করা ছিন্নমূল মানুষের ভিড়ে যতটা সম্ভব রামরতনদের দুর্ভোগ আর কষ্ট লাঘব করার চেষ্টা করেছে। রামরতন যখন পাকিস্তানের ট্রেনে মারা গেলেন তখন চারটি শোকার্ত, বিপন্ন নারীকে সে দুহাতে ঘিরে রেখেছিল। তার আন্তরিকতায়, তার সমবেদনায় নিশ্চয়ই প্রাক্তন হেডমাস্টার মশায়ের স্ত্রী এবং মেয়েরা অভিভূত। হয়তো তারা ভেবেছে, পথের দেখা, অনাত্মীয় এই যুবকটির ওপর নির্ভর করা যায়। বিমলদের বাড়িতে এসে যখন অনাদরে, অসম্মানে তারা জর্জরিত, তখন এই অচেনা শহরে বিনয়ের কথাই বার বার তাদের মনে পড়েছে। বুঝি বা সে-ই তাদের শেষ অবলম্বন। তাকে আঁকড়ে ধরে তারা নতুন করে বাঁচতে চায়। সসম্মানে। নিজেদের মর্যাদা বজায় রেখে।
বিনয় জানে, কলকাতার গার্লস স্কুল আর কলেজগুলোতে মেয়েরা পড়ায়। কিন্তু বাঙালি মেয়েরা পুরুষদের পাশাপাশি বসে অফিসে কাজ করে কি না, সে সম্বন্ধে তার ধারণা নেই। অবশ্য আনন্দদের অফিসে একটি তরুণী রিসেপশনিস্ট চোখে পড়েছে তার। উগ্র সাজপোশাক। চোখধাঁধানো যৌবন। তবে সে বাঙালি নয়, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। আদৌ বাঙালি মেয়েরা যদি অফিসে কাজ করেও, ম্যাট্রিক পরীক্ষা যারা দিতে পারেনি অর্থাৎ ছায়া-মায়াদের পক্ষে কি চাকরি পাওয়া সম্ভব? শিক্ষাগত এই যোগ্যতায় খুব সম্ভব কাজ জুটবে না। হঠাৎ বিনয়ের মনে পড়ল, রিফিউজিদের ব্যাপারে গভর্নমেন্ট অনেক সহানুভূতিশীল। ম্যাট্রিক, আই এ, বি এ পাস করতেই হবে, এমন কোনও কড়াকড়ি নেই। ক্লাস নাইন টেনের বিদ্যাতেও ছোটখাটো কাজ জুটে যায়। নইলে ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়া মুকুন্দপুরের নিশিকান্ত আচার্য সরকারি রেশনের দোকানে চাকরি পেত না।
বিনয় বলল, নিশ্চয়ই আমি জামাইবাবুদের বলব। আমি নিজেও আপনার মেয়েদের চাকরির জন্যে খোঁজখবর নেব।
বিনয়ের একটা হাত আঁকড়ে ধরে আকুল সুরে রামরতনের স্ত্রী বললেন, এই কামটা তুমারে কইরা দিতেই হইব। যত তরাতরি পার–
আমি চেষ্টা করব মাসিমা
তাকে না বলে ছায়া-মায়ার চাকরির কথা বিমলকে কেন বললেন না বৃদ্ধা? প্রশ্নটা করতে গিয়ে থমকে গেল বিনয়। একে তিন মেয়েকে নিয়ে গলগ্রহ হয়ে আছেন, তার ওপর চাকরি জুটিয়ে দেবার জন্যে ছোটাছুটি করতে বললে নিশ্চয়ই বিমল খুশি হতো না। তাই সেটা উত্থাপন করতে সাহস হয়নি বৃদ্ধার।
বাইরে থেকে কার গলা ভেসে এল, ছায়া-মায়া, এদিকে আয় তো~
সচকিত রামরতনের স্ত্রী গলা নামিয়ে বললেন, বিমল আইছে। তুমার লগে এতক্ষণ যে কথা হইল, অরে কিন্তু এই সগল কিচ্ছু কইবা না। বোঝোই তো বাবা
বুঝতে ঠিকই পেরেছে বিনয়। বাড়িতে এনে তোলার পর সারাক্ষণ মানসিক পীড়ন চালাচ্ছে বিমলরা, কিন্তু রামরতনের স্ত্রী যে বাইরের কারও সাহায্য চাইবে, সেটাও হয়তো ওদের সম্মানে বাধবে। এ এক অদ্ভুত পরিস্থিতি।
বিনয় বলল, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন মাসিমা। আমি বিমলবাবুকে কিছুই বলব না।
বসার এই ঘর থেকে কোনাকুনি খোলা সদর রজা দিয়ে বাইরের রাস্তায় একটা রিকশা চোখে পড়ে। সেটায় বসে আছে বিমল। তার পাশে এবং পাদানিতে অনেকগুলো বড় বড় চটের থলে। জিনিসপত্রে বোঝাই।
ছায়া-মায়া দৌড়ে গিয়েছিল। একটু পর তিনজনে থলেগুলো রিকশা থেকে নামিয়ে নিয়ে ফিরে এল।
সামনের চাতালে জলের কল আর পায়খানাগুলোতে এখনও যথেষ্ট ভিড়। তবে খানিক আগে বাড়িটার তিনটে তলা জুড়ে গল গল করে যে কয়লার ধোঁয়া বেরুচ্ছিল, এখন আর তা নেই। পনেরো ঘর ভাড়াটের উনুনগুলো নিশ্চয়ই ধরে গেছে।
আগে লক্ষ করেনি। ঘরের লাগোয়া বারান্দায় উঠতেই বিমলের চোখে পড়ল বাইরের ঘরে বসে আছে বিনয়। দেখামাত্র চিনতে পারল। ব্যস্তভাবে বলল, বসুন। আসছি
পাশের ঘরে হাতের থলে রেখে তৎক্ষণাৎ চলে এল বিমল। ঝপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়ল। তাকে ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। রেশন তুলে, বাজার করে, মালপত্র নিয়ে আসার ধকল তো কম নয়।
বিমল জিজ্ঞেস করল, কতক্ষণ এসেছেন?
বিনয় বলল, মিনিট চল্লিশেক হবে। শুনলাম আজ আর অফিসে যাবেন না। তাই অপেক্ষা করছিলাম। কথাটা ঠিক বলা হল না। বিমলের জন্য মোটেও সে বসে নেই। রামরতনের স্ত্রীর সঙ্গে কথাবার্তা বলতে বলতে অনেকটা সময় কেটে গেছে। দরকার হলে অন্যের অহংকে তুষ্ট করতে। কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়। বিনয় যেন রামরতনের স্ত্রী বা মেয়েদের জন্য নয়, বিমলের সঙ্গে দেখা করতেই এ-বাড়িতে এসেছে।
বিমল বলল, রেশনের দোকানে লম্বা লাইন ছিল। তাই ফিরতে দেরি হয়ে গেল। জেঠিমা, বাসন্তীদিদি, বিনয়বাবুকে চা দিয়েছ?
বিনয়ই উত্তরটা দিল, হ্যাঁ, আতিথ্যে কোনও ত্রুটি হয়নি।
বিমল বলল, খুব টায়ার্ড লাগছে। চা না হলে এনার্জি পাচ্ছি না। আশা করি, আর-এক কাপ খেতে নিশ্চয়ই আপনার আপত্তি হবে না বিনয়বাবু–
বিনয় হাসল। তার আপত্তি নেই।
বিমল ছায়া-মায়াকে বলল, চট করে একটু চা করে নিয়ে আয়।
বিনয় যেটুকু দেখেছে, তাতে মনে হয়েছে, এই দুই বোন যেন জোড়ের পাখি। সারাক্ষণ পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। বিমলের মুখ থেকে কথা খসার সঙ্গে সঙ্গে তারা ডান পাশে রান্নাঘরের দিকে ছুটে গেল।
বিমল এবার বিনয়ের দিকে তাকায়, শিয়ালদা স্টেশনে সেই প্রথম আর শেষ দেখা। প্রায়ই ভাবি, আপনি আসবেন। ঠিকানাও জানি না যে নিজেই গিয়ে দেখা করব। এদিকে জেঠিমারা সর্বক্ষণ আপনার কথা বলে
শিয়ালদার প্রসঙ্গ ওঠায় ভীষণ অস্বস্তি বোধ করে বিনয়। চারটি শোকগ্রস্ত নারী এবং রামরতনের মৃতদেহ বিমলের হাতে তুলে দিয়ে সে ঝিনুককে নিয়ে বাবা আর দিদিদের খোঁজে বেরিয়ে পড়েছিল। শরীর তখন এতটাই ভেঙে পড়েছে যে দাঁড়িয়ে থাকার মতো শক্তি অবশিষ্ট ছিল না। তারপর সেদিন রাতে কী হয়েছে, কীভাবে বিমল সবদিক সামাল দিয়েছে, কিছুই জানা নেই।
বিনয় বলল, ওই দিনটায় আপনার ভীষণ কষ্ট হয়েছিল? পাশে থেকে যে একটু সাহায্য করব, তার উপায় ছিল না।
বিমল জানায়, রামরতনের মৃত্যুশোক ছাড়া অন্য কষ্ট তেমন হয়নি। বিনয় রিফিউজি অ্যান্ড রিলিফ ডিপার্টমেন্টের যে অফিসারটির সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল তার মতো মহানুভব মানুষ এই স্বার্থপর পৃথিবীতে একান্তই বিরল। তিনিই খাট ফুল মালা নতুন কাপড়চোপড়, এমনকি নিমতলায় নিয়ে যাবার জন্য চারজন শববাহকের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। দাহের খরচও দিয়েছেন। সবই অবশ্য উদ্বাস্তু ত্রাণ বিভাগের টাকা। টাকা যেখান থেকেই আসুক, নিজে দায়িত্ব নিয়ে এতটাই বা কে করে?
বিমল কৃতজ্ঞ সুরে বলতে লাগল, আপনি ওই অফিসারের সঙ্গে আলাপ না করিয়ে দিলে মহা বিপদে পড়তাম–
একটু চুপচাপ।
তারপর বিমল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিনয়কে হাজারটা প্রশ্ন করে। এই সহৃদয়, পরোপকারী যুবকটি সম্পর্কে তার অপার কৌতূহল। কলকাতায় সে কোথায় থাকে, কী করছে, ঝিনুকের খবর কী, ইত্যাদি ইত্যাদি। রামরতনের স্ত্রীকে যা যা বলেছিল, বিমলকেও তাই বলল বিনয়। ঝিনুকের নিখোঁজ হওয়া আর অবনীমোহনের গুরুর আশ্রমে চলে যাওয়া-যথারীতি এই দুটো বাদ দিয়ে।
চা এসে গিয়েছিল। খাওয়া শেষ হলে বিনয় উঠে পড়ল, অনেকক্ষণ এসেছি। এবার চলি—
বিমল বলল, কষ্ট করে যখন এসেছেন, দুপুরে দুটি ডাল ভাত খেয়ে গেলে খুশি হব।
বাড়িতে না জানিয়ে চলে এসেছি। আরও দেরি হলে ছোটদিরা খুব ভাববে।
বিমল আর রামরতনের স্ত্রীও উঠে দাঁড়িয়েছেন। বাসন্তীরা তো দাঁড়িয়েই আছে।
রামরতনের স্ত্রী বললেন, তরাতরি আইসো কিন্তুক এই কথাটা তিনি আগে আরও একবার বলেছেন।
দ্রুত মা এবং তিন মেয়েকে দেখে নিল বিনয়। সবার চোখেমুখে অনন্ত আগ্রহ। এর হেতুও তার জানা। বলল, নিশ্চয়ই আসব
বিমল বলল, চলুন, আপনাকে ট্রাম রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।
না না, আপনি ক্লান্ত হয়ে আছেন। আর কষ্ট করতে হবে না।
কষ্ট আবার কী–
বাড়ি থেকে বেরিয়ে নীরবে কয়েক পা হাঁটার পর বিমল কিছুটা ইতস্তত করে বলল, আপনি এসেছেন, খুব ভাল হয়েছে। আপনার কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে।
একটু সতর্ক হল বিনয়, কী অনুরোধ বলুন তো?
কাচুমাচু মুখে বিমল বলল, আমি স্টেট গভর্নমেন্টের এমপ্লয়ি। আপার ডিভিশন ক্লার্ক। কটা টাকা আর মাইনে পাই? বাড়ি ভাড়া, ছেলেমেয়ের পড়াশোনা, অসুখবিসুখ, খাওয়ার খরচ–একেবারে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছিলাম। তার ওপর জেঠিমারা পাকিস্তান থেকে চলে এলেন। বুকে করে যাঁরা মানুষ করেছেন তাদের তো ফেলে দিতে পারি না। এদিকে আসছে মাস থেকে রেশনের চাল চিনি গমের দাম বাড়ছে। সাড়ে ছআনা সেরের মোটা চাল সাড়ে সাত আনা হয়ে যাবে। সেই সঙ্গে বাড়বে আটা চিনি আর অন্য সব জিনিসের দাম। কীভাবে যে চলবে ভেবে পাচ্ছি না বিনয়বাবু–
এত লম্বা ভণিতা করে কী জানাতে চায় বিমল? তার কাছে লোকটার কি কোনও প্রত্যাশা আছে? একটা ব্যাপার অবশ্য বিনয়ের ভাল লাগল। বিমল অমানুষ নয়। জেঠা-জেঠি তার জন্য কী করেছেন তা ভুলে যায়নি। পুরানো দিনের স্মৃতি সে হাত ঝেড়ে ফেলে দিতে চায় না। কিন্তু রাজ্য সরকারের কেরানি। পয়সার জোর নেই। তাছাড়া একদিকে কর্তব্যবোধ, কৃতজ্ঞতা, অন্য দিকে স্ত্রী। মহিলার আদৌ ইচ্ছা নয়, ঘাড়ে চারটে বাড়তি মানুষ আজীবন চেপে থাকুক। স্ত্রী এবং জেঠিমাদের মাঝখানে পিষে যাচ্ছে বিমল। লোকটার জন্য করুণাই হয় বিনয়ের।
বিমল এবার বলল, শুনেছি আপনার বাবা আর ভগ্নীপতিরা খুবই ইনফ্লুয়েন্সিয়াল। সন্ধের দিকে যদি দুতিন ঘণ্টার জন্য একটা পার্ট-টাইম কাজের ব্যবস্থা করে দেন–
রামরতনের স্ত্রী চান ছায়া-মায়ার জন্য চাকরি জুটিয়ে দিতে।বিমল চায় পার্ট-টাইম কাজ। বিনয়ের হাসি পেল। সে নিজেই রয়েছে ভাসমান অবস্থায়। দুদিন পর কোথায় থাকবে, ঠিক নেই। এই সুবিশাল শহরে পরিচিতজনের সংখ্যা আর কজন? শুধু হিরণ আর আনন্দকেই সে বলতে পারে। কিন্তু ওরা ছায়া-মায়া আর বিমলের জন্য কতদূর কী করতে পারবে, কে জানে।
গলির একটা বাঁকের মুখে এসে পড়েছিল তারা। বিমলকে নিরাশ করতে ইচ্ছা হল না বিনয়ের। বলল, নিশ্চয়ই আপনার কথা সবাইকে বলব। অনেকদূর এসেছেন। এবার বাড়ি যান।
সঙ্গ দেবার জন্য জোর করল না বিমল। দাঁড়িয়ে পড়ল সে। হাতজোড় করে বলল, নমস্কার। আমার কথাটা কিন্তু মনে রাখবেন।
রাখব। নমস্কার
গলির আর-একটা পাক ঘুরে ট্রাম রাস্তায় এসে বিনয়ের চক্ষুস্থির। ডাইনে বাঁয়ে কর্ণওয়ালিস স্ট্রিটটার যতদূর অবধি দেখা যায়, সারি সারি ট্রাম দাঁড়িয়ে আছে। সেগুলোর দুপাশে বাস লরি রিকশা ঘোড়ার গাড়ি-যাবতীয় যানবাহন। কোনওটারই নড়াচড়া নেই। সব যেন একটা বিশাল ফাঁদের ভেতর আটকে গেছে। বাসের কন্ডাক্টর, ঘোড়ার গাড়ির কোচোয়ান, রিকশাওলা, রাস্তার লোজন গলার স্বর সবচেয়ে উঁচু পর্দায় তুলে সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। কে কী বলছে, বোঝার উপায় নেই। সব মিলিয়ে যে প্রচণ্ড শব্দের সৃষ্টি হচ্ছে তা যেন আকাশ ফেড়ে ফেলবে। সমস্ত এলাকা জুড়ে তুমুল বিশৃঙ্খলা।
হতবুদ্ধি বিনয় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। ট্রাম বাস না চললে টালিগঞ্জে ফিরবে কী করে? গাড়িঘোড়া যেভাবে জট পাকিয়ে আছে, ফের কখন চালু হবে, কে বলবে। একটা লোককে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, গ্রে স্ট্রিটের কাছে ট্রাম তার ছিঁড়ে লাইন থেকে ছিটকে গিয়ে, আড়াআড়ি রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। তার ফলে এই জট-পাকানো হাল।
এখন অফিস টাইম। বিনয় লক্ষ করল, ফুটপাথ ধরে মানুষের স্রোত। কারও দাঁড়াবার সময় নেই। সবাই সামনের দিকে হাঁটছে। সেও স্রোতে গা ছেড়ে দিল। হঠাৎ মনে পড়ল, সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউতে যেতে পারলে এসপ্ল্যানেডের বাস পাওয়া যাবে। তারপর টালিগঞ্জ যাওয়া এমন কি কঠিন?
হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার জ্যামের দুর্ভাবনাটা মাথা থেকে বেরিয়ে যায় বিনয়ের। চেখের সামনে বিমলদের বাড়ির ছবিটা ফুটে ওঠে। যদি ছায়া কি মায়ার চাকরি না জোটে, বিমলের স্ত্রী যদি ওদের তাড়িয়ে দেয়, এই বিশাল মহানগরে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তারা? কে তাদের আশ্রয় দেবে? চিন্তাটা তাকে আকুল করে তোলে।
কখন হাতিবাগান, স্টার থিয়েটার, রূপবাণী সিনেমা পেরিয়ে বিডন স্ট্রিটের মুখে এসে পড়েছিল, খেয়াল নেই বিনয়ের। এখান থেকে ডান পাশে ঘুরে মিনিট চার পাঁচেক হাঁটলেই সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ। সেদিকে পা বাড়াতে গিয়ে থমকে গেল সে। বিডন স্ট্রিটে সুনীতির শ্বশুরবাড়ি। কেউ দেখে ফেললে তাকে টেনে নিয়ে যেতে চাইবে। হেমনলিনী যতদিন বেঁচে আছেন, ও-বাড়ির ছায়া মাড়াবে না বিনয়। বিডন স্ট্রিট থেকে আরও খানিকটা এগিয়ে বেথুন কলেজের দক্ষিণ দিকের বাউন্ডারি ওয়ালের গা, ঘেঁষে যে সরু রাস্তাটা সোজা পশ্চিমে চলে গেছে সেটা ধরলেও সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউতে যাওয়া যায়।
ফুটপাথ দিয়ে কয়েক পা যেতে না যেতেই খুব পরিচিত গলার ডাক ভেসে এল, বিনুদা বিনুদা।
সারা শরীরে তড়িৎপ্রবাহ খেলে গেল বিনয়ের। এধারে ওধারে তাকিয়ে দেখতে পেল, উলটো দিকে হেদুয়ার সুইমিং পুলের পাশের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আছে ঝুমা।