ময়ূর খেলা দেখাইতে বাহির হইল না
পরদিন সকালে ময়ূর খেলা দেখাইতে বাহির হইল না। বিকালে সাজসজ্জা করিয়া চঞ্চরী ও শিলাবতীকে লইয়া রাজপ্রাসাদের অভিমুখে চলিল। চঞ্চরীর দেহ বোরকায় ঢাকা, শিলাবতীর মাথায় ফলের ঝুড়ি।
প্রাসাদের পশ্চাদ্ভাগে হারেম, প্রাকারবেষ্টিত মহলের কোলে প্রশস্ত অঙ্গন। অঙ্গনের দ্বারে কয়েকজন রক্ষী দাঁড়াইয়া আছে, তাহাদের কোমরে তরবারি, হাতে বল্লম। ময়ূরকে দেখিয়া একজন রক্ষী চিনিতে পারিল, সে পূর্বে ময়ূরের খেলা দেখিয়াছে। ময়ূর অগ্রবর্তী হইয়া তাহাদের সম্মুখে দাঁড়াইল এবং নত হইয়া সেলাম করিল। সদাররক্ষী বলিল—কি চাও?
ময়ূর সবিনয়ে বলিল—যদি অনুমতি হয়, বেগম সাহেবাদের তীর-ধনুকের খেলা দেখাব।
রক্ষীরা মুখ তাকাতাকি করিল, তারপর নিম্ন স্বরে পরামর্শ করিতে লাগিল। তীর-ধনুকের খেলা দেখিবার ঔৎসুক্য তাহাদের নিজেদেরই যথেষ্ট ছিল, কিন্তু এই বাজিকরকে অঙ্গনে আসিতে দেওয়া উচিত হইবে কি না, এই লইয়া তাহাদের মধ্যে তর্ক উঠিল। শেষে সদার রক্ষী ময়ূরকে বলিল—ভিতরে আসার হুকুম নেই, তুমি ফটকের সামনে খেলা দেখাও।
ময়ূর মনে মনে একটু নিরাশ হইল, কিন্তু দ্বিরুক্তি না করিয়া ধনুকে গুণ পরাইতে প্রবৃত্ত হইল।
এই সময় এক অতি সুন্দরকান্তি যুবাপুরুষ রক্ষীদের মধ্যে আসিয়া দাঁড়াইলেন। রক্ষীরা সসম্ভ্রমে তসলিম্ করিল, একজন অস্ফুট স্বরে বলিল—হজরৎ মালিক কাফুর।
মালিক কাফুরকে আলাউদ্দিন বহু বর্ষ পূর্বে ক্রীতদাসরূপে ক্রয় করিয়াছিলেন; এক হাজার স্বর্ণদীনার দিয়া ক্রয় করিয়াছিলেন বলিয়া লোকে কাফুরকে হাজারদীনারী খোজা বলিত। তারপর যুদ্ধে রণপাণ্ডিত্য দেখাইয়া তিনি সুলতানের প্রধান সেনাপতি হইয়াছিলেন; আলাউদ্দিনের শেষ বয়সে কাফুর তাঁহার দক্ষিণহস্ত হইয়া দাঁড়াইয়াছিলেন। বর্তমানে তাঁহার বয়স চল্লিশের ঊর্ধ্বে, কিন্তু দেখিলে যুবক বলিয়া মনে হয়।
ময়ূরও মালিক কাফুরকে তসলিম করিল, তারপর খেলা দেখাইতে আরম্ভ করিল। প্রথমে সে শূন্যে তীর ছুড়িয়া দ্বিতীয় তীর দিয়া প্রথম তীর ফিরাইয়া আনিল। মালিক কাফুর খেলা দেখিয়া বলিলেন—এই খেলা আবার দেখাও।
ময়ূর আবার খেলা দেখাইল। কাফুর তখন সন্তুষ্ট হইয়া বলিলেন—তোমরা অঙ্গনে এস, বেগম সাহেবারা খেলা দেখবেন।
তখন চঞ্চরী ও শিলাবতীকে সঙ্গে লইয়া ময়ূর হারেমের প্রাঙ্গণে গিয়া দাঁড়াইল। মালিক কাফুর অন্দরমহলে প্রবেশ করিলেন। তিনি খোজা, অন্দরে তাঁহার অবাধ গতিবিধি।
ময়ূর দ্বিতীয় খেলা দেখাইল, চঞ্চরীকে বিশ হাত দূরে দাঁড় করাইয়া তাহার মাথায় ডালিম রাখিয়া তীর দিয়া ডালিম বিদ্ধ করিল। এই সময় হারেমের দ্বিতলের অলিন্দে বাতায়নে সূক্ষ্ম মলমলে ঢাকা রমণীমুখের আবির্ভাব হইতে লাগিল। অন্তরীক্ষে রূপের হাট বসিয়া গেল; নির্মেঘ আকাশে বিদ্যুৎ-বিলাস।
দ্বিতীয় খেলা শেষ করিয়া ময়ূর গুপ্ত কটাক্ষে দেখিল, একটি গবাক্ষে দুইজন পুরুষ দাঁড়াইয়াছে—একজন মালিক কাফুর, অন্যজন নিশ্চয় সুলতান আলাউদ্দিন। গবাক্ষপথে তাঁহাকে
আবক্ষ দেখা যাইতেছে; বৃদ্ধ ছাগের মতো একটা মুখ, কিন্তু চক্ষে লালসার ধূমকলুষিত অগ্নি।
এইবার সময় উপস্থিত। ময়ূর শিলাবতীকে ইঙ্গিত করিল, শিলাবতী চঞ্চরীর বোরকা খুলিয়া লইলেন। চঞ্চরীর দেহে সূক্ষ্ম মলমলের বস্ত্র, সে রূপের পসরা উদঘাটিত করিয়া দাঁড়াইল। দর্শকেরা নিশ্বাস ফেলিতে ভুলিয়া গেল।
ময়ূর নির্লিপ্ত মুখে আরও দুই-একটা খেলা দেখাইল। শিলাবতীর ঝুড়ি হইতে তিনটি ডালিম লইয়া সে চঞ্চরীর মাথায় ও দুই হাতে রাখিল, তারপর তাহাকে হারেমের দিকে মুখ ফিরাইয়া দাঁড় করাইল। চঞ্চরী দুই হাত স্কন্ধের দুই পাশে রাখিয়া দাঁড়াইল; ময়ূর তাহার পিছনে বিশ হাত দূরে গিয়া ধনুতে তিনটি শর একসঙ্গে যোজনা করিল। একসঙ্গে তিনটি শরই ছুটিয়া গেল, তিনটি ডালিম একসঙ্গে তীরবিদ্ধ হইয়া মাটিতে পড়িল।
দ্বিতলের অলিন্দে বাতায়ন হইতে স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার বৃষ্টি হইল। ময়ূর সেলাম করিতে করিতে মুদ্রাগুলি কুড়াইতেছে এমন সময় মালিক কাফুর নামিয়া আসিলেন। ময়ূরের পানে অবহেলাভরে কটাক্ষপাত করিয়া বলিলেন—এই বিবিকে সুলতান দেখতে চান। তুমি অপেক্ষা কর। চঞ্চরীর হাত ধরিয়া কাফুর হারেমে লইয়া চলিলেন। চঞ্চরী আপত্তি করিল না, কাফুরের সুন্দর মুখের পানে চাহিয়া তাহার অধরে হাসির বিদ্যুৎ স্ফুরিত হইতে লাগিল।
ময়ূর যেন হতবুদ্ধি হইয়া গিয়াছে এমনিভাবে দাঁড়াইয়া রহিল, তারপর শিলাবতীর পাশে গিয়া বসিল। শিলাবতীর মুখ অর্ধাবগুণ্ঠিত, তিনি খর্বকণ্ঠে বলিলেন—ওষুধ ধরেছে।
ময়ূর জিজ্ঞাসা করিল—ওই বৃদ্ধই আলাউদ্দিন?
শিলাবতী বলিলেন—হাঁ।
ময়ূর আর-একবার আলাউদ্দিনের দিকে তাকাইল। ইচ্ছা করিলেই সে আলাউদ্দিনকে হত্যা করিতে পারে, বিদ্যুদ্বেগে তীর-ধনুক লইয়া লক্ষ্যবেধ করা, কেবল একটি টঙ্কার শব্দ। আলাউদ্দিন নড়িবার সময় পাইবে না—
খেলা শেষ হইয়াছে দেখিয়া বাতায়ন হইতে সুন্দর মুখগুলি অপসৃত হইল, রক্ষীরা স্বস্থানে ফিরিয়া গেল। দ্বারের বাহিরে রাস্তার উপর কিছু নাগরিক তামাসা দেখিবার জন্য জমা হইয়াছিল, তাহারা অধিকাংশ ইতস্তত ছড়াইয়া পড়িল; দুই-চারি জন নিষ্কর্মা লোক আশেপাশে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল।
শিলাবতী বলিলেন—তুমি থাকো, আমি ফিরে যাই। আজ রাত্রে কবুতর বিবির সঙ্গে আবার দেখা করতে হবে। ফলের ঝুড়ি মাথায় লইয়া তিনি চলিয়া গেলেন।
ময়ূর আরও কিয়ৎকাল অপেক্ষা করিবার পর মালিক কাফুর ফিরিয়া আসিলেন, ময়ূরের হাতে এক মুঠি মোহর দিয়া সদয় কণ্ঠে বলিলেন—এই নাও তোমার বশিস্। বিবির জন্যে ভেবো না, সে সুলতানের কাছে সুখে থাকবে।
মালিক কাফুর চলিয়া গেলেন। ময়ূর মোহরগুলির পানে তাকাইয়া কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিল; তারপর সেগুলি কোমরে রাখিয়া ধনুর্বাণ হাতে নতমুখে হারেমের দেউড়ি পার হইয়া গেল।
সে পথে কয়েক পদ অগ্রসর হইয়াছে, পিছন হইতে কণ্ঠস্বর শুনিতে পাইল—কী দোস্ত। বলেছিলাম কিনা, দিল্লীতে বৌ চুরি যায়। মামুদ পিছন হইতে আসিয়া তাহার সঙ্গে সঙ্গে চলিতে লাগিল, সহানুভূতিসিক্ত কণ্ঠে বলিল—দুঃখ কোরো না, যা বশিস্ পেয়েছ তাতে চারটে বিবি কিনতে পারবে। এখন চল শরাবখানায়, দু পেয়ালা টানলেই মেজাজ দুরস্ত হয়ে যাবে।
ময়ূরের একবার ইচ্ছা হইল চঞ্চরীর দেহের মূল্য মোহরগুলা মামুদের হাতে দিয়া তাহাকে বিদায় করিয়া দেয়। সে তো এইজন্যই পিছনে লাগিয়া আছে। কিন্তু তাহা করিলে দুর্জনকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়। ময়ূর রুখিয়া দাঁড়াইয়া বলিল—আমার মেজাজ ভাল নেই। বিরক্ত কোরো না, বিপদে পড়বে।
মামুদ অমনি পিছাইয়া গেল। সে অত্যন্ত ভীরু, ময়ূরের মতো তীরন্দাজকে বেশি ঘাঁটাইতে সাহস করে না। কিন্তু সে ময়ূরের হাতে সোনা দেখিয়াছে, সহজে তাহাকে ছাড়িয়া দেওয়াও মামুদের পক্ষে অসম্ভব।
রাত্রে আহারাদি সমাপ্ত হইলে শিলাবতী বলিলেন—অর্ধেক কাজ শেষ হয়েছে, এখনো অর্ধেক কাজ বাকি।
ময়ূর প্রশ্ন করিল—কবুতর বিবি পায়রা ধরতে পারবে তো?
প্রাসাদের ছাদে পায়রার খোপ, রাত্রে সহজেই ধরা যাবে।
রাত্রি গভীর হইলে শিলাবতী বাহির হইলেন। আজ আর ময়ূরের গৃহে থাকিয়া পাহারা দিবার প্রয়োজন নাই, সেও তীর-ধনুক লইয়া শিলাবতীর সঙ্গে চলিল। চঞ্চরীর কথা ভাবিয়া তাহার একটা নিশ্বাস পড়িল। চঞ্চরীর ভাগ্যে কি আছে কে জানে। তাহার বুদ্ধি বেশি নাই, হয়তো বেশি দুঃখ পাইবে না।
পথ জনহীন, আকাশে আধখানা চাঁদ। দুইজনে পথ চলিতে চলিতে অনুভব করিলেন, কেহ দূরে থাকিয়া তাঁহাদের অনুসরণ করিতেছে। ময়ূরের মুখে ক্রোধের ভ্রূকুটি দেখা দিল, সে চাপা গলায় বলিল হতভাগা মামুদ।
শিলাবতী বলিলেন—ও যদি জানতে পারে হারেমের দাসীর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ আছে, কবুতর বিবি বিপদে পড়তে পারে। ময়ূর বলিল—আমি ব্যবস্থা করছি।
সে পিছনে ফিরিয়া কাহাকেও দেখিতে পাইল না; কিন্তু নিস্তব্ধ বাতাসে সন্তর্পণে পদশব্দ শুনিতে পাইল। তখন সে শিলাবতীর হাত ধরিয়া টানিয়া একটি গৃহের ছায়াতলে লুকাইল। চাঁদের আলোয় ছায়া বড় গাঢ় হয়; ময়ূর ধনুকে শরসংযোগ করিয়া প্রস্তুত হইয়া রহিল।
কিছুক্ষণ পরে দূরে একটি মানুষ আসিতেছে দেখা গেল। আরও কাছে আসিলে ময়ূর দেখিল মামুদই বটে। তখন সে আকর্ণ ধনু টানিয়া শর নিক্ষেপ করিল।
মরণাহত কুকুরের মতো একটা বিকট চিৎকার। মামুদ রাস্তায় পড়িয়া গড়াগড়ি যাইতে লাগিল।
শিলাবতী বলিলেন—মরে গেল নাকি?
ময়ূর বলিল—না, ঊরুতে মেরেছি। ওকে সত্যসত্যই খোঁড়া করে দিলাম। কিন্তু এখানে আর নয়, হয়তো লোকজন এসে পড়বে।
কিন্তু দিল্লীর অধিবাসীরা বুদ্ধিমান, দ্বিপ্রহর রাত্রে অতিবড় বিকট শব্দ শুনিলেও ঘরের বাহির হয় না। ময়ূর ও শিলাবতী মামুদের বিলীয়মান কাতরোক্তি শুনিতে শুনিতে চলিলেন। দেবদারু বৃক্ষতলে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন কবুতর বিবি দাঁড়াইয়া আছে।
চুপিচুপি কথা হইল। কবুতর বিবি কোঁচড় হইতে একটি ধূম্রবর্ণ কপোত বাহির করিয়া দিল। একটু পাখার ঝটপট শব্দ, শিলাবতী কপোতটিকে নিজ বস্ত্রমধ্যে লুকাইলেন। ময়ূর মালিক কাফুরের নিকট যত স্বর্ণমুদ্রা পাইয়াছিল সমস্ত কবুতর বিবির হাতে দিল। শিলাবতী কবুতর বিবির গণ্ডে চুম্বন করিলেন, উভয়ের চক্ষু অশ্রুসিক্ত হইল। তারপর কবুতর বিবি ছায়ার মতো হারেমের দিকে অদৃশ্য হইয়া গেল।
বৃক্ষচ্ছায়াতলে দাঁড়াইয়া ময়ূর বলিল—আর বাসায় ফিরে গিয়ে কাজ নেই। চলুন, নগরের দক্ষিণ দরজার কাছে লুকিয়ে থাকি, দরজা খুললে বেরিয়ে যাব। দিল্লীতে আমাদের কাজ শেষ হয়েছে।
পরদিন পান্থশালায় ফিরিয়া গিয়া ময়ূর আরও সাতদিন সেখানে রহিল; তারপর কপোতের পায়ে জতুনিবদ্ধ পত্র বাঁধিয়া কপোতকে উড়াইয়া দিল। অভ্রান্ত কপোত একবার চক্রাকারে ঘুরিয়া দিল্লীর দিকে উড়িয়া চলিল। ময়ূর মনশ্চক্ষে দেখিতে পাইল, কপোত রাজপ্রাসাদের চূড়ায় গিয়া বসিয়াছে, কোনও পরিচারিকা তাহার পায়ে পত্র বাঁধা আছে দেখিয়া সুলতানকে খবর দিল। তারপর সুলতান আলাউদ্দিনই সেই পত্র পড়িলেন।
দুরাচারীর পাপজর্জরিত জীবনের চরম পরিণাম।
ইহার পর আলাউদ্দিন বিকৃত মস্তিষ্ক ও ভগ্নস্বাস্থ্য লইয়া তিন বৎসর বাঁচিয়া ছিলেন। ইহাই ইতিহাসের সাক্ষ্য।