দুই মাস পরে
দ্বিতীয় আবর্ত
দুই মাস পরে একটি শীতের অপরাহ্নে ময়ূর চঞ্চরীকে লইয়া দিল্লীর উপকণ্ঠে পৌঁছিল।
পথে কোনও বিপদ আপদ ঘটে নাই। ভাগ্যক্রমে তাহারা মথুরাযাত্রী একদল হিন্দু বণিকের সঙ্গ পাইয়াছিল; বণিকদের সঙ্গে সশস্ত্র রক্ষী ছিল। তিনদিন পূর্বে বণিকদল মথুরায় নামিয়া গেল; বাকি পথটুকু ময়ূর নিঃসঙ্গভাবেই অতিক্রম করিয়াছে, কিন্তু কোনও উপদ্রব হয় নাই। চঞ্চরীও কোনও প্রকার গণ্ডগোল করে নাই। সেই রাত্রে ধরা পড়িবার পর হইতে সে মনে মনে ময়ূরকে ভয় করিতে আরম্ভ করিয়াছে, প্রগৰ্ভতা করিবার সাহস আর নাই। ময়ূর যখন যে আদেশ করে সে নির্বিচারে তাহা পালন করে।
দিল্লীর দক্ষিণ তোরণদ্বার হইতে অর্ধ-ক্রোশ দূরে একটি হিন্দু পান্থশালা পাইয়া ময়ূর এখানেই যাত্রা স্থগিত করিল। সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে নগরদ্বার বন্ধ হইয়া যায়, সুতরাং আজ রাত্রিটা পান্থশালায় কাটাইয়া কাল প্রভাতে নগরে প্রবেশ করাই ভাল।
পান্থশালাটি সুপরিসর; মাঝখানে পট্টাবৃত উঠান, চারিদিক ঘিরিয়া ছোট ছোট কুঠুরি। ময়ূর একটি কুঠুরি ভাড়া লইল। তাহাতে চঞ্চরী থাকিবে, অন্য সকলে কুঠুরির দ্বার ঘিরিয়া উঠানে শয়ন করিবে।
হস্তমুখ প্রক্ষালন করিয়া ময়ূর পান্থপালকে ডাকিল, রাত্রির আহারের নির্দেশ দিয়া পান্থশালার বাহিরে গিয়া দাঁড়াইল। কাল দিল্লী প্রবেশ করিতে হইবে, কিছুক্ষণ নির্জনে চিন্তা করা প্রয়োজন।
সূর্যাস্ত হইয়াছে বটে, কিন্তু শীতের দীর্ঘ সন্ধ্যা এখনও নির্বাপিত হয় নাই। পান্থশালার সম্মুখের পথটি জনশূন্য, আশেপাশে বেশি লোকালয় নাই, ইতস্তত দুই-একটি কুটির দেখা যায়। উত্তর দিকে অর্ধ-ক্রোশ দূরে দিল্লীর কৃষ্ণবর্ণ প্রাকার ঘনায়মান অন্ধকারে অস্পষ্টভাবে দেখা যাইতেছে; যেন একটা বিপুলকায় হস্তী ভূমিতে উপবিষ্ট হইয়া শুণ্ড উর্ধ্বে তুলিয়া আছে। ময়ূর জানে না যে ওই ঊর্ধ্বোঙ্খিত শুণ্ডই জগৎবিখ্যাত কুতবমিনার।
চিন্তাক্রান্ত মুখে পান্থশালার সম্মুখে পদচারণ করিতে করিতে ময়ূরের চোখে পড়িল, পান্থশালার প্রাচীরগাত্রে সংলগ্ন একটি অতি ক্ষুদ্র বিপণি রহিয়াছে। ফলের ও শাকসবজির দোকান। একটি স্ত্রীলোক মঞ্চের উপর বসিয়া আছে। পান্থশালায় যাহারা আসে তাহাদের মধ্যে স্বপাকভোজ কেহ থাকিলে বোধ করি এই দোকান হইতে ফলমূল শাকপত্র ক্রয় করে।
নিতান্ত কৌতূহলবশেই ময়ূর দোকানের সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইল। মঞ্চের উপর শুষ্ক এবং তাজা দুই প্রকার ফলই সাজানো রহিয়াছে; ডালিম, দ্রাক্ষা, খেজুর এবং আরও অনেক জাতের অপরিচিত ফল। সে একটি সুপক্ক ডালিম তুলিয়া লইয়া পসারিনীর মুখের পানে চোখ তুলিল।
রমণীর মুখের উপর হইতে ময়ূরের দৃষ্টি যেন প্রতিহত হইয়া ফিরিয়া আসিল। মুখখানা অস্বাভাবিক রকম কৃষ্ণবর্ণ; বরং কৃষ্ণবর্ণ না বলিয়া নীলবর্ণ বলিলেই ভাল হয়। ময়ূর ক্ষণিক বিস্ময় সংবরণ করিয়া বলিল—এই ডালিমের দাম কত?
রমণীও একদৃষ্টে ময়ূরের পানে চাহিয়া ছিল। তাহার মুখ দেখিয়া বয়স অনুমান করা যায় না, তবে বৃদ্ধা নয়। সে বলিল—ফলের দাম এক দ্রম্ম। তুমি দক্ষিণ থেকে আসছ, তোমার দেশ কোথায়?
নবাগত যাত্রীকে এরূপ প্রশ্ন করা অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু ময়ূর সতর্ক হইল; রমণীকে এক দ্রম্ম দিয়া তাচ্ছিল্যভরে বলিল—নর্মদার পরপারে। তারপর সুন্দর পাকা ফলটি দুই হাতে লোফালুফি করিতে করিতে পাচারণ করিতে লাগিল। …সোমশুক্লা যে শঙ্খ-কঙ্কণ দিয়াছিলেন তাহা সে সুতা দিয়া গলায় ঝুলাইয়া রাখিয়াছে, আঙরাখার তলায় কঙ্কণ দেখা যায় না; কিন্তু ময়ূর বক্ষের উপর তাহার স্পর্শ অনুভব করে। কুমারী সোমশুক্লা—
সন্ধ্যা ঘন হইয়া আসিল। পসারিনী রমণী দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করিবার উদ্যোগ করিতেছে, ময়ূর পান্থশালার কোণ পর্যন্ত গিয়া ফিরিবার উপক্রম করিল। বাহিরে বেশ ঠাণ্ডা, এবার পান্থশালার মধ্যে আশ্রয় লওয়া যাইতে পারে। এই সময় সে লক্ষ্য করিল, উত্তর দিক হইতে একটি লোক আসিতেছে। ছায়ান্ধকারে লোকটির অবয়ব ভাল দেখা গেল না; কিন্তু সে খঞ্জ, লাঠিতে ভর দিয়া খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে আসিতেছে। আরও কাছে আসিলে ময়ূর দেখিল লোকটির মুখে প্রচুর দাড়িগোঁফ রহিয়াছে, সম্ভবত মুসলমান। সে ফিরিয়া যাইতেছিল, পিছন হইতে আহ্বান আসিল—দয়ালু শ্রেষ্ঠি, বিকলাঙ্গ অক্ষমকে দয়া কর।
ময়ূর আবার ফিরিল। সঙ্গে সঙ্গে খঞ্জ ভিক্ষুকটা লাঠি হাতে লইয়া দুই পায়ে দাঁড়াইল এবং ক্ষিপ্রহস্তে লাঠি তুলিয়া ময়ূরের মস্তকে সজোরে আঘাত করিল। ময়ূর আত্মরক্ষার সময় পাইল না; জ্ঞান হারাইবার পূর্বে সে রমণীকণ্ঠের একটি তীব্র চিৎকার শব্দ শুনিতে পাইল। তারপর আর কিছু তাহার মনে রহিল না।
জ্ঞান ফিরিয়া পাইয়া ময়ূর দেখিল সে একটি ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে শুইয়া আছে, ঘরের কোণে দীপ জ্বলিতেছে। একটি স্ত্রীলোক তাহার পাশে বসিয়া মাথায় ও কপালে জলের প্রলেপ দিতেছে। সে চিনিল, ফলের দোকানের পসারিনী।
প্রথমেই ময়ূর বুকে হাত দিয়া দেখিল, কঙ্কণ যথাস্থানে আছে। তখন সে বলিল—খঞ্জ লোকটা কে?
পসারিনী দ্বারের দিকে চাহিল। পান্থপাল সেখানে দাঁড়াইয়া ছিল, সে বলিল—ওর নাম মামুদ, দিল্লীর দস্যু। ও সত্যই খঞ্জ নয়, খঞ্জের ভান করেছিল। দিল্লীর বাইরে পান্থশালার আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়। নূতন মুসাফিরকে একলা পেলে মাথায় লাঠি মেরে যথাসর্বস্ব কেড়ে নিয়ে পালায়। দিল্লীতে এরকম ঠক্ রাহাজান অনেক আছে।
পসারিনী বলিল—ভাগ্যে আমি দেখতে পেয়েছিলাম, কাটারি নিয়ে ছুটে গেলাম। আমাকে দেখে মামুদ পালালো, নইলে তোমার সর্বস্ব কেড়ে নিত।
ময়ূর শয্যায় উঠিয়া বসিল। মাথাটা টন্ করিতেছে বটে, কিন্তু গুরুতর কিছু নয়। সে মুখ তুলিয়া দেখিল দ্বারের কাছে তাহার সঙ্গীরাও উৎকণ্ঠিত মুখে দাঁড়াইয়া আছে। সে হাসিমুখে হাত নাড়িয়া বলিল—ভয় নেই, আমি অক্ষত আছি। তাহারা নিশ্চিন্ত হইয়া চলিয়া গেল।
ময়ূর পসারিনীকে বলিল—এটি কি তোমার ঘর?
পসারিনী বলিল—হাঁ, আমি এই পান্থশালায় থাকি। ময়ূর উঠিয়া দাঁড়াইবার উপক্রম করিলে সে বলিল,-উঠো না উঠো না, আরও খানিক শুয়ে থাকো, শরীর সুস্থ হবে।
ময়ূর বসিল, কৃতজ্ঞ স্বরে বলিল—তুমি আজ আমার প্রাণ বাঁচিয়েছ।
পসারিনী বলিল—তুমি হিন্দু, আমার দেশের লোক। তোমার প্রাণ বাঁচাব না?
ময়ূর কিছুক্ষণ পসারিনীর নীলবর্ণ মুখের পানে চাহিয়া রহিল, শেষে বলিল—তুমি দক্ষিণ দেশের মানুষ?
পসারিনী যেন একটু বিচলিত হইয়া পড়িল, তারপর ধীরে ধীরে বলিল—হাঁ। অনেক দিন দেশছাড়া। এই পান্থশালায় দোকান করেছি, দক্ষিণ দেশ থেকে যারা আসে তাদের কাছে দেশের খবর পাই–
এই সময় পান্থপাল এক পাত্র গরম দুধ আনিল; পসারিনী বলিল—গরম দুধটুকু খাও, শরীর সুস্থ হবে।
ময়ূর দুগ্ধ পান করিয়া শরীরে বেশ স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করিল। পান্থপাল শূন্য পাত্র লইয়া যাইবার পর পসারিনী বলিল—তুমি নর্মদার ওপার থেকে আসছ, কিন্তু রাজ্যের নাম তো বললে না।
ময়ূর একটু ইতস্তত করিল। কিন্তু প্রাণদাত্রীর কাছে মিথ্যা বলা চলে না, সে বলিল—পঞ্চমপুরের নাম শুনেছ?
পসারিনীর চক্ষু ধক করিয়া জ্বলিয়া উঠিল। ময়ূর এবার পসারিনীর মুখ ভাল করিয়া নিরীক্ষণ করিল। মুখের বর্ণ নীল বটে, কিন্তু গঠন অতি সুন্দর, আভিজাত্যব্যঞ্জক। এই গঠনের মুখ সে যেন কোথায় দেখিয়াছে।
পসারিনী যখন কথা বলিল তখন তাহার কণ্ঠে প্রচ্ছন্ন উত্তেজনার ঝঙ্কার শোনা গেল—পঞ্চমপুরের নাম শুনেছি। তুমি পঞ্চমপুর থেকে আসছ?
ময়ূর বলিল—হাঁ।
পঞ্চমপুরের সকলকে চেনো?
সকলকে চিনি না। ভট্ট নাগেশ্বরকে চিনি।
ভট্ট নাগেশ্বর! নামটি পসারিনী পরম স্নেহভরে আস্বাদন করিয়া উচ্চারণ করিল—আর কাকে চেনো?
ময়ূর বলিল—আমার অন্তরাত্মা বলছে তোমাকে বিশ্বাস করতে পারি।–আমি রাজপুরীর সকলকে চিনি, রাজা ভূপ সিংহ আমার প্রভু।
পসারিনীর চক্ষু দুইটি অন্তর্বাষ্পে উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। অতঃপর ময়ূর সসম্ভ্রমে বলিল-আপনাকে সম্ভ্রান্ত বংশের মহিলা মনে হচ্ছে। কিন্তু–আপনার–
মুখ কালো? পসারিনী হাসিল! সুন্দর দন্তপংক্তির রেখা ঈষৎ দেখা গেল।
ময়ূর বিস্ফারিত চক্ষে কিয়ৎকাল চাহিয়া থাকিয়া করজোড়ে বলিল—আপনাকে চিনেছি।
পসারিনী বলিল—চিনেছ! কি করে চিনলে?
ময়ূর বলিল—আপনার হাসি দেখে। রাজকন্যা সোমশুক্লার হাসি ঠিক আপনার মতো।
সোমশুক্লা! ওঃ, তার বয়স এখন সতেরো বছর। পসারিনী সহসা দুহাতে মুখ ঢাকিয়া কাঁদিয়া উঠিল।
কিছুক্ষণ কাটিবার পর ময়ূর স্খলিত স্বরে বলিল—কিন্তু দেবি, আপনি এখানে—এভাবে—
চক্ষু মুছিয়া পসারিনী বলিল—আমার কথা পরে হবে। আগে তুমি সব কথা বল। কুমার রামরুদ্র ভাল আছেন?
ময়ূর হেঁটমুখে বলিল—কুমার রামরুদ্র বেঁচে নেই। নয় বছর আগে রাজা তাঁকে দিল্লী পাঠিয়েছিলেন বংশের কলঙ্কমোচনের জন্য, আলাউদ্দিনের জল্লাদের হাতে তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
পসারিনী কপালে করাঘাত করিয়া আবার কাঁদিল। শেষে অশু সংবরণ করিয়া বলিল—হায়, রামরুদ্রের সঙ্গে যদি আমার দেখা হত। নয় বছর আগে আমি এখানেই ছিলাম। সবই বিধিলিপি। কিন্তু এখন রাজা তোমাকে কি জন্য পাঠিয়েছেন তাই বল।
আর গোপনতার প্রয়োজন ছিল না, ময়ূর যাহা যাহা জানিত সব বলিল। পসারিনী সর্বগ্রাসী চক্ষু মেলিয়া শুনিতে লাগিল; শুনিতে শুনিতে কখনও তাহার চক্ষু উদ্দীপনায় ফুরিত হইল, কখনও হিংসায় প্রখর হইল। বিবৃতির অন্তে সে দীর্ঘকাল করলগ্ন কপোলে বসিয়া থাকিয়া শেষে বলিল—পিতা প্রতিহিংসার উত্তম উপায় উদ্ভাবন করেছেন। ম্লেচ্ছ রাক্ষস ভোগের জন্য পাগল, কিন্তু তার মনে একটিমাত্র বাধা আছে; নিজের কন্যা। এখনো আলাউদ্দিনের ভোগক্ষুধা মেটেনি। যাক্, দৈব অনুকূল, তাই আমার সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছে। তুমি একা এ কার্য সাধন করতে পারতে না।
ময়ূর নিজ বক্ষস্থিত শঙ্খ কঙ্কণটি একবার স্পর্শ করিল, মনে মনে বলিলসত্যই দৈব অনুকূল, এই শঙ্খ আমার ভাগ্যদাতা। মুখে বলিল-দেবি, ভাগ্যবশে আপনার সাক্ষাৎ পেয়েছি। কিন্তু এবার আপনার কথা বলুন।
শিলাবতী তখন ভূমিসংলগ্ন নেত্রে ধীরে ধীরে নিজের মর্মন্তুদ কাহিনী বলিলেন—
আলাউদ্দিনের সঙ্গে সাত-আট হাজার অশ্বারোহী সৈন্য এবং দশ-বারোটা হাতি ছিল। শিলাবতীকে হাতির পিঠে তুলিয়া সে সসৈন্যে দক্ষিণ দিকে চলিল। দেবগিরির উত্তুঙ্গ দুর্গের সম্মুখে দুইবার ভীষণ যুদ্ধ হইল; হাতির পিঠে বসিয়া শিলাবতী যুদ্ধ দেখিলেন। এমন বীভৎস দৃশ্য পৃথিবীতে আর নাই। তারপর বহু ধনরত্ন হাতির পিঠে তুলিয়া ম্লেচ্ছরা ফিরিয়া চলিল। প্রথমে তাহারা গেল প্রয়াগের নিকট কারা-মানিকপুর নামক স্থানে। সেখানে আলাউদ্দিনের প্রধানা বেগম এবং অন্যান্য বহু স্ত্রীলোক ছিল; শিলাবতীও হারেমে স্থান পাইলেন।
এই কারা-মানিকপুরেই আলাউদ্দিন বিশ্বাসঘাতকতা দ্বারা তাহার পিতৃব্য সুলতান জালালউদ্দিনকে হত্যা করে, তারপর পিতৃব্যের মুণ্ড বশাফলকে তুলিয়া দিল্লী যাত্রা করে এবং সিংহাসন অধিকার করে।
শিলাবতীও আসিয়া দিল্লীর হারেমে রহিলেন। সেখানে নিত্য নবযৌবনা সুন্দরীর আবির্ভাব। যাহারা পুরাতন হইয়াছে তাহারা সহসা কোথায় অদৃশ্য হইয়া যাইতেছে কেহ জানে না। হারেমে ক্ষুন্নযৌবনার স্থান নাই।
হারেমে একটি দাসী ছিল, তাহার নাম ছিল কপোতী। সে অনেক শিল্পবিদ্যা জানিত–পান সাজা, মালা গাঁথা, অলকা-তিলক আঁকা, আরও কত কি। সে আদৌ হিন্দু ছিল, তাহাকে গো-মাংস খাওয়াইয়া মুসলমান করা হইয়াছিল। কিন্তু মনে মনে সে হিন্দু ছিল। হারেমের মেয়েরা তাহাকে কবুতর বিবি বলিয়া ডাকিত। এই কবুতর বিবি প্রথম হইতেই শিলাবতীর প্রতি আকৃষ্ট হইয়াছিল, সুযোগ পাইলেই আসিয়া দুদণ্ড গল্প করিত; শিলাবতীর দুঃসহ জীবন এই বিগতযৌবনা দাসীর সাহচর্যে কিঞ্চিৎ সহনীয় হইয়াছিল।
দুই বৎসর কাটিবার পর হারেমে প্রবেশ করিলেন গুর্জরের রানী কমলা। তিনি অলৌকিক রূপবতী এবং রতিশাস্ত্রে সুপণ্ডিতা ছিলেন; অল্পকাল মধ্যেই তিনি আলাউদ্দিনকে বশীভূত করিলেন। তারপর কমলার কটাক্ষ ইঙ্গিতে হারেম হইতে উপপত্নীরা একে একে অন্তর্হিত হইতে লাগিল। একদিন কবুতর বিবি চুপি চুপি আসিয়া শিলাবতীকে জানাইল—খবর পেয়েছি। তোমাকে সরাবার চেষ্টা হচ্ছে। ঘোড়াশালের সার-সহিসের ওপর সুলতান খুশি হয়েছেন, তোমাকে তার হাতে দান করবেন।
শুনিয়া ঘৃণায় শিলাবতীর দেহ কুঞ্চিত হইয়া উঠিল। তিনি কবুতর বিবির পদতলে পড়িয়া বলিলেন—আমাকে বাঁচাও। আমি হারেম থেকে পালিয়ে যেতে চাই।
কবুতর বিবি বলিল—পালানো কি সহজ? হারেমের ফটকে কড়া পাহারা। শিলাবতী বলিলেন—তুমি উপায় কর, আমি তোমার কেনা হয়ে থাকব।
কবুতর বিবি তখন বলিল—আমি এক বিদ্যা জানি, তার জোরে তুমি পালাতে পারবে, রক্ষীরা তোমাকে হাবসি দাসী ভেবে পথ ছেড়ে দেবে।
সেই রাত্রে কবুতর বিবি শিলাবতীর মুখে ও হাতে সূচী ফুটাইয়া ফুটাইয়া উলকি কাটিয়া দিল, অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করিয়া শিলাবতী উলকি পরিলেন, তাঁহার মুখ ও হাতের শুভ্রতা উলকির নীলবর্ণে ঢাকা পড়িল।
পরদিন তিনি মাথায় জলের কলস লইয়া হারেম হইতে বাহির হইলেন। হারেমের হাবসি দাসীরা অন্দরে-বাহিরে নিত্য যাতায়াত করে; শিলাবতীর স্ফীত কৃষ্ণবর্ণ মুখের পানে রক্ষীরা তাকাইল না, পথ ছাড়িয়া দিল।
হারেমের বাহিরে কিয়দ্র আসিয়া তিনি কলস ফেলিয়া দিয়া নগরের দক্ষিণ দ্বারের দিকে চলিলেন; তোরণ পার হইয়া সিধা পথ ধরিয়া চলিলেন। কোথায় যাইতে হইবে তাহা জানেন না, কেবল দক্ষিণ দিকে চলিয়াছেন।
এই পান্থশালা পর্যন্ত আসিয়া তাঁহার আর চলৎশক্তি রহিল না। পান্থপাল তাঁহাকে ভিতরে : লইয়া গেল। তদবধি শিলাবতী এই পান্থশালায় আছেন। পান্থপাল পঞ্চমপুরের লোক, সে তাঁহার প্রকৃত পরিচয় জানে। সে তাঁহাকে পঞ্চমপুরে ফিরিয়া যাইবার জন্য নিবন্ধ করিয়াছিল, কিন্তু তিনি যান নাই। কোন্ মুখ লইয়া পিতার সম্মুখে দাঁড়াইবেন?
অনন্তর চৌদ্দ বৎসর এই পান্থশালায় ফল বিক্রয় করিয়া কাটিয়াছে। কেহ তাহাকে চিনিতে পারে নাই। শিলাবতী নাম্নী হতভাগিনী রাজকন্যা মরিয়া গিয়াছে।
তারপর আজ–
আত্মকাহিনী শেষ করিয়া শিলাবতী অঙ্গারের ন্যায় চক্ষু তুলিলেন, বলিলেন—না, শিলাবতী এখনো মরেনি।
তারপর তিনি উঠিয়া ঘরের বাহিরে গেলেন। অল্পকাল পরে তিনি ও পান্থপাল ময়ূরের রাত্রির আহার লইয়া উপস্থিত হইলেন। শিলাবতী বলিলেন—তুমি আহার কর। তোমার সঙ্গীরা নৈশাহার শেষ করে শয়ন করেছে, চঞ্চরীও ঘুমিয়েছে। তুমি আহার করে নাও, তারপর পরামর্শ হবে।
ময়ূর বলিল—আপনি আহার করবেন না?
শিলাবতী বলিলেন—না, ময়ূর ভাই, আজ আমার গলা দিয়ে অন্ন নামবে না।
পান্থপাল আসন পাতিয়া, জলের ঘটি রাখিয়া চলিয়া গেল। পান্থপালটি অতি স্বল্পবাক্ মানুষ, নীরবে কাজ করিয়া যায়। ময়ূর আহারে বসিল।
আহারান্তে মন্ত্রণা আরম্ভ হইল। অনেক রাত্রি পর্যন্ত মন্ত্রণা চলিল।