Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » শঙ্খনীল কারাগার (১৯৭৩) || Humayun Ahmed » Page 7

শঙ্খনীল কারাগার (১৯৭৩) || Humayun Ahmed

মায়ের গানের রেকর্ড

মায়ের গানের রেকর্ডটা একটা লোক এসে দিয়ে গেল। খুব যত্ন করে কাগজে মোড়া। রেকর্ডের লেবেলে মায়ের নাম মিস শিরিন সুলতানা খুব অস্পষ্টভাবে পড়া যায়। হিজ মাস্টার্স ভয়েসের কুকুরের ছবিটার উপর আবার লাল কালিতে কাঁচা হাতে ইংরেজিতে মায়ের নাম লেখা হয়তো তিনিই লিখেছিলেন।

বাসায় একটা সাড়া পড়ে গেল। ঝুনু তার ছেলে কোলে নিয়ে পুরনো দিনের মতোই লাফাতে লাগল। বাজিয়ে শোনার মতো গ্রামোফোন নেই দেখে শুধু কাঁদতে বাকি রাখল।

মন্টু রেকর্ড-প্লেয়ার আনতে বেরিযে গেল তখনি। রাবেয়া কলেজে। সেখানে কী একটা ফাংশন নাকি। মন্টু তাকেও খবর দিয়ে যাবে। বাবাকে দেখে মনে হল, তিনি আমাদের এই হৈচৈ দেখে একটু লজ্জা পাচ্ছেন। নিনুও এতটা উৎসাহের কারণ ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। বাবাকে বললাম, আজ একটা উৎসবের মতো করা যাক বাবা। খুব ঘরোয়াভাবে সন্ধ্যার পর মায়ের কথা আলোচনা হবে। তারপর ঘুমুতে যাবার আগে রেকর্ড বাজান হবে। বাবা সংকুচিত ভাবে বললেন, এ-সবের চেয়ে তো মিলাদটিলাদ। ঝানু সঙ্গে সঙ্গে বাতিল করে বলল, সে পরে হবে, আজ দাদা যা বলছে তাই হোক।

বাবা জুতো পরে ফুল আনতে চলে গেলেন। ফুলের মালায় মায়ের ছবি সাজান হবে। ঝুনু বলল, বাবা, একটু ধূপ এনো। না পেলে আগরবাতি।

আমি রেকর্ডটা লুকিয়ে ফেললাম, যাতে আগেভাগে কেউ শুনে ফেলতে না পারে। কিটকিকে টেলিফোনে বললাম পাশের বাসা থেকে।

হ্যালো কিটকি। আমি–

বুঝতে পারছি আপনি কে? কি ব্যাপার?

খালাকে নিয়ে আয় না বাসায় এক বার।

কী ব্যাপার?

এসেই শুনবি।

আহা বলেন না?

একটা ছোটখাট ঘরোয়া উৎসব।

কিসের উৎসব?

আসলেই দেখবি।

বলেন না ছাই!

মায়ের গাওয়া রেকর্ডটা বাজান হবে। তাছাড়া তাঁর স্মৃতিতে একটা ঘরোয়া আলোচনা। এই আর কি!

বাহু, সুন্দর আইডিয়া তো। আমি আসছি।

আচ্ছা কিটকি, মায়ের সঙ্গে তোলা খালার কোনো ছবি আছে?

দেখতে হবে।

যদি পাস তো—

হ্যাঁ নিয়ে আসব। কখন আসতে বলছেন?

রাত আটটায়। সন্ধ্যাবেলা রাবেয়া রিক্সা থেকে পাংশু মুখে নামল। ভীত গলায় বলল, বাসায় কিছু হয়েছে?

না, কী হবে?

আরে মন্টুটা এমন গাধা, কলেজে। আমার কাছে স্লিপ পাঠিয়েছে, বাসায় এসো, খুব জরুরী। আমি তো ভয়ে মরি! না জানি কার কি হল!

না, কী আর হবে। মায়ের রেকর্ডটা দিয়ে গেছে।

তাই নাকি, বলবি তো।

বাবা দামী দুটি জরির মালা নিয়ে এলেন। ফুলের মালা পেলাম না রে, অনেক খুঁজেছি। মালা দুটি অনেক বড়ো হল। ফটোতে দিতেই ফটো ছাড়িয়ে নিচে অব্দি ঝুলতে লাগল।

বসার ঘরটা সুন্দর করে সাজান হল। চেয়ার-টেবিল সরিয়ে মেঝেতে বিছানা করা হল। ধূপ পোড়ান হল। স্মৃতি হিসেবে মায়ের পার্কার কলমটা রাখা হল। এটি ছাড়া তাঁর স্মৃতি-বিজড়িত আর কিছুই ছিল না বাসায়।

ঠিক আটটায় কিটকি এল। সঙ্গে খালাও এসেছেন। বেশ কতগুলি ছবিও এনেছে কিটকি।

উৎসবটা কিন্তু যেমন হবে ভেবেছিলাম, তার কিছুই হল না। খালার সঙ্গে তোলা মায়ের ছোটবেলাকার ছবিগুলি দেখলাম সবাই।

মার কথা কিছু বলবার জন্যে অনুরোধ করতেই খালা তার নিজের কথাই বলতে লাগলেন। ছোটবেলায় কেমন নাচতে পারতেন, কেমন অভিনয় করতে পারতেন। তাঁর করা ইন্দ্ৰাণীর পাট দেখে কোন ডাইরেক্টর তাঁকে ছবিতে নামার জন্যে ঝোলাঝুলি করেছিল–এই জাতীয় গল্প। খারাপ লাগছিল খুব। খালার থামার নাম নেই। শেষটায় কিটকি বলল, আপনি একটু রেস্ট নিন মা, আমরা খালুজানের কথা শুনি।

বাবা থাত মত খেয়ে বললেন, না-না, আমি কী বলব? আমি কী বলব? তোমরা বল মা, আমি শুনি।

না শালুজান, আপনাকে বলতেই হবে। আমরা ছাড়ব না।

বাবা বিব্রত হয়ে বললেন, তোমাদের মা খুব বড়ঘরের মেয়ে ছিল। আমাকে সে নিজে ইচ্ছে করেই বিয়ে করেছিল। তখন তার খুব দুর্দিন। আমি খুব সাহস করে তাকে বললাম আমাকে বিয়ে করতে! হ্যাঁ, আমি তাকে খুব পছন্দ করতাম। সে খুব অবাক হয়েছিল আমার কথা শুনে। কিন্তু রাজি হয়েছিল সঙ্গে সঙ্গে। না, আমি তার কোনো অযত্ন করি নি। হ্যাঁ, আমার মনে হয় সে শেষ পর্যন্ত খুশিই হয়েছিল। যাক, কী আর জানি আমি। তোমরা বরং গানটা শোন। চোখে আবার কি পড়ল। কি মুশকিল!

বাবা চোখের সেই অদৃশ্য জিনিসটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, মন্টু রেকর্ড চালিয়ে চালিয়ে দিল। পুরনো রেকর্ড, তবু খুব সুন্দর বাজছিল। আমরা উৎকৰ্ণ হয়ে রইলাম। অল্পবয়সী কিশোরীর মিষ্টি সুরেলা গলা। এই তো এত পথ এত যে আলো… ..। অদ্ভুত লাগছিল। ভাবতেই পারছিলাম না, আমাদের মা গান গাইছেন। ফ্রক-পরা পরীর মতো একটি মেয়ে হারমোনিয়ামের সামনে বসে দুলে দুলে গান গাইছে, এমন একটি চিত্র চোখে ভাসতে লাগল।

বাবার দিকে তাকিয়ে দেখি, তাঁর চোখের সেই অদৃশ্য বস্তুটি ফোঁটা ফোঁটা অশ্রুকণা কণা হয়ে করে পড়ছে মেঝেতে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress