Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » শঙ্খনীল কারাগার (১৯৭৩) || Humayun Ahmed » Page 3

শঙ্খনীল কারাগার (১৯৭৩) || Humayun Ahmed

আবিদ হোসেন

ও! ইনি আবিদ হোসেন।

রাবেয়া হাসিমুখে বলল। চকোলেটের প্যাকেট পেয়ে সে খুব খুশি হয়েছে।

কোথায় দেখা হয়েছে তাঁর সাথে?

বাসায় এসেছিলেন, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আলাপ হল। ছোটবেলা তোকে নাকি লিফট্‌ দিতেন গাড়িতে?

হ্যাঁ। স্কুলটা অনেক দূরে পড়ে গিয়েছিল। যাওয়ার সময় বাবা সঙ্গে যেতেন, আসবার সময় প্রায়ই এই ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হত। আমাদের দু জনের মধ্যে খুব খাতির হয়েছিল। দাঁড়া, সবটা বলি। চা বানিয়ে আনি আগে।

ঘরে আলো জ্বলছিল না। বাইরে ভীষণ দুযোগ। অল্প একটু ঝড়-বাদলা হলেই এখানকার কারেন্ট চলে যায়। ঘরে যে একটিমাত্র হ্যারিকেন ছিল, সেটি জ্বালিয়ে লুড়ু খেলা হচ্ছে। বাবাও খেলছেন বেশ সাড়াশব্দ করেই। রুনুর গলা সবচেয়ে উঁচুতে।

সে কি বাবা, তোমার চার হয়েছে, পাঁচ চালালে যে?

পাঁচই তো উঠল।

হুঁ, আমার বুঝি চোখ নাই। এবার থেকে তোমার দান আমি মেরে দেব।

অন্ধকার ঘরে বসে বৃষ্টি পড়া দেখছি। দেখতে দেখতে বর্ষা এসে গেল। ঝমোঝমিয়ে বৃষ্টি নামছে। টিনের চালে বাজনার মতো বৃষ্টি, অপূর্ব লাগে। রাবেয়া চা নিয়ে খাটে উঠে এল। দু জনে চাদর গায়ে মুখোমুখি বসলাম। বাবেয়া বলল গোড়া থেকে বলি?

বল।

থ্রিতে পড়ি তখন। মৰ্ণিং স্কুল। এগারোটায় ছুটি হয়ে গেছে। আমি আর উকিল সাহেবের মেয়ে রাহেলা বাসায় ফিরছি, এমন সময় ঐ ভদ্রলোক কী মনে করে লম্বা পা ফেলে আমাদের কাছে এলেন। আমাকে বললেন, তোমরা কোথায় যাবে? চল তোমাদের পৌঁছে দিই। গাড়ি আছে আমার। ঐ দেখ, দাঁড় করিয়ে রেখেছি।

রাহেলা বলল, আমরা হেটে যেতে পারব।

না-না, হেটে যাবে কেন? এস এস, গাড়িতে এস। মিষ্টি খাবে তোমরা? নিশ্চয়ই খাবে। কি বল?

ভদ্রলোক আমাদের দিকে না তাকিয়ে ড্রাইভারকে বললেন, তুমি নেমে যাও, একটা রিকশা করে জিনিসগুলি নিয়ে যাও, আমি বাচ্চাদের নিয়ে একটু ঘুরে আসি।

আমরা কী করবে। তেবে পাচ্ছিলাম না। গাড়িতে চড়ার লোভ ষোল-আনা আছে। আবার ভয়-ভয়ও করছে। রাহেলা ফিসফিস করে বলল, ও কে রে ভাই?

আমি মিথ্যা করে বললাম, আমাদের এক জন চেনা লোক, চল বেড়িয়ে আসি।

রাহেলা বলল, ছেলেধরা না তো?

তখন চারদিকে খুব ছেলেধরার কথা শোনা যেত। ছেলেধরােরা নাকি ছেলেমেয়ে ধরে নিয়ে হোটেলে বিক্রি করে দেয়। সেখানে মানুষের মাংস রান্না হয়। কে আবার মাংস খেতে গিয়ে একটি বাচ্চা মেয়ের কড়ে আঙুল পেয়েছে। এই জাতীয় গল্প। রাহেলার কথা শুনে ভয় পেলেও হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেছি, ছেলেধরা এমন হয় বুঝি? ভদ্রলোক গাড়ির দরজা খুলে আমাদের ডাকলেন। উঠে বসলাম দু জনেই।

মিষ্টির দোকান দেখে তো আমি হতভম্ব। মেঝেতে কার্পেট, দেয়ালে দেয়ালে ছোট ছোট লম্বা মাদুরে অদ্ভুত সব ছবি, টেবিলগুলির চারপাশে ধবধবে প্লাষ্টিকেব চেয়ার, প্রতিটি টেবিলে সবুজ কাঁচের ফুলদানিতে টাটকা ফুল। ঘরের মাঝখানটায় কাঁচের জারে রং-বেরংয়ের মাছ। রাহেলা পাংশু মুখে বলল, আমার বড় ভয় করছে ভাই।

বল খুকিরা, কী খাবে? কোনো লজ্জা নেই, যত ইচ্ছে, আর যা খুশি। অমি নিজে মিষ্টি খাই না! তোমরা খাও।

ভদ্রলোক হাড় বড়িয়ে কথা বলতে বলতে সিগারেট ধরালেন। রাহেলার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার কী নাম খুকি?

রাহেলা। পাংশু মুখে বলল রাহেলা।

খাও খাও, লজ্জা করো না।

রাহেলা কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলল, আমার ভয় করছে, আমি বাসায় যাব।

অল্প দিনেই ভয় ভেঙে গেল আমাদের। ভদ্রলোকের সঙ্গে রোজ দেখা হতে লাগল। তিনি যেন গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। আমাদের জন্যেই। দেখা হলেই বলতেন, গাড়িতে করে বেড়াতে ইচ্ছে হয় খুকি? ড্রাইভার, মেয়ে দুটিকে নিয়ে একটু বেড়িয়ে আস।

শুধু রাহেলাই নয়, মাঝে মাঝে অন্য মেয়েরাও থাকত। তারা বলত, রাবেয়া, কেউ যদি দেখে ফেলে, তবে?

এর মধ্যে আমি অসুখে পড়লাম। এক মাসের মতো স্কুল কামাই। হাড় জিরজিরে রোগ হয়ে গেছি। পায়ের উপর দাঁড়াতে পারি না এমন অবস্থা, মাথার সব চুল পড়ে গেছে, আঙুল ফুলে গেছে। অফিস থেকে ফিরেই বাবা আমাকে কোলে নিয়ে বেড়াতেন। এক দিন এমন বেড়াচ্ছেন, হঠাৎ দেখি ঐ লোকটি গাইগট করে এসে ঢুকছে গেট দিয়ে, মুখে সিগারেট, ঘন ঘন ধোঁয়া ছাড়ছে। বাবা অবাক হয়ে বললেন, কী চান আপনি?

মেয়েটির অসুখ করেছে?

হ্যাঁ।

কী অসুখ?

লিভার টাবল।

আপনি যদি বলেন তবে আমি এক জন বড়ো ডাক্তার পাঠাতে পারি, আমার এক জন বন্ধু আছেন।

বাবা একটু রেগে বললেন, মেয়েকে বড়ো ডাক্তার দেখাব না। টাকার অভাবে, এই ভেবেছেন। আপনি?

ভদ্রলোক বললেন, কাকে দেখিয়েছেন, আপনি যদি দয়া করে–

শরাফত আলিকে।

ভদ্রলোক খুশি হয়ে গেলেন। আমি শরাফতের কথাই বলছিলাম।

বাবা বললেন, আপনি চলে যান। কেন এসেছেন এখানে?

না, মানে–

আর আসবেন না।

ভদ্রলোক খুব দ্রুত চলে গেলেন। কথাবার্তা শুনে মা বেরিয়ে বললেন, কী হয়েছে? কার সঙ্গে কথা বলছিলে?

অবিদ হোসেন এসেছিল।

যদিও আমি তখন খুব ছোট, তবু বাবা-মা দু জনের ভাবভঙ্গি দেখেই আচ করেছিলাম। এই লোকটি তাঁদের চেনা এবং দু জনের কেউই চান না সে আসুক।

তারপর আমার দেখি নি। তবে। এই এত দিন পরে আবার এসেছেন চকোলেট নিয়ে।

লোকটি কে রে রাবেয?

রাবেয়া জবাব দেবার আগেই বাবা ঢুকলেন, ভাত দিয়ে যাও মা। সকাল সকাল খেয়ে শুয়ে পড়ি।

আগে চকোলেট খাও বাবা। এই নাও।

কে এনেছে চকোলেট, খোকা তুই নাকি?

না বাবা, আবিদ হোসেন এনেছেন।

বাবা একটু অবাক হয়ে বললেন, দেশে ফিরেছে জানি না তো। এক জার্মান মেয়েকে বিয়ে করেছিল শুনেছিলাম। সেখানেই নাকি থাকবে?

আমি বললাম, আবিদ হোসেন কে বাবা?

আমার এক জন বন্ধুমানুষ। রেলওয়ে ইঞ্জিনীয়ার, খুব ভালো সেতার বাজাতে জানে।

সকাল সকাল খাওয়া সারা হল। একটিমাত্র হ্যারিকেনে চারদিক ভৌতিক লাগছে। আমাদের বড়ো বড়ো ছায়া পড়েছে দেয়ালে। বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি। ঝড় উঠেছে হয়তো, শোঁ শোঁ আওয়াজ দিচ্ছে। মন্টু বলল, বাবা, গল্প বলেন।

কিসের গল্প, ভূতের?

নিনু বলল, না, আমি ভয় পাচ্ছি, হাসির গল্প বলেন।

বাবা বললেন, রাবেয়া, তুই একটা হাসির গল্প বল।

রাবেয়ার হাসির গল্পটা তেমন জমল না। বাবা অবশ্যি অনেকক্ষণ ধরে হাসলেন।

রুনু বলল, মনে পড়ে। আপা, মা এক দিন এক কানা সাহেবের গল্প বলেছিল? সেদিনও এমন ঝড়-বৃষ্টি।

কোন গল্পটার কথা বলছিস?

ঐ যে, সাহেব বাজারে গেছে গুড় কিনতে।

মনে নেই তো গল্পটা, বল তো।

রুনু চোখ বড়ো বড়ো করে গল্প বলে চলল। রুনুটা অবিকল মায়ের চেহারা পেয়েছে। এই বয়সে হয়তো মা দেখতে এমনিই ছিলেন। কেমন অবাক লাগে–একদিন মা যে— গল্প করে গেছেন, সেই গল্পই তাঁর এক মেয়ে করছে। পরিবেশ বদল হয় নি একটুও, সেদিন ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছিল, আজও হচ্ছে।

গল্প শেষ হতেই বাবা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। টানা গলায় বললেন, শুয়ে পড় সবাই।

শুয়ে শুয়ে আমার কেবলই মায়ের কথা মনে পড়তে লাগল, বেশ কিছুদিন আগেও এক দিন এরকম মনে পড়েছিল। সেকেণ্ড ইয়ারের ক্লাস নিচ্ছি, হঠাৎ দেখি বারান্দায় একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কার সঙ্গে যেন গল্প করছে। দেখামাত্র ধক করা উঠল। বুকের ভেতর। অবিকল মায়ের মতো চেহারা। তেমনি দাঁড়াবার ভঙ্গি, বিরক্তিতে কুচকে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরা। আমি এত বেশি বিচলিত হলাম যে, ক্লাসে কী বলছি নিজেই বুঝতে পারছিলাম না। ক্লাস শেষ হলেই মেয়েটি সঙ্গে আলাপ করব, এই ভেবে প্ৰাণপণে ক্লাসে মন দিতে চেষ্টা করলাম। ক্লাস একসময় শেষ হল, মেয়েটিকে খুঁজে পেলাম না। সেদিনও সমস্তক্ষণ মায়ের কথা ভেবেছিলাম। সে-রাতে অনেক দিন পর স্বপ্ন দেখলাম মাকে। মা ছোট্ট খুকি হয়ে গেছেন। ফ্রক পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন্ন ঘরময়। আমি বলছি, মা আপনি এত হৈচৈ করবেন না, আমি ঘুমুচ্ছি।

মা বললেন, বা রে, আমি বুঝি এক্কা-দোক্কাও খেলব না?

খেলুন, তবে শব্দ করে নয়।

তুই খেলবি আমার সঙ্গে খোকা?

না, আমি কত বড়ো হয়েছি দেখছেন না? আমার বুঝি এসব খেলতে আছে?

খুব অবাক হয়েছিলাম স্বপ্নটা দেখে। এমন অবাস্তব স্বপ্নও দেখে মানুষ!

মায়ের চারদিকের রহস্যের মতো স্বপ্নটাও ছিল রহস্যময়। চারদিকে রহস্যের আবরণ তুলে তিনি আজীবন আমাদের চেয়ে আলাদা হয়ে ছিলেন। শুধু কি তিনিই? তাঁর পরিবারের অন্য মানুষগুলিও ছিল ভিন্ন জগতের মানুষ, অন্তত আমাদের কাছে।

মাঝে-মাঝে বড়ো মামা আসতেন বাসায়। বাবা তটস্থ হয়ে থাকতেন সারাক্ষণ। দৌড়ে মিষ্টি আনতে যেতেন। রাবেয়া গলদঘর্ম হয়ে চা করত, নিমকি ভাজিত। বড় মামা সিকি কাপ চা আর আধখানা নিমকি খেতেন। যতক্ষণ থাকতেন, অনবরত পা নাচাতেন আর সিগারেট ফুকতেন। আমাদের দিকে কখনো মুখ তুলে তাকিয়েছেন বলে মনে পড়ে না। বাবা অবশ্যি এক এক করে আমাদের নিয়ে যেতেন তাঁর সামনে। আমরা নিজেদের নাম বলে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। মামা ভীষণ অবাক হয়ে বলতেন, এরা সবাই শিরিনের ছেলেমেয়ে? কী আশ্চর্য! আশ্চর্যটা যে কী কারণে, তা বুঝতে না পেরে আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করতাম। মামা রুমাল দিয়ে ঠোঁট মুছতে মুছতে বলতেন, বুঝলেন আজহার সাহেব, শিরিন ছোটবেলায় মোটেই ছেলেমেয়ে দেখতে পারত না। আর তারই কিনা এতগুলি ছেলেমেয়ে!

এই যে, এইটিই কি বড়ো ছেলে?

মামা আঙুল ধরে রাখতেন আমার দিকে। আমি ঘাড় নাড়াতাম।

মামা বলতেন, কী পড়া হয়?

নাইনে পড়ি।

বাবা অতিরিক্ত রকমের খুশি হয়ে বলতেন, খোকা এইটের বৃত্তি পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছে। জ্বর নিয়ে পরীক্ষা দিয়েছিল। স্কুল থেকে একটা মেডেল দিয়েছে। গোন্ড মেডেল। রাবেয়া, যাও তো মা, মেডেলটা তোমার মামাকে দেখাও। ছোট ট্রাঙ্কে আছে।

ব্লেডের মতো পাতলা মেডেলটা মামা ঘুরিয়েফিরিয়ে দেখতেন। আবেগশূন্য গলায় বলতেন, শিরিনের মতো মেধাবী হয়েছে ছেলে। শিরিন মেট্রিকুলেশনে মেয়েদের মধ্যে প্রথম হয়েছিল।

বলতে বলতে মামা গম্ভীর হয়ে যান। অপ্রাসঙ্গিক ভাবে বলেন, আমাদের পরিবারটাই ছিল অন্য ধরনের। হাসিখুশি পরিবার। বাড়ির নাম ছিল কারা কানন। দেয়ালের আড়ালে ফুলের বাগান। শিরিন নিজেই দিয়েছিল নাম।

মা আসতেন আরো কিন্তু পরে। খুব কম সময় থাকতেন। আমরা বেরিয়ে আসতাম। সবাই। একসময় দেখতাম মুখ কালো করে মামা উঠে যেতেন। মা শুয়ে শুয়ে কাঁদতেন। সারা দুপুর। আমরা মনমরা হয়ে ঘুরে বেড়াতাম। কিছুই ভালো লগত না। সেই অল্পবয়সেই মাকে কি গভীর ভালোই না বেসেছিলাম! অথচ তিনি ছিলেন খুবই নিরাসক্ত ধরনের। কথাবার্তা বলতেন কম। নিঃশব্দে হাঁটতেন। নিচু গলায় কথা বলতেন। মাঝে মাঝে মনে হত, বড়ো রকমের হতাশায় ড়ুবে গেছেন। তখন সময় কাটাতেন বিছানায় শুয়ে শুয়ে। প্রয়োজনের কথাটিও বলতেন না। ঘরের কাজ রাবেয়া আর একটা ঠিকে ঝি মিলে করত। বিষন্নতায় ড়ুবে যেত সারা বাড়ি। বাবা অফিস থেকে এসে চুপচাপ বসে থাকতেন বারান্দায়। রাবেয়া চা এনে দিত। বাবা ফিস্‌ফিস্‌ করে বলতেন, তোর মাকে দিয়েছিস?

না, মা খাবে না।

আহা, দিয়েই দেখি না।

ভাতই খায় নি দুপুরে।

অ।

রুনু—ঝনু সকাল সকাল বই নিয়ে বসত। গলার সমস্ত জোর দিয়ে পড়ত দু জনে। বাবা কিছুক্ষণ বসতেন তাদের কাছে, আবার যেতেন রান্নাঘরে রাবেয়ার কাছে। কিছুক্ষণ পরই আবার উঠে আসতেন। আমার কাছে। ইতস্তত করে নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিক ব্যাপার উত্থাপন করতেন, খোকা, তোদের কলেজে মেয়ে-প্রফেসর আছে?

আছে।

বিয়ে হয়েছে নাকি?

সবগুলির নিশ্চয়ই হয় নি। কলেজের মেয়ে-প্রফেসরদের বিয়ে হয় না।

কিংবা হয়তো জিজ্ঞেস করেন, তোর কোনো দিন রাতের বেলা পানির পিপাসা পায়?

পায় মাঝে মাকে।

কী করিস তখন?

পানি খাই। আর কী করব?

খালি পেটে পানি খেতে নেই, এর পর থেকে বিস্কুট এনে রাখবি। আধখান খেয়ে এক ঢোক পানি খাবি, বুঝলি তো?

বুঝেছি।

কথা বলবার জন্যেই কথা বলা। মাঝে মাঝে ম্যার উপর বিরক্ত লাগত। কেন, আমরা কী দোষ করেছি? এমন করবেন কেন আমাদের সাথে?

অবশ্যি বিপরীত ব্যাপারও হয়! অদ্ভুত প্রসন্নতায় মা ভরে ওঠেন। বেছে বেছে শাড়ি পরেন। লম্বা বেণী করে চুল বাঁধেন। মন্টু অবাক হয়ে বলে, মা, তোমাকে অন্য বাড়ির মেয়ের মতো লাগছে।

মা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেব, কী বললি মন্টু?

বললাম, তোমাকে অন্যরকম লাগছে। তুমি যেন বেড়াতে এসেছ আমাদের বাড়ি।

রুনু বলে ওঠে, মন্টুটা বড়ো বোকা, তাই না মা?

মা হেসে হেসে রাবেয়াকে জিজ্ঞেস করেন, ও রাবেয়া, তোর গান ভালো লাগে?

হ্যাঁ মা, খুউব।

আমার বড়দাও ভারি গানপাগল ছিলেন। রোজ রাতে আমরা ছাদে বসে রেকর্ড বাজোতাম। চিন্ময়ের রবীন্দ্রসংগীত যা ভালোবাসত বড়দা

মা, তুমিও তো গান জোন। তোমার নাকি রেকর্ড আছে গানের?

মা রাবেয়ার দিকে তাকিয়ে অল্প অল্প হাসেন, খুশি খুশি গলায় বলেন, স্কুলে যখন পড়ি, তখন রেকর্ড হয়েছিল। মেসবাহউদ্দিন ছিলেন তখন রেডিওর রিজিওনাল ডাইরেক্টর। তিনিই সব করিয়েছিলেন। এক পিঠে আমার, এক পিঠে পিনুহকের। পিানুহককে চিনিস না? এখন তো সিনেমায় খুব প্লেব্যাক গায়। খুব নাকি নামডাক। তখন এতটুকু মেয়ে, আমার চেয়েও ছোট।

যদিও আমরা সবাই জানতাম, গানের একটা রেকর্ড আছে, তবু গানটি শুনি নি কেউ। পুরনো রেকর্ড বাজারে পাওয়া যেত না। নানার বাড়িতে যে-কপিটি আছে, সেটি আনার কথা কখনো মনে পড়ে নি। মা কিন্তু কোনো দিন গান গেয়ে শোনান নি, এমন কি ভুল করেও নয়।

মারা প্রসন্ন দিনগুলির জন্যে আমরা আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। কি ভালোই না লাগ। বাবা নিজে তো মহাখুশি, কি যে করবেন ভেবেই যেন পাচ্ছেন না। অফিসের কোন কলিগ কি করেছে, তাই কমিক করে হাসাতেন আমাদের। বাবা খুব ভালো কমিক করতে পারতেন। অফিসের ছোটবাবু কেমন করে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে বড়ো বাবুর চেম্বারে হাজিরা দিতেন–তা এত সুন্দর দেখাতেন! হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়তাম আমরা। মা বলতেন, আর নয়, পেট ব্যথা করছে আমার। বুনু চোখ বড়ো বড়ো করে বলত, রাবেয়া আপা, বাবা খুব ভালো জোকার, তাই না?

রাবেয়া রেগে গিয়ে বলত, মারব থাপ্পড়। বাবাকে জোকার বলছে। দেখছি বাবা-মেয়ের কেমন ফিচলে বুদ্ধি হয়েছে?

বাবা বলতেন, বুঝুনুর আমার এই এতটা বুদ্ধি। যাও তো রুনু-ঝনু, একটু নাচ দেখাও।

কিটকির কাছে শেখা আনাড়ি নাচ নাচত দু জনে। মা মুখে মুখে তবলার বোল দিতেন। বাবা বলতেন, বাহা রে বেটি, বাহা। কী সুন্দর শিখেছে, বাহ বাহ! এবার মন্টু সোনা, একটি গান গাও।

বলবার অপেক্ষামাত্র-মন্টু যেন তৈরি হয়েই ছিল, সঙ্গে সঙ্গে শুরু—

কাবেরী নদীজলে… । শুধু এই গানটির সে ছয় লাইন জানে!

ছয় লাইন শেষ হওয়ামাত্র ব্যাখ্য বলতেন, ঘুরেফিরে ঘুরেফিরে।

মন্টু ঘুরেফিরে একই কলি বার বার গাইত। ভালো গানের গলা ছিল। ছেলেমানুষ হিসেবে গলা অবশ্যি মোটা, চড়ায় উঠতে পারত না। তবে চমৎকার সুরজ্ঞান ছিল।

মাঝামাঝি সময়ে দেখা যেত। রাবেয়া এক ফাঁকে চা বানিয়ে এনেছে। বিশেষ উপলক্ষ বলেই রুনু-ঝনু-মন্টু আধা কাপ করে চা পেত। সেদিন। সুখের সময়গুলি খুব ছোট বলেই অসম্ভব আকর্ষণীয় ছিল। ফুরিয়ে যেত সহজেই, কিন্তু সৌরভ। থাকত। অনেক অ-নে-ক দিন।

ভাবতে ভাবতে রাত বেড়ে গেল। মানুষের চিস্তা যতই অসংলগ্ন মনে হোক, কিন্তু তলিয়ে দেখলে সমস্ত কিছুতেই বেশ একটা ভালো মিল দেখা যায়। বৃষ্টির রাতে গল্প বলা থেকে ভাবতে ভাবতে কোথায় চলে এসেছি। বৃষ্টি থেমে গেছে অনেকক্ষণ। চারদিকে ভিজে আবহাওয়া, ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। বিদ্যুৎ-চমকানিতে ক্ষণিকের জন্য নীলাত আলো ছড়িয়ে পড়ছে। গলা পর্যন্ত চাদর টেনে ঘুমিয়ে পড়লাম।

মা গো, এত ঘুমুতেও পারেন?

কিটকি হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে সামনে।

কাল সারা রাত ঘুমান নি, না?

দেরিতে ঘুমিয়েছি। তুই যে এত সকালে? শাড়ি পরেছিস, চিনতে পারছি না। মোটেই। রীতিমতো ভদ্রমহিলা!

আগে কী ছিলাম? ভদ্রলোক?

না, ছিলি ভদ্রাবালিকা। বেশ লম্বা দেখাচ্ছে শাড়িতে, কত লম্বা তুই?

পাঁচ ফুট এক ইঞ্চি।

বস, মুখ ধুয়ে আসি।

কলঘরে যাওয়ার পথে রাবেয়ার সঙ্গে দেখা, চায়ের ট্রে নিয়ে যাচ্ছে ভেতরেগ।

ও খোকা, কিটকি বেচারি কখন থেকে বসে আছে, ঘুম ভাঙে না তোর। রাতে কি চুরি করতে গিয়েছিলি?

হাত-মুখ ধুয়ে এসে বসলাম কিটকির সামনে। সবুজ রঙের শাড়ি পরেছে। ঠোঁটে হালকা করে লিপিস্টিক, কপালে জ্বলজ্বল করছে নীল রঙের টিপ। কিটকি বলল, বলুন তো, কী জন্যে এই সাত-সকালে এসেছি?

কোনো খবর আছে বোধ হয়?

বলুন না, কী খবর?

দল বেঁধে পিকনিকে যাবি, তাই না?

কিছুটা ঠিক। আমরা ম্যানিলা যাচ্ছি।

কোথায় যাচ্ছিস?

ম্যানিলা। পাঁচ বৎসরের চুক্তিতে আব্বা যাচ্ছেন এই ডিসেম্বরে। কী যে ভালো লাগছে আমার!

খুশিতে ঝলমল করে উঠল কিটকি। বুকে ধক করে একটা ধাক্কা লাগল আমার।

খুব খুশি লাগছে তোর?

হ্যাঁ, খুব।

আমাদের জন্যে খারাপ লাগবে না?

লাগবে না কেন, খুব লাগবে। আমি চিঠি লিখব সবাইকে।

কিটকি, দেখি তোর হাত।

হাত কি দেখবেন?

ইতস্তত করে হাত বাড়িয়ে দেয় কিটকি। লাল টুকটুকে এতটুকু ছোট্ট হাত।

হাত দেখতে জানেন আপনি? এত দিন বলেন নি তো? ভালো করে দেখবেন কিন্তু। সব বলতে হবে।

কিটকির নরম কোমল হাতে হাত রেখে আমি আশ্চর্য যাতনায় ছটফট করতে থাকি।

কী দেখলেন বলুন? বলুন না।

ও এমনি, আমি হাত দেখতে জানি না।

তবে যে দেখলেন?

কি জন্যে দেখলাম, বুঝতে পারিস নি? তুই তো ভরি বোকা।

কিটকি হাসিমুখে বলল, বুঝতে পারছি।

কী বুঝতে পারলি?

বুঝতে পারছি যে, আপনিও বেশ বোকা।

কিটকিরা ডিসেম্বরের ন তারিখে চলে গেল। এ্যারোড্রামে অনেক লোক হয়েছিল। রাবেয়াকে নিয়ে আমিও গিয়েছিলাম সেখানে। কিটকির যে এত বন্ধু আছে, তা জানতাম না। হেসে হেসে সবার সঙ্গেই সে কথা বলল। কিটকিকে মনে হচ্ছিল একটি সবুজ পরী। সবুজ শাড়ি, সবুজ জুতো, সবুজ ফিতে–এমন কি কাঁধের মস্ত ব্যাগটাও সবুজ।

রাবেয়াকে বললাম, কিটকিকে কী সুন্দর মানিয়েছে, দেখেছিস? তুই এমন মিল করে সাঁজ করিস না কেন?

সাজ দেখে যদি তোর মতো কোনো পুরুষ-হৃদয় ভেঙে যায়, সেই ভয়ে।

খালা লাউঞ্জের এক কোণায় বসে ছিলেন। ইশারায় কাছে ডাকলেন।

চললাম রে তোদের ছেড়ে।

ফিরবেন কবে?

কে জানে কবে। কর্তার মার্জি হলেই ফিরব। পাঁচ বছরের মেয়াদ। কিরে রাবেয়া, হাসছিস কী দেখে?

রাবেয়া হাত তুলে দেখাল, এক মেমসাহেব তার বাচ্চা ছেলেটিকে নিয়ে বিষম বিব্রত হয়ে পড়েছেন। বাচ্চাটা দমাদম ঘুষি মারছে মাকে। কিছুতেই শান্ত করান যাচ্ছে না।

সবাই হাসিমুখে দেখছে ব্যাপারটা। খালা বললেন, তুই তো বড়ো ছেলেমানুষ রাবেয়া। বয়স কত হল তোর? আমি যখন সেভেনে পড়ি, তখন তোর জন্ম হল। তার মানে-সে কি। তোর যে ত্ৰিশ পেরিয়েছে! কী ব্যাপার? বুড়ি হয়ে গেলি যে, বিয়ে এখনো হল না? কি মুশকিল!

রাবেয়া স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইল। আমি চোখ তুলে রাবেয়ার দিকে তাকাতে পারছিলাম না। এমন অবিবেচকের মতো কথা বুঝি শুধু মেয়েদের পক্ষেই বলা সম্ভব। রাবেয়ার চোখ চকচক করছে, কে জানে কেঁদে ফেলবে কিনা। আমি হাত ধরলাম রাবেয়ার।

আমরা যাই খালা, খালুজান কোথায়?

বুকিং-এ কী যেন আলাপ করছেন।

তাকে সালাম দিয়ে দেবেন। খোদা হাফেজ।

কিটকির সঙ্গে গেটে দেখা, তার এক বান্ধবীর সঙ্গে হো হো করে হাসছিল, যাই কিটকি।

সে কি? প্লেন ছাড়তে এখনো চল্লিশ মিনিট।

না রে–একটু সকাল সকাল যেতে হবে, কাজ আছে।

রাবেয়া আপা এমন মুখ কালো করে রেখেছেন কেন?

রাবেয়া থতমত খেয়ে বলল, তুই চলে যাচ্ছিাস, তাই। চিঠি দিবি তো?

রাবেয়া আমার ছ বছরের বড়ো। এ বছর একত্ৰিশে পড়েছে। অথচ কি বাচ্চা মেয়ের মতো হাত ধরে আসছে আমার পিছে পিছে। মাথায় আবার মস্ত ঘোমটাও দিয়েছে। রিক্সায় উঠে জড়সড় হয়ে বসে রইল সে।

রাবেয়া, চুপ করে আছিস যে?

তুই নিজেও তো চুপ করে আছিস।

তুই মুখ কালো করে রাখলে বড়ো খারাপ লাগে! তুই কি মনে কষ্ট পেয়েছিস?

রাবেয়া ফিসফিস্ করে বলল, আমি কখনো কারো কথায় কষ্ট পাই না। আজ খালার কথা শুনে বড়ো খারাপ লাগছে।

নির্জন রাস্তায় রিক্সা দ্রুত চলছে। রিক্সার দুলুনিতে রাবেয়াটা কাঁপছে অল্প অল্প। মাথায় গন্ধ তেল দিয়েছে বুঝি, তার মৃদু সুবাস পাচ্ছি। রাস্তায় কী ধূলো! রাবেয়ার বা হাত অবসন্নভাবে পড়ে আছে আমার কোলে।

খালার কথা এখনো মনে গেথে রেখেছিস, খালার কি মাথার ঠিক আছে?

না, তা নয়। যাই হোক–বাদ দে, , অন্য কথা বল।

কী কথা?

কিটকির জন্য তোর খারাপ লাগছে?

তা লাগছে। যতটা ভাবছিস ততটা নয়।

রাবেয়া অল্প হেসে চুপ করল। তার যে এতটা বয়স হয়েছে, মনেই হয় না। ঐ তো সেদিন যেন কারা দেখতে এল। বুড়ো ভদ্রলোক মাথা দুলিয়ে বললেন, মেয়ে আপনার ভালো, লক্ষ্মী মেয়ে, দেখেই বুঝেছি। বয়সও বেশি নয়, তবে কিনা আজকালকার আধুনিক ছেলে, তাদের কাছে রূপ মানেই হলো ধবধবে ফর্সা। বলেই ভদ্রলোক হায়নার মতো হে হে করে হাসতে লাগলেন।

গান জান মা? কোনো বাজনা? এই ধর গিটার-ফিটার? আজকাল আবার এসবের খুব কদর।

জ্বি না, জানি না।

এবার বরের এক বন্ধু এগিয়ে এলেন।

আপনি কি মডার্ণ লিটারেচার কিছু পড়েছেন?

না, পড়ি নি।

ইবসেনের নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন?

জ্বি না, শুনি নি।

বিয়ে ভেঙে গেল। আরো একবার সব কিছু ঠিকঠাক। ছেলেটিও ভালো, অথচ রাবেয়াই বেঁকে বসল।

ও ছেলে বিয়ে করব না।

কোন বল তো? ছেলে দেখে পছন্দ হচ্ছে না?

না-না, পছন্দ হবে না কেন, বেশ ভালো ছেলে।

তবে! বেতন কম পাচ্ছে বলে?

ছিঃ, সে-জন্যে কেন হবে? আর বেতন কমই—বা কি?

ঠিক করে বল তো, অন্য কোনো ছেলেকে ভালো লাগে?

গাধা! সিনেমা দেখে দেখে তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

কী জন্যে বিয়ে করবি না, বল।

ছেলেটা বড় বাচ্চা। বয়সে ওর দেড় গুণ বড়ো আমি। আমার ভীষণ লজ্জা করছে। তাছাড়া একটা কথা তোকে বলি খোকা–

বল।

বিয়ে-টিয়ে করতে আমার একটুও ইচ্ছে হয় না। ওটা একটা বাজে ব্যাপার। অজানা-অচেনা একটা ছেলের সঙ্গে শুখে থাকা, ছিঃ।

রিক্সা দ্রুত চলছে। রাবেয়া চুপ করে বসে। রোদের লালচে আঁচে রাবেয়ার মুখটাও লালচে হয়ে উঠেছে। কী ভাবছে সে কে বলবে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress