শকুন্তলা
অন্ধ বাপের কী আহাম্মকী। মেয়ের রূপ, গুণ না দেখেই নাম রাখলো শকুন্তলা।
আর যাই হোক। বড় বেশী চেনা লাগে মেয়েটির নাম শুনলেই, ‘শকুন্তলা’। মনেই হয় না এ কোন গ্রাম্য কিশোরী। সবচেয়ে বেশী মনে পড়ে, শকুন্তলার মুখ আয়নার মতো স্থির। চোখ দুটি দীঘির কালো জলের মতো টলটলে। আর আশ্চর্য তার কেশ! রেশম কোমল শরতের আকাশের মতো বিস্তৃত। কালো, ঘন কালো সেই কেশের রঙ। পিঠ ছাপিয়ে ভেঙ্গে নেমেছে মেঘের ঝালর, হাঁটু ছাড়িয়ে। আর রূপের রঙ!
মনে পড়ে কন্বমুনির আশ্রমের কথা। ঐখানে থাকে এ সেই মেয়ে শকুন্তলা। কী রূপ! কী রূপ! আহাঃ যেন হুরী কিংবা পরী। দুধ সকাল মেঘের রাজত্ব থেকে নেমে এসেছে সবুজ ঘেরা কন্বের আশ্রমে। রামধনু আলোয় চোখ ভাসে তার। নিঃশ্বাসে বনজ্যোৎস্নার সুগন্ধি ছড়ায়। এ সেই মেয়ে! খোঁপায় গোঁজে অষ্টপ্রহর ফুলের দাম, গলায় ফুলের মালা। আহাঃ রে, কী রূপ! কী রূপ! শরীর থেকে নেমে এসেছে সুবাস। ফুল~ফল, ফুলের গন্ধে দুষ্মন্তের ঘোড়াও বিপথে যায়। এ সেই মেয়ে, শকুন্তলা। রাজা দুষ্মন্ত স্বপ্ন দেখে………..এক প্রহর, দু প্রহর, তিন প্রহর, সারা রাত ধরে।
অসুখে ভুগে বাপটা অন্ধ হলো। পোয়াতি বৌ’য়ের দিন আর কাটে না। অন্ধ স্বামীকে বুকে জড়িয়ে কুরে কুরে দিন যায়। একদিন রাতে, জ্যোৎস্নার সর গায়ে মেখে জন্ম নিল সে হতভাগিনী। অন্ধ বাপের সাধ আর মেটে না। নাম রাখলো শকুন্তলা।
কী আর করা যায়। এখন আর সে রূপও নেই, এ নামও অচল। তবুও, কখনো সখনো পাওয়া যায় দু এক জনকে, নাম তার শকুন্তলা। কি ছিরি! কি ছিরি! রূপ তো নয় যেন কিংবদন্তিপট। লকলকে হাড়ি হাড়ি চেহারা। পতলুনের সাথে পরে হাওড়া মাঠের গেঞ্জি, কিংবা টানটান জামা কাপড়ের সাথে সরু চিকন ভুরু। নাকে জার্মানি ডায়মন্ডের চাপা নাকছাবি, ঠোঁটে গাঢ় রঙের প্রলেপ। আর কেশ বিন্যাস! কী বাহার! কী বাহার!
এরা অষ্টপ্রহর নাম জপে দুষ্মন্তদের। যদি গন্ধর্ব প্রথা বেঁচে থাকতো আজও, তবে হয়তো কোন চাঁদিনী রাতে স্নান পর্ব সারা হয়ে যেত। আর এই দুষ্মন্তরা! ভালোই জানে দুর্বাসার শাপে ওরা স্মৃতিভ্রষ্ট, পথভ্রষ্ট, নীতিভ্রষ্ট। আর শকুন্তলারা স্বামী হারা, পুত্র হারা, গৃহ হারা হয়ে ঘুরে বেড়ায় পথে পথে দিনে রাতে। নাই বা থাকল গন্ধর্ব বিবাহ। এখন তো আরো সহজ সে প্রথা। কোর্ট ম্যারেজ না করে সিঁদুর ম্যারেজ করলেই হলো। আর তখন থেকেই হারিয়ে যাচ্ছে শকুন্তলারা। এ নাম আর পাওয়াই যায় না।
তবুও কী আহাম্মক বাপটা। দিন যায়। রাত যায়। বড় হয় শকুন্তলা ছেঁড়া কাঁথায়। বাপ তো চোখে কিছুই দেখে না, তবুও যেন বুঝতে পারে, ওকে ঘিরে নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে একটা আলো। আলো তো নয়, আহাঃ রে, কী রূপ! কী রূপ! বাপটা রূপ বোঝে। মেয়ের দীঘল কালো চোখের মনির দিকে তাকিয়ে ভাবে : মেয়ে তো নয়, যেন জগদ্ধাত্রী। মায়ের সূতিকা আর সারে না। দিন দিন রোগা হচ্ছে। আর মেয়ে ধকধক করে বেড়ে উঠছে ডাব গাছের মতো। ছেঁড়া মাদুর ছেয়ে বেড়ে যাচ্ছে হাত পা। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে অপলক। মনে মনে বলেঃ মেয়ে তো নয়, রাজকন্যে।
সকাল হল। ঘরদ্বোরে গোবর লেপা পরে। উনুনে আঁচ জ্বালিয়ে বাপের হাত ধরে শকুন্তলা মাঠে যায়। বাপ আগাছা নিঙরোয়। আর মেয়ে! মাঠে মাঠে, আলের ধারে ধারে গোবর কুড়ায়। দুপুর ফিরবার আগে শকুন্তলা বাপকে শুধায়,- ‘তু থাক বাপ, মুই ঘরকে যাই, ভাত লিয়ে আসি’।
আহাঃ রে, কী গলা! তাতানো রোদের ছাঁদে মনে হয় এক পশলা জলের ফোঁটা ঝরল। বাপ তার মেয়ের পায়ের শব্দ শুনে শুনে জমি নিঙরোয়।
কালো দীঘির জলে গা জুড়ায় শকুন্তলা। আঃ কী ঠাণ্ডা। ডুব ডুব। সাত ডুব। ঘাটের পাড়ে মা, মেয়েদের জলসা চলে ভর দুপুর। ওরা কালো দীঘির রূপ দেখে না, দেখে কালো দীঘির জলের তলায় ডুবে আছে পিত্তিমে। আহাঃ রে, কী রূপ! কী রূপ! বন্যা বইছে যেন গরু চরানি শকুন্তলার শরীর জুড়ে।
ছুঁবি নাকি! তো ছোঁ! দে ডুব! ডুব ডুব সাত ডুব!
শকুন্তলা ঘাটে ওঠে। বুকের উপর তেনা জড়াতে জড়াতে বলল,- ও মাসী, দেখস কী?
ঘরদ্বোর নিকানো হলো। ভাঙ্গা কলাইয়ের থালায় ভাত নিয়ে গরু ছেড়ে মাঠে এলো। কালিন্দির চোখ পড়ল মেয়ের উপর। ধবলীর চোখ স্থির হলো। হাম্বা, হাম্বা – ডাক পারলো দুজনেইঃ কী রূপ! কী রূপ! শকুন্তলাকে নিয়ে কালিন্দি, ধবলী শুয়ে রইলো গাছের তলায়। বিকেল হলো। সাঁঝ নামল মাঠে। বাপ ডাক দিল,- শকুন্তলে, গাই ফেরাও। বাপের হাত ধরে, গাই দুটিকে নিয়ে বাড়ি ফিরল শকুন্তলা। রাত্রি হলো। নিঝুম কালো। শকুন্তলার মন কাড়ল।
শকুন্তলার নাম ছড়ালো। গ্রাম ছাড়িয়ে শহর, গঞ্জে।চম্পাহাটির মুদী মালিক করিম এলো সাত বেহারা পলকী নিয়ে। বলল শেষে,- ঘুটে কুড়োনি, চাই না ওকে। জগদ্দলের নায়েব এলো ছেলে নিয়ে। বাপ জানালো,- দুটো গাই সঙ্গে দিলাম, পাঁচ কুড়ি এক নগদ দিলাম। নায়েব দেখলো, শকুন্তলা। ছেলে দেখে, শকুন্তলা। নায়েব বললো,- কি কর গা। ছেলে শুধালো,- হিসেব জানো। শকুন্তলা ঘাড় নাড়ল। সবাই বললো, – ওতো গরু চড়ানি। ও কী জানে?
সাতকান হয়ে শকুন্তলার কথা পৌঁছুলো আমার কানে। গিন্নীর ঘুম আর আসে না। সকাল হতেই জরুরী তলব এলো, যাও না কালিকাপুরে। ঠিক হলো তাই। ক্যানিং লোকাল চেপে নেমে পড়লাম কালিকাপুরে। মাঠের মাঝখানে আঙ্গুল তুলে দেখাল অতিবৃদ্ধ একজন,-ঐ-খানটায় গরু চড়ানির বাস। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম মাঠের মাঝে। সুনসান চারিদিক। নিস্তব্দ নিঝুম। খাঁ খাঁ করছে ঘর। ডাক দিলাম, ও মেয়ে, মেয়ে। ও বৌ, বৌ। ও শকুন্তলে, শকুন্তলে।
একটি রাখাল বালক বিষ্ময়ে দাঁড়িয়েছিল আমার পিছনে। আমাকে দেখে কচি গলায় বলে উঠল,- কাকে ডাইকতাছেন।
-কেন, শকুন্তলার বাবা, মা।
-মাটা’তো মরে গেল জ্বরে। আর বাপটাকে সাপে কাটলো শেষ মাঘে।
-আর, শকুন্তলা!
-জানিনা তো।
বুক কেঁপে গেল আমার থরথরিয়ে। সেই দীঘির পাড়ে এলাম। ঘাট শুকনো। টলটলে জলে নোংরার ঘন আস্তরণ পড়েছে। বুঝলাম, এখানে আজ আর কেউ ডুব দেয় না। হাঁটতে হাঁটতে গেলাম গরু চরানো মাঠে। ঊকটুকুও ঘাস পড়লো না চোখে। এবড়ো~খছবড়ো ভাঙ্গা রুখু মাঠ যেন পড়ে আছে অনন্তকাল ধরে। সেই গাছটার কোন চিহ্নই নেই।
বলতে পার কেউ তোমরা, আমার শকুন্তলা কোথায়!