Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

যুবরাজের সঙ্গে যে সকল “স্পেশিয়াল” আসিয়াছিলেন, তাঁহাদিগের মধ্যে একজন কোন বিলাতীয় সম্বাদপত্রে নিম্নলিখিত পত্রখানি লিখিয়াছিলেন, আমরা অনুবাদ করিয়া প্রকাশ করিতেছি। সে বিলাতীয় সম্বাদপত্রের নামের জন্য যদি কেহ আমাদিগকে পীড়াপীড়ি করেন, তবে আমরা লাচার হইব। সম্বাদপত্রের নাম আমরা জানি না, এবং কোথায় দেখিয়াছিলাম, তাহা স্মরণ নাই। পত্রখানির মর্ম্ম এই-
যুবরাজের সঙ্গে আসিয়া বাঙ্গালা দেশ যেরূপ দেখিলাম, তাহা এই অবকাশে বর্ণনা করিয়া আপনাদিগকে আপ্যায়িত করিব ইচ্ছা আছে। আমি এদেশ সম্বন্ধে অনেক অনুসন্ধান করিয়াছি, অতএব আমার কাছে যেরূপ ঠিক সম্বাদ পাইবেন, এমন অন্যের কাছে পাইবেন না। এদেশের নাম “বেঙ্গল”। এ নাম কেন হইল, তাহা দেশী লোকে বলিতে পারে না। কিন্তু দেশী লোকে এদেশের অবস্থা সবিশেষ অবগত নহে, তাহারা জানিবে কি প্রকারে? তাহারা বলে, পূর্ব্বে ইহার এক প্রদেশকে বঙ্গ বলিত, তৎপ্রদেশের লোককে এখনও “বাঙ্গাল” বলে, এজন্য এদেশের নাম “বাঙ্গালা।” কিন্তু এদেশের নাম বাঙ্গালা নহে-ইহার নাম “বেঙ্গল”-তাহা আপনারা সকলেই জানেন। অতএব এ কথা কেবল প্রবঞ্চনা মাত্র। আমার বোধ হয়, বেঞ্জামিন গল (Benjamin Gall) সংক্ষেপতঃ বেন্ গল্ নামক কোন ইংরেজ এই দেশ পূর্ব্বে আবিষ্কৃত এবং অধিকৃত করিয়া আপন নামে বিখ্যাত করিয়াছিলেন।
রাজধানীর নাম “কালকাটা” (Calcutta) “কাল” এবং “কাটা” এই দুইটি বাঙ্গালা শব্দে এই নামের উৎপত্তি। এই নগরীতে কাল কাটাইবার কোন কষ্ট নাই, এই জন্যই ইহার নাম “কালকাটা।”
এদেশের লোক কতকগুলি ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণ, কতকগুলি কিঞ্চিৎ গৌর। যাহারা কৃষ্ণবর্ণ, তাহাদিগের পূর্ব্বেপুরুষে বোধ হয় আফ্রিকা হইতে আসিয়া বাস করিয়াছিল, কেন না, সেই কৃষ্ণবর্ণ বাঙ্গালিদিগের মধ্যে অনেকেই কুঞ্চিত কেশ; নরতত্ত্ববিদেরা স্থির করিয়াছিলেন, কুঞ্চিত কেশ হইলেই কাফ্রি। আর যাহারা কিঞ্চিৎ গৌরবর্ণ, বোধ হয় তাহারা উপরিকথিত বেন্ গল্ সাহেবের বংশসম্ভূত।
দেখিলাম, অধিকাংশ বাঙ্গালি মাঞ্চেষ্টরের তন্তুপ্রসূত বস্ত্র পরিধান করে। অতএব স্পষ্টই সিদ্ধান্ত হইতেছে যে, ভারতবর্ষ মাঞ্চেষ্টরের সংস্রবে আসিবার পূর্ব্বে, বঙ্গদেশের লোক উলঙ্গ থাকিত। এক্ষণে মাঞ্চেষ্টরের অনুকম্পায় তাহারা বস্ত্র পরিয়া বাঁচিতেছে। ইহারা সম্প্রতি মাত্র বস্ত্র পরিতে আরম্ভ করিয়াছে, কি প্রকারে বস্ত্র পরিধান করিতে হয়, তাহা এখনও ঠিক করিয়া উঠিতে পারে নাই। কেহ কেহ আমাদিগের মত পেণ্টুলন পরে, কেহ কেহ তুর্কদিগের মত পায়জামা পরে, এবং কেহ কেহ কাহার অনুকরণ করিবে, তাহার কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া বস্ত্রগুলি কেবল কোমরে জড়াইয়া রাখে।
অতএব দেখ, ব্রিটিশ রাজ্য বেঙ্গল দেশে এক শত বৎসর বুড়া হইয়াছে মাত্র, ইতিমধ্যেই অসভ্য উলঙ্গ জাতিকে বস্ত্র পরিধান করিতে শিখাইয়াছে। সুতরাং ইংলণ্ডের যে কি অসীম মহিমা এবং তদ্দ্বারা ভারতবর্ষের যে কি পরিমাণে ধন এবং ঐশ্বর্য্য বৃদ্ধি হইতেছে, তাহা বলিয়া উঠা যায় না। তাহা ইংরেজেই জানে। বাঙ্গালিতে বুঝিতে পারে, এত বুদ্ধি তাহাদিগের থাকা সম্ভব নহে।
দুঃখের বিষয় যে, আমি কয়দিনে বাঙ্গালিদিগের ভাষায় অধিক ব্যুৎপত্তি লাভ করিতে পারি নাই; তবে কিছু কিছু শিখিয়াছি। এবং গোলেস্তান্ এবং বোস্তান্ নামে যে দুইখানি বাঙ্গালা পুস্তক আছে, তাহার অনুবাদ পাঠ করিয়াছি। ঐ দুইখানি পুস্তকের স্থূল মর্ম্ম এই যে, যুধিষ্ঠির নামে রাজা, রাবণ নামে আর একজন রাজাকে বধ করিয়া তাহার মহিষী মন্দোদরীকে হরণ করিয়াছিল। মন্দোদরী কিছুকাল বৃন্দাবনে বাস করিয়া কৃষ্ণের সঙ্গে লীলাখেলা করেন। পরিশেষে তাঁহার পিতা, কৃষ্ণের নিমন্ত্রণ না করায় তিনি দক্ষযজ্ঞে প্রাণত্যাগ করেন।
আমি কিছু কিছু বাঙ্গালা শিখিয়াছি। বাঙ্গালিরা হাইকোর্টকে হাইকোর্ট বলে, গবর্ণমেণ্টকে গবর্ণমেণ্ট বলে, ডিক্রীকে ডিক্রী বলে, ডিষমিষকে ডিষমিষ, রেলকে রেল, ডোরকে ডোর, ডবলকে ডবল, ইত্যাদি ইত্যাদি বলে। ইহাতে স্পষ্টই প্রতীয়মান হইতেছে যে, বাঙ্গালা ভাষা ইংরেজির একটি শাখা মাত্র।
ইহাতে একটি সন্দেহ উৎপন্ন হইতেছে। যদি বাঙ্গালা ইংরেজির শাখাই হইল, তবে ইংরেজেরা এদেশে আসিবার পূর্ব্বে এদেশে কোন ভাষা ছিল কি না? দেখ, আমাদিগের খ্রীষ্টের নাম হইতে ইহাদিগের প্রধান দেবতা কৃষ্ণের নাম নীত হইয়াছে, এবং অনেক ইউরোপীয় পণ্ডিতের*3 মতে ইহাদিগের প্রধান পুস্তক তৎপ্রণীত ভগবদ্‌গীতা বাইবেল হইতে অনুবাদিত। সুতরাং বাইবেলের পূর্ব্বে যে ইহাদিগের কোন ভাষা ছিল না, ইহা একপ্রকার স্থির। তাহার পর কবে ইহাদিগের ভাষা হইল, বলা যায় না। বোধ করি, পণ্ডিতবর মক্ষমূলর মনোযোগ করিলে এ বিষয়ে মীমাংসা করিতে পারেন। যে পণ্ডিত মীমাংসা করিয়াছেন যে, অশোকের পূর্ব্বে আর্য্যেরা লিখিতে জানিত না, সেই পণ্ডিতই এ কথার মীমাংসায় সক্ষম।
আর একটি কথা আছে। সর উইলিয়ম জোন্স হইতে মক্ষমূলর পর্য্যন্ত প্রাচ্যবিৎ পণ্ডিতেরা বলেন যে, এদেশে সংস্কৃত নামে আর একটি ভাষা আছে। কিন্তু এদেশে আসিয়া আমি কাহাকেও সংস্কৃত কহিতে বা লিখিতে দেখি নাই। সুতরাং এদেশে সংস্কৃত ভাষা থাকার বিষয়ে আমার বিশ্বাস নাই। বোধ হয় এটি সর উইলিয়ম জোন্স প্রভৃতির কারসাজি। তাঁহারা পশারের জন্য এ ভাষাটি সৃষ্টি করিয়াছেন।4
যাহা হৌক, উহাদিগের সামাজিক অবস্থা সম্বন্ধে কিছু বলিব। তোমরা শুনিয়াছ যে, হিন্দুরা চারিটি জাতিতে বিভক্ত; কিন্তু তাহা নহে। ইহাদিগের মধ্যে অনেকগুলি জাতি আছে, তাহাদের নাম নিম্নে লিখিতেছি।
১। ব্রাহ্মণ, ২। কায়স্থ, ৩। শূদ্র, ৪। কুলীন, ৫। বংশজ, ৬। বৈষ্ণব, ৭। শাক্ত, ৮। রায়, ৯। ঘোষাল, ১০। টেগোর, ১১। মোল্লা, ১২। ফরাজি, ১৩। রামায়ণ, ১৪। মহাভারত, ১৫। আসাম গোয়ালপাড়া, ১৬। পারিয়া ডগ্‌স।
বাঙ্গালিদিগের চরিত্র অত্যন্ত মন্দ। তাহারা অত্যন্ত মিথ্যাবাদী, বিনা কারণেও মিথ্যা কথা বলে। শুনিয়াছি, বাঙ্গালিদিগের মধ্যে শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত বাবু রাজেন্দ্রলাল মিত্র। আমি অনেকগুলিন বাঙ্গালিকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম যে, তিনি কোন্ জাতি? সকলেই বলিল, তিনি কায়স্থ। কিন্তু তাহারা আমাকে ঠকাইতে পারিল না; কেন না, আমি সেই পণ্ডিতবর মক্ষমূলরের গ্রন্থে 5 পড়িয়াছি যে, বাবু রাজেন্দ্রলাল মিত্র ব্রাহ্মণ। দেখা যাইতেছে যে, “Mitra” শব্দ “Mitre” শব্দের অপভ্রংশ, অতএব মিত্র মহাশয়কে পুরোহিতজাতীয়ই বুঝায়।
বাঙ্গালিদিগের একটি বিশেষ গুণ এই যে, তাহারা অত্যন্ত রাজভক্ত। যেরূপ লাখে লাখে তাহারা যুবরাজকে দেখিতে আসিয়াছিল, তাহাতে বোধ হইল যে, ঈদৃশ রাজভক্ত জাতি আর পৃথিবীতে কোথাও জন্মগ্রহণ করে নাই। ঈশ্বর আমাদিগের মঙ্গল করুন, তাহা হইলে তাহাদিগেরও কিছু মঙ্গল হইতে পারে।
বাঙ্গালিরা স্ত্রীলোকদিগকে পরদানশীন করিয়া রাখে শুনা আছে। ইহা সত্য বটে, তবে সর্ব্বত্র নয়।6 যখন কোন লাভের কথা না থাকে, তখন স্ত্রীলোকদিগকে অন্তঃপুরে রাখে, লাভের সূচনা দেখিলেই বাহির করিয়া আনে। আমরা যেরূপ ফৌলিংপিস লইয়া ব্যবহার করি, বাঙ্গালিরা পৌরাঙ্গনা লইয়াও সেরূপ করে; যখন প্রয়োজন নাই, তখন বাক্সবন্দি করিয়া রাখে, শিকার দেখিলেই বাহির করিয়া তাহাতে বারুদ পোরে। বন্দুকের সিসের গুলিতে ছার পক্ষিজাতির পক্ষচ্ছেদ হয়, বাঙ্গালির মেয়ের নয়নবাণে কাহার পক্ষচ্ছেদের আশা করে বলিতে পারি না। আমি বাঙ্গালির কন্যার অঙ্গাভরণের যেরূপ গুণ দেখিয়াছি, তাহাতে আমার ইচ্ছা করে, আমারও ফৌলিংপিসটিকে দুই একখানা সোণার গহনা পরাইব-দেখি, পাখী ঘুরিয়া আসিয়া বন্দুকের উপর পড়ে কি না।
তবু নয়নবাণে কেন, শুনিয়াছি বাঙ্গালির মেয়ে নাকি পুষ্পবাণ প্রয়োগেও বড় সুপটু। হিন্দু সাহিত্যোক্ত পুষ্পশরে, আর এই বঙ্গকামিনীগণের পরিত্যক্ত পুষ্পশরে কোন সম্বন্ধ আছে কি না, তাহা আমি জানি না; যদি থাকে, তবে বাঙ্গালির মেয়েকে দুরাকাঙ্ক্ষিণী বলিতে হইবে। শুনিয়াছি, কোন বাঙ্গালি কবি নাকি লিখিয়াছিলেন “কি ছার মিছার ধনু, ধরে ফুলবাণ”; এখন কথাটা একটু ফিরাইয়া বলিতে হইবে, “কি ছার মিছার ফুল, মারে ফুলবান”। যাহা হউক, ফুলবাণ সচরাচর প্রচলিত না হইয়া উঠে। বাঙ্গালায় ইংরেজ টেঁকা ভার হইবে-আমার সর্ব্বদা ভয় করে, আমি এই গরিব দোকানদারের ছেলে, দু টাকার লোভে সমুদ্র পার হইয়া আসিয়াছি-কে জানে, কখন বঙ্গকুলকামিনী-প্রেরিত কুসুমশর আসিয়া, এই ছেঁড়া তাম্বু ফুটা করিয়া, আমার হৃদয়ে আঘাত করিবে, আমি অমনি ধপাস্ করিয়া চিতপাত হইয়া পড়িয়া যাইব! হায়! তখন আমার কি হইবে! কে মুখে জল দিবে!
আমি এমত বলি না যে, সকল বাঙ্গালির মেয়ে এরূপ ফৌলিংপিস, অথবা সকলেই এরূপ পুষ্পক্ষেপণী প্রেরণে সচতুরা। তবে কেহ কেহ বটে, ইহা আমি জনরবে অবগত হইয়াছি। শুনিয়াছি, তাঁহারা নাকি ভর্ত্তৃনিয়োগানুসারেই এরূপ কার্য্যে প্রবৃত্ত। এই ভর্ত্তৃগণ দেশীয় শাস্ত্রানুসারেই এই পদ্ধতি অবলম্বন করিয়াছেন। হিন্দুদিগের যে চারিটি বেদ আছে-তাহার মধ্যে চাণক্যশ্লোক নামক বেদে (আমি এই সকল শাস্ত্রে বিশেষ ব্যুৎপন্ন হইয়াছি) লেখা আছে যে,
আত্মানং সততং রক্ষেৎ দারৈরপি ধনৈরপি।
ইহার অর্থ এই, হে পদ্মপলাশলোচনে শ্রীকৃষ্ণ! আমি আপনার উন্নতির জন্য তোমাকে এই বনফুলের মালা দিতেছি, তুমি গলায় পর।

————————-
3 Dr. Lorinzer &C.
4 সাবধান, কেহ হাসিবেন না। মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত ডুগাল্‌ড ষ্টুয়ার্ট যথার্থই এই মতাবলম্বী ছিলেন।
5 Chips from a German Workshop.
6 বাঙ্গালি স্ত্রীলোকেরা কেহ কেহ অন্তঃপুর পরিত্যাগ করিয়া রাজপুত্রকে অভ্যর্থনা করিয়াছিল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress