Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » লাল ফিতের আড়ালে || Syed Mustafa Siraj

লাল ফিতের আড়ালে || Syed Mustafa Siraj

লাল ফিতের আড়ালে

কর্নেলের জার্নাল থেকে

পূর্ব উপকূলে কুম্ভকোণম নামে ছোট্ট সুন্দর একটি বেলাভূমির কথা জানতাম না যদি না আমার স্নেহভাজন তরুণ পরিবেশ বিজ্ঞানী ডঃ শান্তনু দাস মহাপাত্র সেই খবর দিত।

একটু খটকা অবশ্য লেগেছিল। কারণ শান্তনু খবরটা ট্রাঙ্ককলে দিয়েছিল এবং আমাকে আমার শরৎকালীন ভ্রমণ-সূচী বদলে শিগগির সেখানে যেতে বলেছিল। তার শেষ বাক্যটি ছিল, আপনার আগ্রহ জাগানোর মতো কিছু জিনিস এখানে আছে।

তো গিয়ে দেখলাম, চন্দ্রকলার মতো একটুকরো বিচের মাথায় বিত্তবানদের ডজনখানেক নতুন বাংলো, একপ্রান্তে ছোট্ট জেলেবসতি, সরকারি ট্যুরিস্ট লজ এবং পাশাপাশি দুটি অফিস–একটি সমুদ্রবিজ্ঞান, অপরটি পরিবেশবিজ্ঞান সংক্রান্ত। কিন্তু প্রথমেই চোখে পড়ার মতো বিষয় নির্জনতা। বাইনোকুলারে অবশ্য জেলেবসতির দিকে কিছু মানুষজন চোখে পড়ল। তারা ভেলা নৌকো, জাল, অন্যান্য গেরস্থালি নিয়ে ব্যস্ত। একদঙ্গল কাচ্চাবাচ্চা সমুদ্রের সঙ্গে অকুতোভয়ে খেলছে। ওখানে বিচটা মারাত্মকভাবে ঢালু। মাথার ওপর একটা কাছিমের গড়ন টিলা। তারই গায়ে এলোমেলো সাজানো কুঁড়েঘর।

ওদের কি এই বিচে আসতে দেওয়া হয় না?

আমার এই প্রশ্ন শুনে শান্তনু বলল, কাটাতারের বেড়া দেখতে পাচ্ছেন না? পুরোটা নেটিফায়েড এরিয়া।

এতক্ষণে বেড়াটা বাইনোকুলারে ধরা পড়ল। তবে ওটা না থাকারই শামিল। বালিতে ডুবে গেছে কোথাও এবং কোথাও বা গলিয়ে আসার মতো যথেষ্ট ফাঁক।

শান্তুনু একটু হাসল। কৈফিয়ত একটা আছে। ওরা বিচ নোংরা করে। কিন্তু কোটিপতিদের অনেক সময় প্রকৃতিকে এবং নির্জনতার দরকার হয়। সরকারি ট্যুরিস্ট লজটাও মধ্যবিত্তদের নাগালের বাইরে। সেখানে অবশ্য সরকারি আমলারা কিংবা কোম্পানি-একজিকিউটিভরা ওঠেন। এক্সপেন্স অ্যাকাউন্টে। আর মাঝে মাঝে সেমিনার।

বিচের উল্টো প্রান্তে বাইনোকুলারে সমুদ্রে আছড়ে পড়া একটা ধ্বংসস্তূপ দেখে বললাম, প্রাচীন স্থাপত্য মনে হচ্ছে?

হ্যাঁ। আমার ধারণা, কোনও বৌদ্ধস্তূপ ছিল। এলাকার লোকেরা বলে, ওটাই নাকি সমুদ্রমন্থনে পাওয়া অমৃতকুম্ভের একটা টুকরো। তাই কুম্ভকোণম নাম।

বাইনোকুলার নামিয়ে প্রচণ্ড সামুদ্রিক হাওয়া আড়াল করে চুরুট ধরালাম। তারপর বিচে নেমে গিয়ে বললাম, তবে এই বিচটা চন্দ্রকলার চেয়ে কুম্ভ বা কলসির অর্ধেক ভাঙা কানার মতো। তা থেকেও কুম্ভকোণম নাম হতে পারে। স্থান নামের ব্যাপারে আমার তত্ত্ব হল, সচরাচর সাধারণ লোকেরা খুব চেনাজানা জিনিস দিয়ে কোনও স্থানকে চিহ্নিত করতে চায়। পরে শিক্ষিতেরা মাতব্বরি করে নামটা ভদ্রস্থ করে ফেলেন।

শানু পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলল, সমুদ্রবিজ্ঞানী রেড্ডি সায়েবের মতে এটা আসলে একটা খাড়ি ছিল। কারণ এমন অদ্ভুত গড়নের বিচ কোথাও দেখা যায় না। তো উনি তা প্রমাণের জন্য নিজেই খোঁড়াখুঁড়ির প্ল্যান করেছিলেন। হঠাৎ মারা গেলেন।

ঘুরে শান্তনুর দিকে তাকালাম। বিকেল পাঁচটাতেই বিচে ছায়া নেমেছে। ওর চোখে কী একটা ছিল। বললাম, কত দিন আগে?

আপনাকে ট্রাঙ্ককল করার আগের দিন। ভোরে এই বিচে জগিং করার অভ্যাস ছিল। এখানেই ওঁর বডি পাওয়া যায়।

একটু হেসে বললাম, তোমার ট্রাঙ্ককলে একটু খটকা লেগেছিল।

শান্তনু হাসল না। বিষণ্ণ মুখে বলল, আগেই আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা ভেবেছিলাম। পরে পতেছি। কর্নেল নীলাদ্রি সরকার ছাড়া এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর মানুষ তো আজকাল দেখি না। পুলিশকে আগ বাড়িয়ে কিছু বলা মানেই হইচই এবং হয়রানি। তাছাড়া ইদানীং এ রাজ্যে শ্রীলঙ্কার জঙ্গি তামিলদের আনাগোনা বেড়েছে। কার কোথায় ঘা লাগবে।

সামুদ্রিক হাওয়া বড্ড বেশি জোরালো হচ্ছিল এবং অস্বস্তিকরও। আমার দাড়ি যেন উপড়ে নেবে সমুদ্র। টুপিটাও সামলানো যাচ্ছে না। বললাম, চলো। ফেরা যাক।

ছোট-বড় নানা গড়নের পাথর বিচের ওপরে ওঠার জন্য প্রায়-নৈসর্গিক একটা সোপান। ওপরে উঠে একজন প্রৌঢ় শক্ত সমর্থ গড়নের ভদ্রলোককে দেখলাম। তাঁর এক হাতে ছড়ি, অন্য হাতে চেনে বাঁধা প্রকাণ্ড অ্যালসেশিয়ান। বললেন, হাই মহাপাত্র!

শাক্তনু পাল্টা মার্কিন রীতিতে বলল, হাই ডঃ কেশবন

কদিন থেকে দেখছি সন্ধ্যার দিকে সমুদ্র যেন খেপে যাচ্ছে! ব্যাপার কী?

ইংরেজিতে কথা হচ্ছিল। শান্তনু আলাপ করিয়ে দিল। ডঃ আর কেশবন। আমার দফতরের প্রধান। ডঃ কেশবন, ইনি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার, উঃ কেশবন আমাকে তীক্ষ্ণদৃষ্টে দেখে নিয়ে সহাস্যে বললেন, আপনা) ভারতীয় ভাবিনি। আপনাকে দেখে আমার ধারণা, আপনি একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল!

বললাম, অবশ্যই। আমার বয়স প্রায় সত্তর হয়ে এল।

আপনার চেহারা ফাদার ক্রিসমাসের মতো! কিছু মনে করবেন না কর্নেল সরকার! এ যাবৎ যত সামরিক মানুষজন দেখেছি, সবার চেহারায় কাঠখোট্টা ছাপ থাকে। আপনার চেহারায় কোমলতা আছে।

ডঃ কেশবন প্রায় অট্টহাসি হাসলেন। শান্তনু কেটে পড়ার ভঙ্গিতে হাঁটতে থাকল। একটু তফাতে গিয়ে বলল, লোকটা বেজায় দাম্ভিক। মেজাজ থাকলে বড় বাজে রসিকতা করে। সব চেয়ে অসহ্য ব্যাপার, সব সময় সঙ্গে ওই কুকুর। অফিসেও কুকুর নিয়ে যায়।

ওর বাংলো ধাঁচের কোয়ার্টারের বারান্দায় বসলাম। এখান থেকে বিচ দেখা যায় না। সমুদ্র বিশাল হয়ে চোখে আটকে যায়। শান্তনু ভুবনেশ্বরের ছেলে। ওর স্ত্রী মালবী কলকাতার মেয়ে এবং বাঙালি। নিজেই ট্রে সাজিয়ে কফি এবং স্ন্যাক্স আনল। মিষ্টি চেহারার মেয়ে। কফি তৈরি করে দিয়ে বলল, ফাদার ক্রিসমাসের চোখে কোনও রহস্য ধরা পড়ল কি?

শান্তনু বিব্রতভাবে বলল, আহ্! বড় বাজে রসিকতা এটা। একটু আগে ডঃ কেশবনও—

ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, আমি এই কথাটা উপভোগ করি। মালবী, তুমি রহস্যের কথা বলছিলে। হুঁ, কুম্ভকোণমের বিচ সত্যিই রহস্যময়।

মালবী অন্যমনস্কভাবে বলল, বিচটা ওপর থেকে দেখতে ভাল লাগে। কিন্তু নামলে কেমন অস্বস্তি হয়। যেন এক্ষুণি সমুদ্র এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে।

বসো মালবী! বলল, তোমার রিসার্চ কতদূর এগোল?

মালবী বেতের চেয়ার টেনে কাছাকাছি বসে বলল, এগোচ্ছে না। সোর্স মেটিরিয়্যালসের জন্য বারবার কলকাতা ছোটাছুটি। হঠাৎ ওকে এখানে ট্রান্সফার করে দেবে জানলে–

বিয়েই করতে না! শান্তনু বলল। কিন্তু দেখুন কর্নেল, আমি মোটেও ওকে জোর করে এখানে টেনে আনিনি।

বললাম, ডার্লিং! এটা তোমাদের ক্ষেত্রে চমৎকার হনিমুন ধরে নাও।

মালবী বলল, ওসব কথা থাক। কাল বিকেলে অফিস থেকে ফিরে শান্তনু যখনই বলল, আপনি আসছেন, আমি অমনিই ব্যাপারটা হয়ে গেলাম। আচ্ছা কর্নেল, একটা প্রশ্ন। গোয়েন্দা উপন্যাসে দেখা যায় গোয় কোনও হত্যাকাণ্ডের পর তবেই হত্যাকারীকে চিনিয়ে দিচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে গোয়েন্দা টের পাচ্ছেন কাউকে হত্যার চক্রান্ত হচ্ছে। অথচ গোয়েন্দা যেন চরম মূহুর্তের অপেক্ষায় আছেন। কেন? আগেভাগে তাকে ধরিয়ে দিলেই তো বেচারা বেঁচে যায়।

বললাম, উপন্যাসে হোক বা বাস্তবে হোক, যতক্ষণ না সত্যিই কোনও হত্যাকাণ্ড ঘটছে, ততক্ষণ হত্যাকারী নিছক বিমূর্ত সত্তা। চরম মুহূর্তের পর সে মূর্ত রক্ত-মাংসের মানুষে পরিণত হয়। আর তুমি হত্যাকারীর চক্রান্ত টের পেয়ে তাকে ধরিয়ে দেওয়ার কথা বলছ। ব্যক্তিগত এবং ডেলিবারেট খুনখারাপির চক্রান্তের কেসে চক্রান্তকারীকে আগে ধরাতে গেলে আইনের ধোপে টেকে না। তাকে জানিয়ে দিলে কিংবা শাসিয়ে দিলে সে প্ল্যান বদলাবে। ভিকটিমের ক্ষেত্রেও তাই। এসব কারণেই যিনি গোয়েন্দাগিরি করেন, তাঁর প্রকৃত ভূমিকা শুরু হয় হত্যাকাণ্ডের পর থেকে।

শানু বলল, কোনও মার্ডারই আটকানো যায় না, যদি তা ব্যক্তিগত পর্যায়ের ডেলিবারেট মার্ডার হয়।

মালবী আস্তে বলল, তুমি যা-ই বল, ডঃ রেড্ডিকে সতর্ক করে দেওয়া উচিত ছিল।

দিলেও কোনও লাভ হত না। মার্ডারার অন্য কোথাও অন্য কোনও ভাবে তাঁকে মারত। শান্তনু চেয়ারে হেলান দিয়ে ফের বলল, কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা, উনি খুন হয়ে যাওয়ার পর আমার মনে হয়েছে, ঘটনাগুলোর যেন গুরুত্ব ছিল। আগে তো আমার কাছে সেগুলো যত অদ্ভুত হোক, অর্থহীন ঘটনা।

বললাম, যেমন?

শানু খুব আস্তে বলল, ডঃ রেড্ডি এবং ওঁর দফতরের ডঃ পোট্টেকাট একদিন বিকেলে বিচের মাথায় দাঁড়িয়েছিলেন। একটু তফাত থেকে শুনতে পেলাম ডঃ পোট্টেকাট ওঁকে বলছেন, তুমি ওসবে নাক গলাতে যেও না। মারা পড়বে। ডঃ রেড্ডি খটরাগী মানুষ ছিলেন। চটে উঠে বললেন, আমার হাতে প্রমাণ আছে। আর একদিন ডঃ রেড্ডিকে সন্ধ্যাবেলায় ওঁর কোয়ার্টারের গেটে দেখে যেই পেছন থেকে ডেকেছি, অমনিই ভীষণ চমকে ঘুরে দাঁড়ালেন। কিন্তু সেটা অদ্ভুত লাগেনি। অদ্ভুত লাগল ওঁকে প্যান্টের পকেট থেকে দ্রুত ফায়ারআর্মস বের করতে দেখে। তারপর অবশ্য সেটা লুকিয়ে ফেলে নার্ভাস হেসে আমাকে বললেন, ও! তুমি? আমি ভাবলামকাকে ভেবেছিলেন বললেন না। আমারও জিজ্ঞেস করা ঠিক হত না। সবচেয়ে অদ্ভুত লেগেছিল, বিচের উত্তর প্রান্তে যে ধ্বংসস্থূপ দেখলেন, সেখান থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ে ছুটে পালিয়ে আসা। কাছাকাছি পৌঁছুলে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে? উনি বললেন, ওখানে সামুদ্রিক অজগর আছে। ভুলেও ওদিকে পা বাড়িয়ো না।

ততক্ষণে কফি শেষ। আধপোড়া চুরুট জ্বেলে বললাম, বডি ভোরবেলা বিচে পাওয়া যায় বলেছ। কী অবস্থায় ছিল?

উপুড়। মাথার ডানদিকে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে গুলি করা হয়েছিল। স্পষ্ট ডেড।

কে প্রথম বডি দেখেছিল?

অনেকেই ওই সময় বিচে জগিং করতে যায়। বিশেষ কেউ আগে দেখেছিল বলে শুনিনি। তবে ডঃ রেড্ডি বরাবর সবার আগে যেতেন জানি। কারণ আঞ্জি খুব ভোরে উঠি। বিচে যাওয়ার পথটা এই বারান্দা থেকে দেখা যায়।

তুমি খুব ভোরে ওঠ কেন?

শান্তনু হকচকিয়ে গেল। মালবী অস্থির হেসে বলল, গোয়েন্দাদের রীতি প্রত্যেককে সন্দেহ করা। নাও! এবার এক্সপ্লেন করো!

শান্তনু হাসল না। একই ভঙ্গিতে বলল, কিছু বিশেষ প্রজাতির উদ্ভিদে শিশিরের এফেক্ট নিয়ে আমি একটা এক্সপেরিমেন্ট চালাচ্ছি।

মালবী মন্তব্য করল, বেঁচে গেলে। কর্নেল, এবার আমাকে সন্দেহ করুন।

একটু হেসে টাকে হাত বুলিয়ে বললাম, ডঃ রেড্ডি যদি শান্তনুর মতো তরুণ, স্বাস্থ্যবান এবং রূপবান হন–

মালবী দ্রুত বলল, প্রেমিক হিসেবে একেবারে অযোগ্য। রোগা, বেঁটে, কুচকুচে কালো টিপিক্যাল দ্রাবিড়। বয়স আমার দ্বিগুণ। তার চেয়ে সাংঘাতিক, ভদ্রলোকের স্ত্রী জেলাস টাইপ মহিলা। শান্তনুকে জিজ্ঞেস করুন। ওঁর অফিসেরই কাজে কোনও মহিলাকর্মী গেলে জেরায় জেরবার করে ছাড়তেন। একবার আমি কী বিপদে পড়েছিলাম বলার নয়।

সে হেসে উঠল। শান্তনু বলল, ডঃ রেড্ডি একানড়ে স্বভাবের মানুষ ছিলেন। আমি যতবার দেখেছি, অফিসের বাইরে ওঁকে একা দেখেছি। দৈবাৎ কারও সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে এবং সেই লোকটা কথা বললে কিছুক্ষণ সঙ্গ দিতেন। যেমন দেখেছিলাম ডঃ পোট্রেকাটের সঙ্গে। কিংবা আমার সঙ্গেও কিছুক্ষণ কথা বলতেন।

বললাম, জগিংয়ের সময় কি উনি শর্টস্ পরতেন?

হ্যাঁ। চালচলনে খুব স্মার্ট এবং সায়েবি কেতাদুরস্ত ছিলেন।

ওঁর পকেটে কোনও ফায়ারআর্ম পাওয়া গিয়েছিল?

পয়েন্ট ২২ ক্যালিবারের একটা রিভলবার ডান হাতের কাছে পড়েছিল। সেটা ওঁরই এবং লাইসেন্স করা অস্ত্র। মর্গের রিপোর্টে বলা হয়েছে একই রিভলবারের গুলি মাথার ভেতরকার হাড়ে আটকানো ছিল। বুলেট কেসে ছটা বুলেটের মধ্যে একটা ফায়ার্ড।

তাহলে পুলিশের বক্তব্য, এটা আত্মহত্যা?

শান্তনু শ্বাস ছেড়ে বলল হ্যাঁ!

কিন্তু তুমি বলতে চাইছ এটা আত্মহত্যা নয়, হত্যা?

ডেলিবারেট মার্ডার।

তোমার এই ধারণার কারণ কি একটু আগে যে ঘটনা তিনটি বললেন, তা-ই?

শান্তনু একটু চুপ করে থাকার পর বলল, কোনও সুইসাইডাল নোট পাওয়া যায়নি। কিন্তু পুলিশ বলেছে, খটরাগী স্বভাবের লোকেদের পক্ষে এভাবে আত্মহত্যা স্বাভাবিক। ওঁর কলিগ বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথা বলে পুলিসের ধারণা হয়েছে, উনি শিজোফ্রেনিক টাইপ ছিলেন। অনেক সময় জানতেন না কী করছেন। একবার নাকি একটা গুরুত্বপূর্ণ ফাঁইলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন।

তোমাদের দফতরের সঙ্গে ডঃ রেড্ডির দফতরের সহযোগিতার সম্পর্ক থাকা উচিত।

আছে। আমরা পরস্পর ডেটা বিনিময় করি।

মালবী উঠে গেল পরিচারিকার ডাকে। এতক্ষণে আলো জ্বলল। বললাম, আত্মহত্যার চিঠি না পাওয়া গেলেও তোমার বর্ণনা অনুযায়ী ঘটনাটা আত্মহত্যাই দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু তুমি জোর দিয়ে বলছ হত্যা।

শান্তনুকে ঈষৎ উত্তেজিত মনে হল। কর্নেল! ডঃ রেডিন্ড লেফট্‌হ্যাঁন্ডার ছিলেন। তার পক্ষে নিজের মাথার ডানদিকে কানের ওপর রিভলবারের নল ঠেকিয়ে গুলি চালানো সম্ভব নয়।

তুমি নিশ্চিত?

অবশ্যই। কিন্তু আশ্চর্য, পুলিশ এবং অন্য কারও মাথায় এল না প্রশ্নটা!

তুমি প্রশ্নটা কেন—

আমার কথার ওপর শান্তনু বলল, সাহস পাইনি। এখানে যত হোমরাচোমরা লোকের বসবাস। কার কোথায় কী ইন্টারেস্ট আছে, জানি না। মালবীর সঙ্গে আলোচনার পর আপনাকে আসতে বলেছি।

মিসেস রেড্ডি কি আছেন, না চলে গেছেন?

কাল বিকেলে চলে গেছেন। মাদ্রাজের ওদিকে কোন্ গ্রামে ডঃ রেড্ডির পৈতৃক বাড়ি। সেখানে ওঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হবে। একটু চুপ করে থাকার পর শান্তনু ফের বলল, এমন হতে পারে, পুলিশের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মিসেস রেড্ডি অর্ধশিক্ষিত মহিলা। তাছাড়া সেকেলে এবং গ্রাম্য স্বভাবেরও বটে।

চুরুট অ্যাশট্রেতে ঘষটে নিভিয়ে বললাম, তাহলে হত্যার সময় ধস্তাধস্তি অনিবার্য ছিল। নিজের রিভলবার খুনীকে পকেট থেকে বের করে দেবেনই বা কেন ডঃ রেড্ডি? কিংবা ধর, খুনীকে শাসাতে বা খুনীর হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্রটা বের করেছিলেন। খুনী তা কেড়ে নিয়ে গুলি করে। এনি ওয়ে! ধস্তাধস্তি অনিবার্য ছিল। বিচের নরম বালিতে ছাপ থাকা উচিত ছিল।

ডেডবডির তলা দিয়ে সমুদ্রের ঢেউয়ের স্তর বয়ে এসেছিল। আমি লক্ষ্য করেছি।

হুঁ। তাহলে তেমন কোন চিহ্ন মুছে যাওয়াই স্বাভাবিক। দাড়ি থেকে অভ্যাস মতো চুরুটের ছাই ঝেড়ে ফেলে বললাম, ডঃ রেড্ডির সঙ্গে এখানে কার ঘনিষ্ঠতা ছিল–মানে বন্ধুত্ব।

শান্তনু মাথা নাড়ল। কারও সঙ্গে না। ওঁর রগচটা স্বভাবের জন্য কেউ ওকে পছন্দ করত না। আমিও না।

মালবী দরজার পর্দার ফাঁকে দাঁড়িয়ে বলল, সেকেন্ড রাউন্ড কফি?

বললাম, জিজ্ঞেস করছ ডার্লিং? ওঃ! তুমি যে ফাদার ক্রিসমাসকে শীতের কলকাতায় দেখেছিলে, সে এই শরতে একটুও বদলায়নি।

মালবী একমুখ হাসি নিয়ে অদৃশ্য হল। ওর মুখে এখনও বালিকার আদল।

শান্তনু বলল, আচ্ছা কর্নেল, এমন কি হতে পারে না, ডঃ রেড্ডি জগিংয়ের সময় ফায়ারআর্ম সঙ্গে রাখতেন না কারণ তখন বিচে আরও অনেকে আসে?

ঠিক বলেছ। সেই সময় খুনী ওঁর বাড়ি থেকে রিভলবার হাতিয়ে–

শান্তনু থেমে গেল। বললাম, হুঁ। একটা পয়েন্ট বটে। তবে ওঁর স্ত্রীর অগোচরে তা সম্ভব ছিল কি না, এটাই প্রশ্ন। ধরা যাক, খুনী জানত কোথায় অস্ত্রটা থাকে। খুনীর ও বাড়িতে গতিবিধি অবাধ হওয়ার কথা। তো ওঁর বাড়িতে নিশ্চয় কাজের লোক ছিল?

স্থানীয় একটি মেয়ে। আধ কিলোমিটার দূরে একটা বস্তি আছে। আমাদের এই কাজের মেয়েটিও সেখান থেকে আসে। এখনই চলে যাবে।

কখন আসে?

প্রায় সাতটা বেজে যায়। মারিয়াম্মাকে পায়ে হেঁটে আসতে হয়। পায়ে হেঁটে ফেরে। কারণ পিচরাস্তা পর্যন্ত কোন সাইকেল-রিকশো যাতায়াত করতে দেওয়া হয় না। বিগ গাইদের ডেরা এই কুম্ভকোণম। দেখে থাকবেন, সাইনবোর্ডে লেখা আছে, নোটিফায়েড এরিয়া। কিন্ত অনুমতিতে আসা যায় না।

শিগগির কফি এসে গেল। লক্ষ্য করলাম, মারিয়াম্মা লন পেরিয়ে চলে গেল। মালবী ভেতর থেকে গেট বন্ধ করে এল। নিচু বাউন্ডারি ওয়ালের মাথায় তারকাটার বেড়া এবং ঘন দেবদারু শ্ৰেণী।…

শান্তনুর সঙ্গে আমার এই দীর্ঘ বাক্যালাপ থেকে শান্তনুর বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট হবে। সে সরাসরি কোন ঘটনাতে পৌঁছাতে চায় না। তার সঙ্গে অনর্গল কথা বলতে হয়। কলকাতায় থাকার সময় তার এই বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করেছিলাম।

হ্যাঁ, এটা এক ধরনের ব্যক্তিগত অভ্যাস বা চরিত্রগত লক্ষণ বলা চলে। কিন্তু তা কিছুটা অস্বাভাবিক তো বটেই। কুম্ভকোণমে এসে এ নিয়ে চিন্তা-ভবনার পর আমার ধারণা হয়েছিল, প্রচণ্ড আতঙ্ক মনের তলায় চেপে রাখলেও এমনটা হতে পারে। এটা তার স্বভাবভীরুতা। অন্য কেউ হলে প্রথমেই ডঃ রেড্ডির মৃত্যুসংক্রান্ত রহস্যময় ঘটনা আমাকে জানিয়ে দিত। তাছাড়া ঘটনাটা যে আত্মহত্যা নয়, স্রেফ হত্যা, তা জানিয়ে দিতে এত সময় নিত না। এমন কি। শা বিকেলে নিচে নেমে একটা ভিন্ন প্রসঙ্গ তোলার পর প্রথমে শুধু একটি বাক্য দিয়ে ঘটনার সূত্রপাত করেছিল, হঠাৎ উনি মারা গেলেন। ওর এই আতঙ্কটা অস্বাভাবিক। কেন এত ভয় পেয়েছে ও?

পরদিন সাড়ে পাঁচটায় উঠে অভ্যাসমতো প্রাতঃভ্রমণের জন্যে বেরুতে গিয়ে দেখলাম, শান্তনু উঠেছে এবং বাংলোর পেছনের দিকে ঝোপঝাড়ের মধ্যে ঝুঁকে সম্ভবত শিশিরের এফেক্ট পরীক্ষা করছে। সে আমার অভ্যাস জানে। তাই গেটের তালা খুলে রেখেছে। নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলাম।

এখন সমুদ্র কিছুটা শান্ত। যেন ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে আছে। জনহীন বিচের মাথায় ল্যাম্পপোস্টে যে আলোগুলো জ্বলছে, তাদের রঙ ফিকে। সমুদ্র পূর্বে। পূর্বের দিগন্তে গাঢ় মেঘ। টুপি এবং রেনজ্যাকেট থাকায় বৃষ্টি এলেও ভিজব না। পিঠের কিটব্যাগে প্রজাপতি ধরা নেট এবং স্টিক গোঁজা। হঠাৎ মনে হল, বিচে কি প্রজাপতির আশা করছি? অনাবশ্যক বোঝা। বাইনোকুলারে প্রথমে দক্ষিণের জেলেবসতি, তারপর উত্তরের জলে আছড়ে পড়া ধ্বংসস্তূপের দিকটা দেখে নিলাম। জেলেবসতির দিকে ভেলা নৌকো (এই নৌকোর কোন তলা থাকে না) নিয়ে জেলেদের ব্রেকওয়াটারের সঙ্গে মর্মান্তিক লড়াই চোখে পড়ল। চিরকালের বাঁচার লড়াই। উত্তরের ধ্বংসাবশেষের ওপর দিকটায় জঙ্গল গজিয়ে আছে। আবছা একটা নড়াচড়া দেখলাম যেন। বেশ কিছুক্ষণ পরে একটা লোক নেমে এল বিচে। পরনে শর্টস। সে জগিং করতে করতে এদিকে আসছে। বলিষ্ঠ গড়নের মধ্যবয়সী একটা ফর্সা লোক।

বিচের মাঝামাঝি ইচ্ছে করেই তার গতিপথে দাঁড়ালাম এবং কাছাকাছি হওয়ার মুহূর্তে বলে উঠলাম, ধ্বংসস্তূপে কিছু কি খুঁজছিলেন?

থমকে দাঁড়িয়ে শ্বাস-প্রশ্বাসে প্রায় গর্জন করলেন ভদ্রলোক। কী?

বাইনোকুলারে দেখছিলাম আপনি যেন কিছু—

কে আপনি?

পকেট থেকে নেমকার্ড বের করে দিলাম। একটু হেসে বললাম, ওখানে নাকি সামুদ্রিক অজগরের আস্তানা। তাই আমার কৌতূহল জেগেছে।

কার্ড পড়ে আমাকে ফেরত দিয়ে ভদ্রলোক বললেন, সামুদ্রিক অজগর সাংঘাতিক। কৌতূহল বিপজ্জনক হতে পারে।

যেমন হয়েছে ডঃ রেড্ডির পক্ষে।

ভদ্রলোক ভুরু কুঁচকে ফোঁস ফোঁস শব্দে বললেন, আপনি যে-ই হোন সাবধান করে দিচ্ছি। কোথায় উঠেছেন আপনি?

তার আগে আপনার পরিচয় জানতে পারি কি?

না। বলে ভদ্রলোক আমার পাশ কাটিয়ে জগিং করতে করতে চলে গেলেন। সেই মুহূর্তে লক্ষ্য করলাম, ওঁর গলায় সোনার চেন আছে।

জনহীন বিচে উত্তরদিকে হাঁটতে থাকলাম। মাঝে মাঝে থেমে বাইনোকুলারে দেখে নিচ্ছিলাম, সেই ভদ্রলোক জেলেবসতির সীমানা অব্দি গিয়ে ঘুরে আসছেন। তারপর বিচের মাথায় উঠে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আমাকে লক্ষ্য করতে থাকলেন।

ধ্বংসস্তূপের মাথায় সহজেই ওঠা যায়। শান্তনুর ধারণা ঠিক। এটা একটা প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারই ছিল। যথেচ্ছ গজিয়ে ওটা জঙ্গলের ফাঁকে একটুকরো পাথরে পদ্ম, তারপর একটা টুকরোয় ধর্মচক্রের ক্ষয়টে চাপ চোখে পড়ল। খুঁটিয়ে চারপাশ বাইনোকুলারে দেখে নিলাম সতর্কতাবশে। তারপর এদিকে ওদিকে বালিতে মাথা উঁচু করে থাকা পাথর, ভাঙা স্কুপের শীর্ষাংশ এবং উঁচু নিচু গাছপালার ভেতরটা খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে হঠাৎ লাল রঙের একটা কুচি (কতকটা ঝরে পড়া রঙ্গনা ফুলের মতো দেখতে) চোখে পড়ল। ওপরে ঝোপে কোন ফুল ফোটেনি এবং ফোটে বলেও মনে হল না। কাছে যাওয়ার আগে বাইনোকুলারে দেখে নিলাম, প্রায় আধ কিলোমিটার দূরে বিচেরা মাথায় সেই ভদ্রলোক তেমনই দাঁড়িয়ে আছেন। তবে এতক্ষণে একজন-দুজন করে জগিংয়ের ভঙ্গিতে নামতে শুরু করেছে বিচে। তাদের মধ্যে যুবতীরাও আছে।

বুঝলাম, সামুদ্রিক হাওয়া বালি সরিয়ে দিয়েছে। এই ঝোঁপের তলায় সূর্যের আলো পৌঁছায় না। কারণ রঙ্গনা ফুলের কুচির মতো জিনিসটা ঝোপটার উত্তরে এবং কাণ্ডের কাছে পড়ে আছে। বালি সরানোর আগেই জিনিসটা চিনতে পারলাম। সরু লাল ফিতের মাথা।

বালি সরানোর পর পাথরের একটা পাতলা চাঙড় (স্ল্যাব) বেরুল। সেটা সরালে একটা ফাইল বেরুল। এ ধরনের রদ্দি হলদেটে ফাইল সব সরকারি অফিসের টেবিলে দেখা যায়। ফাইলটা না দেখেই ঝটপট পিঠের কিটব্যাগ খুলে ভেতরে ঢোকালাম। তারপর কিটব্যাগ পিঠে এঁটে প্রজাপতি ধরা জাল হাতে নিয়ে প্রজাপতির পেছনে ছোটাছুটির ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক করার পর ধ্বংসাবশেষের চাঙড়ে পা ফেলে নেমে এলাম বিচে।

জগিংরত একজন যুবক এবং এক যুবতী আমাকে দেখে মুহূর্তের জন্যে থেমেছিল। তারপরই তারা এক বুড়ো হাবড়া খেয়ালি লোকের আচরণ নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা না ঘামিয়ে চলে গেল। সেই ভদ্রলোক তখন বিচের মাথায় একটা পাথরে বসে আছেন। আমি সোজা জেলেবসতির দিকে এগিয়ে গেলাম। একখানে কাঁটাতারের বেড়া গলিয়ে টিলায় উঠলাম। টিলার গায়ে কুঁড়েঘরগুলোর বাসিন্দারা আমাকে গ্রাহ্য করল না। কিন্তু একটু পরেই কাচ্চাবাচ্চাদের দঙ্গল প্রথমে তামিল ভাষায়, তারপর ভাঙা ইংরেজিতে পয়সা দাবি করতে থাকল। এই সময় টিলার মাথায় পাথরের তৈরি ছোট্ট এবং পুরনো গির্জাঘর চোখে পড়ল। এই জেলেরা তাহলে খ্রিস্টান। কাচ্চাবাচ্চাদের চেহারায় যেন পোর্তুগিজদের আদল। প্রাচীন ইতিহাস আমাকে টানে। কিন্তু ফাইলটার টান আরও জোরালো। বাচ্চাগুলোকে কয়েক মুঠো চকোলেট (সব সময় পকেটে রাখি) বিলি করে বাইনোকুলারে শান্তনুর বাংলো খুঁজে বের করলাম। টিলার পশ্চিম ঢাল বেয়ে নেমে গেলাম ঢেউখেলানো বালিয়াড়িতে। তারপর থমকে দাঁড়াতে হল। উঁচু এবং ঘন করে দেওয়া তারকাটার বেড়া। মধ্যে-মধ্যে একটা করে লোহার খুঁটি। একখানে সাঁটা একটুকরো ফলক। তাতে কয়েকটা ভাষায় লেখা : ছুঁলেই মৃত্যু। সাবধান। তার মানে, বিদ্যুত্বহী তার আছে। তার তিনসার এবং কাঁটাতারের বাইরে সমান্তরালে টানা আছে। খুঁটির গায়ে সাঁটা অংশটা কালো নন-কন্ডাক্টিভ জিনিসে তৈরি। হঠাৎ করে চোখে পড়ে না।

অতএব খুব হরয়ানি হল। প্রায় এক কিমি.। বালিয়াড়ি এবং পাথুরে অসমতল মাটি পেরিয়ে অবশেষে পিরাস্তা পেলাম। তারপর হাঁটতে হাঁটতে কুম্ভকোণমের প্রবেশপথ। প্রহরীরা পারমিট দেখতে চাইল না, এর নানা কারণ থাকা সম্ভব।

শান্তনুর বাংলোয় পৌঁছুতে আটটা বেজে গেল। মালবী হাসি মুখে বলল, কোনও ক্লু পেলেন?

শুধু বললাম, কফি। আমার গলা শুকিয়ে গিয়েছিল।…

.

শান্তনু অফিস নটায়! দুপুরে খেতে আসে। ফাইলটার কথা বলে ওকে উত্তেজিত বা নার্ভাস করতে চাইনি। তবে গলায় সোনার চেন এবং ফর্সা রঙের ভদ্রলোকের কথা তুললে সে বলল, বিগ গাই। ইন্ডাস্ট্রিয়ালিফট। জগদীশ নায়েক। এক সময় মন্ত্রী ছিলেন। গত ভোটে হেরে যান। এখন আর প্রত্যক্ষ রাজনীতি করেন না শুনেছি। তবে রাজনৈতিক এবং আমলামহলে প্রচণ্ড প্রভাব আছে। থাকারই কথা। কিছু বললেন নাকি আপনাকে?

নাহ্। নিজের পরিচয় দিয়ে পরিচয় চাইলাম। দিলেন না।

শান্তনু আস্তে বলল, ডঃ রেড্ডাি মারা যাওয়ার দুদিন আগে ব্যাটাচ্ছেলে এসেছে। আমাদের হেড ডঃ কেশবন ওর ঘনিষ্ঠ লোক। দেখছি, রোজই। কেশবনকে টেলিফোন করে।

হাসলাম। তোমার আড়িপাতা স্বভাব আছে নাকি?

শান্তনু ব্যস্তভাবে বলল, নাহ্। আসলে ডঃ রেড্ডির ব্যাপারটা নিয়ে—

বুঝেছি। বলে কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে চুরুট ধরালাম। একটু পরে বললাম, ডঃ রেড্ডিকে খুনের কী মোটিভ থাকতে পারে বলে তোমার ধারণা?

শানু বলল, এমন কিছু জানতে পেরেছিলেন, যা খুনীর পক্ষে বিপজ্জনক হত। তাই ওঁকে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছে চিরকালের মতো। আর নিজের কানেই তো শুনেছি ডঃ পোট্টেকাট ওঁকে কী বলছিলেন।

ডঃ পোট্টেকাটকে তোমার এখানে চায়ের নেমতন্ন করলে কি উনি আসবেন?

আসতে পারেন। ওঁর মেয়ে রঞ্জাবতীর সঙ্গে মালবীর বন্ধুত্ব আছে।

তুমি বরং আমার কথা বলে–অর্থাৎ তোমার গেস্টের প্রসঙ্গ তুলে ওঁকে নেমন্তন্ন কর। আজ সন্ধ্যার দিকে। তবে সাবধান, বেস কিছু বলবে না।

নাহ্। আপনি নিজেও তো প্রকৃতিবিজ্ঞানী।…

শান্তনু অফিস গেল জিপে। ব্রেকফাস্টের পর আমার ঘরের দরজা এঁটে কিটব্যাগ থেকে ফাইলটা বের করলাম। প্রচুর বালি ঝরল। লাল ফিতের গিট পরীক্ষা করে শান্তনুর কথার সত্যতা বোঝা গেল। ডঃ রেড্ডি লেফ্টহ্যাঁন্ডার ছিলেন। বাঁ হাতেই কাজ করতেন। ফাঁইলের ওপর কিছু লেখা আছে তামিল ভাষায়। ফাইল খুলতেই প্রথমে বেরুল একটা নকশা। খুঁটিয়ে দেখার পর বুঝলাম, এটা কুম্ভকোণমেরই ম্যাপ ছাড়া কিছু নয়। অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশ লেখা আছে। একটা চৌকো জায়গায় লাল ডটপেনে টিক মারা আছে।

পরের কাগজটাও ম্যাপ। কিন্তু উপকূলবর্তী সমুদ্রের ম্যাপ। একটা বাঁকা তীরচিহ্ন দিয়ে কুম্ভকোণমকে নির্দেশ করা হয়েছে। তারপর চমকে উঠলাম। যেন হাতের কাছেই সাপ। কয়েকটা ইংরেজিতে লেখা চিঠির জেরক্স কপি। তলার সইটা অস্পষ্ট। চিঠিতে এক একটা জাহাজের নাম, তারিখ, কোন্ অবস্থানে কখন পৌঁছুবে এই সব তথ্য।

হুঁ। তাহলে এই ব্যাপার! একটা গুপ্তচক্ৰ কুম্ভকোণমের সমুদ্রবিজ্ঞান দফতরকে কাজে লাগাচ্ছে। কিংবা সঠিকভাবে বলতে গেলে কোন সমুদ্রবিজ্ঞানীকে।

কিন্তু জাহাজের চালকরা মুখ বুজে থাকে কেন? পয়সা খেয়ে, নাকি অন্য কারণে? কিন্তু এই দফতর তো কেন্দ্রীয় সরকারের এবং জাহাজ নাবিক সবই নৌবাহিনীর তদারকে থাকার কথা। নৌবাহিনীও কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা দফতরের অধীনে। ব্যাপারটা জানা দরকার।

দুপুরে শান্তনু খেতে এসে বলল, ডঃ পোট্টেকাট আসবেন পাঁচটা নাগাদ। রঞ্জাবতীও আসবে। ওর মা আডিয়ারে গেছেন। থিওসফিক্যাল সোসাইটির মেম্বার।

একটু পরে কথায় কথায় বললাম, সমুদ্রবিজ্ঞান দফতরের জাহাজঘাট কোথায়?

শান্তনু তাকাল। তারপর বলল, পাঁচ কি. মি. দক্ষিণে কোড্ডালমে। ওখানে একটা নেভি বেস আছে।

সমুদ্রবিজ্ঞান দফতরের নিজস্ব জাহাজ আছে নিশ্চয়?

আগে ছিল না। নৌবাহিনীর ছোট জাহাজ ভাড়া নিত। এখন একটা ছোট। জাহাজ এবং একটা মোটরমোট কেনা হয়েছে নেদারল্যান্ডস থেকে।

কুম্ভকোণমের সমুদ্রে দেখলাম ডুবো পাথর প্রচুর। সমুদ্রও এখানে বড্ড রাফ।

জেলেবসতির দিকে সমুদ্র মোটামুটি নিরাপদ। ব্রেকার অংশটা পেরিয়ে ওরা যেখানে মাছ ধরতে যায়, সেখানে সমুদ্র শান্ত বলা চলে।

ফাইলটার কথা তখনও চেপে গেলাম। বললাম, ওঁদের দফতরের হেড কে? ডাইরেক্টরের নাম মহাবীর প্রসাদ। নর্থ ইন্ডিয়ান। অ্যাসিস্ট্যান্ট ডাইরেক্টর একজন মিল। ডঃ নাগরাজন। রিসার্চ সেকশনেও তামিল বেশি। ডঃ পোট্টেকাট কেরালার লোক। এই সেকশনের হেড। ডঃ রেড্ডি তামিল ছিলেন। তিনি ছিলেন ডেটা সেকশনের চার্জে। রিসার্চ সেকশন থেকে যে সব তথ্য পাওয়া যায়, ডঃ রেড্ডি তা বিশ্লেষণ করে কম্পিউটারাইজড় কোড তৈরি করতেন।

আর কথা বাড়ালাম না। শান্তনু খেয়ে অফিস চলে গেল। বারান্দায় বসে চুরুট টানছি, মালবী এসে মিটিমিটি হেসে বলল, ফাদার ক্রিসমাসকে আজ ভীষণ গম্ভীর দেখাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে ক্লু পেয়ে গেছে।

হঠাৎ বললাম, একটা টেলিফোন করতে চাই। কিন্তু এখানে কি এস টি ডি। লাইন আছে?

হ্যাঁ, গত মাসে অটোমেটিক এক্সচেঞ্জ এবং এস টি ডি চালু হয়েছে। শান্তনু তো আপনাকে এস টি ডি করেছিল।

উঠে দাঁড়ালাম। একটা দুর্ভাবনা গেল। আমি ভেবেছিলাম ট্রাঙ্ককল-মানে, যেভাবে ও কথা বলছিল।

মালবী হাসল। কাছে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কী যেন বলল! আপনার আগ্রহ—

আপনার আগ্রহ জাগানোর মতো কিছু জিনিস এখানে আছে।

মালবী আস্তে বলল, আসলে শানুর ভয়ের কারণ আছে। তামিলনাড়ু বড্ড গোলমেলে হয়ে উঠছে ক্রমশ। ও ট্রান্সফার হওয়ার চেষ্টা করছে।

চল। টেলিফোন করব। কিন্তু গোপনে।

করুন না। এক মিনিট! আমি মারিয়াম্মাকে আগে বাইরের কাজে সরিয়ে রাখি। আজকাল যা হচ্ছে, কাকেও বিশ্বাস করা কঠিন।……

.

রঞ্জাবতাঁকে দেখে বাঙালি বলে ভুল হওয়া স্বাভাবিক। তাছাড়া সে ভাল বাংলা জানে। শান্তিনিকেতনের ছাত্রী। ছুটিতে বাবার কাছে কাটাচ্ছে। ডঃ পোট্টেকাট বাংলা জানেন না। ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, জার্মান ভাল জানেন। সমুদ্রবিজ্ঞানে খেই ধরিয়ে দিলাম। উনি প্রায় আধঘণ্টা বকবক করার পর মুখ খোলার সুযোগ পেলাম। বললাম, আপনাদের একজন বিজ্ঞানী আত্মহত্যা করেছেন শুনলাম।

ডঃ পোট্টেকাট বললেন, দাম্পত্য অশান্তি। রেড্ডির বউ গ্রামের মেয়ে। মানিয়ে চলার সমস্যা ছিল। এদিকে রেড্ডিও ছিল বদরাগী হটকারী স্বভাবের লোক।

সতর্কভাবে বললাম, উনি নিশ্চয় আপনার মতো মিশুকে স্বভাবের মানুষ ছিলেন না?

নাহ্। যেচে কথা না বললে কথাই বলত না।

ওঁর কোন শারীরিক ত্রুটি–মানে অসুখবিসুখ কিংবা–

কিচ্ছু না। রোগা হলেও চমৎকার স্বাস্থ্য ছিল। জগিং করত নিয়মিত। তবে মানসিক গণ্ডগোল ছিলই। শিজোফ্রেনিক টাইপ। ডঃ পোট্টেকাট হাসলেন। একটা ফাঁইলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। তখন অবশ্য খুব, সিগারেট খেত। যদিও বিশেষ করে ওর সেকশনে ধূমপান নিষিদ্ধ। তো দুর্ঘটনাও হতে পারে। একবার কম্পিউটারে ভুল ডেটা ফিড করিয়ে আমাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ রিসার্চ নষ্ট করে ফেলেছিল।

অমনোযোগিতা! এই ম্য করে ডঃ পোট্টেকাটের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকালাম।

উনি বললেন, রেড্ডি ছিল একজন অদ্ভুত চরিত্রের লোক। যেমন ধরুন, ওর কাছে একটা রিভলবার। ওটা কেন ও সঙ্গে রাখত? বুঝতে পারি না।

আপনি জানতেন ওঁর রিভলবার আছে?

ডঃ পোট্টেকাট সোজা হয়ে বসলেন। সে একটা সাংঘাতিক দুর্ঘটনা হতে পারত। একদিন বিচে নেমে যাচ্ছে। তখন প্রায় সন্ধ্যা। লক্ষ্য করলে দেখবেন, এখানে সমুদ্র সন্ধ্যার আগে থেকে ভীষণ রাফ হতে শুরু করে। তো হঠাৎ পেছন থেকে ডেকেছি, ভীষণ চমকে উঠে ঘুরে দাঁড়াল। কয়েক সেকেন্ডের জন্য ওর হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকে বেরিয়ে আসছিল। আমার চোখের ভুল নয়। রিভলবারের বাঁট!

পরে জিজ্ঞেস করেননি?

করেছিলাম। ডঃ পোট্টেকাট অন্যমনস্কভাবে বললেন, তামিলদের ইদানীংকার হাবভাব আমি বুঝতে পারি না। রেড্ডি বলেছিল, ওর কোন ফায়ারআর্মস নেই। কাজেই আমার নাকি চোখের ভুল।

শান্তনু এই সুযোগটা নিল। ডঃ পোট্টেকাট যদি কিছু না মনে করেন, একটা কথা জিজ্ঞেস করব?

স্বচ্ছন্দে।

এক বিকেলে বিচের মাথায় আপনারা দুজনে কথা বলছিলেন। একটু তফাত থেকে আমার কানে এসেছিল, আপনি ওঁকে কিসে নাক না গলাতে নিষেধ করছিলেন–

ডঃ পোট্টেকাটের চশমা ঝুলে পড়েছিল। চশমার ওপর দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আস্তে বললেন, তুমি যা শুনেছিলে, কাকেও কি বলেছ?

নাহ্।

আমি এখান থেকে বদলির চেষ্টায় আছি। তুমিও চেষ্টা কর। কুম্ভকোণম বিপজ্জনক জায়গা হয়ে উঠছে। বিশেষ করে ওই লোকটা–শিল্পপতি এবং প্রাক্তন মন্ত্রী জগদীশ নায়েক সমুদ্রবিজ্ঞান দফতরকে কাজে লাগাচ্ছে।

এবার বললাম, শ্রীলঙ্কার জঙ্গি তামিলদের অস্ত্র মজুতের ঘাঁটি হয়ে উঠছে। কুম্ভকোণম।

তাহলে আপনি জানেন? ডঃ পোট্টেকাট সোজা হয়ে বসলেন। সন্দিগ্ধভাবে বললেন, আপনি কি সি বি আই-এর লোক?

শান্তনু বিব্রতভাবে বলল, না না! ওঁর যে পরিচয় আপনাকে দিয়েছি, উনি তা-ই। প্রকৃতিবিজ্ঞানী এবং অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল।

বললাম, ডঃ পেট্টেকাট! আমার একটা বাতিক আছে। রহস্যময় কিছু ঘটলে নাক গলাই।

ঈশ্বরের দোহাই কর্নেল সরকার। এতে নাক গলাবেন না। ডঃ পোট্টেকাট প্রায় আর্তস্বরে বললেন। তাহলে শান্তনু এবং আমি ভীষণ বিপদে পড়ব।

জানি। তবে আমার কাজ শুধু সত্যে পৌঁছানো!

কী সত্য?

কে খুন করল ডঃ রেড্ডিকে।

কী? ডঃ পোট্টেকাট চমকে উঠলেন। রেড্ডি তো আত্মহত্যা করেছে।

ডঃ পোট্টেকাট! আপনি কি জানেন না ডঃ রেড্ডি লেহ্যাঁন্ডার ছিলেন। তিনি কেমন করে নিজের মাথার ডানদিকে রিভলবারের নল ঠেকিয়ে ট্রিগারে চাপ দেবেন?

উনি মাতৃভাষায় বিস্ময়সূচক কিছু বললেন। তারপর বললেন, কী আশ্চর্য! এটা তো আমার মাথায় আসেনি! আপনি ঠিক বলেছেন।

এতক্ষণে মালবী এবং রঞ্জাবতী লন থেকে বারান্দায় এল। মালবী বলল, খুব গুরুতর আলোচনা হচ্ছে। বাধা দিলাম না তো?

ডঃ পোট্টেকাট মেয়ের দিকে তাকিয়ে মালয়ালমে কিছু বললেন। রঞ্জাবতীর মুখে চমক খেলে গেল এবং সেও মালয়ালমে কিছু বলল।

তারপর রঞ্জাবতী আমার দিকে তাকাল। বাংলায় বলল, মালবীদির কাছে। আপনার সত্যিকার পরিচয় পেলাম।

হাসলাম। মেয়েদের পেটে নাকি কথা থাকে না বলে একটা প্রবচন আছে।

মালবী দ্রুত বলল, না। আসলে রঞ্জু একটা অদ্ভুত কথা বলল। তাই—

কী অদ্ভুত কথা?

রঞ্জাবতী এবং সে পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করল। তারপর রঞ্জাবতী বলল, আমাদের কোয়ার্টার থেকে বিচের একটা অংশ পরিষ্কার দেখা যায়। আমি খুব ভোরে উঠে যোগব্যায়াম করি। রেড্ডিকাকা যেদিন মারা যান, সেই ভোরে বিচে ওঁর পেছনে একজনকে জগিং করতে দেখেছিলাম। একটু পরে এঁরা আড়াল হয়ে যান।

তুমি লোকটাকে চিনতে পেরেছিলে?

নাহ। তখনও আবছা আঁধার ছিল। তবে রেড্ডি কাকাকে চিনতে পেরেছিলাম। কারণ এঁর হাঁটাচলা এবং বিশেষ করে জগিংয়ের একটা বিশেষ ভঙ্গি ছিল।

যেমন?

ডানহাতটা বুকের পাঁজরের সমান্তরালে থাকত। নড়ত না।

ডঃ পোট্টেকাট মেয়েকে মাতৃভাষায় আবার কিছু বললেন এবং সে শান্তভাবে জবাব দিল। মালবী আজ বিকেলেই মারিয়াম্মাকে ছুটি দিয়েছিল। সে বলল, রঞ্জু! আমাকে একটু সাহায্য করবে এস। রঞ্জাবতী তার সঙ্গে ভেতরে গেল। এতক্ষণে আলো জ্বালল। ডঃ পোটেকাট ঘড়ি দেখলেন।

শান্তনু বলল, এখনও ছটাই বাজেনি। আপনার ডিনারের নেমন্তন্ন তো আটটায়।

আমি একটু উদ্বিগ্ন শান্তনু! জগদীশ নায়েকের ডিনারে যাওয়া আমার পছন্দ নয়। কিন্তু ওকে তো জানো। এড়িয়ে থাকার সমস্যা আছে।

শান্তনু বাঁকা হাসল। ও আমাকে কখনও নেমন্তন্ন করে না। আমি নিশ্চয় ওর সুনজরে নেই।

ডঃ পোট্টেকাটও একটু হাসলেন। এক সময় জগদীশ কেরালার লোক মাত্রেই কমিউনিস্ট ধরে নিত। এখন বাঙালি মাত্রেই এর কাছে কমিউনিস্ট। আমাকে বলেছে।

বললাম, আচ্ছা ডঃ পোট্টেকাট, রেডি সাহেবের পক্ষে কি জগদীশ নায়েককে ব্ল্যাকমেল করা সম্ভব ছিল?

উনি ঝুলে পড়া চশমার ওপর দিয়ে আমার দিকে তাকালেন। আস্তে বললেন, অসম্ভব ছিল না, এটুকু বলতে পারি। কেন্দ্রীয় সরকার এই রাজ্যে বেশি কিছু না করতে পারুন, এই নোটিফায়েড এলাকা থেকে জগদীশকে উচ্ছেদ করতে পারেন। কাছাকাছি কোল্ডালমে নৌবাহিনীর ঘাঁটি আছে। তার ওপাশে স্থলবাহিনীর একটা ঘাঁটি আছে। পূর্ব উপকূলে যতদুর যাবেন, কেন্দ্রীয় হিনীর অজস্র ঘাঁটি। শ্রীলঙ্কার ব্যাপারে ভারত সরকারের মাথাব্যথা আছে।

কিন্তু আপনাদের জাহাজ কিংবা বোটের গতিবিধি অবাধ।

হ্যাঁ। জগদীশ সেই সুযোগটা নিচ্ছে। সর্বত্র দুর্নীতি। কী বলব?

এই সময় মালবী এসে খবর দিল, কর্নেল! আপনার ফোন।…

.

কোল্ডালমের নেভি কমান্ডার জয়পাল সিংহের সঙ্গে কিছুক্ষণ প্রয়োজনীয় কথা বললাম। সামরিক সাংকেতিক ভাষায় কথা হল। সমুদ্রবিজ্ঞান দফতরের জাহাজ এবং বোটের গতিবিধি আর অবাধ থাকছে না এর ফলে। সঙ্গে নজরদার। নেভিবোট থাকবে।

এরপর ফোন গাইডের পাতা থেকে জগদীশ নায়েকের ফোন নাম্বার নিলাম। কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর কেউ সাড়া দিল। বললাম, মিঃ জগদীশ নায়েকের সঙ্গে কথা বলতে চাই।

তিনি ব্যস্ত। আপনি কে বলছেন স্যার?

ওঁকে বলুন, কর্নেল নীলাদ্রি সরকার কথা বলবেন। খুব জরুরি।

প্রায় দুমিনিট পরে সাড়া এল। নায়েক বলছি। আপনি আজ ভোরে—

হ্যাঁ। ফাইলটা আমি খুঁজে পেয়েছি। আসলটা তো ডঃ রেড্ডি আপনার টাকা খেয়ে পুড়িয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু জেরক্স কপি লুকিয়ে রেখেছিলেন সতর্কতার জন্য। সেটা আপনাকে ফেরত দিতে চাই।

একটু পরে নায়েক বলল, কোথা থেকে বলছেন? নাম্বার দিন। পরে কথা বলব। এখন আমি ব্যস্ত।

আন্দাজে বলে দিলাম, পাবলিক বুথ থেকে।

খোঁজ নিয়েছি, আপনি ট্যুরিস্ট লজে ওঠেননি। কোথায় উঠেছে?

আপনি ফাইলটা চান কি না বলুন! নাকি ওটা কোল্ডালমে নেভি বেসে পাঠব?

আবার একটু দ্বিধা যেন। তারপর নায়েক বলল, কত দিতে হবে?

এক লাখ।

ঠিক আছে। ভোর পাঁচটায় জেলে বস্তির পশ্চিমের বালিয়াড়িতে যাবেন। দেখা হবে।

আপনার নিজে আসা চাই।

বোকার মতো কথা বললেন না। আমি নিজেই সমস্যার সমাধান করি।

তাহলে সেই কথা রইল। রাখছি।

টেলিফোন রেখে দিলাম। আজ ইচ্ছে করেই বেরোইনি। শান্তনুর কোয়ার্টারের বাইরে থেকে ওই বারান্দাটা দেখা যায় না। বাউন্ডারি ওয়ালের তারকাটা ঘন ঝুমকোলতায় ঢাকা এবং দেবদারু গাছগুলোও পরস্পর গাড় আলিঙ্গনাবদ্ধ। লনের দুধারে উঁচু রঙ্গনা এবং ঝাউ। বারান্দাটা গেট থেকে সরাসরি নজরে আসে না।

ফিরে গিয়ে দেখি, তেলেভাজা এবং পপিরভাজা খাওয়া হচ্ছে। ডঃ পোট্টেকাটের পাশে বসে আস্তে বললাম, একটা অনুরোধ। আপনার এবং শান্তনুর নিরাপত্তার স্বার্থে বলছি। নায়েকের ডিনারে যেন ভুলেও আমার কথা বলবেন না। বরং ভুলে যান, আপনার সঙ্গে আমার দেখা বা আলাপ হয়েছে।

ডঃ পোট্টেকাট দ্রুত বললেন, আমি কি রেড্ডির মতো উন্মাদ?…

.

আমার কিটব্যাগে অনেক জিনিস থাকে। কখন কী কোন প্রয়োজনে লাগে, ঠেকে শিখেশিখে জোগাড় করেছি। শান্তনুকে বলা ছিল। রাত চারটায় বেরোলাম। ওকে কিছু জানাইনি। তাই তার মুখে উদ্বেগ লক্ষ্য করলাম। সে একবার বলল, আমি যেতে পারি, যদি বলেন। তাকে ইশারায় থামিয়ে দিলাম।

কুম্ভকোণমের ম্যাপটা দেখে রেখেছিলাম। কিন্তু সতর্কতার জন্য সংকীর্ণ রাস্তার ধারে যত্নে সাজানো গাছপালার ছায়ায় হাঁটছিলাম। সরকারি কোয়ার্টার এলাকার পর পাথর, বালি এবং কাশবনে ঢাকা অসমতল জমিটা পেরিয়ে কাটাতারের বেড়া। দূরে-দূরে আলো। গুঁড়ি মেরে এগিয়ে নিচের বিদ্যুৎবাহী তারটা খুঁজে বের করলাম। তারপর রবারের দস্তানা পরে প্রথমে বাঁদিকের লোহার খুঁটির গায়ে আটকানো বিদ্যুতের তারটা কেটে সাবধানে একটুকরো পাথরে রাখলাম। ঈষৎ ঝিলিক দিয়েছিল। প্রায় দশ ফুট দূরে ডাইনের খুঁটিতে আটকানো সেই তারের অন্য অংশটা কেটে ফেললাম। এখানেও ঈষৎ ঝিলিক দিল বিদ্যুৎ। কিন্তু বিদ্যুত্বহী তারের দুটো দিক নন-কন্ডাক্টিভ রবারের মুখে থেকে গেল। কাঁটাতারটা কাশবনে ছুঁড়ে ফেললাম। দ্বিতীয় বিদ্যুত্বহী তারটা প্রায় তিন ফুট উঁচুতে। ওটা কাটার দরকার ছিল না। এবার নিচের দিক থেকে দুসারি কাটাতার একবার কেটে দেওয়াই যথেষ্ট। এবারে সরীসৃপের মতো ঢোকা সহজ হবে।

প্রায় আধঘণ্টা লেগে গেল। কাঁটাতার দুটো টেনে মুচড়ে সরালাম। পেরিয়ে যেতে একটুও অসুবিধে হল না। সামরিক জীবনে এ কাজ অজস্রবার করতে হয়েছে।

বালিয়াড়িতে গুঁড়ি মেরে এগোতে হচ্ছিল। কারণ কৃষ্ণপক্ষের একফালি পাণ্ডুর চাঁদ আমার গতিপথের ওপর ঝুলে আছে। খুঁজে একটা গর্ত মতো পাওয়া গেল। এই সব সামুদ্রিক বালিয়াড়িতে সাপ থাকে। খুদে টর্চের আলোয় দেখে নিলাম জায়গাটা। ওপরে ঢেউ খেলানো উঁচু বালির ঢিবি। কোথাও লম্বাটে, কোথাও ক্রুপের মতো। পৌনে পাঁচটা বাজে।

এখান থেকে জেলেবসতির টিলা এবং গির্জাঘরটা দেখা যাচ্ছিল। ক্রমে ভোরের আলো ছড়িয়ে আসছিল। এবার বাইনোকুলারে যতটা দেখতে পাওয়া সম্ভব, দেখতে থাকলাম।

অন্তত দুটো ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম। জগদীশ নায়েক জঙ্গি কমান্ডো বাহিনী সঙ্গে আনবে না। কারণ আমার নামের সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক আছে। দ্বিতীয়টা পরে বলছি।

পাঁচটায় গির্জার ঘণ্টা বাজল। জার্মান মনোবিজ্ঞানী জুংয়ের একটা কথা মনে পড়ছিল। তাঁর এক আত্মীয় তাঁকে একদিন হঠাৎ রাস্তায় দাঁড় করিয়ে বলেন, শয়তান নরকে আত্মাদের কীভাবে পীড়ন করে জানো? তাদের সে অপেক্ষা করিয়ে রাখে। হি কি দেম অ্যাওয়েটিং! আহ, এই অপেক্ষা করে থাকার মতো অত্যাচার সত্যি আর নেই। প্রতিটি সেকেন্ড একেকটি ঘণ্টার মতো দীর্ঘ।

সওয়া পাঁচটায় হঠাৎ চোখে পড়ল, টিলার ঢালে একটা পাথরের আড়ালে গুঁড়ি মেরে বসে আমার মতোই বাইনোকুলারে জগদীশ নায়েক বালিয়াড়ি দেখছে। পরনে শর্টস। কাঁধে একটা ছোট্ট ব্যাগ। হুঁ, এক লাখ টাকা!

সে নিশ্চিত হওয়ার পর উঠে দাঁড়াল। আমিও উঠে সামনের বালির ক্রুপের ওপর গেলাম। দেখতে পেয়ে সে জগিংয়ের ভঙ্গিতে নেমে এল। তারপর প্রায় পাঁচ মিটার দূরে দাঁড়িয়ে বলল, ফাইলটা দেখতে চাই।

তার দিকে সাবধানে লক্ষ্য রেখে জিপ টেনে ফাঁক করে জ্যাকেটের ভেতর। থেকে ফাইলটা বের করলাম। ফিতে খুলে ভেতরটা দেখিয়ে দিলাম। সে কয়েক পা এগিয়ে এল।

আগেই আভাস দিয়েছি, এবার সে কী করবে সেই বিষয়ে আমি নিশ্চিত ছিলাম। তাই মুহূর্তে রিভলবার বের করে বললাম, ডুয়েলে হেরে যাবে নায়েক! পকেট থেকে খালি হাত বের কর। হাতের সঙ্গে পয়েন্ট ২২ ক্যালিবারের রিভলবারের বাঁট দেখামাত্র হাত গুঁড়ো করে দেব। আর তোমার ওই খালি ব্যাগটা ফেলে দাও। এক লাখ টাকা বলা মাত্র তুমি রাজি হওয়ায় আমি জানতাম তুমি কী করবে। হাত ওঠাও! তোমার মতো জঘন্য খুনীকে এখানে কুকুরের মতো মেরে ফেলে রেখে যেতে আমার হাত কাঁপবে না। ওঠাও হাত!

সে দুহাত তুলল। তার চোখে অসহায় ক্রুরতা ঝিলিক দিচ্ছিল। তবে আমি খালি হাতেও ওকে ধরাশায়ী করতে পারি। কয়েক ঘণ্টার জন্য অজ্ঞান করে ফেলে রাখতে পারি। কিন্তু ওই যে বলেছি, অপেক্ষা করতে হবে।

তাই বললাম, আমার এটা পয়েন্ট ৩৮ ক্যালিবারের। কাজেই তুমি ডঃ রেড্ডির ক্ষেত্রে যা করেছ, আমার ক্ষেত্রে তা করে লাভ হত না। তুমি ওঁর ডানপাশে জগিং করতে করতে হঠাৎ তোমার ফায়ারআর্মস থেকে গুলি করেছিলে। তারপর ওঁর শর্টসের পকেট থেকে ওঁর অস্ত্রটা বের করে এক রাউন্ড ফায়ার করে ডান হাতের কাছে ফেলে রেখেছিলে। ওঁর রিভলবার কত ক্যালিবারের তুমি জানতে পেরেছিলে। কিন্তু হঠাৎ হত্যার চমৎকার মওকা পেয়ে একটা মত ভুল করে ফেলেছিলে। এই ধরনের ভুল সব অপেশাদার খুনীই করে। আকস্মিকতার ধাক্কায় বুদ্ধি গুলিয়ে যায়। তুমি জানতে, ডঃ রেড্ডি লেফট্যান্ডার। কিন্তু সে মুহূর্তে কথাটা তোমার মনে পড়েনি। পরে সময় মতো পুলিশকে চুপ করিয়ে দিয়েছ। একজন প্রাক্তন মন্ত্রী এবং শিল্পপতি বলে কথা! কিন্তু আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। আমি অন্য ধাতুতে গড়া।

আহ! এতক্ষণে জিপের শব্দ কানে এল। সামরিকবাহিনীর এই বিশেষ জিপের চাকা চওড়া এবং ভীষণ রুক্ষ। বালিতেও ছুটতে পারে। কোলমের আর্মি কামান্ডার রাজেন্দ্র সিং দলবল নিয়ে ঘিরে ফেললেন। রাজেন্দ্র, সহাস্যে বললেন, আমার ভয় হচ্ছিল নায়েক তার জঙ্গি কমান্ডো নিয়ে না হাজির হয়। দূর থেকে দেখলাম, দুহাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে। যাগে। রক্তপাত হল না।

রাজেন্দ্রকে ফাইলটা দিয়ে বললাম, এটা জেরক্স কপি। আসলটা ডঃ রেড্ডি পুড়িয়ে ফেলেছিলেন। টাকার লোভও ছিল। আবার ভয়ও ছিল। এনি ওয়ে, এতে অনেক বে-আইনি অস্ত্র মজুতের ঘাঁটি চিহ্নিত করা আছে। আরও অনেক তথ্য পেয়ে যাবেন। আমি চলি।

ছোট্ট বাহিনীটি এই অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ কর্নেলকে সামরিক রীতিতে অভিবাদন জানাল। আমিও প্রত্যুত্তর দিলাম। তারপর বালিয়াড়ি পেরিয়ে পিচরাস্তার দিকে হাঁটতে থাকলাম। হ্যাঁ, জেলেবসতি দিয়ে ওই বালিয়াড়িতে এলে আমার অবস্থা রেড্ডি সায়েবের মতো হত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress