ললাট লিখন
গ্রামের নাম ত্রিশূল। মোটামুটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম। কিন্তু জমিদার মানুষটা বড্ড খরচে। দুহাতে টাকা খরচ করেন। তাঁর নানান রকমের শখের মধ্যে একটি হল জ্যোতিষীর কাছে যাওয়া। ভারতবর্ষের বড়-বড় জ্যোতিষীর কাছে যান আর নিজের ভাগ্য জেনে আসেন। অবশ্য খুঁটিনাটি ব্যাপারে ওঁদের ভবিষ্যদ্বাণীর মিল হয় না কিন্তু মূল ব্যাপারটি অভিন্ন থেকে গেছে। যে কথাটা সবাই বলেছেন তা হল যতই খরচ করুন তাঁর পকেট খালি হবে না। এতেই জমিদারবাবুর শান্তি, পকেটে মাল থাকলে যে কোনও সমস্যার মোকাবিলা করা যায়। কিন্তু একটা ব্যাপারে জমিদারবাবুর একটু অস্বস্তি আছে। ত্রিশূল গ্রামের ঠিক মুখটাতে যে বিরাট বটগাছ কয়েক দশক ধরে ছায়া বিলোচ্ছে তার তলায় এক সাধুবাবা বাস করেন। প্রায় কুড়িবছর হয়ে গেল সাধুবাবা সেখানেই অবস্থান করছেন। প্রথম-প্রথম লোকে ওঁকে একটু সন্দেহের চোখে দেখত কিন্তু মানুষটার ওপর একটু একটু করে সবার শ্রদ্ধা জমেছে। কুড়িটা বছর বড় দীর্ঘ সময়। এই সময়। কেউ ওঁকে প্রাকৃতিক প্রয়োজন ছাড়া আসন ছেড়ে উঠতে দ্যাখেনি। গ্রামের লোক খেতে দিলে খান, না দিলে অনশনে কাটান। শরীর ক্রমশ শীর্ণ হলেও মুখে এক ধরনের জ্যোতি জন্ম নিচ্ছে। কথা বলেন খুব কম। সাধুবাবা কিছু চান না, কাউকে স্তোকও দেন না, নিজের মনেই থাকেন। এই মানুষটি সম্পর্কে জমিদারবাবুর প্রথমদিকে কোনও কৌতূহল ছিল না, এখন হচ্ছে। দুতিনদিন সাধুবাবার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন তিনি, চামচেদের দিয়ে সাধুবাবার মত জানতে চেয়েছেন কিন্তু কোনও উত্তর পাননি।
জমিদারবাবুর স্ত্রী সন্তান-সম্ভবা ছিলেন। আজ ভোরে উঠে জমিদারবাবুর মনে হল স্ত্রীর গর্ভে পুত্র কিংবা কন্যা আছে, কিন্তু ঠিক কী আছে তা তিনি জানেন না। কোনও জ্যোতিষী এই ব্যাপারে মুখ খোলেননি। সাধুবাবাকে প্রশ্নটা করলে কেমন হয়? তাঁরই জমিদারির মধ্যে একজন সাধু বাস। করছেন অথচ তিনি আগামীকালের কথা আগাম জানতে পারছেন না এ কি করে সহ্য করা যায়!
খোঁজখবর নিয়ে জানলেন ঠিক দুপুরবেলায় সাধু একা থাকেন। কাঠফাটা রোদ্দুরে কেউ আর গ্রামের বাইরে যায় না। দুপুর অবধি কোনওরকমে ধৈর্য ধরে থাকলেন জমিদারবাবু, তারপর কাউকে সঙ্গে না নিয়ে নিশব্দে ছাতি মাথায় বেরিয়ে পড়লেন।
দূর থেকে সাধুবাবাকে দেখতে পেলেন তিনি। নির্জন বটগাছ আর তার নীচে সাধুবাবা ধ্যানমগ্ন। একটা নেড়িকুকুর ছায়ায় বসে একদৃষ্টিতে সাধুবাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। জমিদারবাবু সাধুর সামনে এসে প্রণাম জানালেন। সাধুর চোখ বন্ধ, তাঁকে দেখতে পাচ্ছেন কিনা জমিদারবাবু বুঝতে পারলেন না। অথচ ধ্যান ভাঙাতেও ঠিক সাহস হচ্ছে না। বেশ কিছুসময় প্রতীক্ষায় কেটে গেল। সাধু চোখ খুলছেন না। ক্রমশ অধৈর্য হয়ে পড়লেন জমিদারবাবু। শেষে তাঁর মাথায় একটা মতলব এল। পড়ে থাকা গাছের ডাল কুড়িয়ে সজোরে নেড়িকুকুরটিকে প্রহার করলেন তিনি। প্রচণ্ড আর্তনাদ করে কুকুরটি সাধুবাবার আসনের দিকে ছুটে গিয়ে শেষমুহূর্তে দিক পরিবর্তন। করে উধাও হল। কিন্তু ততক্ষণে জমিদারবাবুর উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে। সারমেয়র চিৎকারে সাধুবাবার ধ্যান ভঙ্গ হয়েছে। তিনি চোখ মেলে দেখলেন জমিদারবাবু করজোড়ে দাঁড়িয়ে। আছেন। পলায়মান নেড়িকুকুরটির দিকে তাকিয়ে চিৎকারের কারণ বুঝতে অসুবিধে হল না, বিরক্ত সাধুবাবা প্রশ্ন করলেন, কৃষ্ণের জীবটিকে কি তুমি প্রহার করেছ?
জমিদারবাবু বললেন, হ্যাঁ বাবা।
কেন?
না হলে আপনার ধ্যানভঙ্গ হত না। শুনেছি বরফ-পাহাড়ের সামনে খুব জোরে আওয়াজ করলে তবেই বরফ ফাটে।
সাধুবাবার মুখে হাসি দেখা দিল। লোকটি বুদ্ধিমান বটে। কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গে তাঁর মনে পড়ে গেল এই মানুষটি এর আগে তাঁর কাছে কয়েকবার এসেছেন একটাই উদ্দেশ্য নিয়ে। ইনি নিজের ভবিষ্যৎ জানতে চান। ঈশ্বরকে ডাকেন তিনি, ঈশ্বরের নাম করেন, কিন্তু কোন বিদ্যায়। ভবিষ্যতের খবর জানা যায় তা তাঁর জানা নেই। জানতেও চান না। ঈশ্বর তাঁকে করুণা করলেই তিনি ধন্য। অথচ এই সাধারণ মানুষগুলো মনে করে যেহেতু তিনি সন্ন্যাসীর জীবনযাপন করছেন তাই মানুষের অতীত ভবিষ্যৎ জেনে বসে আছেন। তাঁর যে সেরকম কোনও ক্ষমতা নেই, ক্ষমতার লোভে তিনি এগোননি, একথা বললেও কেউ বিশ্বাস করবে না। এই কারণেই তিনি খুব কম কথা বলেন, লোকালয়ের কাছে না থাকলে না খেয়ে মরতে হবে তাই এখানে থাকা।
সাধুবাবার হাসি দেখে জমিদারবাবু বললেন, বাবা আমার বংশে সন্তান আসছে–আপনি বলুন সে পুত্র হবে তো?
সাধুবাবা মাথা নাড়লেন, বিধাতা যা চায় তাই হবে।
জমিদারবাবু বললেন, সেকথা ঠিক, কিন্তু মন তো জানতে চায়। আপনি তো সবই জানেন, দয়া করে বলুন।
সাধুবাবা বললেন, আমি সে ক্ষমতার অধিকারী নই। ঈশ্বরের করুণা পাওয়ার জন্য বসে আছি, তিনি প্রসন্ন হলেই আমার মুক্তি।
আপনি আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছেন। জমিদারবাবু অসহিষ্ণু হলেন।
আমি মিথ্যে কথা বলব কেন তাই বুঝতে পারছি না।
জমিদারবাবু একথা বিশ্বাস করতে রাজি হলেন না। তিনি উষ্ণ গলায় বললেন, আগামীকাল আবার আমি এই সময়ে আসব। আশা করি তখন আপনি ফিরিয়ে দেবেন না।
ক্ষুণ্ণ জমিদারবাবুকে চলে যেতে দেখলেন সাধুবাবা। কী আশ্চর্য ব্যাপার, কোনও মানুষ বিশ্বাস করতে চায় না যে তিনি ভবিষ্যৎ দেখতে পান না। সেই ক্ষমতা কী করলে আয়ত্ত হয় তাও তিনি জানেন না। দিনরাত ঈশ্বরকে ডাকা ছাড়া আর কোনও কিছুই যে তিনি জানেন না। শুনেছেন বড় সন্ন্যাসীরা এসব পারেন কিন্তু বড় সন্ন্যাসী হতে গেলে কী করা দরকার সে বিষয়ে তাঁর কোনও ধারণা নেই।
সাধারণ মানুষের দোষ দেন না সাধুবাবা, তারা তো জানতে চাইবেন। ক্রমশ তাঁর মনে অভিমান এল। এত বছর কেটে গেল ঈশ্বরের প্রত্যাশায় তবু তাঁর করুণা পেলেন না। শীর্ণ জটাধারী তপ্ত। মধ্যাহ্নে আকাশের দিকে তাকালেন। সেখানে একখণ্ড মেঘও নেই। মনে-মনে প্রার্থনা করলেন, হে করুণাময়, তুমি দয়া করো। আমি কিছুই চাইনা তোমার কাছে, শুধু তোমার লীলার স্বাদ নিতে চাই।
সেই সন্ধ্যয় সাধুবাবা কিছু খেলেন না। গ্রামের ভক্তরা অবশ্য নিত্যদিনের উপাচার পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল। এই সঙ্গে এসেছিল আর একটি বিশেষ থালা। ওটি জমিদারবাবু পাঠিয়েছেন। রাজভোগ, রাজসন্দেশ এবং রাজফলে সেটি পরিপূর্ণ। সাধুবাবা কোনও দিকেই তাকালেন না। চিত্ত স্থির করে ক্রমশ ডুবে যেতে লাগলেন এক অসীমে। যেখানে গেলে কোনও জাগতিক কোলাহল কর্ণে প্রবেশ করে না।
মধ্যরাত পেরিয়ে গিয়ে আকাশ একটু-একটু করে চেহারা বদলাচ্ছিল। ফিকে জাফরান রঙের সমারোহ সেখানে। নবমীর চাঁদ ননীর রং মেখে ঝুলে রয়েছে মধ্যগগনে। শুকতারা ক্রমশ উজ্জ্বল হচ্ছে এখন। শেষ প্রহরে সাধুবাবার চেতনা ফিরে এল। বড় নির্জন হয়ে আছে পৃথিবী। বিশ্বচরাচর এখন ঘুমের অতলে। কোথাও কোনও শব্দ নেই। সাধুবাবা চোখ মেললেন। হঠাৎ তাঁর। শ্রবণেন্দ্রিয় সতর্ক হল। দ্রুতপায়ের আওয়াজ কানে আসছে। এই শেষরাতে কে আসছে? ঠিক তখনই নজরে এল। ত্রিশূল গ্রামের ভেতর থেকে এক ব্যক্তি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছে বলা চলে। আকৃতি দেখে চিনতে পারলেন না সাধুবাবা। অথচ এই গ্রামের প্রতিটি মানুষকে তিনি ভালো করে চেনেন। কোনও কুমতলব শেষ করে লোকটা ফিরে যাচ্ছে না তো! গ্রামের মানুষ তাঁর ভক্ত, তাঁকে সেবা করে। ওদের কোনও ক্ষতি করে আসছে না তো লোকটা?
চোখের সামনে দিয়ে যখন সে হনহন করে বেরিয়ে যাচ্ছে তখন সাধুবাবা তাকে ডাকলেন, ওহে এদিকে একবার শোন!
লোকটি একটু শ্লথ হয়ে আবার চলতে শুরু করলে সাধুবাবা গলা তুললেন, তুমি কে হে? ডাকছি শুনতে পাচ্ছ না?
এবার লোকটি থামল। তারপর সেখানেই দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, কী বলছেন তাড়াতাড়ি বলুন, আমার সময় নেই।
সাধুবাবা হাসলেন, অত ব্যস্ত কেন? দুদণ্ড দাঁড়িয়ে যাও না?
লোকটি বিরক্ত মুখে এগিয়ে এল, কী বলছেন?
তোমাকে তো কখনও দেখিনি বাপু, কোথায় থাকো?
এতদিন চোখ ছিল না তাই দ্যাখেননি, এখন চোখ হয়েছে তাই দেখছেন। কী কারণে ডাকছেন তাড়াতাড়ি বলে ফেলুন।
সাধুবাবা লোকটির মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, বসো।
না-না, বসার সময় নেই। এক্ষুনি ভোর হবে, তার আগেই আমাকে পাশের গাঁয়ে যেতে হবে। আগে কাজ পরে কথা।
সাধুবাবার শরীর রোমাঞ্চিত হল, আমি কি ঠিক দেখছি? লোকটি হাসল, হ্যাঁ, ঠিকই দেখছ। এতদিন অন্ধ ছিলে, আর পাঁচজনের মতো চোখ থাকতেও আমায় দেখতে পাওনি। এতবছরের সাধনার পর আজ তোমার দৃষ্টি ফুটেছে তাই দেখতে পেলে। আমি বিধাতাপুরুষ।
সাধুবাবা সঙ্গে-সঙ্গে প্রণাম করলেন। তারপর বললেন, আমি ধন্য, আমি ধন্য।
বিধাতাপুরুষ বললেন, ঠিক আছে। এখন কেন ডেকেছ তাই বল?
সাধুবাবার মাথায় কোনও জিজ্ঞাসা সহসা এল না। তস্কর ভেবে তিনি বিধাতাপুরুষকে ডেকেছিলেন। এখন কি জবাব দেবেন ভাবতে গিয়ে জমিদারবাবুর মুখ মনে পড়ল। বেচারা জানতে চায় তার ছেলে হবে না মেয়ে হবে! সাধুবাবার আর কোনও খেয়াল রইল না, এই প্রশ্নটাই বিধাতাপুরুষকে করলেন।
বিধাতাপুরুষ হাসলেন, আমি তো তার বাড়ি থেকেই আসছি হে। আজ তৃতীয় প্রহরে তার স্ত্রী একটি পুত্র প্রসব করেছে। সেই পুত্রের ললাটে ভাগ্যলিপি লিখে ছুটে আসছি। যেতে হবে পাশের গাঁয়ে। সেখানে এক চাষির কন্যা জন্ম নিচ্ছে। তারও ললাটে লিখতে হবে ভবিষ্যৎ। এখন এত কাজের চাপ একা সামলানো মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। তার ওপর তুমি পিছু ডেকে দেরি করিয়ে দিলে। মানুষ ভাবে বিধাতা হয়ে আমি খুব সুখে আছি!
সাধুবাবা নতজানু হয়ে বললেন, ভগবান, এত যদি করুণা হল তবে দয়া করে আর একটু বলে যান। ওই দুই নবজাতকের ললাটে কী লেখা হল বা হবে!
বিধাতাপুরুষ বললেন, তুমি ভক্ত লোক, তোমাকে বলতে আপত্তি নেই। তাছাড়া আমি একবার ললাটে যা লিখে দেব পৃথিবী গেলেও তা মিথ্যে হবে না। হ্যাঁ, জমিদারের ছেলের কপালে। লিখলাম, কয়েকবছর সে বেশ আদরে মানুষ হবে। কিন্তু জমিদারের বেহিসাবী খরচের জন্যে জমিদারি নিলামে উঠবে। বাপ, মা মরে গেলে ছেলেটি একদম অনাথ নিঃস্ব হয়ে জীবন কাটাবে। তবে অতি দীন অবস্থায় তাকে বাঁচাবার জন্যে একটি কালো গরুর ব্যবস্থা রেখেছি। সেই গরুর দুধ বিক্রি করে সে বেঁচে থাকবে।
বিধাতাপুরুষ যাওয়ার জন্যে পা বাড়ালে সাধুবাবা তাড়াতাড়ি জিজ্ঞাসা করলেন, আর ওই চাষির মেয়ের কপালে কি লিখবেন?
মুখ ঘুরিয়ে বিধাতাপুরুষ বললেন, সে মেয়ের বিয়ে হবে ষোল বছর বয়সে। ঠিক সতেরো বছরে বিধবা হবে। তার এক ভাসুর তাকে নষ্ট করবে। বাধ্য হবে সে পথে বেরিয়ে আসতে। তোমাদের পাশের গঞ্জে সে ঘরভাড়া নেবে। খুব কষ্টে তার দিন কাটবে কিন্তু একদম যাতে না খেয়ে মারা যায় তাই রোজ রাত্রে অন্তত একজন খদ্দের সে পাবেই–এই ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। আর কথা বাড়িও না বাপু, ভোর হয়ে এল বলে, আমি চলি। বিধাতাপুরুষ প্রায় দৌড়ে গেলেন পাশের গ্রামে।
সাধুবাবা সেই ছুটে যাওয়া নয়নভরে দেখলেন। তারপরেই তাঁর খেয়াল হল স্বয়ং ঈশ্বর এসে তাঁর সামনে দাঁড়িয়েছিলেন অথচ নিজের জন্যে কিছু চাওয়ার কথা তাঁর মনেই আসেনি। তা থাক, তিনি তো এখন এই পৃথিবীর দুটি মানুষের ভবিষ্যতের কথা জানেন। এই ক্ষমতা তো ঈশ্বর। তাঁকে দিয়ে গেলেন। তারপরই তাঁর মনে হল, আহা, ওই ছেলেমেয়ে দুটো কত না কষ্ট পাবে! কোনও উপায়ে কি তাদের কষ্ট দূর করা যায় না? তিনি ভেবে রাখলেন, জমিদারবাবু যদি আবার আসেন তাহলে ওঁকে বলবেন মিতব্যয়ী হতে। সন্তানের জন্যে যথেষ্ট সম্পত্তি রেখে যেতে। পাশের গাঁয়ের চাষীকে গিয়ে বলে আসবেন সে যেন খবরদার তার মেয়েকে ষোলো বছর বয়সে বিয়ে না দেয়। তারপরেই মনে হল, মানুষের কর্মফল তো ভোগ করতে হবে, তিনি কেন বাধা। দিতে যাবেন? তাছাড়া ঘটনগুলো আদৌ ঘটে কিনা তাও জানা দরকার।
এই ঘটনার পরে আরও কুড়িটি বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। সেই একই আসনে সাধনা করে। সাধুবাবা আরও শীর্ণ হয়েছে। এখন তাঁর শরীর কয়েকটি হাড়ের সমষ্টি ছাড়া কিছুনয়। কুড়ি বছর পর এক মধ্যাহ্নে সাধুবাবার স্মরণে পড়ল ঘটনাটার কথা। এই কুড়ি বছরের মধ্যে তিনি বিধাতাপুরুষকে আর দেখতে পাননি। কিন্তু এখন প্রতিমুহূর্তে মর্মে-মর্মে তাঁর অস্তিত্ব অনুভব করেন। জাগতিক সুখদুঃখ তাঁকে আর বিব্রত করে না। ঘটনাটা মনে পড়ায় তাঁর কৌতূহল হল। ঈশ্বরের লীলা কী প্রকৃতির তা দেখা যাক। তিনি আসন ছেড়ে উঠলেন।
সাধুবাবাকে গ্রামের পথে দেখতে পেয়ে ভিড় জমে গেল। চল্লিশ বছর ধরে ওঁকে কেউ গ্রামে ঢুকতে দ্যাখেনি। সাধুবাবা তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, জমিদারের বাড়িটা কোন পাড়ায়? ভিড়ের ভেতর থেকে একজন জানাল, জমিদারের বাড়িটা এখন আর নেই। ধারপত্তর করে তাঁদের। অবস্থা এত খারাপ হয়েছিল যে সব নিলাম হয়ে গিয়েছে। বাড়িটা যারা কিনেছিল তারা ভেঙে ফেলে গুদাম করেছে। জমিদারবাবু নেই, শুধু তাঁর ছেলে খুব কষ্টসৃষ্টে একটা ভাঙা বাড়িতে কোনওরকমে থাকে।
সাধুবাবার ইচ্ছায় ওরাই তাঁকে একটা জীর্ণ বাড়ির সামনে পৌঁছে দিয়ে গেল। সেখানে একটি তরুণ করজোড়ে দাঁড়িয়ে সাধুবাবাকে অভ্যর্থনা করল, বাবা, এ আমার কী ভাগ্য যে আপনি পায়ের ধুলো দিয়েছেন!
সাধুবাবা জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি জমিদারের পুত্র? হ্যাঁ বাবা, তাই ছিলাম কিন্তু এখন অতি দীনদরিদ্র, আপনার সেবা করার যোগ্যতাটুকুও নেই। আপনি আমার দুঃখ দূর করুন।
সাধুবাবা জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার চলে কী করে?
ছেলেটি বলল, আমার তো সবই গিয়েছে, শুধু একটা কালো গরু কোনওরকমে টিকেছিল। তার দুধ বিক্রি করে বেঁছে আছি।
সাধুবাবা শিহরিত হলেন। তাহলে বিধাতাপুরুষের বাক্য মিথ্যে হয়নি! তিনি কিছুক্ষণ নয়ন বন্ধ করে চিন্তা করতেই এক ধরনের হাসি ঠোঁটে ফুটে উঠল।
আচ্ছা একটু মজা করলে কীরকম হয়? দেখা যাক, এতে ছেলেটির কোনও উপকার হয় কিনা। তিনি জমিদারপুত্রকে নিভৃতে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললেন, তুমি যদি আমার উপদেশমতো চলো তাহলে তোমার দুঃখ দূর হতে পারে।
ছেলেটি তাঁর পায়ে হাত রাখল, আপনি আদেশ করুন, আমি পালন করব।
সাধুবাবা বললেন, বেশ। তুমি তোমার কালো গরুটিকে গোয়াল থেকে খুলে বাজারে নিয়ে যাও। সেখানে সেটা ভালো দামে বিক্রি করে এসো।
ছেলেটি আঁতকে উঠল, একি কথা বলছেন বাবা, ওই আমার সবেধন নীলমণি, ওকে বিক্রি করলে খাব কী?
সাধুবাবা বললেন, আমার কথা শোনো, তোমার অমঙ্গল হবে না।
ছেলেটি তবু দোনামনা করছে দেখে সাধুবাবা কপট ক্রোধ প্রকাশ করলেন, যা বলছি তাই যদি না করো, তোমার–। বাক্য সমাপ্ত না করে তিনি ফিরে চললেন নিজের আসনে।
সারারাত মন চঞ্চল হয়ে রইল। ছেলেটি তাঁর নির্দেশ মান্য করল কিনা বুঝতে পারছেন না তিনি। ভোর হতে না হতেই দেখলেন ছেলেটি ছুটে আসছে তাঁর কাছে। সাধুবাবার মুখের তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল। ছেলেটি এসে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে বলল, এ আপনার কী লীলা বাবা! গতকাল। আপনার আদেশমতো আমার কালো গরুটাকে বিক্রি করে ফিরে এলাম। খুব মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আজ সকালে চারটের সময় অভ্যেসমতো ঘুম ভেঙে যেতেই হাম্বা ডাক শুনতে পেলাম। গোয়ালঘরে ছুটে গিয়ে দেখি সেখানে একটা কালো গরু দড়ি দিয়ে কে বেঁধে রেখে গেছে।
সাধুবাবা বললেন, এই সবই ঈশ্বরের লীলা, তাঁকে করতেই হবে। কাল কত দাম পেলে?
চারশ টাকা।
বেশ, আজই ওই গরুটাকে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দাও। দেখবে কাল সকালে গোয়ালে আর একটি গরু বাঁধা থাকবে। তোমার দৈনিক আয় জমিদারির আয়ের চেয়ে কম হবে না হে। যাও।
ছেলেটিকে বিদায় করে মনে-মনে তৃপ্ত হলেন সাধুবাবা। তারপর লাঠি হাতে আবার বেরিয়ে পড়লেন পাশের গঞ্জের দিকে। এর মধ্যেই লোকমুখে চারদিকে রাষ্ট্র হয়ে গেছে সাধুবাবার অলৌকিক ক্রিয়ার কথা। সবাই এসে নিজের কষ্ট জানিয়ে সাধুবাবার আশীর্বাদ চায়। কোনওক্রমে তাদের এড়িয়ে সেই গঞ্জের খারাপ পাড়ায় উপস্থিত হলেন তিনি। এখানে কয়েকঘর স্বৈরিণী বাস করে। কিন্তু তাদের মধ্যে বিধাতাপুরুষের বলে যাওয়া মেয়েটি কোনটি হবে? জনে জনে জিজ্ঞাসা করা শোভন নয়, কিন্তু সাধুবাবাকে বেগ পেতে হল না, স্বৈরিণীরা সবাই ছুটে এল তাঁর কাছে, এসে পায়ে পড়ে বলল, বাবা আমাদের উদ্ধার করো।
সাধুবাবা জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের মধ্যে কার যোলোতে বিয়ে হয়ে সতেরোতে বিধবা হতে হয়েছিল?
সুন্দরী এক যুবতি বলল, আমি সেই হতভাগিনী।
সাধুবাবা দেখলেন মেয়েটি সুন্দরী কিন্তু তার সাজপোশাক অত্যন্ত জীর্ণ। বোঝাই যায়, খুব কষ্টে আছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কী রকম আয় হয়?
মেয়েটি বলল, সে পাপের কথা মুখে আনতে লজ্জা করছে বাবা। তবু যখন জিজ্ঞাসা করলেন তখন বলছি, সারারাত কুপি জ্বেলে বসে থেকে কোনওরকমে একটা খদ্দের জোটে।
সাধুবাবা শুধোলেন, কোনও রাত খদ্দের ছাড়া গেছে?
মেয়েটি জানাল, না বাবা, সেরকম হয়নি। একটা টাকা দিক কি দুটো দিক, একজন না একজন এসেছে। এই বাজারে কি আর ওই রোজগারে চলে!
সাধুবাবা প্রফুল্ল হলেন, ঠিক আছে। আমি যা বলছি তাই করবে। আজই গঞ্জে ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে দাও, আজ রাত্রে যে এই বেশ্যার ঘরে আসবে তাকে এক হাজার টাকা দিতে হবে।
মেয়েটির চোখ কপালে উঠে গেল। খানিকক্ষণ কথা বলতে পারল না সে। তারপর তড়বড়িয়ে বলে উঠল, একি কথা বলছ বাবা! লোক আমায় পাঁচটা টাকা দিতেই পাঁচকথা শোনায়, তুমি। আমায় হাজার টাকা চাইতে বলছ? অত টাকা দেওয়ার ক্ষমতা কজনের আছে? আর দেবেই বা কেন?
সাধুবাবা কপট রাগ দেখিয়ে বললেন, আমি যা বলছি তাই না করতো তোমার–। বাক্য শেষ করে সাধুবাবা গঞ্জের বাইরে এক গাছতলার আসনে ফিরে গেলেন।
পরদিন সকাল হতেই মেয়েটি ছুটে এল সেখানে, বাবা তোমার কী লীলা, সত্যিই পাশের গাঁয়ের জমিদারবাবু এসেছিল গো আমার ঘরে। গুনে-গুনে এক হাজার টাকা দিয়ে গেছে আমাকে। তাই দিয়ে সব ধার শোধ করে এলাম। ঢ্যাঁড়া শুনে জমিদারবাবু নাকি অবাক হয়ে দেখতে এসেছিলেন।
সাধুবাবার মুখে হাসি ফুটল, বেশ, আজ ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে দাও তোমার ঘরে ঢুকতে হলে দুহাজার টাকা দিতে হবে।
মেয়েটি ঢোঁক গিলল। কিন্তু এক হাজার টাকার আনন্দে ছুটে গেল ঢ্যাঁড়া পেটাতে। পরদিন মেয়েটি এল একটু বেলায়। সাধুবাবা দেখলেন, ওর অঙ্গে ভালো শাড়ি উঠেছে। হাঁটা-চলার ঢংটাই পালটে গেছে। এসে মুচকি হেসে বলল, এসেছিল গো! ঢ্যাঁড়া যখন দেওয়া হচ্ছিল তখন এক রাজাসাহেব গাড়িতে চড়ে শিকারে যাচ্ছিলেন। তিনি শুনে বললেন, কী ব্যাপার, এই রাজত্বে দুহাজারি মাল আছে? দেখতে হয়! এই বলে আমায় দুহাজার দিয়ে গেলেন। একটা পান গালে ফেলে মেয়েটি হাসল, তা হ্যাঁ বাবা, আজ কি তিন হাজার বলব?
সাধুবাবা মাথা নাড়লেন, না।
তাহলে? মেয়েটি যেন দমে গেল।
আজ ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে দাও, যে মানুষ আজ রাত্রে তোমার ঘরে আসতে চাইবে তার অন্তত তিনটে হাত থাকতে হবে। তিন হাজার নয়, তিন হাত না হলে তুমি কাউকে ঘরে ঢুকতে দেবে না–যাও।
মেয়েটির চোখ কপালে উঠল, একি খেলা বাবা, মানুষের কি তিন হাত হয়, হতে পারে?
সাধুবাবা বললেন, তোমার যখন পাঁচ টাকা রোজগার হত না, সেখানে কাল দুহাজার হল কী করে? যাও আর কথা বাড়িও না, যা বলছি তাই করো, খবরদার আদেশ অমান্য করো না।
মেয়েটি কালো মুখে চলে গেলে সাধুবাবা হাসলেন, এইবার দেখা যাক কী হয়। সেদিন সন্ধে হতে হতেই সাধুবাবা নিশব্দে পতিতা পাড়ায় প্রবেশ করলেন। মেয়েটি যে বাড়িতে থাকে তার ঠিক সামনেই একটা বড় কাঁঠাল গাছ দেখতে পেয়ে তার নিচে আসন নিলেন তিনি। অন্ধকারে কেউ তাঁকে দেখতে পাচ্ছে না কিন্তু তিনি সব দেখছেন। কারণ দরজায়-দরজায় লন্ঠন আলো হাতে নিয়ে স্বৈরিণীরা দাঁড়িয়ে। খদ্দের আসছে এবং দরজা বন্ধ হচ্ছে। কিন্তু সাধুর নজর বিশেষ ঘরের দিকে। সেখানে অত্যন্ত গরবিনির ভঙ্গিতে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। অনেক সাধাসাধি করলেও সে কাউকে ঘরে তুলছে না।
ক্রমশ রাত বাড়ল। পাড়াটা ঝিমিয়ে এল। মেয়েটি দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে হাই তুলতে লাগল। শেষ পর্যন্ত সব আলো নিভে গেল, সে ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করল। সাধুবাবার অস্বস্তি শুরু হল। রাতের তৃতীয় প্রহর এখন। এতবড় গঞ্জ ঘুমে কাদা হয়ে আছে। মাথার ওপর অম্বুরী তামাকের গন্ধের মতো ঝলমল জ্যোৎস্না এসে পড়ল। এখন চরাচর স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সাধুবাবা দেখছেন রাত খুব দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। ঠিক সেই সময় পায়ের শব্দ হল।
সাধুবাবা সচকিত হলেন। একটি মানুষ হনহন করে ছুটে আসছে। কোনওদিকে না তাকিয়ে সে মেয়েটির বন্ধ দরজার সামনে উপস্থিত হয়ে কড়া নাড়ল। দুবার শব্দ হতেই ভেতর থেকে মেয়েটির গলা পাওয়া গেল, কে রে?
লোকটি জবাব দিল, আমি।
আমি-টা কে? ভেতর থেকে ঘুমজড়ানো গলা ভেসে এল।
তোমার কাছে রাত্তিরে কারা আসে?
অ। তা তোমার তিনটি হাত আছে? সাধুবাবা বিধান দিয়েছেন।
বেরিয়ে দ্যাখো আছে কি নেই?
দরজা খুলল। লণ্ঠনের আলো এসে পড়ল আগন্তুকের মুখে। সাধুবাবা গলা বাড়িয়ে লোকটির মুখ দেখতে চেষ্টা করলেন।
মেয়েটি বলে উঠল, ওমা, তাই তো! এরকম আবার হয় নাকি? সাধুবাবা ঠিক বলেছেন দেখছি। তিন হাতে আদর খাব আজ।
লোকটি মুখ বিকৃত করল, এইজন্যে আগেভাগে জানাতে নেই। উত্তরটা জেনে ব্যাটা খুব চাল চালল। চলো।
সাধুবাবা দেখল বিধাতাপুরুষকে নিজের মর্যাদা রাখতে তিন হাতে ঘরে ঢুকতে হচ্ছে। ঈশ্বরের ললাটে এইটে কেউ লিখে দিয়েছিল কিনা কে জানে। ভাবতেই হাসি পেল। ঈশ্বরের ললাটে লেখার ক্ষমতা আবার কার আছে? মানুষ ছাড়া?