বাড়িটা নিস্তব্ধ
বাড়িটা নিস্তব্ধ। ওপরের ঘরে আলো জ্বলছে। অর্জুন বেল না বাজিয়ে দরজায় শব্দ করল। কারও কোনও সাড়া নেই। গঙ্গাপদ বলেছিল, সে বাইরের ঘরে শোয়, সামান্য আওয়াজে ঘুম ভেঙে যাবে তার, দরজা খুলে দেবে। অর্জুন আরও জোরে শব্দ করল। কারও কোনও সাড়া নেই। এত রাত্রে বেল বাজালে ডক্টর পত্ৰনবীশের কাজে ব্যাঘাত হতে পারে, কিন্তু এখন না বাজিয়ে উপায় নেই।
রাত নিস্তব্ধ বলেই বেলের আওয়াজ বেশ কানে লাগল। ঘুম যত গভীর হোক ওই আওয়াজে গঙ্গাপদর উঠে পড়া উচিত। গঙ্গাপদর দেখা মিলল না। অর্জুন খিড়কির দরজায় এল। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। মহা ফাঁপরে পড়ে গেল সে। শেষপর্যন্ত চামড়ার খাপের যন্ত্র ব্যবহার করা ছাড়া কোনও উপায় দেখল না। মধ্যবিত্ত বাঙালি বাড়ি তৈরি করার সময় সদর দরজার কাঠ বেশ মজবুত নির্বাচন করলেও ন্যাচ কির ব্যাপারে নামী কোম্পানির ওপর অন্ধ হয়ে নির্ভর করেন। সল্ট লেক বলেই সদর দরজার তালা যন্ত্রের সাহায্যে খুলতে কোনও অসুবিধে নেই, নিতান্ত দূর্ঘটনা না ঘটলে কেউ দেখবে না। একটু আগের ছাদের দরজা খুলতে যত কম সময় লেগেছিল এখন তার চেয়ে বেশি লাগল। কিন্তু দরজাটা শেষপর্যন্ত খুলে গেল।
ঘর অন্ধকার। আর কিছু না হোক এই সময় কুকুরদুটোর ছুটে আসা উচিত। বাঁধা থাকলে মেয় কেন গলা ফাটাচ্ছে না! আলো জ্বালল অর্জুন। দরজা বন্ধ করল। ঘরে গঙ্গাপদ নেই ৷ এখন রাত বারোটা। লোকটা এখনও ঘুমোয়নি কেন?
ভেতরের বারান্দায় পা দিতেই কানে চাপা আওয়াজ এল। কেউ যেন যন্ত্রণা পেয়ে গোঙাচ্ছে। অর্জুন আলো জ্বেলে পাশের ঘরের দরজায় যেতে দেখতে পেল গঙ্গাপদ মেঝের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে আর তার শরীরের দুপাশে পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে সার এবং মেয়। অর্জুন দ্রুত কাছে চলে গেল। গঙ্গাপদর মাথার পাশ দিয়ে রক্ত পড়েছে মেঝের ওপর। লোকটা এখনও বেঁচে আছে। কুকুরদুটোর একটা মাঝেমাঝে শব্দ করছে, পা ছুড়ছে, অন্যটা স্থির।
এ-বাড়িতে সর্বনাশ হয়ে গেছে। অর্জুন উঠে দাঁড়াল। তারপর দৌড়ে সোজা ওপরে উঠে গবেষণাগারের সামনে চলে এল। ঘরে আলো জ্বলছে। জিনিসপত্র লণ্ডভণ্ড। আলমারির দরজা খোলা। যে যন্ত্রটির মাধ্যমে ডক্টর পত্ৰনবীশ তাঁর গবেষণা চালাচ্ছিলেন সেটি উধাও হয়ে গিয়েছে। ঘরে ডক্টর নেই।
অর্জুন বেশ চেঁচিয়ে ডক্টর, ডক্টর বলে ডাকল। কোথাও কোনও সাড়াশব্দ নেই। অর্জুন দ্রুত টেলিফোনের কাছে পৌঁছে আবিষ্কার করল লাইন মৃত। সম্ভবত তার কেটে দেওয়া হয়েছে।
গভীর জঙ্গলে মাঝরাতে পথ হারালে যে অবস্থা হয়, বাড়ি থেকে বেরিয়ে পুলিশকে খবর দিতে প্রায় সেইরকম অভিজ্ঞতা হল অর্জুনের। ট্যাক্সির দর্শন পাওয়া এ-সময় খুব অসম্ভব নয়। মাঝরাতে যারা সল্ট লেকের বাড়িতে ডাবল ভাড়া দিয়ে ফেরেন, তাঁদের নিয়ে আসা ট্যাক্সির ড্রাইভাররা থানার নাম শুনেই অ্যাকসিলারেটরে চাপ দিয়ে উধাও হয়ে যাচ্ছে। দু-একটা প্রাইভেট গাড়ি তো অর্জুনের হাত নাড়াকে পাত্তাই দিচ্ছে না। আর এগুলো চলে গেলেই ঝুপ করে নেমে আসছে নির্জনতা।
এই সময় অর্জুন দেখতে পেল একটা মারুতি ভ্যান আসছে। দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে ভ্যানটা সোজা পথে আসছে না। হেডলাইট দুটো রাস্তার এপাশ থেকে ও-পাশে চলে যাচ্ছে মাঝে-মাঝেই। অর্জুন হাত নাড়তে লাগল। আর আশ্চর্য ব্যাপার, ভ্যানটা থেমে গেল। ড্রাইভারের সিটে যিনি বসে ছিলেন তিনি জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করলেন, মতলবটা কী? ছিনতাই করবে? নো চান্স। পকেটে একটাও টাকা নেই।
অর্জুন বলল, আমাকে এখনই থানায় যেতে হবে। দয়া করে একটা লিফট দেবেন?
লিট? আমি নিজেই নিজেকে লিফট দিতে পারছি না তো। গাড়ি চালাতে জানো?
হ্যাঁ।
তা হলে উঠে এসো। আমার বাড়ি থানার কাছে। আমি ঠিক বলে দেব। মাতালরা নিজের বাড়ি ভুল করে না। কিন্তু আমি আর চালাতে পারছি না। ভদ্রলোক কোনওরকমে শরীরটাকে টেনেহিঁচড়ে পাশের সিটে নিয়ে গিয়ে বললেন, ভগবানকে ডাকলে তা হলে কাজ হয় এখনও। আঃ! যেন খুব স্বস্তি পেয়েছেন এমন গলায় শব্দটা করলেন।
অর্জুন স্টিয়ারিংয়ে বসল, কোনদিকে যাব?
থানায় যাবে বললে বলে মনে হল।
থানা কোনদিকে?
অ। সোজা চলো। সোজা।
অতএব অর্জুন সামনের পথ ধরল। ভদ্রলোকের মাথা বুকের ওপর ঢলে পড়েছে। অর্জুন দুপাশে তাকাতে-তাকাতে চলছিল। আজ সে থানায় গিয়েছিল। কিন্তু দিনের বেলায় দেখা পথ এক, রাত্রে সেটা হয়ে যায় অন্য। তা ছাড়া ফেরার সময় তাকে জিপে করে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল।
হঠাৎ ভদ্রলোক চিৎকার করে উঠলেন, ব্যস, ব্যস। থামাও গাড়ি।
অর্জুন তাড়াতাড়ি ব্রেক চাপল। ভদ্রলোক বললেন, ওই বাড়ি। সাদা বাড়ি কালো রাস্তা। আমি নামছি।
নামছেন মানে? আমি তা হলে থানায় যাব কী করে?
গাড়ি নিয়ে যাও, আমাকে বিরক্ত কোরো না।
দেখুন মশাই, আমাকে ঝামেলায় ফেলবেন না। থানা এখান থেকে কতদূর?।
ভদ্রলোক হাসলেন, সর্বত্র ভগবান অথচ লোকে তাঁকে খুঁজে বেড়ায়। তুমি যেই বললে থানায় যাবে তখনই আমার মনে হল বেঁচে গেলাম। তোমাকে গাড়ি চালাতে দিলে আমি সশরীরে বাড়িতে পৌঁছে যাব। আমার বাড়ির উলটোদিকে থানা।
অর্জুন অবাক হয়ে ডান দিকে তাকাতেই চিনতে পারল। সে দ্রুত ভ্যান থেকে নেমে পড়ল।
থানায় অবনীমোহন ছিলেন না। সেকেন্ড অফিসার টেলিফোনে কথা বলছিলেন। তিনি অর্জুনকে দেখে ইশারায় বসতে বলে কথা শেষ করলেন। তারপর রুমালে মুখ মুছতে মুছতে বললেন, ওঃ। আর পারি না। রোজ রাত্রে চুরি আর চুরি। কী ব্যাপার? ওহহ, আপনি, আপনি বড়বাবুর পরিচিত, তাই না?
হ্যাঁ। উনি কোথায়?
রাউন্ডে বেরিয়েছেন।
তা হলে আপনি এখনই চলুন। ডক্টর পত্ৰনবীশের বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে। ওঁকে পাওয়া যাচ্ছে না। ওঁর কাজের লোককে এখনই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া দরকার। আমি এখানে নতুন, কাউকে চিনি না, ডাক্তার পর্যন্ত ডাকতে পারিনি। প্লিজ।
দাঁড়ান, দাঁড়ান। ডক্টর পত্ৰনবীশ মানে, বড়বাবুর সঙ্গে যে বৈজ্ঞানিকের পরিচয় আছে, আপনি তাঁর কথা বলছেন? তাঁর বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে?
হ্যাঁ। দেখুন, এর মধ্যে অনেক সময় নষ্ট হয়েছে।
কিন্তু আমি এখন থানা ছেড়ে যাই কী করে?
একটা মানুষের প্রাণ বাঁচানোর জন্যে আপনার যাওয়া উচিত। খানিকটা দোনোমনা করে ভদ্রলোক উঠলেন। একজন সেপাইকে খবরটা বলে আর একজনকে সঙ্গে নিয়ে গাড়িতে উঠলেন, আপনি এখানে পৌঁছলেন কী করে এ-সময়?
অর্জুন মাতাল ভদ্রলোককে দেখতে পেল না। বলল, লিক্ট নিয়েছিলাম।
লিফট? সল্ট লেকেও তা হলে লোকে লিফট দেয়।
আপনি এমনভাবে বলছেন, যেন সল্ট লেক ড়ুয়ার্সের জঙ্গল।
আমি কিছু বলছি না।
ডক্টর পত্ৰনবীশের বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছেই ওরা জিপটাকে দেখতে পেল। পুলিশের জিপ। দরজার সামনে অবনীমোহন দাঁড়িয়ে আছেন। ভেতর থেকে কুকুরের তারস্বরে চিৎকার ভেসে আসছে। মাঝে-মাঝে বন্ধ দরজার ভেতর দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে কুকুরটা, শব্দ তা জানান দিচ্ছে। গাড়ি থেকে নেমে অর্জুন দ্রুত এগিয়ে গেল, আপনি কী করে খবর পেলেন?
অবনীমোহন বললেন, খবর? আমি তো কোনও খবর পাইনি। রাউন্ডে বেরিয়ে এই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ কুকুরের চিৎকার কানে এল। এমন চিৎকার আগে কখনও শুনিনি। কী ব্যাপার জানতে তখন থেকে বেল টিপছি। কিন্তু কারও সাড়া পাচ্ছি না।
থানায় যাবে বলে বেরুবার সময় অর্জুন দরজা টেনে দিয়েছিল, ফলে ল্যাচ-কি আবার বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সেকেন্ড অফিসার বললেন, মনে হচ্ছে বাড়ির ভেতরে কেউ দরজা খোলার মতো অবস্থায় নেই। অর্জুনবাবু বললেন, ডক্টর পত্ৰনবীশকে পাওয়া যাচ্ছে না আর ওঁর চাকর প্রচণ্ড উন্ডেড। দরজা ভাঙা দরকার।
অর্জুন ততক্ষণে তার চামড়ার খাপ বের করেছে। উত্তেজনায় তার হাত কাঁপছিল। ওকে যন্ত্রের সাহায্য নিয়ে তালা খোলার চেষ্টা করতে দেখে সেকেন্ড অফিসার বললেন, আরে। এই বিদ্যে আপনার জানা আছে দেখছি। ডেঞ্জারাস ব্যাপার।
অবনীমোহন তাঁকে হাত তুলে চুপ করতে বললেন।
এবার একটু বেশি সময় লাগলেও দরজা খুলল। অর্জুন দেখল, মাঝরাতে এত কথাবার্তা হচ্ছে, দু-দুটো পুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে কিন্তু আশেপাশের বাড়ির লোক কৌতূহল প্রকাশ করছে না। বাড়িগুলো রাতের গাছের মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে।
দরজা খোলামাত্র মেয় ঝাঁপিয়ে পড়ল। প্রচণ্ড হিংস্র দেখাচ্ছিল তাকে। শেষপর্যন্ত অর্জুনকে দেখে সে শান্ত হল কিছুটা। দ্রুত ছুটে গেল ভেতরে।
গঙ্গাপদ তখন সংজ্ঞাহীন। তাকে একটা জিপে করে তখনই হাসপাতালে পাঠানো হল। মাথায় জল ঢেলে সার-এর জ্ঞান ফিরিয়ে দুটো কুকুরকেই ঘরে বন্দি করে রাখা হল। কুকুরদুটোর শরীরে কোনও আঘাত নেই। সম্ভবত ওষুধ দিয়ে ওদের অজ্ঞান করে ফেলা হয়েছিল।
এবার অবনীবাবু তদন্তে নামলেন, দোতলার ঘরগুলো অন্ধকার। ছাদের গবেষণাঘরের চেহারা অর্জুন যেমন দেখে গিয়েছিল তাই রয়েছে। একবার দেখে নিয়ে অবনীবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আপনি এই ঘরে ঢুকেছিলেন?
হ্যাঁ। ডক্টর পত্ৰনবীশকে খুঁজতে এখানে এসেছিলাম।
কোনও জিনিসপত্রে হাত দেননি তো?
প্রশ্নই ওঠে না।
সারা ঘর জুড়ে তাণ্ডব হয়েছে। মনে হচ্ছে আততায়ীরা কোনও কিছুর সন্ধানে এসেছিল। ডক্টর তো এ-ঘরেই ছিলেন?
হ্যাঁ। রাত্রে আমি যখন বেরিয়েছিলাম তখন তিনি এখানেই কাজ করছিলেন। গঙ্গাপদ বলেছিল আমাকে উনি একাই খেয়ে নিতে বলেছেন।
ঘটনাটি যখন ঘটেছিল তখন আপনি বাড়িতে ছিলেন না?
না।
কোথায় গিয়েছিলেন?
খাওয়াদাওয়ার পর একটু হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। অর্জুন এখনই চট করে সত্যি কথাটা বলল না। অবনীবাবু তার দিকে তাকালেন।
এই হাঁটাহাঁটি আপনি কতক্ষণ করছেন?
একটু বেশি সময়, ধরুন বারোটা নাগাদ আমি ফিরে আসি। গঙ্গাপদ বলেছিল ও বাইরের ঘরে শোয়, ঘুমও পাতলা। সামান্য শব্দ করলেই দরজা খুলে দেবে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও যখন ও দরজা খুলল না-
তখন আপনি আপনার যন্ত্রের সাহায্য নিলেন?
হ্যাঁ।
অবনীবাবু বললেন, কিন্তু অন্যের দরজার তালা ওইভাবে খোলা অপরাধ, তা তো আপনার অজানা নয়। দরজা কেউ খুলছে না দেখে আপনার থানায় যাওয়া উচিত ছিল।
আমার ভয় হচ্ছিল বাড়িতে কোনও বিপদ হয়েছে, তাই–।
অবনীবাবু আর কথা না বাড়িয়ে সন্তর্পণে ঘরের জিনিসপত্র দেখতে লাগলেন। দেখতে-দেখতে বললেন, যেভাবে কাগজপত্র ছড়ানো রয়েছে। তাতে মনে হচ্ছে আততায়ীরা কোনও বিশেষ কাগজ খুঁজতে চেয়েছিল। ডক্টর পত্ৰনবীশ আপনাকে কখনও এই ঘরে নিয়ে এসেছেন?
হ্যাঁ। উনি ওঁর এই কাজের জায়গা আমাকে দেখিয়েছেন।
তখনকার দেখা সব জিনিসপত্র এখন দেখতে পাচ্ছেন?
সব মনে নেই, তবে ডক্টর পত্ৰনবীশ যে মেশিনটা নিয়ে কাজ করতেন সেটাকে দেখতে পাচ্ছি না। ওখানে ছিল মেশিনটা। মেয় ওর তলায় চাপা পড়েছিল।
আচ্ছা! আর–?
আর কিছু, হ্যাঁ, ডক্টর বলেছিলেন ওঁর গবেষণার সমস্ত কাগজপত্র এ-ঘরের আলমারিগুলোতে রাখা আছে। আমি ওঁকে পরামর্শ দিয়েছিলাম এই ঘর থেকে সরিয়ে অন্য কোথাও রাখতে। উনি বলেছিলেন দোতলায় একটা লোহার। সিন্দুক রয়েছে। সেখানে উনি সরিয়ে রেখেছিলেন কিনা তা জানি না।
এরকম পরামর্শ দিতে গেলেন কেন?
কেউ যদি ওরাং ওটাং পাঠিয়ে চুরি করার প্ল্যান করে, সে নিজে যে আসবে না এমন নিশ্চয়তা নেই। তাই সতর্ক হতে বলেছিলাম। কথা বলতে বলতে অর্জুনের চোখে পড়ল ঘরের মেঝের ওপর একটা স্ট্র্যাপ ছেড়া ঘড়ি পড়ে আছে। অবনীবাবুর অলক্ষ্যে সেটাকে কুড়িয়ে নিয়ে পকেটে পূরল সে।
দোতলার সিন্দুক বন্ধ। চাবি কোথায় আছে তা একমাত্র ডক্টর পত্ৰনবীশই বলতে পারেন। অবনীবাবু বললেন, অর্জুনবাবু, আপনার ব্যাকগ্রাউন্ড না জানা থাকলে এখন আপনাকে আমি অ্যারেস্ট করতাম। রাত্রের খাওয়া শেষ করে হাঁটাহাঁটির গল্প আমি বিশ্বাস করি না। হয় আপনি আমার কাছে কোনও সত্যি চেপে যাচ্ছেন, নয় মিথ্যে কথা বলছেন। এখন গঙ্গাপদই আমাদের ভরসা। তার জ্ঞান ফিরে এলে প্রকৃত ঘটনা জানা যাবে। ডক্টরকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। ওঁকে যত দ্রুত সম্ভব খুঁজে বের করতে হবে। উনি যখন ওঁর অস্বস্তির কথা বলেছিলেন তখন আমি ঠিক গুরুত্ব দিইনি। দেওয়ার কারণও ছিল না। সেকারণেই উনি আপনাদের শরণাপন্ন হন। অথচ আপনি খুঁকে বাঁচাতে পারলেন না। আততায়ীরা যখন এল ঠিক তখনই আপনি ঠুনকো কারণ দেখিয়ে বাড়ির বাইরে চলে গেলেন। আপনি আমার সঙ্গে চলুন।
কোথায়? অর্জুন অবাক হল।
থানায়।
আপনি আমায় অ্যারেস্ট করছেন?
না। তবে সন্দেহভাজনের লিস্টে আপনিও আছেন। গঙ্গাপদর স্টেটমেন্ট না পাওয়া পর্যন্ত আপনাকে আমি ছাড়তে পারি না। অবনীবাবু গম্ভীর গলায় বললেন।
আপনি চাইলে আমি যেতে বাধ্য। কিন্তু আমাকে সন্দেহ করার কারণ নেই। আমি এখানে এসেছি ডক্টর পত্ৰনবীশকে সাহায্য করতে। আপনি যদি আমাকে সাহায্য করেন তা হলে ডক্টর পত্ৰনবীশের উপকার হবে।
কী সাহায্য চাইছেন?
প্রথম ভেবে দেখুন আততায়ীরা কীভাবে বাড়িতে ঢুকেছিল?
সেটা আমি ভেবেছি। দরজা-জানলা ভাঙা হয়নি। তার মানে গঙ্গাপদ খুলে দিয়েছে।
এটা সরল ভাবনা। কিন্তু স্বার্থ ছাড়া গঙ্গাপদ ওদের সাহায্য করবে কেন?
ওরা নক করেছিল। গঙ্গাপদ ভেবেছিল আপনি ফিরে এসেছেন। তাই দরজা খুলেছে।
এত রাতে ওরা নক করে নিজেদের অস্তিত্ব জানিয়ে দেবে কেন? দরজা না খুলে গঙ্গাপদ যদি ওদের পরিচয় জানতে চাইত তা হলে অচেনা গলা পেয়ে না-ও খুলতে পারত। এই ঝুঁকি কেন ওরা নেবে? ওরা নিশ্চয়ই সতর্ক হয়ে এসেছিল।
তা হলে ধরে নিতে হচ্ছে গঙ্গাপদ ওদের লোক। টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছে। তারপর চলে যাওয়ার সময় আমাদের বিভ্রান্ত করতে ওকে আহত করে ফেলে রেখে গেছে। এ ছাড়া আর কী হতে পারে?
এটা সত্যি কিনা তা আপনি গঙ্গাপদকে জেরা করে জানতে পারবেন। বেশিক্ষণ সত্য গোপন করার মতো মনের জোর লোকটার নেই। কিন্তু এটা সত্যি নয় তার কারণ এই কাজটা আমি আসার আগেই গঙ্গাপদ করতে পারত। কিন্তু করেনি।
আপনি কী বলতে চাইছেন?
আপনি কি লক্ষ করেছেন গবেষণাঘরের ওঠার সিঁড়ির-জানলার কাচ এখনও ভাঙা। ডক্টর বলেছিলেন মিস্ত্রি ডেকে এনে ওটা সারিয়ে নেবেন। কিন্তু সেটা করার সময় পাননি। ওই পথ দিয়ে আগেরবার ওরাং ওটাং ঢুকেছিল। তাই জায়গাটা ওর জানা, আজও সেই পথে সে ঢুকতে পারে।
সে ঢুকলে কুকুরদুটো নিশ্চয়ই পাথর হয়ে থাকত না।
কুকুরদুটোকে অজ্ঞান করে ফেলার মতো কোনও খাদ্যবস্তু যদি প্রাণীটি। নিয়ে আসে তা হলে তো তার ভয়ের কিছু নেই। সার আর মেয় দিশি কুকুর। খাবার দেখেও নিলোভ থাকার কোনও শিক্ষা ওদের নেই। তারপর একটি ট্রেন্ড ওরাং ওটাং-এর পক্ষে সদর অথবা খিড়কির দরজা খুলে দেওয়া অসম্ভব ব্যাপার নয়।
অর্জুনের কথাগুলো শুনে অবনীবাবু ফোনের দিকে এগোচ্ছিলেন, কিন্তু অর্জুন তাঁকে জানিয়ে দিল সে দেখে গেছে টেলিফোন মৃত। অবনীবাবু তবু রিসিভার তুললেন এবং বেশ বিরক্ত হয়ে বললেন, চমৎকার!
ওপাশে বন্ধ ঘরে মেয় ক্রমাগত চিৎকার করে যাচ্ছিল। অর্জুন বলল, একথা নিশ্চয়ই স্পষ্ট, যারা কিডন্যাপ করেছে তারাই ডক্টর পত্ৰনবীশকে আর্থিক সাহায্য দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। উনি রাজি না হওয়াতে এটা করা ছাড়া ওদের অন্য পথ ছিল না।
অবনীবাবু বললেন, আশ্চর্য! আপনি এমন গলায় কথা বলছেন যেন ওদের ওপর আপনার প্রচুর সহানুভূতি আছে!
আপনি আবার আমাকে ভুল বুঝছেন। ডক্টর পত্ৰনবীশকে যারা নিয়ে গিয়েছে তারা নিশ্চয়ই এখনই খুন করবে বলে নিয়ে যায়নি। তাই ওদের অবস্থানের কথা জানতে হলে ওদের মতো করেই ভাবা উচিত, তাই না? অর্জুন বলল।
বেশ। আপনি ভেবে কিছু বের করতে পারলেন?
ভাবনা বেশ কিছু সম্ভাবনা সামনে এনে দেয়। সেগুলোর কোনওটাই হয়তো ঠিক নয়। তবু! যেমন ধরুন, যারা অপহরণ করেছে তারা ডক্টর পত্ৰনবীশের গবেষণা সম্পর্কে রীতিমতো ইন্টারেস্টেড। অর্থাৎ ওই গবেষণা সাফল্য পেলে তারা শব্দকে কাজে লাগাবে।
আপাতভাবে তাই মনে হচ্ছে।
কারা শব্দকে কী কাজে লাগাতে পারে?
ডক্টর চেয়েছিলেন মানুষের শরীরের অনেক অসুখ শব্দের অনুরণনে নির্মূল করতে। এ ছাড়া প্রাকৃতিক অবরোধ বা ওই জাতীয় কিছুর ব্যাপারে শব্দকে প্রয়োগ করে মানুষের উপকার করতে চেয়েছিলেন তিনি। অবনীবাবু বললেন, আমার অবশ্য শুনে কখনওই বিশ্বাস হয়নি কিন্তু উনি এত সিরিয়াস ছিলেন যে, চুপচাপ শুনে যেতাম।
কিন্তু যারা অপহরণ করেছে তারা যে বিশ্বাস করেছে সেটা বোঝাই যাচ্ছে। তারা শব্দকে কাজে লাগাতে চায়। নিশ্চয়ই কোনও সাধারণ মানুষ তা চাইবে না। এমনকী যারা কাজটা করেছে, তারাও নয়। তাদের পাঠিয়েছে যারা, তারা রয়েছে আড়ালে এবং সেই আড়ালটা ভারতবর্ষে নয়।
তার মানে আপনি বলতে চাইছেন বিদেশিরা ইনভল্ভড়?
এ-সবই আমার অনুমান। মানুষের কল্যাণের জন্যে যদি ডক্টর পত্ৰনবীশের আবিষ্কারকে তারা কাজে লাগাতে চাইত তা হলে টাকার লোভ দেখিয়ে না পেরে গায়ের জোর প্রয়োগ করত না। ওরা অন্য কিছু করতে চায়। আর সেটা একাধিক মানুষের বাসনা, কোনও একজনের নয় বলেই আমার মনে হয়।
ঠিক আছে। এগুলোকে ধরে নিলাম বাস্তবসম্মত ভাবনা। কিন্তু ডক্টর পত্ৰনবীশকে কারা কোথায় নিয়ে গিয়েছে তার কোনও ক্রু পাচ্ছি না আমরা।
চলুন, আর-একবার বাড়িটাকে ভাল করে খোঁজা যাক।
বাড়ির সমস্ত আলো জ্বালিয়ে খোঁজাখুঁজি আরম্ভ হল। দোতলায় ওঠার সিঁড়ির মুখেই আধখাওয়া মাংস দেখতে পেল একজন সেপাই। মাংসগুলো প্লাস্টিক প্যাকেটে আনা হয়েছিল। আর এগুলো খেয়েই সার এবং মেয় অজ্ঞান হয়ে যায়। প্যাকেটের গায়ে কোনও ছাপ নেই। অবনীবাবুর নির্দেশে ওগুলো আলাদা সরিয়ে রাখা হল পরীক্ষার জন্যে।
দোতলা বা গবেষণাঘরের সিঁড়িতে কিছুই পাওয়া গেল না।
গবেষণাঘরের দরজায় পৌঁছে অর্জুন বলল, মনে হয় ডক্টর পত্ৰনবীশ বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। ভয় দেখিয়ে ওঁকে আত্মসমর্পণ করাতে পারেনি আততায়ীরা। জিনিসপত্র লণ্ডভণ্ড হয়ে থাকা সেটাই প্রমাণ করছে।
ঘরটি খোঁজা হল। অবনীবাবু একটি বোতাম পেলেন। সাদা বোতাম। সুন্দর। বললেন, এরকম বোতাম নিউ মার্কেটে পাওয়া যায়।
তার মানে টানাহ্যাচড়া হয়েছিল। এই দেখুন, এই ঘড়িটাকে পেলাম এখানে।
পকেট থেকে ঘড়ি বের করে রেখেছিল অর্জুন। প্রথমবার যখন সে ওটাকে কুড়িয়ে নিয়েছিল তখন ভেবেছিল অবনীবাবুকে তখনই বলে লাভ নেই। কিন্তু এই ভদ্রলোকের সাহায্য ছাড়া এখানে তার পক্ষে এগনো মুশকিল।
অবনীবাবু ঘড়িটাকে নিলেন, নাইলনের ব্যান্ড বলেই ছিঁড়ে গেছে। এটা কি ডক্টর পত্ৰনবীশের ঘড়ি? আমি কোনওদিন অবশ্য ভদ্রলোককে ঘড়ি পরতে দেখিনি।
ঘড়িটা বিদেশি?
হ্যাঁ। কিন্তু সুইজারল্যান্ডের তৈরি নয়, ফ্রান্সের। ফ্রান্সে ঘড়ি তৈরি হয় বলে কখনও শুনিনি। হয়তো হয়। হয়তো কেন, হয়েছে বলেই এখানে লেখা রয়েছে। কিন্তু ফ্রান্সের ঘড়ি ডক্টর কী করে পাবেন? হতে পারে, উনি তো কিছুদিন আগে বিলেতে গিয়েছিলেন। সেখানে কেউ উপহার হিসেবে এটা দিতে পারে।
অর্জুন ঘড়িটাকে আবার হাতে নিল। সাধারণ ঘড়ি নয়। দুপাশে অনেক চাবি রয়েছে। তলার দিকে আলাদা কাচের খুপরিতে নাম্বার লেখা। ঘড়ির পেছনে ছোট্ট করে লেখা, টেডি।
সঙ্গে সঙ্গে প্রায় লাফিয়ে উঠেছিল অর্জুন। মুখ থেকে বেরিয়ে এল, আরে!
কী হল? অবাক হয়ে তাকালেন অবনীবাবু।
এটা টেডির ঘড়ি! চিৎকার করে উঠল অর্জন।
টেডি কে?
জানি না। তবে নামটা আমি দেখেছি।
দুর মশাই। এমন করে চেঁচালেন! টেডি বিয়ার শোনেননি? যাক গে, ওই ঘড়ি আর বোতাম ছাড়া আর কিছুই পাওয়া গেল না। কোনও বড় গোয়েন্দা হলে এই কু থেকে বিশাল ব্যাপার ঘটিয়ে দিতে পারতেন। এখন আমরা সেটা পারছি না। আপাতত বাড়িটাকে সিল করে আমরা চলে যেতে পারতাম। কিন্তু প্রবলেম হল ওই কুকুরদুটো। এইজন্য আমি কোনও জীবজন্তু পুষতে চাই না। বাড়ি বন্ধ করে ইচ্ছেমতো কোথাও যাওয়া যায় না।
আপনার কি এখনও আমাকে থানায় নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে আছে?
না থাকলে?
তা হলে আমি এ বাড়িতে থাকতে পারতাম। কুকুরদুটো আমাকে চিনে গেছে।
এমনিতে ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু আপনার অতীতের কথা মনে করে–। নীচে নামতে লাগলেন অবনীবাবু। অর্জুন পা বাড়িয়েও থমকে গেল। ভাঙা কাচ, যেখান দিয়ে প্রথমদিন ওরাং ওটাং ঢুকেছিল, যেটা সারানো হয়নি, সেটার গায়ে কিছু লেগে আছে। এখন প্রায় কালচে হয়ে যাওয়া দাগটা যে রক্তের তা বুঝতে অসুবিধে হল না তার। যদি ওরাং ওটাং আবার ওই পথ দিয়ে ঢুকে থাকে তা হলে নিশ্চয়ই আহত হয়েছিল। আহত অবস্থায় জন্তুটা ঠাণ্ডা মাথায় কুকুরদুটোকে খাবার দিয়েছে, দরজা খুলে দিয়েছে?
গঙ্গাপদ জ্ঞান ফিরলেই অর্জুনকে খবর দেওয়া হবে, এই আশ্বাস দিয়ে অবনীবাবু চলে গেলেন। বলে গেলেন, আপনি কোনও অবস্থাতেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোথাও যাবেন না। পুলিশ ছাড়া অন্য কেউ এলে দরজা খুলবেন না।
অর্থাৎ গৃহবন্দি হয়ে থাকুন। বাইরের দরজা বন্ধ করে আলো না নিভিয়ে অর্জুন কুকুরদুটোকে ছেড়ে দিল। তীরের মতো তেড়ে গেল তারা অদৃশ্য শত্রুর উদ্দেশ্যে। দোতলায় নিজের ঘরে এল সে। বড্ড কাহিল লাগছে এখন। আর কয়েক ঘণ্টা বাদে ভোর হয়ে যাবে। জামাপ্যান্ট না খুলেই বিছানায় শুয়ে পড়ল সে। সাধারণত বেশি রাত জাগলে তার ঘুম আসতে চায় না। কিন্তু আজ উলটোটা হল।
গভীর ঘুমের মধ্যে কেউ যেন ডাকছে। অর্জুন যেন সমুদ্রের নীচ থেকে পরিয়ে দেওয়া হত? কই কিন্তু এই ঘড়ির মধ্যে কিছু মনে করিয়ে ভুল করে ওপরে উঠে এল। এবং তখনই তার কানে ডাকটা স্পষ্ট হল, টেডি, টেডি, টেডি! এর সঙ্গে-সঙ্গে পকেটঘেঁষা পায়ের ওপর অস্বস্তি। সে কি স্বপ্ন দেখছে? টেডির স্বপ্ন? কিন্তু গলার স্বর স্পষ্ট আর সেটা আসছে নীচের দিক থেকে। এবং তখনই সে অস্বস্তিটাকে আবার টের পেল। ঝট করে পকেটে হাত ঢোকাতে ঘড়িটাকে পেতেই হাতে কুটুস করে কিছু ধাক্কা দিয়ে আবার সরে গেল।
উঠে বসল অর্জুন। তড়িঘড়ি পকেটে হাত ঢোকাতে ঘড়িটা বেরিয়ে এল। শব্দটা ভেসে আসছে ঘড়ি থেকেই। সেইসঙ্গে ডানদিকের চাবিগুলোর পাশ থেকে একটা সরু সুচের মতো জিনিস বেরুচ্ছে আর ঢুকে যাচ্ছে ঘড়ির মধ্যে। অর্জুন ঘড়িটাকে হাতের ওপর রাখতেই সুচের জন্যে চিনচিনে অনুভূতি এল। এবং তারপরই থেমে গেল শব্দটা, সুচটাও ভেতরে ঢুকে স্থির হয়ে গেল।
ঘড়িটাকে চোখের সামনে নিয়ে এল অর্জুন। এবং তখনই দেখতে পেল নাইলনের ব্যান্ড এবং মেটাল ঘড়ির মাঝখানের ফাঁকে কয়েকটা বাদামি লোম আটকে আছে। লোমগুলোকে টেনে বের করতেই সে উত্তেজিত হল। তা হলে টেডি কি ওই ওরাং ওটাংয়ের নাম? আর এই ঘড়ি ওরাং ওটাংয়ের হাতে পরিয়ে দেওয়া হত? কীভাবে ঘড়িটা ওরাং ওটাংয়ের হাত থেকে পড়ে গিয়েছে তা কেউ বলতে পারবে না। কিন্তু এই ঘড়ির মধ্যে নিশ্চয়ই অনেক সঙ্কেত ঢোকানো আছে। সুচ ফোটানো এবং নাম ধরে ডেকে ওকে কিছু মনে করিয়ে দেওয়া হত।
অর্জুন দৌড়ে ফোনের কাছে পৌঁছে থেমে গেল। ফোন তো মৃত। সময় এখন খুবই মূল্যবান। টেলিফোনের তার বাইরে থেকে কাটা হয়েছে। কিন্তু সেই জায়গাটা এই রাত্রে খুঁজে বের করা অসম্ভব! এই সময় একটা মোটরবাইকের আওয়াজ কানে আসতেই অর্জুন দৌড়ে জানলার কাছে গেল। হেলেমেটে ঢাকা মাথা নিয়ে সেই আরোহীকে এক ঝলকের জন্যে দেখতে পেল অর্জুন। তারপরই এঞ্জিনের আওয়াজ থেমে গেল। লোকটা এই বাড়িতেই এসেছে। মেয় এবং সারকে ছেড়ে দেওয়ায় ওরা এখন ঝিমোচ্ছে। মেয় আর চিৎকার করছে না। আততায়ীরা খাবারে বিষ মিশিয়ে দিতে পারত। তা না করে ওদের অজ্ঞান করে দিয়েছিল ওষুধ দিয়ে। বোঝাই যাচ্ছে খামোখা প্রাণিহত্যা ওদের পছন্দ নয়।
অর্জুন নীচে নেমে এল। দরজা খোলার আগেই টেলিফোন হঠাৎ জোরে বাজতে আরম্ভ করল। ভৌতিক ব্যাপার। তারপরই মোটরবাইকের আওয়াজ উঠল এবং দ্রুত মিলিয়ে গেল। তা হলে ওদের কেউ এসে টেলিফোনের লাইন জুড়ে দিয়ে গেল নাকি? ওরকম একটা ঘটনা ঘটিয়ে আবার যারা অকুস্থলে ফিরে আসে তাদের ক্ষমতা উপেক্ষার নয়! অর্জুন টেলিফোন ধরল। হ্যালো বলতেই চাপা গলায় কেউ বলল, প্লিজ হোল্ড অন। তার কয়েক সেকেন্ড বাদে ডক্টর পত্ৰনবীশের গলা শুনতে পেল অর্জুন, হ্যালো? কে? গঙ্গাপদ?
অর্জুন উত্তেজিত গলায় বলল, ডক্টর পত্ৰনবীশ। আমি অর্জুন বলছি। আপনি কোথায়? তাড়াতাড়ি বলুন, আপনি কোথায়?
এসব প্রশ্নের ধার দিয়ে গেলেন না ভক্টর। অদ্ভুত স্বরে বললেন, আমার দোতলার ঘরের সিন্দুকটা খুলতে হবে। চাবি আছে আমার মা বাবার ছবির ফ্রেমের পেছনে। সিন্দুক খুললে একটা ফাইল পাবে। কাউকে কিছু না বলে ওটা নিয়ে চলে এসো।
কোথায়? অর্জুন জিজ্ঞেস করল। পাঁচ-সাত সেকেন্ড চুপচাপ থেকে ডক্টর পত্ৰনবীশ বললেন, সুইমিং পুলের স্টপেজে। পনেরো মিনিটের মধ্যে। কিন্তু পুলিশ যেন জানতে না পারে। আঃ!
কী হল? আপনি কোত্থেকে কথা বলছেন? হ্যালো, হ্যালো!
লাইনটা কেটে গেল। ডক্টর পত্ৰনবীশ কথা বললেও তাঁকে কেউ বলতে বাধ্য করেছে বলে মনে হল অর্জুরে। স্বেচ্ছায় কেউ তার সারাজীবনের গবেষণাসংক্রান্ত কাগজ শত্রুপক্ষের হাতে তুলে দেয় না। এখন কী করা যায়?
অর্জুন ডক্টর পত্ৰনবীশের শোয়ার ঘরে ঢুকে আলো জ্বালল। ঘরের পশ্চিমদিকের দেওয়ালে মধ্যবয়সের দুজন পুরুষ এবং মহিলার ছবি বাঁধানো রয়েছে। এঁরা নিশ্চয়ই ডক্টর পত্রনবীশের বাবা এবং মা। অর্জুন ছবিটা নীচে নামাতেই পেছনদিকের খাঁজে একটা বড় লোহার চাবি দেখতে পেল। চাবিটি অভিনব। অনেক ঘাট আছে এবং বেশ ভারী।
চাবিটা নিয়ে ছবি যথাস্থানে রেখে অর্জুন ঘরের কোণে রাখা সিন্দুকের দিকে এগিয়ে গেল। তারপর কী ভেবে দাঁড়িয়ে পড়ল। না। সে সিন্দুক খুলবে না। কণ্ঠস্বর ডক্টর পত্ৰনবীশের হলেও নয়। খুলতে হলে তিনি নিজে এসে খুলুন। চাবিটা কোথায় রাখা যায় ভাবতে-ভাবতে নীচে নামতেই সার এবং মেয়কে দেখতে পেল। প্রাথমিক উত্তেজনা চলে যাওয়ার পর ওরা এখনও ওষুধের প্রতিক্রিয়া থেকে মুক্ত হয়নি। মেয় শুয়ে-শুয়ে একবার চোখ খুলল মাত্র, সার তবু উঠে বসল। অর্জুন কুকুরটার গলায় হাত বুলিয়ে আদর করতে যেতেই বকসটাকে অনুভব করল। লোমের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে সেটা। সঙ্গে সঙ্গে মতলব মাথায় এল। বকলসের স্ট্র্যাপ খুলে সেটা চাবির গর্তের মধ্যে ঢুকিয়ে আবার সারের গলায় বেঁধে দিল সে। ভারী চাবিটা সামান্য ঝুলে রইল বটে, কিন্তু খুঁটিয়ে না দেখলে কেউ ধরতে পারবে না।
মিনিট কুড়ি বাদে আবার ফোন বাজল। অর্জুন রিসিভার তুলে লো বলতেই সেই আগের ইংরেজি বলা গলা ধমকে উঠল, কী ব্যাপার? আপনি কি চান ডক্টর মারা যাক? পনেরো মিনিট সময় দেওয়া হয়েছিল, আসেননি কেন?
চাবি খুঁজে পাইনি।
মিথ্যে কথা! ডক্টর বলে দিয়েছে কোথায় চাবি আছে।
সেখানে কোনও চাবি নেই।
খবরটা পুলিশকে জানানো হয়েছে?
ডক্টর আমাকে নিষেধ করেছেন সেটা করতে। কিন্তু আপনারা কে? কেন জোর করে ডক্টরকে তুলে নিয়ে গিয়েছেন? এঁর গবেষণার কাগজপত্রে আপনার কী দরকার?
কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ। অর্জুন কয়েকবার হ্যালো বলা সত্ত্বেও সাড়া এল। অথচ লাইন মৃত নয়। তারপর আবার কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ডক্টর ভুল করতে পারেন। ওঁর বাবা-মায়ের ছবি ছাড়া অন্য ছবিগুলোর পেছনে দেখুন। কুইক। লাইন এবার কেটে দেওয়া হল। অর্জুন জানলার বাইরে তাকাল। অন্ধকার হালকা হয়ে আসছে। টেডি নামটা মনে আসামাত্র সে উঠে দাঁড়াল। আর সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। কিন্তু একা ওই বাড়িতে গিয়ে কোনও লাভ হবে না। সে রিসিভার তুলল। গাইড দেখে নাম্বার বের করে ডায়াল করে বুঝল নাম্বার পালটে গেছে। শেষপর্যন্ত লালবাজারকে চাইল সে। অপারেটরকে বলল সল্ট লেক থানার নাম্বার দিতে। ঠিক তখনই বাড়ির সামনে গাড়ির শব্দ হল। রিসিভার রেখে অর্জুন দৌড়ে গেল জানলায়। গাড়ি থেকে অবনীমোহনবাবু নামছেন।
দরজা খুলতে অবনীমোহনবাবু বললেন, হাসপাতাল থেকে আসছি। গঙ্গাপদর সেন্স ফিরে এসেছে। খিড়কির দরজায় আওয়াজ হতে সে বিছানা ছেড়ে ভেতরের বারান্দায় গিয়েছিল দেখতে। হঠাৎ দুটো লোক তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে সে লুটিয়ে পড়ে। তার জ্ঞান চলে যায়।
কিন্তু ওকে পাওয়া গিয়েছে ঘরের ভেতরে, কুকুরদুটোর সঙ্গে।
ঠিক। কিন্তু কীভাবে ও ঘরে গেল তা গঙ্গাপদ জানে না। হয়তো ওদের ঘরের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু মোদ্দা কথা হল গঙ্গাপদর কাছ থেকে কোনও তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না, এমনকী, সে আততায়ীদের বর্ণনা পর্যন্ত দিতে পারছে না।
এর মধ্যে আবার ফোন এসেছিল।
ফোন? লাইন ঠিক হল কী করে?
জানি না। হয়তো ওরাই আবার জুড়ে দিয়ে গিয়েছে। ওরা ডক্টর পত্ৰনবীশকে দিয়ে কথা বলিয়েছিল। গবেষণার কাগজপত্র নিয়ে তিনি আমাকে পনেরো মিনিটের মধ্যে সুইমিং পুলের কাছে যেতে বলেছিলেন। ওঁর গলার স্বর শুনে মনে হয়েছে উনি স্বেচ্ছায় কথাগুলো বলেননি। ওঁকে বাধ্য করা হয়েছিল।
তারপর?
কাগজগুলো আমি খুঁজেই পেলাম না যে নিয়ে যাব।
পেলে নিয়ে যেতেন নাকি?
অর্জুন হেসে ফেলল।
অবনীমোহন বললেন, চলুন, একবার সুইমিং পুলের ওদিকটা ঘুরে আসি। লোকগুলো যদি ওখানে এখনও থাকে–।
অগত্যা দরজা বন্ধ করে অর্জুন অবনীমোহনের গাড়িতে উঠল। সুইমিং পুলের রাস্তায় পৌঁছনো পর্যন্ত কেউ কথা বলেনি। এই প্রায়-ভোর সময়ে রাস্তা কাঁকা। কোথাও কোনও গাড়ি দাঁড়িয়ে নেই। আফসোসে মাথা নাড়লেন অবনীমোহন। অর্জুন বলল, একটা ব্যাপার নিশ্চিত, ডক্টর পত্ৰনবীশ সল্ট লেকেই রয়েছেন।
সল্ট লেকে? কতখানি জায়গা জানেন? কেউ যদি লুকিয়ে থাকতে চায় তা হলে তাকে খুঁজে বের করা অসম্ভব
মনে রাখবেন যারা ডক্টরকে কিডন্যাপ করেছে তারা স্থানীয় বাসিন্দা নয়।
ডক্টর পত্ৰনবীশের মতো মানুষ নিখোঁজ হয়েছেন এই খবরটা চেপে রাখা যাবে না। কাল সকাল হতেই সাংবাদিকরা আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। ওপরওয়ালাদের কাছে কৈফিয়ত দিতে-দিতে—উঃ.। কী করা যায়! ডক্টর যখন তাঁর সন্দেহের কথা বলেছিলেন তখনই যদি ওঁর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতাম! অবনীমোহন আফসোস করছিলেন।
অর্জুন বলল, গাড়িটা চালু করুন।
বাড়ি যাবেন?
না। সোজা চলুন।
গাড়ি চালু করে অবনীমোহন জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাচ্ছি আমরা?
একটা ঝুঁকি নিতে চাই। হ্যাঁ, ওই মোড়ে গাড়ি থামান। আপনার সেপাইদের বলুন এখানেই অপেক্ষা করতে। গাড়ি থামানোমাত্র অর্জুন নেমে পড়ল।
হাঁটতে-হাঁটতে অবনীমোহনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, যাচ্ছেন কোথায়?
ঠিক তখনই অর্জুনের পকেটে রাখা ঘড়ি থেকে শব্দ বের হল, টেডি, টেডি, টেডি! অবনীমোহন দাঁড়িয়ে পড়লেন, কী ব্যাপার?
অর্জুন বলল, আমরা টেডির সন্ধানে যাচ্ছি।
টেডি কে?
বোধ হয় ওই ওরাং ওটাংটার নাম।
আপনি জানলেন কী করে?
এখনও স্পষ্ট জানতে পারিনি, অনুমান করছি মাত্র।
আপনার পকেট থেকে শব্দটা আসছিল কী করে?
খুব আধুনিক টেপে শব্দটাকে রেকর্ড করা হয়েছে, যা নির্দিষ্ট সময় অন্তর বেজে যায়। হয়তো ওরাং ওটাংটাকে বারংবার মনে করিয়ে দেয় যে, তার নাম টেডি। যা করতে বলা হয়েছে তাই যেন সে করে। ও যাতে উপেক্ষা না করে তাই শব্দটা যখন বাজে তখন একটা পিন মৃদু চাপ দেয় চামড়ায়। তাতেই বোধ হয় কাজ হচ্ছিল।
কিন্তু এসব হচ্ছে কোথায়?
ঘড়িতে। ঘড়িটা যে ওরাং ওটাংয়ের শরীরে বাঁধা ছিল এব্যাপারে আমি নিশ্চিত। দাঁড়ান, ওই বাড়ি। আঙুল তুলে দেখাল অর্জুন বাড়িটাকে। আজ সন্ধের পর সে যে অবস্থায় বাড়িটাকে দেখে গিয়েছিল এখন সেই অবস্থাতেই আছে বলে মনে হল। নতুন কোনও আলো জ্বলছে না বাড়িতে।
অর্জুন বলল, আপনি সদর দরজায় অপেক্ষা করুন। দশ মিনিট হয়ে গেলেই দরজার বেল টিপবেন। তাতেও যদি দরজা না খোল, ভাঙতে পারেন। অবনীমোহনকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে অর্জুন আগের চেনা পথে দোতলার বারান্দায় উঠে এল। এবং ওঠামাত্র চোখে পড়ল দরজা ইঞ্চি ছয়েক খোলা। অথচ সে যখন বাড়িতে এর আগে ঢুকেছিল তখন দরজা বন্ধ ছিল, সে যখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল তখন দরজা বন্ধ দেখেই গিয়েছে।
তার মানে ইতিমধ্যে লোক এসেছে। সে সন্তর্পণে দরজার কাছে গিয়ে কান পেতে কিছু শুনতে চাইল। না, কোনও শব্দ নেই। অর্জুন চাপ দিয়ে দরজা সরিয়ে ফাঁকটাকে বাড়াল। কোনও প্রতিক্রিয়া নেই। সে চট করে ভেতরে ঢুকে পড়ে দেখল ঘরের মধ্যে ওষুধের গন্ধ ভাসছে। ওষুধটা ডেটল জাতীয় কিছু।
অন্ধকার চোখ সয়ে গেলে অর্জুন জল পড়র আওয়াজ শুনতে পেল। শাওয়ার ছেড়ে স্নান করলে এমন আওয়াজ হয়। অর্জুন টর্চ বের করে সরু আলো ফেলতেই চমকে উঠল। বিছানায় গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে একটা ওরাং ওটাং। শুধু তার চোখ দুটো পিটপিট করছে অর্জুনের দিকে। জন্তুটা তাকে দেখে ভয় পেয়েছে বলে মনে হল না। ওর হাতের অনেকটা জুড়ে ব্যান্ডেজ করা হয়েছে। বোধ হয় সেই যন্ত্রণায় ও কাতর হয়ে আছে। অর্জুন বুঝল তার অনুমান ঠিক। ভাঙা কাচের গর্ত দিয়ে ঢুকতে গিয়ে বেচারার হাত কেটে রক্ত বের হয়েছে। ঠিক তখনই অর্জুনের পকেটে রাখা ঘড়ি আবার বেজে উঠল, টেডি টেডি টেডি।
সঙ্গে-সঙ্গে লাফ দিয়ে উঠে বসল ওরাং ওটাং। অভ্যস্ত পরিচিত ডাক শুনতে পেয়ে বিছানা থেকে নেমে কয়েক পা এগিয়ে এল অর্জুনের দিকে। তারপর জখম না হওয়া হাত বাড়িয়ে মুঠো খুলল।
বাথরুম থেকে গলা ভেসে এল, টেডি, ঘড়িটাকে কোথায় ফেলেছিলে? আমি তোমাকে বলেছি ঘড়িটাকে না খুলতে। তখন থেকে জিজ্ঞেস করছি ঘড়ি কোথায়, অথচ দেখাতে পারোনি। এই বাক্যগুলো ইংরেজিতে উচ্চারিত হচ্ছিল। টেডি সম্ভবত ইংরেজি বোঝে।
অর্জুন পকেট থেকে ঘড়ি বের করে ওরাং ওটাংটাকে দেখাল। প্রাণীটা কুতকুতে চোখে সেটাকে দেখে ছোঁ মেরে নিয়ে নিল হাতে। তারপর জখম না হওয়া হাতে পরার চেষ্টা করল। কিন্তু ওর পক্ষে বকলসের মধ্যে স্ট্র্যাপের মুখ ঢোকানো সম্ভব হচ্ছিল না। তা ছাড়া ছিঁড়ে যাওয়ায় স্ত্রাপটা লাগবে না, এই বুদ্ধি প্রাণীটার নেই। এই সময় বেল বাজল। শব্দটা কানে আসতেই এক লাফ দিয়ে ওরাং ওটাং উঠে গেল বিছানায়। ঘড়ি হাতে নিয়ে শুয়ে পড়ে পিটপিট করতে লাগল। দ্বিতীয়বার বেল বাজামাত্র বাথরুমের দরজা খোলার আওয়াজ হল। অর্জুন দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির ওপর চলে গেল যেটা ছাদে গিয়েছে। লোকটা গজগজ করছিল, এই ভোরবেলায় আবার কে এল? টেডি, চুপচাপ শুয়ে থাকো। আমি ওয়ার্নিং দিলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গাছে চলে যাবে। ও কে? কথাগুলো ইংরেজিতে বলে লোকটি নীচে চলে গেল। অর্জুন লোকটার চেহারা দেখতে পায়নি। সে দ্রুত ঘরে ঢুকে বারান্দার দরজা বন্ধ করে দিল, যাতে ওরাং ওটাং পালিয়ে গাছে না যেতে পারে। তারপর দ্রুত গাছের ডাল বেয়ে সে নীচে নেমে এল।
ওদিকে ততক্ষণে দরজাটা খোলা হয়েছে। ভারী গলায় প্রশ্ন হল, কী চাই?
অবনীমোহন কিছুই জানেন না
এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, আপনি এই বাড়িতে থাকেন?
কী আশ্চর্য! এবাড়িতে না থাকলে ভোরবেলায় দরজা খুলব কেন? কে আপনি? কী চাই আপনার? খুব বিরক্ত হলেন ভদ্রলোক।
অর্জুন ততক্ষণে এগিয়ে এসেছে। এবার সে ভদ্রলোককে দেখতে পেল। পার্কে দূর্বাঘাস তোলা ভদ্রলোকই ওই বাড়ির দরজায়। সে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনার টেডির সঙ্গে আলাপ করতে চাই।
তার মানে? ভদ্রলোক হকচকিয়ে গেলেন।
আপনি সেদিন পার্ক থেকে দূর্বাঘাস তুলছিলেন অসুস্থ পোষা প্রাণীকে খাইয়ে সুস্থ করবেন বলে। আমার মনে হয় ওই পোষা প্রাণীটার নাম টেডি। তাই না?
দেখুন, এই ভোরবেলায় এভাবে আমাকে বিরক্ত করবেন না। আমার বাড়িতে যে কোনও পোষা প্রাণী নেই তা পাড়ার সবাই জানেন। ইচ্ছে হলে জিজ্ঞেস কতে পারেন। ভদ্রলোকের কথা শেষ হওয়ামাত্র রাস্তার উলটো দিকের বাড়িটার দোতলার জানলা খুলে গেল। গলায় চাদর ঝুলিয়ে কমলাপতিবাবু মুখ বের করলেন, ওহে! তুমি অর্জুন তো? সারারাত ঘুমোও নাকি? গোয়েন্দাদের খুব পরিশ্রম করতে হয় দেখছি। তা ওবাড়িতে কী করছ?
অর্জুন ঘুরে তাকাল, গুড মর্নিং। এঁকে চেনেন?
কমলাপতি বললেন, বিলক্ষণ। তবে সাতসকালে পুলিশকে চিনতে চাইনি। মার্জনা করবেন দারোগামশাই।
দারোগা? আপনারা পুলিশ? লোকটি হকচকিয়ে গেল।
এবার অবনীমোহনবাবু তাঁর ফর্ম ফিরে পেলেন, আপনি ভেতরে চলুন। আপনার বাড়ি সার্চ করব।
সার্চ করবেন? ওয়ারেন্ট এনেছেন?
প্রশ্নটা দোতলার জানলায় কানখাড়া করে রাখা কমলাপতিবাবুর কানে যাওয়ামাত্র তিনি চেঁচিয়ে বললেন, বাড়িটা ডক্টর হালদারের ছিল। উনি মারা যাওয়ায় ওঁর স্ত্রী এখন ওনার। তিনি আমেরিকায় আছেন। ইনি কেয়ারটেকার। কেয়ারটেকার ওয়ারেন্ট দেখতে চাইবে কেন? কোনও এক্তিয়ার নেই।
হঠাৎ ভদ্রলোক নিজের ঘড়িতে চাপ দিতে লাগলেন। সঙ্গে-সঙ্গে ওপরের দরজায় শব্দ হল। কেউ যেন দরজা খোলার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। অর্জুন বলল, আপনার সিগন্যালিং-এ কোনও কাজ হবে না। ব্যালকনির দরজা বন্ধ। ছাদেরটাও। বেচারাকে বেরুতে হলে ওই দরজা দিয়ে বেরুতে হবে।
ওরাং ওটাং এবং তার মালিককে গ্রেফতার করতে বেশি বেগ পেতে হল। লোকটির নাম মন্মথ দত্ত নয়। এই নাম সে ব্যবহার করেছিল ডক্টর পত্ৰনবীশকে বিভ্রান্ত করতে ডক্টর হালদারের মেয়ে যিনি আমেরিকায় থাকেন তাঁকেও বলা হয়েছে ভদ্রলোকের নাম মন্মথ দত্ত। ওখানকার প্রবাসীদের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে ডলারে পেমেন্ট করে এই বাড়ি ভাড়া নিয়েছিল মন্মথ দত্ত ওরফে টিটো বসু। এই ভাড়া দেওয়ার ব্যাপারটা ডক্টর হালদারের স্ত্রী এবং ছেলে জানতেন না। আমেরিকার দুই প্রান্তে ছেলে এবং মেয়ে থাকে। মা এসেছেন ছেলের কাছে।
মন্মথ দত্তের আসল নাম টিটো বসু, তা বের করতে অবনীমোহনকে অনেক কত করতে হয়েছে। এখন দোতলার শোয়ার ঘরে ওরা বসে। ওরাং ওটাংটাকে একটা চেনে আটকে রাখা হয়েছে। টিটো বসু বলল, আমার বিরুদ্ধে আপনাদের অভিযোগ কী তাই এখনও বুঝতে পারছি না। আমি এই ওরাং ওটাংটাকে পুষেছি। এটা কি অপরাধ? ইস্ট বার্লিনের মেয়র আমাকে ওকে পোমার লাইসেন্স দিয়েছেন। আমি সম্পূর্ণ বৈধভাবে ওর মালিক।
ওর পাশপোর্ট আছে?
পাশপোর্ট? পশুপাখিদের পাশপোর্ট লাগে নাকি?
ওকে কীভাবে এ-দেশে নিয়ে এলেন?
আমার সঙ্গে এসেছে। কাস্টমস ইমিগ্রেশন কেউ আপত্তি করেনি।
তারা দেখেছিল ওকে?
না দেখার কোনও কারণ নেই। আমি বোম্বে পোর্টে নেমেছিলাম।
বোম্বে পোর্টে? মানে এয়ারপোর্ট? অর্জুন বিশ্বাস করছিল না।
না। আমি জাহাজে এসেছিলাম মিডল ইস্ট থেকে। নাউ মিস্টার, একটা ওরাং ওটাংকে পোষ মানিয়ে কাছে রাখা যদি এ-দেশে অপরাধ বলে গণ্য হয় তা হলে আমি ওকে নিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি। আমার পাশপোর্ট দেখেছেন, আমি আপনাদের আইনে পড়ছি না।
অবনীমোহন বললেন, কিন্তু বিদেশিরা যদি এ-দেশে অপরাধ করে তা হলে তার বিচার এ-দেশের আইনেই হয়ে থাকে।
আমি কী অন্যায় করেছি?
আপনার ওরাং ওটাং করেছে। বেশ কয়েকটা চুরির অভিযোগ আছে ওর বিরুদ্ধে। ওর জ্বালায় দোকানদাররা তটস্থ। শেষ ক্রাইম করেছে ও গত রাত্রে।
গত রাত্রে?
অর্জুন হাসল, বেচারার হাতের ব্যান্ডেজ তার প্রমাণ। ডক্টর পত্ৰনবীশের বাড়িতে ঢুকে দরজা খুলে দিয়ে কিডন্যাপ করতে সাহায্য করেছে ও।
বাঃ! এর কোনও প্রমাণ আছে?
নিশ্চয়ই। ওর রক্ত এখনও উক্টর পত্ৰনবীশের বাড়ির ভাঙা কাচে লেগে আছে। অর্জুন এগিয়ে এল সামনে, ডক্টর পত্ৰনবীশকে কোথায় রেখেছেন?
কী আশ্চর্য! কার কথা বলছেন আপনি? তাঁকে তো আমি চিনিই না।
মিথ্যে কথা বলছেন আপনি।
কোনও প্রমাণ করতে পারবেন না।
অর্জুন টেবিলের ওপর তাকাল। টিটো বসুর পকেটে যা-যা ছিল সব বের করে ওখানে জড়ো করে রাখা হয়েছে। এমনকী লোকটার পাশপোর্টও। সে হাত বাড়িয়ে ছোট্ট রিমোট তুলল। গেট থেকে এটা টিপেই সে ওরাং ওটাংকে নির্দেশ দিচ্ছিল পালিয়ে যাওয়ার জন্যে। রিমোট টিপতেই ওরাং ওটাংয়ের হাতে ধরা ঘড়ির রেকর্ড বাজতে লাগল, টেডি, টেডি, টেডি।
তৎক্ষণাৎ প্রাণীটি উঠে দাঁড়িয়ে ব্যালকনির দিকে ছুটে গেল। দরজা বন্ধ দেখে কুঁইকুঁই করতে লাগল। অর্জুন অবনীবাবুকে বলল, চলুন, ওঁকে নিয়ে একটু মর্নিং ওয়াক করে আসা যাক। বলে সে ঘড়িটাকে ওরাং ওটাংয়ের হাতে ভাল করে বেঁধে দিল। দিয়ে ব্যালকনির দরজা খুলে দিল। তৎক্ষণাৎ প্রাণীটি দরজা দিয়ে বেরিয়ে দেবদারু গাছে উঠে বসল। অর্জুন এবং অবনীমোহন বাধ্য করল টিটো বসুকে নীচে নামতে। গাড়ি রয়েছে মোড়ের মাথায়। ওরা রাস্তায় নামামাত্র কমলাপতিবাবু বেরিয়ে এলেন দরজা খুলে, ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। আমি এইমাত্র একটা হনুমান জাতীয় প্রাণীকে ও বাড়ির ব্যালকনি থেকে বেরিয়ে আসতে দেখলাম। স্ট্রেঞ্জ!
অর্জুন আঙুল তুলে দেবদারু গাছ দেখাল, ওই দেখুন তাকে। খুব ভাল এবং অনুগত ভৃত্য। মালিককে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
ওদের দেখে অবনীমোহনবাবুর ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে চলে এল সামনে। অর্জুন বলল, উঠুন। আমাদের পূর্বপুরুষকে অনুসরণ করা যাক।
টিটো বসু আপত্তি করলেন, কী বলতে চাইছেন আপনি? আমার পক্ষে কোথাও যাওয়া অসম্ভব। যদি আমাকে অ্যারেস্ট করতে চান, স্বচ্ছন্দে সেটা করে থানায় নিয়ে চলুন। আমি অন্য কোথাও যাব না।
অবনীমোহন এবার দাঁতে দাঁত রাখলেন, আপনি যদি কথা না শোনেন তা হলে এমন ব্যবস্থা নেব যে, জীবনে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবেন না। উঠুন বলছি, এই, একে গাড়িতে তোলো। বলামাত্র দুজন সেপাই ওকে জোর করে গাড়িতে তুলে নিল। ড্রাইভারের পাশে অবনীমোহন এবং ধারে বসল অর্জুন। তখন ভোরের আলো ফুটে গেছে। গাছগুলো শান্ত। ওর কোনটায় ওরাং ওটাং আছে, বোঝা যাচ্ছে না। অর্জুন রিমোট টিপল। সঙ্গে সঙ্গে খানিকটা তফাতের একটা গাছের ডাল নড়ে উঠল আচমকা। তারপর এ-ডাল থেকে ও-ডালে লাফিয়ে যেতে দেখা গেল ওরাং ওটাটাকে।
অবনীমোহনবাবুর ড্রাইভারকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যতটা সম্ভব শ্লথগতিতে গাড়ি চালাতে, যাতে ওরাং ওটাংয়ের পেছনে থাকা যায়। মাঝে-মাঝেই প্রাণীটি থেমে যাচ্ছে এবং তথন রিমোট টিপতে হচ্ছে অর্জুনকে।
যে পথ পাঁচ মিনিটে যাওয়া বেত সেটা পার হতে সময় লাগল কুড়ি মিনিট। যেখানে গাছ নেই সেখানেই মুশকিল হয়েছে। আড়াল থেকে নামতে চায়নি প্রাণীটা সহজে। ক্রমাগত রিমোট টিপে রেকর্ড বাজিয়ে বিরক্ত করে তবে কাজ হয়েছে।
অবনীমোহনবাবু বললেন, আমরা যে উদয়াচলে চলে এসেছি।
উদয়াচল?
টুরিস্ট বাংলো।
অর্জুন গাড়ি থামাতে বলল। তারপর অবনীমোহনকে নীচে নামতে বলে খানিকটা তফাতে গিয়ে দাঁড়াল। অবনীমোহন কাছে এলে সে বলল, আমার বিশ্বাস, এই টুরিস্ট লজেই ডক্টর পত্ৰনবীশকে রাখা হয়েছে। ওই যে সামনে যে গাড়িটা পার্ক করা রয়েছে ওটাকেই কাল রাতে আমি দেখেছি। আপনি আরও পুলিশ আনান, ওরা অ্যাটাক করতে পারে।
কথা বলতে বলতে অর্জুন দেখল ওরাং ওটাংটা গাছ থেকে নেমে টুরিস্ট লজের বারান্দায় উঠে পড়ল। এবং চোখের আড়ালে চলে গেল। অর্জুন সঙ্গে-সঙ্গে দৌড়ল। অবনীমোহনবাবু দ্রুত টিটো বসুকে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে গাড়ির সঙ্গে আটকে সেপাই দুটোকে সঙ্গে নিয়ে অনুসরণ করলেন অর্জুনকে। টুরিস্ট লজের অফিস তখন বন্ধ, লোকজন ঘুম থেকে ওঠেনি। ওরা দোতলায় উঠে দেখল কোণের দিকের একটা ঘরের দরজা খোলা। সেই খোলা দরজা দিয়ে একটা লোক সন্তর্পণে বেরিয়ে আড়াল থেকে নীচে দাঁড়ানো পুলিশের গাড়ি দেখল। তারপরই ঢুকে গেল ভেতরে। অবনীমোহন ইশারায় জানতে চাইলেন এগোবেন কি না। অর্জুন ইশারায় অপেক্ষা করতে বলল। ওই লোকটাকে বিদেশি বলে মনে হয়েছে তার। তখনই ওরাং ওটাংটা বেরিয়ে এল। ওর ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল ভাল করে হাঁটতে পারছে না। কিছু একটা বেঁধে দেওয়া হয়েছে ওর বুকে। বারান্দায় এসে দাঁড়াতে ভেতর থেকে কেউ বোধ হয় ওকে কিছু কুম করল। ওরাং ওটাং নীচে নেমে গাড়ির দিকে এগোতে লাগল। এইবার লোকটার গলা পাওয়া গেল, কুইক, টেডি কুইক।
সঙ্গে-সঙ্গে দৌড়তে লাগল প্রাণীটা। গাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ামাত্র প্রচণ্ড আওয়াজে চারধার কেঁপে উঠল। বিস্ফোরণে গাড়িটার অনেকখানি উঠে। গেল। দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠল গাড়িতে। অবনীমোহন চিৎকার করে উঠলেন, মাই গড!
সঙ্গে-সঙ্গে দুজন লোক কোণের ঘর থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে পড়ল। নীচে দাঁড়ানো দ্বিতীয় গাড়িটার দিকে তারা ছুটে যেতেই অর্জুন চিৎকার করল, হল্ট!
অবনীমোহন তখন তাঁর রিভলভার বের করেছেন। লোক দুটো একটু ইতস্তত করতে ওঁরা এগিয়ে গেলেন সামনে। এবার লোক দুটো আবার দৌড়ল গাড়ির ভেতর ঢোকার জন্যে। অবনীমোহন এবার গুলি চালালেন। একটা লোক পড়ে গেল মাটিতে। দ্বিতীয়জন গাড়িতে উঠে এঞ্জিন চালু করে বিদ্যুদ্বেগে গাড়িটি ঘোরাতে অবনীমোহনবাবু চাকায় গুলি করলেন। সঙ্গে সঙ্গে ফেটে গেল, চাকা। আর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাড়িটা গিয়ে ধাক্কা মারল জ্বলন্ত গাড়িতে। একটা আর্তনাদ কয়েক মুহূর্তের জন্যে শোনা গেল।
ডক্টর পত্ৰনবীশকে চেয়ারে বেঁধে রাখা হয়েছিল। অর্জুন ঘরে ঢুকে তাঁকে বাঁধনমুক্ত করতেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, বাইরে কী হয়েছে?
অপরাধীরা নিজেদের শাস্তি নিজেরাই ডেকে এনেছে। আর কোনও ভয় নেই।
কার্ল? কার্ল কোথায়?
কার্ল? মানে সেই জার্মান বৈজ্ঞানিক?
হ্যাঁ। কালই এই প্ল্যানটা করেছিল।
ডক্টরকে নিয়ে বাইরে এল অর্জুন। আহত লোকটি বিদেশি কিন্তু সে কার্ল নয়। কার্ল গাড়ি নিয়ে পালাতে চেয়েছিল। কিন্তু এখন তার শরীর পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে। সেইসঙ্গে আরও দুটো পোড়া মৃতদেহ পাওয়া গেল। টিটো বসু ও ওরাং ওটাংটার। ডক্টরের কাছে শোনা গেল কার্ল ওই ওরাং ওটাংটার বুকে টাইম বোম বেঁধে পাঠিয়েছিল অর্জুনদের উড়িয়ে দিতে।
সেই সকালে ডক্টর পত্ৰনবীশের বাড়িতে বসে তাঁর মুখে সমস্ত ঘটনা শুনছিলেন পুলিশের বড়কর্তারা। এরকম একটা ঘটনার সমাধান অর্জুনের সাহায্য ছাড়া সম্ভব ছিল না, ডক্টর পত্ৰনবীশ বারংবার বলেও যেন তৃপ্তি পাচ্ছিলেন না। সার এবং মেয় তাঁর দুপাশে বসে ছিল। তাদের গলায় হাত বোলাতে-বোলাতে ডক্টর চমকে উঠলেন, এটা কী? এ তো লকারের চাবি।
হ্যাঁ। বিশ্বস্ত জায়গায় রেখে দিয়েছিলাম। আপনার সব কাগজ সুরক্ষিত আছে।
আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ অর্জুন।
না। কৃতজ্ঞতা যদি জানাতে হয় তা হলে জানানো উচিত ওই অবলা প্রাণীকে, যে নিজের জীবন দিয়েছে আদেশ পালন করতে। যে পথ না দেখালে আমরা উদয়াচলে পৌঁছতে পারতাম না। তার বদলে মানুষের খামখেয়ালির শিকার হয়েছে বেচারা!