লজ্জা (Lojja) : 08
বিরূপাক্ষ সুরঞ্জনের পার্টির ছেলে। নতুন ঢুকেছে। বেশ মেধাবী ছেলে। সুরঞ্জন তখনও বিছনা ছাড়েনি, বিরূপাক্ষ ঢোকে।
—দশটা বাজে এখনও ঘুমোচ্ছেন?
–ঘুমোচ্ছি। কই। শুয়ে আছি। কিছুই করার না থাকলে শুয়ে থাকতেই হয়। আমাদের তো আর মসজিদ ভাঙার সাহস নেই। তাই শুয়ে থাকতেই হবে।
–ঠিকই বলেছেন। শত শত মন্দির ভাঙছে ওরা। যদি আমরা একটা চিল ছুঁড়ি কোনও মসজিদে, কী উপায় হবে! চারশ বছরের পুরনো রমনা কালীবাড়িটি পাকিস্তানিরা ধুলোয় মিশিয়ে দিল, কোনও সরকারই তো বলেনি ওটি গড়ে দেবে!
—হাসিনা বার বার বলছেন বাবরি মসজিদ পুনর্নির্মাণের কথা। কিন্তু বাংলাদেশের হিন্দুদের ক্ষতিপূরণের কথা বললেও ভাঙা মন্দির পুনর্নির্মাণের কথা কিন্তু একবারও বলেননি। বাংলাদেশের হিন্দুরা বানের জলে ভেসে আসেনি। তারা এ দেশের নাগরিক। তাদের বেঁচে থাকবার অধিকার, নিজের জীবন, সম্পত্তি, উপাসনালয় রক্ষা করবার অধিকার কারও চেয়ে কম নয়।
–কেবল কি বাবরি মসজিদ ইস্যু নিয়ে ওরা লুটপাট ভাঙচুর করে? বিরানব্বইয়ের একুশে মার্চ ভোরবেলা বাগেরহাটের বিশারিহাটা গ্ৰাম থেকে কলিন্দ্রনাথ হালদারের মেয়ে পুতুল রানীকে ওই এলাকারই মোখলেসুর রহমান আর চাঁদ মিয়া তালুকদার কিডন্যাপ করেছে। পটুয়াখালির বগা ইউনিয়নের ইউ পি চেয়ারম্যান ইউনুস মিয়া আর ইউ পি সদস্য নবী আলি মৃধার অত্যাচারে গ্রামের মণি আর কানাই লালের পরিবার দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। রাজনগর গ্রামের বীরেনের জমি দখল করার জন্য বীরেনকে ধরে নিয়ে যায়, আজও বীরেনের কোনও খবর পাওয়া যায়নি। সুধীরের জায়গা জমি দখল করার জন্য অত্যাচার চালালে সুধীরও দেশ ত্যাগ করে। সাবুপুরা গ্রামের চন্দন শীলকে চেয়ারম্যান নিজেই ধরে নিয়ে যায়। আজও তার কোনও খোঁজ নেই। বামনকাঠি গ্রামের দীনেশের কাছ থেকে জোর করে সাদা স্ট্যাম্পে সই নিয়েছে। বগা গ্রামের চিত্তরঞ্জন চক্রবতীর ক্ষেতের ধান কেটে নিয়ে যায়। চিত্তবাবু মামলা করলে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য চাপ দেয়। এমনকি মেরে ফেলার হুমকিও দিচ্ছে।
সুরঞ্জন সিগারেট ধরায়। বিরূপক্ষের আলোচনায় সে অংশ নিতে চায় না। তবু সে লক্ষ করে অল্প অল্প জড়িয়ে যাচ্ছে ঘটনায়। সিগারেট ঠোঁটে চেপে সে বলে-পিয়লা এপ্রিল স্বপন চন্দ্ৰ ঘোষের নিউ জলখাবারে সাত-আটজন লোক পিস্তল দেখিয়ে দশ হাজার টাকা চাঁদা চায়। চাঁদা না পেয়ে দোকানের কর্মচারীদের পেটাতে শুরু করে। পিটিয়ে ক্যাশ ভেঙে বিশ হাজার টাকা নিয়ে যায়। অবশ্য এসব ঘটনা মুসলমানদের দোকানেও ঘটছে। চাঁদাবাজাদের অত্যাচার দিন দিন বাড়ছে। তারপর ধর সিদ্দিক বাজারের মানিক লাল থুপীর নিজস্ব সম্পত্তির অর্ধেক অংশ এলাকার সাহাবুদ্দিন, সিরাজ, পারভেজ, সালাউদ্দিন এরা জোর করে দখল করে নিয়েছে। এখন তারা মানিক লালের পুরো সম্পত্তি নিয়ে নেবার চেষ্টা চালাচ্ছে।
সুরঞ্জন কিছুক্ষণ থেমে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে—ধান কেটে নেওয়া, মেয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া, রেপ করা, জমি দখল, মেরে ফেলার হুমকি, পিটিয়ে বাড়ি ছাড়া করা, দেশ ছাড়া করা এসব কি আর এদিক সেদিক উদাহরণ দিয়ে হবে! এ তো সারা দেশ জুড়ে হচ্ছে। আমরা আর কটা অত্যাচারের খবর রাখি, দেশত্যাগের খবর আর কটা রাখি, বল।
—নোয়াখালির সেনাবাগে কৃষ্ণলাল দাসের বউ স্বর্ণবালা দাসকে আবুল কালাম মুলি, আবুল কাশেম সহ কয়েকজন কিডন্যাপ করে, রেপ করে, তারপর অজ্ঞান অবস্থায় বাড়ির পাশের ধানক্ষেতে ফেলে রেখে যায়। বিরূপাক্ষ বলে।
সুরঞ্জন বিছানা ছেড়ে কালতলায় যায়। মুখ ধুতে গিয়ে কিরণময়ীকে দুটো চায়ের কথা বলে। কাল রাতে কিরণময়ীর হাতে সে দু হাজার টাকা দিয়েছে। সুতরাং ছেলে যে একেবারই দায়িত্বজ্ঞানহীন এ কথা নিশ্চয়ই বলবেন না। তিনি। কিরণময়ীকে অন্য দিনের তুলনায় ফ্রেশ লাগছে। সম্ভবত অর্থনৈতিক দুশ্চিন্তা ঘুচেছে বলে। বিরূপাক্ষ শুকনো মুখে চেয়ারে বসেছিল। সুরঞ্জন ঘুরে ঢুকেই বলে–চিয়ার আপ, চিয়ার আপ।
বিরূপাক্ষ ম্লান হাসে। সুরঞ্জনেরও আজ অনেকটা তাজা লাগছে হাত পা। সুধাময়ের ঘরে একবার টু দিয়ে আসবার কথা ভাবে সে। এর মধ্যেই চা চলে আসে। মায়া নিয়ে আসে দু কাপ চা ৷
–কিরে তুই এ ক’দিনে বেশ শুকিয়ে গেছিস মনে হচ্ছে। পারুলের বাড়িতে খাওয়া-টাওয়া দেয়নি বুঝি? মায়া কোনও উত্তর না দিয়ে চলে যায়। সুরঞ্জনের এই রসিকত্ৰা সে গায়ে মাখে না। সুধাময় অসুস্থ। এ সময় এমন হাস্যরস করা বোধহয় উচিত হয়নি সুরঞ্জনের। মায়ার নীরবতা তাকে খানিকটা ভাবায়।
এই ভাবনা থেকে বিরূপাক্ষ তাকে সরিয়ে আনে। সে চা পান করতে করতে বলে—সুরঞ্জনদা, আপনি তো ধর্ম মানেন না। পুজো করেন না, গরুর মাংস খান, মুসলমানদের বলুন আপনি সত্যিকার হিন্দু নন, অর্ধেক মুসলমান।
—আমি যে সত্যিকার মানুষ, ওদের আপত্তি তো ওখানেই। উগ্ৰ মৌলবাদী হিন্দু আর মুসলমানে কোনও বিরোধ নেই। এখানকার জামাত নেতার সঙ্গে ভারতের বি জে পি নেতাঙ্গের বন্ধুত্ব দেখছ না? দুই দেশে দুই মৌলবাদী দল ক্ষমতাবান হতে চাইছে। ভারতের দাঙ্গার জন্য দায়ী বি জে পি নয়, দায়ী কংগ্রেস এ কথা তো বায়তুল মোকাররমের সভায় নিজামি নিজেই বলেছে।
—ভারতের দাঙ্গায় এক হাজার লোক নিহত হয়েছে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, আর এস এস, বজরঙ্গ, জামায়াত, ইসলামি সেবক সংঘ দলকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এদিকে সিলেটে হরতাল হচ্ছে, পিরোজপুরে একশ চুয়াল্লিশ ধারা, ভোলায় কার্ফু, তা ছাড়া টুকরো টুকরো শান্তি মিছিল তো হচ্ছেই। মিছিলে শ্লোগান উঠছে ‘নিজামি আদভানি ভাই ভাই, এক দড়িতে ফাঁসি চাই।’ আজ সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সর্বদলীয় শান্তি সভা। ব্রিটেনের মন্দিরে ও নাকি হামলা হয়েছে। তোফায়েল আহমেদ ভোলা ঘুরে এসে বলেছেন ভোলায় বি ডি আর পাঠানো দরকার। এলাকার অবস্থা খারাপ।
–কেন, পুড়ে সব ছাই হয়ে গেলে বি ডি আর গিয়ে কি করবে ওখানে? ছাই-এর গাদা জমাবো? কোথায় ছিলেন তোফায়েল ছয় তারিখ রাতে? সে রাতেই তিনি কেন প্রটেকশনের ব্যবস্থা করলেন না?
সুরঞ্জন উত্তেজিত হয়ে ওঠে। বলে–আওয়ামি লিগকে ধোয়া তুলসীপাতা ভেব না।
–এরকম কি হতে পারে, এই সরকারের ওপর দোষ পড়ার জন্য আওয়ামি লিগও দাঙ্গা থামানোর চেষ্টা করেনি?
-জানি না। হতে পারে। তবে সবার হচ্ছে ভোটের প্রয়োজন। এই দেশে চলে ভোটের রাজনীতি, এখানে আদর্শ ফাদর্শের ধার কেউ ধারে না, ছলে-বলে-কৌশলে ভোট পেলেই হল। আওয়ামি লিগ তো ভেবেছে হিন্দুর ভোট তারা পাবেই। কী যেন বলে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক না কি। কোথাও কোথাও নাকি ওরাই লুটপাট করেছে।
–কোথাও এমনও হয়েছে, যেসব এলাকা থেকে আওয়ামি লিগ ভোটে জেতে, সেসব এলাকার বি এন পি-র লোকেরা হিন্দু বাড়ি লুট করে মন্দির ভেঙে-পুড়িয়ে বলছে যাদের ভোট দাও, তারা কোথায় এখন? একইরকম বি এন পি যেখানে জেতে, আওয়ামি লিগ করেছে। ভোলায় করেছে বি এন পি-র লোকেরা, এদিকে আবার মহেশখালি, ঘিওর, মানিকগঞ্জে করেছে আওয়ামি লিগের লোক।
—রাজনীতির ব্যাপার তো আছেই। কিন্তু মৌলবাদীদের বাদ দিয়ে কিছু হয়নি। আচ্ছা, আজ নাকি অভিন্ন সম্পাদকীয় বের হয়েছে প্ৰায় সব পত্রিকায়? সাম্প্রদায়িক সম্প্ৰীতি রক্ষার আবেদন আছে নাকি ওতে?
–আপনি কি পত্রিকা পড়েন না?
—ইচ্ছে করে না। এ সময় মায়া ঢেকে ঘরে। একটি খাম রাখে টেবিলে, বলে—মা দিয়ে দিল, বলল লাগবে না!
মা কি দিল। এই প্রশ্ন করুবার আগে মায়া চলে যায়। সুরঞ্জন খাম খুলে দেখে গত রাতের দু হাজার টাকা। অপমানে লাল হয়ে ওঠে সুরঞ্জনের মুখ। এ কি কিরণময়ীর অহঙ্কার? নাকি তিনি ভেবেছেন বেকার ছেলে চুরি ডাকাতি করে টাকা এনেছে? অভিমানে লজ্জায় সুরঞ্জনের আর কথা বলতে ইচ্ছে করে না। বিরূপাক্ষর সঙ্গেও না।
কিরণময়ীর বাবা ছিলেন ব্ৰাহ্মণবাড়িয়ার নামকরা লোক। বড় উকিল। অখিল চন্দ্ৰ বসু। ষোল বছরের মেয়েকে ডাক্তার ছেলের কাছে বিয়ে দিয়ে পুরো ফ্যামিলি নিয়ে কলকাতা চলে গিয়েছিলেন। তাঁদের আশা ছিল মেয়ে জামাইও বুঝি চলে আসবে একসময়। কিরণময়ীও ভেবেছিলেন এক এক করে বাপ মা জ্যাঠা কাকা পিসি মাসি মামা প্রায় সবাই যখন চলে গেছেন, তিনিও বোধহয় যাবেন। কিন্তু এ এক অদ্ভুত ফ্যামিলিতে এসে পড়েছেন তিনি, শ্বশুর শাশুড়ির কাছে ছিলেন ছ’ বছর, ছ’বছরে তাঁরা আত্মীয়স্বজন পাড়া-পড়শিকে চোখের সামনে পাততাড়ি গুটোতে দেখেছেন, তবু ভুলেও কখনও দেশত্যাগের নাম করেননি। কিরণময়ী লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতেন। কলকাতা থেকে বাবার চিঠি আসন্ত-মা কিরণ, তোমরা কি আসিবে না ঠিক করিলে? সুন্ধাময়কে আরও ভাবিতে বল। দেশ ছাড়িয়া আসিতে তো আমাদেরও ইচ্ছা করেনি। কিন্তু আসিতে বাধ্য হইয়াছি। এইখানে আসিয়া খুব যে ভাল আছি তাহা নহে। দেশের জন্য মন কেমন করে। তবু বাস্তবকে তো মানিয়া লইতেই হয়। তোমাদের জন্য চিন্তা হয়। ইতি তোমার বাবা।’ এইসব চিঠি কিরণময়ী কত যে পড়তেন, চোখের জল মুছতেন, রাতে রাতে। সুধাময়কে বলতেন—’তোমার আত্মীয়রা অনেকেই নেই। আমার আত্মীয়রাও চলে গেছে। এখানে থেকে রোগে শোকে মুখ জল দেবার লোক পাব না।’ সুধাময় বিদ্যুপের হাসি হেসে বলতেন-‘জলের এত কাঙালি তুমি। তোমাকে পুরো ব্ৰহ্মপুত্রই দিয়ে দেব। কত জল খেতে পারো দেখব। আন্ধীয়রা কি ব্ৰহ্মপুত্রের চেয়ে বেশি জল ধারণ করে দু’ দেশ ছেড়ে যাবার কথা শ্বশুর নয়, স্বামী নয়, এমনকি পেটের ছেলে সুরঞ্জন, সেও মনোনি কোনও দিন। কিরুণাময়ীকে অগত্যা এই সংসারের স্বাভাবি চরিত্রের সঙ্গে তাল মেলাতে হয়েছে। তাল মেলাতে গিয়ে কিরণময়ী অবাক হন সংসারের সুখ দুঃখে, সম্পদে দারিদ্রে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছেন সুধাময়ের চেয়ে বেশি।
কিরণময়ী তাঁর হাতের দুটো বালা বিক্রি করেছেন। হরিপদ ডাক্তারের স্ত্রীর কাছে। বাড়ির কাউকে তিনি জানতে দেননি ঘটনাটি। এসব জানাবারুই বা কি আছে। সোনাদানা তো এমন মূল্যবান কিছু নয় যে প্রয়োজনে বিক্রি করা যাবে না। সুধাময়ের সুস্থ হয়ে ওঠাই এ মুহুর্তে সবচেয়ে জরুরি। মানুষটির প্রতি কোথেকে যে এত ভালবাসা জন্মায়, কিরণময়ী বুঝতে পারেন না। সেই একাত্তরের পর থেকে সুখময়কে তাঁর গভীর করে পণ্ডিয়া হয় না। মাঝে মধ্যে সুধাময় বলেন—কিরণময়ী, আমি বোধহয় তোমাকে ঠকালাম খুব, তাই না?
কিরণময়ী বোঝেন কিসের ঠিকার কথা বলেন সুধাময়। তিনি চুপ করে থাকেন। কিছু যে বলবেন তিনি, তিনি যে বলকেন-না, আমি আবার ঠিকাছি কোথায়? বলা হয় না। তাঁর। বলবার কোনও কথা তিনি খুঁজে পান না। সুধাময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন-তুমি কি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে কিরণ? আমার বড় ভয় হয়।
কিরণময়ী কখনও সুন্ধাময়কে ছেড়ে যাবার কথা ভাবতে পারেন না। মানুষের কি ওই একটি সম্পর্কই প্রধান? আর তুচ্ছ সব? তুচ্ছ তবে পিঁয়ত্ৰিশ বছর একঘরের জীকন? এত সহজেই স্নান হয়ে যেতে পারে দীর্ঘ আনন্দ-বেদনার সংসারযাপন? না, কিরণময়ী ভাবেন-জীবন মানুষের একটাই। এই জীকন তো আর ঘুরে ফিরে বার বার আসবে না। জীবনে না হয় মেনেই নিলাম কিছুটা দুঃসহবাস। একাত্তর থেকে সুধাময় যৌন জীবন যাপনে অক্ষম একজন মানুষ। এ নিয়ে কিরণময়ীর কাছে তাঁর লজ্জার অন্ত ছিল না। তিনি প্রায়ই গভীর রাতে ফিসফিস করে তাঁকে ডেকে তুলে বলতেন—তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে কিরণ?
—কি কষ্ট? কিরণময়ী বুঝেও বোঝেননি ভাব করতেন।
সুধাময়ের অস্বক্তি হত বলতে। তিনি অক্ষমতার যন্ত্রণায় বালিশে মুখ খুঁজতেন। আর কিরণময়ী দেয়ালের দিকে ফিরে নিঝুম রাত পার করতেন। মাঝে মধ্যে সুধাময় বলতেন—’তুমি যদি ইচ্ছে কর, না হয় নতুন করে সংসার পাতো, আমি কিছু মনে করব না।‘
কিরণময়ীর শরীরে কোনও তৃষ্ণা ছিল না। এ কথা সত্য নয়। ছিল, সুধাময়ের বন্ধুরা যখন আসতেন, সামনে বসে গল্প করতেন, ওঁদের ছায়া পড়ত তাঁর কোলে, কিরণময়ী প্রায়ই তাঁর কোলের ছায়ার দিকে আড়াচোখে তাকতেন। তাঁর হঠাৎ হঠাৎ ইচ্ছেও হত কোলের ছায়াটি যদি সত্যি হত, যদি ছায়াটির মানুষ একবার মাথা রাখত কোলে। শরীরের তৃষ্ণাটি খুব বেশি বছর ভোগায়নি তাঁকে। সংযমে সংযমে পার হয়ে গেছে। বয়স কি থেমে থাকে! একুশ বছর দেখতে দেখতে কেটে গেল। কিরুণাময়ী এর মধ্যে এও ভেবেছেন সুখময়কে ছেড়ে যার কাছে যাকেন সেও যদি এমন অক্ষম পুরুষ হয়। অথবা অক্ষম না হোক, যদি এত হৃদয়বান না হয় সুধাময়ের মত!
কিরণময়ী মাঝে মধ্যেই ভাবেন সুধাময় বুঝি তাঁকে ভালবাসেন খুব। সঙ্গে ছাড়া খেতে বসেন না, মাছের বড় টুকরোটি নিজের পাত থেকে কিরণময়ীর পাতে তুলে দেন। বাড়িতে কাজের লোক না থাকলে বলেন-বাসন মাজ-টাজ কিছু থাকলে বল, আমি বেশ ভাল বাসন মাজতে পারি।
বিকেলে-টিকেলে কিরণময়ী উদাস বসে থাকলে সুধাময় বলেন-চুলে তোমার জট। পড়েছে কিরণ, এস ছাড়িয়ে দিই। আজ বিকেলে রমনা ভবনে গিয়ে ভাল দুটো শাড়ি কিনে এন। ঘরে পরিবার শাড়ি তোমার নেই-ই তেমন। টাকা থাকলে তোমার নামে বড় একটি বাড়ি বানিয়ে দিতাম কিরণ। তুমি বাড়ির উঠোনে খালি পায়ে হেঁটে বেড়াতে। বাড়ি ভরে ফল ফলাস্তির গাছ লাগাতে। মৌসুমের সবজি লাগাতে, ফুলগাছ লাগাতে। শিমগাছে শিম, লাউয়ের মাচায় লাউ, জানালার ধার ঘেষে হাসনুহেনা, আসলে তোমাকে ব্ৰাহ্মাপল্লীর বাড়িতেই মানাত বেশি। কিন্তু আমার সমস্যাটা কি জানো তো, টাকার লাইনের দিকে আমি মোটে গেলামই না। চাইলে যে টাকা করা যেত না তা নয়। বাড়ি বিত্ত দেখে তোমার বাবা বিয়ে দিয়েছিলেন, সেই বাড়িও আর নেই, বিত্তও নেই। অনেকটা হ্যান্ড টু মাউথ অবস্থা। এ নিয়ে আমার কোনও দুঃখ নেই। তোমার বোধহয় কষ্ট-টষ্ট হয় কিরণ।
কিরণময়ী বুঝতে পারতেন এই সরল সোজা, নিরীহ ভালমানুষটি তাঁকে ভালবাসেন বড়। কোনও ভালমানুষকে ভালবেসে জীবনের ছোটখাট সুখ যদি ত্যাগ করা যায়, অথবা ছোটখাট নয়, বড় কোনও স্বার্থও, তবে ক্ষতি কী। কিরুণময়ী তাঁর আঠাশ বছর বয়স থেকে এক অতৃপ্তি পুষছেন শরীরে, কিন্তু মনের ভেতর যে গোঙরায় এক সমুদ্র ভালবাসার জল, এই জল তাঁর শরীরের অসুখগুলো, ব্যথা ও বেদনাগুলো ধুয়ে দেয় বার বার।
সুরঞ্জন টাকা দিয়েছে। সম্ভবত ধার করে। উপার্জন করে না বলে এক ধরনের হীনমন্যতায় বোধহয় ভোগে ও। কিন্তু দেওয়ালে এখনও পিঠ ঠেকে যায়নি। কিরণময়ীর। এখনও চালিয়ে নেবার মত কিছু টাকা আছে হাতে, সুধাময় কখনও নিজের কাছে একটি পয়সা রাখেননি, উপার্জনের সবটুকুই কিরণের হাতে তুলে দিতেন। তা ছাড়া এখনও সোনাদানও কিছু অবশিষ্ট আছে। তিনি মায়ার হাত দিয়ে সুরঞ্জনের টাকা কটি ফেরত পাঠান। ফেরত পাঠানোয় ও যে কষ্ট পাবে ভাবেননি কিরণময়ী। আচমকা ঘরে ঢুকেই সুরঞ্জন বলে-ভেবেছ চুরি-ডাকাতি করে টাকা এনেছি? নাকি বেকারের টাকা নিতে লজ্জা হয়? কিছুই হয়ত করতে পারি না। কিন্তু করতে তো ইচ্ছে করে আমার। এ কথা কি বোঝা উচিত ছিল না কারও?
নিথর বসেছিলেন কিরণময়ী। কথাগুলো বেঁধে তাঁর বুকে।
রত্নার বাড়িতে কড়া নাড়ে সুরঞ্জন। রত্নাই দরজা খোলে। দেখে খুব চমকায় না। সে। যেন সুরঞ্জনের আসবার কথাই ছিল। সোজা তাকে শোবার ঘরে নিয়ে যায়। যেন কতকালের আত্মীয় সে। এক প্যাঁচে সুতি শাড়ি পড়েছে রত্না। কপালে লাল একটি টিপ হলে চমৎকার মানাত। আর যদি সিঁথিতে সিঁদুরের দাগ থাকত অল্প। সুরঞ্জন কুসংস্কার মানে না, কিন্তু শাঁখা সিঁদুরের, উলুধ্বনির, শাঁখ বাজানোর বাঙালিয়ানা তাকে মুগ্ধই করে। বাড়িতে তাদের পুজো-আচ্চা একেবারেই নিষেধ ছিল, কিন্তু দল বেধে পুজো দেখতে যাওয়া, আরতিতে শখের নাচা, পুজো মণ্ডপের গানে তাল দেওয়া, দু-চারটে নাডু টাডু খাওয়া এসবে সে আপত্তি করেনি।
রত্না তাকে বসিয়ে রেখে চা করতে গেছে। কেমন আছেন ছাড়া একটি বাক্যও সে বলেনি। সুরঞ্জনও বলেনি। কথা খুঁজে পায়নি সে। সে ভালবাসতে এসেছে। ইঞ্জি করা একটি শার্ট পরে, অনেকদিন পর শেভ করে, স্নান করে, গায়ে একটু সুগন্ধি লাগিয়ে এসেছে। বুড়ো বাবা মা, বড় ভাই আর রত্না, এই নিয়ে সংসার। ভাই-এর বউ ছেলে মেয়ে আছে। ছেলে মেয়েগুলো ঘুরঘুর করছে, নতুন মানুষটি কে, কি চায় এখানে ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর তারা পায় না বলে দরজা থেকে তারা খুব দূরেও যায় না। সুরঞ্জন একটি সাত বছরের মেয়েকে ডেকে জিজ্ঞেস করে নাম কি?
মেয়েটি ঝটপট উত্তর দেয়–মৃত্তিকা।
—বাহ, সুন্দর নাম তো। কী হয় রত্না তোমার?
—পিসি।
–ও।
—তুমি বুঝি পিসির অফিসে চাকরি কর?
–না। আমি কোনও চাকরি টাকরি করিনা। ঘুরে বেড়াই।
ঘুরে বেড়াই বাক্যটি মৃত্তিকার পছন্দ হয়। সে আরও কিছু কথা বলতে যাবে এমন সময় রত্না ঢেকে ঘরে, হাতে ট্র, ট্রেতে চা বিস্কুট, চানাচুর, দুরকম মিষ্টি।
—কি ব্যাপার হিন্দুদের ঘরে আজকাল তো খাবার থাকার কথা নয়। তারা ঘরের বাইরে যেতে পারছে না। আর এখানে তো দিব্যি দোকান খুলে বসা হয়েছে। তা সিলেট থেকে এলেন কবে?
—সিলেটে না। গিয়েছিলাম হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মৌলভিবাজার। আমার চোখের সামনে হবিগঞ্জের মাধবপুর বাজারে তিনটে মন্দির ভেঙে ফেলেছে।
-কার ভেঙেছে?
-টুপি দাড়িঅলা মুসল্লিরা। এরপর বাজারের কালী মন্দির ভেঙে ফেলেছে। আমার আত্মীয় হন তপন দাশগুপ্ত, ডাক্তার, তার চেম্বারও লুট করে ভেঙে দিয়েছে। সুনামগঞ্জে দুটো মন্দির ভেঙে ফেলল। আট তারিখে। নয় তারিখে চারটে মন্দির, পঞ্চাশটা দোকান, ভেঙে লুট করে আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে। মৌলভিবাজারের রাজনগর ও কুলাউড়ায় ছটা মন্দির আর আখড়া ভেঙে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। ব্ৰাহ্মণবাজারের সাতটি দোকানও লুট করেছে।
–নিশ্চয় হিন্দুর দোকান!
রত্না হেসে বলে-তো আর বলতে।
চাচানাচুর এগিয়ে দিয়ে রত্না বলে-বলুন তো, এ দেশে কি আর থাকা যাবে?
—কোন যাবে না? এ দেশ কি মুসলমানের বাপের সম্পত্তি?
রত্না হাসে। হাসিতে বিষগ্নতা খেলা করে। বলে-ভোলায় নাকি টিপসই দিয়ে জায়গা বেচে চলে যাচ্ছে মানুষ। কেউ টাকা পয়সা পাচ্ছে সামান্য, কেউ পাচ্ছে না।
–ভোলা থেকে কারা যাচ্ছে? হিন্দুরা তো?
–তা তো নিশ্চয়ই।
—তবে উল্লেখ করছেন না কেন? সুরঞ্জন চানাচুর খেতে খেতে বলে।
হিন্দু শব্দটি উল্লেখ করবার কোনও প্রয়োজন পড়ছে না। তারপরও সুরঞ্জনের ইচ্ছে যারা যাচ্ছে তারা যে হিন্দু, যাদের লুট হচ্ছে বাড়িঘর দোকানপাট, তারা যে ভোলা বা হবিগঞ্জের ‘মানুষ’ নয়, কেবল হিন্দু—এ কথাই রত্নাকে বোঝায়।
রত্না কী বোঝে কে জানে সে গভীর দুচোখ মেলে সুরঞ্জনের চোখে তাকায়। সে ভেবে এসেছিল, কোনও রকম রাখঢাক না করেই আজ সে কথা পড়বে। বলবে–আপনাকে আমার ভাল লাগে, বিয়ে-টিয়ে করতে চাইলে বলুন করে ফেলি।
রত্না জল আনতে ওঠে। ওর শাড়ির আঁচল সুরঞ্জনের বাঁ হাত ছুঁয়ে যায়। স্পর্শ লেগে থাকে বাহুতে। আচ্ছা রত্না তো ইচ্ছে করলেই পারে বউ হতে তার, উড়নচণ্ডী জীবনটিকে একটি সংসারে স্থির করা উচিত এই জন্য যে তার বিয়ে করতে ইচ্ছে হচ্ছে তা কিন্তু নয়। সারাদিন শুয়ে শুয়ে রত্নার আঙুল নিয়ে খেলা করা যাবে, খেলতে খেলতে ন্যাংটোকালের গল্প করতে করতে এমন হবে যে দুজনের মধ্যে না জানা কিছু, দেয়াল কিছু থাকবে না। সে আসলে ঠিক বউ হবে না তার, বন্ধু হবে।
রত্নার গভীর চোখদুটো কি চায়? সুরঞ্জন বিব্রত হয়। বলে ওঠে–দেখতে এসেছিলাম অক্ষত আছেন কি না?
–অক্ষত? অক্ষতার তো আবার দুরকম অর্থ, নারীর বেলায় এক, পুরুষের বেলায় আরেক। কোনটি দেখতে এসেছিলেন?
–দুটোই।
রত্না হেসে মাথা নীচু করে। সে হাসলে মুক্তে হয়ত ঝরে না, কিন্তু বেশ লাগে দেখতে। ওর মুখ থেকে চোখ সরতে চায় না সুরঞ্জনের। তার কি বয়স বেশি বেড়ে গেছে? এই বয়সের ছেলেদের কি খুব বুড়ো বুড়ো লাগে দেখতে? বিয়ের জন্য একেবারেই বেমানান? ভাবতে গিয়ে সুরঞ্জন লক্ষ্য করে রত্না তাকে দেখছে। দৃষ্টিতে মোহঘোর।
—আপনার সেই বিয়ে না করার সিদ্ধান্তটি এখনও আছে? রত্না হোসে জিজ্ঞেস করে।
কিছুক্ষণ সময় নিয়ে সুরঞ্জন বলে—জীবন হচ্ছে নদীর মত জানেন তো? নদী কোথাও থেমে থাকে? সিদ্ধান্তও সব সময় অনড় থাকে না। বদলায়।
শুনে বাইরে হিন্দুর ওপর সাম্প্রদায়িক আক্রমণ, আর এই চরম দুঃসময়ে রত্না হাসতে হাসতে বলে–বাঁচলাম।
সুরঞ্জন জিজ্ঞেস করে না ‘বাঁচলাম’ অর্থ কী। সে বুঝে নেয়। রত্না তাকে আমল এক আনন্দ দিচ্ছে। তার ইচ্ছে করে রত্নার সরু সরু আঙুলগুলো খুঁয়ে বলে-চলুন আজ শালবন বিহার যাই। সবুজ ঘাসে সারারাত শুয়ে থাকি। চাঁদ আমাদের পাহারা দেবে। চাঁদকে আমরা তার জ্যোৎস্না লুকোতে বলব না। সুরঞ্জন সিঁড়ির কাছে গিয়েও ভাবে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকা রত্নাকে সে বলবে–আমাদের অনড় সিদ্ধান্তগুলো পাল্টে চলুন কিছু একটা করে ফেলি দুজন।
সুরঞ্জনের বলা হয় না। রত্না দুসিঁড়ি নেমে বলে—আবার আসবেন। আপনি এলেন বলে মনে হল পাশে দাঁড়াবার কেউ একজন আছে। একেবারে একা হয়ে যাইনি।
সুরঞ্জন স্পষ্ট বুঝতে পারছে পারভিনের জন্য যেমন হত, ওই চঞ্চল চড়ুইটি তাকে যেমন সুখে ভাসিয়ে রাখত, তেমনই সুখ হচ্ছে তার।