লজ্জা (Lojja) : 13
জাতীয় সংসদে ১৯৫৪ সালে মোট সদস্য ছিলেন ৩০৯ জন। সংখ্যালঘু ছিলেন ৭২ জন,’৭০-এ ৩০০-র মধ্যে সংখ্যালঘু ১১ জন, ১৯৭৩ সালে ৩১৫ জনে ১২ জন, ১৯৭৯ সালে ৩৩০ জনে ৮জন। ১৯৮৬ সালে ৩৩০ জনে ৭ জন, ১৯৮৮ সালে ৪ জন, ১৯৯১ সালে ৩৩০ জনে ১২ জন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কোনও সংখ্যালঘু ব্রিগেডিয়ার বা মেজর জেনারেল নেই। কর্নেল সত্তর জনে একজন, লেফটেনেন্ট কর্নেল চারশ পঞ্চাশ জনে আটজন, মেজর এক হাজার জনে চল্লিশ জন, ক্যাপ্টেন তেরশ জনে আটজন, সেকেন্ড লেফটেনেন্ট নয়শ জনে তিনজন, সিপাহি আশি হাজারে পাঁচশ জন। চল্লিশ হাজার বি ডি আর-এর মধ্যে হিন্দু মাত্র তিনশ জন। আশি হাজার পুলিশের মধ্যে ধর্মীয় সংখ্যালঘু মাত্র দুই হাজার। এডিশনাল আই জি কেউ নেই, আই জি তো নেই-ই। পুলিশ অফিসারের ৮৭০ জন সদস্যের মধ্যে সংখ্যালঘু মাত্ৰ ৫৩ জন। স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদে, বিদেশে বাংলাদেশ মিশনের উচ্চপদে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোনও লোক নেই। সচিবালয়ের অবস্থা আরও করুণ। সচিব বা অতিরিক্ত সচিব পদে কোনও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোক নেই। জয়েস্ট সেক্রেটারি আছেন একশ চৌতিরিশ জনে মাত্র তিনজন, চারশ তেষট্টি জন ডেপুটি সেক্রেটারির মধ্যে সংখ্যালঘু আছেন। পাঁচশ জন। স্বায়ত্ব-শাসিত সংস্থাগুলোর মধ্যে প্রথম শ্রেণীর কর্মকতা ছেচল্লিশ হাজার। আটশ চুরানব্বই-এর মধ্যে আছেন সাড়ে তিনশ জন। সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্ব-শাসিত প্ৰতিষ্ঠানের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকতা পদে সংখ্যালঘু লোক শতকরা পাঁচ ভাগের বেশি নেই। আবগারি ও শুষ্ক কর্মকতা একশ বাহান্নো জনে একজন, আয়কর কর্মকতা সাড়ে চারশর মধ্যে আটজন। রাষ্ট্রািয়ত্ব শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোয় কর্মকতা শতকরা এক ভাগ, কর্মচারী তিন থেকে চার ভাগ, শ্ৰমিক এক ভাগেরও নীচে। শুধু তাই নয়। বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক সহ কোনও ব্যাঙ্কেরই ডাইরেক্টর, চেয়ারম্যান বা এম ডি পদে হিন্দু নেই। এমনকি বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলোর কোনও শাখায় ম্যানেজার পদে হিন্দু নেই। ব্যবসা বাণিজ্য করতে গেলে মুসলমান অংশীদার না থাকলে কেবল হিন্দু প্রতিষ্ঠানের নামে সব সময় লাইসেন্স পাওয়া যায় না। তাছাড়া সরকার নিয়ন্ত্রিত ব্যাঙ্ক, বিশেষত শিল্প সংস্থা থেকে শিল্প কারখানা গড়বার জন্য কোনও ঋণ দেওয়া হয় না।
সুরঞ্জনের ঘুম হয়নি। সারারাত। ভাল না লাগায় তাকে পেয়ে বসেছে। কিরণময়ী সকালে একবার এসেছিলেন ঘরে। সম্ভবত মায়ার কথাই জিজ্ঞেস করতে যে, কিছু কি হবে না, দিন কি এমন মায়াহীন যাবে? এ ক’দিনে কিরণময়ীও কেমন মরা মরা হয়ে গেছেন। চোখের কোণে কালি, শুকনো মুখে রা নেই, হাসি নেই। ঘুমিয়ে আছে এমন শিথিল পড়ে ছিল সুরঞ্জন বিছানায়। কিরণময়ীকে বুঝতে দেয়নি তার ভেতরে ভীষণ এক যন্ত্রণা হচ্ছে। কিরণময়ী তার টেবিলে দুবেলা খাবার রেখে যান, নিঃশব্দে। সুরঞ্জনের মাঝে মধ্যে রাগও ধরে, মানুষটি কি পাথর? তাঁর স্বামী পঙ্গু, কন্যা হারিয়ে গেছে, পুত্ৰ থেকেও নেই, তবু কেন অভিযোগ নেই। কারও প্রতি? মৃত মানুষের মত অভিযোগহীন, অনুভবহীন আশ্চর্য নিথর জীবন কিরণময়ীর।
সে সিদ্ধান্ত নেয় সারাদিন সে ঘুমোবে। তার ঘুম দরকার। অনেকদিন ঘুম হয় না। ভয়ঙ্কর এক থাবা সে চোখ বুজলেই টের পায় এগিয়ে আসছে তার দিকে। গলা টিপে ধরছে তার। শ্বাসরোধকারী হাত একটির পর একটি আসছেই। সে স্বস্তি পায় না, একফোঁটা শান্তি পায় না।
ননীগোপাল এসেছেন মানিকগঞ্জ থেকে, সঙ্গে বউ ছেলে মেয়ে। ননীগোপাল সুধাময়ের লতায়-পাতায় আত্মীয় হন। সুধাময়ের ঘরের ভাঙা জিনিসগুলো দেখে এতটুকু বিস্মিত হন না। ননীগোপাল, বলেন—আপনার বাড়িও তবে বাদ দেয়নি?
ললিতা, ননীগোপালের বউ, সিঁদুর মোছা সিঁথিও ঘোমটায় ঢেকেছেন। তিনি কিরণময়ীর দুটো হাত বুকে চেপে ‘বৌদিগো’ বলে কেঁদে ওঠেন। জড়সড় দাঁড়িয়ে থাকে ললিতার মেয়েটি। কি নাম যেন ওর, সুধাময় মনে করতে পারেন না। মায়ার বয়সী হবে মেয়েটা। মায়ার চেয়ে দু-এক বছর কম হতে পারে। মেয়েটির দিকে অপলক তাকিয়ে থাকেন সুধাময়। তাঁর চোখ আবার ঝাপসা হয়ে ওঠে। মায়া নেই। মায়া যে নেই এ কথা সুধাময়ের বিশ্বাস হতে চায় না। যেন আছে, পাশের বাড়িতেই আছে, অথবা টিউশনিতে গেলে বিকেলে ফিরে আসবে। আসলে বাড়ির সকলের গোপনে গোপনে এই আশা থেকেই গেছে, যে, ধর্ষিতা নির্যাতিতা ক্ষতবিক্ষত মায়া একদিন ফিরে আসবে।
–দাদা, এই দেশে আর থাকব না। মেয়ে বড় হয়েছে, বড় ভয় হয় কখন কী হয়।
সুধাময় মেয়েটি থেকে চোখ ফিরিয়ে বলেন–চলে যাবার কথা আমার-সামনে বলো না। শুনলাম পাশের বাড়ির গৌতমরাও চলে যাচ্ছে। পেয়েছটা কি? কথায় কথায় চলে যাব। যেখানে যাবে সেখানে গুণ্ডা বদমাশ নেই? সেখানে ভয়-ডর নেই? মেয়েদের নিরাপত্তার অভাব সব দেশেই। বলে না নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস? তোমার হয়েছে সেই অবস্থা।
ননীগোপালের পরনে পাজামা পাঞ্জাবি। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়িও গজিয়েছে। তিনি কপালে দুটো হাত রেখে চুপচাপ বসে থাকেন। ললিতা কাঁদেন। আশঙ্কায় কাঁদেন। আর কিরণময়ী পাথর হয়ে ললিতার কান্না শোনেন। এ কথা বলতেও তাঁর স্বর ওঠে না যে না মায়াকে ধরে নিয়ে গেছে, আজও ফেরেনি মায়া।
ননীগোপালের কাঠের ব্যবসা ছিল। পুড়িয়ে দিয়েছে ওরা কাঠের গোলা। এতেও তিনি বিচলিত হননি, তাঁর ভয় অঞ্জলিকে নিয়ে। মেয়েকে না। আবার কবে ধরে নিয়ে যায়! তিনি বলেন–দাদা, ললিতার এক আত্মীয় ফেনীর চাঁদপুরে বাড়ি, সম্পত্তির লোভে তাঁকে ধরে নিয়ে গেছে, পরে তাঁকে মেরে ফেলে রেখেছে। জয়দেবপুরের পিংগাইলে অশ্বিনী কুমার চন্দ্রের চৌদ্দ বছরের মেয়ে মিকোকে ধরে নিয়ে রেপ করেছে জানেন না? পরে মেয়েটি মারা গেছে। গোপালগঞ্জের বেদগ্রামের হরেন্দ্রনাথ হীরার মেয়ে নন্দিতা রানী হীরাকে ধরে নিয়ে গেছে। বাঞ্ছারামপুরের ক্ষিতীশ চন্দ্র দেবনাথের মেয়ে করুণাবালাকে গ্রামের মুসলমান ছেলেরা ধরে নিয়ে রেপ করেছে। ভোলার কালীনাথ বাজারের শোভা রানীর মেয়ে তন্দ্ৰা রানীকেও ধরে নিয়ে রেপ করেছে। টাঙ্গাইলের আদালত পাড়া থেকে সুধীর চন্দ্ৰ দাসের মেয়ে মুক্তি রানী ঘোষকে আবদুল কাইয়ুম নামের এক আদম ব্যাপারী ধরে নিয়ে গেছে। ভালুকার পূর্ণচন্দ্ৰ বৰ্মণের মেয়েকে জোর করে ধরে নিয়ে গেছে। রংপুরের তারাগঞ্জে তিনকড়ি সাহার মেয়ে জয়ন্তী রানী সাহাকে অপহরণ করা হয়। এসব শোনেননি?
—এসব কবেকার ঘটনা? সুধাময় ক্লান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন।
ননীগোপাল বলেন–উননব্বই-এর।
—এত আগের কথা এখনও মুখস্থ করে রেখেছ?
—এসব কি ভোলার মত?
—কোন পরীবানু, আনোয়ারা, মনোয়ারা, সুফিয়া, সুলতানা। এদের খবর রাখো না? এদেরও তো ধরে নিয়ে যায়। এদেরও তো অত্যাচার করে, রেপ করে।
ননীগোপাল আবারও মাথায় দুই হাত রেখে বসে থাকেন। খানিকপর বলেন—আপনার অসুখ খবর পেয়েছি। দেখতে যে আসব, নিজের চিন্তায় বাঁচি না। যাবার সময় ভাবলাম দেখা করে যাই। আজ রাতেই বেনাপোল চলে যাব। বাড়িঘর বিক্রি করা সম্ভব হল না। ললিতার এক মামাতো ভাইকে বলেছি সে যেন একসময় বিক্রি করে দেয়।
–সুধাময় বুঝতে পারেন তিনি ফেরাতে পারবেন না। ননীগোপালকে। তিনি ভেবে পান না চলে গেলে কী লাভ ৷ এই দেশের রয়ে যাওয়া হিন্দুরা সংখ্যায় আরও যদি কমে যায়, তবে এদের ওপর অত্যাচার আরও বাড়বে। লাভ হবে–যারা যাবে তাদের, নাকি যারা থেকে যাবে তাদের? সুধাময় অনুমান করেন লাভ আসলে কারওর নয়, ক্ষতি সকলের, ক্ষতি দরিদ্রের, ক্ষতি সংখ্যালঘুদের। কী করলে, ঠিক কতজন মারা গেলে এ দেশের হিন্দুরা ভারতের উগ্ৰবাদী হিন্দুদের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সকল অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করতে পারবে তা জানতে ইচ্ছে করে সুধাময়ের। জানলে তিনি নিজে অন্তত আত্মহত্যা করতেন। অনেককে আত্মহত্যার জন্য বলতেন। তাতে যদি বাকি হিন্দুদের কিছু কল্যাণ হত।
বিকেলে শফিক আহমেদের স্ত্রী আসেন বাড়িতে। আলেয়া বেগম। আগে প্রায়ই আসতেন। আজকাল অনেকেই আসেন না। হায়দারের বাবা মা-ও অনেকদিন আসেন না। কিরণময়ী বড় একা হয়ে গেছেন টের পান সুধাময়। আলেয়া বেগমকে দেখে একটু অবাকই হন কিরণময়ী, যেন কারও আসবার কথা নয় এ বাড়িতে। এ বাড়ি একটি পোড়োবাড়ির মত। আলেয়া বেগমের হাসি হাসি মুখ, ঝকমকে শাড়ি, গায়ের গয়না দেখে সুধাময় ভাবেন কিরণময়ী কি তাঁর সামনে ম্লান বোধ করছেন? কিরণময়ীর ওপর তিনি বোধহয় এতদিন অন্যায়ই করেছেন। একটি সচ্ছল, শিক্ষিত রুচিবান পরিবারের মেয়েকে একটি অসচ্ছল, স্বপ্নহীন সংসারে ঢুকিয়ে, তার ওপর একুশ বছর তাঁকে শরীরী অবদমন দিয়ে বঞ্চিত করেছেন। সুধাময় নিজের স্বার্থই বড় করে দেখেছেন, নয়ত তাঁর বলা উচিত ছিল কিরণময়ী তুমি আবার বিয়ে কর। বললে কি কিরণময়ী চলে যেতেন? আলেয়া বেগমের মত ঝলমলে জীবনের সাধ কি ছিল না তাঁর গোপনে? মানুষের মন তো, চলে যেতেও পারতেন। ঐই ভয়ে সুধাময় কিরণময়ীর কাছাকাছি থেকেছেন বেশি, বন্ধুবান্ধবকে খুব একটা ডাকতেন না বাড়িতে। কেন ডাকতেন না, সুধাময় তাঁর অসুস্থ শয্যায় নিজের দুর্বলতাকে নিজেই আঙুল তুলে দেখিয়ে দেন, বলেন—সুধাময়, তুমি যে নির্বান্ধব হয়ে যাচ্ছিলে ক্রমশ, ইচ্ছে করেই হচ্ছিলে, যেন এ বাড়িতে তোমার বন্ধুদের আড্ডা বসলে কিরণময়ীর আবার কোনও সক্ষম পুরুষকে যদি পছন্দ হয়ে যায়। কিরণময়ীর জন্য সুধাময়ের ভালবাসা এত তীব্র হয়ে উঠবার পেছনে ছিল স্বার্থপরতা, যেন এই তীব্ৰতা দেখে ক্রিয়াময়ী ভাবেন এই ভালবাসা ছেড়ে কোথাও যাওয়া তাঁরা উচিত নয়। কেবল ভালবাসায় কি মন ভরে? এতকাল পর সুধাময়ের মনে হয় কেবল ভালবাসায় মানুষের মন ভরেনা, আরও কিছুর প্রয়োজন হয়।
আলেয়া বেগম ঘরের ভাঙা জিনিসপত্র দেখেন, সুধাময়ের অচল হাত পা দেখেন, মায়ার অপহৃত হওয়ার গল্প শোনেন আর চুকচুক করে দুঃখ করেন। একসময় বলেন—বৌদি, আপনার কোনও আত্মীয়-টাত্মীয় থাকে না ইন্ডিয়ায়?
–থাকে। আমার প্রায় সব আত্মীয়ই তো ওখানে।
–তবে আর এখানে পড়ে আছেন কেন?
–নিজের দেশ তো তাই।
কিরণময়ীর উত্তরে আলেয়া বেগম একটু যেন অবাকই হন। কারণ কিরণময়ীরও যে দেশ এটি, তা যেন প্রথম তিনি অনুধাবন করছেন। আলেয়া বেগম যত জোর দিয়ে বলেন ‘এটা আমার দেশ’, কিরণময়ীকে তত জোর কি মানায়–আলেয়া বোধহয় ভাবছেন এ কথাই। আজ সুধাময় ভাবেন আলেয়া আর কিরণময়ী এক নয়। কোথায় যেন সূক্ষ্ম এক ফারাক তৈরি হচ্ছে।