লক্ষ্মী কলি-লক্ষ্মী ঠাকরুনের ঝগড়া
পুরীর জগন্নাথ দেবের রথ যাত্রার যে যে বিভিন্ন রীতিনীতি অনুসরণ করা হয় আমাদের বাংলায়ও তার অনুসরণ হয়। বাহিরীর রথযাত্রা তেমনই এক সুপ্রাচীন রথযাত্রা উৎসব। 432 বছরের পুরানো! পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের রীতিনীতি মেনে এখানে রথ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়! সেই অনুযায়ী মূল রথযাত্রার পঞ্চম দিনে একটি বিশেষ অনুষ্ঠান হয় “হেরা পঞ্চমী”! মূল রথযাত্রা আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে অনুষ্ঠিত হয়! এর পাঁচ দিন পরে সপ্তমীর দিন অনুষ্ঠিত হয় এই “হেরা পঞ্চমী’! এটি একটি রঙ্গ কৌতুক এর মত! রথযাত্রায় জগন্নাথ দেব দাদা বলরাম ও বোন সুভদ্রা কে নিয়ে চলে গেছেন মাসির বাড়ি। শ্রীমন্দিরে একা রয়েছেন মা লক্ষ্মী। তাঁর মনে উদ্বেগের শেষ নেই। তাই গোপনে তিনি রথের চাকার দাগ অনুসরণ করে পৌঁছে যান রথের কাছে। সেখানে গিয়ে দেখলেন যে সেটি রাজবাড়ী– মাসির বাড়ি– বাগুন্ডিচা বাড়ি! জগন্নাথ দেবের মাসির হলেন রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের পত্নী মহারানী গুন্ডিচা দেবী। তিনি নিশ্চিন্ত হলেন যে এখানেই আছেন সকলে। লক্ষী দেবী নন্দিীঘোষ রথের কিছুটা অংশ ভেঙে দিয়ে আসার আদেশ দেন তার সহচর সহচরীদের। যাতে গুন্ডিচা মন্দিরে সাড়া পড়ে যায় —কে এসে রথ ভাঙলো? জগন্নাথ দেবের ফেরার দেরি দেখে লক্ষ্মী ঠাকুর এমন রেগে আছেন ঠিক সাত দিনের মাথায় আবার তিনি দলবল নিয়ে গুন্ডিচা মন্দির এ উপস্থিত হন। এবং ভীষন ঝামেলা বাধান ঘরে ঢোকার জন্য। ঘরের সামনে থাকা প্রহরীদের সাথে এঁদের ভীষণ ঝগড়া হয়। ওড়িয়া ভাষায় একে বলে “লক্ষী কলি”—” লক্ষ্মী ঠাকরুণের ঝগড়া”!
এই ঝগড়ার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায় পরিবারের পুরুষ ও স্ত্রী চরিত্র নিয়ে তরজা— এটি লড়াইয়ের আকার নিয়ে দর্শকদের কাছে মজাও কৌতুকের সৃষ্টি করে। অভিনয়ের আকারে এই ঝগড়া চলতে চলতে একসময় শেষ হয়। জগন্নাথ– সুভদ্রা– বলরাম রথে উঠে আবার শ্রী মন্দিরে ফিরে আসেন। লোক সংস্কৃতির আঙ্গিকে পরিবেশিত ঝগড়াটি লোক বিনোদনের একটি বড় উদাহরণ। এতে বিভিন্ন পারিবারিক ও সামাজিক নানা কথা যা মনের সুপ্ত ছিল সেগুলি ঝগড়ার কালে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে বেরিয়ে আসে। এই ঝগড়ার কৌতুক টি পুরীর অনুসরণে করা হয়ে থাকে— নাটকীয় ভঙ্গিতে! এতে একদল মেসোর বাহিনীর লোক অন্যদল লক্ষ্মী ঠাকরুণের বাহিনী র লোক। মেসোর বাহিনী তে পুরুষ ও লক্ষীঠাকরুণের বাহিনীতে থাকেন মহিলারা। তর্ক-বিতর্ক চলে সংস্কৃত শ্লোক সহ বাংলা তরজমায়— গানের সুরে কীর্তন এর ঢঙে।
লোক শিক্ষা মূলক প্রশ্ন উত্তর, উক্তি প্রত্যুক্তি বাংলা রসালাপ এর মত। নবম দিনে উল্টো রথের দিন গুন্ডিচা বাড়ি থেকে নিজের মন্দিরে এসেও রথ থেকে নেমে তাঁদের অপেক্ষা করতে হয়। হঠাৎ করে শ্রীমন্দিরে ঢুকতে পারেন না— এখানেও একপ্রস্থ ঝগড়ার রগড বা লোক নাট্য উত্থাপিত হয়। তারপর জগন্নাথ সুভদ্রা বলরাম স্বগূহে তথা নিজ মন্দিরে অবস্থান করতে থাকেন ।
তথ্যসূত্র- লোকভাষ
ক্ষেত্র সমীক্ষাও
গ্রামীণ সংস্কৃতির ঝুলি– ডক্টর প্রবাল কান্তি হাজরা