Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » রোদনভরা এ বসন্ত (২০০৩) || Humayun Ahmed » Page 6

রোদনভরা এ বসন্ত (২০০৩) || Humayun Ahmed

মীরু স্বপ্নটা আবারো দেখছে

মীরু স্বপ্নটা আবারো দেখছে। তবে স্বপ্নটা আগের মত না। একটু মনে হল বদলেছে। ডায়াসে স্যারকে দেখা যাচ্ছে। স্যারের চেহারা শান্ত। তিনি। আঙুল উঁচিয়ে ডাকলেন, এই যে মেয়ে। উঠে এসো। তোমার নামই তো ঐ? অদ্ভুত এক অক্ষরের নাম–ঐ।

স্যার আমার নাম ঐন্দ্রিলা।

ঐন্দ্রিলার চেয়ে ঐ অনেক সুন্দর নাম। আজ থেকে আমরা সবাই তোমাকে ঐ নামে ডাকব। ঠিক আছে?

মীরু কিছু বলার আগেই সব ছাত্রছাত্রীরা একসঙ্গে বলে উঠল, ইয়েস ইয়েস কণ্ঠ ভোটে পাশ। কণ্ঠ ভোটে পাশ।

মীরু তাকালো নিজের দিকে। আশ্চর্য কাণ্ড, তার গায়ে কাপড় আছে। সাদা জমিনে লাল সবুজের খেলা। তার বিয়ের শাড়ি। এটা তাহলে দুঃস্বপ্ন না। এটা আনন্দের স্বপ্ন। স্যার যদি তাকে এখন বোর্ডে যেতে বলেন সে যাবে।

হ্যাঁ ঐ হ্যালো!

জি স্যার।

তুমি বিয়ের শাড়ি পরে ক্লাসে এসেছ কেন?

আজ আমার বিয়ে হয়েছে এই জন্যেই বিয়ের শাড়ি পরে ক্লাসে এসেছি।

কার সঙ্গে বিয়ে ঔ-এর সঙ্গে? ঐ-এর বিয়ে ঔ-এর সঙ্গে?

জি না স্যার।

ছাত্ররা আবারো চেঁচিয়ে উঠল, ইয়েস। ইয়েস। কণ্ঠ ভোটে পাস। কণ্ঠ ভোটে পাস।

স্যার জিজ্ঞেস করলেন, ঐ তোমাদের বিয়ে কবে হবে?

পরশু সকাল এগারোটায় হবে।

ছাত্ররা চেঁচিয়ে উঠল, পাস পাস কণ্ঠ ভোটে পাস।

স্যার বললেন, আমরা সবাই তোমার বিয়েতে যাব।

আবারো ডেস্ক চাপড়িয়ে চিৎকার, পাস পাস। কণ্ঠ ভোটে পাস।

স্বপ্নে প্রচণ্ড হৈচৈ-এ মীরুর ঘুম ভাঙল। ঘর নিঃশব্দ। বইয়ের ভাষায় পিনপাতনিক নৈঃশব্দ। স্বপ্নের ভেতর হৈচৈ হলে স্বপ্ন ভঙ্গের পর দেখা যায় ঘরেও হৈচৈ হচ্ছে। অথচ ঘরে কোনো শব্দ নেই।

মীরুর ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত বাজে আটটা। মাথা ধরেছিল বলে সে দুটা প্যারাসিটামল খেয়ে শুয়েছিল। কখন ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতে পারেনি। মাথা ধরা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লে ঘুম ভাঙার পরেও মাথা ধরা থাকে। তারবেলা ব্যতিক্রম হয়েছে। মাথা ধরা নেই। শরীর ফুরফুরে লাগছে।

মীরু পাশ ফিরল। সে ঠিক করল ঘুম ভাঙলেও সে বিছানা থেকে নামবে না। আরো কিছুক্ষণ গড়াগড়ি করবে। নিজের বিছানায় গড়াগড়ি খাওয়ার দিন তার শেষ হয়ে এসেছে। তাকে চলে যেতে হবে অন্য কোথাও। বারসাত কোথায় নিয়ে তাকে তুলবে কে জানে। আত্মীয়-স্বজনের বাসায় নিয়ে তুলবে না এটা বলে দেয়া যাচ্ছে। এক-দুদিনের জন্যে বন্ধুবান্ধবের বাসায় স্ত্রীকে নিয়ে ওঠা যায়–তারপর? মীরুর ব্যাংকে পনেরো হাজার চারশ টাকা আছে। এই টাকাটা নিয়ে কক্সবাজার চলে যাওয়া যায়। যুগল জীবনের প্রথম কিছুদিন সমুদ্র দেখে কাটানো।

সমুদ্র দেখার পর তারা দেখবে— পাহাড়। চলে যাবে রাঙ্গামাটি কিংবা বান্দরবান। সমুদ্র এবং পাহাড় দেখার পর যাবে অরণ্যে। সুন্দরবন। সমুদ্র পর্বত ও অরণ্য এই তিন জিনিস দেখার পর শুরু হবে যুগল জীবন…

মীরু ঘুমাচ্ছিস?

মীরু চোখ মেলল। পাশ ফিরল। জাহেদা বানু ঘরে ঢুকেছেন। তিনি মনে হয় দরজা বন্ধ করে কেঁদেছেন। চোখ লাল হয়ে আছে। তিনি মেয়ের পাশে বসলেন। মীরু বলল, কোনো সমস্যা হয়েছে?

জাহেদা ক্ষীণ গলায় বললেন, রুনি ব্যাগ স্যুটকেস নিয়ে এসেছিল। তোর বাবা ধমক দিয়ে আবার তাকে ফেরত পাঠিয়েছেন। মেয়েটা হাসিমুখে এসেছিল কাঁদতে কাঁদতে গেছে।

মীরু বলল, জগতের এটাই নিয়ম। হাসতে হাসতে যে আসবে তাকে কাঁদতে কাঁদতে বিদায় হতে হবে। একবারই শুধু এর ব্যতিক্রম হয়। মানুষ আসেও কাঁদতে কাঁদতে যায়ও কাঁদতে কাঁদতে।

কখন?

জন্ম-মুত্যুর সময়। জন্মের সময় কাঁদতে কাঁদতে পৃথিবীতে আসে এবং মৃত্যুর সময়ও কাঁদতে কাঁদতে যায়।

জাহেদা বললেন, কথাটা তো সুন্দর।

মীরু বিছানায় উঠে বসতে বসতে বলল, আমার একজন ফিলসফার বন্ধু আছে। এইসব মজার মজার কথা সবই তার কাছ থেকে শেখা।

জাহেদা আতংকিত গলায় বললেন, ছেলে বন্ধু না তো?

মীরু বলল, তুমি ঠিক ধরেছ। ছেলে বন্ধু। এবং আগামী পরশু সকাল এগারোটায় তাকে বিয়ে করছি। তুমি যদি ভাব তোমার সঙ্গে ঠাট্টা করছি তাহলে ভুল করবে।

বিয়ে করছিস?

হ্যাঁ। বিয়ে করে আমি ফুড়ুৎ করে উড়াল দিয়ে চলে যাব। তুমি তখন তোমার অতি প্রিয় স্বামীকে নিয়ে অতি সুখে জীবন যাপন করতে পারবে–

দু’জনে মুখোমুখি
গভীর দুখে দুখী
আঁধারে ঢাকিয়া গেছে আর সব।

জাহেদা অবাক হয়ে বললেন, তুই সত্যি বিয়ে করছিস?

হুঁ।

ছেলেটা কে?

বারসাত নাম।

কাজি অফিসে বিয়ে করছিস?

কাজি অফিস ছাড়া উপায় কি? তোমরা কি কমুনিটি সেন্টারে আমার বিয়ে দেবে?

জাহেদা কাদো কাদো গলায় বললেন, আমি আমার দুই মেয়ের কোনো মেয়েকেই কি শখ করে বিয়ে দিতে পারব না?

মীরু বলল, সে রকমই তো মনে হচ্ছে।

জাহেদা কেঁদে ফেললেন। মীরু মার হাত ধরে বলল, বাবাকে রাজি করাও। বাবাকে গিয়ে বল— মীরু একটা ছেলেকে বিয়ে করতে চাচ্ছে। ছেলে বেকার। হতদরিদ্র। বাবা যদি তাতেই রাজি থাকে তাহলে আমি খুবই খুশি মনে বেনারসি শাড়ি পরে বিয়ে করব। বাবাকে বলতে পারবে?

জাহেদা কিছু বললেন না। চোখ মুছতে থাকলেন। মীরু বলল, এত মন। খারাপ করো না তো মা। যা হবার হবে। কে সারা সারা। এসো আমরা হাসি। ছাদে যাবে? চল ছাদে যাই। ছাদের ঘুম সোফায় তুমি শুয়ে থাকবে। আমি তোমার চুল টেনে দেব। যাবে?

জাহেদা এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললেন, বিয়ের পর তুই কী করবি? রুনির মতো বাড়ি ছেড়ে চলে যাবি?

মীরু শান্তগলায় বলল, আমার চলে যাবার জায়গা নেই মা। ওর হাতে একেবারেই টাকা-পয়সা নেই। ঘর ভাড়া করে আমাকে নিয়ে থাকার তো প্রশ্নই ওঠে না। আমাকে তোমাদের সঙ্গেই কুমারী মেয়ে সেজে থাকতে হবে। মাঝে মধ্যে স্বামীর সঙ্গে তার মেসে দেখা করতে যায়।

এইভাবে কতদিন থাকবি?

যতদিন থাকা যায়। মা তুমি কি আমাকে এইভাবে থাকতে দেবে না। কি বাবার কাছে আমাকে ধরিয়ে দেবে?

ধরিয়ে দেব কেন?

স্বামীর কাছে ভালো সাজার জন্যে ধরিয়ে দেবে। আদর্শ স্ত্রী সাজতে যাবে। তোমার জীবনের লক্ষ্য হল আদর্শ স্ত্রী হওয়া। আদর্শ মা হওয়া না।

আমার সম্বন্ধে তোর এত খারাপ ধারণা?

হ্যাঁ মা তোমার সম্পর্কে আমার খুবই খারাপ ধারণা। রুনি আপু যে গোপনে বিয়ে করেছে সেই খবরটা বাবাকে তুমি দিয়েছ। আমি তোমার কী নাম দিয়েছি শুনতে চাও? আমি তোমার নাম দিয়েছি তালেবান মা। বাবার সব কথায় তুমি তাল দাও বলেই তুমি তালেবান।

আমি তালেবান?

হ্যাঁ তুমি তালেবান। বাবা যখন ঘুষ খায় তখন তুমি বল, অফিসের সবাই ঘুষ খায়। তোর বাবা একা যদি না খায় সে একঘরে হয়ে যাবে। তার চাকরি চলে যাবে। চাকরি বাঁচানোর জন্যেই তার ঘুষ খাওয়া দরকার। বলনি এমন কথা?

জাহেদা ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। মীরু বাথরুমে ঢুকল। চোখেমুখে পানি দিল। রান্নাঘরে ঢুকে নিজের জন্যে এক কাপ চা বানাল। চায়ের। কাপে দুই চুমুক দেয়ার পর আফজল সাহেব ডাকলেন, মরিয়ম। মরিয়ম।

মীরু চায়ের কাপ রেখে উঠে দাঁড়াল। আফজল সাহেব আবারো। ডাকলেন, মরিয়ম।

মীরু বলল, বাবা আমি আসছি। একটা টেলিফোন করে আসছি।

টেলিফোন পরে হবে আগে শুনে যা।

এত ব্যস্ত হয়ো না বাবা আমি আসছি। টেলিফোন করতে এক মিনিট লাগবে।

মীরু টেলিফোনের ডায়াল ঘুরাল। সুলতানা ফুপুকে টেলিফোন করা দরকার। নামাজে দাঁড়িয়ে পড়লে এক-দেড় ঘণ্টা তাকে আর পাওয়া যাবে না।

হ্যালো ফুপু।

হুঁ।

কী ব্যাপার এখনো তুমি এশার নামাজে দাঁড়াওনি?

তুই কী বলবি বল তো সময় নষ্ট করিস না।

আমার জন্যে একটা ঘর খালি করে রাখ আমি আসছি।

তুই এমন কী মহারানী যে তোর জন্যে ঘর খালি করে রাখতে হবে। তুই আসবি আমার সঙ্গে ঘুমাবি।

নাসের সাহেবের টেলিফোন নাম্বারটা আমাকে একটু দাও তো ফুপু।

টেলিফোন করবি?

টেলিফোন না করলে নাম্বার নিয়ে কী করব?

ঠিক করে বল তো মীরু ছেলেটাকে তোর পছন্দ হয়েছে না?

হ্যাঁ।

কিন্তু নতুন ধনী না। চারপুরুষের ধনী।

ফুপু তুমি টেলিফোন নাম্বারটা দাও। আমার হাতে বেশি সময় নেই। বাবা ডাকছেন।

তুই আমার এখানে কখন আসবি?

এই ধর ঘণ্টা খানিক।

বাড়িতে কি কোনো সমস্যা হয়েছে?

মীরু বলল, আমি যে পরশু সকাল এগারোটায় গোপনে একজনকে বিয়ে করতে যাচ্ছি এই খবরটা মাকে বলেছিলাম। আমার ধারণা মা বাবাকে গিয়ে বলেছেন। যে কারণে বাবা ব্যস্ত হয়ে আমাকে তলব করেছেন।

তুই বারসাতকে বিয়ে করছিস?

হুঁ।

নাসেরের টেলিফোন নাম্বার দরকার কেন?

সাক্ষী লাগবে না? উনি হবেন আমার দিকের সাক্ষী।

আমি জীবনে অনেক মেয়ে দেখিছি। তোর মতো অদ্ভুত মেয়ে দেখিনি।

মীরু বলল, বারসাতের সঙ্গে যখন তোমার পরিচয় হবে তখন তুমি বলবে— আমি অনেক অদ্ভুত ছেলে দেখেছি কিন্তু বারসাতের মতো অদ্ভুত ছেলে দেখিনি। আমিও অদ্ভুত সেও অদ্ভুত! অদ্ভুত অদ্ভুতে ধূল পরিমাণ।

জাহেদা এসে ঘরে ঢুকলেন। মীরু টেলিফোন নামিয়ে রেখে বলল, মা কিছু বলবে?

জাহেদা বললেন, তোর বাবা তোকে ডাকছে তুই যাচ্ছিস না কেন?

মীরু বলল, তুমি কি বাবাকে পরশু সকালে কী ঘটতে যাচ্ছে সেটা বিস্তারিতভাবে বলেছ?

জাহেদা চুপ করে রইলেন। মীরু বলল, বাবার সঙ্গে আমি দেখা করব না। তিনি হার্টের রোগী। চিৎকার চেঁচামেচি করে একটা সমস্যা তৈরি করবেন। আমি নিঃশব্দে পালিয়ে যাব। তোমার কাছে টাকা-পয়সা থাকলে আমাকে দাও।

শোবার ঘর থেকে আফজল সাহেব আবারো ডাকলেন, মরিয়ম। মরিয়ম।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress