Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » রোদনভরা এ বসন্ত (২০০৩) || Humayun Ahmed » Page 4

রোদনভরা এ বসন্ত (২০০৩) || Humayun Ahmed

ঐন্দ্রিলার সঙ্গে কথা

আমি কি ঐন্দ্রিলার সঙ্গে কথা বলতে পারি? তার আরেক নাম মীরু।

আমার নাম ঐন্দ্রিলা। আপনি কে?

ঐন্দ্রিলা তুমি আমাকে চিনবে না। আমার নাম নীলুফার… আমি…

আপনি কি অন্য কোন সময় টেলিফোন করবেন? আজ আমাদের বাসায় বিরাট ঝামেলা।

ঐন্দ্রিলা আমি তিন মিনিটের বেশি সময় নেব না। আমার নাম নীলুফার। আমার ছেলের নাম টুকটুকি। বারসাত আমার ছেলের প্রাইভেট টিউটর। তুমি নিশ্চয়ই বারসাতকে চেন? চেন না?

জি চিনি।

আমি যতদূর জানি বারসাতের সঙ্গে তোমার বিয়ের কথা হয়েছিল। আমি ছিলাম একজন সাক্ষী। তুমি আসনি… আমরা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম…

আপনার সঙ্গে আরেকদিন কথা বলি। আজ আমাদের বাসায় বিরাট ঝামেলা।

আমার কথা শেষ হয়ে গেছে। ঐদিন তুমি আসনি। কেন আসনি সেটা তোমার ব্যাপার। না আসার মত কারণ নিশ্চয়ই তোমার আছে। আমি তোমাকে টেলিফোন করেছি বারসাতের খবর জানার জন্যে। ও হঠাৎ উধাও হয়ে গেছে। বারাসাত কোথায় আছে জানো?

না।

কালিয়াকৈরে বারসাতের দূর সম্পর্কের কোন আত্মীয়ের একটা বাগানবাড়ি আছে। বিয়ের পর তোমাকে নিয়ে বারসাতের সেই। বাগানবাড়িতে যাবার কথা ছিল। তুমি কি সেই বাগানবাড়ির ঠিকানা জাননা?

না।

বারসাতের তিন বোন ঢাকায় থাকে। তার মা-ও ঢাকায় থাকেন। তুমি কি তাদের ঠিকানা জানো?

না।

আমার কেন জানি মনে হচ্ছে তুমি আমার কথায় বিরক্ত হচ্ছ। তোমাকে বিরক্ত করা আমার উদ্দেশ্য না। আমি বারসাতের খোঁজ জানতে চাচ্ছি। ওর কোন বন্ধু-বান্ধবের টেলিফোন নাম্বার কি তুমি জানো?

না।

তুমি কি আমার টেলিফোন নাম্বারটা রাখবে? যদি তোমার সঙ্গে বারসাতের যোগাযোগ হয় তাহলে কষ্ট করে যদি আমাকে জানাও। I will be so happy.

দিন আপনার টেলিফোন নাম্বার।

আমি তুমি তুমি করে বলছি। দয়া করে এতে কিছু মনে করো না। আমি বয়সে তোমার অনেক বড়।

আপনি টেলিফোন নাম্বারটা দিন।

তোমার সঙ্গে কাগজ-কলম কি আছে?

কাগজ-কলম লাগবে না। টেলিফোন নাম্বারটা বলুন। একবার শুনলেই আমার মনে থাকবে। আমার স্মৃতিশক্তি ভাল।

আচ্ছা থাক তোমার টেলিফোন নাম্বার রাখতে হবে না। মনে হচ্ছে তুমি খুবই বিরক্ত। সরি।

নীলুফার খট করে টেলিফোন রেখে দিল। মীরুর মুখে কোন ভাবান্তর হল না। সে টেলিফোন রেখে ছুটে গেল রান্নাঘরে। রান্নাঘরে আজ ক্রমাগত চা বানানো হচ্ছে। ভাপা পিঠা বানানো হচ্ছে। যার ইচ্ছা চা ভাপা পিঠা নিয়ে যাচ্ছে। বাড়ি ভর্তি মানুষ। পিঠা এবং চা বানিয়ে দুজন কাজের মেয়ে এবং মীরুর মা জাহেদা বানু কূল পাচ্ছেন না।

বাড়িতে চা এবং ভাপা পিঠা এই বিপুল আয়োজনের কারণ হচ্ছে আফজল সাহেব আজ সকালে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। তিনি নাস্তা হিসেবে ভাপা পিঠা খেতে চেয়েছেন। তার বাড়ি ফেরা উপলক্ষে দুনিয়ার আত্মীয়-স্বজন এ বাড়িতে ভিড় করেছে। আফজল সাহেব ভাব করছেন যে তিনি খুব বিরক্ত হচ্ছেন, আসলে তা না। তিনি অত্যন্ত খুশি। তিনি চাচ্ছেনও না যে কেউ বাড়ি থেকে চলে যাক। তিনি মীরুকে ডেকে ষড়যন্ত্র করার ভঙ্গিতে বললেন, এরা তো কেউ নড়বে বলে মনে হচ্ছে না। দুপুরে খাবার ব্যবস্থা করা দরকার। কি করা যায় বল তো?

মীরু বলল, তোমাকে এইসব নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। তুমি ভাপা পিঠা খাচ্ছ, ভাপা পিঠা খাও। মা আছে মা যা পারে করবে।

তোর মার মাথায় এত বুদ্ধি থাকলে তো কাজই হত। বিয়ের সময় সে তার সব বুদ্ধি বাবার বাড়ির কোন একটা ট্রাংকে তালাবদ্ধ করে চলে এসেছে। এক কাজ করা যাক ওয়ান আইটেম রান্না হোক। তেহারি।

মীরু বলল, বাবা কি আইটেম রান্না হবে, হবে না এইসব নিয়ে কথা বলতে আমার একেবারেই ইচ্ছা করছে না।

আফজল সাহেব দুঃখিত গলায় বললেন, তুই কি কোন কারণে আমার ওপর রেগে আছিস?

হুঁ রেগে আছি।

আফজল সাহেব বিস্মিত গলায় বললেন, কেন রেগে আছিস?

মীরু বলল, আমি রেগে আছি কারণ তুমি অসুস্থ হবার পর থেকে ধারাবাহিকভাবে মার বদনাম করে যাচ্ছ। যেই আসছে তাকেই বলার চেষ্টা করছ মা কত খারাপ একজন মহিলা। হার্ট এটাকের রোগী ফেলে বোনের মেয়ের বিয়ে খেতে চলে গেছে।

কথাটা তো সত্যি।

কথা সত্যি না। মা যখন বিয়ে খেতে গিয়েছে তখনো তোমার হার্ট এটাক হয়নি। হার্ট এটাক হলে মা তোমাকে ফেলে যেত না। এই সত্য তোমার চেয়ে ভাল কেউ জানে না।

আফজল সাহেব বললেন, যে দুএকজনের সঙ্গে এই কথা বলেছি তারা সবাই নিজের লোক। বাইরের কেউ না। আপনা লোকের কাছে। দুএকটা ভুল ভাল কথা বললে কিছু যায় আসে না।

তুমি বাইরের মানুষের সামনেও মাকে অপমান করেছ।

সেটা আবার কখন করলাম?

ডাক্তার যখন মাকে ওষুধপত্র বুঝিয়ে দিচ্ছিল তখন তুমি বললে, এই বোকা মহিলাকে এইসব বুঝিয়ে লাভ নেই। সে সব আউলিয়ে ফেলবে। আপনি বরং আমার মেয়েকে বুঝিয়ে দিন।

তোর মা সংসারের নানা কাজে ব্যস্ত থাকে— ওষুধপত্রের হিসাব মাথায় ঢুকবে না। এই ভেবে বলেছি।

এই ভেবে তুমি বলনি। তুমি মাকে বোকা ভেবেই বলেছ। আমি ঠিক। করেছি মার কাছে ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত আমি তোমার ঘরে আসব না। কথা বলা তো অনেক পরের ব্যাপার।

আফজল সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, ক্ষমা চাওয়ার মত অপরাধ কি করলাম?

চিন্তা করে দেখ কি করেছ।

তুই এবং তোর মার সমস্যা কি জানিস? তোরা একজন অসুস্থ মানুষকে যে চাপ দিতে পারিস পৃথিবীর আর কেউ তা পারে না। হার্ট এটাক হয়ে গেছে এমন একজন মানুষের সঙ্গে কথা কি করে বলতে হয়। এটা তোরা জানিস না। আমার আসলে বাড়িতে আসাই উচিত হয় নাই। আমার উচিত ছিল হাসপাতালে পড়ে থাকা। তুই সামনে থেকে যা।

মীরু বাবার সামনে থেকে চলে এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বাবাকে আরো কিছু কঠিন কথা শুনাতে পারলে তার ভাল লাগত। অসুস্থ মানুষ হিসেবে কিছু কনসেশন তাকে করা হল। ভয়ংকর কঠিন কথাগুলি শুনানো হল না।

আফজল সাহেবের গ্রামের বাড়ির দূর সম্পর্কের আত্মীয়-স্বজনরা খুঁটি গাড়তে হবে এই চিন্তা-ভাবনা নিয়ে এসেছে বলে মনে হচ্ছে। প্রত্যেকের হাতে ব্যাগ, স্যুটকেস। বেশ কিছুদিন থাকার পরিকল্পনা। আশ্চর্যজনক ভাবে এদের অনেকেই আগে ভাগে স্বপ্নের মাধ্যমে এত বড় দুর্ঘটনা যে। ঘটবে সেই বিষয়ে জেনে গেছেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছেন। আফজল সাহেবের চাচাতো ভাই ইসমাইল হোসেন। তিনি ভাদরগঞ্জ প্রাইমারি স্কুলের হেড মাস্টার। দেখে মনে হয় সুফি সাধক। মুখ ভর্তি চুলদাড়ি-গোঁফের জঙ্গল। চোখে সুরমা। গায়ে রবীন্দ্রনাথের আলখাল্লা টাইপ পোশাক। তিনি মীরুকে বারান্দায় ডেকে নিয়ে গলা নিচু করে বললেন, মাগো তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে।

মীরু বলল, বলুন কি কথা।

কথাগুলি তুমি দ্বিতীয় কোন ব্যক্তির কাছে প্রকাশ করবে না। স্বপ্নের মাধ্যমে পাওয়া কথা। এইসব কথা বাতেনি পর্যায়ের। এইসব প্রকাশ হলে ক্ষতি হয়। আমারো ক্ষতি হবে তোমারও ক্ষতি হবে।

বলুন কি কথা। আমি শুনছি।

ভদ্রলোক গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বললেন, তোমার বাবা সম্পর্কে কথা। যে দিন ঘটনা ঘটবে সেই রাতে এশার নামাজের পর আমি শুয়েছি। শরীরটা খারাপ। রোজা করেছি এই জন্যেই শরীর খারাপ। তুমি শুনেছ। নিশ্চয়ই আমি বছরে ছয় মাস রোজা রাখি। এই বয়সে এত কষ্ট করা উচিত না। কিন্তু কি করব বল, এমন একজনের কাছ থেকে নির্দেশ পেয়েছি শরীরে না কুলালেও রোজা রাখতে হবে।

কার কাছ থেকে নির্দেশ পেয়েছেন?

মাগো সেটা বলা যাবে না। আমার গলা কেটে ফেললেও আমি বলতে পারব না। যাই হোক ঘটনা যেটা বলতে চাচ্ছি সেটা শোন। বিছানায় যাওয়া মাত্র চোখ বন্ধ হয়ে গেল তখনি খোয়াবে উনাকে পেলাম। দেখামাত্রই চিনলাম। আগেও কয়েকবার দেখেছি।

কাকে দেখেছেন?

মাগো তুমি শুধু ভেতরের কথা জানতে চাও। ভেতরের কথা তো বলা। যাবে না। আচ্ছা ঠিক আছে ইনার নামটা বলি— কথা একটাই কারো কাছে প্রকাশ করবে না, খোয়াবে যাকে পেলাম তার নাম খোয়াজ খিজির রাজিআল্লাহুতালা আনহু। উনি দরিয়ার সম্রাট। দরিয়ায় দরিয়ায় থাকেন।

উনি কি বললেন?

তোমার বাবার কথা বলে আফসোস করলেন। বললেন, সামনে পরপর তিনটা বিপদ। প্রথমটা কাটান দেয়াই সমস্যা। প্রথমটা কাটান দেয়া গেলে বাকি দুটা কাটান দেয়া সহজ। আমি তখন স্বপ্নের মধ্যেই উনার পা চেপে ধরে বললাম, আপনাকে যখন পেয়েছি তখন দোয়া করে যান। উনিও দোয়া করবেন না আমিও ছাড়ব না এমন অবস্থা। রীতিমত ঝুলাঝুলি, যাই হোক। শেষে উনার মন গলল। উনি বললেন, তোর কাছে আসাই ভুল হয়েছে। হাত তোল দোয়া করি। দোয়া শেষ করলাম, আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। দেখি ঘরে খাটি মৃগনাভীর গন্ধ। এই হচ্ছে ঘটনা। তাকায়ে দেখ মা ঘটনার কথা বলতে গিয়ে হাতের লোম খাড়া হয়ে গেছে।

মীরু বলল, আমার বাবার মত ঘুষখোর একজন মানুষের জন্যে দোয়া করতে খোয়াজ খিজির এসে পড়বেন। এটা কি বিশ্বাসযোগ্য কথা?

ইসমাইল হোসেন অবাক চোখে বেশ কিছুক্ষণ মীরুর দিকে তাকিয়ে থাকলেন। নিজেকে সামলে নিয়ে হতভম্ব গলায় বললেন, মাগো আমি কি মিথ্যা কথা বলছি?

মীরু বলল, অবশ্যই মিথ্যা কথা বলছেন। আমার বাবার মত বিরাট ঘুষখোরের জন্যে খোয়াজ খিজির আসবেন না। আমাদের বনানীতে একটা বাড়ি আছে। ঐ বাড়ি বানানোর প্রতিটি টাকা ঘুষের টাকা। বাড়ি বানানো শেষ করার পর বাবা যখন বাড়ির নামের জন্যে আমার কাছে এলেন আমি বাবাকে বললাম–নাম দাও ঘুষ কুটির। সেই থেকে বাবার সঙ্গে আমার গণ্ডগোল।

নিজের বাবা সম্পর্কে এইসব কি কথা বলছ মা?

সত্যি কথা সবার সম্পর্কেই বলা যায়। নিজের বাবা সম্পর্কে তো আরো বেশি বলা যায়। ভাল কথা, আপনি কি নাস্তা করেছেন?

চা-নাস্তা খেয়েছি।

তাহলে বাড়ি চলে যান। বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা কথা বলবেন না। মিথ্যা কথা আমার খুব অপছন্দ। আপনি একেবারে মৃগনাভীর গন্ধ পেয়ে গেলেন। মৃগনাভির গন্ধ কখনো শুকেছেন?

না।

জিনিসটা দেখেছেন?

দেখি নাই।

আমি কি প্রমাণ করতে পেরেছি যে আপনি মিথ্যাবাদী?

ইসমাইল হোসেন পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকলেন, মীরু চলে গেল ছাদে। তার অসহ্য লাগছে। কিছুদিনের জন্যে ঢাকার বাইরে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছা করছে।

এ বাড়ির ছাদটা খুবই সুন্দর। বাড়িওয়ালা শরফুদ্দিন সাহেবের গাছের শখ আছে। ছাদে তিনি অস্বাভাবিক সুন্দর একটা বাগান তৈরি করেছেন। বাগানে নানা জাতের অর্কিড আছে, গোলাপ আছে আর আছে বাগানবিলাস। ছাদের এই বাগানে ঢুকলেই মীরুর মাথা যেন কেমন কেমন করে।

শরফুদ্দিন সাহেব এই বাগানের ছাদে কাউকে আসতে দেন না। শুধু মীরুকে ছাদে আসার একটা চাবি দিয়েছেন। প্রতিদিন এক মিনিটের জন্যে হলেও মীরু একবার ছাদে আসে। ছাদটার নাম সে দিয়েছে অক্সিজেন সেন্টার। অক্সিজেন সেন্টারে তার নিজের একটা আলাদা জায়গা আছে। সেখানে রট আয়রনের একটা মাঝারি আকৃতির সোফা সে নিজে কিনে এনে বসিয়েছে। সোফাটা নীল অপরাজিতার ঝোপের আড়ালে এমন ভাবে রাখা যে সোফায় বসে থাকলে কেউ চট করে তাকে দেখবে না। অথচ সে অপরাজিতার পাতার ফাঁক দিয়ে সবাইকে দেখতে পাবে।

মীরু ছাদে এলে সোফায় মাথা রেখে শুয়ে থাকে। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার, এই সোফায় মাথা রাখা মাত্রই তার প্রচণ্ড ঘুম পায়। মীরুর ধারণা নীল অপরাজিতা গাছ থেকে কড়া কোন ঘুমের ওষুধ বাতাসে ভেসে আসে।

সুলতানা মীরুর খোঁজে ছাদে এসেছেন। তিনি অবাক হয়ে বললেন, আশ্চর্য কাণ্ড, তুই কি ঘুমাচ্ছিস না-কি?

মীরু বলল, হ্যাঁ।

বাসায় হুলস্থুল ঝামেলা বাধিয়ে তুই ছাদে ঘুমাচ্ছিস। আশ্চর্য! তোর কাণ্ডকারখানা বোঝা মুশকিল।

বাসায় হুলস্থুল ঝামেলা?

তুই ভাইজানকে কি বলেছিস কে জানে। ভাইজান কান্নাকাটি করছেন। ভাবীর সঙ্গে করেছেন ঝগড়া। ভাবী রাগ করে তার ভাই-এর বাসায় চলে গেছেন। বলে গেছেন আর কোনোদিন আসবেন না। কিছুক্ষণ আগে ডাক্তার ডেকে এনে ভাইজানের প্রেসার মাপা হল।

প্রেসার নিশ্চয়ই নরম্যাল ছিল। ছিল না?

হ্যাঁ প্রেসার নরম্যাল। তুই কি করে বুঝলি?

বাবার বেশির ভাগ কর্মকাণ্ডই ভান।

নিজের বাবা সম্পর্কে এ ধরনের কথা বলা কি ভাল?

নিজের কথা সম্পর্কে কেউ বলার চেয়ে নিজের বাবা সম্পর্কে কথা বলাই কি ভাল না?

তোর সঙ্গে যুক্তি-তর্কে যাব না। যুক্তি-তর্ক আমি পারি না। আমি ভাইজানকে ঠিক করে ফেলেছি। উনি এখন নরম্যাল। তোর দায়িত্ব হচ্ছে ভাবীকে নরম্যাল করে বাসায় নিয়ে আসা।

ঠিক আছে নিয়ে আসব। তুমি বস তো আমার পাশে।

সুলতানা বসলেন। মীরু বলল, তোমাকে দিয়ে আমি একটা ছোট্ট এক্সপেরিমেন্ট করতে চাই।

কি এক্সপেরিমেন্ট?

তুমি চোখ বন্ধ করে এই সোফায় কিছুক্ষণ শুয়ে থাকবে। আমি দেখতে চাই তোমার ঘুম আসে কি না। আমি এই সোফাটার নাম দিয়েছি ঘুম সোফা। এখানে মাথা রেখে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলেই ঘুম পায়।

তাহলে এক কাজ কর। সোফাটা আমাকে দিয়ে দে। আমি বাসায় নিয়ে যাই। আমার রাতে এক্কেবারেই ঘুম হয় না। এখন থেকে ঘুম সোফায় শুয়ে ঘুমুব।

মীরু বলল, ফুপু সোফা দেয়া যাবে না। সোফা এখানে থাকবে। ঘুমাতে চাইলে তোমাকে আমাদের বাড়ির ছাদে এসে ঘুমাতে হবে। এত কথা বলে লাভ নেই। শুয়ে পড়।

সুলতানা বাধ্য মেয়ের মত শুয়ে পড়লেন।

মীরু বলল, চোখ বন্ধ কর।

সুলতানা চোখ বন্ধ করলেন। মীরু বলল, আমি এখন চলে যাচ্ছি। তুমি চোখ বন্ধ করে থাক। আমি পনেরো মিনিট পরে এসে খোঁজ নেব ঘুম এসেছে কি না।

সুলতানা খপ করে মীরুর হাত ধরে বললেন, তুই পাগল হয়েছিস আমি একা একা ছাদে বসে থাকব? ভয়েই মরে যাব। তুই যা করতে বলবি আমি করব। কিন্তু তোকে আমার পাশে বসে থাকতে হবে। আমি এই লোহার সোফায় মাথা রেখে ঘুমুতে পারব না। তোর কোলে মাথা রেখে ঘুমাব। তুই আমার চুলে হাত বুলিয়ে দে।

সুলতানা মীরুর কোলে মাথা রাখলেন। মীরু ফুপুর চুলে হাত বুলাতে লাগল। সুলতানা ঘুম ঘুম গলায় বললেন, নাসের তোর খুব প্রশংসা করছিল। তার ধারণা তুই হচ্ছিস তার দেখা পাঁচজন শ্রেষ্ঠ মানুষের একজন।

বাকি চারজন কে?

বাকি চারজন কে আমি জিজ্ঞেস করিনি। বাকি চারজনকে দিয়ে আমার দরকার নেই। পাঁচজনের মধ্যে তুই আছিস এটাই বড় কথা।

মীরু বলল, নাসের সাহেব আমার বিষয়ে সব গল্প কি করেছেন? আমি যে তাকে নিয়ে বারসাত নামের এক লোককে খুঁজছিলাম সেই গল্প বলেছেন?

না তো। বারসাতটা কে? ঐ যে ছবি আঁকনেওয়ালা?

হুঁ।

প্রাইভেট টিউশনি করে জীবন চালায়?

হ্যাঁ।

এইসব পরজীবী, প্যারাসাইট টাইপ মানুষের নাম মনেও করবি না। এই শ্রেণীর মানুষ গল্প করার জন্য বা সঙ্গে নিয়ে ঘুরার জন্যে খুব ভাল। স্বামী হিসেবে এরা ভয়ংকর খারাপ।

কেন খারাপ?

এরা অপদার্থ এই জন্যে খারাপ।

তোমার কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। ফুপু তোমার কি ঘুম পাচ্ছে?

হুঁ। শাড়িটা আমার মুখের ওপর দিয়ে দে। আমি কিছুক্ষণ ঘুমাব।

মীরু ফুপুর মাথার ওপর শাড়ি দিয়ে দিল। সুলতানা জড়ানো গলায় বললেন, তুই কি নাসেরকে বিয়ে করবি? হ্যাঁ বলার দরকার নেই। চুপ করে থাকলেই বুঝব তোর অমত নেই।

ফুপু ঘুমাও।

তাহলে তোর মত আছে? আলহামদুলিল্লাহ।

মীরু বলল, তুমি বলেছিলে চুপ করে থাকলেই বুঝবে আমার মত আছে। আমি কিন্তু চুপ করে থাকিনি। আমি কথা বলেছি। আমি বলেছি, ফুপু ঘুমাও।

সুলতানা বললেন, তোর মত থাকুক বা না থাকুক নাসেরের সঙ্গেই তোর বিয়ে হবে। আমি ইস্তেখারা করে এই জিনিস পেয়েছি।

কি করে এই জিনিস পেয়েছ?

ইস্তেখারা। দোয়া-কালাম পড়ে স্বপ্নে ভবিষ্যৎ জানার একটা পদ্ধতি।

কি দেখেছিলে স্বপ্নে?

স্বপ্নে দেখেছি তোরা দুইজন এক থালায় ভাত খাচ্ছিস। চীনা মাটির বড় একটা থালা।

এক থালায় ভাত খাওয়া স্বপ্নে দেখলে কি বিয়ে হয়?

ইস্তেখারার স্বপ্নগুলি আসে প্রতীকের মত। প্রতীক ব্যাখ্যা করতে হয়। আমার ব্যাখ্যায় এইটাই আসে। তোর ব্যাখ্যা কি?

আমার ব্যাখ্যা হল তুমি মনেপ্রাণে চাচ্ছ নাসের সাহেবের সঙ্গে আমার বিয়ে হোক। চাচ্ছ বলেই স্বপ্নে এই জিনিস দেখেছ। উইশফুল থিংকিং থেকে উইসফুল ড্রিমিং। ফুপু তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছ?

সুলতানা জবাব দিলেন না। তিনি আসলেই ঘুমিয়ে পড়েছেন।

মীরু ভেবেছিল সন্ধ্যার দিকে সে নিজে বড় মামার বাসায় যাবে। মাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে আসবে। তিনি আসতে চাইবেন না। রাগেঅভিমান-দুঃখে কান্নাকাটি করবেন। যে কোনো একদিন আটত্রিশটা ঘুমের ওষুধ খাবেন এটা বলবেন এবং হেন্ডব্যাগ খুলে ঘুমের ওষুধ দেখাবেন। সব শেষে একটা শর্তে আসতে রাজি হলেন—স্বামীর সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক নাই এটা সবাইকে স্বীকার করতে হবে। তিনি অন্য ঘরে আলাদা বিছানায় ঘুমাবেন। বাড়িতে স্বামী-স্ত্রীর যত যুগল ছবি আছে সব নামিয়ে ফেলতে হবে।

মীরু আগেও কয়েকবার তার মাকে এনেছে। এবারো আনা যাবে কোনো সমস্যা হবে না। বোকা মানুষদের পরিচালনা করা খুব সহজ।

মাকে আনার জন্যে মীরুকে কোথাও যেতে হল না। জাহেদা দুপুর বেলা নিজেই চলে এলেন। যথারীতি রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন। এক ফাঁকে আফজল সাহেবের ঘরে গিয়ে বললেন, তোমাকে পেঁপে কেটে দেব?

আফজল সাহেব বললেন, দাও। আরেকটা কাজ কর। পায়ের তলা। চুলকাচ্ছে। সরিষার তেল গরম করে মালিশ করে দাও।

জাহেদা বললেন, রূপচান্দা মাছের শুটকি রান্না করছি। তরকারি চড়িয়ে দিয়ে আসি।

আফজল সাহেব দরাজ গলায় বললেন, এসো। কোনো অসুবিধা নাই। চেঁপা শুঁটকি খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। চেঁপা ভরতা কর খেয়ে দেখি।

হার্টের অসুখে ঝাল খেলে সমস্যা নাই তো?

সমস্যা থাকলে থাকবে। তাই বলে সব খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দেব না কি?

তাদের দেখে কে বলবে আজ সকালেই দুজনের ভয়াবহ ঝগড়া হয়েছে। আফজল সাহেব কঠিন গলায় স্ত্রীকে বলেছেন–তোমার সঙ্গে রাস্তার নেড়ি কুত্তির কোনো ডিফারেন্স নাই। নেড়িকুত্তি কাপড় পরে না। তুমি শাড়ি পর— ডিফারেন্স বলতে এই টুকুই।

মীরু পর্দার আড়াল থেকে দেখল তার মা প্রবল বেগে বাবার পায়ে তেল মালিশ করে দিচ্ছেন। মীরুর ইচ্ছা করল মাকে কঠিন কিছু কথা। শোনায়। শোনানো গেল না। কারণ সে প্রতিজ্ঞা করেছে বাবার ঘরে ঢুকবে। না। প্রতিজ্ঞা করা হয় প্রতিজ্ঞা ভাঙার জন্যে। মীরুর প্রতিজ্ঞা ভাঙতে ইচ্ছা করে না।

বাড়ি খালি। ইসমাইল হোসেন সাহেবের সঙ্গে ঝামেলা পাকিয়ে একটাই লাভ হয়েছে— আত্মীয়-স্বজনরা আপাতত এ বাড়িতে কেউ নেই। তবে পুরোপুরি চলেও নিশ্চয়ই যায়নি। দৃষ্টি সীমার বাইরে আছে। আবারো উদয় হবে। বিশেষ করে ইসমাইল সাহেব। ইনি টাকা-পয়সা না নিয়ে গ্রামে ফিরবেন তা কখনো হবে না। খোয়াজ খিজিরের এমন একটা গল্প তিনি নিশ্চয়ই অকারণে তৈরি করেননি।

দুপুরের পর থেকে মীরুর শ্বাসকষ্ট শুরু হল। অথচ শ্বাসকষ্ট শুরু হবার মত কোন ঘটনা ঘটেনি। ঝগড়াঝাটি যা হবার সকালবেলা হয়েছে। সকালের কথা তার মনেও নেই। তাহলে শ্বাসকষ্টটা হচ্ছে কেন? আবহাওয়ার পরিবর্তনের জন্যে?

আকাশ মেঘলা করেছে। বর্ষাকালে এ রকম মেঘলা আকাশ দিনের মধ্যে কয়েকবার হয়। তার জন্যে শ্বাসকষ্ট শুরু হবার কথা না। মীরু ইনহেলারটা হাতে নিয়ে তার নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।

খাটে আধশোয়া হয়ে বসে শ্বাসকষ্ট সামাল দিতে চেষ্টা করল। আজ সে ইনহেলার নেবে না। ইনহেলার নেয়া অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে। শেষে অবস্থা এ। রকম হবে যে একটু পর পর হা করে মুখে ইনহেলার পাফ করতে হবে। দৃশ্যটা কুৎসিত। মীরু কোন কুৎসিত দৃশ্যের অংশ হতে চায় না।

টেলিফোন বাজছে। টেলিফোনটা মীরুর হাতের পাশে। সে যেখানে বসে আছে সেখান থেকে না নড়েও সে টেলিফোন ধরতে পারে। টেলিফোন ধরবে কি ধরবে না তা সে বুঝতে পারছে না। মীরু লক্ষ্য করেছে। শ্বাসকষ্টের সময় টেলিফোন ধরলে মাঝে মাঝে শ্বাসকষ্টটা কমে যায়। অবশ্যি টেলিফোনে যদি ইন্টারেস্টিং কোনো কথাবার্তা হয় তবেই।

মীরুর মনে হচ্ছে নীলুফার নামের মহিলা টেলিফোন করেছেন। যে মহিলার ছেলের নাম টুকটুকি। ছেলেদের নাম টুকটুকি হয় সে আগে কখনো শুনেনি। মহিলা কি তার টেলিফোন নাম্বার দেবার জন্যে টেলিফোন করেছেন? তিনি এখন কি বলবেন? সরি লাইন কেটে গিয়েছিল–টেলিফোন নাম্বারটা লিখে নাও। মীরু বলবে, লাইন কেটে গিয়েছিল না কি আপনি রাগ করে টেলিফোন রেখে দিয়েছিলেন? ভদ্রমহিলা বলবেন, ও আল্লা রাগ করব। কেন শুধু শুধু। তুমি কি রাগ করার মত কিছু করেছ?

টেলিফোন বেজেই যাচ্ছে। মীরু টেলিফোন রিসিভার কানে ধরল। ক্লান্ত গলায় বলল, হ্যালো।

মীরুকে অবাক করে দিয়ে ওপাশ থেকে স্পষ্ট এবং সুন্দর স্বর শোনা গেল।

আপনি আমাকে মনে রেখেছেন কি না বুঝতে পারছি না। ভয়ে ভয়ে টেলিফোন করেছি। আমার নাম নাসের।

কেমন আছেন আপনি?

আমি ভাল আছি কিন্তু আপনার তো মনে হয় শরীর খারাপ।

কেন মনে হল আমার শরীর খারাপ?

গলার স্বর শুনে মনে হল। শ্বাস টানছেন বলে মনে হচ্ছে। আপনার কি এ্যাজমা আছে?

হ্যাঁ, এ্যাজমা আছে। আপনি টেলিফোনে আমার গলা শুনেই বুঝে। ফেললেন আমার এ্যাজমা আছে? না কি ছোট ফুপু আপনাকে বলেছে?

আপনার ছোট ফুপু আমাকে কিছু বলেননি। আপনার ছোট ফুপু আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে দিতে চাচ্ছেন। তিনি আগবাড়িয়ে আপনার দোষ-ত্রুটি আমাকে বলবেন না।

এ্যাজমা আমার দোষের মধ্যে পড়ছে?

অবশ্যই। বিয়ের কনে এবং কোরবানির পশু এক শ্রেণীতে পড়ে। কোরবানির পশু দেখেশুনে কিনতে হয়। এ্যারেঞ্জ ম্যারেজেও মেয়ে দেখেশুনে যাচাই করে নিতে হয়।

ছেলেদের যাচাই করতে হয় না?

না। সোনার চামচ বাকা হলেও সোনার চামচ।

আপনি সোনার চামচ?

নাসের জবাব দিচ্ছে না। তাকিয়ে আছে। মীরুর কপালের চামড়া কুঁচকে এসেছে। সে এখন বড় বড় করে শ্বাস নিচ্ছে।

নাসের শব্দ করে হেসে ফেলল। মীরু বলল, আপনি হাসছেন কেন? আমার কথার জবাব দিন? আপনার ধারণা আপনি সোনার চামচ?

আমি সোনার চামচ না কি এলুমিনিয়ামের চামচ সেই জবাব দিচ্ছি তার আগে আপনি বলুন তো আপনার শ্বাসকষ্টটা পুরোপুরি চলে গেছে না?

মীরু কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, হ্যাঁ চলে গেছে।

নাসের বলল, যখন কারো হেঁচকি উঠে তখন যদি তাকে হকচকিয়ে দেয়া যায় তাহলে হেঁচকি চলে যায়। শ্বাসকষ্টের বেলাতেও একই ব্যাপার। নিজেকে সোনার চামচ বলে আপনাকে হকচকিয়ে দিয়ে শ্বাসকষ্ট দূর করে দিয়েছি। আপনি ইচ্ছা করলে আমাকে ছোট্ট করে একটা থ্যাংকস দিতে পারেন।

মীরু বলল, থ্যাংকস দেবার আগে আপনার কাছে জানতে চাচ্ছিআপনি আমাকে কেন টেলিফোন করেছেন? গল্প করার জন্যে?

হ্যাঁ।

শুধুই গল্প না কি উদ্দেশ্যমূলক গল্প?

উদ্দেশ্যমূলক গল্প।

উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করবেন?

হ্যাঁ করব। আমি চাচ্ছি আপনার কাছাকাছি যেতে। কথাবার্তা বলা ছাড়া সেটা সম্ভব না। যে কোন দুপ্রান্তের যে কোন দুজন শুধুমাত্র কথা বলেই কাছাকাছি আসে।

আমার কাছাকাছি আসতে চাচ্ছেন কেন?

আপনার সুলতানা ফুপুর স্বপ্ন পূরণের জন্যে। আমি ব্যবসায়ী মানুষ তো, আমার চট করে কাউকে পছন্দ হয় না। কারো সঙ্গে পরিচয় হলে আমি নানা ভাবে তাকে যাচাই করার চেষ্টা করি। হিসাব-নিকাশ করতে থাকি। এক সময় বলি– No. চলবে না। আপনার ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। আমি আপনাকে যতই দেখছি ততই ভাল লাগছে।

আপনি কিন্তু আমাকে একবারই দেখেছেন।

ও আচ্ছা তাই তো! তাহলে আমার কেন মনে হচ্ছে রোজই আপনার সঙ্গে আমার একবার করে দেখা হয়?

মীরু শান্ত গলায় বলল, আমার ধারণা আপনি একটা ব্যাপার পুরোপুরি ভুলে গেছেন। বারসাত নামে একজন মানুষের কথা আপনাকে বলেছিলাম। আপনাকে সঙ্গে নিয়ে তার মেসেও গিয়েছিলাম।

নাসের বলল, উনার কথা ভুলিনি। উনার কথা মাথায় রেখেই আপনাকে টেলিফোন করেছি।

তাই বুঝি?

আপনার তাই বুঝি বলাটায় এক ধরনের ব্যঙ্গ আছে। আমি কিন্তু সত্যি সত্যি বারসাত সাহেবের কথা মাথায় রেখেই আপনাকে টেলিফোন করেছি।

তাই?

উনি ঢাকায় ফিরেছেন এই খবরটা আপনাকে জানানোও আমার একটা উদ্দেশ্য ছিল।

মীরু থমকে গেল। নাসের নামের মানুষটার কাণ্ডকারখানা এখন সে। ঠিক বুঝতে পারছে না। এখন তার মনে হচ্ছে নাসের তাকে টেলিফোন করেছে বারসাতের খবর দেবার জন্যে। এতক্ষণ যেসব কাব্যময় কথা বলল। তার সবই খেলা। ইংরেজিতে এই খেলার একটা নামও আছে— Word Gane.

বারসাত কবে ফিরেছে সেটা কি জানেন?

হ্যাঁ জানি। আজ সকালে ফিরেছেন। সাড়ে নটায়।

এতো ডিটেইলে কিভাবে জানেন? আপনি কি স্পাই লাগিয়ে রেখেছিলেন?

হ্যাঁ। অফিসের একজনকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম সে যেন মেসের ম্যানেজারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে।

কেন?

কেনর জবাব এখন দেব না। পরে দেব।

পরে কখন?

আপনার যেদিন বিয়ে হবে সেদিন দেব।

মীরু বলল, কিছু মনে করবেন না আপনার সঙ্গে কথা বলতে এখন আর আমার ভাল লাগছে না। আমি টেলিফোন রেখে দেব।

আপনার শ্বাসকষ্টটা কি ফিরে এসেছে?

হ্যাঁ ফিরে এসেছে।

বুঝতে পারছি আমি হঠাৎ আপনার মেজাজ খারাপ করে দিয়েছি। আমি চাচ্ছি না আপনি আমার ওপর বিরক্ত হন। আপনি বলুন কি করলে আপনার বিরক্তি কমবে? আমি তাই করব। স্পাই কেন লাগিয়ে রেখেছিলাম সেটা বলব?

মীরু টেলিফোন নামিয়ে রাখল।

আকাশ কালো হয়ে আছে। যে কোন মুহূর্তে হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামবে। বৃষ্টি নামার আগেই তাকে বারসাতের মেসে উপস্থিত হতে হবে। সামান্য বৃষ্টিতেই বারসাতের মেসের সামনে পানি জমে যায়। মেসে ঢুকতে হলে নোংরা পানিতে পা ডুবিয়ে ঢুকতে হয়। ঘেন্নার ব্যাপার। সে এখন সুন্দর একটা শাড়ি পরবে। নতুন স্যান্ডেল পরবে। নোংরা পানিতে পা ডুবাতে পারবে না।

খুব সাবধানে কে যেন দরজা খুলছে। ভৌতিক ছবিতে দরজা যেভাবে খোলা হয় অবিকল সেইভাবে। প্রায় নিঃশব্দে। মীরু দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে তার মা। কিছু একটা ঘটেছে–মার বয়স মনে হচ্ছে দশ বছর কমে গেছে। তার চেহারায় এবং তাকানোর ভঙ্গিতে খুকি খুকি ভাব।

মীরু ঘুমোচ্ছিস?

না।

বিরাট একটা ঘটনা ঘটেছে।

কি ঘটনা?

আন্দাজ করতো কি ঘটনা?

আন্দাজ খেলা এখন খেলতে পারব না মা। কি ঘটেছে বলতে চাইলে বল। বলতে না চাইলে চলে যাও।

জাহেদা ফিসফিস করে বললেন, তোর বাবা রুনিকে ক্ষমা করে দিয়েছে। আমাকে একটু আগে বলেছে, রুনিকে বাড়ি ফিরতে বল। বিরাট ঘটনা না?

হ্যাঁ। কিন্তু তুমি ফিসফিস করছ কেন? ফিসফিস করার মতো ঘটনা তো এটা না।

জাহেদা মেয়ের পাশে বসলেন। গলার স্বর আরো নামিয়ে ফেলে বললেন, দুপুরে ভাত খাবার পর তোর বাবা বলল, আমাকে কাঁচা সুপারি। দিয়ে একটা পান দাও তো। কাঁচা সুপারি হার্টের জন্যে ভাল। ঘরে কাঁচা সুপারি ছিল। আমি দিলাম পান বানিয়ে। পান খেতে খেতে হঠাৎ বলল, আমি এতদিন হাসপাতালে ছিলাম তোমার বড় মেয়ে কি আমাকে দেখতে গেছে?

আমি বললাম, না।

তোর বাবা বলল, দেখতে আসেনি কেন?

আমি বললাম, ভয়ে আসেনি। তাকে দেখে তোমার যদি প্রেসার উঠে যায়। এই সময় প্রেসার খুবই ক্ষতিকর।

তখন তোর বাবা বলল, ওকে আসতে বল। বিছানা বালিশ নিয়ে যেন চলে আসে। অদ্ভুত না?

মীরু জবাব দিল না। হাই তুলল। জাহেদা বললেন, মীরু আমাকে একটা সাজেশান দে। আমি নিজে গিয়ে নিয়ে আসব। না কি টেলিফোনে চলে আসতে বলব।

যেটা তুমি ভাল মনে কর সেটাই কর।

আমার কি যে ভাল লাগছে। তোর শরীর খারাপ না কি রে মীরু। চোখ-মুখ কেমন শুকনা।

শরীর খারাপ না।

জাহেদা আনন্দময় গলায় বললেন, রুনির বাড়ি ফেরার পেছনে তোর সুলতানা ফুপুর একটা ভূমিকা আছে। সুলতানার কাছে তোর বাবা শুনলেন যে তুই নাসেরকে বিয়ের ব্যাপারে মত দিয়েছিস। এটা শুনেই তোর বাবার মন ভাল হয়ে গেল। তোর বাবা ঠিক করেছে তোর বিয়ে হবে দেশের বাড়িতে। ঢাকা থেকে বরযাত্রীকে গ্রামে যেতে হবে। তোর বাবা রেল স্টেশনে হাতী রাখবে। হাতীতে চড়ে বরযাত্রী যাবে। বিয়ে উপলক্ষে মেমানি। হবে। মেমেনি বুঝিস? মেমানি হল গণ-খাওয়া। একটা গ্রামের সব মানুষকে যদি দাওয়াত করে খাওয়ানো হয় তখন তাকে বলা হবে মেমানি।

মীরু মার দিকে তাকিয়ে আছে। মা কি বলছেন তা এখন আর তার মাথায় ঢুকছে না। সে জানালা খুলল। আকাশ মেঘে মেঘে কালো হয়ে আছে। যে কোন সময় বৃষ্টি নামবে।

জাহেদা বললেন, হাতী দিয়ে বরযাত্রী নেয়ার আইডিয়া তোর কাছে কেমন লাগছে?

হাস্যকর লাগছে।

হাস্যকর কেন লাগবে? আমার তো মনে হয় সবাই পছন্দ করবে।

বরযাত্রীদের কেউ কেউ হাতী থেকে পিছলে পড়ে ব্যথা পেতে পারে মা।

জাহেদা বিরক্ত গলায় বললেন, অদ্ভুত সব চিন্তা শুধু তোর মাথাতেই আসে। হাতী থেকে পিছলে পড়বে কেন?

মীরু বলল, পিছলে পড়বে কারণ হাতীতে চড়ে কারোর অভ্যাস নেই। নতুন ধরনের কিছু করতে চাইলে কর তবে এমন কিছু কর যাতে রিস্ক নেই। যেমন বরযাত্রীদের ঠেলাগাড়িতে করে নেয়ার ব্যবস্থা কর।

মীরু চুপ কর।

মীরু হাই তুলতে তুলতে বলল, মা শোন আমি যদি আমার নিজের পছন্দের কাউকে বিয়ে করি তাহলে বাবা কি করবে? হাতী দিয়ে লাথী দেয়াবে?

জাহেদা হেসে ফেললেন। মীরু মাঝে মাঝে এমন মজা করে কথা বলে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress