দুটা মাছি ভন ভন করছে
বারসাতের মুখের ওপর অনেকক্ষণ ধরে দুটা মাছি ভন ভন করছে। একটা বড় একটা ছোট! বড়টার রঙ ঘন নীল। বারসাত বিস্মিত চোখে মাছি দুটার দিকে তাকিয়ে আছে। বৃষ্টি-বাদলার সময় মাছি উড়ে না। বৃষ্টি শুরু হলেই মাছিরা যে যেখানে আছে সেখানে ঝিম ধরে বসে থাকে। বৃষ্টির পানি পাখায় লাগলে মাছিদের উড়তে অসুবিধা হয় বলেই তাদের এত সাবধানতা।
অথচ এই মাছি দুটা উড়েই যাচ্ছে। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। সেদিকেও তাদের নজর নেই। তারা উড়ে উড়ে জানালা পর্যন্ত যাচ্ছে আবার ফিরে এসে বারসাতের নাকের কাছাকাছি ওড়াউড়ি করছে। বারসাতের কেন জানি মনে হচ্ছে এই মাছি দুটার একটা (বড়টা যেটার গায়ের রঙ ঘন নীল।) তার নাকের ফুটো দিয়ে ঢুকে পড়ার চেষ্টায় আছে। যে কোনো। মুহর্তে এই কাজটা সে করবে।
খুবই অদ্ভুত চিন্তা-ভাবনা। মাছিরা এমন কাজ কখনো করবে না। তারা জাপানি কামাকাজি পাইলট না। বারাসাত তাদের শত্রুও না। তারপরেও সে এই চিন্তা মাথা থেকে দূর করতে পারছে না। জ্বর বেশি হলে মানুষের মাথায় উদ্ভট চিন্তা আসে। বারসাতের গায়ে জ্বর। বেশ ভালোই জ্বর। মাথার ভেতর এরোপ্লেন চলার মতো শব্দ হচ্ছে। জ্বর খুব বেড়ে গেলে মাথার ভেতর এরোপ্লেন চলার মতো শব্দ হয়। এরকম জ্বর-তপ্ত মাথায় উদ্ভট চিন্তা আসতেই পারে।
বারসাত শুয়ে আছে তার দূর-সম্পর্কের মামার বাগানবাড়িতে। বাড়ির নাম পদ্মাকাঠের একতলা বাড়ি। বড় বড় জানালা। জানালা খুললেই চোখে পড়ে বাড়ির পেছনের পদ্ম পুকুর। পুকুরে সত্যিকার পদ্ম ফুটে আছে। মীরু এই বাড়ি দেখলে মুগ্ধ হত। সেটা সম্ভব হল না। মীরু আসেনি, বারসাতকে একা আসতে হয়েছে। বারসাত তিন বেহালাবাদক ঠিক করে রেখেছিল। এরা পদ্ম নামের বাড়ির উঠানে বসে থাকবে। বারসাত এবং মীরুর বাড়ির গেট দিয়ে ঢুকতে দেখলে বেহালায় বাজাতে থাকবে—
লীলাবালী লীলাবালী
বড় যুবতী কন্যা কি দিয়া সাজাইতাম তরে?
বারসাতের আসতে দেরি দেখে তিন বেহালাবাদকের মধ্যে দুজন বারান্দার সোফায় লম্বা হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। একজন জেগে রইল। সেই একজন বারসাতকে একা ঢুকতে দেখে খানিকটা বেদিশা হয়ে গেল। তারপরেও সে বেহালা হাতে নিল। বাজাব না-কি বাজাব না ভঙ্গিতে তাকাল। বারসাত বলল, লাগবে না। বেহালা বাজানোর দরকার নেই।
বেহালাবাদক বলল, আপনার কী হয়েছে? চোখ টকটকা লাল।
বারসাত বলল, আমার কিছু হয় নাই, চোখে লাল রঙ মেখেছি। মেয়েরা ঠোটে লিপস্টিক দেয়। আমি ঠোটে দিয়েছি আই স্টিক। আপনাদের তো টাকা-পয়সা আগেই দিয়ে রেখেছি এখন বাড়ি চলে যান। বিদায়।
বাজনা বাজাব না?
বাজনা বাজাতে হবে না। বাজনার দরকার ছিল আমার স্ত্রীর জন্যে। স্ত্রী নাই, বাজনাও নাই।
উনি কোথায়?
জানি না উনি কোথায়। আপনারা বিদায় হন। টা টা বাই বাই।
ভাই সাব আপনার কি জ্বর? আপনি তো দাঁড়ায়ে থাকতে পারতেছেন না।
বারসাত বলল, দাঁড়িয়ে থাকতে না পারলেও কোনো সমস্যা নেই। আমি এক্ষুনি বিছানায় শুয়ে পড়ব। এক মাস ঘুমাব। গিনিস বুক অব রেকর্ডে নাম তুলে ফেলব। একবিংশ শতাব্দীর রিপ ভ্যান উইংকেল।
বারসাত কতক্ষণ ঘুমুচ্ছে বা কতক্ষণ ঘোরের মধ্যে আছে তা সে জানে না। তার কাছে মনে হচ্ছে সে বেশির ভাগ সময় অচেতন অবস্থাতেই থাকে। মাঝে মাঝে সামান্য চেতনার মতো আসে তখন পদ্ম নামের বাগানবাড়ির কেয়ারটেকারের সঙ্গে তার কিছু কথাবার্তা হয়। কেয়ারটেকারের নাম রফিক। রফিকের চেহারা বারসাতের কাছে একেক সময় একেক রকম মনে হয়। প্রবল জ্বরের কারণেই এরকম হচ্ছে এটা বারসাত বুঝতে পারছে। মেয়েরা সাজগোছ করে চেহারা বদলায়। ছেলেদের চেহারা বদলায় না। রফিকের চেহারা একেক সময় একেক রকম দেখানোর আর কোনো কারণই নেই। জ্বর বারসাতের মাথা এলোমেলো করে দিচ্ছে।
জ্বর খুব যখন বাড়ছে তখন আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে। মাথার ভেতর ঝিঝি পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। এক পর্যায়ে ঝিঝি পোকার ডাকটা বেহালার শব্দের মতো হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে তিন বেহালাবাদক বাজাচ্ছে—
লীলাবালী লীলাবালী
বড় যুবতী কন্যা কি দিয়া সাজাইতাম তরে।
বারসাত ডাকল, রফিক রফিক
রফিক প্লেটে করে কাটা পেঁপে নিয়ে ঢুকল। যে কোনো খাদ্যদ্রব্য দেখলেই বারসাতের সমস্ত শরীর মোচড় দিয়ে ওঠে। ইচ্ছা করে খাদ্যদ্রব্য নিয়ে যে ঢুকেছে তার গায়ে বমি করে ভাসিয়ে দেয়। এবারো একই ঘটনা ঘটল। বারসাত নিজেকে সামলে নিয়ে অনেক কষ্টে প্রায় আদুরে গলায় বলল, কেমন আছ রফিক?
রফিক হড়বড় করে বলল, আমি তো ভালোই আছি। আফনের অবস্থাটা কী কন দেহি।
আমিও ভালোই আছি শুধু এই মাছি দুটা খুব বিরক্ত করছে। মাছি দুটা মারতে পারলে একশ টাকা বকশিশ পাবে। বড় মাছিটা মারতে পারলে পাবে সত্তর টাকা আর ছোটটা মারতে পারলে ত্রিশ। দেখ তো মারতে পার কি না।
একশ টাকা বকশিশ রফিককে কাবু করতে পারল না। সে পেঁপের প্লেট বিছানার পাশের টেবিলে রাখল। কঠিন কোনো কথা বলবে এর রকম ভঙ্গিতে বারসাতের খাটের পাশে এসে দাঁড়াল। থমথমে গলায় বলল, স্যার আমি আপনেরে দুইটা কথা বলব মন দিয়া শুনেন।
বারসাত বলল, তোমার কথা আমি মন দিয়েই শুনি রফিক। মীরুর কথা যতটা মন দিয়ে শুনি ততটা মন দিয়ে হয়তো শুনি না। সেটা সম্ভবও না। তারপরেও…
স্যার আপনি কথা কইয়েন না। আমি কী বলতেছি শুনেন। আপনার আল্লাহর দোহাই লাগে।
বল শুনছি।
আপনের শরীর খুবই খারাপ। আপনারে এইখানে রাখতে কোনো ভরসা পাই না। আপনের এইখানে মৃত্যু হলে আমরা বিরাট বিপদে পড়ব।
বিপদের কী আছে? মানুষের মৃত্যু হয় না? মৃত্যু হলে এখানে কবর দিয়ে দিবে। কিংবা আমাকে ইটসহ বস্তায় ভরে পদ্ম পুকুরে ফেলে দেবে। কোনো সমস্যা নাই।
স্যার শুনেন, উল্টাপাল্টা কথা বলে লাভ নাই। আজ সন্ধ্যায় আমি টেম্পো ভাড়া করে আনতেছি। আমি আপনারে নিজে ঢাকায় দিয়ে আসব।
রফিক এখন তুমি আমার কথা মন দিয়ে শোনো আমার শরীরের যে অবস্থা–পথেই মারা যাব তখন তুমি বিরাট বিপদে পড়বে। পুলিশ তোমাকে ধরে নিয়ে যাবে। তোমার সঙ্গে নিরীহ বেবিটেক্সিওয়ালাকে ধরে নিয়ে যাবে। হেভি প্যাদানি দেবে। পুলিশের পাদানি খেয়েছ কখনো? মারাত্মক জিনিস।
স্যার আপনি ঢাকার বাড়ির আত্মীয়-স্বজনের ঠিকানা দেন। আমি তাদের নিয়া আসি।
তোমাকে এইসব কিছু করতে হবে না। আমি শরীরে বল পাওয়া শুরু করেছি। এক-দুই দিনের ভেতর উঠে বসব। তখন তুমি একটা বেবিটেক্সি ডেকে আনবে। আমি বেবিটেক্সিতে উঠে ফুড়ুৎ করে চলে যাব। আমার সঙ্গে তোমাকে আসতে হবে না। কাজেই পথে যদি মারা যাই তোমাকে কেউ ধরবে না। বেবিটেক্সিওয়ালাকে ধরবে।
স্যার আপনি এত কথা বলতেছেন কেন?
শরীর যে ঠিক হতে শুরু করেছে এটা তোমাকে বোঝানোর জন্যে এত কথা বলছি। এখন তুমি দয়া করে পেঁপের পিরিচটা সামনে থেকে নাও। তোমাকে তো বলেছি আমার সামনে কোনো খাদ্যদ্রব্য আনবে না। আমি বাতাস খেয়ে বাঁচব। এখন থেকে আমি বায়ু-ভুক।
আজকেও কিছু খাবেন না?
না। কিছু না খাওয়াও এক ধরনের চিকিৎসা। এই চিকিৎসার নাম উপবাস চিকিৎসা।
অন্য কিছু খাইতে ইচ্ছা করে?
এই মুহূর্তে একটা জিনিস খেতে ইচ্ছা করছে। জিনিসটার নাম মার্বেল সিঙাড়া। মার্বেলের সাইজ। একসঙ্গে দুটা-তিনটা মুখে দেয়া যায়। মগবাজার কাজি অফিসের কাছে এই সিঙাড়া বানানো হয়। মীরুর খুবই পছন্দের খাদ্য। একবার সে আটত্রিশটা সিঙাড়া খেয়ে ফেলেছিল। তখন আমি তাকে টাইটেল দিলাম সিঙাড়া কন্যা। এই অপূর্ব সিঙাড়া যে কারিগর বানায় তার নাম নেক মর্দ। অদ্ভুত নাম না?
রফিক জবাব দিল না। পেপের প্লেট নিয়ে চলে গেল। বারসাত চিৎ অবস্থা থেকে পাশে ফিরল। তার মাথায় কবিতার লাইন আসছে। সবই উল্টা হয়ে আসছে। ব্যাপারটা কী? মাথা কি পুরো খারাপ হয়ে গেল–
য়াখিরা নম্পক ন্নক্ষু ব্ধক্ষু ন্তেপ্রালজ
য়াকিআঁ যাকিআঁ গুচিণরচ লজস
বারসাত বুঝতে পারছে না তার পৃথিবী উল্টো হয়ে যাচ্ছে কি না। মাথার ভেতর বড় রকমের কোনো ঝামেলা অবশ্যই হচ্ছে। হোক ঝামেলা। মাথার ভেতর উলটপালট ঝামেলা হলে খারাপ লাগে না।
Ring a ring O roses
A pocket full of poises
Atishoo! Atishoo!
We alf fall down.
এই কবিতাটা মাথায় উল্টা আসেনি। ঠিকমতোই এসেছে। ১৬৬৫ সনে লন্ডনে যখন ভয়াবহ plague দেখা দিল তখন লন্ডনের ছেলেমেয়েরা এই ছড়াটা রাস্তায় রাস্তায় বলে বেড়াত। We all fall do down. আমরা সবাই মরে পড়ে যাব। কারণ আমাদের হয়েছে ভয়াবহ ব্যাধি–প্লেগ!
রফিক রফিক।
রফিক বিরক্ত মুখে দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। বারসাত বলল, তাড়াতাড়ি বালতিটা আনো। আমি বমি করব। বমির টাইম চলে এসেছে। বমি করার পর কী হবে জানো? We all fall down.
রফিক বালতি নিয়ে এসেছে। বালতির রঙ ঘন লীল। রঙটা চোখে লাগছে। অসুস্থ অবস্থায় কটকটা হলুদ রঙ চোখে লাগে। লাল রঙ লাগে। নীল রঙ কি লাগে?
রফিক!
জি স্যার।
আমি আর বাঁচব না। আমার আত্মীয়-স্বজনকে খবর দাও।
স্যার বলেন কারে খবর দিব।
আমার মাকে খবর দিতে পার। তাকে খবর দেবার সমস্যা কী জানো? তিনি এসেই আমার সঙ্গে ঝগড়া শুরু করবেন। ক্যাটক্যাট কথা বলবেন। এমন সব কথা যা শুনলে নিতান্ত ভালোমানুষের গায়েই আগুন ধরে যাবে।
স্যার কথা না বলে চুপ করে শুয়ে থাকেন। রেস্ট নেন।
কথা বলাতেই আমার রেস্ট হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের একটা বিখ্যাত গান আছে— আমার এই কথা বলাতেই আনন্দ। উঁহু ভুল করেছি, গানটা হচ্ছে— আমার এই পথ চলাতেই আনন্দ। রফিক।
জি।
তুমি বিরক্ত মুখ করে হলেও আমার যথেষ্ট সেবা করেছ। আমি যদি কোটিপতি হতাম তাহলে উইল করে তোমাকে লাখ বিশেক টাকা দিয়ে। যেতাম। আমি হতদরিদ্র। বাজারে আমার দেনা হল তেইশ হাজার টাকা। বিয়ে যে আমার হয়নি সেটা একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। রফিক!
জি।
দুটা মাছি আমার নাকের কাছে ভ্যান ভ্যান করছিল। এরা কোথায় গেছে একটু দেখ তো। এদেরকে ধরার জন্যে একশ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিলাম। জীবিত বা মৃত একশ টাকা দেয়া হবে।
স্যার আপনি শুয়ে থাকেন আমি মাথায় পানি ঢালি।
যা ঢালতে ইচ্ছা হয় ঢাল। একটাই শুধু কথা, আমার মা যদি আমার খোঁজে চলে আসে তাহলে বলবে আমি মারা গেছি। বলতে পারবে না?
অবশ্যই বলতে পারবে। বলতে না পারার কিছু নেই। সামান্য মিথ্যা বলা হবে। তবে ঠিক মিথ্যাও না। আমি তো মারাই যাচ্ছি। আমি যদি অতি বিখ্যাত কেউ হতাম তাহলে তুমি একটা বই লিখতে পারতে–
বারসাত আলীর সঙ্গে
শেষ কিছু সময়।
আমি বিখ্যাত কেউ না। বিখ্যাত কেউ হবার কোনো সম্ভাবনাও আমার মধ্যে নেই। আমার মত মানুষরা জীবন শুরু করে প্রাইভেট টিউটর হিসেবে। জীবন শেষ করে কোচিং সেন্টারের ম্যানেজার হিসেবে।
রফিক বারসাতের মাথায় পানি ঢালতে শুরু করেছে। বারসাত কথা। বলা বন্ধ করেছে। তবে এখন তার অন্য সমস্যা দেখা দিয়েছে। তার কাছে। মনে হচ্ছে বিছানার পাশে তার মা দাড়িয়ে আছেন। তাঁর মুখ থেকে জর্দার গন্ধ পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে। জর্দার কড়া গন্ধের কারণে বারসাত বুঝতে পারছে না— তার মা কি সত্যি সত্যি চলে এসেছেন না কি সে যা দেখছে। ঘোরের মধ্যে দেখছে।
মাকে দেখতে ইচ্ছা করছে না। বারসাত চোখ বন্ধ করল। তাতেও লাভ হল না। চোখ বন্ধ অবস্থাতেও সে তার মাকে পরিষ্কার দেখতে পেল।
লাভের মধ্যে লাভ আগের মা জর্দার গন্ধ নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। ছিলেন। এই মা কথা বলা শুরু করলেন।
এই তোর কী হয়েছে?
জানি না।
শরীর থেকে চামড়া উঠছে না কি?
শরীর থেকে চামড়া উঠবে কেন? আমি কি সাপ?
শরীর থেকে চামড়া ওঠা রোগ তোর বাপেরও হয়েছিল। এই রোগেই সে মারা গেল। এটা তোদের বংশের ধারা। চামড়া ওঠা রোগে মৃত্যু।
দুষ্ট লোকে বলে বাবা মারা গেছেন তোমার ক্যাটক্যাটানি শুনে। বাবা যখন মৃত্যুশয্যায় তখনো তুমি তার কানের কাছে দিনরাত ক্যাটক্যাট করেছ।
তোর বাপের সঙ্গে কী করেছি সেটা তোর বাপের আর আমার ব্যাপার। রোজ হাশরে আমার মধ্যে আর তোর বাপের মধ্যে ফয়সালা হবে।
ফয়সালা হলে তো ভালোই।
লোকমুখে শুনলাম তুই গোপনে বিয়ে করেছিস।
বিয়ে করার চেষ্টা করেছিলাম মা। শেষ মুহূর্তে পাত্রী আসেনি বলে বিয়ে হয়নি।
তাহলে তো ভালোই হল। এখন তুই আমার বোনের মেয়েকে বিয়ে কর।
ফাতিলকে বিয়ে করতে বলছ?
ফাতিলটা আবার কে?
লতিফাকে উল্টো করে বললাম ফাতিল। এখন বেশির ভাগ শব্দ আমার। মাথায় উল্টো করে আসছে।
লতিফার মত মেয়ে পাবি না। তোকে সে মাথায় করে রাখবে। একশ বার লাথি দেবার পরেও মাথা নিচু করে রাখবে। কোনো শব্দ করবে না।
বারসাত গুনগুন করে বলল,
লাথি-কন্যা নাম
আজ আমি তোমাকে দিলাম।
কী বললি?
একটা কবিতা বলেছি মা।
কী কবিতা?
লতিফাকে নিয়ে কবিতা। তুমি কি একটা কাজ করবে? লতিফাকে পাঠিয়ে দেবে। আমি অসুস্থ মানুষ। সে আমার সেবা করুক।
তুই কি পাগলটাগল হয়ে গেলি? একটা কুমারী মেয়েকে এমন নির্জন জংলা টাইপ জায়গায় একা পাঠিয়ে দেব? তোর চিন্তা-ভাবনা তো ভালো না। তোর চিন্তা-ভাবনাও দেখি তোর বাবার মত।
বাবার চিন্তা-ভাবনা এ রকম ছিল?
হুঁ। আমি তোর বড় বোনের জন্মের সময় এক মাস ছিলাম হাসপাতালে। হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে দেখি তোর বাবা অল্প বয়েসী এক কাজের বুয়া রেখেছে। সেই বুয়া ঠোটে লিপস্টিক মাখে। তোর বাবার দিকে তাকিয়ে কেমন করে জানি হাসে।
তুমি কি করলে, ঝেঁটিয়ে বিদায় করলে?
বিদায় করব কি? তোর বাবা বিদায় করতে দিলে তবে না বিদায় করব। একদিন দেখি কি সে তোর বাবার পিঠে তেল মালিশ করে দিচ্ছে।
ঐ বুয়ার নাম কি ছিল মা?
রানী।
শেষ পর্যন্ত তাকে বিদায় করলে কি ভাবে মা?
কি কষ্টে যে বিদায় করেছি তা শুধু আমি জানি আর আল্লাহপাকে জানেন। তোর বাবা তাকে ছাড়াবে না, সেও এই বাড়ি ছেড়ে যাবে না।
উনি দেখতে কেমন ছিলেন মা?
উনি উনি করছিস কেন? কাজের বুয়ার আবার উনি কি।
দুষ্টু লোকে যে বলে বাবা গোপনে ঐ বুয়াকে বিয়ে করেছিলেন সেই জন্যেই সম্মান করে উনি বলছি।
এক থাপ্পড় দিয়ে আমি তোর দাঁত ফেলে দেব।
ছড়া শুনবে মা?
কী শুনব?
ছড়া। ইংরেজি ছড়া—
Atishoo! Atishoo!
We all fall down.
এর মানে কী?
এর মানে হল আমাদের সবারই প্লেগ রোগ হয়েছে। আমরা সবাই মরে। পড়ে থাকব তুমি, আমি, রানী বুয়া, লতিফা, ঐন্দ্রিলা, নীলুফার।