বারসাত আনন্দমাখা গলায় বলল
বারসাত আনন্দমাখা গলায় বলল, বৃষ্টি দেখেছেন? কেমন ঝুম ঝুমান্তি নেমেছে। শ্রাবণ মাসে টিপটিপ বৃষ্টি হয়। ঝুম বৃষ্টি হয় না। আবহাওয়া আসলেই বদলে যাচ্ছে। ওজোন স্কেয়ার ফুটো হয়ে গেছে। বারসাত জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকাল। ফুটো হওয়া ওজোন ফেয়ার দেখার জন্যে কি না কে জানে। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে সে ফুটো দেখতে পাচ্ছে।
নীলুফার কৌতূহলী হয়ে বারসাতকে দেখছে। মানুষটার আনন্দ আনন্দ ভাব তার কাছে অদ্ভুত লাগছে। আজ বারসাতের বিয়ের দিন। আনন্দ ভাব থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু বিয়ের কনের দেখা নেই। এগারোটার মধ্যে মেয়ের আসার কথা। এখন বাজছে একটা। নীলুফারের মনে হচ্ছে কনের দেখা শেষ পর্যন্ত পাওয়া যাবে না। অথচ বারসাতের মধ্যে এ নিয়ে কোনোরকম টেনশান দেখা যাচ্ছে না। বরং তাকে আনন্দিত মনে হচ্ছে। এই আনন্দ নিশ্চিয়ই লোক দেখানো আনন্দ—Fake happyness.
বারসাত বলল, বৃষ্টির ফোঁটার সাইজ ম্যাক্সিমাম কত বড় হতে পারে জানেন ভাবি?
নীলুফার না-সূচক মাথা নাড়ল।
বারসাত বলল, বৃষ্টির ফোঁটার রেকর্ডেড বড় সাইজ হল— পিং পং বলের সাইজ। ভেনিজুয়েলায় ১৮৭০ সনে এই সাইজের বৃষ্টি হয়েছিল। সেখানকার চার্চের রেকর্ড বইয়ে রেকর্ড করা আছে।
নীলুফার কিছু বলল না। সে এসেছে বারসাতের বিয়েতে একজন সাক্ষী হিসেবে। সে ভেবেছিল দুপুর বারোটার মধ্যে সব শেষ হয়ে যাবে। সে চলে যেতে পারবে। তার ছেলে টুকটুকির স্কুল ছুটি হয় দুপুর দুটায়। তার আগেই তাকে যেতে হবে। ছেলেকে স্কুল থেকে আনার আর কেউ নেই। বারসাতকে চলে যাবার কথা বলতে মায়া লাগছে। নীলুফারের ধারণা বারসাত এখনো আশা করে আছে মীরু নামের মেয়েটা চলে আসবে।
বারসাতের চেহারায় আনন্দ এখনো ঝলমল করছে। তাকে দেখতে সুন্দর লাগছে। হালকা হলুদ রঙের হাফ শার্ট পরেছে। শার্ট থেকে হলুদের আভা চলে গেছে মুখে।
ভাবী চা খাবেন?
না। আমি ঘন ঘন চা খাই না।
বৃষ্টি দেখতে দেখতে চা খেতে ভালো লাগে।
তুমি খাও। বারসাত আমার যে এখন উঠতে হয়। ছেলেকে স্কুল থেকে আনতে হবে।
বারসাত বলল, ভাবী আমার মনে আছে। ওর স্কুল ছুটি হবে দুটায়। আপনাকে দেড়টার সময় উঠলেই চলবে। এখনো আপনার হাতে পঁচিশ মিনিট সময় আছে।
নীলুফার বলল, মেয়েটার বাসায় টেলিফোন নেই? তুমি টেলিফোনে খোঁজ নাও না কেন?
এক ফাঁকে চেষ্টা করে এসেছি। ওদের টেলিফোন নষ্ট।
রিং হয়?
মনে হচ্ছে রিং হয়। কিন্তু কেউ তো ধরছে না।
নীলুফার বলল, শেষ মুহূর্তে মেয়ে মত বদলায়নি তো?
বারসাত বলল, বদলাতে পারে। মেয়েরা কেন জানি কাজির অফিসে এসে বিয়ে করার টেনশানটা নিতে পারে না। বাড়ি থেকে বের হবার আগ মুহর্তে মত বদলায়। কাজের মেয়ের সঙ্গে লুডু খেলতে বসে।
লুডু খেলতে বসে মানে?
কথার কথা বললাম।
বারসাত হাসছে। শব্দ করেই হাসছে। নীলুফার বলল, হাসছ কেন?
বারসাত বলল, মজার একটা কথা মনে করে হাসছি। মাঝে মাঝে। এমনও হয় কাজি অফিসের টেনশানের উত্তাপে সাত বছরের প্রেমও উড়ে যায়। প্রেমিককেই চিনতে পারে না বিয়ে তো দিল্লি হনুজ দূর অস্ত।
প্রেমিককেই চিনতে পারবে না কেন?
আমার নিজের চোখে দেখা। আমার বন্ধু রকিবুল কাজি অফিসে বিয়ে করবে। আমি সাক্ষী। মেয়ের বিকেলে আসার কথা। রাত আটটা বেজে গেল মেয়ের খোঁজ নেই। রকিবুল গেল টেলিফোন করতে। মুখ শুকনা করে ফিরে এল। মেয়ে তাকে চিনতে পারছে না। টেলিফোনে রকিব যতই বলে— আমি রকিব। মেয়ে বলে, কোন রকিব? হা হা হা।
হাসছ কেন?
মজা পেয়ে হাসছি ভাবী।
নীলুফার বলল, তুমি মনে হয় সব কিছুতেই মজা পাও।
বারসাত বলল, আসলে আমি কোনো কিছুতেই মজা পাই না। কিন্তু ভঙ্গি করি সব কিছুতে মজা পাচ্ছি।
তার মানে তুমি এখন মজা পাচ্ছ না?
একটু কম পাচ্ছি।
মেয়েটার জন্যে আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবে?
চারটা পর্যন্ত অপেক্ষা করব।
চারটা কেন?
মীরুকে বলে রেখেছিলাম আমি অবশ্যই চারটা পর্যন্ত অপেক্ষা করব। ভাবী আপনার কি ক্ষিধে লেগেছে। কিছু খাবেন? এখানে একটা দোকান আছে মিনি সিঙাড়া পাওয়া যায়। প্রায় মার্বেলের মতো সাইজ। খেতে অসাধারণ। নিয়ে আসি?
নীলুফারের মনে হল বারসাতের ক্ষিধে পেয়েছে। টেনশানে সে হয়তো সকালে নাস্তাই করেনি। মিনি সিঙাড়া খাওয়ার কোনো ইচ্ছাই নীলুফারের করছে না। বারসাতের কথা ভেবে সে বলল, চট করে নিয়ে এসো।
বারসাত সিঙাড়া আনতে পারল না। আজ সিঙাড়া বানানোর কারিগর আসেনি। বারসাত ফিরল কাক ভেজা হয়ে। নীলুফার বলল, এ কী অবস্থা! এমন ভিজা কী করে ভিজলে?
ইচ্ছা করে ভিজলাম ভাবী। যখন দেখলাম সিঙাড়া বানানোর কারিগর আসেনি তখন এমন মেজাজ খারাপ হল যে রাস্তায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। বৃষ্টিতে ভিজে যদি গরম মেজাজ একটু ঠাণ্ডা হয়।
ঠাণ্ডা হয়েছে?
কিছুটা হয়েছে।
নীলুফার বলল, আমাকে এখন যেতে হবে। তুমি অপেক্ষা কর। আমার মোবাইল টেলিফোন খোলা থাকবে। মেয়েটা যদি এসে পরে আমাকে টেলিফোন করবে।
আচ্ছা।
না এলেও করবে। কী হয়েছে পুরোপুরি না জানা পর্যন্ত আমার অস্থীর ভাব যাবে না।
ভাবী চারটার পর নিউজ বুলেটিন প্রচার করা হবে।
নীলুফার বলল, তোমাকে আমি এখন ছোট্ট একটা উপদেশ দিতে চাচ্ছি। দেব?
দিন।
ঠাণ্ডায় তোমার গা কাপছে। তোমাকে দেখেই মনে হচ্ছে তোমার জ্বর আসবে। চারটা পর্যন্ত অপেক্ষা করার দরকার নেই তুমি চলে যাও। কাজি সাহেবকে বলে যাও–ঐন্দ্রিলা নামের মেয়েটা এলে যেন তাকে বলা হয় তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে। ঠিক আছে?
বারসাত হাসল। কিছু বলল না।
নীলুফার বলল, বাসায় যেতে না চাও থাক এখানে। অপেক্ষা কর। একটা টাওয়েল জোগাড় করে মাথাটা মোছার ব্যবস্থা কর।
বারসাত আবারো হাসল।
তার মাথায় অন্য পরিকল্পনা খেলা করছে। তার ইচ্ছা করছে ঝুম বৃষ্টিতে ভালোমতো ভিজে সত্যি সত্যি একটু অসুখ বাধাতে। বেশ কিছুদিন ধরে তার শরীর অতিরিক্ত রকমের ভালো যাচ্ছে। অসুখ-বিসুখ কিছু হচ্ছে না। শেষবার হল ভাইরাল ফিভার। বিছানায় তিনদিন শুয়ে থাকা। বিছানা থেকে উঠে বসলেই মাথা চক্কর দিত। চক্করটা খারাপ লাগত না। পর্দা সরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলে চোখ কড়কড় করত। মাথা ধকধক করত। দুটাই কেন জানি ভালো লাগত। অসুখও উপভোগ করতে জানতে হয়।
বারসাত বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়াল। ভেজার উদ্দেশে বৃষ্টিতে নামলেই বৃষ্টি কেন জানি কমে যায়। বারসাত ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টি অনেকখানি কমে গেছে—তারপরও যা আছে খারাপ না। এই বৃষ্টি ঘণ্টা দুই শরীরে মাখাতে পারলে অসুখ অবশ্যই হবে। ডবল নিউমোনিয়া বাধিয়ে ফেলা যেতে পারে। ঘোর ঘোর ভাব নিয়ে বিছানায় পরে থাকা খারাপ কী?
বৃষ্টিতে ভেজার জন্যে বারসাত মোটামুটি একটা ভালো জায়গা পেয়েছে। রাস্তা থেকে চট করে তাকে দেখা যাবে না। সে রাস্তার লোকজন ঠিকই দেখতে পাবে। রাস্তার সব লোক তার দেখার দরকার নেই। মীরুকে দেখতে পেলেই চলবে। আচ্ছা মীরু যখন দেখবে সে হাসি হাসি মুখে বৃষ্টিতে ভিজছে তখন কী করবে? রিকশা থেকে নেমেই বিরক্তিতে কপালে ভাঁজ ফেলে বলবে, তুমি বৃষ্টিতে ভিজছ কেন?
বারসাত বলবে, এই বৎসর বৃষ্টিতে ভেজা হয়নি। কাজেই ভাবলাম কোটা শেষ করে রাখি। শুভদিনে বৃষ্টিতে ভেজা যাক।
আজ শুভদিন না কি?
আরে আজ আমাদের বিয়ের দিন। আজ শুভদিন না? রিকশা ভাড়া দিয়ে চলে এসো দুজনে মিলেই ভিজি।
তুমি পাগল হতে পার। আমি তো পাগল না। দুনিয়ার মানুষের সামনে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ভিজব। লোকজন তাকিয়ে দেখবে শাড়িটা কতটা গায়ের সঙ্গে লেগেছে।
তাহলে তুমি বৃষ্টিতে ভিজবে না?
না।
শাড়ি গায়ের সঙ্গে লেগে যাবে এই ভয়ে বৃষ্টিতে ভেজার আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করবে?
উফ চুপ কর তো!
রবীন্দ্রনাথের ঐ গানটা মনে করলে কিন্তু ভেজা শাড়ির কথা মাথায় আসবে না। দুহাত তুলে ঘুরে ঘুরে বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছা করবে।
কোন গান?
এসো কর স্নান, নবধারা জলে
এসো নীপবনে ছায়াবীথি তলে।
বারসাত শোনো তুমি অনেক দিন আমার সঙ্গে আছ ঠিকই কিন্তু তুমি আমাকে সেই অর্থে চেন না। আমার মধ্যে প্রকৃতিপ্রেম নেই। বৃষ্টি দেখলেই আমার বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছা করে না।
রেগে যাচ্ছ কেন?
রাগছি না। তোমার নায়ক টাইপ কথা শুনে বিরক্ত হচ্ছি। তুমি কি জানো তুমি মানুষকে খুব বিরক্ত করতে পার।
জানি।
বৃষ্টিতে ভেজার এই ঢংটা না করে তুমি কি দয়া করে রিকশায় উঠবে?
তোমার সঙ্গে?
হ্যাঁ, আমার সঙ্গে।
তোমার নতুন শাড়ি ভিজে যাবে তো।
ভিজুক। তুমি উঠে এসো।
এখন উঠতে পারব না। ছোট্ট একটা কাজ আছে কাজটা শেষ করে উঠতে হবে।
কী কাজ?
নীলুফার নামের একটি মেয়েকে নিউজ বুলেটিন পাঠাতে হবে। তার মোবাইলে টেলিফোন করে জানাতে হবে যে তুমি এসেছ। বিয়েটা শেষপর্যন্ত হচ্ছে! হাসছ কেন?
হাসছি কারণ আমি আসিনি। আমাদের বিয়েও হচ্ছে না। আমার রিকশায় করে চলে আসার ব্যাপারটা পুরো কল্পনা। শুধু যে আমার ব্যাপারটাই কল্পনা তা না, বৃষ্টির ব্যাপারটাও কল্পনা।
তাই না কি?
হ্যাঁ, তাই। বৃষ্টি অনেকক্ষণ থেমে গেছে। আকাশে মেঘ কেটে গিয়ে রোদ পর্যন্ত উঠে গেছে। তুমি যদি একটু ডান দিকে সরে দাঁড়াও তাহলে তোমার গালে রোদ পড়বে।
মীরু তোমার হাতে কি ঘড়ি আছে?
না আমার হাতে ঘড়ি নেই। আমি কল্পনার মীরু। কল্পনার মীরু হাতে ঘড়ি পরে না। বাস্তবের মীরু পরে। ঘড়ি দিয়ে কী হবে?
চারটা বাজছে কি না জানতে চাই।
তোমার নিজের হাতে ঘড়ি আছে। ঘড়িটা দেখে সময় জেনে নাও। আমার ধারণা চারটার বেশি বাজে।
বারসাত ঘড়ি দেখল। চারটা পঁচিশ বাজে। মীরুর জন্যে আর অপেক্ষা করার দরকার নেই। এখন চলে যাওয়া যেতে পারে। একটা টেলিফোন নীলুফার ভাবীকে করতে হবে। উনি নিশ্চয়ই টেলিফোনের জন্যে অপেক্ষা করে আছেন।
হ্যালো ভাবী।
হ্যাঁ।
মীরু আসেনি।
আই এ্যাম সরি টু হিয়ার দ্যাট। তুমি কোথায়?
আমি এখনো কাজি অফিসের আশপাশে। টেলিফোন শেষ করেই রওনা দেব।
কোথায় রওনা দিবে?
আমার দূর-সম্পর্কের এক মামার বাগানবাড়িতে। বাগানবাড়িতে আটচল্লিশ ঘণ্টা কাটানোর অনুমতি নিয়েছিলাম। ঐখানে যাব।
বাগানবাড়িটা কোথায়?
কালিয়াকৈর-এর কাছে।
আমি একটা সাজেশান দেই?
দিন।
একা একা কালিয়াকৈর যাবার কোনো মানে হয় না। আজ কোথাও যাবার দরকার নেই। ঢাকাতেই থাক। মীরু মেয়েটার বাসায় যাও, খোঁজ নাও তার কী হয়েছে।
তার কিছু হয়নি, সে ভালো আছে। সে আমাকে মাথা থেকে ঝেড়ে। ফেলেছে। এখন বাসায় গেলে দেখব সে তার মার সঙ্গে সাপ লুডু খেলছে।
উল্টোটাও হতে পারে। সে হয়তো কোনো সমস্যায় পড়েছে। তুমি আজ বাগানবাড়িতে যাবার আইডিয়া বাদ দাও।
বাদ দিতে পারব না। আমাকে যেতেই হবে। সেখানে তিনজন বেহালা বাদক ঠিক করা আছে। তারা আজ দুপুর থেকে বসে আছে।
তোমার শরীর ঠিক আছে তো? তোমার কথাবার্তা কেমন যেন জড়ানো মনে হচ্ছে।
শরীর ঠিক আছে।
কালিয়াকৈর যাবার আগে কি আমার বাসা হয়ে যাবে? এক কাপ চা খেয়ে যাবে।
চেষ্টা করব।
চেষ্টাটেষ্টা না। চলে এসো। তোমাকে ইন্টারেস্টিং কিছু কথা বলব। তোমার কালিয়াকৈর যাওয়া আমি আটকাচ্ছি না। তুমি যাও তবে যাবার আগে আমার এখানে এক কাপ চা খেয়ে যাও।
ভাবী কটা বাজে বলতে পারবেন? আমার হাত ঘড়িটা কাজ করছে। বৃষ্টিতে ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে।
এখন বাজছে পাঁচটা ছয়। তুমি আসছ তো?
বারসাত জবাব না দিয়ে টেলিফোন রেখে দিল। সে পরিষ্কার বুঝতে পারছে তার জ্বর এসেছে। এই জ্বর চট করে যাবার জ্বর না। জ্বর তাকে ভোগাবে। চিৎ করে বিছানায় ফেলে দেবে।
মীরু তার ছোট ফুপুর দিকে তাকিয়ে বলল, ফুপু কটা বাজে?
সুলতানা বললেন, পঁচটা দশ বাজে।
মীরু বলল, ফুপু আমি এখন চলে যাব।
সুলতানা অবাক হয়ে বললেন, তোর বাবার এই অবস্থা তুই কোথায় চলে যাবি! তোর কি মাথাটাথা খারাপ হয়ে গেছে?
মীরু বলল, বাবার অবস্থা এখন ভালো। ডাক্তাররা বলেছেন বিপদ কেটে গেছে। তোমরা সবাই চলে এসেছ। এখন আমার দরকার কী?
তুই দেখি সত্যি সত্যি পাগল হয়ে গেছিস। তোর দরকার থাকবে না?
তোমরা যা পার কর। হাসপাতাল আমার পছন্দের জায়গা না। হাসপাতালে ঢুকলেই আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। দমবন্ধ অবস্থায় অনেকক্ষণ আছি। এখন আমাকে যেতেই হবে।
কোথায় যেতে হবে?
মীরু স্বাভাবিক গলায় বলল, কাজি অফিসে যাব ফুপু। আজ আমার বিয়ে।
সুলতানা বিরক্ত গলায় বললেন, সব সময় ঠাট্টা-ফাজলামি করিস এসব ভালো না। তোর ওপর দিয়ে খুব ধকল গেছে। বুঝতে পারছি মাথা আউলিয়ে গেছে। যা কিছুক্ষণের জন্য ঘুরে আয়। নাসেরকে বলে দিচ্ছি ও তোকে নামিয়ে দেবে।
নাসেরটা আবার কে?
নাসেরের সঙ্গে তো আজ ভোরেই এক গাদা কথা বললি। এর মধ্যে ভুলে গেছিস? তোর হয়েছে কী বল তো?
মীরু ক্লান্ত গলায় বলল, ফুপু আমার কিছু হয়নি। আমি ভালো আছি। আর শোনো আমাকে পৌঁছে দিতে হবে না। আমি রিকশা নিয়ে যাব।
নাসেরের গাড়ি আছে, তুই রিকশা নিয়ে যাবি কেন? তুই আয় তো আমার সঙ্গে, তোকে গাড়িতে তুলে দিয়ে আসি।
মীরু অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসল। সুলতানা বললেন, হাসছিস কেন? মীরু বলল, জানি না কেন হাসছি। মনে হয় আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
সুলতানা বললেন, তুই এক কাজ কর যেখানে যাবি আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যা। তোর ভাবভঙ্গি এলোমেলো, তোকে একা ছাড়া যাবে না।
মীরু বলল, তুমি তোমার অসুস্থ ভাইকে ফেলে আমার সঙ্গে বেড়াতে বের হবে? নিজের ভাই মরে যাচ্ছে।
সুলতানা বিরক্ত গলায় বললেন, মরে যাচ্ছে কী? কথা বলার স্টাইলটা তোর এরকম হয়ে যাচ্ছে কেন? তুই আমার চেয়ে ভালো জানিস যে ভাইজানের অবস্থা এখন ভালো। সব বিপদ কেটে গেছে।
মীরু হাই তুলতে তুলতে বলল, ফুপু বেশি করে চিনি দিয়ে আমাকে এক কাপ চা খাওয়াও। তারপর ডলে ডলে আমার মাথায় তেল দিয়ে দাও।
সুলতানা অবাক হয়ে মীরুর দিকে তাকালেন। মীরু ফিক করে হেসে ফেলে বলল, তুমি কি ভাবছ আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে? তোমাকে হকচকিয়ে দেবার জন্যে হঠাৎ চায়ের কথা বলেছি। আমার অবশ্যি চা খেতে ইচ্ছা করছে। মাথায় তেল দিতেও ইচ্ছে করছে। ফুপু তুমি কি জানো এই পৃথিবীতে তোমার চেয়ে ভালো করে কেউ মাথায় তেল দিতে পারে না। তেল দেবার পর চুলের গোছা ধরে তুমি যে টুকুস করে টান দাও–এক্কেবারে স্বর্গীয় টান।
নাসেরকে বলে দিচ্ছি ও তোকে ভালো কোনো রেস্টুরেন্টে চা খাইয়ে দেবে।
মাথায় তেল দিয়ে দেবে না?
সুলতানা হেসে ফেললেন। মীরু এমন মজা করে কথা বলে না হেসে থাকা সম্ভব না।
মীরু গম্ভীর গলা করে বলল, আমি নাসের-ফাসের কাউকে সঙ্গে নেব। তোমার বোরকাটা খুলে তুমি কি আমাকে দিতে পারবে?
সুলতানা ধমক দেবার ভঙ্গিতে তাকালেন। মীরু বলল, আমার এখন এমনভাবে যাওয়া উচিত যাতে কেউ আমাকে চিনতে না পারে। বোরকার অনেক উপকারিতা আছে।
মীরু বোরকা নিয়ে কোনো রসিকতা করবি না। এই রসিকতা আমার পছন্দ না।
মীরু বলল, আচ্ছা যাও তোমার এই মহান পোশাক নিয়ে আমি কোনো রসিকতা করব না। আমি এখন বিদায় হচ্ছি।
তোর বাবার সঙ্গে দেখা করে যা।
মীরু অনিচ্ছা সত্ত্বেও ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট-এর ভেতর ঢুকল। তার বাবার বিছানার সামনে দাঁড়াল। আফজল সাহেব ঘুমের ওষুধের কারণে সারাক্ষণই ঘুমুচ্ছেন। তারপরেও মীরু যখন বলল, বাবা আমি এখন যাচ্ছি— আফজল সাহেব চোখ মেললেন এবং একটা হাত বাড়িয়ে দিলেন। হাত বাড়ানোর অর্থ হাত ধরা। মীরু হাত ধরল না। সহজ-স্বাভাবিক গলায় বলল, বাবা আমি যাচ্ছি। তুমি রেস্ট নাও।
আফজল সাহেব বললেন, আচ্ছাগো মা।
মীরু বলল, তোমার দুঃশ্চিন্তার এখন আর কিছু নেই। ঢাকা শহরে আমাদের যত আত্মীয়-স্বজন আছেন সবাই চলে এসেছেন। আজ বিকেল থেকে ঢাকার বাইরের আত্মীয়-স্বজনরা আসতে শুরু করবেন। তারা কেউই সহজে যাবে না। চিড়িয়াখানা, শিশু পার্ক, লালবাগের কেল্লা এইসব দেখে বেড়াবে।
আফজল সাহেব মেয়ের কথায় হেসে ফেললেন। কারোর রসিকতায় তিনি কখনো হেসেছেন এমন উদাহরণ নেই। হার্ট এটাকের পর সম্ভবত তার মানসিকতার কোনো পরিবর্তন হয়েছে। মীরুর কথা শুনে তিনি যে শুধু হাসলেন তা-না। অনেকক্ষণ ধরে হাসলেন।
মীরু বলল, বাবা তুমি ঘুমাও। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হার্ট ঠিক কর। হার্টকে রেস্ট দাও।
আজফল সাহেব বললেন, তুই নিজেও রেস্ট নে। তোর ওপর দিয়ে বিরাট ধকল গিয়েছে।
বুকে ব্যথাট্যথা এসব তো এখন আর নেই?
না। মীরু শোন, তুই না থাকলে তো আজ আমি মরেই যেতাম রে মা! আফজল সাহেবের চোখে পানি এসে গেল। তার ইচ্ছা করল কিছুক্ষণ মেয়ের হাত ধরে থাকতে। তিনি আবারো তার ডান হাতটা মেয়ের দিকে বাড়ালেন। মীরু এমন ভাব করল যেন সে দেখতে পায়নি। হাত ধরাধরি নাটক করতে তার ইচ্ছা করছে না।
নাসের নামের ভদ্রলোকের গাড়িতে করেই মীরু রওনা হয়েছে। ভদ্রলোক নিজে গাড়ি চালাচ্ছেন। কাজেই মীরুকে বসতে হয়েছে ড্রাইভারের পাশের সিটে। এই ভদ্রলোক কে? তাদের কোন ধরনের আত্মীয় তা মীরু ধরতে পারছে না। ভোর রাত থেকে ভদ্রলোক গাড়ি নিয়ে ডিউটি দিচ্ছেন। কাজেই ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হবার কথা। ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হলে মীরুর চেনার কথা। সে চিনতে পারছে না। মীরুর মনে ক্ষীণ সন্দেহ— এই ভদ্রলোকই কি সুলতানা ফুপুর ঠিক করা পাত্র? যার সঙ্গে মীরুর বিয়ে দেবার জন্যে সুলতানা ফুপু প্রায় জীবন দিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু সেই ছেলের নাম নাসের না। তার নাম অন্যকিছু মোঘল রাজা বাদশার নামে নাম। ভদ্রলোকের মাথা ভর্তি টাক। এরকম টেকো মাথার কাউকে ফুপু তার পাত্র হিসেবে ঠিক করবেন তা ভাবা যায় না। তাছাড়া পাত্ররা কখনো হাসপাতালে ডিউটি দেয় না। তারা ভাব ধরে দূরে থাকে। হাসপাতালে ডিউটি দেয় গরিব প্রেমিকরা।
মীরুর ঘন ঘন হাই উঠছে। বাবাকে নিয়ে তার খুব টেনশান গিয়েছে। এখন টেনশানমুক্ত বলে হঠাৎ শরীর ছেড়ে দিয়েছে। যেভাবে তার হাই উঠছে গাড়ির মধ্যেই ঘুমিয়ে পরা বিচিত্র না। মীরু ঘুম কাটানোর জন্যেই কথা বলা শুরু করল—আপনার নামটা ভালো না, এটা কি আপনি জানেন?
মানুষটা কথা শুনে হাসল তবে মীরুর দিকে তাকাল না। সামনের দিকে তাকিয়ে বলল, কেন ভালো না?
নাসের নামের সঙ্গে টাক মাথা মানায় না। নাসের নাম শুনলে মনে হয়। মানুষটার মাথা ভর্তি চুল।
ও আচ্ছা।
এই নাম ছাড়া আপনার অন্য কোনো নাম নেই?
আমার ডাক নাম জাহাঙ্গীর।
মোঘল বাদশার নামে যে নাম সেই নাম ডাক নাম হবে কেন? আপনার পোশাকি নাম হওয়া উচিত জাহাঙ্গীর। ডাক নাম নাসের। বাবা মা আদর। করে ডাকবেন নাসু।
আপনার সাজেশান আমার মনে থাকবে। ডাক নাম এবং পোশাকি নাম। ইন্টারচেঞ্জ করার সুযোগ থাকলে করে ফেলব। আপনি কোথায় যাবেন। বললে আমার গাড়ি চালাতে সুবিধা হয়।
সরি আপনাকে বলা হয়নি–আমি যাব মগবাজারে। আমরা কি ভুল পথে চলে এসেছি?
সামান্য এসেছি। এটা কোনো ব্যাপার না। আপনার ফুপু বলেছিলেন পথে কোথাও গাড়ি থামিয়ে আপনাকে বেশি চিনি দিয়ে কড়া এক কাপ চা খাওয়াতে। এখন কি খাবেন? এখানে একটা ভালো রেস্টুরেন্ট আছে আমার পরিচিত।
না।
নাসের এক ঝলক মীরুর দিকে তাকিয়ে বলল, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি কোনো কারণে আমার ওপর বিরক্ত। আপনার বিরক্তি উৎপাদনের মতো কিছু কি আমি করেছি? আমার মাথায় কোনো চুল নেই এই কারণেই কি আপনি বিরক্ত? বারবার মাথার চুলের দিকে তাকাচ্ছেন তাই বললাম।
মীরু চুল প্রসঙ্গে না গিয়ে হঠাৎ বলল, আচ্ছা শুনুন। আপনি কি সেই ব্যক্তি যার সঙ্গে আমার বিয়ে দেবার জন্য সুলতানা ফুপু প্রায় জীবন বাজি রেখে ফেলেছেন?
জি।
আপনিও মনে হয় আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন।
অপেক্ষা করছি কারণ আপনার ফুপু বলেছেন— এই সৌরজগতে আপনার মতো ভালো মেয়ে নেই। আপনার ফুপুর কথা আমি খুব বিশ্বাস করি।
আপনার কি বিশ্বাস হচ্ছে যে আমার মতো ভালো মেয়ে সৌরজগতে নেই?
হ্যাঁ হচ্ছে। আপনি আপনার বাবার চিকিৎসার যে ব্যবস্থা করেছেন সেটা চিন্তাই করা যায় না। রাত সাড়ে তিনটার সময় একা ওষুধ কিনতে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল থেকে শাহবাগে গিয়েছেন।
আপনি ভুল করেছেন। আমি একা যাইনি আমার সঙ্গে বলশালী। একজন পুরুষ মানুষ ছিল। সে আমাকে ভরসা দিয়েছিল যে কোনো ভয় নেই।
নাসের অবাক হয়ে বলল, পুরুষ মানুষের কথা জানতাম না। কে ছিল। আপনার সঙ্গে?
মীরু হাসতে হাসতে বলল, যে রিকশায় করে গিয়েছি সেই রিকশার রিকশাওয়ালা ছিল।
নাসের শব্দ করে হেসে ফেলল। হাসি থামিয়ে বলল, আপনার সেন্স। অব হিউমার অসম্ভব ভালো।
মীরু বলল, এখন আমি যাই করব তাই আপনার কাছে ভালো লাগবে। কারণটা খুব সহজ। আমাকে না দেখে শুধুমাত্র সুলতানা ফুপুর কথা শুনেই আপনার আমাকে পছন্দ হয়ে গিয়েছিল। আমার সঙ্গে যখন দেখা হল তখন সেই পছন্দ হওয়াটা কমে না গিয়ে বাড়ল। প্রায় প্রেম পর্যায়ে চলে গেল। এখন যদি আমি শব্দ করে নাক ঝাড়ি এবং নাকের সর্দি আপনার গাড়ির সিট কাভারে মুছে ফেলি সেটাও আপনার কাছে ভালো লাগবে।
কেন?
ভালো লাগার জন্যে আপনি কোনো-না-কোনো লজিক দাঁড় করিয়ে ফেলবেন। প্রেমিকরা এই কাজটা খুব ভালো করে।
নাসের বলল, সর্দি গাড়ির সিটে মুছবেন। এটা ভালো লাগবে এরকম লজিক দাঁড় করানো তো কঠিন।
কঠিন কিছুই না। তখন আপনি ভাববেন— মেয়েটা স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড। তার মধ্যে কোনো ভনিতা নেই। তার বিষয়ে কে কী ভাবল তা নিয়ে এই মেয়ের কোনো মাথাব্যথা নেই। কোনো দিকে না তাকিয়ে এই মেয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে সর্দি গাড়ির সিটে মুছে ফেলেছে। একসেলেন্ট। এ রকম একটা মেয়েই তো আমি চাচ্ছিলাম।
নাসের শব্দ করে হাসছে। মীরু বলল, আপনার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে আপনি খুব মজা পাচ্ছেন।
নাসের বলল, হ্যাঁ মজা পাচ্ছি।
মীরু বলল, আমি যখন মগবাজারে পৌছব তারপর থেকে আপনি আমার আর কোনো কর্মকাণ্ডে মজা পাবেন না। বরং আমার প্রতিটি কর্মকাণ্ডে বিরক্ত হবেন। নাসের বিস্মিত হয়ে বলল, কেন বলুন তো?
মীরু বলল, কারণ আমি যাচ্ছি মগবাজার কাজি অফিসে। সেখানে আমার আজ গোপনে বিয়ে করার কথা। যার সঙ্গে বিয়ে হবার কথা তার নাম বারসাত। আমার যাবার কথা ছিল সকাল এগারোটায়। বাবার শরীর খারাপের কারণে যেতে পারিনি। আমার মনে হয় না বারসাত এখনো। আমার জন্যে বসে আছে, তারপরেও খোঁজ নেবার জন্যে যাচ্ছি। এখন বলুন আমাকে কি আপনার অসহ্য মনে হচ্ছে?
নাসের বলল, না মনে হচ্ছে না। কিছুক্ষণ আগে আপনাকে যতটা ভালো লাগছিল— এখন তারচেয়ে বেশি ভালো লাগছে। সত্যি বলছি। বারসাত সাহেব যদি থাকেন এবং আপনাদের বিয়েটা যদি হয় তাহলে আমি বিয়ের সাক্ষী হিসেবে আমাকে অফার করব।
বারসাতকে কাজি অফিসে পাওয়া গেল না। মীরু নাসেরকে সঙ্গে নিয়ে বারসাতের মেস-এ গেল। সেখানেও সে নেই।
নাসের বলল, আপনাকে খুবই ক্লান্ত লাগছে। আসুন এক কাপ চা খাই।
মীরু বলল, চলুন চা খাই। এখন মনে পড়েছে আমি দুপুরেও কিছু খাইনি। ক্ষিধের জন্যেই মাথা ধরেছে।
আমি আপনার মাথা ধরা সারিয়ে দেব।
কীভাবে?
খুব ভালো চা খাওয়াব। তারপর আপনার মাথা ধরা না সারা পর্যন্ত আপনাকে গাড়িতে নিয়ে ঘুরব।
মীরু চোখ বন্ধ করে ফেলল।
মীরু কতক্ষণ পরে চোখ মেলল তা সে নিজেও জানে না। তার কাছে মনে হল সে দীর্ঘ ঘুম দিয়ে জেগে উঠেছে। ঘুমের ভেতর নানা ধরনের স্বপ্ন সে দেখে ফেলেছে। স্বপ্নের মধ্যে গা ছমছমানো বিশেষ স্বপ্নও আছে। সে ক্লাসে বসে আছে, গায়ে শুধু পাতলা একটা চাদর। আর কিচ্ছু নেই। এই চাদরটাও আবার হাঁটুর উপর রাখা। স্যার বললেন, এই যে চাদর গায়ে মেয়ে আজকের ক্লাসের পড়া বুঝেছ?
মীরু হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
তাহলে এক কাজ কর। বোর্ডে চলে এসো। বোর্ডে এসে সবাইকে বুঝিয়ে দাও।
স্যার আমি বোর্ডে যেতে পারব না। আমার একটু অসুবিধা আছে।
কী অসুবিধা?
সেটা স্যার বলতে পারব না।
কোনো অজুহাত শুনতে চাচ্ছি না। এসো বোর্ডে। এসো বলছি।
মীরুর তখন ঘুম ভাঙল। সে দেখল গাড়ি রাস্তার ওপর থেমে আছে। গাড়ির ওপর মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। নাসের নামের মানুষটা ড্রাইভারের সিটে ঝিম ধরে বসে আছে। নাসের হাসিমুখে বলল, ঘুম ভেঙেছে?
মীরু বলল, আমরা কোথায়?
নাসের বলল, আমরা রাস্তায়। রাস্তা কাটা ছিল। বৃষ্টির পানিতে পুরো রাস্তা ঢাকা। বুঝতে পারিনি গাড়ি নিয়ে খাদে পড়ে গেছি। আপনি গভীর ঘুমে ছিলেন কিছু বুঝতে পারেননি।
আমাকে ডাকলেন না কেন?
এত আরাম করে ঘুমুচ্ছিলেন, ডাকতে মায়া লাগল।
আমি কতক্ষণ ঘুমিয়েছি?
এক ঘণ্টা দশ মিনিট।
বলেন কি! আপনি এতক্ষণ কী করলেন?
ঝিম ধরে বসে থাকলাম। বৃষ্টি দেখলাম। চা খাবেন?
এখানে চা কোথায় পাবেন?
আমি মোবাইলে টেলিফোন করে চা আনিয়েছি। ফ্লাস্ক ভর্তি গরম চা এবং সিঙাড়া আছে। চা দেই?
মীরু বলল, দিন। আপনি দেখি খুব গোছানো মানুষ।
নাসের বলল, আমি অবশ্যই গোছানো তবে মেয়েরা গোছানো মানুষ পছন্দ করে না। মেয়েরা পছন্দ করে অগোছালো মানুষ।
আপনার এরকম ধারণা?
জি। গাড়ি যখন খাদে পড়ল তখন যদি হৈচৈ করে আপনার ঘুম ভাঙাতাম, খুব অস্থির হয়ে যেতাম সেটা আপনার অনেক বেশি পছন্দ হত।
মীরু বলল, ঝুম বৃষ্টিতে গাড়িতে বসে গরম চা খাচ্ছি, সিঙাড়া খাচ্ছি। এটা আমার বেশ পছন্দ হচ্ছে। চা খাবার পর আমরা কি গাড়িতে বসে থাকব নাকি গাড়ি খাদ থেকে উঠানোর ব্যবস্থাও আপনি করে রেখেছেন?
নাসের হাসিমুখে বলল, চা খাবার পর আপনাকে নিয়ে একটা মাইক্রোবাসে উঠব। মাইক্রোবাস আনানো হয়েছে। আমার লোকজন মাইক্রোবাসে বসে আছে। তারা এসে খাদে পড়া গাড়ি তুলবে। আমরা মাইক্রোবাস নিয়ে চলে যাব।
মীরু ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আপনি ঠিকই বলেছেন। এত গোছানো মানুষ মেয়েরা পছন্দ করে না। যখন গরম চা খাচ্ছিলাম তখন। আপনাকে ভালো লাগছিল। বিপদ থেকে উদ্ধারের সব ব্যবস্থা করে রেখেছেন শুনে আর ভালো লাগছে না। এখন আপনাকে রোবট রোবট লাগছে।
নাসেরের অফিসের লোকজন ছাতা হাতে চলে এসেছে। মীরু কিছুক্ষণ ভুরু কুচকে তাদের দেখল। তারপর নাসেরের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার কেন জানি গাড়ি থেকে নামতে ইচ্ছা করছে না। আমি কি আরেক কাপ চা খেয়ে তারপর নামতে পারি?
অবশ্যই পারেন।
নাসের কাপে চা ঢেলে এগিয়ে দিল। মীরু বলল, আপনাকে অন্যরকম লাগছে। কেন অন্যরকম লাগছে বুঝতে পারছি না।
নাসের বলল, আমাকে অন্যরকম লাগছে কারণ আমি আমার টাক মাথা ঢেকে ফেলেছি। ক্যাপ পরেছি।
মীরু বলল, আশ্চর্য! এই ব্যাপারটা আমি লক্ষ্য করলাম না কেন?
নাসের বলল, আপনার পর্যবেক্ষণ শক্তি খুব ভালো বলে আপনি লক্ষ্য করেননি। যাদের পর্যবেক্ষণ শক্তি খুব ভালো তারা প্রায়ই খুব কাছের জিনিস দেখতে ভুল করে।
মীরু নাসেরের দিকে তাকিয়ে আছে। নাসের কি কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে কথাগুলি বলেছে? সে-রকম মনে হচ্ছে না। আবার কেন জানি মনে হচ্ছে। মীরু বলল, ভালো কথা, আপনি কি আমার নাম জানেন?
আপনার নাম মীরু।
মীরু আমার নাম ঠিকই আছে কিন্তু এই নামটা আমার অপছন্দের। আমার পছন্দের নাম ঐন্দ্রিলা। আমার চা খাওয়া শেষ হয়েছে। এখন আমি নামব।
নাসের বলল, আমরা কি আরেকবার বারসাত সাহেবের মেসে খোঁজ নিয়ে দেখব। উনি ফিরেছেন কি না।
মীরু ক্লান্ত গলায় বলল, না আমি বাসায় যাব।
আপনার মাথা ধরা কি কমেছে?
হ্যাঁ কমেছে।
যে ভাবে ভুরু কুঁচকে আছেন মনে হচ্ছে না মাথা ধরা কমেছে।
না কমলেও সমস্যা নেই।
আমি চাচ্ছি না আপনি মাথা ধরা নিয়ে বাসায় যান।
কি বলতে চাচ্ছেন পরিষ্কার করে বলুন।
নাসের শান্ত গলায় বলল, আপনার সঙ্গে হয়ত আমার আর দেখা হবে না। আমাদের শেষ দেখায় হাইফেনের মত থাকবে মাথাব্যথা। এই হাইফেনটা না থাকলে হয় না।
মীরু বলল, আমাকে বাসায় নামিয়ে দিন। আমার কথা বলতে ভাল লাগছে না।