Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » রূপা (২০১০) || Humayun Ahmed » Page 7

রূপা (২০১০) || Humayun Ahmed

রূপা ছবি নিয়ে বসেছে

রূপা ছবি নিয়ে বসেছে। লেমন ইয়েলোর প্রথম ওয়াশ দেয়া হয়েছে। রঙ শুকানোর পর দ্বিতীয় ওয়াশ। ওয়াটার কালার মানেই ম্যাজিক। প্রথম ওয়াশেই কিছু একটা ঘটে যেতে পারে। কাগজের বাম পাশে ঘূর্ণির মতো তৈরি হয়েছে সেখানে এক দানা লবণ ফেলে কি দেখবে কিছু হয় কি-না। কিংবা ড্রপার দিয়ে একফোঁটা নারকেল তেল ফেলে দেখা যেতে পারে। তেল পানিকে বিকর্ষণ করবে। হলুদ রঙের পানি সরিয়ে দেবে। রূপা চোখ বন্ধ করে ফেলল। কাগজ শুকানোর আগে সে চোখ খুলবে না। লবণ এবং নারকেল তেল আপাতত বাদ। বাইরের সাহায্য ছাড়াই যা হবার হোক। চোখ বন্ধ করে রঙের সঙ্গে কথা বলার খেলা এখন খেলা যেতে পারে। রঙকে নির্দেশ দিয়ে প্রভাবিত করা। রূপা মনে মনে বলল, লেমন ইয়েলো! তুমি আমার অতি প্রিয় একটা রঙ। আমি তোমাকে আমার কাগজে বিছিয়ে দিয়েছি। এখন তুমি আমাকে সাহায্য কর। তুমি তোমার ক্ষমতা দেখাও। কাগজের উপর সামান্য নাচ। ছোট্ট একটু ঢেউ উঠুক। অদ্ভুত কোনো ঘূর্ণি। বিচিত্র কোনো ডিজাইন।

আফা। আফা গো।

রূপা চোখ মেলল। মলিনা উত্তেজিত গলায় বলল, বিরাট ঘটনা ঘটে গেছে। আম্মা আসছে। গাড়িতে বসা। নামতে বলছি, নামব না। আপনারে যাইতে বলছে। রূপা একবার ভাবল বলে, এখন ছবি আঁকতে বসেছি যেতে পারব না। এই চিন্তা বাদ দিয়ে তাকে উঠে দাঁড়াতে হল। বড় কোনো ঘটনা নিশ্চয়ই ঘটেছে। কোনো কারণ ছাড়া তার মা গাড়ি নিয়ে ছুটে আসবেন না।

বিশাল পাজেরো গাড়ির পেছনের সিটে শায়লা বসা। তাঁকে ক্লান্ত এবং বিরক্ত দেখাচ্ছে। কফি কালারের চাদর দিয়ে শরীর এবং মাথা ঢেকে রেখেছেন। তার হাতে ইনহেলার। রূপাকে দেখে তিনি হাঁ করে ইনহেলার মুখের কাছে ধরলেন। দুবার চাপলেন। রূপা বলল, মা কি ব্যাপার?

শায়লা বললেন, গাড়িতে উঠে আয়।

এখন আমি কোথাও যাব না মা।

কোথাও যেতে হবে না। গাড়িতে উঠ। কথা বলব।

বাসায় এসো। সেখানে কথা বলব। গাড়িতে বসে কথা বলতে হবে কেন?

ঐ বাড়িতে আমি কখনো গিয়েছি? যাই নি, যাবও না। গাড়িতে উঠতে বলছি উঠে আয়। জরুরি কথা।

রূপা গাড়িতে উঠল। শায়লা ড্রাইভারকে বললেন, তুমি গাড়ি থেকে নাম। আমি মেয়ের সঙ্গে কিছু কথা বলব। তোমার শুনার প্রয়োজন নেই। তবে আশেপাশেই থাকবে। নিরুদ্দেশ হয়ে যেও না।

ড্রাইভার নেমে গেল। রূপা বলল, বল কি বলবে।

শায়লা বললেন, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখলাম, জীবন সঙ্গিনী চাই।

রূপা বলল, বিজ্ঞাপন বের হয়েছে? এত তাড়াতাড়ি?

তুই ব্যাপারটা জানতি?

জানতাম। ইনফ্যাক্ট বিজ্ঞাপনের কপি আমি লিখে দিয়েছি। প্রথম ড্রাফটটা বাবা লিখেছেন। যথারীতি কুৎসিত ছড়া দিয়ে শুরু–

জীবন সঙ্গিনী চাই
আর সময় নাই।

শায়লা বললেন, এই বয়সে এমন একটা হাস্যকর কাণ্ড তোর বাবা করল? তুই কিছু বললি না? তুই হয়ে গেলি তার এসোসিয়েট। কপি রাইটার?

রূপা বলল, হাস্যকর কোনো কাণ্ড বাবা করে নি। বাবা নিঃসঙ্গ একজন মানুষ। আমি চলে যাব ফ্রান্সে। বাবা আরো একা হয়ে যাবে, তখন তাকে কে দেখবে?

তুই ফ্রান্সে যাবি মানে কি?

ছবি আঁকা শেখার জন্যে যাব। একটা স্কলারশিপ পেয়েছি।

আমি তো কিছু জানলাম না।

এই তো জানলে।

শায়লা কিছু সময় চুপ করে থেকে বললেন, তোর বাবা বুড়ো বয়সে বিয়ের জন্যে পাগল হয়ে গেছে এটা তোর কাছে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে?

রূপা বলল, তুমি যদি জোয়ান বয়সে আরেকটা বিয়ের জন্যে পাগল হতে পার তাহলে বাবার সমস্যা কি? অল্প বয়সে পাগল হওয়া যাবে বেশি বয়সে হওয়া যাবে না। এই তোমার যুক্তি?

আমাকে এখানে কেন টানছিস?

তোমাকে সব কিছুর বাইরে রাখব এটা কি করে ভাবছ? যাই হোক, বাবার বিয়ে নিয়ে অস্থির হয়ো না। শেষ পর্যন্ত বাবা বিয়ে করবে আমার তা মনে হয় না। কোনো কিছুতেই বাবার আগ্রহ বেশিদিন থাকে না। আর যদি বিয়ে হয় সেটা তোমার জন্যে ভাল হবে।

আমার জন্যে ভাল হবে কীভাবে?

বাবা তখন আর হুটহাট টেলিফোন করে তোমাকে বিরক্ত করবে না। ঝুড়ি ভর্তি মাছ-মাংস পাঠাবে না। জন্মদিন উপলক্ষে শাড়ি পাঠাবে না। তুমি ব্ৰিত হবে না। বাবা ব্যস্ত থাকবে ছোট মাকে নিয়ে।

ছোট মা?

রূপা হাসতে হাসতে বলল, তুমি আমার মা, উনি ছোট মা। নতুন মাও ডাকতে পারি। তোমার কোনটা পছন্দ? নতুন মা না-কি ছোট মা?

শায়লা বললেন, you hate me. তাই না?

রূপা বলল, না, তা না। তোমার ব্যাপারটা আমি বুঝিয়ে বলি। আমি সব মানুষের মধ্যে একটা রঙ দেখি। বাবার রঙ হচ্ছে কচি কলাপাতার রঙ। মলিনা মেয়েটা মেজেন্টা রাশেদ সাহেব লেমন ইয়েলো। তুমি গ্রে।

আমি গ্রে?

হুঁ। তবে রঙ নিয়ে মন খারাপ করো না। একজন ভাল পেইন্টার কিন্তু গ্রে কালার দিয়েও চমৎকার ছবি আঁকতে পারেন।

রাশেদ সাহেবটা কে?

আছেন একজন। গুরুত্বপূর্ণ কেউ না। মা তোমার কথা কি শেষ হয়েছে? আরো কিছু বলবে?

ফ্রান্সে যে স্কলারশিপ পেয়েছিস সেটা কি রকম স্কলারশিপ?

আলতু ফালতু টাইপ। পেটে ভাতে স্কলারশিপ বলতে পার। যা পাব তা দিয়ে কোনমতে দিন গুজরান হবে। ছুটির দিনে কফি শপে কফি খাওয়ার পয়সা জুটবে না।

চল কোনো একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসি। দুজন মিলে কফি খাই। তোর মুখে কফির কথা শুনে কফি খেতে ইচ্ছা করছে।

অন্য আরেক দিন। আজ না কেন?

আমি একটা ছবি আঁকতে শুরু করেছি। আমার মন পড়ে আছে ছবিতে। সেকেন্ড ওয়াশ দেব।

তোর বাবা নিজের বিয়ে নিয়ে লাফালাফি করছে, তোর বিয়ে নিয়ে ভাবছে না।

আমার বিয়ে নিয়ে আমি ভাবব। বাবা কেন ভাববে?

শায়লা বললেন, কি রকম ছেলে তোর পছন্দ?

যার ইনার কালার হবে ডার্ক বু! ঝগড়ায় তাকে পারদর্শী হতে হবে। তর্কে আমাকে হারানোর ক্ষমতা থাকতে হবে। তার প্রচুর টাকা না থাকলেও চলবে। তবে সে বাবার মতো কৃপণ হতে পারবে না।

এটা ভাল বলেছিস। কৃপণ পুরুষ আমারও অসহ্য। থ্যাংক গড়, টগরের বাবা কৃপণ না। ঐ দিন কি হয়েছে শোন। এক বিয়ে বাড়িতে যাব। টগরের বাবার ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর মেয়ের বিয়ে। সোনার কিছু দিতে হবে। হঠাৎ কানের একজোড়া টপ দেখে আমার নিজের জন্যে পছন্দ হয়ে গেল। ডায়মন্ডের টপ। দাম এক লাখ পনেরো। টগরের বাবা বলল, এত যখন পছন্দ কিনে ফেল। দামের দিকে তাকানোর দরকার নেই।

রূপা বলল, এই টপজোড়াই কি পরে আহু মা?

হুঁ। সুন্দর না?

অদ্ভুত সুন্দর, তবে তোমার উচিত এই টপ না পরা। এক্ষুণি খুলে ফেল।

কেন?

তোমার কান দেখতে খুব খারাপ। ইঁদুরের কানের মতো কান। ডায়মন্ডের টপ পরার কারণে সবার চোখ যাবে কানের দিকে। তোমার বিশ্রী কান দেখবে। তোমার উচিত চুল দিয়ে বিশ্রী কান দুটা ঢেকে রাখা।

শায়লা আহত চোখে তাকিয়ে রইলেন।

রূপা বলল, মা তুমি কিছু মনে করো না। টপের ডায়মন্ড দুটা নকল। আমি অনেক কিছু বুঝতে পারি। এই ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না। নিজের মেয়ের সঙ্গে ভান করার কিছু আছে? মা! অনেকক্ষণ বকবক করেছি এখন আমি যাব। ছবি আঁকব।

দুটা মিনিট বস। দুই মিনিটে তোর ছবি পালিয়ে যাবে না। বসলাম দুমিনিট। বল কি বলবে।

শায়লা আবার ইনহেলার নিলেন। রূপা হাসল। শায়লা বললেন, হাসছিস কেন?

রূপা বলল, ইনহেলার নিয়ে যে ঢঙটা তুমি কর তা দেখে হাসি। তুমি অসুস্থ। তোমার হাঁপানি এটা দেখানোর জন্যেই তোমার হাতে ঐ বস্তু থাকে।

আমাকে তুই এতটা ছোট ভাবতে পারলি?

তুমি তো ছোটই মা। ছোট কেন ভাবব না।

আমি ছোট?

হ্যাঁ, তুমি ছোটবেলায় আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছ যে বাবা তোমাকে শারীরিক নির্যাতন করত বলেই তুমি তাকে ছেড়ে চলে গেছ। একটা ভয়ংকর মিথ্যা তুমি তোমার মেয়ের মাথায় ঢুকানোর চেষ্টা করেছ। এটা অন্যায়। তুমি বলতে পারতে তোর বাবা ভয়ংকর বোকী। এই জন্যে তাকে ছেড়ে গেছ। আমি একসেপ্ট করতাম। মা এখন কি আমি যেতে পারি?

শায়লী কিছু বললেন না।

রূপা বলল, টগর কেমন আছে মা?

শায়লা বলল, টগরের প্রসঙ্গ থাক। ওকে নিয়ে বাইরের কারো সঙ্গে আমি কথা বলতে পছন্দ করি না। তুই গাড়ি থেকে নেমে যা ছবি শেষ কর।

রূপা মুগ্ধ হয়ে তার ছবির দিকে তাকিয়ে আছে। প্রথম ওয়াশের ফলাফল আশাতীত ভাল হয়েছে। ঘূর্ণনটা শেষপর্যন্ত আসে নি, তার বদলে ঢেউ খেলানো একটা ব্যাপার এসেছে। দ্বিতীয় ওয়াশের ফলাফল কি হবে কে জানে। রূপা গাঢ় হলুদ রঙের সঙ্গে বালি মিশাল। দ্বিতীয় ওয়াশে বালি মেশানো থাকবে। ওয়াশের পর কাগজ খাড়া করে রাখবে তখন গ্রেভিটেশনের কারণে বালির কণাগুলি নিচে নামতে থাকবে। এতে সুন্দর কোনো টেক্সচার তৈরি হতে পারে। এটা রূপার নিজের আবিষ্কার না। ভেনিজুয়েলার ওয়াটার কালারের গ্রান্ডমাস্টার হানমুনের আবিষ্কার। তিনি তার বেশির ভাগ ওয়াটার কালারে বালির দানা ব্যবহার করে টেক্সচার তৈরি করেন।

আফা। অফা গো।

রূপ চোখ না তুলেই বলল, বল কি ব্যাপার। হড়বড় করে এক গাদা কথা বলবে না।

একটা মেয়ে আফনেরে বুলায়, তার নাম রুবিনা।

চায় কি?

জানি না।

বসতে বল। আমি জরুরি কাজ করছি কাজ শেষ হলেই যাব। চা বানিয়ে দাও। বসে বসে চা খাক। খবরের কাগজ পড়ুক।

বলছিলাম আফা! উনার নাকি বারোটা থাইকা ডিউটি। ডাক্তার মাইয়া। সময় মতো না গেলে রোগী মইরা ভূত হয়া যাবে। দোষ পড়বে উনার। দোষ ধরতে তো মানুষের সময় লাগে না।

রূপা উঠে দাড়াল। তার স্র সামান্য কুচকে আছে। এমন কি হতে পারে। তার বাবার বিজ্ঞাপনের কারণে ক্যান্ডিডেটরা সরাসরি ইন্টার দিতে চলে আসছে? ঘটনা এ রকম হলে ভাল ঝামেলা হবে। পাত্রীদের ইন্টারভ্য তাকেই নিতে হবে। অত্যন্ত অস্বস্তিকর অবস্থা। রূপা দোতলা থেকে নামল।

বসার ঘরে অল্পবয়েসী মেয়ে বসে আছে। ডাক্তার বলে মনে হচ্ছে না। কলেজে পড়ে পর্যন্ত ঠিক আছে।

রূপা বলল, আপনি আমার কাছে এসেছেন।

আপনার নাম কি সিলভার?

আমার নাম রূপা। তবে রূপা এবং সিলভার অবশ্যি একই। কেন বলুন তো?

আমি এ্যাপলো হসপিটালে কাজ করি। আমাদের একজন পেশেন্টের অত্যন্ত খারাপ অবস্থা। তিনি তাঁর কোনো আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ দিতে পারছিলেন না, যার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়। এই বাড়ির ঠিকানাও কিন্তু তিনি দিতে পারেন নি। কিছুক্ষণের জন্যে তাঁর ঘোর কেটেছিল। তখন তিনি কলাবাগানের গাছপালায় ঢাকা দোতলা বাড়ির কথা বলেছেন। বলেছেন বাড়ির নাম সিলভার।

তার নাম কি রাশেদ?

জী। রাশেদ রহমান। তিনি আমেরিকান এক ইউনিভার্সিটিতে অঙ্কের লেকচারার। মোরহেড স্টেট ইউনিভার্সিটি। আমি আজ চেষ্টা করব তাঁর ইউনিভার্সিটির সঙ্গে যোগাযোগ করতে।

আপনি ডাক্তার?

জী। আমার নাম রুবিনা।

রূপা বলল, রাশেদ সাহেবকে সেভাবে আমি চিনি না। তিনি ঠিকানা ভুল করে আমাদের বাড়িতে উঠেছিলেন। কিছুক্ষণ ছিলেন।

সরি। সরি।

সরি কেন হবেন? আপনি যে কাজটা করেছেন কতজন এটা করে? আমাকে পাঁচটা মিনিট সময় দিন। আমি আপনার সঙ্গেই যাব। এক কাপ চা দিতে বলি?

বলুন।

রাশেদ সাহেবের অবস্থা কতটা খারাপ?

বেশ খারাপ। সারভাইব নাও করতে পারেন। পরিচিত কেউ তার পাশে নেই। মানুষটা মারা যাচ্ছে। আমার খুব খারাপ লাগছিল।

রূপা স্যান্ডেল খুঁজছে। দরজার আড়াল থেকে দেখছে মদিনা। চোখে চোখ পড়তেই সে সরে গেল। রূপা বলল, মদিনা কাছে আস।

মদিনা ভীত মুখে সামনে এসে দাঁড়াল। যেন সে বড় কোনো অপরাধ করেছে। অপরাধের বিচার সভা বসেছে। অপরাধের কারণে তাঁর কঠিন শাস্তি হবে। রূপা বলল, আমি কোথায় যাচ্ছি তুমি জান?

মদিনা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।

রূপা বলল, তুমি অত্যন্ত বিপজ্জনক এক মেয়ে। আগেভাগে সব জেনে ফেলছে। এটা ঠিক না। এতে আমাদের পরিকল্পনা এলোমেলো হয়ে যায়।

মদিনা বলল, আমারে মাফ করে দেন আফা।

মাফ দেয়ার মত কোনো অপরাধ তুমি করোনি, শুধু শুধু ভয় পাচ্ছ কেন?

মদিনা ভয় পাচ্ছে কারণ সে আরো একটা ঘটনা জানে। যে ঘটনা ঘটে নি কিন্তু ঘটবে। ঘটনাটা সে রূপাকে বলার সাহস করে উঠতে পারছে না।

নিজের উপর মাঝে মাঝে তার ভয়ংকর রাগ লাগে। সবাই এক রকম, সে আলাদা কেন? কেউ ভূত দেখে না সে কেন দেখে? এক শ্রাবণ মাসের দুপুরে সে যদি পুকুরের পাড়ে না যেত তাহলে হয়ত সে অন্য রকম হত না। স্বাভাবিক থাকতো।

তার যখন চার বছর বয়স সে স্কুল ঘরের সামনের দিঘিতে ড়ুবে গিয়েছিল। দিঘির পানি কি পরিস্কার! ড়ুবে যাবার পর মানুষ বাঁচার জন্যে ছটফট করে। সে কিছু করেনি। চোখ বড় বড় করে তাকিয়েছিল। হঠাৎ কি যেন ঘটল। সে অবাক হয়ে দেখলো তার মুখের উপর একটা মুখ। এমন এক নারীর মুখ যা দেখে শান্তিতে মন ভরে যায়। সেই অদ্ভুত নারী ফিসফিস করে বলল, যা তোকে জিনিস দিলাম। অনেক বড় জিনিস দিলাম।

ততক্ষণে স্কুলের ছেলেরা ছুটে এসেছে, ড্রিল মাস্টার লাফ দিয়ে পানিতে পড়লেন। মদিনাকে টেনে তুললেন।

কতদিন পার হয়েছে। মদিনার বয়স এখন এগারো। দিঘির পানির মেয়েটিকে মদিনা এখনো হঠাৎ হঠাৎ স্বপ্নে দেখে। মেয়েটি কোমল গলায় বলে, কি রে মনে আছে আমার কথা?

মদিনার খুব ইচ্ছা এই মেয়েটির কথা সে রূপা আপাকে বলে।

রূপী আপা রাগ করবেন। করলে করবেন। কাউকে তো বলতে হবে। তার যদি বড় ধরনের কোনো অসুখ হয়ে থাকে রূপা আপাই চিকিৎসা করবেন। তারা কত বড়লোক। তাদের তো আর টাকার অভাব নাই।

রূপা ডাকল, মদিনা।

মদিনা বলল, কি আপা।

তুমি কি আমার সঙ্গে হাসপাতালে যাবে? যদি যেতে চাও স্যান্ডেল পর।

মদিনার খুব যেতে ইচ্ছা করছিল। কিন্তু সে বলল, আফা আমি যাব না।

রূপা বলল, রাশেদ নামের মানুষটা সম্পর্কে তুমি কি আরো কিছু জান?

জানি। বলব?

না।

শায়লা মেয়েকে টেলিফোন করেছেন। রূপা বলল, একটু আগেই না তোমার সঙ্গে কথা হল।

শায়লা বললেন, একটু আগে কথা হলে এখন কথা বলা যাবে না?

না, যাবে না। আমি হাসপাতালে যাচ্ছি। হাসপাতাল থেকে ফিরে কথা হবে।

হাসপাতালে কেন?

এক ভদ্রলোক মারা যাচ্ছেন। মৃত্যুর আগে তিনি আমাকে গোপন কিছু কথা বলতে চান।

কি আশ্চর্য কথা, তার নাম কি? আমি কি যাব তোর সঙ্গে?

তুমি কেন যাবে? তার গোপন কথা শুনতে? অন্যের গোপন কথা তুমি কেন শুনবে?

রূপা টেলিফোনের লাইন কেটে দিল।

মদিনা ছাদে। চৌবাচ্চার পাশে বসে আছে। চৌবাচ্চার পানি স্কুল ঘরের সামনের দিঘির পানির মত পরিষ্কার। মদিনার ইচ্ছা করছে চৌবাচ্চার পানিতে শুয়ে তাকিয়ে থাকতে। পানির মেয়েটিকে অনেকদিন সে স্বপ্নে দেখে না। আজ খুব দেখতে ইচ্ছা করছে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress