আমি যে কজন গাধা মানুষকে চিনি
আমি যে কজন গাধা মানুষকে চিনি তোর সুলতান চাচা তাদের মধ্যে এক নম্বর। গাধা শ্রেষ্ঠ।
সুলতান চাচা মোটেই গাধা মানুষ না। ভাল মানুষ, বুদ্ধিমান মানুষ। কথা রিপিট করলেই মানুষ গাধা হয় না।
চুপ করে ভাত খা। তোর জ্ঞানী কথা ভাল লাগছে না।
চুপ করেই তো খাচ্ছি। কথা তুমি শুরু করেছ। তুমি একতরফা কথা বলবে আমি চুপ করে থাকব এটা তো ফেয়ার না।
তোর সুলতান চাচাকে গাধা মানব প্রমাণ করে দেব। প্রমাণ করাব?
কর।
থাক। তোর সঙ্গে কোন কথা নেই। আমি নিঃশব্দে খাব।
নিঃশব্দে তুমি খাচ্ছ না বাবা। কড়মড় করে শসা কামড়াচ্ছ। আমার উপরের রাগ শসার উপরে ঢালছ।
হারুন মেয়েকে নিয়ে রাতের খাবার খেতে বসেছেন। খাবার সময় হালকা গল্প-গুজব করতে তিনি পছন্দ করেন। রূপা বেশির ভাগ সময় আলোচনা হালকা পর্যায়ে রাখে না। কঠিন পর্যায়ে নিয়ে যায়। হারুনকে মেজাজ খারাপ করে আলোচনা শেষ করতে হয়।
রূপা বলল, বাবা। তোমার ইতিহাস কাব্য কেমন চলছে?
হারুন বললেন, তোর কথার মধ্যে ফাজলামী ভাব লক্ষ করছি। এটা আমার পছন্দ না।
রূপা বলল, তাহলে ঐ প্রসঙ্গ থাক। অন্য প্রসঙ্গ। তলাবিহীন কুয়া সম্পর্কে তো কিছুই বললে না। কুয়া পেয়েছিলে?
হুঁ।
সত্যি তলা নেই?
মস্ত বড় একটা পাথর ছুড়ে মেরেছিলাম। সেই পাথর পানিতে হিট করেছে এমন শব্দ পাই নি।
রূপা বলল, মনে হয় কুয়ায় পানি নেই।
হারুন বললেন, পানি না থাকলে মাটি তো থাকবে। মাটিতে পড়ার শব্দ হবে না?
হয়ত নিচে মাটি নেই। নরম কাদামাটি। পাথর কাদামাটিতে শব্দ না করেই দেবে গেছে।
হতে পারে।
বাবা! তুমি মেজাজ খারাপ করে খচ্ছি। বদ হজম হবে। মেজাজ ঠিক কর। আমি একটা থিওরি বের করেছি। শুনবে?
বল শুনি।
আমার ধারণা এই পৃথিবীর প্রতিটি মানব সন্তানকে কোনো না কোনো Special gift দিয়ে পাঠানো হয়। বেশির ভাগ মানুষই তাদের এই গিফট সম্পর্কে জানে না। তোমার ঘড়ি বালিকা, ঘড়ি না দেখে সময় বলতে পারে। তার মতো আমিও হয়ত কিছু পারি। তুমিও পার। যদিও এখন কোনো কারণে পারছো না।
হারুন কিছু বললেন না। রূপা বলল, বাবা তুমি কি গিফট নিয়ে এসেছ বলে তোমার ধারণা?
আমি কোন গিফট নিয়ে আসিনি।
অবশ্যই এসেছ। চিন্তা করে বল।
হারুন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, কোনো কারণ ছাড়া মানুষকে বৈরী করার ক্ষমতা নিয়ে আমি পৃথিবীতে এসেছি। এটাই আমার Special Gift. উদাহরণ হল তোর মা। আমি এমন কি করেছি যে সে আমাকে ছেড়ে চলে গেল? তুই একটা কারণ দেখা সে কেন গেছে।
রূপা বলল, মানুষ হিসেবে তুমি খুবই Predictable. কোন কাজের পর তুমি কোন কাজ করবে তা আগে থেকে বলে দেয়া যায়। প্রেডিকটেবল মানুষ হল যন্ত্রের মতো। মেয়েরা যন্ত্র মানব পছন্দ করে না। মা এই জন্যেই তোমাকে ছেড়ে চলে গেছে এবং ভাল করেছে।
হারুন বললেন, যার কাছে গেছে সে খুব আনপ্রেডিকটেবল? সে তো চশমা চোখে ছাগল ছাড়া কিছু না। ছাগলের সঙ্গে তার একটাই তফাৎছাগল ব্যা ব্যা করে আর সে চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলে। যখন কথা বলে তখন মনে হয় জাবর কাটছে। ছাগলার ছাগলা।
রূপা বলল, বাবা তুমি উনার উপর শুধু শুধু রাগ করছ। উনি মাকে তোমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে যান নি। মা স্বেচ্ছায় গেছেন। রাগ করলে তুমি মার উপর রাগ করতে পার।
ঐ ছাগলাটা তোর কাছে রসগোল্লা?
রূপা বলল, খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে মানুষের তুলনা করা ঠিক না, তবে উনি মানুষ ভাল। যথেষ্টই ভাল।
ছাগলাটার ভাল কি আছে যা আমার নেই?
আলোচনাটা থাক না বাবা।
থাকবে না। আমি শুনতে চাচ্ছি। তোর কাছে ছাগলাটা কীভাবে মহামানব হয়ে গেল।
বাবা। তুমি প্রচণ্ড রেগে গেছ। আমি তোমার রাগ আর বাড়াব না। খাওয়া শেষ কর। মটরশুটি দিয়ে কৈ মাছের ঝোল ক্লাসিক পর্যায়ের ভাল হয়েছে!
তোর ক্লাসিক কৈ মাছের আমি গুষ্ঠি কিলাই। হারুন খাওয়া ছেড়ে উঠে দাড়ালেন।
রূপা হতাশ গলায় বলল, বাবা তুমি ছেলেমানুষ না। দুই মাস আগে আমরা তোমার ষাট বছর পূর্তির উৎসব করেছি। এই বয়সে তুমি যদি রাগ করে ভাত না খাও সেটা হবে খুবই হাস্যকর।
হারুন বললেন, গোদের উপর বিষফোঁড়ার কথা আমরা বলি। তুই হচ্ছিস গোদের উপর ক্যানসার কিংবা এরচেয়েও খারাপ কিছু গোদের উপর এইডস। তুই কাল ভোরে চলে যাবি। তোর মা এবং তার মহামানব স্বামীর সঙ্গে বাস করবি। আমার মতো প্রেডিকটেবল মানুষের সঙ্গে থাকার তোর কোনো দরকার নেই। কাল ভোরে তুই অবশ্যই আমার সংসার থেকে অফ হয়ে যাবি। অবশ্যই, অবশ্যই।
রূপা বলল, তুমি যে খুব প্রেডিকটেবল মানুষ তার উদাহরণ আমি এখন দেব। কিছুক্ষণের মধ্যেই তুমি আমাকে বলবে, আমি খেতে বসছি, রূপা তুই আমার সামনে বোস। কেউ সামনে না বসলে আমি খেতে পারি না।
হারুন বললেন, এমন কথা আমি যদি বলি তাহলে আমি মানুষ জাতির কেউ না। আমি কুকুর প্রজাতির। ভাল জাতের কুকুরও না। দেশী নেড়ি কুত্তা।
হারুন টেবিল থেকে কফি মগ তুলে দেয়ালে ছুড়ে মারলেন। কফি মগটা রূপার ছোটবেলার এবং খুবই পছন্দের। স্কুলে ড্রেস এস ইউ লাইক টোকাই মেয়ে সেজে পেয়েছিল। টোকাই রূপার বড় বাঁধানো ছবি তাদের বাসায় ছিল। রূপার মা বাড়ি ছেড়ে যাবার সময় ছবিটা সঙ্গে নিয়ে গেছেন।
হারুন মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, এখন শিক্ষা হয়েছে?
রূপা বলল, হয়েছে। আজকের ডিনার আমার জন্যে বিশেষ শিক্ষা সফর।
হারুন বললেন, এত কিছুর পরেও তুই হাসিমুখে খাওয়া-দাওয়া করতে। পারছিস?
রূপা বলল, পারছি। তোমার মেজাজ খারাপ হয়েছে। আমার তো হয় নি। ক্লাসিক কৈ মাছের ঝোলের পুরো বাটি আমি শেষ করব। তুমি রাতে কোনো সময় না কোনো সময় খেতে আসবে। তখন দেখবে কৈ মাছের বাটি খালি।
ভারভ্যারানি বন্ধ কর। ফাজিল মেয়ে।
রূপা বাবার দিকে তাকিয়ে হাসল।
হারুন দোতলায় উঠে গেলেন। মলিনা কফি মগের ভাঙা টুকরা তুলতে তুলতে বলল, খালুজান আইজ বেজায় রাগছে। অবশ্য পুরুষ মানুষের রাগ ভাল জিনিস। মেনা বিলাইয়ের মত পুরুষ কোনো কামের না। নারী চিনি লাজে, পুরুষ চিনি রাগে।
রূপা বলল, কথা কম বল মলিনা, তোমার কথার যন্ত্রণায় আমি অস্থির।
মলিনা বলল, আপনি আমার কথার যন্ত্রণায় অস্থির আর আমি অস্থির মদিনার কথার যন্ত্রণায়। এই মেয়ে রাইতে ঘুমায় না। খালি কথা কয়।
কার সাথে কথা বলে?
আমি বললে তো বিশ্বাস যাবেন না, সে কথা কয় ভূতের সাথে। এই বাড়িতে না-কি একটা ভূত আছে। ভূতটার সাথে মদিনা গফ করে। আমি তারে বলেছি, আমার লগে রাইতে থাকবা না। আফার সাথে গিয়া থাক। আফাও শুনুক তোমার ভূতের গফ। আমি একলা শুনব কোন দুঃখে।
রূপা বলল, মদিনাকে থাকতে বল আমার সঙ্গে। আমার অসুবিধা নাই।
মলিনা বলল, বুঝছেন আফা, হে ভূতের সাথে গফ করে। ভূত তো দুই একটা কথা বলবে। আমি ভূতের কথা কিছু শুনি না। মদিনা একলাই কথা কয়। মাইয়াটা পাগল। তার মাথা কামাইয়া তালুতে পাগলের তেল দিলে ভাল হয়। আমাদের অঞ্চলের বশির কবিরাজ পাগলের তেল বেচে। পঞ্চাশ টাকা বেতিল। দুই বোতল একত্রে কিনলে পঁচাশি টেকা। পনরো টাকা কমিশন।
রূপা নিজের ঘরের দিকে রওনা হল। মলিনার কথার হাত থেকে বাঁচার একটাই উপীয় সামনে থেকে সরে যাওয়া।
মদিনা বিছানা বালিশ নিয়ে রূপার সঙ্গে ঘুমুতে এসেছে। মেঝেতে বিছানা করে শুয়েছে। রূপার একবার মনে হল মেয়েটাকে বলে, মদিনা মেঝেতে শোবার দরকার নেই। এসো খাটে উঠে এসে আমার সঙ্গে শোও। আমরা দুজনই মহাশক্তিধর মানব প্রজাতির অংশ। টাকা-পয়সা নামক একটি বিষয়ের কারণে আমরা আলাদা হয়ে গেছি। টাকা-পয়সার বিষয়টা অন্য কোনো প্রজাতির মধ্যে নেই বলে তারা আলাদা হয় নি।
রূপা বলল, তোমার ভূতটার কি অবস্থা? ভূত এখনো দেখ?
দেখি। আপনের ঘরে খাড়ায়া ছিল। আমারে দেইখা চইলা গেছে।
তোমাকে ভয় পায়?
জী না, তয় হে আমার উপরে নারাজ।
নারাজ কেন?
আমি তারে দেখতে পারি এই জন্যে হে নারাজ। হে চায় না কেউ তারে দেখুক।
রূপা গায়ে চাদর টানতে টানতে বলল, তোমার মাথায় সমস্যা আছে। তোমাকে আমি একজন ভালো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। ডাক্তার তোমার
দরজায় টোকা পড়ছে। রূপা বলল, কে?
হারুন বললেন, রূপা মা, ভাত খেতে যাচ্ছি। তুই এসে বোস। তুই না বসলে খেতে পারব না।
ক্ষুধায় অস্থির হয়েছ বাবা?
হুঁ।
রূপা বলল, তুমি টেবিলে যাও আমি আসছি।
মদিনা চাপা গলায় বলল, আফা আপনার পিতা খুবই ভালোমানুষ। আমি এমন ভালোমানুষ দেখি নাই।
হারুন আগ্রহ করে খাচ্ছেন। তার বাঁ পাশে রূপা বসেছে। সে বাবার খাওয়া দেখছে। তার মুখ হাসি হাসি। হারুন বললেন, আমি ডিসিসান নিয়েছি এখন থেকে আনপ্রেডিকটেবল সব কর্মকাণ্ড করব।
রূপা বলল, ভাল তো! এই বয়সে আমার বিয়ে করাটা হবে সবচে আনপ্রেডিকটেবল ঘটনা। বিয়ে করবে ঠিক করেছ?
হ্যাঁ। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে পাত্রী খুঁজব। তারপর ধুমধাম করে বিয়ে। আমি ঠাট্টা করছি না। আমি সিরিয়াস।
রূপা বলল, সত্যি সত্যি তুমি যদি বিয়ে কর তাহলে ভালই হবে। তুমি মোটামুটি নিঃসঙ্গ একজন মানুষ। বিয়ে করলে সার্বক্ষণিক সঙ্গী পাবে। পীর-ফকিরের সন্ধানে যখন যাবে নতুন মা তোমার সঙ্গে যাবে।
তাকে মা ডাকবি?
কেন ডাকবো না।
তোর মা যে মহামানবকে বিয়ে করেছে তাকে কি তুই বাবা ডাকিস?
না।
তাহলে আমি যাকে বিয়ে করব তাকে মা ডাকবি কোন লজিকে?
বাবা ডাকা অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। মা ডাকা সহজ।
বাবা ডাকা কঠিন কেন?
জানি না কেন।
হারুন বললেন, নবীজির একটা হাদিস আছে। নবীজি বলেছেনআল্লাহর পরে আমি যদি আর কাউকে সিজদা করার হুকুম দিতাম সে হত বাবা। এর অর্থ হচ্ছে বাবা অনেক বড় ব্যাপার। এই কারণেই বাবা ডাকা এত কঠিন।
হতে পারে।
হারুনের খাওয়া শেষ। তিনি বেসিনে হাত ধুতে ধুতে বললেন, সুন্দর করে একটা বিজ্ঞাপন রেডি করে দিস। পাত্রী চাই লিখবি না। লিখৰি জীবনবান্ধবী চাই।
সঙ্গে কি তোমার যুবক বয়সের কোনো ছবি যাবে?
ঠাট্টা করবি না। আই মিন বিজনেস। বিজ্ঞাপনে আমার বয়স উল্লেখ থাকবে। আমার যেসব ত্রুটি আছে, তারো উল্লেখ থাকবে।
তোমার ত্রুটিগুলি কি?
তোর মার কাছ থেকে জেনে নিস। স্ত্রীরাই স্বামীর ত্রুটি সবচে ভাল জানে।
রূপা বলল, বাবা! তুমি একজন ত্রুটিহীন মানুষ।
হারুন বললেন, আমাকে খুশি করা টাইপ বলবি না। কাজের কথায় আয় জীবন বান্ধবী চাই লেখা ঠিক হবে না। লোকজন অন্য অর্থ করতে পারে। জীবন সঙ্গিনী লেখাই ভাল।
যদিদং হৃদয়ং তব
অদিদং হৃদয়ং মম
এর মানে কি? এর মানে হল, তোমার হৃদয় যা। আমার হৃদয়ও তা।
রাত তিনটা বাজে।
রূপার ঘুম ভেঙে গেছে। ঘরের বাতি নেভানো। বারান্দায় বাতি জ্বলছে। সেই আলোয় ঘরের ভেতরটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। রূপা দেখল মদিনা বিছানায় বসে আছে। হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছে।
আপনারে বললাম, আপনে আফার ঘরে ঢুকবেন না। আফার ক্ষতি করলে আমি কিন্তু আফনেরে ছাড়ব না। এই বাড়ির মেলা ঘর আছে খালি পইড়া থাকে। সেই খানে থাকেন। আফার পিছে ঘুর ঘুর করেন কি জন্যে?
রূপা ডাকলো, মদিনা!
মদিনা চমকে তাকালো।
রূপা বাতি জ্বালালো। বিছানার পাশে রাখা টেবিল থেকে পানির গ্লাস নিয়ে চুমুক দিল।
মদিনা মাথা নিচু করে বসে আছে। রূপার দিকে তাকাচ্ছে না। রূপা বলল, কার সঙ্গে কথা বল মদিনা?
মদিনা নিচু গলায় বলল, ভূতটার সাথে।
তোমার ভূতটা কি এখনো আছে?
না।
তুমি একাই ভূতের সঙ্গে কথা বল? ভূত কথা বলে না?
টুক টাক কথা কয়! বেশি না।
ভূতটার কি কোনো নাম আছে?
না। ভূতটা আপনের পিছে লাগছে। তাড়াতাড়ি বিয়া করেন আফা। এই ভূতটা কুমারী মেয়ের পিছে ঘুরে আপনার বিয়া হইলে অন্য মেয়ের সন্ধানে চইলা যাবে।
রূপা হাই তুলতে তুলতে বলল, ভূতের আলাপটা শুনতে ভাল লাগছে না। তুমি ঘুমাও। আমি বাতি নিভিয়ে দিচ্ছি। ভূত যদি আসেও তার সঙ্গে কথা বলতে যাবে না।
রূপা বাতি নিভিয়ে দিল। ঘুমের সমস্যা আর কখনো হয়। আজ। সে এপাশ ওপাশ করতে লাগল। ভূত-প্রেত বলে সত্যি কি কিছু আছে? যদি থাকে তাদের জগতটা কেমন? তাদের চিন্তা-ভাবনাই বা কেমন?
আফা।
এখনো জেগে আছো। ঘুমাও।
আপনে কি আমার উপর রাগ হইছেন?
রাগ হব কেন?
আমি যে একজনের বিষয়ে বলেছি উনার অবস্থা ভালো না।
রূপা বলল, যা মনে আসে তাই বলে ফেলা ঠিক না।
আফা আমি মিথ্যা বলি নাই।
অনেক সময় আমরা ভাবি সত্যি কথা বলছি, আসলে তা না।
উনার শইলে নীল রঙের চাদর। নাকে নল। আমি পরিষ্কার দেখলাম।
কখন দেখলে?
এই কিছুক্ষণ আগে। উনার মাথার কাছে একটা ঘড়ি আছে। ঘড়িতে তিনটা বিশ বাজে।
ঠিক আছে। এখন ঘুমাও।
আমি ঘড়ির সময় কীভাবে দেখি আপনারে বলব?
না। বকবকানি বন্ধ। এক মলিনাকে নিয়ে কুল পাচ্ছি না। তুমি হয়েছ দ্বিতীয় মলিনা। ঘুমাও।
মদিনা ক্ষীণ স্বরে বলল, মনে করেন আপনে আমারে বললেন, মদিনা! কয়টা বাজে? ঘর অন্ধকার আমি কিছু দেখতেছি না কিন্তু চউখ বন্ধ করলেই, এই বাড়ির যে কোন একটা ঘড়ি দেখব। আফা আমার মনে হয় আমার বিরাট কোনো অসুখ আছে।
রূপা বলল, আমারও তাই ধারণী। এখন আর কথা না।
রাত তিনটা পঁচিশ মিনিটে রাশেদকে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তার লাংসের কার্যক্ষমতা সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে গেছে। কৃত্রিম যন্ত্রে ফুসফুসে অক্সিজেন দেবার ব্যবস্থা করতে হবে। সকালের আগে তা করা যাচ্ছে না। সকাল পর্যন্ত সময়টা রাশেদকে নিজের উপরে টিকে থাকতে হবে।
রাশেদের মনে হচ্ছে ট্রেনে করে সে যাচ্ছে। ট্রেনটা টানেলের ভেতর ঢুকেছে। টানেলের ভেতর সারি সারি হলুদ আলো। টানেলের দুপাশে ছোট ছোট ঘর। রাশেদ বিড়বিড় করে বলল,
রেলগাড়ি ঝমাঝম, পা পিছলে আলুর দম
ইস্টিশনের মিষ্টি কুল, শখের বাগান ‘গোলাম’ ফুল।
গোলাম ফুলটা আবার কি? গোলাপ ফুল হবার কথা না? সে আবারও ছড়াটা বলল, গোলাপ ফুলের জায়গায় আবারও গোলাম ফুল হয়ে গেল।
এতক্ষণ সে ট্রেনে যাচ্ছিল হঠাৎ দেখল ট্রেনটা হাসপাতালের ট্রলি হয়ে গেছে। ট্রলি ঠেলছে রূপা ব্যানার্জি। তার গায়ে রাতে শোবার পাতলা পোশাক। শরীর দেখা যাচ্ছে। তার ঠোঁটে সিগারেট। সে ধোয়া ফেলছে রাশেদের মুখে। সিগারেটের ধোঁয়ায় রাশেদের গা গুলাচ্ছে।
রূপা ব্যানার্জি বলল, তুমি কি ভেবেছিলে? আমাকে ছেড়ে পালিয়ে বাঁচবে? পালাতে পেরেছ?
না।
মাইকেল মধুসূদনের কবিতা শুনবে?
না।
আহা শোন না–জলধির অতল সলিলে, পষিস যদিও তুই, পষিব সে দেশে। এর অর্থ হচ্ছে–সাগরের নিচে লুকিয়ে থাকলেও আমি তোমাকে খুঁজে বের করব।
হুঁ।
তুমি যে মারা যাচ্ছ এটা বুঝতে পারছ?
হুঁ।
কি মজার কথা। মারা যাবার কথা ছিল আমার। আমি ঠিকই বেঁচে আছি। তুমি মরে যাচ্ছ।
হুঁ।
তোমার কবরে কি এপিটাফ হবে তুমি চিন্তা করেছ?
না।
আমি একটা বলব?
বল।
তোমার কবরে লেখা থাকবে–পাখি উড়ে গেছে।
আচ্ছা।
কালো গ্রানাইট পাথরে সাদা অক্ষরে লেখা। সেখানে উড়ন্ত একটা পাখির ছবিও থাকবে। তোমার কী পাখি পছন্দ?
ঘুঘু পাখি।
আচ্ছা ঠিক আছে–ঘুঘু পাখিই থাকবে। পাখিটার নিচে লেখা থাকবে। বার বার ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান। হি হি হি।
রূপা ব্যানার্জি শব্দ করে হাসছে। সে একা হাসছে না। আরো অনেকেই হাসছে। যারা হাসছে তারা কি সবাই ট্রেনের যাত্রী? ট্রেন থেমে আছে কেন?