Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » রূপা (২০১০) || Humayun Ahmed » Page 3

রূপা (২০১০) || Humayun Ahmed

রূপা ছবি আঁকতে বসেছে

রূপা ছবি আঁকতে বসেছে। জলরঙের ছবি আঁকার আয়োজন অনেক। পেপারে ট্রিটমেন্ট দিয়ে আয়োজনের শুরু। বাথটাবে হ্যান্ডমেড পেপার ভেজানো হয়েছে। ভেজা কাগজ রোদে খানিকটা শুকিয়ে রঙের প্রথম ওয়াশ দিতে হবে। জলরঙ ছবির বিষয়বস্তু আগেভাগে ঠিক করা কঠিন। ছবি তার নিজের প্রাণে এগিয়ে চলে। তারপরেও রূপা ঠিক করে রেখেছে তার ছবির মূল বিষয় হবে জানালা। জানালা দিয়ে ঘরে রোদ ঢুকছে এ রকম ছবি। ছবির নাম রোদ্র। কিংবা রোদ। রোদের আলাদা কোনো ইংরেজি প্রতিশব্দ নেই। রোদ হচ্ছে Sunshine, একইভাবে জোছনা Moonshine. কবি-সাহিত্যিকরা নতুন নতুন শব্দ তৈরি করেন। ইংরেজি ভাষার কেউ রোদ এবং জোছনার কোনো প্রতিশব্দ কেন করলেন না ভাবতে ভাবতে রূপা একটা শব্দ নিজেই তৈরি করল, রোদ হল Sube. তার ছবির নাম Sube. কেউ যদি জিজ্ঞেস করে Sube কি? সে বলবে রোদ। একইভাবে জোছনা হল Mube.

রূপা ডিকশনারি খুলল, হয়ত দেখা যাবে sube বলে কোনো শব্দ আছে। Oxford Advanced Learners Dictionary-তে Sube বা Mube নামে কোনো শব্দ নেই। কাজেই ছবির নাম sube রাখা যেতে পারে।

আফা, খালুজান আসছে। সাথে একটা মাইয়া নিয়া আসছে। মাইয়াটারে দেইখা মনে হয় দোয়াইতের কালি দিয়া সিনান কইরা আসছে। এমুন কালা মাইয়া আমি বাপের জন্মে দেখি নাই। মা কালীও এই মাইয়ার কাছে ফর্সা।

রূপা উঠে দাঁড়াল। বাথটাবে কাগজ আরো কিছুক্ষণ ভিজলেও ক্ষতি হবে না। এই মুহূর্তে তার ইচ্ছা করছে বাবার ব্যস্ত মুখ দেখতে। বাবা যেখানেই যান মাইক্রোবাস ভর্তি জিনিসপত্র নিয়ে আসেন, কলার কাদি, মানকচু। মাটির হাঁড়িতে জিয়ল মাছ। একবার দুটা রাজহাঁস নিয়ে এসেছিলেন। ছাড়া পেয়েই দুটা হাঁসের একটা ছুটে এসে রূপার হাঁটুতে ঠোকর দিয়েছিল।

রূপা বারান্দায় এসে দাঁড়াল। হারুন ব্যস্ত ভঙ্গিতে জিনিসপত্র নামাচ্ছেন। একটু দূরে কাপড়ের পুঁটলি হাতে দশ-এগারো বছরের এক বালিকা। বালিকার গাত্রবর্ণ ঘন কালো। তার মুখ গোলাকার। এতই গোল যে দেখে মনে হয় কাঁটা কম্পাস দিয়ে আঁকা।

গোলাকার মুখের সঙ্গে মিলিয়ে বড় বড় গোল চোখ। গোল চোখে আপনাতেই বিস্ময় ভাব চলে আসে। বালিকার চোখের বিস্ময় নেই, বিষণ্ণতা আছে।

হারুন রূপার দিকে তাকিয়ে বললেন, হ্যালো ইয়াং লেডি।

রূপা বলল, হ্যালো ওল্ড বাবা। এই কি তোমার ঘড়ি-কন্যা?

হারুন বললেন, ইয়েস।

জীবন্ত ঘড়ি নিয়ে চলে এসেছ?

হুঁ। ঘরের টুকটাক কাজ করবে। স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেব। পড়াশোনা করবে।

বাবা-মা ছেড়ে দিল?

না দিয়ে করবে কি? একবেলা খাওয়া জুটে তো দুই বেলা জুটে না এমন অবস্থা। আমি যখন বললাম, মেয়েটাকে আমার কাছে দিয়ে দাও, তারা মনে হল আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে। মেয়েটাকে কাছে ডেকে দুএকটা কথা বল। ঘড়ির সময় জিজ্ঞেস কর। ওর ভয়টা কাটিয়ে দে।

সে ভয় পাচ্ছে না বাবা।

ভয় অবশ্যই পাচ্ছে। বস্তি থেকে উঠে আসা মেয়ে। প্রথম ঢাকা শহরে এসেছে। ভয় পাবে না মানে?

নাম মদিনা! তাই না বাবা?

হুঁ। বাবা-মা ডাকে লতি।

নাম মদিন, বাবা-মা লতি ডাকবে কেন?

আমি জানব কীভাবে? আমাদের বাড়িতে তার স্টেটাস কি?

কাজের মেয়ে? তার স্টেটাস হচ্ছে A gifted child.

হারুন গলা উঁচিয়ে ডাকলেন, লতি এদিকে আস। তোমার আপার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই।

মদিনা এগিয়ে এল। তার আসার মধ্যে কোনো জড়তা নেই। রূপার আবার মনে হল, নতুন পরিবেশে এসে মেয়েটা মোটেই ভয় পাচ্ছে না। ভয় না পেলেও কৌতূহল থাকবে। মেয়েটার চোখে কৌতূহলও নেই।

হারুন বললেন, লতি! রাজকন্যার মতো যে মেয়েটাকে দেখছ সে হচ্ছে আমার মেয়ে। তার কথা তোমাকে বলেছি। ছবি আঁকে। আমার মেয়ের নাম রূপা তাকে তুমি আপা ডাকবে।

রূপা বলল, মদিনা এসো আমার সঙ্গে। আমি জরুরি কিছু কাজ করছি। কাজ করতে করতে গল্প করব।

মদিনা মেঝেতে মাথা নিচু করে বসেছে। আরচোখে রূপার কাজ দেখছে। রূপা বাথটাব থেকে ভেজা কাগজ মেঝেতে বিছিয়ে দিল। কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে মদিনার দিকে তাকিয়ে থাকলো। মদিনাও চোখ তুলে তাকালো। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে।

রূপা বলল, নতুন জায়গায় এসে তোমার কি ভয় লাগছে?

মদিনা মুখে কিছু বলল না, তবে মাথা নেড়ে জানালো তার ভয় লাগছে। রূপা বলল, ভয় লাগার কিছু নেই। আমার বাবা অত্যন্ত ভাল মানুষ। ভাল মানুষের ছেলেমেয়েরাও ভাল মানুষ হয়। আমিও ভাল মেয়ে।

মদিনা বলল, আপনি যে ভাল মেয়ে আমি জানি।

রূপা বলল, কীভাবে জান?

মদিনা জবাব দিল না।

রূপা বলল, এ বাড়িতে তোমার প্রধান কাজ কি হবে জান? তোমার প্রধান কাজ হবে আমাকে সাহায্য করা। কাগজ পানিতে ভেজানো, শুকানো, বোর্ডে কাগজ বসিয়ে টেপ লাগানো, রঙের টিউবের মুখ বন্ধ করা, ব্রাশ পরিষ্কার করা এইসব। আমি কি করি দেখবে। দেখে দেখে শিখবে।

মদিনা ঘাড় কাত করে জানালো সে শিখবে।

তুমি কি লেখাপড়া জান?

ক্লাস ফাইভ পাস করছি।

খুব ভাল। এখন তুমি একটা কাজ কর। তোমার এই মুহূর্তে কি কি লাগবে একটা কাগজে লিখে আমার কাছে দাও। আমি আনিয়ে দেব। একই সঙ্গে তোমার হাতের লেখারও একটা পরীক্ষা হবে।

আমার কিছু লাগবে না।

অবশ্যই লাগবে। তুমি খালি পায়ে এসেছ। তোমার একজোড়া স্যান্ডেল লাগবে। টুথপেস্ট, ব্রাশ লাগবে। মুখে মাখার ক্রিম লাগবে, নারিকেল তেল লাগবে, সাবান, তোয়ালে লাগবে।

মদিনা হাসল। রূপা লক্ষ করল মেয়েটার হাসি অস্বাভাবিক সুন্দর। বেশির ভাগ মানুষ যখন হাসে শুধু তাদের ঠোঁট হাসে। চোখ হাসে না। এই মেয়েটার ঠোঁট এবং চোখ একসঙ্গে হাসছে।

আফা একটা কথা বলব?

বল।

আপনার এই বাড়িতে ভূত আছে।

তাই নাকি?

জী। খারাপ ভূত।

ভূতের ভাল-খারাপ আছে?

হুঁ।

তুমি কি ভূতটাকে দেখতে পাচ্ছি?

হুঁ! ঘরের কোনায় খাড়ায়া আপনার দিকে তাকায়াছিল। এখন নাই।

রূপা হাতের কাজ বন্ধ করে কিছুক্ষণ মদিনার দিকে তাকিয়ে বলল, মদিনা শোন, ভূত-প্রেত, রাক্ষস-খোক্কস এইসব পৃথিবীতে নেই। মানুষ কল্পনা করতে ভালবাসে বলে এইসব কল্পনা করে। তুমি এখন মলিনার কাছে। যাও। মলিনা দেখিয়ে দেবে তুমি কোথায় থাকবে। তোমাকে যে লিস্ট করতে বলেছি লিস্টটা করবে। মলিনাকে বল আমাকে এক কাপ চা বানিয়ে দিতে। তুমি কি চা বানাতে পার?

না।

মলিনার কাছ থেকে শিখে নেবে কীভাবে চা বানাতে হয়। পারবে না?

পারব।

রূপা মদিনার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ অন্য রকম গলায় বলল, আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বল কয়টা বাজে।

মদিনা বলল, বলতে পারব না।

বাবা বলছিল, জিজ্ঞাস করা মাত্র তুমি সময় বল।

সবসময় পারি না। মাঝে মাঝে পারি।

আচ্ছা যাও।

মদিনা উঠে দাঁড়াল। নীচু গলায় বলল, আফা ভূতটা আবার আসছে। ঐ যে কোনায় খাড়ায়া আছে।

রূপা বলল, ভূত ভূতের মতো দাঁড়িয়ে থাকুক। তোমাকে যা করতে বলেছি কর।

দুপুরে খেতে বসে হারুন বললেন, ঐ ছেলে রাশেদ না ফাসেদ কি যেন নাম, সে কি তার জিনিসপত্র নিয়ে গেছে?

রূপা বলল, না।

কতদিন হল গেছে?

তিন দিন দুই রাত।

টেলিফোনে কোনো খোঁজ খবর করেছে?

না।

হারুন বিস্মিত হয়ে বললেন, আশ্চর্য তো।

রূপা বলল, আশ্চর্যের কিছু নেই। উনি ইচ্ছা করেই এটা করছেন। আমার উপর মানসিক চাপ দেয়ার চেষ্টা। জিনিসপত্র ফেলে রেখে Mental pressure.

তোকে মেন্টাল প্রেসার সে কেন দিবে? তুই তার কে?

আমি তার কেউ না। তিনি আমার উপর মানসিক চাপ কেন দেবেন তাও। জানি না। হয়তো তিনি এক ধরনের খেলা খেলছেন। কিছু মানুষ আছে, আশেপাশের মানুষদের নিয়ে খেলতে পছন্দ করে, যেমন তুমি।

আমি?

তুমি জীবন্ত ঘড়ি নিয়ে চলে এসেছ। এটা তোমার খেলার একটা অংশ। তাকে নিয়ে এসেছ তোমার সব আগ্রহের সমাপ্তি।

তোর জ্ঞান তো বেশি হয়ে যাচ্ছে। কিছুদিন পর তোকে আর রূপা ডাকা যাবে না। ডাকতে হবে জ্ঞান রূপা।

জ্ঞান রূপা নাম আমার পছন্দ হয়েছে। বাবা থ্যাংক য়্যু।

ঐ ছেলেকে খুঁজে বের করতে হবে। আমার নেক্সট প্রজেক্ট–অপারেশন রাশেদ কিংবা ফাসেদ হান্ট।

রূপা বলল, ঢাকা শহরে এক কোটি মানুষ বাস করে। কেউ যদি এক কোটি মানুষের মধ্যে লুকিয়ে থাকতে চায় সে সারাজীবন লুকিয়ে থাকতে পারবে।

হারুন বললেন, কোনো বুদ্ধিমান লোক চেষ্টা করলে খুঁজে বের করতে পারবে।

রূপা বলল, বাবা তুমি বুদ্ধিমান মানুষ না। তুমি পারবে না।

আমি বুদ্ধিমান না?

না। যে কবিতায় ইতিহাসের বই লেখে সে বুদ্ধিমান না।

হারুন কঠিন গলায় বললেন, আমি গাধা মানব?

রূপা বলল, বাবা তুমি রেগে যাচ্ছ।

আমি তাকে কীভাবে খুঁজে বের করব শোন–ছবি দিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেব। শিরোনাম হবে–রাশেদ কিংবা ফাসেদ তোমাকে খুঁজছি।

রূপা বলল, বারবার রাশেদ কিংবা ফাসেদ বলবে না। তার নাম রাশেদ। এখন বল তার ছবি কোথায় পাবে?

থানায় ডায়েরি করাব। পুলিশ ছবি জোগাড় করবে।

তোমার কি ধারণা ডায়েরি করানোর সঙ্গে সঙ্গে থানার সব পুলিশ হাতে রাশেদ সাহেবের ছবি নিয়ে তাকে খুঁজতে বের হয়ে যাবে?

হারুন বললেন, আচ্ছা যা, তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না এটা মানলাম। আমি যে একজন গাধা মানব সেটাও মানলাম।

হারুন কিছু বলতে যাচ্ছিলেন তখন হন্তদন্ত হয়ে মলিনা চুকল। তার হাতে রূপার মোবাইল ফোন সেট। মলিনা বলল, আফা আম্মা টেলিফোন করছেন। রূপার মা টেলিফোন করলেই মলিনার মধ্যে অস্বাভাবিক ব্যস্ততা দেখা যায়।

রূপা বলল, মাকে বল আমি ভাত খাচ্ছি। এখন টেলিফোন ধরব না। তোমাকে আগেও বলেছি খাওয়ার সময় আমাকে টেলিফোন দিবে না।

হারুন বললেন, তুই যে কাজটা করলি তা অভদ্রতা এবং অসভ্যতা। বাইরের কেউ টেলিফোন করেনি, তোর মা টেলিফোন করেছে। নিশ্চয়ই জরুরি কোনো কথা।

রূপা বলল, যে কোনো কথা জরুরি ভাবলেই জরুরি, না ভাবলেই জরুরি না।

এটা কার কথা?

জ্ঞান রূপার কথা।

হারুন রাগি গলায় বললেন, এইসব বাণীগুলি তুই একটা খাতায় লিখে ফেল। আমি নিজ খরচে ছাপিয়ে দেব। একুশে ফেব্রুয়ারি বইমেলায় বের হবে। বইয়ের নাম হবে কথামৃত। লেখিকা জ্ঞান রূপা।

রেগে রেগে কথা বলছ কেন বাবা?

তুই তোর মার সঙ্গে অভদ্রতা করেছিস দেখে রাগ উঠেছে। সন্তানরা মাবাবার সঙ্গে অদ্ৰতা করবে এটা আমার পছন্দ না।

রূপা বলল, বাবা-মা অকারণে আমার উপর রাগ করবে এটাও আমার পছন্দ না। কাজেই এখন অপছন্দে অপছন্দে কাটাকাটি।

রূপার মার নাম শায়লা খানম। বাংলা সাহিত্যে এম.এ, তিনি স্কুল শিক্ষক বাবার পাঁচ ছেলেমেয়ের সর্বশেষ জন। তরুণী বয়সে অসম্ভব রূপবতী ছিলেন। এখনো সেই রূপ ধরে রেখেছেন। হারুনের ধারণা এখন শায়লা আগের চেয়েও রূপবতী। যতই দিন যাচ্ছে ততই না-কি তার রূপ বাড়ছে।

রূপার যখন সাত বছর বয়স তখন এক ঝড়বৃষ্টির রাতে তিনি রূপার ঘরে ঢুকলেন। নরম গলায় বললেন, ভয় লাগছে না-কি মা?

রূপা বলল, হ্যাঁ।

শায়লা বললেন, ভয় লাগারই কথা, মনে হচ্ছে কাছেই কোথাও বাজ পড়ছে।

রূপা বলল, আজ রাতে তুমি আমার সঙ্গে ঘুমাবে?

শায়লা বললেন, হ্যাঁ।

রূপার আনন্দের সীমা রইল না। রূপার ঘরটা সুন্দর করে সাজানো। ফ্যানের হুক থেকে একটা দোলনা ঝুলে। রূপার খাটটা কুষ্টিয়ার এক জমিদার বাড়ি থেকে কেনা। খাটের চারদিকে আয়না বসানো। খাটে বসলেই আয়নায় অনেকগুলি রূপ দেখা যায়। কিন্তু রূপা তার ঘরে রাতে একা ঘুমুতে তার খুবই ভয় লাগে। আকবরের মা কাজের বুয়া মেঝেতে বিছানা করে রূপার সঙ্গেই ঘুমায়। তারপরেও রূপার ভয় যায় না। শুধু মা পাশে থাকলে তার ভয় লাগে না।

রাতের খাবার শেষ করে শায়লা রূপার সঙ্গে ঘুমুতে এলেন। রূপা মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, আমার আর ভয় লাগছে না মা।

শায়লা বললেন, খুব ভালো।

রূপা বলল, মা গল্প বল।

শায়লা বললেন, গল্প না, আজ রাতে তোমার সঙ্গে জরুরি কিছু কথা বলি। মন দিয়ে শোন।

রূপা বলল, আচ্ছা। শুধু যখন বজ্রপাত হবে তখন মন দিয়ে শুনতে পারব না।

শায়লা বললেন, জরুরি কথাটা হচ্ছে, আমি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। তোমাকে ঠিক করতে হবে, তুমি আমার সঙ্গে যাবে না-কি তোমার বাবার সঙ্গে থাকবে?

তুমি কোথায় যাবে?

চিটাগাং। সেখানের এক কলেজে আমি চাকরি পেয়েছি। যাবে আমার সঙ্গে?

রূপা বলল, হুঁ।

হুঁ না, স্পষ্ট করে বল–আমি তোমার সঙ্গে যাব।

রূপা কি বলল, বুঝা গেল না, সেই সময় প্রচণ্ড বজ্রপাত হল।

শায়লা বললেন, এখন কি কবিতা বলে তোমাকে ঘুম পাড়াব?

রূপা বলল, হুঁ।

শায়লা রূপার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে কবিতা শুরু করলেন। সক মায়েরা সন্তানদের ঘুম পাড়ানি গান গেয়ে ঘুম পাড়ান। শায়লা কবিতা আবৃত্তি করেন। একটি কবিতাই আবৃত্তি করেন

দিনের আলো নিবে এল সূয্যি ডোবে ডোবে।
আকাশ ঘিরে মেঘ জুটেছে চাঁদের লোভে লোভে
মেঘের উপর মেঘ করেছে, রঙের উপর রঙ।
মন্দিরেতে কাঁসর ঘণ্টা বাজল ঠঙ ঠঙ।

পরের অংশ রূপার কাছে অস্পষ্ট। রূপা দেখল এক সন্ধ্যাবেলা তার মা ব্যাগ। স্যুটকেস নিয়ে চলে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। যদিও তিনি বলেছেন, চিটাগাং যাবেন আসলে তী-না, তিনি থাকবেন ঢাকাতেই। আকবরের মা বুয়া রূপাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলল, তোমার বাপ-মার ছাড়াছাড়ি হইছে।

রূপা বলল, ছাড়াছাড়ি কি?

ছাড়াছাড়ি হইল তালাক। তারার তালাক হইছে।

তালাক কি?

তোমার মা অন্য এক লোকরে হাঙ্গা বইছে।

হাঙ্গা বইছে মানে কি?

অত কিছু বলতে পারব না। তোমার কপাল ভাঙছে।

পুরো বিষয়টা হারুন মেয়েকে ব্যাখ্যা করলেন। সুন্দর করেই ব্যাখ্যা করলেন। তিনি মেয়েকে বললেন, তোমাদের ক্লাসে এমন কেউ কি আছে যাকে তুমি সহ্য করতে পার না। দেখলেই রাগ লাগে।

রূপা বলল, আছে সুমি নাম।

সে কি করে?

পেনসিল দিয়ে আমাকে খোঁচা দেয়। একদিন আমার স্যান্ডেলে থুথু দিয়েছিল। আমার অংক বইয়ের পাতা ছিঁড়েছে।

সুমি অন্য সেকশানে চলে গেলে ভালো হয় না?

খুব ভালো হয় বাবা।

তোমার মার সঙ্গে আমার এই অবস্থা হয়েছে। তোমার মা চলে গেছেন অন্য সেকশানে।

মা তো তোমাকে পেনসিল দিয়ে খোঁচা দেয় না।

বড়রা পেনসিলে খোঁচা দেয় না। কথা দিয়ে খোঁচা দেয়। তোমার মা কথার খোঁচা দেন। আমিও দেই। খোঁচাখুঁচি করতে করতে দুইজনই ক্লান্ত। তোমার মা অনেক বেশি ক্লান্ত বলেই এখন অন্য এক ভাল মানুষকে বিয়ে করেছেন। বুঝেছ?

হুঁ।

তোমার মা চাচ্ছেন তুমি তাদের সঙ্গে গিয়ে থাক। আমিও তাই চাচ্ছি। তোমার বয়স খুব কম। এই বয়সের ছেলেমেয়েদের জন্যে মায়ের আদর দরকার। মা তুমি কি যাবে তোমার মার সঙ্গে?

রূপা বলল, না।

হারুন বললেন, তোমার জন্যে যা ভাল তাই তোমার করা উচিত। তোমার জন্যে ভাল হল তোমার মার সঙ্গে থাকা। আমি প্রতি সপ্তাহে তোমাকে দেখতে যাব। খেলনা চকলেট এইসব নিয়ে যাব।

আমি মার সঙ্গে থাকব না। তোমার সঙ্গে থাকব।

রূপা! তুমি তোমার মায়ের মতই জেদি হচ্ছ।

আমি তোমার সঙ্গে থাকব।

আচ্ছা যাও আমার সঙ্গে থাকবে। একটু বড় হও দেখবে কত ধানে কত চাল। আমি কথার খোঁচা দিতে শুরু করব। তুমি পালাবার পথ পাবে না।

শায়লা মেয়েকে নিজের কাছে রাখার অনেক চেষ্টা করেছিলেন। কোনো লাভ হয় নি।

রূপী তার মাকে টেলিফোন করল। শায়লা বললেন, তোর খবর কি?

রূপা বলল, ভাল।

জরুরি একটা বিষয় নিয়ে তোর সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছিলাম।

বল।

কথাটা তোর বাবার বিষয়ে। সে আশেপাশে নাই তো?

না।

তোর বাবা ইদানীং খুব বিরক্ত করছে।

কি করছে?

মাছ পাঠাচ্ছে, তরিতরকারি পাঠাচ্ছে। টেলিফোনে খোঁজ-খবর করছে। ব্যাপারটা আমার কাছে ভাল লাগে না, টগরের বাবার কাছেও না। টগরের বাবা অতিমাত্রায় ভদ্র। সে কখনো কিছু বলবে না। কিন্তু সে যে বিরক্ত হচ্ছে তা বুঝা যাচ্ছে। এই মাসের ১২ তারিখ সে কি করেছে তা-কি জানিস?

জানি না।

আমাকে দামী একটা শাড়ি পাঠিয়েছে। ১২ তারিখ তোর বাবার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছিল এই উপলক্ষে শাড়ি। এখন ব্যাপারটা আমার জন্যে কতটা অস্বস্তিকর বুঝতে পারছিস? যে বিয়ের অস্তিত্বই নেই সেই বিয়ের দিন আবার কি?

ঠিক বলেছ মা।

টারের বাবা আমাকে বলল, তুমি তোমার প্রথম হাজব্যান্ডকে নিয়ে কোনো একটা রেস্টুরেন্টে ডিনার করে এসো। ঘণ্টা দুই স্মৃতি রোমণ কর।ভদলোককে কিছু সময় দাও। ভদ্রলোক তোমার হাত ধরতে চাইলে হাত ধরতে দাও। তিনি তোমাকে মিস করেন। কি রকম বিব্রতকর অবস্থা বুঝতে পারছিস?

পারছি।

তুই কি তোর বাবাকে বিষয়টা বুঝিয়ে বলতে পারবি?

পারব তবে বলব না।

বলবি না কেন?

কারণ সমস্যাটা তোমার, আমার না। তোমার সমস্যা তুমি সমাধান করবে। বাবাকে টেলিফোন করে বলবে, স্টপ দিস ননসেন্স। মা টেলিফোন রাখলাম। রূপী ফোনের লাইন কেটে দিন। হারুন তখনি মেয়ের পাশে এসে দাড়ালেন, আগ্রহ নিয়ে বললেন, এতক্ষন তুই কি তোর মার সঙ্গে কথা বলছিলি?

রূপা বলল, হ্যাঁ।

কি বলল তোর মা?

হাবিজাবি কথা।

হাবিজাবি কি কথা?

আমি ভাল আছি, তুমি কেমন আছে এই জাতীয় কথাবার্তাকে বলে হাবিজাবি muit

আর কিছু বলেনি?

না।

আমার বিষয়ে তোর মা কিছু বলেছে?

না।

আজ একটা বিশেষ দিন তো। আমি ভাবলাম এই বিষয়ে তোকে কিছু বলল কি না।

বিশেষ দিনটা কি?

তোর মার সঙ্গে আজ আমার প্রথম দেখা হয়।

তোমাদের তো আর প্রেমের বিয়ে না। প্রথম দেখাটা এত ইস্পর্টেন্ট কেন হবে?

হারুন লজ্জিত গলায় বললেন, তোর মাকে দেখে বাসায় ফিরে বিরাট এক কবিতা লিখেছিলাম। বয়স কম ছিল তো। খানিকটা বোকাও ছিলাম। পুরো কবিতাটা আমার মুখস্ত আছে। শুনবি?

রূপা বলল, না শুনব না। তুমি ছাদে চলে যাও। নিজের মনে কবিতা আবৃত্তি করতে থাক। ছাদে অনেক গাছপালা আছে, তারা তোমার কবিতা শুনে মজা পাবে। বাবা প্লিজ।

চারা লাইন শোন। চার লাইন কবিতায় তোর তেমন কোনো ক্ষতি হবার কথা না।

রূপা হতাশ গলায় বলল, শুনাও।

হারুন সঙ্গে সঙ্গে আবৃত্তি শুরু করলেন। তাকে আনন্দে অভিভূত হতে দেখা গেল। রূপা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল।

আষাঢ়ের কলি ছিল
সময় সন্ধ্যা
চারদিক সুনসান
জীবন বন্ধ্যা॥
গিয়েছিলাম মালিবাগ
বাড়ি নম্বর সাত
কিছু সময় কাটালাম
হয়ে গেল রাত।
আমার এক বন্ধু
নাম সুমন
বলল সে আজ তুমি
থাকে কিছুক্ষণ
শায়লা নামে এক মেয়ে
ঐ বাড়িতে থাকে।
দেখবে তার শান্ত মুখ
কোন এক ফাঁকে…

রূপা বলল, চার লাইন বলার কথা। তুমি দেখি ফেরদৌসির শাহানামা শুরু করেছ। কবিতা বন্ধ।

হারুন বন্ধ করলেন না, আগ্রহ এবং আনন্দ নিয়ে আবৃত্তি করতে লাগলেন।

সুমনের কথা সত্য
মিথ্যা মোটেই নয়
শায়লার সঙ্গে আমার
হল পরিচয়॥

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress