হারুনের কাছে চিঠি
হারুনের কাছে চিঠি নিয়ে কে একজন এসেছে। ভীত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। হারুন খবরের কাগজ পড়ছিলেন এই সময় তার মেজাজ এমনিতেই খারাপ থাকে। আজ অতিরিক্ত খারাপ কারণ প্রথম পৃষ্ঠাতেই খবর–
ঘাতক ট্রাক ছিনিয়ে নিল ছোট্ট মীলাকে
মীলার বয়স চার। সে নার্সারিতে পড়ে।
সে তার লবণ মাখানো দুটা আমড়ার স্টিক হাতে নিয়ে মার দিকে ছুটে আসছিল। হঠাৎ ট্রাকের নিচে পড়ে গেল। আটকে গেল ট্রাকের চাকায়। এই অবস্থাতেই ট্রাক ছুটে বের হয়ে গেল।
ছোট্ট মীলার একটা ছবি ছাপা হয়েছে। কাঁধে স্কুল ব্যাগ। মাথার চুল পনিটেল করে বাঁধা। মীলাকে দেখাচ্ছে ছোটবেলার রূপার মতো।
কাগজ দূরে ছুড়ে ফেলে হারুন বললেন, কার চিঠি?
পত্রবাহক ভয়ে ভয়ে বলল, নাম জানি না স্যার। আমারে বলেছেন আপনারে দিতে। বাসা চিনায়ে দিয়েছেন।
যে চিঠি লিখেছে সে কোথায়?
উনি কোথায় জানি না। উনি বলেছেন, দেশের বাড়ি চলে যাবেন।
দেশের বাড়ি কোথায়?
জানি না স্যার।
হারুন বললেন, তোমার ভাওতাবাজি আমি বুঝতে পরছি না এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। চাদাবাজ চাঁদা চেয়ে চিঠি লিখে তোমাকে দিয়ে পাঠিয়েছে। তোমাকে আমি ছেড়ে দেব তা ভাববে না। যদি ভাব তাহলে তুমি বোকার স্বর্গে বাস করছ। তোমাকে আমি পুলিশে দেব। জীবন যাবে জেলের ল্যাপসি খেতে খেতে। ল্যাপসি চেন?
জী না স্যার।
রূপা বলল, কেন শুধু শুধু ফেনাচ্ছ বাবা? হাত থেকে চিঠি নিয়ে পড় তারপর যা করার করবে।
হারুন বললেন, নাম-গোত্রহীন কারোর লেখা চিঠি তো আমি পড়ব না। এই চিঠি ডাকে আসে নি। কুরিয়ার সার্ভিসেও আসে নি। কাজেই চিঠিতে সমস্যা আছে।
তাহলে তাকে বলে দাও চিঠি নিয়ে চলে যেতে।
হারুন কঠিন গলায় বললেন, তোমার এই চিঠি আমি পড়ব না। যে চিঠি লিখেছে তার নাম-ঠিকানা নিয়ে এসো তারপর দেখা যাবে।
রূপা বলল, বাবা! আমার সাজেশন হচ্ছে চিঠিটা পড়ো। হয়ত চিঠিতেই নাম-ঠিকানা আছে।
হারুন নিতান্তই অনিচ্ছায় চিঠি হাতে নিলেন। চিঠিতে লেখা–
শ্রদ্ধাভাজনেধু
রূপার বাবা।
আমি দুটি কারণে অত্যন্ত লজ্জিত। প্রথম কারণ, আপনার নাম জানা হয়নি। যে কারণে বাধ্য হয়ে রূপার বাবা লিখছি। দ্বিতীয় কারণ ঐ দিন আপনার কাছ থেকে বিদায় নেয়া হয়নি।
আশা করি বুঝতে পারছেন আমি রাশেদ। ঐ রাতে আপনাদের গাড়ি নিয়ে প্রথম কলাবাগান গেলাম। সেখান থেকে গেলাম এক চায়ের দোকানে। সেখানে বসেই এই চিঠি লিখছি। চিঠি লেখা শেষ হলে সামছুর হাতে দিয়ে রওনা হব কমলাপুর রেল স্টেশনের দিকে। যাব নেত্রকোনা। রেল স্টেশনের নাম আঠারোবাড়ি। রেল স্টেশন থেকে মাইল দশেক দূরে আমাদের বাড়ি। বাড়ির নাম উকিল বাড়ি। উকিল বাড়ি নাম কেন হয়েছে আমি জানি না। আমাদের গুঠিতে কোনো উকিল নেই। একজন পীর ছিলেন। আমার দাদার বাবা। নাম বলতে পারব না। বাড়ির নাম পীর বাড়ি হলে যুক্তিযুক্ত হত। পীরের প্রসঙ্গ আনলাম কারণ আপনি পীর ফকির খুঁজে বেড়ান।
যে জন্যে এই চিঠি লেখা সেটা ব্যাখ্যা করি। চায়ের দোকানের মালিক সামছুর ছেলের নাম কেনতু, সে অপূর্ব গানের গলা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছে। আমি গান বুঝি না। আধো ঘুম আধো জাগরণে তার গান শুনে মনে হয়েছে, প্রকৃতি হাত ভরে তাকে সুর দান করেছে।
আপনার নিশ্চয়ই অনেক জানা-শোনা। আপনি কি কোনোভাবে এই ছেলেটিকে সাহায্য করতে পারেন? প্রকৃত প্রতিভা কখনো পাথরচাপা থাকে না। তবে পাথর সরাতে বাইরের কিছু সাহায্য লাগে।
অতি অল্প সময়ে আপনার যতটুকু পরিচয় পেয়েছি তাতে মনে হয়েছে আপনি এই কাজ আগ্রহ এবং আনন্দ নিয়ে করবেন।
বিনীত
রাশেদ রহমান।
রূপা বলল, চিঠিতে কি লেখা বাবা? কত টাকা চাঁদা চেয়েছে? না-কি পাত্রী চেয়ে যে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলে তার উত্তরে কেউ লিখেছে।
হারুন বললেন, পড়ে দেখ।
যে চিঠি নিয়ে এসেছে সে এখনো পঁাড়িয়ে। হারুন বললেন, তোমার ছেলেকে নিয়ে আস আধা ঘণ্টা সময়। আধা ঘণ্টা পরে এলে ট্রেন মিস করবে।
রূপা চিঠি শেষ করে হাসল। হারুন বললেন, এমন বিশ্রীভাবে হাসছিস কেন? মনে হচ্ছে পেত্নী হাসছে।
চিঠি পড়ে তুমি কি পরিমাণ আনন্দ পেয়েছ এটা বুঝতে পেরে হাসছি। তোমার পরবর্তী কাজকর্ম কি হবে সেটা বুঝতে পেরেও মজা লাগছে।
আমার পরবর্তী কর্মকাণ্ড কি?
মাইক্রোবাসের দুটা চাকা নষ্ট হয়ে গেছে। চাকা দুটা প্রথম ঠিক করাবে তারপর সুলতান চাচাকে নিয়ে রওনা হবে। আঠারোবাড়ি যাবে সেখান থেকে শুরু উকিল বাড়ি অনুসন্ধান অভিযান।
অর্ধেক ঠিক হয়েছে। বাকি অর্ধেক হয় নি।
কোন অর্ধেক ঠিক হয়েছে?
আমি রাশেদকে খুঁজে বের করব এটা ঠিক। তবে গাধা সুলতানকে সঙ্গে নেব না। সুলতান নামে কাউকে এখন আমি চিনি না।
চাচাকে নিতে না চাইলে নেবে না। কিন্তু উনাকে গাধা সুলতান বলবে না। যাদের আমি পছন্দ করি তাদের সম্পর্কে খারাপ কিছু শুনতে আমার ভাল লাগে না।
আচ্ছা আর বলব না।
রূপা বলল, আমি টেলিফোনে লাইন করে দিচ্ছি তুমি সুলতান চাচার সঙ্গে কথা বল।
কোন বিষয়ে কথা বলব?
কেনতু ছেলেটির গান শুনার জন্যে আসতে বল। তুমি তো গানের কিছু বুঝ না। উনি গানের সমজদার মানুষ।
তোর কথা সামান্য হলেও যুক্তি আছে। দে লাইন করে দে।
রূপা বাবার হাতে টেলিফোন দিয়ে উঠে গেল। মঙ্গলগ্রহে জোছনা ছবিটা আজ আঁকবে। ছবি শেষ না হওয়া পর্যন্ত উঠবে না। রঙ দেয়ার পর পর হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে শুকাবে। বৃষ্টি বাদলার দিনে আপনাআপনি কাগজ শুকাতে অনেক সময় লাগে।
হারুন বললেন, সুলতান কেমন আছ?
ভাল।
একবার ভাল বলেছ কেন? তোমার তো দুবার ভাল বলার কথা। তুমি বলবে, ভাল ভাল।
সুলতান বললেন, ভাল ভাল।
হারুন বললেন, বাসায় চলে এসো, কাজ আছে।
কখন আসব? কখন আসব?
আধা ঘণ্টার মধ্যে আসবে। এক মিনিট দেরি হলে ট্রেন মিস করবে। কাপড়-চোপড় নিয়ে এসো ঢাকার বাইরে যেতে হতে পারে।
সুলতান বললেন, পাত্রী চেয়ে যে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলে তার জবাব এসেছে? জবাব এসেছে?
গোটা বিশেক চিঠি পেয়েছি। এখনো খুলে দেখিনি। বাড়িতে চলে এসো। দেখবে।
আচ্ছা। আচ্ছা। অবশ্যই দেখবো। অবশ্যই দেখবো।
রূপা মঙ্গলগ্রহে জোছনার ছবি আঁকছে। এই ছবি আঁকায় কোনো বন্ধন নেই। মাটির রঙ লাল করা যাবে। নীল করা যাবে। জোছনার খেলাও বন্ধনমুক্ত। রূপা যা ইচ্ছা করতে পারে।
মদিনা সামনেই বসা। ছবি আঁকা দেখছে। তার চোখে আগ্রহ নেই, অনাগ্রহও নেই। এক ধরনের নির্লিপ্ততা যা সচরাচর দেখা যায় না। মানুষের পক্ষে নির্লিপ্ত হওয়া কঠিন ব্যাপার। রূপা বলল, তোমার কি শরীর খারাপ?
মদিনা না সূচক মাথা নাড়ল।
মন খারাপ?
মদিনা আবারও না সূচক মাথা নাড়ল। রূপা বলল, আমি তোমার বাবাকে একটা চিঠি লিখব। আমাকে ঠিকানা দিও।
মদিনা বলল, আমার বাবা লেখাপড়া জানেন না। মা জানে। চিঠি মারে লেখেন।
তার নাম কি?
সখিনা বিবি।
রূপী বলল, তোমার সম্পর্কে আমি প্রায় কিছুই জানি না। তোমরা কয় ভাইবোন?
চাইর ভইন। ভাই নাই। আমি সবচে ছোট। দুই ভইনের বিয়া হইছে। এক দুলাভাই রিকশা চালায় আরেক দুলাভাই ভ্যান চালায়।
তুমি যে মাঝে মাঝে অদ্ভুত কথা বল এই বিষয়ে তারা জানে?
জী জানে।
কিছু বলে তোমাকে?
না তারা থাকে পেটের ধান্দায়। পেট ছাড়া তারার অন্য চিন্তা নাই।
আমি যে ছবিটা আঁকছি সেটা কি ভাল হচ্ছে?
জী। জায়গাটা কোনখানে আফা?
মঙ্গল গ্রহ। সেখানে জোছনা ফুটেছে, তার ছবি।
এই রকম জায়গা সত্যই আছে?
রূপা বলল, পৃথিবীতেই এরচে সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে। বিশ্বভ্রহ্মাণ্ড কত বিশাল! কি অদ্ভুত সব জিনিসই না সেখানে আছে।
রূপাকে হঠাৎ চমকে দিয়ে মদিনা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গ তুলল। নীচু গলায় বলল, আফা! এই বাড়িতে যে একটা ভূত ছিল সেটা তো আপনে জানতেন।
রূপা বলল, ভূতের আলাপ থাকুক। আগেই বলেছি ভূতের আলাপ আমার পছন্দ না।
মদিনা এক দৃষ্টিতে রূপার দিকে তাকিয়ে আছে। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সে কিছু বলতে চাচ্ছে। কিন্তু সাহস করে উঠতে পারছে না।
সন্ধ্যা নাগাদ ছবি আঁকা শেষ হল। রূপা নিজেই মুগ্ধ গলায় বলল, বাহ্!
মদিনা বলল, ছবিটা খুবই সুন্দর হইছে আফা। আমার জায়গাটায় যাইতে ইচ্ছা করে। ঐ দেশে দুইটা চান?
রূপা বলল, হ্যাঁ। একটার নাম ডিমোস আরেকটার নাম ফিবোস। এখন আমার জন্যে কাগজ আর কলম আন। আমি তোমার মাকে চিঠি লিখব। তোমার মার নাম সখিনা বিবি। ঠিক বলেছি না?
জী।
সখিনা বিবিকে লেখা রূপার চিঠি।
সখিনা বিবি।
আপনি কেমন আছেন? আমার নাম রূপা। আপনার মেয়ে মদিনা, আমার সঙ্গেই থাকে। নানান ভাবে আমাকে সাহায্য করে। সে খুব ভাল মেয়ে।
এখন আপনাকে একটা দুঃসংবাদ দিচ্ছি। মদিনার খারাপ একটা অসুখ ধরা পড়েছে। ব্রেইন টিউমার। ডাক্তাররা বলেছেন দ্রুত অপারেশন করে টিউমার দূর করতে। এতেই যে রোগ সারবে তা-না। দীর্ঘদিন কেমোথেরাপি রেডিও থেরাপি নামক চিকিৎসা চালাতে হবে। এতে প্রচুর টাকা-পয়সা লাগবে। আমাদের এত টাকা-পয়সা নেই। তারপরেও আমি চেষ্টা চালিয়ে যাব।
আপনার মেয়ে অপারেশনের ভেতর দিয়ে যেতে রাজি না। আমি তাকে আপনাদের কাছে পাঠাচ্ছি। আপনি এবং আপনার স্বামী তাকে রাজি করাবেন। সে আপনাদের সঙ্গেই থাকবে। অপারেশনের ব্যবস্থা করাতে পারলেই আমি তাকে নিয়ে আসব। আপনারা ভাল থাকবেন।
রূপা।
প্রতি সপ্তাহের সোমবারে রাত নটা থেকে দশটার মধ্যে শায়লা রূপাকে টেলিফোন করেন এবং দীর্ঘ সময় কথা বলেন। রূপা যতই বলে, আমার কাজ আছে বা ঘুম পাচ্ছে তাতে লাভ হয় না। শায়লা কথা বলতেই থাকেন।
দীর্ঘ কথোপকথনের জন্যে শায়লা এই দিন বেছে নিয়েছেন তার কারণ এই দিনে রাত আটটা থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত তার স্বামী তার এক বন্ধুর বাড়িতে হাইড্রোজেন নামের জুয়া খেলতে যান। ভদ্রলোকের জুয়ার ভাগ্য সর্বনিম্ন পর্যায়ের। তিনি প্রতিবারই হারেন। মধ্যরাত পার করে বাড়ি ফেরেন। তখন তার শারীরিক অবস্থা এমন থাকে যে গাড়ির ড্রাইভার এবং বাড়ির মালী দুজন মিলে ধরাধরি করে তাকে লিফটে তুলে। তিনি যেন লিফটে বমি না করেন তার জন্যে মুখের কাছে পলিথিনের একটা ব্যাগ ধরে রাখা হয়।
রাত নটা দশ। শায়লা তার মেয়েকে টেলিফোন করেছেন। নিতান্ত অনিচ্ছায় রূপা টেলিফোন ধরল।
কেমন আছিস রূপা?
ভাল।
তোর বাবা যে পাত্রী চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল তার ফলাফল কি?
প্রচুর জবাব এসেছে। যাচাই বাছাই হচ্ছে।
যাচাই বাছাই কে করছে?
আমি করছি। সুলতান চাচা করছেন। দুই সদস্যের একটা কমিটি তৈরি করা হয়েছে। মা তুমি কি এই কমিটিতে থাকতে চাও?
আমি থাকব কোন দুঃখে?
বাবার ভাল-মন্দতো তুমি সবচে ভাল জান। তোমার পক্ষেই সম্ভব সেই মেয়ে খুঁজে বের করা যে বাবার জন্যে পারফেক্ট।
শায়লা বললেন, আমি লক্ষ্য করেছি যেসব কথায় আমি হার্ট হই, অপমানিত বোধ করি, তুই আমাকে সেইসব কথাই বলিস। এই জন্যেই তোর সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই না।
রূপা বলল, তাহলে মা টেলিফোন রাখি। আমার নিজেরও কাজ আছে। সুলতান চাচা আজ আমাদের বাড়িতে থাকবেন। তিনি রাই সরিষা বাটা দিয়ে মুরগির মাংস খেতে চাচ্ছেন। আমাকেই না-কি রাঁধতে হবে।
শায়লা বললেন, জরুরি একটা কথা বলার জন্যে তোকে টেলিফোন করেছি। কথা শেষ হোক তারপর রাই সরিষা দিয়ে মুরগি রাধবি।
বল।
তোর বাবা যে আমাদের ম্যারেজ ডের ক্যান্ডেল লাইট ডিনার নষ্ট করেছে সেটা তো তোকে বলেছি।
হ্যাঁ বলেছ।
আমার জন্যে হয়েছে শাপে বর! কীভাবে জানতে চাস?
জানতে চাই না, তারপরেও তুমি জানাতে চাইলে বল। আমি শুনছি। অল্প কথায় শেষ করবে মা। মলিনার মত উপন্যাস পাঠ শুরু করবে না।
আজ সকালে টগরের বাবা বলল, শায়লা ঐ দিনের ডিনার নষ্ট হয়েছেচল সেটা কমপেনসেটের ব্যবস্থা করি। কাঠমাণ্ডু থেকে ঘুরে আসি। কাঠমাণ্ডুতে একরাত থাকব, সেখান থেকে চলে যাব পোখরায়। কাঠমাণ্ডু থেকে পোখরায় প্লেনে করে যাব। পোখরায় যে হোটেলে থাকব সেটা সেভেন স্টার। ওদের নিজস্ব হেলিকপ্টার সার্ভিস আছে। টগরের বাবার ইচ্ছা হেলিকপ্টার রাইড নেয়া। আমি বলে দিয়েছি অসম্ভব। আমার হাইট ফোবিয়া আছে। হেলিকপ্টার রাইড তুমি নাও। আমি হোটেলে বসে থাকব।
রূপা বলল, বাবাকে ছেড়ে উনাকে বিয়ে করে তুমি খুব ভাল করেছ মা। বাবা সঙ্গে থাকলে তার ভাঙা মাইক্রোবাসে করে, চাঁদপুর, মুন্সিগঞ্জ এইসব জায়গায় পীর ফকিরের সন্ধানে যেতে হত। তোমার সঙ্গী হতেন সুলতান চাচা। তিনি প্রতিটি কথা দুবার তিনবার করে বলে তোমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দিতেন। তোমার জন্যে শুভেচ্ছা। সেভেন স্টার হোটেলে সুন্দরভাবে তোমার ম্যারেজ ডে পালিত হোক। মা এখন কি টেলিফোন রাখতে পারি। নাকি আরো কিছু বলবে? টগরের বাবা সম্পর্কে আরো ভাল কিছু কথা।
তুই আমাকে টিজ করে কথা বলছিস কেন?
রূপা শান্ত গলায় বলল, কেন টিজ করছি জানতে চাও? জানলে কিন্তু ধাক্কামত খাবে। আর রাতে ঘুমাতে পারবে না। সারারাত জেগে কাটাবে। প্রেসারের অষুধ খাবে। প্রেসার কমবে না।
বল কি বলবি। দেখি আমার প্রেসার কতটা বাড়ে।
রূপা বলল, তোমার প্রাণপ্রিয় স্বামী–একটি তরুণী মেয়ের নামে ফ্ল্যাট কিনেছেন। সেই ফ্ল্যাটে তিনি প্রায়ই সময় কাটান। মনে হয় তাকে বিয়ে করেছেন। মেয়েটার নাম আমি বলতে পারব না। তবে মেয়েটা এভারেজ বাঙালি মেয়ের চেয়ে লম্বা। গায়ের রঙ কালো। শব্দ করে হাসে।
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে শায়লা বললেন, মেয়েটার নাম কি বেণু?
আগেই তো বলেছি নাম বলতে পারব না।
তোকে কে বলেছে?
আমাকে কেউ বলেনি মা। কেউ কিছু বলেনি।
তাহলে জানলি কি করে?
রূপা বলল, ঐ প্রসঙ্গ থাক। সরিষা বাটা দিয়ে মুরগি রাধার রেসিপিটা দাও। শুধু সরিষা বাটা দিলেই হবে? তেল দিতে হবে না? আমার তো ধারণা তেল না দিলেও চলবে। সরিষা বাটা থেকেই তেল উঠবে।
শায়লা জবাব না দিয়ে টেলিফোন রেখে দিলেন।
হারুন সুলতানকে নিয়ে খেতে বসেছে। রূপা খাচ্ছে না। তার না-কি শরীর খারাপ লাগছে। সে আগ্রহ নিয়ে সুলতানের খাওয়া দেখছে। সুলতান বললেন, মা তোমার সরিষা বাটা মুরগি অসাধারণ হয়েছে। তোমাকে আমি শ্রেষ্ঠ বঙ্গ রাধুনী স্বর্ণপদক দিলাম। পদকটা আমিই দেব। আধাভরি সোনার মেডেল। তোমার আগামী জন্মদিনে পদক গলায় পরিয়ে দেয়া হবে। ইনশাল্লাহ।
রূপা বলল, আমি মুগ্ধ, আমি আনন্দিত। পদক দিচ্ছেন সেই কারণে না চাচা। আপনি দীর্ঘ বাক্য বলেছেন এবং রিপিট করেন নি এই কারণে। আপনারা আঠারোবাড়ি যাচ্ছেন কবে?
হারুন বললেন, আগামীকালই যাবার কথা ছিল। কেনতু ছেলেটির একটা ব্যবস্থা না করে যেতে পারছি না। চ্যানেল আই-এর সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। তারা কেনতুর গান শুনতে রাজি হয়েছে। সেখানেও সমস্যা।
রূপা বলল, সমস্যা কি?
হারুন বললেন, ঐ ছেলে তো কারো সামনে গান গায় না। আমি প্রায় পায়ে ধরতে বাকি রেখেছি। বদ ছেলের মুখ বন্ধ। রাশেদ চিঠিতে লিখেছে ছেলে অসাধারণ গান গায়। রাশেদের কথা অবশ্যই সত্য। কিন্তু গানটা শুনাতে তো হবে।
রূপী বলল, আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
তুই কীভাবে ব্যবস্থা করবি?
রূপা বলল, আমার কাছে একটা ভয়েস রেকর্ডার আছে। দেখতে কলমের মত। সেখানে দশ মিনিট ডিজিটালি ভয়েস রেকর্ড হয়। ভয়েস রেকর্ডারটা তুমি কেনতুর বাবাকে দেবে। কীভাবে চালাতে হয় শিখিয়ে দেবে। কেনতুর বাবা গোপনে ছেলের গান রেকর্ড করবেন। তোমরা রেকর্ড করা গান চ্যানেল আই-এর লোকদের শুনাবে।
ভয়েস রেকর্ডার কোথায় পেলি?
রূপা বলল, রাশেদ সাহেব আমাকে দিয়েছিলেন। প্রকৃতির একটা খেলা কি বাবা তুমি লক্ষ্য করেছ? কেনতু নামের ছেলেটির গান রেকর্ড করার জন্যে প্রকৃতি ব্যবস্থা করে রেখেছে। একটা ভয়েস রেকর্ডার আমার কাছে আছে। রাশেদ সাহেবের সঙ্গে কেনতুর পরিচয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমরা সবাই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে পড়েছি। Nature is playing a garme, we all are players.
হারুন বললেন, চুপ কর। জ্ঞান ঝরে ঝরে পড়ছে! গাধা টাইপ কথাবার্তা।
সুলতান বললেন, ওর ভয়েস রেকর্ডারের আইডিয়া আমার পছন্দ হয়েছে। আমার পছন্দ হয়েছে। পছন্দ হয়েছে।
ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছে রূপী। ঘন গাছপালার কারণে বৃষ্টির ফোঁটা দেখা যাচ্ছে না। গাছের পাতায় বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। আচ্ছা এমন যদি হত ছবির সঙ্গে শব্দ যোগ করার ব্যবস্থা থাকত তাহলে কেমন অদ্ভুত ব্যাপারই না হত। ধরা যাক সে একটা ছবি এঁকেছে–ঢাকা শহরে বৃষ্টি। সেখান থেকে এক রকম শব্দ আসছে আবার বনের বৃষ্টির ছবি থেকে আরেক রকম শব্দ।
মদিনা বলল, আফা ঘুমাইতে যাবেন না?
যাব। কিছুক্ষণ বৃষ্টি দেখে তারপর ঘুমাতে যাব। আমার মার কাছে চিঠিটা কি লিখেছেন?
হুঁ।
চিঠি পাঠাইবেন না?
না। তুমি যখন যাবে হাতে হাতে নিয়ে যাবে।
আমি কবে যাব?
বাবার সঙ্গে কথা বলে ঠিক করব। খুব তাড়াতাড়ি পাঠাব। তুমি শুয়ে পড়।
মদিনা ঘুমুতে গেল না। রূপার পাশে দাঁড়িয়ে রইল। রূপা বলল, কিছু বলবে মদিনা।
একটা কথা বলব আফা? ভূতটার কথা।
ভূতের আলাপ তো শেষ। আবার কেন?
আফা ভূতটারে কি আপনেও দেখতেন? আপনার পায়ে ধরি আফা বলেন।
রূপা বলল, ঘুমাতে যাও। কথায় কথায় পায়ে ধরার কিছু নেই।
মদিনা ঘুমুতে গেছে। রূপা দাঁড়িয়ে আছে জানালার পাশে। সে হাত বাড়িয়ে বাতি নিভিয়ে দিল। স্ট্রিট লাইটের সামান্য আলো আসছে। ঘর অন্ধকার করায় বৃষ্টি দেখা যাচ্ছে।
রূপা নিজের মনে বলছে–
কবে বিষ্টি পড়েছিল, বান এলো সে কোথা–
শিব ঠাকুরের বিয়ে হল কবেকার সে কথা!
সেদিনও কি এমনিতরো মেঘের ঘটাখানা!
থেকে থেকে বাজ-বিজুলি দিচ্ছিল কি হানা।
তিন কন্যে বিয়ে করে কী হল তার শেষে!
না জানি কোন্ নদীর ধারে, না জানি কোন্ দেশে,
কোন্ ছেলেরে ঘুম পাড়াতে কে গাহিল গান–
বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, নদেয় এল বান।
রবীন্দ্রনাথের এই কবিতাটা রূপার মুখস্ত। মার কাছ থেকে শুনে শুনে রূপার পুরো কবিতা মুখস্ত হয়ে গেছে। তবে শায়লা কবিতাটা সামান্য বদলে আবৃত্তি করতেন। কোন ছেলেরে ঘুম পাড়াতে কে গাহিল গানের জায়গায় বলতেন, কোন মেয়েরে ঘুম পাড়াতে কে গাহিল গান।
সব সন্তানই বাবা-মার কাছ থেকে অনেক কিছু ধার করে। রূপা ঠিক করে রেখেছে সে তার মার কাছ থেকে কবিতা বলে ঘুম পাড়ানোর অংশটা ধার করবে। তার বাচ্চাদের ঘুম পাড়াতে সবদিন কবিতা আবৃত্তি করবে না। যেদিন ঝড়বৃষ্টি হবে সেদিন।
আফা!
এখনো ঘুমাও নি।
মন খুব অস্থির আফা।
রূপা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, মন অস্থির হবার মতো কিছু ঘটে নি। ঠিক আছে তোমার মন শান্ত করার ব্যবস্থা করছি। তুমি যে ভূতটাকে দেখতে আমিও দেখতাম। সুলতান চাচাকে একদিন বলেছিলাম। সুলতান চাচা বলেছিলেন, আরেকবার এই ধরনের কথা বললে থাপ্পড় খাবি। এরপর থেকে কাউকে বলিনি। ধরে নিয়েছিলাম, আমার নিজের কোনো সমস্যা।
আফা আপনারাও কি আমার মতো কোনো অসুখ?
হতে পারে।
মদিনা ফিসফিস করে বলল, রাশেদ ভাইজানের সঙ্গে আপনার যে বিবাহ হবে আপনি কি জানেন আফা?
জানি।
কবে জেনেছেন?
যেদিন তাকে প্রথম দেখি সেদিনই জেনেছি।
ত্যাগেই সব জানা কি ভাল আফা?
না ভাল না। হিসেব এলোমেলো হয়ে যায়।
উনি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে এটা কি বুঝেছিলেন?
হ্যাঁ। বুঝেও না বুঝার ভান করেছি। আমি স্বাভাবিক মেয়ে হতে চেয়েছি। মদিনা! মেঝেতে শোবার দরকার নেই। এসো খাটে এসে শোও। তুমি বিশেষ এক ক্ষমতা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছ। আমিও এসেছি। এই ক্ষমতার উৎস যদি ব্রেইনের টিউমার হয় তাহলে এই জিনিস আমারও আছে। এসো খাটে আস।
মদিনা বিনাবাক্য ব্যয়ে খাটে উঠে এল। ক্ষীণ স্বরে প্রায় ফিসফিস করে বলল, আপনার খুব তাড়াতাড়ি রাশেদ ভাইজানের কাছে যাওয়া দরকার।
রূপা বলল, আমি জানি। আর কোনো কথা না। ঘুমাতে চেষ্টা কর। ঘুম এলে বৃষ্টির শব্দ শোন।
মদিনা জেগে আছে, বৃষ্টির শব্দ শুনছে। সে ঠিক করে রেখেছে রূপা আপা ঘুমুতে এলে সে একটা হাত আপার গায়ে রাখবে। আপা নিশ্চয়ই কিছু বলবে না।