বৃদ্ধা আকলিমা বেগম
বৃদ্ধা আকলিমা বেগম রেলিং দেয়া খাটের মাঝখানে জুবথবু হয়ে বসে আছেন। তাঁর সাজানো জীবন-যাপন এই মুহূর্তে খানিকটা এলোমেলো, কারণ তাঁর গায়ে পাতলা ফিনফিনে একটা গরম চাদর জড়িয়ে দেয়া হয়েছে। নিজেকে তার বউ বউ মনে হচ্ছে। অনেক অনেক কাল আগে বউ সেজে তিনি এই খাটের মাঝখানে ঠিক এই ভাবেই বসেছিলেন। তখন ছিল পৌষ মাস। তিনি শীতে মাঝে মাঝে কাঁপছিলেন বলে তাঁর শাশুড়ি এসে তার গায়ে চাদর দিয়ে দিলেন। বাড়ি ভর্তি কত লোক, কত আনন্দ, কত উল্লাস। আকলিমা বেগমের তরুণ বর— হাসিখুশি এবং খানিকটা বোকাসোকা ধরনের মানুষটা কারণে অকারণে ঘরে ঢুকে পড়ছে এবং মায়ের বকা খাচ্ছে— তোর হইছেটা কী? মুরগির ছাও এর লাহান এইখানে ঘুরতাছ।
মানুষটা লজ্জা পেয়ে নিচু করে বলল, খড়ম খুঁজতে আসছি।
যা কইলাম। না গেলে খড়ম দিয়া তোর মাথাত বাড়ি।
সবার সে-কী হাসি। সবচে বেশি হেসেছেন আকলিমার শাশুড়ি। আহা কী হাসিই না তিনি হাসতে পারেন। সারাক্ষণ কারণে এবং অকারণে হাসছেন। তাঁর মৃত্যুর সময়ও তার মুখে চাপা হাসি দেখা গেল। তিনি আকলিমা বেগমকে কাছে ডেকে ফিস ফিস করে বললেন, তোমার শ্বশুর সাহেবের আইজ খবর আছে। সে হুরপরী নিয়া খুব নাচানাচি করতাছে। আমি উপস্থিত হইয়া এমন ঝাটাপিটা করব। হি হি হি।
পুরনো দিনগুলি বারবার ফিরে ফিরে আসে কেন? আজ কেন নিজেকে বউ বউ লাগছে? মোবারক যে গরম শালটা গায়ে জড়িয়ে দিয়েছে সেই শালটা থেকে কেন অনেক অনেক দিন আগে তার গায়ে যে চাদর তার শাশুড়ি জড়িয়ে দিয়েছিলেন সেই চাদরের গন্ধ আসছে? কেন মনে হচ্ছে বাড়ি ভর্তি লোকজন। কেন মনে হচ্ছে তার মানুষটা একটু আগেই একবার খড়ম খুঁজে গিয়েছে, আবারো আসবে।
মোবারক বলল, কানতেছ কেনগো দাদিজান?
আকলিমা বেগম বললেন, কান্দি না রে। বয়স হইছে, অখন খালি খালি চউখ দিয়া পানি পড়ে।
শালটা তোমার মনে ধরছে দাদিজান?
আকলিমা বেগম চোখ মুছতে মুছতে বললেন, মোবারক তুই একটা চটের বস্তা আমার শইল্যে দিয়া দে। হেই বস্তাও মনে ধরব।
তুমি খুশি হইছ দাদিজান?
আমি বেজার হইছি। খুবই বেজার হইছি। আয় কাছে আয় মুখটা দেখি।
চোখতো নাই মুখ কীভাবে দেখবা? হাত দিয়া দেখব। চউখ নাইতো কী হইছে। হাত আছে না?
মোবারক খাটে উঠে এল। আকলিমা বেগম মোবারকের চোখে মুখে হাত বুলাতে লাগলেন। মোবারকের চোখে পানি এসে গেল।
মোবারক! জ্বি।
আমারে ফালাইয়া থুইয়া তুই একলা একলা কই থাকস? কী করস? আমি যখন মরব তখন তোরে দেখতে ইচ্ছা করব না?
মোবারক উদাস গলায় বলল, এখন থেকে তুমি আমার সঙ্গে থাকবা। ঢাকায় ঘর ভাড়া করব। বলতে পার ভাড়া করা হয়েছে।
ঢাকায় গিয়া থাকব ক্যামনে। এই খাট ছাড়া আমার ঘুম হয় না।
তোমার এই খাট নিয়া যাব। কোনো অসুবিধা নাই। এই খাটতো যাবেই— খাটের উপরে জিনিসপত্র যা আছে সব যাবে।
চাকরি পাইছস মোবারক?
না চাকরি পাই নাই। ব্যবসা করব সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
কিয়ের ব্যবসা?
ফুলের ব্যবসা।
তুই দেখি আগের মতই পাগলা আছস? ফুলের আবার ব্যবসা কী?
বিরাট এক দোকান দিতেছি— নাম হল FRUITS AND FLOWERS বাংলা হল, ফুল ও ফল। আমার দোকানে ফলও পাওয়া যাবে আঙ্গুর, বেদানা, নাসপাতি, আপেল, কলা, কমলা, আনারস, বানারস…
বানারসটা কী?
আছে বানারসও আছে। দেখতে আনারসের মত। সাইজে, ছোট।
আকলিমা বেগম মুগ্ধ হয়ে নাতির কথা শুনছেন। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে আরো একজন মুগ্ধ হয়ে কথা শুনছে। তার নাম সরুফা। বাবা-মা মরা মেয়ে। আকলিমা বেগমের দেখাশোনা করে। এই বাড়িতেই থাকে। বয়স চৌদ্দ পনেরো। মেয়েটা অস্বাভাবিক ধরনের লাজুক। আজ তার লজ্জা আকাশ স্পর্শ করছে কারণ আকলিমা বেগম তাকে অসংখ্যবার বলেছেন তার এক নাতি আছে। নাম মোবারক। তিনি মৃত্যুর আগে অতি অবশ্যই মোবারকের সঙ্গে তার বিয়ে দিয়ে যাবেন। সরুফাঁকে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে কখনো চিন্তা করতে হবে না।
মোবারক নামের মানুষটা চলে এসেছে। মানুষটাকে সে যত দেখছে ততই ভাল লাগছে। কী অদ্ভুত মানুষ, ঘরে ঢুকেই একটা চাদর দিয়ে দাদিকে পেঁচিয়ে ফেলল। কোনো কথা নাই। পা ছুঁয়ে সালাম নাই। তারপরই মানুষটা তার দিকে তাকিয়ে বলল— এই খুকি। তুমি দাদিজানের দেখাশোনা কর? শোন তুমি কি চা বানাতে পার। আমি চা পাতা নিয়ে এসেছি। চা বানাওতো। যদি চা ভাল হয় তাহলে পুরস্কার, ভাল না হলে তিরস্কার। আর যদি খুব খারাপ হয় তাহলে— মারস্কার। হা হা হা।
সরুফার তখনো বিশ্বাস হচ্ছে না এমন অসাধারণ একজন মানুষের সঙ্গে তার বিয়ে হবে! তার বাপ নেই, মা নেই। তাকে আত্মীয় স্বজনরা ঘরে জায়গা দেয় না। সে তার জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়ে দিল অন্যের বাড়িতে। তারই কি-না এমন একটা ভাল ছেলের সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে?
বাড়িতে মেহমান এসেছে। সরুফার হাতে কত কাজ। রান্নাবান্নার আয়োজন দেখতে হবে। মাছ আনতে হবে। মুরগির ব্যবস্থা করতে হবে। অথচ সে দরজার আড়াল থেকে নড়তেই পারছে না। মানুষটা দাদিজানের সঙ্গে যে সব কথা বলছে তার সবই শুনতে ইচ্ছা করছে।
ইচ্ছা করলেও উপায় নেই। এত দূর থেকে সব কথা কি আর শোনা যায়? আর শোনা গেলেও যে কথা বলছে তার মুখতো দেখা যাচ্ছে না। যে কথা বলছে তার মুখ না দেখলে মনে হয় কথাটা বুঝি পুরোপুরি শোনা হল না। কিছু বোধহয় বাদ রয়ে গেল।
বৃদ্ধা বললেন, সরুফা মেয়েটারে কেমন দেখলি?
মোবারক বলল, দেখলাম আর কোথায়? ওতো দরজার আড়ালে আড়ালে থাকে। ও হচ্ছে আড়াল-কন্যা। হা হা হা।
তুই এমন কথায় কথায় হাসতেছস ক্যান? তোর হইছেটা কী?
মোবারক বলল, অনেকদিন পর তোমাকে দেখে মন ভাল হয়ে গেছে। আমার অবস্থা হয়েছে তোমার শাশুড়ির মত। কারণ ছাড়াই হিহি-হাহা-হোহো।
বৃদ্ধা হাত বাড়িয়ে মোবারকের বা হাত ধরলেন। শক্ত করে ধরলেন। শাস্তি দেবার আগে দুষ্ট ছেলেকে মা যেভাবে খপ করে ধরেন সেই ভঙ্গিতে ধরা। ছেলে হাজার চেষ্টা করেও ছুটে যেতে পারবে না।
মোবারক শোন। সরুফারে তুই বিবাহ কর। সরুফা খুবই দুঃখী মেয়ে আর তুইও খুব দুঃখী। দুঃখে দুঃখে সুখ। আমার কোনো কথাইতো তুই রাখস না। এইটা রাখ। মেয়েটা কত সুন্দর এইটা ভাল কইরা দেখছস?
সুন্দর তুমি কীভাবে দেখলে? হাত বুলিয়ে।
আমার হাত মাইনষের চউখের চেয়ে ভাল। চউখ আন্ধাইরে দেখতে পারে না। আমার হাত পারে। খালি রঙ টা বুঝে না। ফর্সা না শ্যামলা টের পায় না।
প্র্যাকটিস করেল এইটাও হয়ত পারবে। প্র্যাকটিসে সব হয়।
তুই আসল কথা ঘুরাইতেছস। মেয়েটারে বিবাহ করবি?
মোবারক তাকিয়ে রইল। বৃদ্ধা গলা নামিয়ে বললেন, তোর নয়া শালটা আমারে যেমনে প্যাচাইয়া ধইরা আছে— সরুফা সারাজীবন তোরে ঠিক এইরকম প্যাচাইয়া ধইরা রাখব। মেয়েটারে আমি কথা দিছি তোর সাথে বিবাহ দিব।
কথাও দিয়ে ফেলছ?
হ কথা দিছি। কোনো শান্তি তুই আমারে দেস নাই। মরণের আগে এই। শান্তিটা দে।
মোবারক উদাস গলায় বলল, আচ্ছা যাও কবুল। মেয়েটা নিতান্তই শিশু, যাই হোক তোমার কথা রক্ষা। আমার দুই বন্ধু সঙ্গে থাকলে আজই যন্ত্রণা শেষ করে ফেলতাম।
খবর দিয়া তারারে আন।
মোবারক বলল, এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? কথাতো দিলাম আর কী? মরদকা বাত, হাতীকা দাঁত। এখন হাতটা ছাড়, বাইরে থেকে একটা সিগারেট খেয়ে আসি।
সিগারেট আমার সামনেই খা। আমি তো আর চউক্ষে দেখি না। কী খাস না খাস দেখব না। অসুবিধা কী?
অসুবিধা আছে।
মোবারক উঠানে এসে সিগারেট ধরাল। পরিষ্কার ঝক ঝক করছে উঠান। এককোণায় আবার কয়েকটা গাদা ফুলের গাছ। হলুদ ফুলে গাছ ভর্তি হয়ে আছে। নিশ্চয়ই সরুফা মেয়েটার কাণ্ড। ফুলের প্রতি মেয়েটার টান আছে। এটা ভাল। FRUITS AND FLOWERS এর মালিকের স্ত্রী যদি ফুল ভাল না বাসে তাহলে হবে কীভাবে? তবে মেয়েটা বড়ই লাজুক। লজ্জা দূর করতে হবে। আড়াল কন্যা হলে চলবে না। আর বাচ্চা মেয়ে মাথায় ঘোমটা কেন? ঘোমটা ফেলে বউ-মানুষরা।
সরুফা চায়ের কাপ নিয়ে আসছে। মেঝের দিকে তাকিয়ে এমন ভাবে আসছে যেন একটা স্প্রিং দেয়া কাঠের মুর্তী। স্প্রিং এ চাবি দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছে— যন্ত্রের মত মূর্তি এগুচ্ছে। চাবি শেষ হবে মূর্তি থেমে যাবে।
চা হাতে দিয়েই সরুফা চলে যেতে ধরেছিল— মোবারক বলল, খুকি দাঁড়াও। চা কেমন হয়েছে খেয়ে দেখি। পুরস্কার, তিরস্কার না মারস্কার।
সরুফা দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ নিজের পায়ের দিকে। মনে হচ্ছে সে অল্প অল্প কাঁপছে। মোবারকের মনটা খারাপ হয়ে গেল। মেয়েটা তাকে ভয় পাচ্ছে না-কি? আশ্চর্য তাকে পিঁপড়াও ভয় পায় না, এই মেয়েটা ভয় পাবে কেন।
মোবারক বলল, চা ভাল হয়েছে। খুবই ভাল। পুরস্কার টাইপ ভাল।
মেয়েটা এই কথায় খুশি হয়েছে কি-না বোঝা যাচ্ছে না। মাথা নিচু করে আছে বলে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। দুএকটা কথা মেয়েটার সঙ্গে বলতে ইচ্ছা করছে। মজাদার কথা। মজাদার কথা সে ভালই জানে, তবে মেয়েরা কোন কথায় মজা পায় তা জানে না। বিল্লি মে কাট দিয়া গল্পটা কি করবে? মজাদার গল্প। হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরার কথা। না-কি কোনো ধাঁধা জিজ্ঞেস করবে। ছোট মেয়েরা ধাঁধা পছন্দ করে। একে বলে শিল্লুক ভাঙানি। শিল্পক ভাঙানির ক্ষমতা থেকে বুদ্ধির আঁচও পাওয়া যায়। মোবারক কঠিন কোনো ধাঁধা মনে করার চেষ্টা করছে। কিছুতেই মনে পড়ছে না। ব্যাপারগুলি এ রকম যখন যেটা মনে পড়ার দরকার সেটা মনে পড়ে না। যখন প্রয়োজন নেই তখন মনে পড়ে।
সরুফা চলে যেতে ধরতেই মোবারক বলল, আচ্ছা দেখি তোমার বুদ্ধি কেমন। একটা শিল্লুক দেই ভাঙ্গাও দেখি— বল কোন ফুল মানুষ সব সময় নাকের কাছে রাখে কিন্তু কোনো গন্ধ পায় না। চিন্তা ভাবনা করে বল। ফুলটা ছোট। নানান রঙের হয়— কোনোটা শাদা, কোনোটা হলুদ, কোনোটা লাল। নাকের কাছে রাখলেও কোনো গন্ধ নাই।
সরুফা বিড়বিড় করে বলল, বলতে পারতেছি না।
মেয়েটার মুখ কেমন হয়ে গেছে। উত্তর না দিতে পারার কষ্টে সে যেন মরে যাচ্ছে।
মোবারকের মায়া লাগছে। শিল্পকটা কঠিন হয়ে গেছে। এমন কঠিন শিল্লুক মেয়েটার পারার কথা না।
মোবারক বলল, এই ফুলটি হল নাক ফুল। তোমার নাকেওতো এখন একটা আছে। বল এই ফুলের গন্ধ আছে?
জ্বি না।
আচ্ছা এইটা বলদেখি–
ঘর আছে দরজা নাই
মানুষ আছে কথা নাই।
সরুফা বলল, কব্বর।
হয়েছে। তোমারতো ভাল বুদ্ধি। এখন যাও আরেক কাপ চা বানিয়ে আন। চিনি বেশি করে দেবে। আমি চিনি বেশি খাই। রান্না বান্নার জন্যে ব্যস্ত হয়ো না। আমার কাছে খাওয়া দাওয়াটা কোনো বড় ব্যাপার না। খুব যদি ক্ষিধা লাগে তাহলে নিজের একটা পা ছিঁড়ে খেয়ে ফেলব।
সরুফা অবাক হয়ে তাকাচ্ছে।
মোবারক বলল, মাকড়সা কী করে জান? মাকড়াসার যখন খুব ক্ষিধে লাগে তখন সে নিজের পা ছিঁড়ে খেয়ে ফেলে। তাতে কোনো অসুবিধা হয়। টিকটিকির খসে পড়া লেজ যেমন গজায়, মাকড়সারও তেমন পা গজায়।
এইসব কী কন?
সত্যি কথা বলছি। সবই বিজ্ঞানের কথা।
আমার বিশ্বাস হইতেছে না।
বিশ্বাস না হবারই কথা। চোখের সামনে কত মাকড়সা ঘুরঘুর করে। কিন্তু আমরা কি জানি এরা ক্ষিধার সময় নিজের পা ছিঁড়ে খায়। এই জাতীয় আরো অদ্ভুত অনেক কথা আছে। তোমাকে ধীরে স্থীরে বলব।
সরুফা দাঁড়িয়ে আছে, যাচ্ছে না। বেচারীর বোধহয় এ রকম গল্প আরো শুনতে ইচ্ছা করছে। মোবারক দড়ি কাটার একটা ম্যাজিক জানে। দড়ি কেটে জোড়া দিয়ে দেয়া। ফুটপাতে দন্তরোগ-যম মাজন বিক্রি করে এক লোক নানান রকম ম্যাজিক দেখায়। তার মধ্যে সবচে বিস্ময়কর ম্যাজিকটা হল দড়ি কেটে জোড়া দেয়া। মোবারক এই ম্যাজিক দেখে এতই মুগ্ধ হয়েছিল যে ম্যাজিসিয়ানকে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে ম্যাজিকের কৌশল শিখে নিয়েছিল। ম্যাজিকটা ভাল হলেও কৌশলটা খুবই সহজ। মুল দড়ি কাটা হয় না। দুই ইঞ্চি লম্বা ছোট্ট একটা দড়ির টুকরা কাটা হয়। সেই টুকরাটা লুকানো থাকে হাতের তালুতে। দড়ির ম্যাজিকটা সরুফাঁকে দেখানো যেতে পারে। গ্রামের মেয়ে ভাল জিনিসতো কিছুই দেখে না। খুশি হবে। মেয়েটাকে সঙ্গে করে সুইজারল্যান্ডে নিয়ে যেতে পারলে হত। বরফ টরফ দেখে খুশি হত। অন্যের খুশি দেখার মধ্যেও আনন্দ আছে।
মোবারক দড়ির খুঁজে দাদিজানের ঘরে ঢুকল। যে-কোনো জিনিস দাদিজানের খাটে থাকবেই। তাঁর রেলিং দেয়া খাট ভর্তি নানা ধরনের, নানান সাইজের টিন, বাক্স, পেটরা। কোনোটায় চিড়া, কোনোটায় মুড়ি। কোনোটায় আমসত্ব। এই মহিলার সব কিছু হাতের কাছে থাকা চাই।
দাদিজান তোমার কাছে দড়ি আছে। চিকন দড়ি?
আছে। কী করবি?
কাজ আছে— দড়ি দাওতো।
তুই ব আমার কাছে। তোর শইল্যের গন্ধ বিস্মরণ হইছিলাম। অখন গন্ধ পাইতেছি।
গন্ধটা কেমন?
ভাল গন্ধ। তুই থাকবি কয় দিন?
কয়দিন মানে? দুপুরে ভাত খেয়েই রওনা।
কস কী তুই?
উপায় নাই। বিদেশ যাব। কাজ কর্ম বাকি আছে। তুমি কোনো চিন্তা করবা না। দেশে ফিরেই গ্রামে চলে আসব। বন্ধু দুজনকে সাথে নিয়ে আসব। আর শোন সরুফার বিয়ের ব্যাপারে যা বলেছ— সেটা ফাইন্যাল।
বৃদ্ধা হাসছেন। হাসতে হাসতে বললেন, মেয়ে পছন্দ হয়েছে?
মোবারক বলল, খুব বেশি না। মোটামুটি হয়েছে। মেয়ের লজ্জা বেশি। তার উপর বুদ্ধি সামান্য কম আছে। সহজ একটা শিল্পক দিয়েছি ভাঙ্গাতে পারে নাই। যাই হোক এইসব কথা তাকে বলে লাভ নাই। বেচারী মনে কষ্ট পাবে। বাচ্চা মেয়ে মনে কষ্ট দিয়ে লাভ কী?
বৃদ্ধা শব্দ করে হেসে ফেললেন। মোবারক বিষ্মিত হয়ে বলল, হাস কেন?
বৃদ্ধা বললেন, মেয়েটারে তোর খুব বেশি পছন্দ হইছে এইজন্যে হাসতেছি। মনের খুশিতে হাসতেছি। কি আমি ভুল কইছি?
মোবারক জবাব দিল না। বৃদ্ধা ঘোরলাগা গলায় বললেন, আমার অনেক দিনের ইচ্ছা তোর বিবাহ দিব। তুই নয়া বউরে নিয়া রুপার পালঙ্কে বাসর করবি।
মোবারক অবাক হয়ে বলল, রুপার পালঙ্ক পাব কোথায়?
এই পালঙ্কইতো রুপার পালঙ্ক। তোর দাদাজান আর আমি যে পালঙ্কে জীবন শুরু করছি। যে পালংকে তোর বাবা তোর মারে নিয়া প্রথম ঘুমাইতে গেছে সেই পালঙ্ক রুপার পালঙ্ক না?
একটু আগে বৃদ্ধা হাসছিলেন। এখন কাঁদছেন। মোবারকের চোখেও পানি এসে গেল। পানিতে ঝাপসা চোখে পালঙ্ক দেখছে বলেই হয়ত তার মনে হল পালঙ্কটা ঝকমক করছে। আসলেই যেন এটা রুপার পালঙ্ক।