বান্ডেল খুলে টাকা বের করতে মায়া লাগছে
বান্ডেল খুলে টাকা বের করতে মায়া লাগছে। মায়া করে লাভ নেই। টাকা খরচ করতেই হবে। টাকার বান্ডেল দেখিয়েতো আর সওদা করা যাবে না। এক প্যাকেট বেনসন সিগারেট কিনতে গিয়ে মোবারক পুরো কার্টুনই কিনে ফেলল। হঠাৎ এতগুলি টাকা পাওয়া গেছে। বন্ধুবান্ধবকে কিছু না দিলে নিজেকে চশমখোরের মত লাগবে। ড্রাইভার বেচারা তাকে নিয়ে ঘুরছে। তাকেও এক প্যাকেট সিগারেট দেয়া দরকার। সে খুশি থাকবে। মানুষের উচিত তার সাধ্যমত সবাইকে খুশি রাখা।
মোবারক হাসি মুখে বলল, ড্রাইভার সাহেব আপনার নাম কী?
ড্রাইভার বলল, স্যার আমার নাম কিসমত।
ড্রাইভার তাকে স্যার বলছে এটাও বিস্ময়ের ঘটনা। ইতিহাসের বই-এ লিখে রাখার মত ঘটনা।
কিসমতের দেশ কোথায়?
কুমিল্লা।
কুমিল্লা অত্যন্ত ভাল জায়গা। বিউটিফুল। আপনি সিগারেট খান?
জ্বি সামান্য বদঅভ্যাস আছে।
মোবারক বেনসনের প্যাকেট এগিয়ে দিল। উদার গলায় বলল, আমার সামনেই খান। কোনো অসুবিধা নেই। তবে ধূমপান ছাড়ার চেষ্টা করবেন। অতি পাজি নেশা। লাভের লাভ কিছু হয় না শুধু ক্ষতি।
ড্রাইভার বিস্মিত হয়ে সিগারেটের প্যাকেট নিল। মোবারক বলল, রাস্তার পাশে যে চায়ের স্টল আছে তার কোনো একটার সামনে থামান। আসুন চা খাই। ফুটপাত টি। এর মজাই আলাদা। চা খেতে খেতে সওদাপাতি কোথায় করব ভেবে নেই।
ড্রাইভার ফুটপাতের এক চায়ের দোকানে থামল। গাড়ির দরজা খোলা রেখে গাড়িতে বসে চা খাওয়ার আনন্দই অন্যরকম। মোবারকের মনে হল বেহেশতেও নিশ্চয়ই এ জাতীয় ব্যবস্থা আছে। বেহেশতবাসিরা গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। গাড়ির ড্রাইভার একজন হুর। বেহেশতের ফুটপাতে গাড়ি থামছে। ফুটপাতের চায়ের দোকান থেকে এক গেলমান চা নিয়ে দৌড়ে চলে এল।
ড্রাইভার সাহেব!
জ্বি স্যার।
গানের ক্যাসেটগুলি আমার পছন্দ হচ্ছে না। Five Six Seven Eight কী রকম গান? এটা হল ধারাপাতের নামতা। গরম কাপড়ের দোকানে যাবার আগে কোনো একটা ক্যাসেটের দোকানে যাবেন। পুরনো দিনের গান কিনতে হবে— একটা গান লিখ আমার জন্যে টাইপ।
জ্বি আচ্ছা।
ইচক দানা বিচুক দানা ঐ গানটা খোঁজ করতে হবে। এক সময় হিট গান ছিল। আরেকটা হিট গান হল মেরা জুতা হায় জাপানী। আগে এইসব গান চায়ের দোকানে বাজাত। এখন আর চায়ের দোকানে গান বাজে না। আগে চারিদিকে আনন্দ ছিল। এখন চারদিকে নিরানন্দ।
খাঁটি কথা বলেছেন স্যার।
ড্রাইভার সাহেব আপনার ক্ষিধে লাগলে বলবেন। ভাল কোনো রেস্টুরেন্টে ঢুকে খেয়ে নেব। লজ্জা করবেন না। আর এই একশটা টাকা রাখুন। আমি যখন বাজার সদাই করব তখন আপনার যদি চা-পান খেতে ইচ্ছা করে খাবেন। লজ্জার কিছু নাই।
চা খেতে খেতে মোবারক আজকের দিনের কর্মকাণ্ডের খসড়া মনে মনে তৈরি করে ফেলল। কাগজ কলম থাকলে ভাল হত, লিখে ফেলা যেত। মনের লেখা ঠিক থাকে না। উলট পালট হয়ে যায়।
ড্রাইভার সাহেবের কাছে কি কাগজ কলম আছে?
জ্বি স্যার আছে।
এক পিস কাগজ আর কলম দিনতো লিস্ট করে ফেলি।
ড্রাইভার কাগজ কলম দিল। মোবারক লিস্ট করতে গিয়ে দেখে কিছুই মনে আসছে না। যা করতে হবে তা হল কাগজ কলম হাতে নিয়েই থাকতে হবে। কিছু একটা মনে হলেই লিখে ফেলা। আপাতত তিনটা আইটেম মনে এসেছে। এই আইটেমগুলি লিখে ফেলা যায়—
১. ক্যাসেট পুরনো দিনের গান।
ইচুক দানা বিচুকদানা, মেরা জুতা, একটা গান লিখ। হেমন্তের কোনো এক গাঁয়ের বধু, জগন্ময়ের চিঠি।
২. দাদিজানের জন্যে গরম শাল। দাম দিয়ে কিনতে হবে। ফাইন কোয়ালিটি। ফাইনের উপরেও যদি কিছু থাকে। সুপার ফাইন।
৩. পরিমল দাস। (শয়তান নাম্বার ওয়ান।)
মোবারক ঠিক করল পরিমল দাসের সঙ্গে সে অত্যন্ত ভদ্র ব্যবহার করবে। মাসে চারশ টাকা করে ছয় মাসে হয় চব্বিশশ টাকা। কচকচে একশ টাকার নোটে চব্বিশশ টাকা দেবে। টাকার সঙ্গে এক প্যাকেট বেনসন। এবং একটা লাইটার। টাকাটা দিয়ে বলবে, অসুবিধায় ছিলাম বলে এতদিন দিতে পারি নি। নিজগুনে ক্ষমা করে দেবেন। ছয় মাসে সিট রেন্ট না দেয়ার পরেও যে আপনি মেস থেকে বের করে দেন নি এটা অনেক বড় ব্যাপার। আপনি আমার সঙ্গে যত খারাপ ব্যবহারই করেন না কেন আপনাকে কিছুতেই খারাপ লোক বলা যাবে না। আপনি আসলে অতি মহৎ ব্যক্তি। মেসের ম্যানেজারী করে ধর্ম কর্ম করলে এতদিনে বড় সাধু হয়ে যেতেন।
শালের দোকানের সেলসম্যান বলল, স্যার বলুন কোন প্রাইস রেঞ্জের ভেতর মাল দেখাব।
মোবারক বলল, ভাল কিছু দেখান। আমি আমার দাদিজানের জন্যে কিনছি। বুড়ো মানুষ কয়দিন আর বাঁচবে। একটা ভাল শাল গায়ে দিয়ে মরুক।
কালার কী দেখাব স্যার?
কালার কোনো ব্যাপার না। দাদিজান চোখে দেখেন না। চোখে দেখেন বলেই জিনিসটা হতে হবে সুপার ফাইন। যেন হাত দিলেই কোয়ালিটি বোঝা যায়।
মাখনের মত মোলায়েম শাল দেখাব। হাতে নিলে মনে হবে শাল হাতের মধ্যে গলে যাচ্ছে। পাহাড়ি কচি ভেড়ার গায়ের পশমের শাল। তাও সব পশম না। পেটের পশম। পিঠের পশমের না।
পিঠের পশমের সমস্যা কী?
পিঠে সূর্যের আলো বেশি পড়ে, পশম শক্ত হয়ে যায়। দাম স্যার সামান্য বেশি পড়বে। তবে জিনিসের মত জিনিস।
দেখি কেমন জিনিস। বুড়িকে কোনোদিন কিছু দেয়া হয় না। দেব যখন ভাল জিনিসই দেই। আর আপনার এখানে ভাল স্যুয়েটার আছে?
পিওর আফগান উলের স্যুয়েটার আছে। শুধু স্যুয়েটার গায়ে দিয়ে বরফের চাঙে শুয়ে থাকতে পারবেন। কিচ্ছু হবে না। বরং গরমে ঘামাচি হয়ে যাবে।
আমার দুই বন্ধুর জন্যে দুটা ভাল স্যুয়েটার বের করেন। আপনার এখানে সিগারেট খাওয়া যায়?
জ্বি না স্যার। কাপড়ের দোকানতো। তবে আপনি খান অসুবিধা নেই। দাঁড়িয়ে আছেন কেন বসুন।
মোবারক বসল। তার খুবই ভাল লাগছে। মনে হচ্ছে সে ভাবের জগতে চলে এসেছে। একা একা এসেছে বলে সামান্য মন খারাপ হচ্ছে। শাল এবং স্যুয়েটার কেনা হয়ে গেলেই জহির এবং বজলুকে খুঁজে বের করতে হবে। দুপুরে পুরনো ঢাকায় গিয়ে কাচ্চি বিরিয়ানী খাওয়া যায়। কাচ্চি বিরিয়ানী সঙ্গে চিকেন কোরমা। রাতে ছাতিম গাছের নিচে ভাল জিনিস নিয়ে বসতে হবে। বিদেশী জিনিস। সমস্যা হচ্ছে সন্ধ্যার পর বড় সাহেব কথা বলবেন। উনার কাছ থেকে ছুটি নিয়ে আসতে হবে। দাদিজানের কথা বলে ছুটি নিতে হবে। বিদেশ যাবার আগে মুরুব্বীদের দোয়াতো নিতেই হবে। বড় সাহেব আপত্তি করবেন বলেতো মনে হয় না।
বজলু বা জহির কাউকেই পাওয়া গেল না। বজলু যে বাসায় থাকে সে বাসায় এক ভদ্রলোক বের হয়ে কঠিন গলায় বললেন, বজলু নামে কেউ এখানে থাকে না।
মোবারক বলল, কতদিন ধরে থাকে না!
অনেক দিন।
কোথায় থাকে জানেন?
জানি না।
আমি বজলুর ফ্রেন্ড। তার জন্যে একটা চাকরির খোঁজ এনেছি। বান্দরবানে ফরেস্টে। মাসে পাঁচ হাজার টাকা বেতন। বেতনের বাইরে এক্সট্রা ইনকামও আছে। আজকের মধ্যেই ছবিসহ বায়োডাটা জমা দিতে হবে। যদি একটু কাইন্ডলি বলেন, কোথায় গেলে তাকে পাব।
কোথায় গেলে পাবেন আমি জানি না।
ভদ্রলোক ঘরে ঢুকে শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দিলেন।
মোবারকের মন সামান্য খারাপ হল। ভদ্রলোক যদি তার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করতেন তাহলে ভদ্রলোকেরই লাভ হত। এক প্যাকেট বেনসন সিগারেট পেয়ে যেতেন।
প্যাকেট আশি টাকা। প্রতিটা সিগারেট চার টাকা। খারাপ কী?
জহিরও বাসায় নেই। জহিরের বাবা বারান্দায় বসে ছিলেন। মোবারকের সঙ্গে তার কয়েকবার দেখা হয়েছে, তারপরেও তিনি মোবারককে চিনতে পারলেন না। মনে হয় চোখে ছানী পড়েছে। ছানী পড়া লোকজন রোদের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালবাসে। এই লোকও রোদের দিকে তাকিয়ে আছে।
তুমি জহিরের বন্ধু? জ্বি।
অদ্ভুত কথা বললা। জহিরের কোনো বন্ধু আছে বলেতো জানতাম না। জহিরের আছে শত্রু।
ও বাসায় নাই?
না নাই। সকালে রক্ত বমি করেছে। খবর শুনে দৌড় দিয়ে গেলাম। আমাকে বলে— রক্ত না বাবা। পানের পিক।
জর্দা দিয়ে পান খেয়েছি সেই পানের পিক। আরে ব্যাটা তুই আমারে পানের পিক শিখাস। কোনটা রক্ত কোনটা পানের পিক আমি জানি না?
ডাক্তারের কাছে গিয়েছে?
ও কি আর যেতে চায়। আমার বড় ছেলে বলতে গেলে কানে ধরে নিয়ে গেছে।
কোন ডাক্তারের কাছে গিয়েছে জানেন?
জানি না। তোমারে একটা কথা বলি— ডাক্তারে এখন তার কিছু হবে না। তুমি যদি চার পাঁচটা ডাক্তার পানিতে গুলে তাকে খাইয়ে দাও তারপরও কিছু হবে না। আজকে মুখ দিয়ে রক্ত পড়বে, কাল পড়বে নাক দিয়ে, তারপর পড়বে কান দিয়ে। তুমি যখন বলছ তুমি তার বন্ধু তাহলেতো সবই জান।
মোবারক অত্যন্ত বিনয়ের সলে বলল, চাচাজী আমি আসলে কিছু জানি। স্কুলে তার সঙ্গে পড়েছি। বিদেশে চলে গিয়েছিলাম— অল্প কিছুদিন হল ফিরেছি।
তাহলেতো তুমি ঘটনা কিছুই জান না।
জ্বি না। কিছু জানি না।
আমার ছেলে উচ্ছন্নে গেছে।
বলেন কী?
পরশু রাতে তিনটার সময় বাসায় ফিরেছে। আমি দরজা খুলে দিলাম— আমাকে চিনে না। আমাকে বলে— হ্যালো আপনি কে? কাকে চান?
সর্বনাশ।
নিজের বাবাকে বলে হ্যালো হ্যালো আপনি কে?
বাইরের লোককে এইসব কথা বলতে ভাল লাগে না। তুমি ওর বন্ধু। তোমাকে বললাম। রোজগার নাই, রোজগারের চেষ্টা নাই। নেশা ভাং করে।
মোবারক এক প্যাকেট সিগারেট বাড়িয়ে দিল। বিনীত গলায় বলল, বিদেশ থেকে তেমন কিছু আনতে পারি নাই চাচাজী— আপনার জন্যে এক প্যাকেট সিগারেট।
বৃদ্ধ স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, মানুষের ছেলে পুলে দেশে বিদেশে যায়। কত কিছু আনে— আর আমারটাকে দেখ— রক্তবমি করে। পাতলা পায়খানা করে। সব কপাল। ভাঙ্গা কপাল।
মোবারক বলল, চাচাজী নেন।
বৃদ্ধ ধরা গলায় বললেন, আবার কী?
একটা লাইটার।
তোমার নামটা যেন কী বাবা। চেহারা মনে আছে। ছোট বেলায় দেখেছি নাম মনে পড়ছে না। স্মৃতিশক্তি গেছে। যার ঘরে এমন আজদহা তার স্মৃতিশক্তি থাকবে কেন? তুমিই বল থাকার কোনো কারণ আছে?
জ্বি না।
বাবা তোমার নামটা বল?
আমার নাম মোবারক।
এইতো মনে পড়েছে মোবারক। মালয়েশিয়া গিয়েছিলে তাই না?
জ্বি না।
এখন মনে পড়েছে। কুয়েত।
জ্বি না সুইজারল্যান্ডে গিয়েছিলাম।
ও হ্যাঁ হ্যাঁ সুইজারল্যান্ড। এখন মনে পড়েছে। যাওয়ার আগে দেখা করে দোয়া নিলে।
জ্বি হ্যাঁ।
বিবাহ করেছ?
জ্বি না।
দেশে যখন এসেছ বিবাহ কর। দেশের একটা মেয়ের গতি হোক। আমার আজদহা যে বিয়ে করে ঘর সংসার করবে এই আশা করি না। এখন পরের ছেলের বিবাহ দেখে শান্তি পাওয়া।
সন্ধ্যার দিকে মোবারক কুদুসের দোকানে গেল। যদি ওদের পাওয়া যায়। তাছাড়া কুদ্দুসকে এক প্যাকেট সিগারেট দিতে হবে। হাজার হলেও বন্ধু মানুষ। বিপদে আপদে বাকিতে চা খাওয়ায়। গাড়িটা রাখতে হবে কুদুসের চায়ের দোকানের সামনে। কয়েকবার হর্ণ দিয়ে নামতে হবে। এই সময় ছোট রফিক থাকলে ভাল হয়। সে অবশ্য ছোট রফিকের সঙ্গে খুবই দ্র ব্যবহার করবে। এক প্যাকেট সিগারেট ছোট রফিককেও দেয়া যেতে পারে। সিগারেট দেয়ার পর সৌজন্যমূলক কিছু কথাবার্তা। যেমন—
ভাই ভাল আছেন? আপনার কথা শুনেছি— এর আগে একবার দেখা হয়েছিল। চিনতে পারিনি। কেমন আছেন ভাই?
অতি ডেনজারাস লোক। বেশি খাতির দেখানো ঠিক না। এদের কাছ থেকে যত দূরে থাকা যায়। এদের কাছে মানুষের জীবনের দাম পাঁচ পয়সা।
আল্লাহ পাকের দুনিয়াতে কত অদ্ভুত ব্যাপারই না আছে। কালো যে রঙ সেই রঙেরও কত পদ। পাতিল কালো, কাক কালো, ময়না কালো। মন্দ মানুষেরও কত অদ্ভুত পদ। পৃথিবীর সবচে মন্দ মানুষটা কে জানা গেলে ভাল হত। পৃথিবীর সবচে মন্দ মানুষ এবং পৃথিবীর সবচে ভাল মানুষ— এই দুজনকে যদি মুখোমুখি বসিয়ে দেয়া যেত। তারা যদি খানিকক্ষণ গল্প করে কী নিয়ে গল্প করবে?
কুদ্দুস আজ দোকানে আসেনি। তার শালীর বিয়ে। রাতে একবার ফিরতে পারে। কখন ফিরবে কেউ জানে না। মোবারক এক ঘণ্টা অপেক্ষা করল। এই এক ঘণ্টায় চার কাপ মালাই চা খেয়ে ফেলল। কাজটা ঠিক হচ্ছে না। কিডনির হয়ত ক্ষতি হচ্ছে। একজনের বায়না করা কিডনির ক্ষতি করা ঠিক না। চায়ের দোকানে চুপচাপ বসে থাকাও ঠিক না। উঠে যাবার মুখে বটুকে একটা একশ টাকার নোট দিল চায়ের দাম বাবদ। বটু বিরক্ত মুখে বলল, ছোট নোট দেন।
মোবারক উদাস গলায় বলল, ছোট নোট নাইরে। সবই বড় নোট।
কথা সত্যি না। ভাংতি টাকা এখন মোবারকের কাছে আছে। চার কাপ চায়ের দাম একশ টাকার নোটে দেয়ার পেছনে কারণ আছে। বটু যখন ভাংতি নিয়ে আসবে তখন সে ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলবে— ভাংতি রেখে দে বখসিশ।
ছোট রফিক একবার বটুকে চা খেয়ে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট বখশিশ হিসেবে দিয়ে ছিল। এমন কোনো লোক নেই যার সঙ্গে বটু এই গল্প করেনি। গল্প করার সময় বটুর চোখ মুখ অন্যরকম হয়ে যেত। এই গল্প করার সময় বটুর চোখ স্থির হয়ে যায়। স্বরও কেমন খসখসে হয়ে যায় ছোট রফিক লোকটা ভাল না মন্দ এইটা আমি জানি না। এইটা আমারে জিগাইয়া লাভ নাই। আমি জানি না। আমি খালি জানি লোকটার দিল কতবড়। মানুষটার ওজন যদি হয় একমণ তার দিলের ওজন সাত মণ।
এ ধরনের গল্প বটু তাকে নিয়ে করবে না। কারণ সে ছোট রফিক না। সে মোবারক। তার দিল ছোট না বড় তা নিয়ে মানুষের কোনো কৌতূহল নেই। ছোট রফিকের দিল ছোট না বড় এটা নিয়ে সবারই কৌতূহল আছে। এখন কী করা যায়? মেসে যাবে? পরিমল দাসের টাকা পয়সা মিটিয়ে আবার এসে খোঁজ নেবে জহিররা এল কি-না? করা যেতে পারে। সঙ্গে গাড়ি আছে। উঠে বসলেই হল। গাড়ি থাকার কত মজা! রিকশা বা বেবী টেক্সির মত আগে জিজ্ঞেস করতে হয় না— অমুক জায়গায় যাবে কি-না। যেতে রাজি হলেই যে সব মুশকিল আহসান তা না— শুরু হয় ভাড়া নিয়ে কচাকচি। মোবারক পরিমল দাসের সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিল। মনু মিয়াকে বখশিশ হিসেবে কিছু দিতে হবে। একটা লুঙ্গি কেনার টাকা। যদিও হারামজাদা মহা বদ। কী আর করা। এই দুনিয়ার সবাই বদ। কেউ বেশি কেউ কম।
পরিমল দাস মেসের বারান্দায় বসে জুতা পালিশ করাচ্ছিল। গাড়ির হর্ন শুনে তাকাল এবং যতটুকু অবাক হবার কথা তার চেয়েও বেশি অবাক হল। মোবারক গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলল, পরিমলদা ভাল আছেন?
পরিমল হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। মোবারক বলল, রাতের বেলা জুতা পালিশ করানো ঠিক না।
পরিমল বলল, এই গাড়ি কার?
আমার গাড়ি আবার কার।
তোমার গাড়ি মানে?
মোবারক রহস্যময় গলায় বলল, সামান্য অন্যায় করে ফেলেছি পরিমলদা, কিছু মনে করবেন না। বাবা-মার সঙ্গে রাগ করে মেসে এসে লুকিয়ে ছিলাম। এখন মিটমাট হয়েছে। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাচ্ছি।
বল কী?
আপনার হিসাবটা দিনতো মিটিয়ে দেই। আর মনুকে আসতে বলুন। ওকে সামান্য বখশিশ দেব।
মনুতো নাই। তার চাকরি নট হয়ে গেছে।
কেন?
মেসের স্টোর থেকে দুডজন ডিম চুরি করে নিয়ে বিক্রি করে দিয়েছে। ধরা পড়েছে হাতে নাতে।
মার দেয়া হয় নাই?
এমন মার খেয়েছে এক মাস বিছানা থেকে উঠতে পারবে না। চোখও মনে হয় একটা গেছে।
চোখ গেছে মানে কী?
ভিড়ের মধ্যে কেউ মনে হয় চোখে খামচি দিয়েছে। গলগল করে চোখ দিয়ে রক্ত পড়ছিল।
মোবারকের মনটা অসম্ভব খারাপ হয়ে গেল। চোরের মারে এ রকম ঘটনা সব সময় ঘটে। ভিড়ের সুযোগে কেউ না কেউ ভয়ংকর কিছু করে শান্ত ভঙ্গিতে চলে যায়। যে এই কাজটা করে সে এম্নিতে সহজ সাধারণ মানুষ। দশটা পাঁচটা অফিস করে। সন্ধ্যাবেলায় বাচ্চাদের পড়তে বসায়। ছুটিছাটায় পরিবারের সবাইকে নিয়ে চিড়িয়াখানায় যায়। বাঁদরের খাচার সামনে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে বাঁদরের খেলা দেখে।
মনু মিয়ার একটা চোখ তাহলে তুলে ফেলেছে?
মনে হয় সে রকমই।
ভাল। দুটা কিডনি যেমন মানুষের দরকার নাই। দুটা চোখেরও দরকার। নাই। একটাই যথেষ্ট।
মোবারক পরিমল দাসের হিসাব মিটিয়ে দিল। উদাস গলায় বলল, আমার বিছানা বালিশ কাউকে দিয়ে দেবেন।
কাকে দেব?
যাকে ইচ্ছা দিবেন।
পরিমল দাস লজ্জিত গলায় বলল, না বুঝে আপনাকে অনেক কটু কথা বলেছি। ভাই মনে কিছু রাখবেন না।
আচ্ছা রাখব না। মনু মিয়াকে কি হাসপাতালে নিয়ে গেছে?
না। মেরে মেসের সামনে ফেলে রেখেছিল। কিছুক্ষণ পরে নিজেই হেঁটে কোথায় যেন চলে গেছে।
মোবারক পকেট থেকে দুটা পাঁচশ টাকার নোট বের করে পরিমলের দিকে
এগিয়ে দিল।
টাকাটা রাখুন। মনু মিয়া যদি কখনো আসে টাকাটা তাকে দেবেন।
জ্বি আচ্ছা।
আমার কি কোনো চিঠি পত্র আছে? বলতে পারছি না। এতে আপনার ঘরেই আছে। আমি ঘরে ঢুকব না। আপনি যান দেখে আসুন।
পরিমল অতিরিক্ত ব্যস্ত হয়ে চিঠির খুঁজে গেল। মোবারক অপেক্ষা করছে। প্রতি মাসে একটা চিঠি সে দাদিজানের কাছ থেকে পায়। গত মাসে চিঠি আসে নি। এ মাসেও না। বুড়ি মরে গেছে কি-না কে জানে।
পরিমল ফিরে এসে লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, চিঠি নাই।
তাকে দেখে মনে হচ্ছে চিঠি না আসার অপরাধে সে অপরাধী।