Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » রূপার পালঙ্ক (১৯৯৯) || Humayun Ahmed » Page 3

রূপার পালঙ্ক (১৯৯৯) || Humayun Ahmed

তারা তাদের জায়গায় চলে এসেছে

সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের পুলিশ ফাঁড়ির একটু পেছনে ঝাকড়া বাদাম গাছের নিচটাই তাদের জায়গা। একদিকে শিশু পার্ক, একদিকে পুলিশ ফাঁড়ি, বাকি দুদিকে ঘন ঘাছপালা। বাগানের এই অংশটা ঠিক বাগান বলে মনে হয় না । মনে হয় জংলা জায়গা। ছাতিম গাছটাকেও জংলা গাছের মতই লাগে। গাছটা নিচু, দাঁড়ালে ছাদের মত ছড়ানো ডালে মাথা লেগে যাবে। কিন্তু বসতে কোনো অসুবিধা নেই। গাছটা এমনভাবে ছড়িয়েছে যে মাথার উপর প্রকাণ্ড ছাতা ধরে আছে এমন মনে হয়। শুধু মনে হওয়া-হওয়ি না। গাছটা আসলেই ছাতার কাজ করে। একবার তারা গাছের নিচে বসে আছে নামলো ঝুম বৃষ্টি। একটা ফোঁটা পানি তাদের গায়ে পড়ল না।

মোবারকদের পছন্দের জায়গার আরো কিছু বিশেষত্ব আছে। প্রথম বিশেষত্ব হচ্ছে— সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে সন্ধ্যার পর থেকে নানান ধরনের লোকজন এবং মেয়ে মানুষ ঘোরাফেরা করে কিন্তু এই দিকে কেউ আসে না। জায়গাটা ভাল না; গরম— এমন কথা প্রচলিত আছে। মাস দুএক আগে আঠারো উনিশ বছরের একটি মেয়ের মৃতদেহ পাওয়া গেছে। তারও আগে বর্ষার সময় মাথা নেই একটা পুরুষের শরীর পাওয়া গেছে। শরীরটা বস্তায় ভরে মুখ সেলাই করে এই ছাতিম গাছের নিচেই ফেলে রাখা হয়েছিল। মৃতদেহ পচে গলে বিকট গন্ধ ছড়ানো শুরু করার পর পুলিশ এসে বস্তা নিয়ে যায়। পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হয়।

মুণ্ডুহীন লাশ শিরোনামে কয়েকটা প্রতিবেদন ছাপা হবার পর পাঠক এবং পত্রিকা দুইই ক্লান্ত হবার কারণে ব্যাপারটা থেমে যায়। তবে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে চা এবং চায়ের সঙ্গে অন্যসব বস্তু যারা বিক্রি শুরু করে তারা জমাটি এক ভূতের গল্প চালু করে দেয়। নিশুতি রাতে গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ হঠাৎ নাকি মাথা নেই একটা মানুষ দেখা যায়। মানুষটা বাগানের লোকদের কাছে তার মাথাটা কোথায় তা জানতে চায়।

সন্ধ্যা মিলিয়ে গেছে। প্রেমিকা বাড়ি ফিরতে চাচ্ছে, প্রেমিক দিচ্ছে না। অন্ধকারে প্রেমিকাকে যতক্ষণ পাশে রাখা যায়। দুজনেরই ঝিম ঝিম অবস্থা। তখন মাথা নেই লাশ গাছের আড়াল থেকে শরীরটা বের করে বলবে, এক্সকিউজ মি আপা। আমার মাথাটা কোথায় বলতে পারেন?

এই ধরনের গল্প কেউ বিশ্বাস করে না, তবে পুরোপুরি অবিশ্বাসও করে না। মানুষের মনের একটা অংশ উদ্ভট এবং বিচিত্র গল্প বিশ্বাস করতে পছন্দ করে।

রাত দশটা। মোবারক, জহির এবং বজলু— তিনজনই আছে। বজলু যথারীতি গম্ভীর হয়ে আছে, কথা বলছে না। ছাতিম গাছের নিচে বসার সময় একবার শুধু বলেছে, আমার কাজ আছে। আমি দশ পনেরো মিনিট থাকব।

জহির বলেছে, থাকিস না। তোকে কি আমরা শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছি? যার যার শিকল তার তার হাতে। তুই তোর শিকল বাজাতে বাজাতে চলে যা।

বজলু বলেছে, আজ কিছু খাবও না। তোরা খাওয়ার জন্যে পাছরা পাছরি করিস না।

জহির বিরক্ত হয়ে বলেছে, তুই কি কচি খোকা যে ফিডিং বোতলে করে তোকে মদ খাওয়াতে হবে? না খেলে না খাবি। চলে যেতে চাইলে চলে যা। এখনি চলে যা।

বজলু বলেছে, চলে যাব?

জহির বলেছে, অবশ্যই চলে যাবি। তোর মত বন্ধু আমি ‘ ’ দিয়েও পুছি না।

বজলু সঙ্গে সঙ্গে উঠে হাঁটা দিয়েছে। জহির বা মোবারক এটা নিয়ে মোটেও ব্যস্ত হয়নি। কারণ দুজনই জানে বজলু ফিরে আসবে। কতক্ষণে ফিরবে এটা বলা যাচ্ছে না। পাঁচ মিনিটেও ফিরতে পারে আবার ঘণ্টা দুই পরেও ফিরতে পারে। তবে কিছুদিন হল বজলু বদলাচ্ছে। অতি দ্রুত বদলাচ্ছে। তাকে কয়েকদিন না-কি ছোট রফিকের সঙ্গে দেখা গেছে। তার বন্ধুরা বজলুকে এ বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। তবে আজ হয়ত মোবারক জিজ্ঞেস করবে। রাগ করে বজলুর চলে যাওয়া বা ফিরে আসা কোনো ঘটনা না। তবে এ রকম ঘটনা ঘটলে খুবই রাগ লাগে। নেশার জন্যে রাগটা খারাপ। যে রেগে থাকে তাকে কোনো কিছুতেই ধরে না। নেশার খরচ জলে যায়।

জহির কাঁধের ব্যাগ থেকে বোতল বের করল। জমাটি নেশা করার কিছু নিয়ম কানুন আছে। নেশার সব কিছু চোখের সামনে রাখতে হয়। ভাগ্য ভাল থাকলে সুন্দর করে সাজানো বোতল দেখলেই নেশা হয়ে যায়। নেশা তো আর কিছু না— মনের একটা বিশেষ ভাব। সেই বিশেষ ভাবে হুট করে উঠা যায় না। একতলা থেকে দোতলায় উঠতে হলে যেমন অনেকগুলি সিঁড়ি পার হতে হয়। এক ভাব থেকে আরেক ভাবে যেতেও সিঁড়ি টপকাতে হয়। কেউ দুটা তিনটা সিঁড়ি এক সঙ্গে টপকায়। কেউ সিঁড়ি টপকানোর সময় পা পিছলে পড়ে যায়, উপরের তলায় উঠতেই পারে না। আসল ভাবের জায়গায় যারা উঠবে তারা প্রতিটি সিঁড়ি আস্তে আস্তে পার হবে। কারণ প্রতিটি সিঁড়ির কিছু আলাদা মজা আছে। আলাদা ভাব আছে।

জহির বলল, পুড়িয়াও আছে। দিব?

মোবারক বলল, এখন না।

আয় ডাইল দিয়ে শুরু করি। বজলু ফিরে আসুক তখন পুড়িয়া। ডাইরেক্ট একশন।

মোবারক জবাব দিল না। তার মানে ডাইল দিয়ে শুরুর ব্যাপারে তার আপত্তি নেই। ডাইল হল ফেন্সিডিল। ইদানীং চালু হয়েছে ফেন্সিডিলের বোতলে একটা দশ মিলিগ্রাম ইউনিকট্রিন ট্যাবলেট ছেড়ে দেয়া। ট্যাবলেটটা পুরোপুরি গুলে না। আধাগলা হয়ে তলায় পড়ে থাকে। সেই পড়ে থাকা অংশটা খাওয়ার নিয়ম নেই।

ভাবে বসার প্রথম পনেরো মিনিট বেশ জটিল। একেক জন একেক মুডে থাকে। কেউ কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ বিরক্ত হয়ে যায়। কেউ রাগ করে। কেউ ধুম করে বলে বসে, না আজ শরীর ভাল না। আজ কিছু খাব না। তখন একজনকে থাকতে হয় যে সবাইকে সামলে সুমলে রাখে। সে হল সামালদার। তাকে মেজাজ খারাপ করলে চলবে না। ভাবের আসর নষ্ট হয়ে যাবে। প্রথম দশ পনেরো মিনিট কষ্ট করে পার করে দিলে বাকি সময়টা নিয়ে আর চিন্তা করতে হয় না। প্রথম পনেরো মিনিটের ধাক্কাটা সব সময় সামলায় জহির। কোনো বিষয়ে তার ধৈর্য নেই কিন্তু ভাবের আসরে তার ধৈর্য অসীম।

জহির ফেন্সিডিলের একটা বোতলের মুখ খুলে মোবারকের দিকে এগিয়ে দিল। মোবারক হাত বাড়াল না। বরং ছাতিম গাছে হেলান দিয়ে উদাস হয়ে গেল। জহির চিন্তিত গলায় বলল, খেতে ইচ্ছা করছে না?

মোবারক এই প্রশ্নেরও জবাব দিল না।

ঘটনা খারাপ। শুরুতেই কেউ বেঁকে বসলে সমস্যা। জহির শান্ত গলায় বলল, খেতে ইচ্ছা না করলে খাস না। রোজই এই বিষ খাওয়া লাগবে তার কোনো কথা নেই। ইচ্ছা না হলে খাবি না।

জহির নিজেই বোতলে চুমুক দিল। গলা করুণ করে বলল, অনেক কষ্টের টাকায় এই বিষ কিনেছি। একজন রাগ করে চলে যাবে। একজন খাবে না। ভাল কথা। আমি খাব। আমার হল কষ্টের টাকা। আমি ছাগল কোরবানি দিয়েছি। আমি না খেলে হবে?

জহির পকেটে হাত দিয়ে সিগারেট বের করল। দলামচা সিগারেট। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সাধারণ সিগারেট না। বিশেষ সিগারেট। তামাকের সঙ্গে জিনিস মেশানো হয়েছে। সিগারেটে মিশানোর জিনিসও কয়েক পদের আছে। একটা আছে সামান্য টানলেই মাথার তালু জ্বলে। আরেকটায় হাই প্যালপটিশনের মত মাথায় প্যালপিটিশন। এই দুইটাই খারাপ। জিনজির নামে একটা পাওয়া যায়— এক্সপোর্ট কোয়ালিটি। বাজারের সেরা। জহির ওস্তাদ লোক। সে জিনজির ছাড়া অন্য কিছু আনবে না। টাকা পয়সা না থাকলেও জহিরের নজর উঁচা।

জহির বলল, সিগারেটও না?

মোবারক বলল, না।

পান খা একটা। মিষ্টি পান আছে। জর্দা দিয়ে একটা পান খেলে ভাল লাগবে। ময়মনসিংহের মিকচার জর্দা। বেহেশতী জিনিস।

মোবারক না-সূচক মাথা নেড়ে নিজের সিগারেট বের করল। জহির ধরালো তার বিশেষ সিগারেট। দুজনের সিগারেটের আগুন ওঠানামা করছে। শীত শীতও লাগছে। মোবারকের গায়ে দামি শাল, মাথায় পশমি টুপি তারপরেও তারই শীতটা বেশি লাগছে। জহির তার বোতলে একবারই চুমুক দিয়েছে। একা একা ভাবের আসর শুরু করা যায় না। সঙ্গী লাগে। ভাল কাজ মানুষ একা করতে পারে। বেশির ভাগ সময় তাই করে। কিন্তু কোনো মন্দ কাজই মানুষ একা করতে পারে না। মন্দ কাজে সঙ্গী সাথি লাগে, উৎসাহদাতা লাগে। তালি বাজানোর নোক লাগে।

মোবারক বলল, তুই দেখি আজ মেলা খরচ করেছিস। এক হাজার টাকার পুরোটাই শেষ?

জহিরের মুখে সামান্য হাসির আভা। মোবারক কথা বলা শুরু করেছে। এটা ভাল লক্ষণ। এখন যদি বজলু চলে আসে তাহলেই আসর জমে যাবে। আজকের সাপ্লাই ভাল। শুধু ভাল না, খুবই ভাল। জহিরের কাপড়ের ব্যাগে ভদকার একটা বোতল আছে। পুরো বোতল না, অর্ধেকেরও কম আছে। এটা জহির ইচ্ছা করে রেখে দিয়েছে ফিনিশিং দেয়ার জন্যে। ফিনিশিং-এর জন্য ভদকার মত জিনিস হয় না। যে জাতি ভদকার মত আসলি চিজ বের করেছে সেই জাতি আমেরিকার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পারল না। পাছায় লাথি খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল এটা ভাবাই যায় না।

গাছপালার ফাঁক দিয়ে কে যেন আসছে। তার মুখেও জ্বলন্ত সিগারেট। হ্যাঁ বজলুই ফিরে আসছে। জহির নিশ্চিন্ত হয়ে নিঃশ্বাস ফেলল। তার দায়িত্ব শেষ হয়েছে। ভাবের আসর এখনি শুরু হবে।

বজলুকে আসতে দেখেই মোবারকের মনে হয় মুড ভাল হয়ে গেছে। সে জহিরের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, দেখি একটা বোতল। সামান্য খাব। দুই চুমুক।

জহির নিজের বোতল এগিয়ে দিল। এবং অতি দ্রুত আরেকটা বোতলের মুখ খুলল। বোতলের টিনের মুখায় লেগে হাত মনে হয় কেটেছে। রক্ত বের হচ্ছে। বের হোক। এত কিছু দেখলে চলবে না। বজলু এসে দাঁড়ানো মাত্র তার হাতে বোতল তুলে দিতে হবে। জহিরের এত আনন্দ লাগছে। মনে হচ্ছে সে কেঁদে ফেলবে।

জমিয়ে কুয়াশা পড়ছে। চারপাশ ঝাপসা। ছাতিম গাছের পাতায় শিশির জমেছে। মাঝে মাঝে দুএকটা ফোঁটা এদের গায়ে পড়ছে। যার গায়েই ফোঁটা পড়ছে সেই বিস্মিত হবার ভঙ্গি করে বলছে, গাছ মুতে দিয়েছে। এই রসিকতায় হেসে তিনজনই গড়াগড়ি খাচ্ছে। ভাবের রাজ্যে কোনো রসিকতাই পুরনো হয় না। প্রথমবার যেমন হাসি হাসে সপ্তমবারেও তেমন হাসি হাসে। বরং বেশি হাসে। এই হাসি এই আনন্দ যে-কোনো মুহূর্তে গভীর বিষাদে রূপান্তরিত হতে পারে। এদের এখনো হচ্ছে না কারণ এরা তিন জন। আনন্দের ভাব প্রবল থাকে যখন সংখ্যায় তিন বা তিনের বেশি থাকে। দুজন থাকলে উল্টোটা হয়।

এদের পোষাক আশাকেও কিছু পরিবর্তন হয়েছে। মোবারকের শাল এবং মাথার টুপি জহির গায়ে দিয়ে বসে আছে। মোবারক বসে আছে গেঞ্জি গায়ে কারণ তার শার্টে ডাইল পড়ে গেছে। জহির বসে আছে, বাকি দুজন মাথার নিচে হাত দিয়ে শুয়ে আছে।

মোবারক বলল, ক্ষিধে লেগেছে।

বজলু উঠে বসতে বসতে বলল, ক্ষিধে লেগেছে।

জহির বলল, ক্ষিধার চোটে পেট জ্বলে যাচ্ছে।

ভাবের রাজ্যে ভিন্নমতের স্থান নেই। সবাই সব বিষয়ে একমত হয়। এখানেও তাই। একজনের ক্ষিধে লাগলে সবার লাগতে হবে।

বজলু বলল, ক্ষিধে লাগলে মাকড়সা কী করে জানিস?

মোবারক উৎসাহিত হয়ে জানতে চাইল, কী করে?

যদি পোকা মাকড় না থাকে তাহলে নিজের একটা দুটা পা ছিঁড়ে খেয়ে ফেলে। ক্ষিধা মিটায়।

বলিস কী?

হুঁ। পা খেয়ে ফেললেও সমস্যা নেই। মাকড়সাদের পা আবার গজায়। টিকটিকির মত। টিকটিকির যেমন লেজ গজায়। মাকড়সারও পা গজায়।

জহির সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল, দোস্ত সত্যি কথা বলছিস তো?

বজলু বিরক্ত হয়ে বলল, আমি কোনদিন মিথ্যা বললাম? তোরা বুকে হাত দিয়ে বল, মিথ্যা কোনদিন বলেছি?

না, তা অবশ্যি ঠিক।

মাকড়সার পা খাওয়ার বিষয়ে যা বললাম, এটাও ঠিক। আমরা মাকড়সা হলে ভাল হত। নিজেদের পা নিজেরা খেয়ে বসে থাকতাম। কিংবা আমি খেতাম মোবারকেরটা। মোবারক খেত আমারটা।

মোবারক ঘেন্নায় মুখ কুঁচকে বলল, অসম্ভব। আমি মরে গেলেও মানুষ খাব না।

খাওয়ার ব্যবস্থা নেই বলে তুই খাচ্ছিস না। খাবার ব্যবস্থা থাকলে তুই খেতি।

খাওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও খেতাম না।

তুই নিজেকে বেশি চিনে ফেলেছিস?

আমাকে আমি চিনি না আর তুই চিনে ফেললি?

অবশ্যই আমি তোকে চিনি। চোর চিনতে সময় লাগে না। তুই একটা বিরাট চোর। থিফ নাম্বার ওয়ান। থিফ অফ বাগদাদের মত তুই হলি থিফ অফ ঢাকা।

মোবারক হতভম্ব গলায় বলল, আমি চোর?

বজলু বলল, অবশ্যই চোর। তুই বুকে হাত দিয়ে বল যে শালটা তুই গায়ে দিয়েছিস এটা চুরির মাল না?

মোবারক বুকে হাত দিয়ে বলল, এই শালটা আমার এক দূর সম্পর্কের মামার। মামার কাছে একটা কাজে গিয়েছিলাম। ফেরার সময় মামা বললেন, আমার একটা পুরনো শাল আছে। নিয়ে যা।

এ রকম দিলদরিয়া মামা তোর আছে? এক কথায় শাল দিয়ে দিল?

হার্ট বড় লোকজন পৃথিবীতে আছে না? আমার এই মামার হার্ট খুবই বড়। সব সময় না। মাঝে মাঝে বড়। মনে কর আমার একশ টাকার দরকার। আমি যদি মামার পায়ে ধরে কেঁদে পা ভিজিয়েও দেই কোনো লাভ হবে না। আবার কোনোদিন চলে আসার সময় হুট করে বলবে–ধর রিকশা ভাড়া নিয়ে যা। বলেই একটা একশ টাকার নোট ধরিয়ে দেবে।

তুই যে শুধু চোর তাই না, তুই মিথ্যা কুমার। সমানে মিথ্যা কথা বলছিস।

আমি যদি মিথ্যা বলে থাকি তাহলে আমি অসতী মায়ের জারজ সন্তান।

জহির বলল, আহা তোরা কী শুরু করলি। চুপ কর না। সামান্য ভদকা আছে এক ঢোক করে হবে। ফিনিশিং টাচ। এখন খাবি না পরে খাবি?

বজলু বলল, এখনই খাব। পরে আবার কী?

জিনিস কিন্তু শেষ। আর কিছুই নাই।

লাগবে না। ভদকা পেটে এক ফোঁটা পড়লেই হবে।

জহির বলল, তোরা চাইলে আমি ব্যবস্থা করি। আমার কাছে টাকা আছে।

মোবারক বলল, কত টাকা আছে?

বজলু বলল, খবরদার কত টাকা আছে বলবি না। মোবারক হাপিস করে দেবে। হারামজাদা বিরাট চোর। থিফ অফ ঢাকা।

মোবারক চোখ লাল করে বলল, আমি যদি চোর হয়ে থাকি তাহলে এই মাটি ছুঁয়ে বলছি— আমি অসতী মায়ের গর্ভের জারজ সন্তান।

জহির বলল, তোরা একটু চুপ করবি? চেঁচামেচি শুরু করলি কেন?

মোবারক বলল, তাতে তোর অসুবিধা হচ্ছে? তুই ঝিম মেরে বসে আছিস বসে থাক।

জহির বলল, কোলকাতার একটা গল্প মনে পড়েছে।

জহির বছর তিনেক আগে চারদিনের জন্য কোলকাতায় গিয়েছিল। সেই গল্প তিন বছরেও শেষ হয় নি। কোনোদিন শেষ হবে বলেও মনে হচ্ছে না। যে-কোনো পরিস্থিতিতে যে-কোনো উপলক্ষে তার কোলকাতার একটা গল্প থাকে। জহির উৎসাহের সঙ্গে শুরু করল।

হয়েছে কী— রাত তখন দুটা, আমি আর শিবেন ট্যাক্সি করে যাচ্ছি। রাস্তাঘাট ফাঁকা। যাচ্ছি গড়িয়াহাটার দিকে। গড়িয়াহাটা জায়গাটা কোথায় বলি…

গড়িয়াহাটা জায়গা কোথায় বলতে হবে না। তুই গল্প শেষ কর।

আমাদের ট্যাক্সির ড্রাইভার পাঞ্জাবি। শিখ। মাথায় পাগড়ি…।

মাথায় কী বলার দরকার নাই। শিখরা মাথায় পাগড়ি পরে সবাই জানে। গল্প শেষ কর।

ট্যাক্সি যাচ্ছে। আমার ঝিমুনির মত এসেছে।

ঝিমুনির মত আসবে আবার কী? তোরতো ঝিমুনি লেগেই আছে।

প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছি। হঠাৎ হার্ড ব্রেক। আমার ঘুম গেল ভেঙে। শিখ ড্রাইভার বলল, সে আর যাবে না।

মোবারক বলল, যাবে না মানে। মাঝপথে প্যাসেঞ্জার নামিয়ে দেবে? ইয়ারকি? লাথি মেরে হারামজাদাকে ট্যাক্সি থেকে ফেলে দেয়া দরকার। তুই কী করলি?

আমি ভদ্রভাবে বললাম, ভাই কেন যাবেন না। সমস্যা কী?

বাংলায় বললি?

হিন্দিতেই বলেছি। ভুল হিন্দি। ট্যাক্সি ড্রাইভাররা আবার ভুল হিন্দিটাই ভাল বুঝে। সব সময় ভুল হিন্দি শুনেতো।

হিন্দিটা কী?

ভাইয়া! কেউ নাহি জায়েগি। প্রবলেম কিয়া হুয়া?

ড্রাইভার কী বলল?

ড্রাইভার বলল, বিল্লি মে কাট দিয়া।

কী বলল আবার বল।

বলল— বিল্লি মে কাট দিয়া।

এর মানে কী?

জহির রহস্যময় ভঙ্গিতে বলল, মানে হচ্ছে তার গাড়ির সামনে দিয়ে একটা বিড়াল চলে গেছে। বিড়ালটা রাস্তার এক পাশ থেকে আরেক পাশে গিয়েছে।

তাতে সমস্যা কী?

সমস্যা আছে। শিখ ড্রাইভাররা বিশ্বাস করে গাড়ির সামনের রাস্তা যদি বিল্লি মে কাট দেয় তাহলে মহাবিপদ। এ্যাকসিডেন্ট হবেই। তখন তারা কিছুতেই গাড়ি ঐ রাস্তা দিয়ে চালাবে না। গাড়ি রাস্তার এক পাশে নিয়ে অপেক্ষা করবে। অন্য কোনো গাড়ি যদি পার হয় তাহলেই বিল্লি কাটার দোষ কাটা যাবে।

বাক্যটা কী?

বিল্লি মে কাট দিয়া।

তিনজনই একসঙ্গে হাসতে শুরু করল। এর পরের ঘটনা অতি বিচিত্র। কিছুক্ষণের জন্যে হাসি থামে, তখন একজন বলে, বিল্লি মে কাট দিয়া। সঙ্গে সঙ্গে সমবেত হাসি শুরু হয়। সেই হাসি থামতেই আরেকজন বলে, বিল্লি মে কাট দিয়া। আবারো হাসি শুরু হয়। হাসতে হাসতে এদের চোখে পানি এসে গেল। তাতেও হাসি থামে না।

সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে পুলিশ টহলে আসে রাত একটার দিকে। টহল মানে চাঁদা তোলা। নিশিকন্যাদের রোজগারের একটা অংশ পুলিশকে দিতে হয়। এদের সঙ্গে যে সব কাস্টমার থাকে, ধমক ধমক দিয়ে তাদের কাছ থেকেও কিছু আদায়ের চেষ্টা করা হয়। তবে নেশারুদের এরা ঘটায় না।

হাসির শব্দে আকৃষ্ট হয়ে দুজন টহল পুলিশ এগিয়ে এল। ওদের গায়ে টর্চের আলো ফেলে বলল, কী হয়েছে?

তিনজনই হাসতে হাসতে একজন আরেকজনের গায়ে গড়িয়ে পড়তে পড়তে বলল, বিল্লি মে কাট দিয়া। বিল্লি মে কাট দিয়া।

পুলিশ টর্চ নিভিয়ে চলে গেল। তার কিছুক্ষণ তার আধবুড়ো এক লোককে দেখা গেল। ভীত চেহারা। সে সঙ্গে মেয়ে নিয়ে এসেছে। নিরিবিলি জায়গা খুঁজছে। বজলু বলল, এই যে ওল্ড ব্রাদার, অন্য জায়গায় যান। এই জায়গাটা ভাল না। এই জায়গা বিল্লি মে কাট দিয়া।

রাত অনেক হয়েছে। তিন বন্ধুই পাশাপাশি শুয়ে আছে। তাদের গায়ে মোবারকের শাল। জহির ঘুমুচ্ছে। শান্তির গাঢ় ঘুম। জেগে আছে মোবারক এবং বজলু। আকাশে চাঁদ উঠেছে। চাদের আলোয় কুয়াশা চকচক করছে। মোবারকের কাছে কুয়াশাটাকে মনে হচ্ছে হালকা শাদা পশমে বোনা বিশাল এক চাদর। কেউ একজন যেন পৃথিবীতে বিশাল এক চাদর পাঠিয়েছে। যে চাদর দিয়ে পৃথিবীর সব দুঃখী মানুষকে ঢেকে দেয়া যায়।

মোবারক একটা হাত রাখল বজলুর গায়ে।

বজলু বলল, কিছু বলবি?

মোবারক বলল, দোস্ত তোকে একটা মিথ্যা কথা বলেছি। আমি আসলেই চোর। এই শালটা আমি চুরি করে এনেছি।

বাদ দে।

না দোস্ত বাদ দিব কেন? আমি চোর। বিরাট চোর। আমি অসতী মায়ের জারজ সন্তান।

আহ্ বাদ দে না।

মোবারক কাঁদতে শুরু করল। জহির বলল, দোস্ত কাঁদিস না। কান্না থামা। তোর পায়ে ধরি কান্না থামা।

মোবারক কাঁদছে। মোবারকের কান্না দেখে বজলুরও কান্না পেয়ে গেছে। সেও কাঁদছে। তাদের গায়ে গাঢ় হয়ে কুয়াশা পড়ছে। কান্না থামানোর জন্যে জহির একবার মোবারকের পায়ে ধরছে আরেকবার ধরছে বজলুর পায়ে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress