মাফলার পরার মত শীত পড়েনি
মাফলার পরার মত শীত পড়েনি, কিন্তু মোবারকের গলায় মাফলার। মাথায় পশমি টুপি। গায়ে উলের চাদর। পশমি টুপি এবং চাদরের কারণে তার চেহারা বদলে গেছে। আয়নায় সে তার নতুন চেহারা দেখেনি, না দেখলেও চেহারা যে বদলেছে এটা নিশ্চিত। চায়ের দোকানের মালিক কুদ্দুস মিয়া কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে বলল, কেডা মোবারক না?
মোবারক জবাব না দিয়ে হাই তুলল। পোশাক মানুষের আচার আচরণও বদলে দেয়। টুপি এবং উলের চাদর গায়ে দেয়ার পর থেকে মোবারকের অন্য রকম লাগছে। খাতির জমানো টাইপ কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। কুদ্দুস মিয়া তার বন্ধুস্থানীয় মানুষ। সে একটা প্রশ্ন করবে আর মোবারক জবাব দেবে না— এ রকম আগে কখনো হয়নি।
চা খাইবা মোবারক?
মোবারক এই প্রশ্নেরও জবাব দিল না। চায়ের স্টলে ঢুকলে। চায়ের স্টলের
কোনো নাম থাকে না, এর নাম আছে— মদিনা রেস্টুরেন্ট। রেস্টুরেন্টের নামের সঙ্গে মিল রেখেই বোধ হয় কুদ্দুসের লেবাসেও ইসলামী ভাব আছে। পায়ের গোড়ালি স্পর্শ করে এ রকম তিনটা পাঞ্জাবী তার আছে। তার মুখ ভর্তি চাপ দাড়ি। মাথায় সব সময় কিস্তি টুপি। তার পাশ দিয়ে হাঁটলে আতরের গন্ধ পাওয়া যায়। তবে তার এই পোশাকের সঙ্গে ধর্মকর্মের সম্পর্ক নাই। নবীজী তাকে স্বপ্নে এ ধরনের পোষাক পরতে বলেছেন বলেই সে পরে। এর বেশি কিছু না। নবীজীর কথা শুনে এ ধরনের পোশাকে পরা শুরু করার পর থেকে নাকি তার ব্যবসার সুবিধা হয়েছে। তবে চা বিক্রি ছাড়াও তার অন্য ব্যবসা আছে। সেই ব্যবসা নবীজীর পছন্দ হবার কোন কারণ নেই।
মোবারকের মেজাজ সামান্য খারাপ। সে যে চেয়ারে বসে সেখানে একজন কাস্টমার বসে আছে। কাস্টমার যেভাবে চা খাচ্ছে তাতে মনে হয় চা শেষ করতে ঘণ্টাখানিক সময় লাগাবে। আরে ব্যাটা পিরিচে ঢেলে লম্বা টান দে। এক টানে ঝামেলা শেষ। তুই বিড়াল নাকি? বিড়ালের মত চুকচুক করে চা খাচ্ছিস। এক কাপ চা খেতে যদি এক ঘণ্টা লাগিয়ে দিস অন্য কাজ কখন করবি?
অত্যন্ত বিরক্ত মুখে মোবারক কাস্টমারের সামনে এসে দাঁড়াল। গম্ভীর গলায় বলল, ব্রাদার একটু সরে পাশের চেয়ারে বসেন।
কাস্টমার চায়ের কাপ নামিয়ে শান্ত গলায় বলল, কেন?
এই চেয়ারটায় আমি বসব।
খালি চেয়ার তো আরো আছে সেখানে বসেন।
অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত কথা। চায়ের দোকান প্রায় ফাঁকা। যে-কোনো জায়গায় বসা যায়। যে আরাম করে বসে চা খাচ্ছে তাকে সরিয়ে তার জায়গাতে বসতে হবে কেন? কাস্টমারের কথায় মোবারকের রাগ হবার কোনোই কারণ নেই। কিন্তু রাগ লাগছে। ইচ্ছা করছে হারামজাদাটার বিশেষ জায়গায় কোঁৎ করে একটা লাথি মারতে। দুটা বিচির যে কোনো একটায় লাগলেই খবর আছে। দুনিয়া অন্ধকার হয়ে যাবে। মোবারক নিজেকে সামলালো। এইসব ঝামেলায় একা যাওয়া ঠিক না। একা মানে বোকা। সে উদাস ভাব নিয়ে কাস্টমারের পাশে বসল।
পরিচিত চায়ের দোকান থাকার সুবিধা আছে। মুখে অর্ডার দিতে হয় না। ইশারায় কাজ হয়। অনেক সময় ইশারাও লাগে না। বয় বাবুর্চি, কাস্টমার দেখলেই বুঝে কার কী লাগবে।
চায়ের স্টলের বয় বটু মোবারকের সামনে কাচের গ্লাসে এক গ্লাস মালাই চা রেখে চলে যাচ্ছিল। মোবারক কঠিন গলায় বলল, এই বটু শুনে যা।
বটু থমকে দাড়াল। মোবারক বলল, ইটা মাইরা গ্লাস ফেললি। আদব কায়দা জানস না? চড় দিয়া চাপার দুইটা দাঁত ফেইল্যা দেই। বজ্জাতের বাচ্চা বজ্জাত। বেয়াদবি সবের সাথে করা যায় না। ক্ষেত্রবিশেষে করা যায়।
বটু চায়ের গ্লাসটা খপ করে নামিয়ে রেখেছে ঠিকই কিন্তু তার জন্য এতটা রাগ করা যায় না। রাগটা মোবারক করেছে পাশের কাস্টমারকে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য। অনেকটা ঝিকে মেরে বউকে শিখানোর মত। শিক্ষাটা মনে হয় কাজে লেগেছে। পাশে বসে থাকা কাস্টমার তার দিকে তাকাচ্ছে। ব্যাটার চোখে ভয়। চুক-চুক চা খাওয়া বন্ধ করেছে।
মোবারক বটুকে বলল, এই চা নিয়ে যা, খাব না। মোবারক চাদরের নিচ থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল। সাধারণ সিগারেট না। বিদেশী সিগারেট— মারলবোরো। মোবারকের ইচ্ছা করছে সিগারেটের প্যাকেটটা কাস্টমারের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে মধুর গলায় বলে, ব্রাদার নেন একটা সিগারেট নেন।
কাজটা সে করেই ফেলত, তার আগেই চায়ের স্টলের মালিক কুদ্দুস মিয়া গলা খাকাড়ি দিল এবং চোখের ইশারায় তাকে ডাকল।
মোবারক বিরক্ত মুখে উঠে গেল। চোখের ইশারায় ডাকাডাকি এটাও তার পছন্দ না। এও এক ধরনের বেয়াদবি। মোবারক সব সহ্য করতে রাজি আছে, বেয়াদবি সহ্য করতে রাজি না।
কুদ্দুস গলা নিচু করে বলল, ঝামেলা কী?
মোবারক বলল, কোনো ঝামেলা নাই।
তোমার ডান পাশে যে বসছে তার সাথে কিছু হইছে?
না।
তারে চিনছ?
মোবারকের চোখ ছোট হয়ে গেল। কুদুসের গলা যেন কেমন কেমন। পাশের লোকটা কি বিশেষ কেউ? কুদ্দুস গলা নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলল, সে হইল ছোট রফিক। কথাবার্তা, খুব সাবধান। খুবই সাবধান। তার সাথে বেয়াদবি কিছু কইরা থাকলে মাফ নিয়া নাও। সাপের মাথায় পাড়া দিলে অসুবিধা নাই। লেজে পাড়া দিলে খবর আছে।
মোবারক মুখ শুকনো করে আগের জায়গায় ফিরে যাচ্ছে। অন্য কোথাও বসতে পারলে ভাল হত। তবে সেটাও ঠিক হত না। ছোট রফিক ঠিকই লক্ষ্য করতো; মনে মনে ভাবত, লোকটা একটু আগে আমার পাশে বসেছে। এখন জায়গা বদলেছে।
আল্লাহ পাকের অসীম দয়া যে সে ছোট রফিকের সাথে ঝামেলা করেনি। সে শুধু বলেছে, এই চেয়ারটায় আমি বসব। তবে ছোট-রফিককে এই কথা বলাও বিরাট বেয়াদবি।
একজন যে চেয়ারে বসে আছে সেই চেয়ারে তুমি বসবে কেন? তুমি কোন দেশের লাট বাহাদুর? তুমি হলে মোবারক। তোমার দাম তিন পয়সা।
ছোট রফিক চা খাওয়া শেষ করেছে। পাঁচ টাকার একটা নোট চায়ের কাপের পাশে রাখতে রাখতে উঠে দাঁড়াল। মনে হচ্ছে চায়ের দাম এবং বখশিশ একসঙ্গে দিয়েছে। ছোট রফিক মোবারকের দিকে তাকিয়ে বলল, জায়গা ছেড়ে দিলাম বসেন। আরাম করে চা খান।
মোবারক মুখ হাসিহাসি করার একটা চেষ্টা করল। ছোট রফিক সেই হাসিমুখ দেখার জন্যে অপেক্ষা করল না। লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে যাচ্ছে। কুদ্দুস মিয়া ক্যাশবাক্স ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাত তুলে সালাম দিল। ছোট রফিক সেদিকে না তাকিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে সালাম নিল। কোনো দিকে না তাকিয়েও চারদিকে কী হচ্ছে বুঝতে পারা বিরাট ব্যাপার। মোবারক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বটু চা দে। মালাই চা না, নরম্যাল চা।
বটু গলা নামিয়ে বলল, উনারে চিনেছেন? ছোট রফিক। একবার আমারে পঞ্চাশ টাকার চকচকা নোট বখশিশ দিছিল।
মোবারক উদাস গলায় বলল, ভাল।
তার এখন বেশ ভালও লাগছে।
নিজের চেয়ারে আরাম করে পা তুলে বসে এখন মারলবোরো সিগারেট টানতে টানতে চা খাওয়া যায়। আজ অল্পের উপর দিয়ে ফাড়া কেটেছে। মোবারকের সামান্য আফসোসও হচ্ছে। ছোট রফিককে চেয়ার ছাড়তে না বলে সে যদি ভদ্রভাবে পাশে বসত এবং সিগারেট সাধত তাহলে কত ভাল। হত। সে রকম খাতির হলে এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করা যেত, ভাইজান আপনাকে ছোট রফিক বলে কেন? আপনি যদি ছোট রফিক হন— বড় রফিকটা কে? হা হা হা। ভাইজান রসিকতা করলাম। কিছু মনে করবেন না।
ছোটখাট মানুষ হলে ছোট রফিক ডাকা যায়। কিন্তু মানুষটা মোটেই ছোটখাট না— লম্বা। তবে রোগা। গাল বসে গেছে। চেহারা ভাল। দেখে মনে হয় কোনো ব্যাংকে ট্যাংকে কাজ করে। মানুষটার গলার স্বরে রাগ আছে, কিন্তু চেহারায় কোনো রাগ নেই। বয়স কত হবে— চল্লিশ পঁয়তাল্লিশের বেশি হবে না। মোবারকের বয়স আটত্রিশ। কিন্তু তাকে দেখা যায় পঁয়তাল্লিশের মত। সব চুল পেকে যাওয়ায় এই অবস্থা হয়েছে। নিয়মিত কলপ করাও সমস্যা। একেকবার কলপে ত্রিশ টাকা লাগে। পশমি টুপিটা পাওয়ায় বিরাট কাজ হয়েছে। মাথা ঢেকে ঘোরাঘুরি করলে কে বুঝবে টুপির নিচের চুল কাঁচা না পাকা? টুপিটাও সুন্দর! এই টুপি আল্লাহ পাকের তরফ থেকে সরাসরি পাওয়া উপহার। আল্লাহপাক তার নাদান বান্দাদের জন্য মাঝে মাঝে সামান্য উপহার পাঠান। বান্দা ভাল না মন্দ সেদিকে তাকান না। এত কিছু দেখলে তার চলে না।
দোতলা বাসের দোতলায় বসে মোবারক আসছিল মীরপুর থেকে। তার আগারগাঁয়ে নেমে যাবার কথা। বসে থাকতে ভাল লাগছিল বলে নামল না। যতদূর যাওয়া যায় যাওয়া থাক। এর মধ্যে আল্লাহ পাকের একটা ইশারা অবশ্যই আছে। বাস যখন প্রেসক্লাবের কাছাকাছি তখন তার পাশের একজন যাত্রী তাড়াহুড়া করে নেমে গেল। মোবারক দেখে সিটের উপর একটা নীল আর শাদা রঙের মিশেল দেয়া পশমি টুপি। মোবারক চট করে জায়গা বদল করে পাশের সিটে চলে এল। টুপির উপর খানিকক্ষণ বসে থাকা অত্যন্ত জরুরি। টুপির মালিক ফিরে আসতে পারে। যদি ফিরে আসে তাহলে সিট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে বলতে হবে— আরে এইতো আপনার টুপি! জিনিস পত্র সাবধানে রাখবেন না?
টুপি নিতে কেউ এল না। মোবারক টুপি হাতে গুলিস্তানে নেমে পড়ল। নেমে পরার আগে ছোটখাট একটা বাণিজ্যও হয়ে গেল। সে বাসের
বাসের কন্ডাকটার চোখ গরম করে বলল, কীয়ের টাকা? কন কী?
মোবারক বলল, দশ টাকার একটা নোট দিলাম। আপনি বললেন— এখন ভাংতি নাই পরে দিবেন।
কন্ডাকটার চোখ আগের চেয়েও গরম করে বলল, কী কন? দিল্লেগী করেন? ধাক্কা দিয়া চাক্কার নিচে ফেলাইয়া দিমু…।
মোবারক শান্ত গলায় অন্য পেসেঞ্জারদের দিকে তাকিয়ে বলল, ভাইসাব দেখলেন কী বলে? ধাক্কা দিয়ে চাকার নিচে ফেলে দেবে। তখনি আমি টাকা দিতে চাই নাই। আমি বলেছি ভাংতি নিয়ে আস তারপরে নোটটা নাও। তখন সেটা করবে না।
এক যাত্রী ক্ষিপ্ত গলায় বলল, শুওরের বাচ্চার গাল বরাবর একটা চটকনা দেন। হারামজাদার কত বড় সাহস।
চটকনা দিতে হল না। তার আগেই কন্ডাকটার একটা দশ টাকার নোট বাড়িয়ে দিল।
মোবারক বলল, এক টাকা ভাড়া কেটে রাখেন। নয় টাকা দেন।
কন্ডাকটার বিরস গলায় বলল, থাউক ভাড়া লাগব না। আফনের ভাড়া TIPI
মোবারক দর্শকদের দিকে তাকিয়ে হতাশ গলায় বলল, ভাইসাবরা দেখলেন, কীভাবে অপমান করে আমার ভাড়া নাকি মাফ।
অন্য এক ক্রুদ্ধ যাত্রী বলল, হারামজাদারে একটা চড় দেন না। দেখেন। কী? মার না খেলে শিক্ষা হবে না।
মোবারক জোরেসোরে এক চড় বসিয়ে হেঁটে চলে এল। পিছনে ফিরল না। পিছনে ফিরলে হয়ত দেখা যাবে, কন্ডাকটার অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। তবে চড় মারাটা বাড়াবাড়ি হয়েছে। আল্লাহপাকের হিসাবের খাতায় নাম উঠে গেছে। এমন একটা চড় কোনো না কোনো সময় মোবারককে খেতে হবে। চড়ে চড়ে কাটাকাটি হবে। সবার হিসাবে ভুল হয়, আল্লাহপাকের হিসাবে ভুল নাই। বাসের কন্ডাকটার যেমন অনেক লোকের সামনে চড় খেয়েছে, সেও অনেক লোকের সামনেই খাবে। হয়ত আজই খেত। ছোট রফিকের হাত থেকে খেত। কপাল গুণে বেঁচে গেছে।
মোবারক চা খাচ্ছে। তার নিজের পছন্দের চেয়ারে বসে খাচ্ছে। চেয়ারটা এই জন্যে পছন্দ যে এখান থেকে রাস্তা দেখা যায়। রাস্তার লোকজন তাকে এত সহজে দেখবে না। চেয়ারটা মদিনা রেস্টুরেন্টের এক কোণায়। রাস্তার লোক দোকানের দিকে তাকায়, দোকানের কোণার দিকে তাকায় না।
সন্ধ্যা হয় হয় করছে। সন্ধ্যাবেলাটা মোবারকের খারাপ লাগে। বিশ্রী একটা সময়, দিনও না, রাতও না। এই দুয়ের মাঝামাঝি একটা ব্যাপার। দিনের এক রকম মজা, রাতের আরেক রকম মজা। এই দুয়ের মাঝামাঝি সময়ের কোনো মজা নেই। সন্ধ্যা একা কাটানো যায় না। সন্ধ্যার জন্যে বন্ধু লাগে। মোবারকের মেজাজ দ্রুত খারাপ হচ্ছে। জহিরেরও দেখা নেই, বজলুরও দেখা নেই। মনে হচ্ছে এরা দুজন যুক্তি করে হাওয়া হয়ে গেছে। বজলুর জন্যে ব্যাপারটা স্বাভাবিক। সে প্রায়ই ড়ুব মারে। দু তিন দিন পরে হঠাৎ উদয় হয়। এই দু তিন দিন সে কোথায় ছিল, কী করেছে সে সম্পর্কে কিছুই বলে না। প্রাইভেট কোনো ব্যাপার নিশ্চয়ই আছে। সব মানুষেরই কিছু না কিছু প্রাইভেট ব্যাপার থাকে। কিন্তু জহিরের ব্যাপারটা কী? আবার কোনো অসুখ বিসুখ হয়নি তো?
জহিরের হল অসুখ রাশি— এই জ্বর, এই কাশি, এই হাম। মানুষের হাম হয় একবার ছোটবেলায়। গা ভর্তি হাম বের হল। হাম ডেবে গেল, মামলা ডিসমিস। সেই হাম জহিরের হয়েছে তিনবার। জন্ডিস হল চারবার। শেষবারে এমন অবস্থা যে, কলাবাগানের জামে মসজিদের ইমাম সাহেবকে ডেকে এনে তওবা পড়ানো হল। তওবা পড়ানোর পর মিলাদ হল। বজলু সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতে জহিরকে বলল— তুই এখন শিশুর মত নিস্পাপ হয়ে গেলি। বাম কাঁধের ফিরিশতা এতদিন তার খাতায় যা লিখেছে সব মুছে গেছে। আগের সব পাপ কাটাকাটি হয়ে গেছে। যে অসুখ বাঁধিয়েছিস এর মধ্যে নতুন পাপ আর কিছু করতে পারবি না। যদি মারা যাস— স্ট্রেইট বেহেশত নসিব হবে। হুরপরীরা তোকে নিয়ে টানাটানি শুরু করে দেবে।
আল্লাহপাকের বোধহয় ইচ্ছা না জহির বেহেশতে দাখিল হয়। সে তওবা পড়ানোর দিন তিনেকের মধ্যে উঠে বসে চি চি করে বলল— তার সরষে শাক দিয়ে ফ্যান ভাত খেতে ইচ্ছা করছে। লোকজনের কানের পাশ দিয়ে গুলি যায়। জহিরের গুলি গেছে বগলের তলা দিয়ে। হাসপাতাল থেকে রিলিজ নেবার সময় ডাক্তার সাহেব বলেছিলেন— আপনার লিভার মারাত্মক ড্যামেজড হয়েছে। আপনি যে বেঁচে আছেন এইটাই মিরাকল। বাকি জীবন আপনাকে খুব রেগুলেটেড লাইফ মেইনটেইন করতে হবে। মাংস পারতপক্ষে খাবেন না। মাছ ভাত খাবেন। মদ্যপান করবেন না। ঈদে চান্দেও না। ড্রপার দিয়ে এক ফোঁটাও না। বুঝতে পারছেন কারো কারো জন্যে মদ খাওয়া নিষিদ্ধ। আপনার জন্যে মদের গন্ধ শোকাও নিষিদ্ধ।
বজলু এবং মোবারক দুজনই হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। এবং এক সঙ্গে বলল, জ্বি আচ্ছা।
ডাক্তার সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, আমি পেশেন্টকে জিজ্ঞেস করছি। আপনারা দুজন মাথা নাড়ছেন কেন? আপনারা কে?
স্যার আমরা জহিরের ফ্রেন্ড।
আপনারা সামনে থেকে যান। আমি আপনাদের বন্ধুকে কিছু কঠিন কথা বলব। দাঁড়িয়ে থাকবেন না। চলে যান।
ডাক্তার সাহেব অনেক কঠিন কথা বললেন। জহির ঝিমঝিম চোখে হাই তুলতে তুলতে কঠিন কথা শুনল। তাকে খুব বিচলিত মনে হল না। সে কখনোই বিচলিত হয় না।
বন্ধুর রোগমুক্তি উপলক্ষে ছোটখাট উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল। আজরাইলের হাত থেকে বাইম মাছের মত পিছলে বের হয়ে আসা কোনো সহজ ব্যাপার না। যে মানুষ এমন অসাধ্য সাধন করতে পারে তার জন্যে বড় উৎসবই করা দরকার। বড় উৎসবের সামর্থ্য কোথায়? ভদকার একটা বোতল যে জোগাড় হয়েছে এটাই যথেষ্ট। এক বোতল ভদকা, খাসির চাপ, হাজির বিরিয়ানি। আসর বসেছে বজলুর ঘরে। মোবারক এবং বজলু অতি দ্রুত বোতল শেষ করছে। জহির শুকনো চোখে তাকিয়ে আছে। তার শুকনো চোখ দেখে মায়া লাগছে কিন্তু কিছু করার নেই। আগে প্রাণে বাঁচতে হবে। জহিরের গন্ধ শোঁকা নিষিদ্ধ বলেই তারা ভদকা এনেছে। ভদকার গন্ধ নেই।
মোবারক বলল, নিয়ম রক্ষার জন্য এক ফোঁটা খাবি নাকি রে জহির। জাস্ট ওয়ান ড্রপ। জিভ বের কর। জিভের আগায় এক ফোঁটা দিয়ে দেই।
জহির না-সূচক মাথা নাড়ল। মোবারক বলল, থাক কোনো দরকার নেই। তুই শুয়ে থাক। বিরিয়ানি গরম আছে। গরম গরম খেয়ে শুয়ে পড়। আমি মাথা বানিয়ে দেব।
বজলু বলল, ডাক্তার যে মৃত্যুর ভয় দেখাল, কাজটা কি ঠিক করল? মৃত্যুর কথা বলার তুমি কে? মৃত্যুর মালিক হলেন আল্লাহ্। তিনি ইচ্ছা করলে মৃত্যু হবে। ইচ্ছা না করলে দশ বোতল ভদকা খেলেও কিছু হবে না। জহিরের কি বাঁচার আশা ছিল? ডাক্তাররা জবাব দিয়ে দিয়েছিল না? তারপরেও বাঁচল কীভাবে? আরে বাবা তুমি ডাক্তার হয়েছ বলে যা ইচ্ছা তাই বলবে? তোমার মত ডাক্তার আমি দিয়েও পুছি না। রোগ যদি হয়, অষুধ দিয়ে রোগ সারাবে। বড় বড় কথা কী জন্যে? আমি বজলুর রহমান তোমার কথার উপরে পেচ্ছাব করি।
মোবারক বলল, আমি পেচ্ছাব করে দেই।
আধা বোতল ভদকা শেষ হবার পরেও দেখা গেল নেশা যে ভাবে হওয়া উচিত সেভাবে হচ্ছে না। ছাড়া ছাড়া নেশা হচ্ছে। এই ভাব আসছে, এই চলে যাচ্ছে। নেশার ব্যাপারটা বড়ই অদ্ভুত। কোনো কোনো দিন কিছু খেতে হয় না, বোতল দেখেই নেশা হয়ে যায়। আবার কোনো কোনো দিন যতই খাও কিছু হবে না। মাথা ঝিম ঝিম করবে, বমি ভাব হবে কিন্তু আসল যে জিনিস—‘ভাব’ সেটা আসবে না।
বজলু বিরক্ত মুখে বলল, নেশা হচ্ছে না। ব্যাপারটা কী? মোবারক তোর অবস্থা কী?
মোবারক বিরস মুখে বলল, মনে হয় পানি খাচ্ছি। মিনারেল ওয়াটার।
এতদিন পর হাসপাতাল থেকে বন্ধু রিলিজ পেয়েছে। সেই আনন্দে যদি একটু নেশাও না হয় তাহলে বন্ধুর ফিরে আসার দরকার কী ছিল? বজলু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কাজকর্ম সব সময় তিনজন একত্রে করেছি। আজ দুইজন, একজন থেকেও নেই। এই জন্যেই কিছু হচ্ছে না। বোতল শেষ করে লাভ নেই, বাদ দে।
জহির তখন ক্ষীণ গলায় বলল, বেশি করে পানি মিশিয়ে সামান্য একটু দে। তিন চার ফোঁটার বেশি না। নিয়ম রক্ষার জন্যে খাওয়া।
দরকার নেই। বাদ দে। এতবড় অসুখ থেকে উঠলি।
খাই এক ফোঁটা। এক ফোঁটায় আর কী হবে?
জহিরকে সামান্য দেয়া হল। সঙ্গে সঙ্গে দুই বন্ধুর নেশা কঁকিয়ে এল। বজলু বলল, বোতলতো শেষ হয়ে আসছে। তিন বোতল ফেন্সি নিয়ে আসি। ভদকার পরে ফেন্সি— উড়াল দেয়া নেশা হবে। ফেন্সি জহিরও খেতে পারবে। ডাক্তার মদ খেতে নিষেধ করেছে ফেন্সি খেতে নিষেধ করেনি। তাছাড়া ফেন্সি অষুধের মত— কফ সিরাপ। কীরে জহির ফেন্সি খাবি একটা?
জহির বলল, না।
আমোদ ফূর্তিই যদি না করলি বেঁচে থেকে লাভটা কী? সকালে চিড়া ভিজানো পানি এক গ্লাস চিরতার রস, বিকালে জাউ ভাত। রাতে এক পিস আটার রুটি। সিগারেট না, মদ না, গাঁজা না। এই ভাবে বেঁচে থেকে লাভ কী— নায়লনের একটা দড়ি কিনে নিয়ে আসি, ঝুলে পড়।
মোবারক উদাস গলায় বলল, এটা মন্দ না। দুই বোতল ফেন্সি আন আর তিন গজ নায়লনের দড়ি। ব্লু কালার।
ব্লু কালার কেন?
বজলু গম্ভীর গলায় বলল, মৃত্যুর রঙ নীল। এই জন্যে।
এত কিছুর পরেও জহির এক ফোঁটা মুখে দিল না। দুই বন্ধুরই খুব মেজাজ খারাপ হল। সাতশ টাকার বোতলে সাত টাকার নেশা হল না। ধরে যাওয়া নেশা একবার চটে গেলে কিছুতেই কিছু হয় না। ঝিম ভাব হয়— ঝিম ভাব আর নেশা এক না। পর পর তিন রাত অঘুমো থাকলেও ঝিম ভাব হয়।
মোবারক নড়ে চড়ে বসল। চায়ের স্টলের বাইরে জহির এসে দাঁড়িয়েছে। ইঁদুরের মত চোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। তাকে খুঁজছে বলাই বাহুল্য। গাধার গাধা— সে জানে না মোবারক কোথায় বসে? তুই পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ সব দিক দেখে ফেললি— আসল দিক দেখলি না? তোর কি ব্রেইনে সমস্যা হয়েছে? নাকি সন্ধ্যাবেলাতেই কিছু খেয়ে এসেছিস? দাড়ি শেভ নাই। চুল উস্কুখুস্কু। একটা শার্ট গায়ে দিয়েছে যার পাঁচটা বোতামের মধ্যে দুটা নাই। শার্টের ফাঁক দিয়ে বুকের লোম বের হয়ে আছে। তুই ভেবেছিস কী? তোর বুকের লোম দেখে মেয়েরা মূৰ্ছা যাবে? কাঁধে আবার বাহারি ব্যাগ। ব্যাগের পেট ফুলে আছে। কে জানে কী আছে ব্যাগে।
জহির মোবারককে দেখেছে। জহিরের মুখ ভর্তি হাসি। যেন দশ বছর পরে পুরনো বন্ধুর দেখা পাওয়া গেল। মোবারকের মেজাজ চট করে খারাপ হয়ে গেল। মনে মনে বলল, তোর হাসি মুখে আমি পেচ্ছাব করে দেই। আরে শুওরের বাচ্চা গত দুই দিন তুই ছিলি কোথায়? এমন তো না যে বিয়ে করেছিস শাশুড়িকে সালাম করতে যেতে হবে। শালীর গালে ধরে রং ঢং করতে হবে।
জহির এসে মোবারকের সামনে বসল। বসেই মোবারকের মারলবোরো সিগারেটের প্যাকেট হাতে নিয়ে সিগারেট বের করল। যেন তার শ্বশুরের টাকায় কেনা সিগারেট। শ্বশুর চায়ের স্টলের টেবিলে ফেলে রেখে গিয়েছিল। এখন জামাইকে পাঠিয়েছে খুঁজে নিয়ে যাবার জন্যে। বন্ধুর সিগারেট খাচ্ছে— আচ্ছা ঠিক আছে খাক। এত দামি বিদেশী সিগারেট, একবার জিজ্ঞেস করবে না সিগারেটের এই প্যাকেট কোত্থেকে পাওয়া গেল? নাকে মুখে কেমন ধুঁয়া ছাড়ছে, যেন তার শ্বশুর বাড়ির সস্তা ধুঁয়া।
জহির বলল, আছিস কেমন?
মোবারক জবাব দিল না। তার কথা বলতেই ইচ্ছা করছে না। সবচে ভাল হত যদি উঠে চলে যেতে পারত। উঠে চলে যাওয়া এক সপ্তাহের জন্যে ড়ুব মারা। তোরা দুই দিনের জন্যে ড়ুব দিতে পারলে আমিও এক সপ্তাহের জন্যে ড়ুব দিতে পারি।
জহির বলল, তোর গায়ে উলের চাদর?
মোবারক এই প্রশ্নেরও জবাব দিল না। যদিও তার ইচ্ছা করছে বলতে— উলের চাদর না। পাটের কোস্টার চাদর। চাদরও না, গামছা।
জহির বলল, চাদর পেয়েছিস কোথায়?
মোবারক গম্ভীর গলায় বলল, আমার নিজের চাদর। এর মধ্যে পাওয়া পাওয়ি কী?
জিনিস ভাল।
মোবারক বলল, জিনিস যে ভাল তোকে সেই সার্টিফিকেট দিতে হবে না। আমার জিনিস আমি জানি ভাল না মন্দ।
রেগে আছিস কেন?
মোবারক জবাব না দিয়ে টেবিলের উপর রাখা সিগারেটের প্যাকেট চাদরের নিচে ঢুকিয়ে ফেলল। জহিরের স্বভাব খারাপ। সামনে সিগারেটের প্যাকেট থাকলে ক্রমাগত খেয়ে যাবে। দুই মাসও হয়নি এতবড় অসুখ থেকে উঠেছে কিছু সাবধান হওয়াতো দরকার। মদের চেয়েও ক্ষতি করে সিগারেট।
জহির বলল, গরমের মধ্যে চাদর গায়ে ঘুরছিস কেন?
ইচ্ছা হয়েছে ঘুরছি। তাতে তোর কোনো সমস্যা হয়েছে?
গরমের মধ্যে উলের চাদর। তোকে দেখে আমার নিজেরই গরম লাগছে।
গরম লাগলে শার্ট প্যান্ট খুলে ন্যাংটা হয়ে যা।
জহির গলা নামিয়ে বলল, চাদরের নিচে কিছু আছে?
না।
না থাকলেও অসুবিধা নাই। আমি জিনিসপত্র নিয়ে এসেছি। সাতটা বোতল। এক নম্বরী ডাইল। সিগারেটের প্যাকেট সামলে ফেললি কেন? দেখি প্যাকেট বের কর।
মোবারক সিগারেটের প্যাকেট বের করল। জহিরের উপর তার রাগটা অতি দ্রুত কমছে। এই তার এক সমস্যা। সে রাগ ধরে রাখতে পারে না। অতি দ্রুত কমতে থাকে। শুধু যে রাগ কমছে— তা না। এখন আবার মায়াও লাগতে শুরু করেছে। কী অবস্থা করেছে শরীরের। এত বড় একটা অসুখ থেকে উঠেছে— নিজের শরীরের দিকে তাকাবে না? মনে হচ্ছে দুপুরে সে কিছু খায়ওনি। কেমন পা টেনে টেনে হাঁটছিল। পায়ে কী কিছু হয়েছে?
মোবারক বলল, দুপুরে ভাত খেয়েছিস?
না।
না কেন?
সময় পাই নাই।
সময় পাস নাই কেন? তুই কি মিনিস্টার যে মিটিং মিছিল করে দম ফেলতে পারছিস না।
মোবারক চোখের ইশারায় বটুকে ডেকে দুটা পরোটা আর শিক কাবাব দিতে বলল।
জহির হামলে পড়ে খাচ্ছে। দেখে মায়া লাগছে।
এই দুই দিন ছিলি কোথায়?
নারায়ণগঞ্জ।
সেখানে কী?
ছোট খালু মারা গেছে। খবর পেয়ে দেখতে গিয়ে বিরাট ক্যাচালের মধ্যে পড়ে গেলাম।
কী ক্যাঁচাল?
আরে টাকা নাই, পয়সা নাই। দশ গজ কাফনের কাপড় কিনতে গিয়েছে তাও টাকা শর্ট পড়েছে। খালা আমাকে ধরে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করা শুরু করল–-ওরে কই যাব রে? তুই বলে যা কই যাব রে?
আমার নিজের যাওয়ার নাই ঠিক, আমি কী করে বলব— কই যাবে? দাফন করতে যাবে, আমি বললাম, খালা আমাকে পাঁচটা মিনিট সময় দেন। চা খাবার নাম করে আসছি। চা খেতে বের হয়ে ফুটলাম।
ভাল করেছিস।
ঘর ভর্তি বাচ্চা কাচ্চা। এর মধ্যে একটার আবার উঠেছে জ্বর। মাথায় পানি ঢালাঢলি হচ্ছে। বিশ্রী অবস্থা।
মোবারক বলল, তুই গেলি কেন খামাখা। যাওয়াটাই ভুল হয়েছে।
জহির থমথমে গলায় বলল, বিরাট ভুল হয়েছে। যাওয়া উচিত হয় নাই। আমার যাবার কোন ইচ্ছা ছিল না, বাবা বলল, জহির যা দেখে আয়। আমি নড়তে পারছি না। নয়ত আমি যেতাম। আমি ভাবলাম যাই। ছোটবেলা কিছুদিন খালার সঙ্গে ছিলাম। খালা খালু দুইজনই খুব আদর করত। খালার চেয়ে বরং খালুর আদর ছিল বেশি। এই জন্যই চলে গেছি। গিয়ে পড়লাম কাঁচালে। এমন মনটা খারাপ হয়েছে কিছুই ভাল লাগে না। কাদলে মনটা হালকা হত। কান্নার চেষ্টা করেছি। কান্না আসে না–এখন করব কী বল? নেশা করলে যদি চোখে পানি আসে এই জন্যেই ছয়টা বোতল নিয়েছি।
টাকা কই পেয়েছিস?
জহির জবাব দিল না। মাথা নিচু করে বসে রইল।
মোবারক আবার বলল, টাকা কোথায় পেয়েছিস?
জহির কথা শুনতে পায়নি এমন ভাব করে আরেকটা সিগারেট ধরাল।
কেউ কোনো কথা বলতে না চাইলে সেই কথা শোনার জন্যে চাপাচাপি করা ঠিক না। মোবারক চুপ করে গেল। বলার হলে সে নিজেই বলবে। পেটে জিনিস পড়লেই হড়বড় করে কথা বের হবে। জিনিস পড়ার জন্যে অপেক্ষা করতে হবে। কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে সেটাই হল কথা। বজলুর এখনো দেখা নাই। বজলু থাকে তার ছোট বোনের সঙ্গে ঝিকাতলায়। ঠিকানা আছে। কিন্তু বজলুর কঠিন নিষেধ যেন তার খোঁজে কখনো যাওয়া না হয়। নিষেধ হোক যাই হোক একবার যাওয়া দরকার। মানুষটার অসুখ বিসুখও তো হতে পারে। বন্ধু যদি বন্ধুর খোঁজ না করে কে করবে? পাড়ার লোকে করবে? পাড়ার লোকের কী দায় পড়েছে?
মোবারক বলল, তোর পায়ে কী হয়েছে?
জহির বলল, রগে টান পড়েছে মনে হয়।
ল্যাংড়া হয়ে যাবি তো।
হুঁ।
তোর তো দেখি শরীর একেবারে গেছে।
গেলে কী আর করা? শরীর দিয়ে কী হয়? এত বড় যে গামা পালোয়ান শরীর দিয়ে সে করলটা কী?
তোর জিহ্বা কালো হয়ে গেছে। তোর মধ্যে একটা সাপ সাপ ভাব চলে এসেছে।
জহির হঠাৎ বিরাট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, দোস্ত মনটা খারাপ, খুবই খারাপ।
কী জন্যে মন খারাপ বলে ফেল। শুনলে তোরও মন খারাপ হবে। তাহলে বাদ দে।
জহির কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে হঠাৎ বিড়বিড় করে বলল, ছোটখালা এক হাজার টাকা দিয়েছিল। তার কাছে তো ছিল না। ধারধোর করে এনে দিয়েছে। চা খাওয়ার নাম করে ঐ টাকা নিয়ে ফুটে গেছি।
জিনিসপত্র ঐ টাকায় কিনেছিস?
হুঁ। দোস্ত খুবই খারাপ লাগছে। একবার ভাবলাম লাফ দিয়ে কোনো ট্রাকের নিচে পড়ে যাই।
পড়লি না কেন?
ট্রাকের সামনে ঝাপ দিতে ইচ্ছা করে, ঝাপ দেই না। ছাদে উঠে ঝাপ দিয়ে নিচে পড়তে ইচ্ছা করে, ঝাপ দেই না। সাহস নাইরে দোস্ত, সাহস নাই। এই দুনিয়ায় আসল জিনিসের নাম— সাহস। যার সাহস আছে তার সবই আছে। যার সাহস নাই তার কিছুই নাই।
ক্যাশ বক্স ফেলে কুদ্দুস উঠে এসে মোবারকের পাশে বসল। গলা নামিয়ে বলল, গায়ের শাল কি বিক্রি হবে?
মোবারক উদাস গলায় বলল, দামে পুষালে বিক্রি।
কুদ্দুস শাল পরীক্ষা করতে করতে বলল, সেকেন্ড হ্যান্ড ব্যবহারী জিনিস। তিনশ টাকা। যদি পুষায় জিনিস রেখে যাও, কাল দাম নিবা।
পুষাল না।
পুষালে নাই। আমারটা আমি বললাম। তিনশ।
ভাল বলেছ। এখন ফুটে যাও।
কুদ্দুস যেভাবে এসেছিল সেইভাবে চলে গেল। হাসিমুখে বসল ক্যাশবাক্সে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, দুনিয়াটা বড়ই আনন্দময়।