আয়নায় নিজেকে দেখে
আয়নায় নিজেকে দেখে ছেলেরা সাধারণত মুগ্ধ হয় না। অতি বুদ্ধিমান ছেলেকেও আয়নায় খানিকটা বোকা বোকা লাগে। কিন্তু মোবারক মুগ্ধ। তার মনে হচ্ছে সে নিজেকে দেখছে না, অন্য কাউকে দেখছে। তার কোনো জমজ ভাইকে। যে ভাই কলেজে অধ্যাপনা করেন। এবং যে ভাই-এর কলাবাগান টাইপ জায়গায় একটা বাড়ি আছে। বাড়ির সামনে বাগান আছে। যে ভাই তার স্ত্রী দুই ছেলেমেয়েসহ বাগানে বসে বিকালে চা খায়। চায়ের সঙ্গে হালকা নাশতা থাকে। কোনোদিন নিমকি, কোনোদিন সমুচা।
চুল আচড়ানোই ছিল, তারপরেও মোবারক আচড়ানো চুলের উপরই কয়েকবার চিরুনী চালালো। চুলের স্টাইলটা অন্যরকম করবে কি-না ভাবল। শেষে মনে হল অন্যরকম করা ঠিক হবে না। হঠাৎ করে নতুন স্টাইলে চুল বসবে না। খাড়া খাড়া হয়ে থাকবে। যা আছে তাই ভাল। শুধু ভাল না–বেশ ভাল, যাকে বলে উত্তম।
নিজেকে উত্তম করার জন্যে মোবারককে বেশ কিছু জটিল প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে— ভোর সাতটায় গোসল। শীতের শুরুতে সকালবেলা গোসল কঠিন আজাবের একটি। সেই আজাবকে সহনীয় করার জন্যে মেসের বয় মনু মিয়াকে দুটা টাকা দিয়েছিল। কথা ছিল, দুটাকার বিনিময়ে মনু মিয়া এক কেতলি টকটকে গরম পানি বালতিতে ছেড়ে দেবে। মনু মিয়া দাঁত বের করে বলেছে, চিন্তা নাই দুই কেতলি পানি ছাড়তাছি। বলক তুলা পানি। শইল্যে ফুসকা পইড়া যাইব।
মোবারক সেই পানি মাথায় ঢেলে শিউরে উঠল। হিমালয়ের বরফগোলা পানি। মনু এক ফোঁটা গরম পানিও দেয় নি। হারামজাদাটাকে এই পানিতে চুবিয়ে দিতে পারলে মন শান্ত হত। মোবারককে বরফগোলা পানি দিয়ে গোসল সারতে হল। এক প্যাকেট লেমন শ্যাম্পু কিনেছিল। প্যাকেটে চা চামুচের এক চামুচের বেশি শ্যাম্পু হবে না। তার দামই নিল চার টাকা। শ্যাম্পু দুই নম্বরী কি-না কে জানে। মাথায় ফেনা হচ্ছে না, চোখ জ্বালাপোড়া করছে। এই শ্যাম্পু দেয়ার কারণে মাথায় আরো আধাবালতি বরফ-পানি বেশি ঢালতে হল। ভদ্র সাজার এ-কী যন্ত্রণা!
মোবারকের গায়ে ইস্ত্রী করা পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির ডান হাতায় পানের পিকের দাগ আছে। লাল দাগ ছিল। ধোপাখানায় পাঠানোর পর লাল দাগ হলুদ হয়েছে, এবং আরো কড়া হয়েছে। হারামজাদা ধোপার পাছায় একটা লাথি মারতে পারলে ভাল হত। ভাগ্য ভাল দাগটা এমন জায়গায় যে চট করে চোখে পড়ে না। পায়জামা ছিল না বলে প্যান্টের উপর পাঞ্জাবি পরতে হয়েছে। সেই প্যান্টও সে গতকালই ইস্ত্রী করে আনিয়েছে। সবই ভাল, শুধু স্যান্ডেলজোড়া ইজ্জত মেরে দিয়েছে। স্যান্ডেলের দিকে তাকানো যায় না। মোটরগাড়ির টায়ার দিয়ে হাফসোল করোনোটা বোকামি হয়েছে। দেখেই মনে হয় ফকিরের স্যান্ডেল। ভিক্ষার জন্যে প্রচুর হাঁটাহাঁটি করতে হবে— এটা মাথায় রেখে বানানো।
একটাই ভরসা— বড়লোকরা সাধারণত পায়ের দিকে তাকায় না। এটা অবশ্যি সাধারণ বড়লোকের কথা। অতি অতি বড়লোকরা কী করে মোবারক জানে না। আজ হয়ত জানবে। একজন অতি অতি বড়লোকের কাছে যাবার জন্যেই সকাল থেকে এই কষ্ট। শ্যাম্পুর চোখ জ্বলুনি এখনো যায় নি।
বড়লোকদের কাছে ভাল সাজ পোশাকে যেতে হয়। সাধারণ প্রচলিত ধারণা— মলিন পোশাকে উপস্থিত হলে করুণা পাওয়া যায়। মোবারক নিশ্চিতভাবে জানে ধারণা ভুল। ময়লা পোশাকে লেবেনডিস সেজে গেলে বড়লোকরা নাক কুঁচকে তাকান। ভাবটা এরকম যেন পোশাক থেকে মুরগির গুয়ের গন্ধ আসছে। এই দুর্গন্ধের হাত থেকে বাঁচার জন্যে কথাবার্তা দ্রুত শেষ করে হাতটা এমনভাবে নাড়ান যেন মুরগি তাড়াচ্ছেন। মুরগি হবার দরকার কী? একটু না হয় ঝামেলা করে ফিটফাট হওয়া গেল। তবে শ্যাম্পুটা না দিলেও হত। চোখ শুধু যে জ্বালা করছে তাই না, একটু লাল লালও হয়েছে। তার মত মানুষের লাল চোখ মানায় না। লাল চোখ মানায় শুধু মেথরদের আর অতি অতি বড়লোকদের। তাদের জন্মই হয়েছে চোখ লাল করে রাখার জন্যে।
আজ সকাল সাড়ে নটায় মোবারকের এ্যাপয়েন্টমেন্ট। দেখা হবে মুখোমুখি। এই মুখোমুখি দেখা হবার জন্যে ঝামেলা কম করতে হয় নি। টেলিফোন করতে হয়েছে পাঁচবার। যে ফার্মেসী থেকে সে টেলিফোন করে, তারা একটা কলের জন্যে পাঁচ টাকা করে নেয়। যাকে বলে দুপুরে ডাকাতি। পাঁচটা কলে পঁচিশ টাকা চলে গেল। পঁচিশ টাকা কোনো খেলা কথা না। পঁচিশ টাকায় তিনবেলা খাওয়া হয়ে যায়। টেলিফোন করাও কোনো সহজ ব্যাপার না। সব সময় সাবধান থাকা। বেফাস কিছু যদি মোবারক বলে ফেলে তাহলে সব কেঁচে যাবে। বাণিজ্যের যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে এক ঝাকিতে সব শেষ। প্রথম টেলিফোনটা একটা বাচ্চা মেয়ে ধরল। মিষ্টি গলা। অতি ভদ্র ব্যবহার। আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?
মোবারক থতমত খেয়ে বলল, আমার নাম মোবারক। মোবারক হোসেন।
আপনি কার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছেন?
মোবারক পড়ে গেল বিপদে। আসলেইতো সে কার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছে? শুরুতেই দেখি সব কেচে যাচ্ছে। মোবারক হড়বড় করে বলল,
পত্রিকায় একটা বিজ্ঞাপন দেখে টেলিফোন করছি।
ও আচ্ছা। আপনাকে ম্যানেজার চাচুর সঙ্গে কথা বলতে হবে।
ম্যানেজার সাহেব কি আছেন?
জ্বি আছেন। ডেকে দেব?
আচ্ছা দাও। তবে তোমার সঙ্গে একটু কথা বলে নেই। তোমার নাম কী?
আমার নাম আয়না।
বাহ্ কী সুন্দর নাম আয়না। কোন ক্লাসে পড়?
কেজি ওয়ান।
আমার নাম মোবারক ঈদ মোবারকের মোবারক। খুকি এখন তুমি ম্যানেজার সাহেবকে ডেকে দাও।
আপনি টেলিফোন ধরে থাকুন। আমি ডাকছি।
মোবারক ধরে থাকল। খুবই কায়দার টেলিফোন। নানান রকম বাজনা বাজছে। একটা শেষ হয়তো আরেকটা শুরু হয়। ম্যানেজার চাচু এসে আর টেলিফোন ধরেন না। এক সময় ধরলেন এবং ম্যানেজার টাইপ লোকদের স্বভাব মত গম্ভীর ভঙ্গিতে বললেন, কে?শব্দটা মওলানা সাহেবদের কাফ উচ্চারণের মত। নাভি থেকে আসছে।
মোবারক নরম স্বরে বলল, স্যার আমার নাম মোবারক হোসেন। পত্রিকায় একটা বিজ্ঞাপন দেখে টেলিফোন করছি। বিজ্ঞাপনটা গতকালের দুটা দৈনিক পত্রিকায়…
মোবারকের কথা শেষ করতে না দিয়েই ম্যানেজার বললেন, আপনি ইন্টারেস্টেড পার্টি?
জ্বি স্যার।
বয়স কত?
স্যার, পয়ত্রিশ। থার্টি ফাইভ ক্রস করেছে।
এটা মোবারকের আসল বয়স না। সে পাঁচ বছরের মত কমিয়েছে। কেন কমিয়েছে নিজেও জানে না।
এখন আমি ব্যস্ত আছি, কথা বলতে পারছি না। আমি কি স্যার কিছুক্ষণ পরে করব?
এক ঘণ্টা পরে করুন। তবে এই নাম্বারে না— আমি নাম্বার দিচ্ছি। কাগজ কলম আছে?
আপনি বলুন। আমার স্মৃতিশক্তি ভাল। মনে থাকবে।
ম্যানেজার সাহেব নাম্বার বলেই খট করে টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন। ভাবটা যেন তিনি মহাব্যস্ত। নিঃশ্বাস ফেলার সময়ও নাই।
এরপর থেকে শুরু হল ঝামেলা— মোবারক যতবারই টেলিফোন করে বুড়ো মানুষের মত গলায় কে একজন বলে, ম্যানেজার সাহেব মিটিং-এ আছেন। পরে করেন। মোবারকের মেজাজ পুরো খারাপ হয়ে গেল। আরে তুই ব্যাটা ম্যানেজার, তোর এত কী মিটিং। তুই কি মন্ত্রী না-কি যে ঘুম থেকে উঠে চা খেয়ে মিটিং শুরু করবি। রাত বারটার সময় মিটিং শেষ করে ঘুমুতে যাবি। ঘুমের মধ্যেও স্বপ্ন দেখবি মিটিং করছিস। তুই হচ্ছিস চার পয়সা দামের ম্যানেজার।
যাই হোক ম্যানেজার সাহেব এক সময় টেলিফোন ধরলেন। ধমকের স্বরে বললেন, কে? আবারো সেই কাফ মার্কা কে?
মোবারক বিনয়ে গলে গিয়ে বলল, স্যার আমার নাম মোবারক। মোবারক হোসেন। সকালে আপনার সঙ্গে কথা বলেছি।
সকাল থেকেতো অনেকের সঙ্গেই কথা বলছি। আপনার ব্যাপারটা কী বলুন। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে টেলিফোন করছেন?
জ্বি স্যার।
আপনি কি ইন্টারেস্টেড পার্টি?
জ্বি স্যার।
আপনার বয়স কত?
পয়ত্রিশ।
আপনি এক কাজ করুন, বুধবার সকাল সাড়ে নটায় চলে আসুন। মুখোমুখি কথা হওয়া দরকার।
কোথায় আসব?
সঙ্গে কাগজ কলম আছে? ঠিকানা বলছি, লিখে নিন। কাঁটায় কাঁটায় সকাল সাড়ে নটায় চলে আসবেন। ইন্টারেস্টেড পার্টিতো আপনি একা না। আরো অনেকেই আছে। স্যার সরাসরি কথা বলবেন।
ম্যানেজার সাহেবের এই কথায় মোবারক খুবই দমে গেল। ইন্টারেস্টেড পার্টি আরো আছে মানে কী? তার ধারণা ছিল সে-ই একমাত্র ইন্টারেস্টেড পার্টি। যেহেতু সে একা, তার সুযোগ থাকবে জায়গা মত মোচড় দিয়ে দাম বাড়াতে। এখন দেখা যাচ্ছে এখানেও ইন্টারেস্টেড পার্টি। দেশটা যাচ্ছে কোথায়?
কিডনীর মত একটা জিনিস বিক্রি করতে লোকজন হামলে পড়বে এটা কী করে হয়? তোর শরীরে আছেই দুটা কিডনী। একটা বিক্রি করে দিলি, বাকিটা যদি নষ্ট হয়ে যায়– তুই যাবি কোথায়? তুইতো আর পয়সা দিয়ে এই জিনিস কিনতে পারবি না।
মোবারক স্পষ্ট কল্পনায় দেখল বুধবার সকাল সাড়ে নটা। একটা হলঘরের মত ঘরে সে বসে আছে। তার সঙ্গে মেয়ে পুরুষ মিলিয়ে আরো ত্রিশজনের মত আছে। সবার হাতে নম্বর ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। নম্বর অনুসারে ডাক পড়ছে। চাকরির ইন্টারভর মত ইন্টারভু হচ্ছে। কারো ইন্টারভু ভাল হয়েছে। সে বের হয়ে এসেছে হাসি মুখে। সবাই তাকে ঘেঁকে ধরেছে। সবার প্রশ্ন কী জিজ্ঞেস করল? কী জিজ্ঞেস করল? আবার কারো ইন্টারভু খুব খারাপ হয়েছে, বের হয়ে এসেছে কাঁদো কাঁদো মুখে। সে শুকনো গলায় বলল, ইজি ইজি কোশ্চেন জিজ্ঞেস করেছে। উত্তরও জানা ছিল, বলতে পারি নি। উত্তরটা মাথায় ছিল। মুখে আসে নি।
কী ধরনের প্রশ্ন হতে পারে? জেনারেল নলেজের দু একটা প্রশ্নতো থাকবেই।
পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব কত?
কোন তারিখে চাঁদে মানুষ প্রথম নামে?
বর্তমান পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্য কী কী?
বিজ্ঞানের উপরও কিছু প্রশ্ন থাকবে। যুগটাই বিজ্ঞানের। সেই বিজ্ঞানের উপর প্রশ্ন না থাকলে হবে কীভাবে?
পেনিসিলিন কে আবিষ্কার করেন?
ফাউন্টেন পেন এবং বল পয়েন্টের মধ্যে তফাৎ কী?
লুই পাস্তুর কোন দেশের নাগরিক?
কিছু থাকবে পলিটিক্যাল প্রশ্ন।
কোল্ড ওয়ার কী?
তৃতীয় বিশ্ব মানে কী?
ইটালীর প্রেসিডেন্টের নাম কী?
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা কে দিয়েছিলেন?
এটা একটা ট্রিকি প্রশ্ন। বোর্ডের চেয়ারম্যান আওয়ামী-পন্থী না বিএনপি-পন্থী তার উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। আওয়ামীপন্থী হলে সঙ্গে সঙ্গে বুক ফুলিয়ে বলতে হবে— জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। বিএনপি-পন্থী হলে বলতে হবে মেজর জিয়া।
বোর্ডে একজন ডাক্তারও নিশ্চয়ই থাকবেন। ডাক্তার পেট টিপেটুপে দেখবেন মাল ঠিক আছে কি-না। পেট কেটে দেখতে চাইলেও অনেকে হয়ত আপত্তি করবে না। কাস্টমার জিনিস কিনবে না দেখে কেন কিনবে? দেখে শুনে কিনবে। সাইজ পছন্দ করবে, রঙ পছন্দ করবে।
মেস থেকে বেরুবার মুখে মনু মিয়ার সঙ্গে দেখা। কোকের বোতল ভর্তি গরম চা নিয়ে কোনো বোর্ডারের ঘরে যাচ্ছে। হারামজাদার সাহস কত বড় তার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে আছে। মনে হয় হাসছে। হারামজাদাটাকে লাথি দিয়ে কোকের বোতলসহ মেঝেতে ফেলে দেয়া উচিত। মোবারক তা করল না। শুভ কাজে যাচ্ছে, এ সময় মারামারি করা ঠিক না। গলা নামিয়ে বলল, সামনের দরজা দিয়া যাইয়েন না। বাবু আছে।
বাবু মানে পরিমল সাহা। মেসের মালিকের শালা। এবং মেসের ম্যানেজার। মোবারকের ছয়মাসের মেস ভাড়া বাকি। পরিমল বাবু তাকে দেখলে বাঘের মত ঝাপ দিয়ে পড়বেন। এই সুযোগ তাকে দেয়া ঠিক হবে না। মোবারক পেছন দরজা দিয়ে বের হল এবং তাকে যথা সময়ে সাবধান করে দেবার জন্যে মনু মিয়ার ঠাণ্ডা পানি বিষয়ক অপরাধ প্রায় ক্ষমা করে দিল।
অতি বিস্ময়কর ব্যাপার হল মোবারক দেখল ইন্টারেস্টেড পার্টিতে ঘর ভর্তি না। সে একা। যে ঘরে তাকে বসানো হয়েছে সেই ঘরও হলঘর না। ছোট ঘর। তবে বসার ঘর। সোফা আছে, মেঝেতে কার্পেট আছে, দেয়ালে পেইনটিং আছে। বড়লোকদের বসার ঘর একটা থাকে না। কয়েকটা থাকে। তাদের কাছে নানান ধরনের লোক আসে। সবাইকে এক জায়গায় বসানো হয়। না। অবস্থা বুঝে বসার ব্যবস্থা হয়।
ম্যানেজার সাহেবের সঙ্গে মোবারকের কথা হয়েছে। টেলিফোনে তাঁকে যেমন গম্ভীর এবং রাগী মনে হয়েছিল বাস্তবে তাঁকে মিনমিনেটাইপ মনে হল। চেহারা, চলাফেরা এবং কথাবার্তায় লজ্জিত ভঙ্গি। একটু তোতলামী আছে। মনে হয় টেলিফোন হাতে পেলে উনি বদলে যান। বন্দুক হাতে পেলে মানুষ যেমন বদলে যায়, উনিও বোধহয় টেলিফোন হাতে পেলে বদলান। ম্যানেজার সাহেবের নাম জগলু। নাম বগলু হলে ভাল হত। লম্বা বলে তাঁর মধ্যে বগা বগা ভাব আছে। জগলু সাহেবের সঙ্গে মোবারকের কিছু কথা হল।
আপনি মোবারক সাহেব?
জ্বি স্যার।
আপনি কী করেন?
কিছু করি না।
একেবারেই কিছু করেন না তা কী করে হয়? আগে কী করতেন?
শিক্ষকতা করতাম।
কথাটা পুরোপুরি ভুল না। এনজিও-ওয়ালাদের এক স্কুলে মোবারক সর্বমোট এগারো দিন পড়িয়েছে। বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্র। গোটা বিশেক থুড়থুড়ো বুড়ো-বুড়ি বই-খাতা নিয়ে বসা। তাদেরকে কিছুক্ষণ স্বরে অ, স্বরে আ করানো। বুড়োবুড়িরা যে শিক্ষার মহান আলোয় আলোকিত হতে এসেছে তাও না। স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুবাদে তাদের নাম রেজিস্ট্রি হয়েছে। সবাই একটা করে ছাতা পেয়েছে। ছাতায় এনজিওর নাম। ছাতা ছাড়া মাঝে মধ্যে টুকটাক উপহারের ব্যবস্থা আছে। অক্ষরজ্ঞান শেষ হলে সবাই শাড়ি লুঙ্গি পাবে এরকম গুজব শোনা যাচ্ছে। এগারো দিন পড়ানোর পর মোবারক ঈ পর্যন্ত আগালো। কিন্তু দেখা গেল ছাত্রছাত্রীরা শুরুর স্বরে অ ভুলে গেছে। মোবারক এগারো দিনের দিন এনজিও-ওয়ালাদের তিনটা ছাতা নিয়ে সড়ে পড়লো। কাজেই সে শিক্ষকতা করেছে এটা বলা ভুল হয় নি। যে একদিন পড়িয়েছে সে শিক্ষক। সারা জীবনই শিক্ষক। আবার যে একদিন চুরি করেছে সে কিন্তু সারাজীবনই চোর না। তাহলে পৃথিবীর সব মানুষই চোর হত।
আপনি তাহলে শিক্ষকতা করতেন?
জ্বি স্যার।
এখন কিছু করেন না?
করলে কি কিডনী বিক্রি করতে আসতাম?
তা ঠিক। আপনি বসুন। চা-টা খান। স্যার আপনার সঙ্গে কথা বলবেন। সামান্য দেরি হবে।
কিডনী কার জন্যে দরকার?
স্যারের জন্যে। উনার দুটা কিডনী নন ফাংশানাল হয়ে গেছে। ডায়ালাইসিস করে করে এতদিন চলেছে, এখন ডাক্তাররা কিডনী ট্রান্সপ্লান্টের কথা বলছেন। আত্মীয়-স্বজনরা অনেকেই ডোনেট করতে রাজি। কিন্তু স্যার তা চান না।
মোবারক হাসি মুখে বলল, আমরা থাকতে আত্মীয়-স্বজনরা কেন কষ্ট করবে? আমরা আছি কী জন্যে?
ম্যানেজার সাহেব কিছুক্ষণ সরু চোখে তাকিয়ে থেকে আগের মত মিনমিনে গলায় বললেন, আপনি অপেক্ষা করুন। আমি যথাসময়ে ডেকে নিয়ে যাব।
মোবারক বিনীত গলায় বলল, জ্বি আচ্ছা স্যার। একটা কথা শুধু জিজ্ঞেস করি, এই ঘরে কি সিগারেট খাওয়া যায়?
হ্যাঁ খাওয়া যায়। ঐ যে এসট্রে।
স্যার অনেক ধন্যবাদ।
মোবারক সিগারেট ধরালো। বড় সাহেবের কাছে যাবার আগে হাত-মুখ ধুতে হবে। মুখ কুলকুচা করতে হবে। অসুস্থ মানুষরা দূর থেকে সিগারেটের গন্ধ পায়। তাদের মেজাজ খারাপ হয়। বড় সাহেবের মেজাজ খারাপ করা একেবারেই ঠিক হবে না।
মোবারক যে চেয়ারে বসেছে তার দুটা চেয়ারের পরের চেয়ারেই সুন্দর একটা উলের চাদর পড়ে আছে। চাদরের ওপর মারলবোরো সিগারেটের একটা প্যাকেট। মনে হছে তার মত কেউ একজন এখানে বসেছিল। সে-ও কিডনী বেচতে এসেছে। বড় সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছে। তবে যে এমন দামি চাদর গায়ে দেয় এবং মারলবোরো সিগারেট খায় সে কিডনী বেচবে কেন? তার উচিত দুএকটা কিডনী কিনে ফ্রীজে রেখে দেয়া। প্রয়োজনে ব্যবহার করবে। প্রয়োজন না হলে কালোবাজারে বেচে দেবে।
ব্যস্ত ভঙ্গিতে এক ভদ্রলোক ঢুকলেন। রাজপুত্র রাজপুত্র চেহারা। হাতে তলোয়ারের বদলে লম্বা স্কেল। কমপ্লিট স্যুট পরা। গলায় লাল টাই। জুতাজোড়াও সম্ভবত নতুন হাটলেই মুড়ি খাওয়ার মত মচমচ শব্দ হচ্ছে। ভদ্রলোক ঘরে ঢুকেই মোবারককে বললেন, আচ্ছা আনিস সাহেব কি চলে গেছেন?
মোবারক বিনীত ভঙ্গিতে বলল, জ্বি স্যার চলে গেলেন।
যদিও আনিস সাহেব কে মোবারক কিছুই জানে না। এ বাড়ির একজনকেই সে চেনে। ম্যানেজার জগলু।
কখন গেছেন বলতে পারেন?
এগজাক্ট টাইম বলতে পারব না। দশ এগারো মিনিট হবে। কমও হতে পারে।
আনিস সাহেবের সঙ্গে কি কোনো ফাইলপত্র ছিল?
স্যার আমি লক্ষ করিনি।
আপনার অবশ্য লক্ষ করার কথাও না। থ্যাংকস এনিওয়ে।
ভদ্রলোক যেমন ব্যস্ত ভঙ্গিতে ঢুকেছিলেন তারচেয়েও ব্যস্ততার সঙ্গে চলে গেলেন। মিথ্যা কথাগুলি বলার জন্যে মোবারক তেমন দুশ্চিন্তা করছে না। এই নিয়ে পরে যদি প্রশ্ন করা হয় সে বলবে, সে আসলে বুঝতে পারে নি। সে ভেবেছে ভদ্রলোক ম্যানেজার সাহেবের কথা জানতে চেয়েছেন। ম্যানেজার জগলু সাহেব এই ঘরে কিছুক্ষণ ছিলেন, তারপর চলে গেছেন। এই অংশতো মিথ্যা না। পুরোপুরি সত্যি কথা বলা ঠিকও না। সোনার মধ্যে যেমন খাদ মিশাতে হয়। সত্যি কথার মধ্যেও সামান্য মিথ্যা মিশাতে হয়।
মোবারক চেয়ার বদলে পাশের চেয়ারে গেল। এই চেয়ার থেকে হাত বাড়িয়ে মারলবোরোর প্যাকেটটা নেয়া যায়। প্যাকেট খুলে দেখা যেতে পারে মোট কটা সিগারেট আছে। প্যাকেট ভর্তি থাকলে কিছু করার নেই। আধাআধি থাকলে একটা সিগারেট খাওয়া যেতে পারে। সিগারেটের মালিক যদি চলেও আসে তাকে বলা যাবে, ভাই একটা সিগারেট নিয়েছি। কিছু মনে করবেন না।
তেরটা সিগারেট আছে। মোবারক একটা সিগারেট ধরালো। ম্যানেজার চায়ের কথা বলে গিয়েছিলেন। সেই চা এখনো আসে নি। বিদেশী সিগারেট চায়ের সঙ্গে খেতে পারলে আরাম হত। উপায় কী? মোবারক হাত বাড়িয়ে উলের শালটা পরীক্ষা করল। হাত দিলেই বোঝা যায় দামি জিনিস। এক চাদরে মাঘ মাসের শীত পার করে দেয়া যাবে। শালের নিচে গেঞ্জি বা শার্ট কিছু না থাকলেও সমস্যা হবে না। শালের মালিককে পেলে জিজ্ঞেস করা যেত শালটার দাম কত।
মোবারক সাহেব।
ম্যানেজার জগলু এসে দাঁড়িয়েছে পেছনে। এই মিনমিনে লোক হাঁটেও বিড়ালের মত। টেলিফোনে হাঁটার ব্যবস্থা থাকলে বুট পরে ধপ ধপ শব্দ করে হাঁটতো।
আসুন স্যারের সঙ্গে কথা বলবেন।
মোবারক ভেবেছিল স্যার এক বিরাট পালংকে শুয়ে আছেন। তাকে ঘিরে সেবা করার লোকজন। পাশের টেবিল ভর্তি ফলমুল। দুজন নার্স এবং একজন ডাক্তার একটু দূরে শুকনো মুখে হাঁটাহাঁটি করছে। স্যার ঠিকমত নিঃশ্বাসও নিতে পারছেন না। কাতলা মাছ পুকুর থেকে তোলার পর যেভাবে থেমে থেমে দম নেয় সেভাবে দম নিচ্ছেন। এই সময়ে তাঁর প্রিয়তমা পত্নী কপালে ভেজা রুমাল ঘসে দিচ্ছেন।
দেখা গেল সম্পূর্ণ বিপরীত ছবি। অফিস ঘরের মত ঘর। স্যার বসে আছেন চেয়ারে। তার সামনে প্রচুর ফাইলপত্র। তিনি ফাইলপত্রে সিগনেচার করছেন। তার ঠোঁটে জ্বলন্ত সিগারেট। তিনি সিগারেট হাতে নিয়ে টানছেন না। ঠোঁটে রেখেই টানছেন। ঠোঁটে রেখেই অদ্ভুত কায়দায়, একটু মাথা ঝুঁকিয়ে ছাই ফেলছেন। কায়দাটা ইন্টারেস্টিং। শিখে রাখতে হবে। তাহলে সিগারেট খাবার সময় দুটা হাত খালি রাখা যায়। স্যারের গায়ে সিল্কের শার্ট। সুন্দর মেরুন রঙ। তবে তিনি লুঙ্গি পরে আছেন। প্রিয়তমা পত্নীর মুখ বিষাদময়।
স্যার সিগনেচার বন্ধ রেখে টেবিলে রাখা সোনালি চশমা চোখে দিয়ে মোবারকের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি মোবারক?
মোবারক বলল, জ্বি।
বসুন।
মোবারক বসল।
আপনি এক সময় শিক্ষকতা করতেন?
জ্বি।
আমিও এক সময় শিক্ষকতা করতাম। একটা প্রাইভেট কলেজে তিন মাস পড়িয়েছি। তিন মাসে এক মাসের বেতন পেয়েছি। যাই হোক, আপনি কিডনী বিক্রি করতে চান কেন?
মোবারক বলল, টাকার জন্যে চাই স্যার। শখ করেতো আর কেউ কিডনী বিক্রি করে না।
আপনার টাকা দরকার?
জ্বি স্যার।
কত টাকা চাচ্ছেন?
আমার দরকার দুই লাখ টাকা।
আরো কিছু মানুষ এসেছে যারা আপনার মত কিডনী বিক্রি করতে চায়। তবে তারা চাচ্ছে পঞ্চাশ হাজার। আপনি এত চাচ্ছেন কেন? আপনার কিডনীর কোয়ালিটি কি ভাল?
খুব ভাল হবারতো কথা না। আপনারটা হল মেড ইন বাংলাদেশ। মেড ইন বাংলাদেশের জিনিস সাধারণত ভাল হয় না।
মোবারক চুপ করে রইল। ভদ্রলোক রসিকতা করছেন। রসিকতায় মজা পেয়ে তার হাসা উচিত কিনা সে বুঝতে পারছে না। বোকা সেজে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা যায়। সেটাই মনে হয় ভাল হবে।
দুই লাখ টাকা দিয়ে কী করবেন?
একটা ব্যবসা করার ইচ্ছা।
কী ব্যবসা?
এখনো চিন্তা করি নাই। আগেভাগে চিন্তা করে তো কোনো লাভ নাই।
বিবাহ করেছেন?
জ্বি-না।
আচ্ছা ঠিক আছে। আপনার সঙ্গে আমার কথা শেষ হয়েছে। আপনাকে জগলু একজন ডাক্তারের ঠিকানা দেবে। তার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। ডাক্তার বোধহয় কিছু পরীক্ষা নীরিক্ষা করবেন। তারপর তিনি যদি ok বলেন, তখন কিডনীর দরদাম নিয়ে আমরা বসব।
জ্বি আচ্ছা।
থাকেন কোথায়?
একটা মেসে থাকি?
দেশের বাড়ি কোথায়?
নেত্রকোনা।
আপনাদের নেত্রকোনায় বিশেষ এক ধরনের মিস্টি পাওয়া যায়। মিষ্টিটার নাম বালিশ। বালিশ মিষ্টি কখনো খেয়েছেন?
জ্বি স্যার।
খেতে কেমন?
চমচমের মত।
এখন আপনি যেতে পারেন।
মোবারক উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আপনাকে একটা কথা বলব স্যার?
বলুন।
আপনাকে দেখে মোটেই অসুস্থ মনে হচ্ছে না।
আমিতো অসুস্থ না। শরীরের একটা যন্ত্র কাজ করছে না। এটাকে অসুখ বলা ঠিক না।
স্যার যাই। স্লামালিকুম।
ওয়ালাইকুম সালাম।
স্যার আবার সিগনেচারে মন দিলেন। মানুষটার বয়স পঞ্চাশ। দেখে অনেক কম লাগছে। কিডনী নষ্ট হয়ে গেলে চেহারা সুন্দর হয় কি-না কে জানে। ভদ্রলোককে সুন্দর লাগছে। চোখে মুখে গোলাপী আভা। দীর্ঘদিন ভাল ভাল খাবার খেলেও হয়ত চোখে মুখে গোলাপী আভা আসে।
আবার পুরনো জায়গায় ফিরে আসা। ম্যানেজার সাহেব না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা। পাশের চেয়ারে চাদর এবং সিগারেট আগের মতই আছে। আশ্চর্য! মালিক কোথায়? বারোটা সিগারেট থেকে আরেকটা কমলে তেমন ক্ষতি কী হবে?
মোবারক একটা সিগারেট ধরালো। একটা পকেটে রেখে দিল। রাজপ্রাসাদ থেকে বের হয়ে একটা ধরাতে হবে। ভাল সিগারেটের সত্যিকার স্বাদ তখন পাওয়া যাবে।
ম্যানেজার সাহেব আসতে দেরি করছেন। টেবিলে বেশ কিছু ম্যাগাজিন আছে। যে-কোনো একটা হাতে নিলে ধর্ষণের কোনো সচিত্র প্রতিবেদন পাওয়া যাবে। সময় কাটানোর জন্যে খুন এবং ধর্ষণ বিবরণের তুলনা হয় না। মোবারকের ম্যাগাজিন পড়তে ইচ্ছা করছে না। সে চাদরটা হাতে নিয়ে সুন্দর করে ভাজ করে সামনে রাখল। ম্যানেজার সাহেবের সঙ্গে কথা শেষ করে উঠে যাবার সময় খুব সহজ ভঙ্গিতে চাদরটা নিয়ে উঠে যাওয়া যাবে। যেতে হবে ম্যানেজার সাহেবের সঙ্গে গল্প করতে করতে। তখন কেউ যদি কিছু বলে, তাহলে অত্যন্ত বিস্ময়ের সঙ্গে বলতে হবে— কী সর্বনাশ, কার চাদর আমি নিয়ে যাচ্ছি। এই দীর্ঘ সময়ে কেউ যখন চাদরটার খোঁজ করেনি তখন আশা করা যায় যে শেষ পাঁচ মিনিটও কেউ খোঁজ করবে না। বাকিটা কপাল।
ম্যানেজার সাহেব ঢুকলেন। হাতে একটা কাগজ। কাগজে ডাক্তার সাহেবের ঠিকানা লেখা। ম্যানেজার সাহেব পাশের চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, ডাক্তার সাহেবকে সব জানানো আছে। আপনি উনার কাছে কার্ডটা শুধু দেবেন। নিন কার্ডটা রাখুন। হারাবেন না।
মোবারক বলল, জ্বি আচ্ছা।
ম্যানেজার সাহেব গলা নিচু করে বললেন, আপনাকে একটা ভাল পরামর্শ দেই। কিডনীর দাম নিয়ে দরাদরিতে যাবেন না। এটা স্যারের হাতে ছেড়ে দিলে আপনার লাভ ছাড়া ক্ষতি হবে না। বুঝতে পারছেন?
জ্বি পারছি।
স্যার যদি আপনার উপর খুশি হন, তাহলে বাকি জীবনের জন্যে আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে গেলেন। কিডনী ট্রান্সপ্লান্ট কোথায় হবে জানেন?
জ্বি-না।
সুইজারল্যান্ড। বিনা খরচায় সুইজারল্যান্ড দেখে চলে আসবেন।
পাসপোর্ট কি করিয়ে ফেলব?
আগে সব ঠিকঠাক হোক।
মোবারক বলল, আমার উপর একটু দোয়া রাখবেন ভাই সাহেব। যেন বাণিজ্যটা হয়।
ম্যানেজার সরু চোখে তাকান। মোবারকের বাণিজ্য কথাটা তার মনে হয় পছন্দ হল না।
মোবারক বলল, স্যার উঠি? বলতে বলতেই চাদর হাতে সহজ ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল। সিগারেটের প্যাকেট আগেই পকেটে ঢুকিয়ে ফেলেছে। ম্যানেজার সাহেব কিছু বললেন না। চাদর নিয়ে লোকটা চলে যাচ্ছে এটা মনে হয় তার চোখে পড়ছে না।
হাঁটতে হবে স্বাভাবিক ভাবে। গল্পগুজবে ম্যানেজার সাহেবকে ভুলিয়ে রাখতে হবে। মোবারক বলল, আয়না কোথায় ম্যানেজার সাহেব।
জগলু ভুরু কুঁচকে বলল, আয়না কোথায় মানে কি?
আয়না নামের মেয়েটার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে।
আয়না নামে কেউ এ বাড়িতে নেই।
অবশ্যই আছে। আমার সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয়েছে। কেজি ওয়ানে পড়ে।
ম্যানেজার বিরক্ত চোখে তাকাচ্ছে। তাকিয়ে থাকুক। মোবারক এগুচেচ্ছ। আর একটু গেলেই মুক্তি।
শেষ বাধা গেট। গেটের দারোয়ান কিছু জিজ্ঞেস না করলেই হয়। মনে হয় জিজ্ঞেস করবে না। দারোয়ান দুই জনেরই বয়স অল্প। অল্প বয়েসী দারোয়ানরা সন্দেহপ্রবণ হয় না। বুড়োগুলি হয়।
মোবারক কোনো রকম সমস্যা ছাড়াই গেট পার হল। এখন কেউ গেট খুলে বের হয়ে আসবে এবং তার কাছে ছুটে এসে বলবে, আমার কাশ্মিরী শাল নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন? সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ। কার্তিক মাসের শুরু, বাতাসে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব থাকলেও শাল গায়ে দেয়ার মত না। তাতে কী? মোবারক শাল গায়ে দিয়ে ফেলল। চৈত্র মাসেও কমপ্লিট স্যুট পরা লোক দেখা গেলে সেও শাল গায়ে দিতে পারে। জিনিসটা খুব তাড়াতাড়ি বিক্রি করে দিতে হবে। বিক্রির আগে কিছুদিন ব্যবহার করা। অনেকটা ধোপর মত। ধোপার দোকানে শাড়ি ধুতে পাঠালে, ধোপার বউ সেই শাড়ি এক দুবেলা পরে। ধোপর বাড়িতে শাড়ি গেছে, ধোপার বউ সেই শাড়ি পরেনি এমন কখনো হয়