অনেকক্ষণ হল সন্ধ্যা মিলিয়েছে
অনেকক্ষণ হল সন্ধ্যা মিলিয়েছে। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখছি—শত শত জোনাকি পোকা, জ্বলছে নিভছে। কী যে আশ্চর্য হচ্ছি। জোনাকি পোকা আগে দেখি নি তা না। অনেক দেখেছি। কিন্তু এত জোনাকি পোকা এক সঙ্গে কখনো দেখি নি। মনে হচ্ছে থোকায় থোকায় আলোর ফুল ফুটেছে। ফুলগুলি উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। চঞ্চল অস্থির কিছু ফুল। পৃথিবীতে কত অদ্ভুত দৃশ্যই না আছে।
আমার জীবনের প্রথম জোনাকি পোকা দেখার দৃশ্যটাও খুব অদ্ভুত ছিল। বাবা-মার সঙ্গে ট্রেনে কোথায় যেন যাচ্ছি। রাতের ট্রেন। ট্রেনের বাতি হঠাৎ নিভে গেল। মা বিরক্ত হয়ে নানান কথা বলতে লাগলেন–ছাতার এক দেশে ছাতার এক ট্রেন। এখন ডাকাত পড়বে জানা কথা–এই সব। মায়ের কথা শুনে আমার ভয় ভয় করতে লাগল। মনে হচ্ছিল এই বুঝি দরজা জানালা দিয়ে হুড়মুড় করে একদল ডাকাত ঢুকে পড়বে। ডাকাত ঢুকল না। কী ভাবে জানি একটা জোনাকি পোকা ঢুকে পড়ল। বাবা বললেন–রুমালী দেখ একটা জোনাকি পোকা। আমি অবাক হয়ে দেখছি কী সুন্দর আলো। এই জ্বলছে, এই নিভছে। বাবা বললেন—বেচারা জোনাকি একা একা ট্রেনে করে কোথায় যাচ্ছে কে জানে। আমারো মনে হল তাইতো—এর বন্ধু বান্ধব, সঙ্গী সাথী সব কোথায় পড়ে আছে। আর সে একা একা চলে যাচ্ছে। বাবা জোনাকি পোকাটা ধরে আমার হাতে দিয়ে বললেন–মুঠি বন্ধ করে ধরে থাক। আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে আলো আসবে। আমি মুঠি বন্ধ করে ধরে আছি। উত্তেজনায় আমার শরীর কাঁপছে। মা বললেন, বকু এখনই জোনাকি পোকা জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দে। ফেলে দে বললাম।
আমি বললাম, কেন?
মা চাপা গলায় বললেন, গাধা মেয়ে, জোনাকি পোকা ধরে রাখলে রাতে বিছানা ভিজানো রোগ হয়।
আমি বললাম, বিছানা ভিজানো রোগটা কী?
মা আরো গলা নামিয়ে বললেন—প্রতি রাতে বিছানায় পেচ্ছাব করবি। গাধা মেয়ে। বিয়ের পরেও এই অভ্যাস যাবে না।
কী সর্বনাশের কথা। আমি জোনাকি পোকাটাকে জানালা দিয়ে ফেলে দিলাম। সে যতক্ষণ উড়ে গেল আমি তাকে দেখার চেষ্টা করলাম। যে হাতে পোকাটা ধরেছিলাম শুকে দেখি সেই হাতে কেমন অদ্ভুত দুর্বা ঘাসের গন্ধের মত গন্ধ।
মিস রুমাল!
আমি চমকে দেখি সোহরাব চাচা। তাঁর হাতে প্রকান্ড বড় একটা বালতি। ফিল্ম লাইনের সবকিছুই খানিকটা উদ্ভট। এত বড় বালতি আমি আগে দেখি নি।
কী করছ গো মা?
জোনাকি পোকা দেখছি চাচা।
জংলা জায়গা। জোনাকি-ফোনাকি কত কিছু দেখবে। চা কফি কিছু খাবে?
জ্বি না।
কিছু লাগলে বল–আমি বাজারে যাচ্ছি। পাপিয়া ম্যাডামের সবুজ কালির বল পয়েন্ট দরকার। এখন আমি সবুজ কালির বল পয়েন্ট কোথায় পাব কে জানে। নেত্রকোনা ছাড়া পাওয়া যাবে না।
নেত্রকোনা যাবেন?
এখানে না পেলে যাব।
আমি পাপিয়া ম্যাডাম হলে আপনাকে একটা জিনিস দিতে বলতাম।
জিনিসটা কী?
ফুলের মালার মত একটা জোনাকি পোকার মালা। মালা গলায় দিয়ে বসে থাকতাম—মালা জ্বলতো নিভতো।
সোহরাব চাচা সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর গলায় বললেন, আচ্ছা দেখি কী করা যায়। মৌমাছির মোম জোগাড় করতে পারলে জোনাকির মালা বানানো যাবে।
আমি বললাম, আমি ঠাট্টা করছিলাম চাচা। আপনাকে জোনাকির মালা বানাতে হবে না। আপনি ভারী বালতি হাতে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বালতিটা রাখুন তারপর কিছুক্ষণ আমার সঙ্গে গল্প করুন।
সোহরাব চাচা বালতি নামিয়ে রাখলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, বল কী গল্প শুনতে চাও।
তাঁর ভাবটা এ রকম যে–… আমি যে গল্পই শুনতে চাই, তিনি সেই গল্পের রেকর্ড বাজিয়ে দেবেন।
মহিলা পীরের গল্প বলুন।
সোহরাব চাচা বিস্মিত হয়ে বললেন, মহিলা পীরটা কে?
এই অঞ্চলে একজনের সন্ধান পাওয়া গেছে যে নিমিষের মধ্যে মানুষের ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান বলে দিতে পারে।
ও আচ্ছা–হাফিজ আলির বৌ এর কথা বলছ?
বৌটাকে আপনি দেখেছেন?
না তাকে দেখি নি। হাফিজ আলিকে দেখেছি। সকালবেলা সে ছিলতো। কাঠ ফাড়াই করে দিল। ফাকিবাজের শেষ। পঞ্চাশ টাকা দিয়ে সারাদিনের জন্যে নিয়েছি। দুপুরের পর থেকে নেই।
তার বৌ যে ভবিষ্যৎ বলতে পারে এটা কি সত্যি!
আরে দূর দূর। গ্রামাঞ্চলে প্রায়ই এই জাতীয় খবর শুনবে। কারো এই ক্ষমতা, কারো সেই ক্ষমতা। সব বোগাস। আর মানুষের স্বভাব এরকম যে সে আসল জিনিস বিশ্বাস করে না। বোগাস জিনিস বিশ্বাস করে।
চাচা ঐ মহিলার কাছে কি আপনি আমাকে নিয়ে যাবেন?
কেন?
গ্রামের অল্পবয়েসী একটা মেয়ে কোন কৌশলে মানুষকে ধোকা দেয় এটা আমার দেখার শখ?
সোহরাব চাচা বালতি হাতে নিয়ে হাসতে হাসতে বললেন–তুমি তো ভাল পাগলী আছ। বারান্দায় মশার মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকো না। জংলি মশা। কামড় খেয়ে ম্যালেরিয়া ফ্যালেরিয়া বাধাবে। ঘরে চলে যাও। ঘরে ঘরে মসকুইটো কয়েল জ্বালিয়ে দিয়েছি।
আমি লক্ষ্মী মেয়ের মত ঘরে চলে এলাম।
এমন কোন রাত হয় নি কিন্তু চারদিক কেমন নিঝুম হয়ে গেছে। এই অঞ্চলের লোকরা মনে হয় সন্ধ্যা সাতটা বাজতেই খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কেমন অস্বস্থি লাগছে। গাড়ির হর্ণের শব্দ নেই, রিকশার শব্দ নেই। আমি বিছানায় উপুর হয়ে পড়লাম। ডাইরি লেখা যাক। পাপিয়া ম্যাডামের মত সবুজ কালির একটা বল পয়েন্ট আমার জন্যে আনতে বললে হত। ডাইরিতে ইন্টারেস্টিং কিছু কথা সবুজ কালিতে লিখতাম।
আমাদের আজ রান্না হতে দেরি হবে। রান্না কিছুক্ষণ আগে চড়ানো হয়েছে। পাপিয়া ম্যাডাম সন্ধ্যাবেলায় বলেছেন তার খাসির মাংসের রেজালা খেতে ইচ্ছে করছে। বিরিসিরি থেকে খাসি কিনে আনা হয়েছে। এই মাত্র রান্না বসানো হল। আমাদের বাবুর্চির নাম কেয়ামত মিয়া। কেয়ামত কারো নাম হতে পারে?
শুরুতেই আমার সন্দেহ হয়েছিল নামটার কোন সমস্যা আছে। একদিন জিজ্ঞেস করে দেখি আসলেই তাই। তার নাম আসলে নেয়ামত। সবাই ঠাট্টা করে কেয়ামত ডাকতে ডাকতে এখন নাম হয়ে গেছে কেয়ামত। এখন কেউ যদি . জিজ্ঞেস করে আপনার নাম কী, তিনি স্বাভাবিক গলায় বলেন— আমার নাম কেয়ামত, কেয়ামত মিয়া।
কেয়ামত মিয়া রান্না খুব ভাল করেন। অতি সামান্য জিনিস এত যত্ন করে রাঁধেন যে শুধু খেতেই ইচ্ছে করে। প্রতিদিনই একটা না একটা অদ্ভুত আইটেম থাকবে। আজ দুপুরে ছিল সজনে পাতা ভাজি। সজনে গাছের কচি পাতা প্রচুর পেয়াজ দিয়ে সামান্য টক দিয়ে এমন একটা বস্তু বানালেন যে সবাই একবার করে ফেলল—কেয়ামত মিয়া এই ভাজিটা রোজ করবে।
আমি নিজে ডাইরিতে লিখলাম, আজ আমরা নতুন একটা খাবার খেলাম সজনে পাতা ভাজি। খাবারটা এত ভাল হয়েছে যে আমার ধারণা এখন থেকে আমরা রোজই এই খাবার খাব। এবং যখন আমাদের শুটিং শেষ হবে তখন দেখা যাবে দুর্গাপুরের সব সজনে গাছ আমরা খেয়ে ফেলেছি। সজনে পাতা ভাজি রান্নার রেসিপি আমরা পেয়ে গেছি। পাপিয়া ম্যাডাম রেসিপি চেয়েছিলেন তাকে দেয়া হয়েছে, এবং ছোট ম্যাডাম হিসেবে আমাকেও দেয়া হয়েছে।
সজনে পাতা ভাজি
পেয়াজ দুই কাপ
রসুন আধা কাপ
তেতুলের রস আধা কাপ
কাচা মরিচ আধা কাপ
শুকনো মরিচ দশটা
সজনে পাতা এক গামলা
বসন্তের নতুন সজনে পাতা কুচি কুচি করে কেটে তেতুল পানিতে সারাদিন ডুবিয়ে রাখতে হবে। ভাজার আগমুহূর্তে পানি ঝরিয়ে নিতে হবে। লবণ পানিতে ধুয়ে কষ ফেলে দিতে হবে। এক কাপ পেয়াজ তেলে ভাঁজবে। পেয়াজ বাদামী বর্ণ হয়ে যাবার পর সজনে পাতা, এককাপ পেয়াজ কুচি এবং আধ কাপ রসুন কুচির তেলে ফেলে দিয়ে অল্প আঁচে ভাঁজতে হবে। সজনে পাতা তেল টেনে নেবার পর আরো আধ কাপ পানি দিয়ে দমে বসিয়ে দিতে হবে। পরিবেশনের আগে মুচমুচে করে ভাজা শুকনো মরিচ খাবারের উপর দিয়ে দিতে হবে। গরম ভাতের সঙ্গে সজনে পাতা ভাজি অতি উপাদেয়।
মজার ব্যাপার হচ্ছে এই রেসিপিটা মিথ্যা রেসিপি। সোহরাব চাচা বিকেলে আমাকে এসে বললেন মিস রুমাল আমাকে একটু সাহায্য করতো একটা কাগজে সজনে পাতা ভাজির রেসিপি লিখে দাও। পাপিয়া ম্যাডাম বড় যন্ত্রণায় ফেললেন— কিছু একটা রান্না হলেই রেসিপি।
আমি বললাম, কীভাবে রান্না হয় আপনি বলুন, আমি লিখে দিচ্ছি।
বানিয়ে বানিয়ে একটা কিছু লিখে দাওতো। তোমার কি ধারণা রেসিপি দেখে উনি জীবনে কখনো রান্না করবেন?
রান্না না করলে চাচ্ছেন কেন?
কেন চাচ্ছেন তা একমাত্র আল্লাহ পাকই জানেন। মা লক্ষী তুমি সুন্দর করে একটা রেসিপি লিখে দাও।
যা ইচ্ছা লিখে ফেলব?
লিখে ফেল।
আমি রান্নার বইয়ের মত করে রেসিপি লিখে ফেললাম। যখন লিখছি তখন ঘাড়ের উপর মা ঝুঁকে এসে উদ্বিগ্ন গলায় বললেন— বকু কী লিখছিস। ডাইরি? আমাকে কোন কিছু লিখতে দেখলেই মা উদ্বিগ্নবোধ করেন। ভাবেন নিষিদ্ধ কিছু বোধ হয় লিখছি।
আমি দুহাতে লেখাটা ঢেকে বললাম, আমার যা মনে আসছে লিখছি তুমি পড়বে না।
উপুর হয়ে লেখালেখি করবি নাতো ফিগার খারাপ হয়ে যায়।
প্লীজ তুমি যাওতো মা।
মা মুখ কালো করে চলে গেলেন। তবে তার মন পড়ে রইল ডাইরিতে। না জানি তার কন্যা কী গোপন কথা লিখে ফেলেছে। এই গোপন কথা জানার জন্যে মা কোন না কোন সময়ে তাঁর কন্যার ডাইরি পড়বেন। আমার ধারণা আজ রাতেই এই কাজটা করবেন। আমি ঘুমিয়ে পড়ার পর চাবি দিয়ে আমার স্যুটকেস খুলে অতি দ্রুত পড়ে ফেলবেন। উত্তেজনায় এই সময় তাঁর নাক ঘামতে থাকবে। কান্ডটা করে তিনি যেন একটা শক পান সেই ব্যবস্থা আমি করে রেখেছি। দলকলস গাছ প্রসঙ্গে লিখতে লিখতে এক ফাঁকে কিছু নিষিদ্ধ গোপন কথা জুড়ে দিয়েছি। তার একটা লাইন খুব ভাল করে কাটা যাতে মা কিছুতেই সেই লাইনের পাঠোদ্ধার করতে না পারেন। মা জানবেন না কী লেখা হয়েছিল, ছটফট করতে থাকবেন। আমি লিখেছি–
দলকলস মধু
আজ ভোমরার মত ফুল থেকে মধু খেয়েছি। দুপুরের দিকে একা একা হাঁটছিলাম তখন সেলিম ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হল। খুব চমৎকার একজন মানুষ। হ্যান্ডসাম, বুদ্ধিমান। আমরা দুজন অনেক গল্প করলাম। উনিই গল্প করলেন, আমি শুধু শুনে গেলাম। উনি আবার গাছপালা খুব ভাল চেনেন। আমাকে স্বর্ণলতা চিনিয়ে দিলেন— তারপর চিনিয়ে দিলেন দলকলস গাছ। এই গাছ থেকে কীভাবে মধু পান করতে হয় তাও শেখালেন। তারপর নিজেই একগাদা ফুল এনে দিলেন। আমি ফুল থেকে মধু খাচ্ছি উনি হঠাৎ বললেন— এই রুমালী তোমাকে ঠিক ভোমরার মত লাগছে। ভোমরা যেমন ফুলের মধু খায় তুমিও খাচ্ছ—তাই। উনি আমাকে রুমালী ডাকেন। তবে সবার সামনে না, আড়ালে। সবার সামনে আমাকে বকুল বলেন এবং আপনি করে ডাকেন। আমি তাঁকে বলেছি–সবার সামনে আমাকে আপনি বলার দরকার কী? আমিতো সিনিয়ার কোন ম্যাডাম না, আমার বয়স মাত্র সতেরো। উনি বললেন, আঠারো হোক তখন সবার সামনে তুমি বলব। কে জানে এই কথাটার মানে কী? আমি বড়দের সব কথা বুঝতে পারি না। দেখি একবার কায়দা করে মাকে জিজ্ঞেস করব। মাকে সরাসরি কিছু জিজ্ঞেস করা যাবে না। তিনি অনেক কিছু সন্দেহ করবেন।
এইটুক লিখে আরো দুটা লাইন লিখে খুব ভালমত কালি দিয়ে কেটে দিয়েছি। পরিষ্কার বুঝতে পারছি পড়ার পর মার ঘাম দিয়ে জ্বর এসে যাবে। বুক ধড়ফড় করতে থাকবে। এমনও হতে পারে তাঁর জিবের নীচে এনজিস্টও দিতে হতে পারে। আমি চাচ্ছি আজ রাতেই মা ডাইরিটা পড়ুক। কাজেই আমি আজ যা করব তা হচ্ছে ডাইরিটা স্যুটকেসে ঢুকিয়ে তালাবন্ধ করে রাখতে ভুলে যাব।
মা এখন কফি খাচ্ছেন এবং আড়ে আড়ে আমাকে দেখছেন। কফি নিশ্চয়ই পাপিয়া ম্যাডামের জন্যে বানানো হয়েছিল। রাতের খাবারের দেরি হবে সে জন্যেই কফি। খবর পেয়ে মা নিজের কন্যার জন্যে নিয়ে এসেছেন। আমি যেহেতু কফি খাই না—তিনি নিজেই চুকচুক করে খাচ্ছেন। ইউনিটে কোন একটা খাবার রান্না হলে–মা তা খাবেন না— তা কখনো হবে না। মা কফি খেতে খেতে জালালের মার সঙ্গে নিচু গলায় কথা বলছেন।
জালালের মা একজন এক্সট্রা। তিনি আমাদের ছবিতে কাজের বুয়ার চরিত্রে অভিনয় করবেন। রিটায়ার্ড পুলিশের বড় কর্তার বাসায় এই বুয়া ছোটবেলা থেকে আছে। ছুটি কাটাতে সবাই যখন এসেছে বুয়াকেও সঙ্গে নিয়ে এসেছে।
জালালের মা রাতে আমাদের ঘরে থাকেন। আমরা সবাই থাকি দুর্গাপুর পি, ডাবলিউ, ডি, রেস্ট হাউসে। আমাদের ঘরে দুটা খাট। একটা খাটে আমি আর মা—আরেকটা খাটে জালালের মা। রাত্রে আমি ঘুমিয়ে পড়ি, মা এবং জালালের মা সহজে ঘুমান না, তাদের গল্প চলতেই থাকে। ফিসফিস গুজগুজ! জালালের মা ছবির জগতের সব স্ক্যান্ডালের গল্প জানেন। বলার সময় এমন ভাবে বলেন যেন ঘটনাটা তার নিজের চোখের সামনে ঘটেছে। মা প্রতিটি গল্প খুব আগ্রহের সঙ্গে শোনেন এবং প্রতিটি গল্পই বিশ্বাস করেন। অবিশ্বাস্য গল্পগুলিই বেশি বিশ্বাস করেন।
এখন যে গল্প হচ্ছে আমি তা শুনতে পাচ্ছি। যদিও গল্প ফিসফিস করে বলা হচ্ছে–আমার কান খুব পরিষ্কার। মশাৱা যদি কথা বলতে পারত তাহলে মশাদের গুনগুন কথাও শুনতে পেতাম।
বুঝছেন আপা টেকনাফে আউটডোর পড়ছে। চিত্রা প্রডাকশানের ছবি ডাকু সর্দার। নায়িকা হলেন মহুয়া ম্যাডাম। ম্যাডামের প্রথম ছবি। প্রথম ছবি যখন করে তখন ম্যাডামদের মাথার ঠিক থাকে না। কী করে না করে নিজেও বুঝে না। মাথার মধ্যে থাকে ছবির জগতে যখন আছি তখন উল্টা পাল্টা কাজ করাই লাগবে। বুঝছেন আপা মনে হলে এখনো গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়–ছিঃ ছিঃ ছিঃ।
জালালের মা গলা আরো নিচু করে ফেলল। আমি দেখি মায়ের মুখ হা হয়ে গেছে চোখ বড় বড়। যেন এমন আনন্দময় গল্প তিনি কখনো শোনেন নি। তাঁর কর্ণ আজ স্বার্থক।
সন্ধ্যাবেলা ম্যাডাম চা খেতে গিয়েছেন, ব্লাউজের দুটা হুক খোলা, ইচ্ছা করে খোলা। ব্লাউজের নীচে ইয়েও নেই। গরম বেশি বলে পরেন নি। কারণ ছাড়াই ম্যাডামের হাহা হিহি হাসি। একেকবার হাসেন আর কাঁধ থেকে শাড়ির আঁচল পড়ে যায়।
গল্পে বাধা পড়ল। সোহরাব চাচা এসে বললেন, মিস রুমাল–যাও স্যার ডাকছেন।
আমি উঠে দাঁড়াবার আগেই মা লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।
সোহরাব চাচা বললেন, ভাবী আপনার যাবার দরকার নেই। স্যার কালকের শুটিং কী হবে বুঝিয়ে দেবেন।
মা বললেন, সর্বনাশ, আমাকে থাকতেই হবে। বকু কিছু মনে রাখতে পারে না। আমাকেই সব মনে রাখতে হবে।
আসুন তা হলে। দেরি করবেন না।
মা বললেন, দেরি হবে না। এখনই আসছি।
সোহরাব চাচা ঘর থেকে বের হতেই মা বললেন, বকু চুল আচড়ে চট করে কপালে একটা টিপ দিয়ে নে।
আমি বললাম, আমিতো শুটিং এ যাচ্ছি না মা। স্ক্রীপ্ট বুঝতে যাচ্ছি।
ফকিরনীর মত যাবি? উনি কী ভাববেন?
সেজেগুজে গেলেই তো অনেক কিছু ভাবার কথা।
তার মানে?
উনি ভাবতে পারেন আমি তার সঙ্গে প্রেম করতে চাচ্ছি। তাঁকে ভুলাতে চাচ্ছি।
মা হতভম্ব হয়ে গেলেন। চোখ মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। জালালের মা যেখানে বসেছিলেন সেদিকে তাকালেন। কিছুটা স্বস্তি পেলেন। জালালের মা নেই। সোহরাব চাচাকে ঢুকতে দেখেই তিনি চলে গেছেন। এই মহিলা সোহরাব চাচাকে যমের মত ভয় করেন। মা বললেন, এ রকম কথা তুই কীভাবে বললি?
আমি বললাম, ভুলতো মা বলি নি। মেয়েদের সঙ্গে প্রেম করার দিকে তোমার মঈন ভাইয়ের ঝোঁক আছে। দেখ না এখন পাপিয়া ম্যাডামের সঙ্গে প্রেম করছেন।
তুই এমন কুৎসিত কথা বলছিস কীভাবে!
প্রেম কুৎসিত হবে কেন মা?
আর একটা কথা বলবি তো টেনে জিভ ছিড়ে ফেলব। বাঁদরামী যথেষ্ট করেছিস।
আমি কথা বাড়ালাম না। চুল আঁচড়ালাম, কপালে টিপ দিলাম। মা অতি দ্রুত তার শাড়ি পাল্টালেন। মুখে পাউডার দিলেন। ঠোঁটে লিপস্টিক দিলেন।
এই বকু আমাকে কেমন দেখাচ্ছে?
আমি উৎসাহের সঙ্গে বললাম, খুব ভাল দেখাচ্ছে। উনি যদি তোমার প্রেমে পড়ে যান আমি মোটেও অবাক হব না। তোমাকে রাণীর প্রিয় সখীর মত দেখাচ্ছে।
মা আচমকা আমার গালে চড় বসালেন। তারপর বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে আমাকে নিয়ে রওনা হলেন যেন কিছুই হয় নি।
ডিরেক্টর সাহেব তার ঘরে একা বসে আছেন। পায়জামা পাঞ্জাবি পরেছেন বলে তাকে প্রফেসর প্রফেসর লাগছে। তাঁর চুল সুন্দর করে আঁচড়ানো মনে হয় কিছুক্ষণ আগে গোসল করে চুল টুল আঁচড়ে ভদ্র হয়েছেন। গা থেকে হালকা মিষ্টি গন্ধও আসছে। আফটার শেভ এর গন্ধ হতে পারে। মুখে মাখা ক্রীমের গন্ধ হতে পারে। আবার সাবান দিয়ে গোসল করা হলে সাবানের গন্ধ ও হতে পারে। আমার নাক কুকুরের নাকের মত–খুব তীক্ষ।
আজ তাঁকে অল্প বয়স্ক মনে হচ্ছে কারণ চুলে কলপও দিয়েছেন। চুলে কলপ দেয়া স্টেজে যারা চলে যান তাদের দেখতে খুব মজা লাগে। বুড়োটে ধরনের মানুষ হঠাৎ একদিন দেখা যায় কুচকুচে কালো চুলের একজন মানুষ। হাব ভাব যুবকের মত। এরা আবার রঙ চঙে সার্ট পরতেও ভালবাসে। চুলে যেমন কলপ লাগায়— মনেও খানিকটা লাগায়।
বকুল এবং বকুল মাতা গেট সীটেড। বসে পড়ুন।
আমরা সামনের খাটে বসলাম। মা বললেন, ভাই সাহেব কেমন আছেন? ইস্ আপনার উপর খুব কাজের চাপ যাচ্ছে। আপনাকে দেখি আর অবাক হই। একটা মানুষ এত কাজ কীভাবে করে। আমি বকুলকে বলছিলাম–তোর চাচাকে দেখে শেখ, কর্মযোগী কাকে বলে। সকাল বিকাল দুবেলা উনার পায়ের ধুলা নিয়ে কপালে ঘষবি এতে যদি কপালের উনিশ বিশ হয়। যে কপাল নিয়ে জন্মেছিস সে কপালে কিছু হবে না। তোর বাবা থেকেও নেই। এখন ওর মুরুব্বী বলতেও আপনি, বাবা বলতেও আপনি।
ডিরেক্টর সাহেব শান্ত ভঙ্গিতে শুনে যাচ্ছেন। উনি রাগ করছেন কি-না বুঝতে পারছি না। মনে হয় রাগ করছেন না। মার স্বভাব তিনি জেনে গেছেন। এই স্বভাবের মানুষের উপর রাগ করা যায় না। আমি ডিরেক্টর সাহেব হলে রাগ করতাম না। বরং মনে মনে হাসতাম।
মা কথা বলেই যাচ্ছেন। থামছেন না। মা চুপ করতো–বলে মাকে আমি থামাতে পারি। ইচ্ছে করছে না। যার থামাবার সে থামাবে— আমার কী?
মঈন ভাই আমার মেয়ের গলায় একটা গান কিন্তু আপনার ছবিতে রাখতে হবে। আপনার কাছে আমার রিকোয়েস্ট। দুই লাইনের একটা গান হলেও তার গলায় রাখবেন। সবচে ভাল হয় নিজের গান সে যদি নিজে গায়। আপনি ওর গান শুনে দেখুন। যদি পছন্দ না হয় তখন প্লে ব্যাক সিঙ্গার নেবেন। ভাই আমার মেয়ের একটা গান আপনি শুনে দেখুন। পথহারা পাখি গানটা সে কী সুন্দর যে গায়। বকু, চাচাকে গানটা গেয়ে শোনা।
ডিরেক্টর সাহেব হাসলেন। আমি ভদ্রলোকের ধৈর্য দেখে অবাক হলাম। ভদ্রলোকের হাসি দেখে মনে হতে পারে উনি এখনই বলবেন— বকুল শোনাও তোমার পথ হারা পাখি গান। আমি জানি তিনি তা করবেন না। আমার গানের প্রতি তার আগ্রহ নেই। আমার গান এই ছবির জন্যে প্রয়োজন নেই। চিত্রনাট্যে কোথাও নেই দিলু গান করছে।
মঈন ভাই— পান খাবেন?
জ্বি না, পান খাব না। আপনার কন্যার গানও আজ শুনব না। অন্য একসময় শুনব।
কতক্ষণ আর লাগবে। ছোট গান, একটা মাত্র অন্তরা।
গান হচ্ছে মুডের ব্যাপার। আজ মুড নেই। কাল সকাল থেকে শুটিং হবে–আমি আপনার মেয়ের সঙ্গে সেই বিষয়ে কিছু কথা বলি।
মা হতাশ গলায় বললেন, জি আচ্ছা বলুন। কিন্তু মঈন ভাই ওর গান কিন্তু আপনাকে শুনতে হবে। মশলা খাবেন? পানের মশলা?
না মশলাও খাব না। আপনি এক কাজ করুন–নিজের ঘরে গিয়ে বিশ্রাম করুন, কিংবা রান্না বান্না কেমন এগুচ্ছে একটু দেখুন। আমি একা আপনার কন্যার সঙ্গে কথা বলব।
মার মুখ শুকিয়ে গেল। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি অতি দ্রুত কিছু যুক্তি দাঁড়া করাবার চেষ্টা করছেন যে যুক্তিতে মেয়ের সঙ্গে থাকতে পারেন কোন যুক্তি তার মাথায় আসছে না। মা নিষ্প্রাণ গলায় বললেন, আচ্ছা। মা বের হয়ে যাচ্ছেন–তাঁর হতাশ ভঙ্গিতে চলে যেতে দেখে আমার খারাপ লাগছে। ডিরেক্টর সাহেব নিশ্চয়ই এমন কোন কথা বলবেন না যা আমার মায়ের সামনে বলা যায় না। তিনি থাকলে কোন ক্ষতি ছিল না। মা বেশি কথা বলেন তা ঠিক— মাকে চুপ করে থাকতে বললেই তিনি চুপ করে যেতেন।
বকুল।
জ্বি।
কেমন আছ তুমি বল।
ভাল আছি।
গ্রাম কেমন লাগছে?
ভাল লাগছে।
চিত্রনাট্যটা কি মন দিয়ে পড়েছ?
জি।
চিত্রনাট্য তোমার কাছে কেমন লেগেছে?
ভাল।
এই ছবি কি বাংলাদেশের মানুষ দেখবে?
না।
না কেন? ছবিতে নাচ-গান নেই এই জন্যে?
ছবির গল্পটা খুব জটিল।
ছবির গল্প তোমার কাছে জটিল মনে হয়েছে?
জ্বি।
তোমার নিজের চরিত্রটা কি তোমার পছন্দ হয়েছে?
জ্বি।
দিলুকে তোমার পছন্দ হয়েছে?
জি হয়েছে।
তুমি কি দিলুর মত?
না আমি দিলুর মত না।
এখন তুমি বল— দিলু কেমন?
দিলু খুব নিঃসঙ্গ একটা মেয়ে। একা একা থাকে। তার কিছুই ভাল লাগে–খুব দুঃখী মেয়ে।
না ঠিক হল না। আর দশটা পনেরো-ষোল বছরের মেয়ে যেমন দিলুও তেমন। দিলু আলাদা কেউ না। দিলুর শেষ পরিণতিটা খুব দুঃখময় বলে তুমি তাকে দুঃখী মেয়ে ভাবছ! সে সবার সঙ্গে হাসছে, খেলছে, গল্প করছে–ছুটি কাটাতে এসে মজা করছে। তারপর এক সময় তার জীবনে ভয়াবহ একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। এমন একজনের প্রেমে পড়ে গেল যে বয়সে তারচে অনেক অনেক বড়। যাকে তার প্রেমের কথাটা সে বলতেও পারছে না। এইটাই তার সমস্যা। এর বাইরে তার কোন সমস্যা নেই। ঠিক বলছি?
জি।
দিলু মেয়েটার যে সহজ স্বাভাবিক জগৎ ছিল, প্রেমে পড়ার পর তার সেই জগৎ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। সে পুরোপুরি হকচকিয়ে গেল। তাই না?
জ্বি।
বকুল তুমি কি কখনো প্রেমে পড়েছ?
জ্বি না।
প্রেমে পড়লে আমাদের জন্যে সুবিধা হত। তোমার জন্যেও অভিনয় করতে সুবিধা হত।
ডিরেক্টর সাহেব মিটিমিটি হাসছেন। কেন হাসছেন আমি বুঝতে পারছি না। তিনি সিগারেট ধরালেন। কয়েকটা টান দিয়ে সিগারেট ছুঁড়ে ফেলবেন, আমি তার জন্যে অপেক্ষা করছি। তিনি সিগারেট ফেললেন না। সহজ ভঙ্গিতে টেনে যেতে লাগলেন। সম্ভবত আজ তিনি আর সিগারেট ফেলবেন না। মনে হচ্ছে পারিপার্শ্বিক অবস্থার উপর তার কর্মকান্ড নির্ভর করে। তাকে এখন কেউ দেখছে না— তাকে ঘিরে ভিড় জমে নেই কাজেই তিনি সিগারেট ফেলছেন না।
বকুল।
জ্বি স্যার।
মেয়েটা এমন বয়স্ক একজন মানুষের প্রেমে কেন পড়ল?
জানি না। চিত্রনাট্যে সেটা উল্লেখ করা হয় নি।
তোমার কী ধারণা সেটা বল?
আমার কোন ধারণা নেই।
বয়োসন্ধির পর মেয়েরা হঠাৎ খানিকটা অসহায় বোধ করতে থাকে। তাদের মধ্যে লতা ধর্ম প্রবল হয়ে ওঠে ….
লতা ধর্মটা কী?
লতা ধর্ম হচ্ছে–লতানো গাছের ধর্ম। লতানো গাছ কী করে? আশে পাশে শক্ত কোন গাছের খোজ করে। পনেরো-ষোল বছরের মেয়েদের মধ্যে লতা ধর্ম যখন প্রবল হয়ে দেখা দেয়, প্রেমটা তখনি আসে। কার প্রেমে পড়ল, তখন সে আর ভেবে দেখে না।
আমি হেসে ফেলে সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর হয়ে গেলাম। প্রেম সম্পর্কে এমন সহজ ব্যাখ্যা এর আগে কেউ বোধ হয় দেয় নি।
হাসছ কেন?
এম্নি হাসছি।
আমার ব্যাখ্যা খুব বেশি সরল বলে হাসছ? যে ব্যাপারটা বাইরে থেকে যত জটিল মনে হয় তার ব্যাখ্যা কিন্তু তত সহজ! পনেরো ষোল বছরের মেয়েরা কাদের প্রেমে পড়ছে সেই স্ট্যাটিসটিকস যদি নাও তাহলে অনেক মজার ব্যাপার দেখবে। এই সময়ে তারা যাদের সংস্পর্শে আসছে তাদেরই প্রেমে পড়ে যাচ্ছে। প্রাইভেট মাস্টারের সঙ্গে প্রেম হচ্ছে কারণ সে তাকে পড়াতে আসছে। গানের মাস্টারের সঙ্গে প্রেম হচ্ছে, তার সঙ্গে তার যোগাযোগ হচ্ছে। বড় ভাইয়ের বন্ধুর সঙ্গে প্রেম হচ্ছে। এমন কি বাবার বন্ধুর সঙ্গেও প্রেম হচ্ছে। কারণ বাবার বন্ধু মাঝে মাঝে বাসায় আসেন। তার সঙ্গে কথা হয়। সেই সময়কার প্রেমটা অন্য রকম। হিসাব নিকাশের বাইরের প্রেম।
আমি কিছু বলব না, বলব না করেও বলে ফেললাম— হিসাব নিকাশের বাইরের প্রেম মানে কী?
প্রেমের পরিণতি কী হবে তা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করা মানেই হিসাব নিকাশ। পরিণতি নিয়ে চিন্তা ভাবনা ছাড়া প্রেম মানে হিসাব নিকাশহীন প্রেম। বুঝতে পারছ?
না।
না বোঝার মত কিছু না। আমাদের ছবির মেয়ে দিলুর প্রেম হিসাব নিকাশ হীন প্রেম। প্রেমের পরিণতি নিয়ে সে কখনো ভাবে নি। সে অন্ধের মত প্রেমে পড়েছে।
পরিণতি নিয়ে না ভাবলে সে আত্মহত্যা করে কেন?
আত্মহত্যাটাও তার প্রেমেরই একটা অংশ। সে তার আবেগের তীব্রতাটা সবাইকে দেখাতে গিয়ে এই কান্ডটা করেছে। এই বয়সের প্রেমে একটা দেখানোর ব্যাপারও থাকে। দেখ আমি কী করে ফেললাম এই ভাব।
আমি বললাম, স্যার আমার সে রকম মনে হচ্ছে না।
তিনি গম্ভীর হয়ে বললেন, তোমার কী মনে হচ্ছে?
আমার মনে হয় মেয়েটা হঠাৎ তার নিজের ভেতরের প্রেম ভাল মত লক্ষ্য করে। তার তীব্রতা দেখে সে হকচকিয়ে যায়। সে সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে।
তিনি একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে একটু হাসলেন। প্রশ্রয়ের হাসি। ছোট বাচ্চারা হঠাৎ জ্ঞানীর মত কথা বলে উঠলে বড়রা যেমন হাসে তেমন হাসি। তবে আমার কথার তেমন গুরুত্ব দিলেন না।
বকুল!
জ্বি স্যার।
চিত্রনাট্যর কোন অংশটা তোমার কাছে খুব সুন্দর মনে হয়েছে?
দিলু যে মাঝে মাঝে খুব সুন্দর করে সাজে তারপর পুকুরের কাছে যায়। পুকুরের জলে নিজেকে দেখে এবং নিজের সঙ্গে কথা বলে এই দৃশ্যটা।
সেই দৃশ্যটা আমরা কাল করব। এই দৃশ্য দিয়ে শুরু। তুমি দৃশ্যগুলি আজ রাতে খুব ভাল মত পড়বে। শোবার আগে ভাববে। আমি দৃশ্যগুলি কী ভাবে নেব ভেবে রেখেছি–তোমার মাথায় যদি কিছু থাকে তাও আমাকে বলবে।
জি আচ্ছা।
এই ছবির আসল নায়িকা কে তুমি কি জান?
জানি, দিলু।
হ্যাঁ এই কিশোরী মেয়েটিই ছবির নায়িকা। পাপিয়া ব্যাপারটা জানে না। তার ধারণা সেই ছবির নায়িকা। তাকে সে রকম বলাও হয়েছে। চিত্রনাট্য সে পড়ে নি। তাকে চিত্রনাট্য পড়তেও দেই নি। চিত্রনাট্য পড়লে সে খুব হৈ চৈ করত। আচ্ছা তুমি যাও —
তিনি যা বললেন কিন্তু আমি আগের জায়গাতেই বসে রইলাম। আমার কেন জানি উঠতে ইচ্ছা করছে না। তিনি বললেন–কিছু বলবে?
জ্বি না।
তিনি আরেকটা সিগারেট ধরালেন। তাঁকে হঠাৎ খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে তিনি অন্য কিছু ভাবছেন। আমি যে তাঁর সামনে বসে আছি তা আর
তার মনে নেই। ঘরে মসকুইটো কয়েল জ্বলছে। ধোয়ায় নাক জ্বালা করছে।
বকুল! জ্বি। আচ্ছা দেখি তোমার বুদ্ধি।
তিনি নড়েচড়ে বসলেন এবং হাসি মুখে তাকালেন। তাঁর চোখে চাপা আনন্দ। ম্যাজিশিয়ান মজাদার কিছু করার আগে মনে হয় এই ভাবেই দর্শকদের দিকে তাকায়।
গল্পটা মন দিয়ে শোন—একটা হাতি এবং একটা পিঁপড়ার গল্প। একটা পিঁপড়া মোটর সাইকেলে করে যাচ্ছিল। একটা হাতি আসছিল উল্টা দিক থেকে। পিঁপড়া ব্যালেন্স হারিয়ে মোটর সাইকেল নিয়ে হাতির গায়ে পড়ল। বিরাট এ্যাকসিডেন্ট। মজার ব্যাপার হচ্ছে একসিডেন্টে পিঁপড়ার কিছু হল না—শুধু হাতিটা আহত হল। এখন বল কেন এ্যাকসিডেন্টে পিঁপড়ার কিছু হল না?
আমি বললাম, জানি না।
খুব সহজ উত্তর। পিঁপড়াটার মাথায় হেলমেট পরা ছিল। পিঁপড়া ছোট প্রাণী হলেও, ট্রাফিক রুল মেনে চলে। হেলমেট ছাড়া মোটর সাইকেল নিয়ে বের হয় না।
আমি ভেবেছিলাম জবাবটা দিয়ে তিনি তার স্বভাব মত হো হো করে হাসবেন। তিনি হাসলেন না বরং খানিকটা গম্ভীর হয়ে গেলেন। সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন–
আহত হাতিকে নিয়ে যাওয়া হল হাসপাতালে। সেখানে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখা গেল। দেখা গেল আহত হাতি এবং পিঁপড়া পাশাপাশি বেড়ে শুয়ে আছে।
এখন তুমি বল–পিঁপড়াটারতো কিছু হয় নি। সে কেন হাতির বেডের পাশে শুয়ে আছে?
জানি না।
পিঁপড়া শুয়ে আছে কারণ পিপাড়াটা হাতিকে রক্ত দিচ্ছিল। তাদের দুজনের একই গ্রুপের রক্ত ও পজিটিভ।
তিনি এবারে গলা খুলে হাসছেন। আমি মুগ্ধ হয়ে তাঁর ছেলেমানুষি হাসি দেখছি। আমার মধ্যে একটা অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে–তার হাসি আমার শরীরের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। আমার শরীর ঝমঝম করছে। শরীরের ভেতরটা কাঁপছে। আমার ইচ্ছা করছে ছুটে চলে যাই। কিন্তু উঠতে পারছি না। এমন সময় সোহরাব চাচা ঢুকলেন। ডিরেক্টর সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন–আমি নেত্রকোনা যাচ্ছি। আপনার কিছু লাগবে?
ডিরেক্টর সাহেব বললেন, নেত্রকোনায় এক ধরনের মিষ্টি পাওয়া যায় নাম হচ্ছে বালিস। মিষ্টিটার শুধু নাম শুনেছি কখনো খেয়ে দেখি নি। যদি পাও নিয়ে এসো।
রান্নাও হয়েছে, খাবার দিতে বলি?
ডিরেক্টর সাহেব বললেন–দিতে বল। পাপিয়াকে জিজ্ঞেস কর–সে কি সবার সঙ্গে খাবে, না তার খাবার আলাদা দেয়া হবে?
ম্যাডাম বলেছেন উনি রাতে কিছু খাবেন না।
সেকী?
ম্যাডাম খেতে চেয়েছেন বলেই খাসি কিনে এনে রেজালা করা হয়েছে। পোলাও এর চালের ভাত করা হয়েছে। স্যার আপনি একটু বলে দেখবেন?
খাবে না কেন কিছু বলেছে?
উনার নাকি শরীর ভাল না। উনি দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়েছেন।
ভাল যন্ত্রণা হল দেখি।
ফরহাদ সাহেবও এখনো এসে পৌছালেন না। উনাকে ছাড়া শুটিং শুরু হবে কীভাবে? কাউকে কি পাঠিয়ে দেব? রাতে খেয়ে গাড়ি নিয়ে ঢাকা চলে যাবে— উনাকে নিয়ে চলে আসবে।
না।
ডিরেক্টর সাহেব চিন্তিত মুখে বের হয়ে গেলেন। কিছু না বললেও বোঝা যাচ্ছে তিনি পাপিয়া ম্যাডামের ঘরের দিকে যাচ্ছেন। আমার কেন জানি খুব ইচ্ছা করছে পাপিয়া ম্যাডামের রাগ কীভাবে ভাঙ্গানো হয় সেই দৃশ্য দেখি। ডিরেক্টর সাহেবের পেছনে পেছনে যাই।
সোহরাব চাচা বললেন, মিস রুমাল চল খেতে চল। আমি বললাম, চলুন।
মা নিশ্চয়ই মুখ গম্ভীর করে তাঁর ঘরে আমার জন্যে অপেক্ষা করছেন। আমি যাওয়া মাত্র ডিরেক্টর সাহেবের সঙ্গে আমার কী কী কথা হল সব শুনবেন। কোন কিছুই বাদ দেয়া যাবে না। কোন কোন জায়গা দুবার তিনবার করেও শুনাতে হবে। মার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। আমি সোহরাব চাচার সঙ্গে সরাসরি ডাইনিং রুমে চলে গেলাম।
খাওয়া শুরু হয়ে গেছে। গণ খাবারের কায়দা কানুন অন্য রকম প্লেট হাতে যেতে হয় বাবুর্চির কাছে। বাবুর্চি তার লোকজন নিয়ে বসে থাকেন। তার সামনে বিরাট বিরাট ডেকচিতে ভাত, তরকারি, ভাজি, সালাদ। বড় বড় চামুচে প্রেটের উপর খাবার তুলে দেয়া হয়। থালা উপচে আগুন গরম খাবার পড়ে যেতে থাকে। সেই খাবার গবাগব করে খাওয়া হয়। পুরো ব্যাপারটায় পিকনিক পিকনিক ভাব থাকে। আমার খুব ভাল লাগে।
ডাইনিং রুমে সবাই আছেন শুধু মা আর জালালের মা নেই। মা নিশ্চয়ই আমার জন্যে অপেক্ষা করছেন—–আর জালালের মা, মাকে এই ফাঁকে কয়েকটা ভয়ংকর টাইপ গল্প শুনিয়ে ফেলছে। আমাদের এই ডিরেক্টর সাহেবকে নিয়েও অনেক গল্প নিশ্চয়ই জালালের মা জানেন। তার কাছ থেকে কিছু গল্প শুনতে হবে। মাকে না জানিয়ে শুনতে হবে।
তরকারির রঙ খুব সুন্দর হয়েছে। আমি প্লেট হাতে খাবার নিয়ে নিলাম। ধোঁয়া ওঠা পোলাওয়ের চালের ভাত— সুন্দর গন্ধ আসছে ভাত থেকে। খাসির গোসতের রেজালা। রেজালা দেখেই বোঝা যাচ্ছে— খেতে খুব ভাল হবে। পাপিয়া ম্যাডাম যদি খেতেন, রেজালার রেসিপি চাইতেন।
কেয়ামত ভাই হাসি মুখে বললেন— আপা, মা কই?
আমি বললাম, মা আসবে। আমার খুব ক্ষিধে লেগেছে আমি আগে খেয়ে নেব!
আজ এক তরকারির খানা। সালাদ নেন।
না সালাদ নেব না।
ডাইনিং রুমে চেয়ার টেবিল আছে। চেয়ার টেবিলে সবার জায়গা হয় না। অলিখিত নিয়ম হচ্ছে শিল্পীরা চেয়ার টেবিলে বসবেন— বাকিরা প্লেট হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে খাবেন–বুফে সিস্টেম। তবে আমাদের ডিরেক্টর সাহেবের কোন ঠিক ঠিকানা নেই। এই দেখা যায় তিনি চেয়ার টেবিলে বসেছেন— আবার দেখা যায় দাঁড়িয়ে খাচ্ছেন। একবার দেখি ফকিরদের মত মাটিতে ল্যাপচা মেরে বসে খাচ্ছেন। সোহরাব চাচা কোখেকে পুরানো খবরের কাগজ এনে বললেন— স্যার এর উপর বসুন। তিনি বললেন—— লাগবে না। লাগবে না। সোনার বাংলার স্বর্ণ ধুলি গায়ে মেখে নিচ্ছি। তার এই কথায় আসে পাশের সবাই হাসল। ডিরেক্টর সাহেব যাই বলেন তাতেই মজা পেয়ে সবাই হাসে। তিনি রসিক মানুষ হিসেবে পরিচিত। আমার নিজের ধারণা তিনি পদাধিকার বলে রসিক। ডিরেক্টর না হয়ে তিনি যদি ক্যামেরা ম্যানের এসিসটেন্ট হতেন তাহলে তাঁর রসিকতায় কেউ হাসত না। বরং তার কাজ কর্মে সবাই বিরক্ত হত।
আমি প্লেট নিয়ে খাবার টেবিলের দিকে যাচ্ছি হঠাৎ দেখি ঘরের এক কোণায় সেলিম ভাই দাঁড়িয়ে। তার হাতে খাবারের প্লেট। তিনি মাথা নিচু করে খাচ্ছেন। আজ তার গায়ে পাঞ্জাবি। তিনি একটামাত্র সার্ট প্যান্ট নিয়ে এসেছিলেন আজ পাঞ্জাবি পেলেন কোথায়? আমি হাসিমুখে ডাকলাম সেলিম ভাই।
তিনি এমন ভাবে চমকে উঠলেন যে আরেকটু হলে হাত থেকে প্লেট পড়ে গিয়ে বিশ্রী কান্ড হত। নায়িকার হাত থেকে প্লেট পড়ে ভেঙ্গে যাওয়া মজার ব্যাপার। সবাই তাতে মজা পায়। প্রোডাকশন ম্যানেজার আনন্দে হেসে ফেলেন। এক্সট্রা মেয়ের হাত থেকে প্লেট পড়ে গেলে সবাই কটমট করে তাকায়। প্রোডাকশন ম্যানেজার চাপা গলায় ধমক দেন। ধমক চাপা গলায় হলেও সবার কানে যায়। আমি হাসি মুখে ডাকলাম, সেলিম ভাই এদিকে আসুন। প্লেট হাতে সেলিম ভাই বিব্রত ভঙ্গিতে আসছেন। তাঁর অস্বস্তি দেখে মনে হচ্ছে–বেচারাকে না ডাকলেই হত। নিজের মনে আরাম করে খেতে পারতেন।
বসুন। আসুন আমরা গল্প করতে করতে খাই।
সেলিম ভাই অসহায় ভাবে চারদিকে একবার দেখলেন। আমার পাশে বসে খাওয়াটা ঠিক হবে কি-না বুঝতে পারছেন না। শেষ পর্যন্ত দ্বিধা দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে বসলেন আমার পাশে। সব দ্বিধা অবশ্যি ঝেড়ে ফেলতে পারলেন না। তার চোখে খানিকটা মুখে লেগে রইল।
সেলিম ভাই কেমন আছেন?
ভাল।
কী রকম ভাল? অল্প ভাল না অনেক খানি ভাল?
অল্প ভাল।
এক বস্ত্রে এসেছিলেন–আজ দেখি গায়ে পাঞ্জাবি।
সার্ট প্যান্ট ধুয়ে দিয়েছি।
ভাল করেছেন। ডিরেক্টর সাহেব কী জানেন যে আপনি তাঁর কথামত তাঁর সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছেন?
জ্বি। আগে মনে করেছিলাম কিছু জানেন না। এখন বুঝেছি জানেন।
কথা হয়েছে তার সঙ্গে?
জ্বি।
কখন কথা হল?
আজ সন্ধ্যায়।
কী কথা হল?
প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সেলিম ভাই বিব্রত স্বরে বললেন, আমি একটা বিরাট ঝামেলায় পড়েছি।
কী ঝামেলা?
আপনাকে আমি বলব।
বলুন শুনি।
এখন বলব না। এখানে অনেক লোকজন।
কখন বলবেন?
আজই বলব। আমি মস্তবড় একটা ঝামেলায় পড়েছি। জীবনে এতবড় ঝামেলায় পড়ি নি।
খুব চিন্তিত?
জ্বি।
আচ্ছা ঠিক আছে–আপনার ঝামেলার কথা শুনব— এখন চুপচাপ খেয়ে যান। খাবারটা ভাল হয়েছে না!
জ্বি হয়েছে।
রেসিপি লাগবে? লাগলে বলুন।
আপনার কথা বুঝতে পারছি না।
আমি হেসে ফেললাম— আর তখনি মা ঢুকলেন। তিনি আমাকে খেতে দেখে হতভম্ব হয়ে গেলেন। আমার পাশে সেলিম ভাইকে দেখে তাঁর মাথায় প্রায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মত অবস্থা হল। তিনি নিশ্চয়ই এর মধ্যেই আমার ডাইরি পড়ে ফেলেছেন। দুইয়ে দুইয়ে চার বানিয়ে বসে আছেন। মা খাবার নিয়ে আমার দিকে আসছেন। আমার কাছে তিনি বসতে পারবেন না, কোন চেয়ার খালি নেই। তাকে অনেকটা দূরে বসতে হবে। তবে তিনি অন্য একটা কাজও করতে পারেন— হয়ত সেলিম ভাই এর কাছে এসে বলবেন, এই শোন তোমার নাম যেন কী? তুমি ঐ চেয়ারটায় গিয়ে বোস।
মা সামাজিক অবস্থান মাথায় রেখে তুমি আপনি বলেন। তিনি তাঁর রাডারের মত চোখ দিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝে ফেলেন মানুষটার সামাজিক অবস্থান কী। তখন তুমি আপনি নির্ধারিত হয়ে যায়। সেলিম ভাইকে তিনি শুরু থেকেই তুমি বলছেন। শুধু যে তুমি বলছেন তাই না— ছোট খাট কাজকর্মও তাকে দিয়ে করাচ্ছেন। গতকাল সকালেই তিনি সেলিম ভাইকে ডেকে বললেন— এই যে ছেলে শোন, আমার জন্যে একটা হাত পাখা নিয়ে এসো। প্রোডাকশনের কাউকে বললেই হাত পাখা দিয়ে দেবে।
মা আমার পাশে এসে দাঁড়াতেই সেলিম ভাই উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আপনি বসুন।
মা বিনাবাক্যব্যয়ে বসে পড়লেন। সেলিম ভাই প্লেট হাতে আগের জায়গায় চলে গেলেন। মনে হল তিনি হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছেন।
মা রাগে কাঁপছেন। আমি তার রাগ টের পাচ্ছি। রাগের প্রকাশ কীভাবে হবে বুঝতে পারছি না। ঘটনাটা বাসায় ঘটলে প্লেট ছুঁড়ে মারতেন আমার দিকে। আমার শরীর রেজালার ঝোলে মাখামাখি হয়ে যেত। প্লেটের কোণা লেগে কপাল কেটে রক্ত পড়ত। এখানে এ জাতীয় কিছু করা সম্ভব না। মা কাঁপা গলায় প্রায় ফিস ফিস করে বললেন—মঈন ভাইয়ের সঙ্গে কথা শেষ হয়েছে?
হ্যাঁ।
কী বললেন?
প্রেম কত প্রকার ও কী কী উদাহারণ সহ ব্যাখ্যা করলেন।
মা কঠিন চোখে তাকিয়ে আছেন। আমি সহজ ভঙ্গিতে ভাত মাখতে মাখতে বললাম––উনিতো প্রেম বিশারদ। প্রেমের সব কিছু তিনি জানেন।
ফাজলামি করছিস কেন?
ফাজলামি করছি না, যা সত্যি তাই বললাম।
আমি তোর জন্যে বসে আছি–তুই আমাকে না নিয়ে একা একা খেতে চলে এলি কী মনে করে?
ক্ষিধে লেগেছিল চলে এসেছি।
তোর হয়েছে কী?
কিছু হয় নি। এই গাধাটা তোর সঙ্গে খাচ্ছে কেন?
আমি ডেকে এনেছি বলে আমার সঙ্গে বসে খাচ্ছিলেন। কারো সঙ্গে গল্প না করে আমি খেতে পারি না।
গাধাটার সঙ্গে কী গল্প করছিলি?
বার বার উনাকে গাধা বলছ কেন?
যে গাধা আমি তাকে কী বলব? হাতি বলব?
মা তুমি খাচ্ছ না। খাবার ঠান্ডা হয়ে গেলে তুমি খেয়ে মজা পাবে না। খাসির রেজালাটা খুব ভাল হয়েছে। খাঁটি সরিষার তেলে রান্না হয়েছেতো এই জন্যে। খেয়ে তোমার যদি ভাল লাগে আমাকে বলবে আমি রেসিপি দিয়ে দেব।
মা আগুন চোখে তাকাচ্ছেন। আমি তাকিয়ে আছি হাসি মুখে। আমার খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছে। মা কিছুক্ষণ থাকুক একা একা। রেগে অস্থির হোক। রেগে অস্থির হয়ে এক সময় মা ড্রাগনের মত হয়ে যাবে তার নাক মুখ দিয়ে আগুনের হলকা বের হতে থাকবে। সেই পর্যায়ে আসুক তখন ঠান্ডা পানি ঢেলে মার রাগ কমানোর ব্যবস্থা করা যাবে।
বকুল!
হুঁ।
মঈন ভাইয়ের সঙ্গে তোর কী কী কথা হয়েছে বল। কোন কিছু বাদ দিবি না।
হাতি এবং পিঁপড়া সম্পর্কে অনেক কথা বললেন।
হাতি এবং পিঁপড়া মানে?
একটা হাতি এবং পিঁপড়া ছিল— তাদের হচ্ছে একই ব্লাড গ্রুপ, ও পজিটিভ।
তোকে এখন আমি সবার সামনে চড় মারব।
হাত ধুয়ে তারপর চড় মার মা। নয়ত গালে ঝোল লেগে যাবে।
মা তাকিয়ে আছেন। আমি উঠে দাঁড়ালাম। এবং মার চোখের সামনেই সেলিম ভাইয়ের সামনে এসে দাঁড়ালাম। মাকে দেখিয়ে দেখিয়ে সেলিম ভাইয়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করব। মাকে আমি আজ ড্রাগন বানিয়ে ফেলব।
সেলিম ভাই আমাকে দেখে বিব্রত ভঙ্গিতে তাকালেন। মা যেমন আমার কান্ডকারখানা বুঝতে পারছেন না, মনে হয় তিনিও পারছেন না।
সেলিম ভাই!
জি।
আপনি বলেছেন–আপনি ভয়ংকর বিপদে পড়েছেন। আমার ধারণা আমি বুঝতে পারছি আপনার বিপদটা কী?
বুঝতে পারছেন?
হ্যাঁ। আমার ধারণা ডিরেক্টর সাহেব আপনাকে ডেকে বলেছেন–সেলিম তুমি মন দিয়ে আমার কথা শোন, ফরহাদ সাহেবের যে চরিত্রটি করার কথা ছিল— সেই চরিত্রটা তুমি করবে। কাল তোমার শুটিং।
সেলিম ভাই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছেন। তাঁর চোখ বড় করা দেখেই বুঝতে পারছি আমার অনুমান সত্যি। তবে এই অনুমান করার জন্যে শার্লক হোমস বা মিসির আলি হবার দরকার নেই। সাধারণ বুদ্ধি যার আছে সেই এই অনুমান করবে। আগামীকাল শুটিং শুরু হচ্ছে অথচ ফরহাদ সাহেব আসেন নি। সেলিম নামের এই মানুষটিকে ঢাকা থেকে নিয়ে আসা হয়েছে। ডিরেক্টর সাহেবের মাথায় কোন একটা উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই ছিল। উদ্দেশ্য ছাড়া তিনি কিছু করেন না। সাব্বিরের চরিত্রে সেলিম ভাইকে খুব মানাবে। ডিরেক্টর সাহেব স্ট্যান্ডবাই হিসেবেই সেলিম ভাইকে নিয়ে এসেছেন।
আমি বললাম, আমার কথা কি ঠিক হয়েছে সেলিম ভাই?
হুঁ।
খুব ভয় লাগছে?
হুঁ।
ভয় লাগছে কেন?
আমি আমার জীবনে কখনো অভিনয় করি নি। স্কুলে কলেজে কোথাও না।
আপনি কখনো অভিনয় করেন নি?
জ্বি না।
কথাটাতো সেলিম ভাই ঠিক বলেন নি। মানুষ হয়ে জন্ম নিলেই অভিনয় করতে হয়। সংসারে অভিনয়। কখনো খুশি হবার অভিনয় করতে হয়, কখনো দুঃখিত হবার অভিনয় করতে হয়। প্রেমে না পড়েও প্রেমে পড়ার অভিনয় করতে হয়। আবার প্রেম লুকিয়ে রাখার অভিনয় করতে হয়। আসলে প্রতিটি মানুষই জন্মসূত্রে পাকা অভিনেতা।
আপনি খুব গুছিয়ে কথা বলেন।
শুনুন সেলিম ভাই আপনার মুখ থেকে আপনি আপনি শুনতে আমার ভাল লাগছে না। আপনি দয়া করে আমাকে তুমি তুমি করে বলবেন। পারবেন না?
সেলিম ভাই চুপ করে আছেন। আমি মাথা ঘুরিয়ে মার দিকে তাকালাম। মা কঠিন চোখে তাকিয়ে আছেন। কিছু খাচ্ছেন না। আমার মনে হয় তিনি পুরোপুরি ড্রাগন হয়ে গেছেন। মার জন্যে আমার এখন মায়া লাগছে। আমি তার রাতের খাবার নষ্ট করলাম। ইউনিটের খাওয়া মার খুব পছন্দের জিনিস। ইউনিটের ফ্রি খাওয়া যত তুচ্ছই হোক মা সোনামুখ করে খান।