অনেকদিন পর ডাইরি লিখতে বসেছি
অনেকদিন পর ডাইরি লিখতে বসেছি। দোতলার বারান্দায় বসেছিলাম। মা কিছুক্ষণ ঘ্যান ঘ্যান করলেন তাঁর সঙ্গে যাবার জন্যে। কঠিন গলায় তাকে বললাম আমি যাব না। তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, শুধু শুধু বারান্দায় বসে থেকে কী করবি? আমি বললাম, প্রকৃতির শোভা দেখব।
আমার সঙ্গে চল হাঁটতে হাঁটতে প্রকৃতির শোভা দেখবি।
তোমার পায়ে ধরছি মা, আমাকে বাদ দাও।
এরকম করছিস কেন? আমি অস্পৃশ্য?
না তুমি খুবই সস্পৃশ্য তবে এই মুহূর্তে তোমার সঙ্গে যাব না। আমার কোমরে চেইন বেঁধেও তুমি আমাকে নড়াতে পারবে না।
মা মন খারাপ করে জালালের মাকে সঙ্গে নিয়ে বের হলেন। ইউনিটের মালামাল এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নেয়ার জন্যে মাসওয়ারী টেম্পো ভাড়া করা আছে। শুটিং যেহেতু হচ্ছে না টেম্পো পড়ে আছে। যার ইচ্ছা টেম্পো নিয়ে ঘুরতে যেতে পারে।
আমি দোতালা থেকে দেখলাম, মা, জালালের মা এবং মওলানা সাহেব টেম্পো নিয়ে বের হয়েছেন। তিনজনই খুব হাসিখুশি। মওলানা সাহেবকে যত দেখছি ততই অবাক হচ্ছি। উনি কি নিজ থেকেই যাচ্ছেন না, মা তাঁকে সেধে সঙ্গে নিয়েছেন?
উঠোনে নীরা ম্যাডামের মেয়েটা একা একা খেলছে। মেয়েটা অসম্ভব রোগা। রোদে দাঁড়ালে ছায়া পড়বে না এমন অবস্থা।
আমি ডাইরি নিয়ে বসেছি এবং মাঝে মাঝে মেয়েটাকে দেখছি। মেয়েটা একবারও আমার দিকে তাকাচ্ছে না। আমি ঠিক করে রেখেছি যেই সে আমার দিকে তাকাবে–আমি ঠিকই ভেংচি কাটব। সে নিশ্চয় কেঁদে তার মাকে ডেকে এনে আমাকে দেখাবে। নীরা ম্যাডাম তখন কী করেন আমার দেখার ইচ্ছা। আমি দ্রুত লিখে যাচ্ছি।
সর্প বিষয়ক জটিলতা
সেলিম ভাই এবং মিজানুর রহমান সাহেবের যৌথ প্রযোজনায় আজ সর্প রন্ধন হয়েছে। আমার ধারণা ছিল রান্না পর্যন্তই হবে, কেউ খাবে না। আমার ধারণা ভুল প্রমাণ করে মিজান সাহেব বেশ আয়েশ করে। খাওয়া শুরু করেন। তিনি সারাক্ষণই নেশার ঘোরে থাকেন— কাজেই তাঁর সাপ খাওয়াটা তেমন বড় কিছু না। সেলিম ভাই যে খাবেন তা ভাবি নি। আমার ধারণা তিনি চক্ষুলজ্জায় পড়ে খেয়েছেন। সবাই তাদের খাওয়া দেখার জন্যে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একজন আয়েশ করে খেয়ে যাচ্ছে—এইসব দেখে তিনি এক টুকরা মুখে দিলেন। আমি বললাম, সেলিম ভাই খেতে কেমন?
তিনি বললেন, খারাপ না। টেস্ট অনেকটা বাইন মাছের মত।
কাঁটা নেই?
না, শুধু মাঝের কাঁটা।
আমি বললাম, নিজেকে জাহির করার জন্যে জোর করে খাবেন না।
শরীর খারাপ করবে।
সেলিম ভাই বললেন, জাহির করার কী আছে। ইচ্ছা করলেই সাপ ব্যাঙ সবই খাওয়া যায়। বলেই এক সঙ্গে দুটুকরা মুখে দিয়ে দিলেন। আমার বমি আসছিল বলে আমি দ্রুত চলে এলাম। নিজের ঘরে আসার কিছুক্ষণ পরেই শুনি সেলিম ভাই ক্রমাগত বমি করছেন। তাঁর বমি বন্ধ হচ্ছে না। সেলিম ভাইকে বর্তমানে মিশনারী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। স্যালাইন দেয়া হচ্ছে। তার বমি বন্ধ হয়েছে তবে এখন হিক্কা উঠছে। পেথিড্রিন ইনজেকশন দিয়ে ডাক্তাররা তাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছেন। ঘুমের মধ্যেও তার হিক্কা উঠছে।
এই পর্যন্ত লিখে আমি থামলাম। সেলিম ভাই সাপের মাংস খাবার মত একটা উদ্ভট কাণ্ড কেন করলেন সে সম্পর্কে আমার নিজের থিওরীটা লিখব কি-না ভাবছি। লিখতে ইচ্ছে করছে না। আমি প্রায় নিশ্চিত কাণ্ডটা তিনি করেছেন আমাকে অভিভূত করার জন্যে।
এন্টেনা আমার দিকে তাকাচ্ছে। আমি ভেংচি কাটলাম। মেয়েটা তাকিয়ে আছে। মার কাছে ছুটে যাচ্ছে না। কেঁদে ফেলার উপক্রমও করছে না। আমি ডাইরিতে মন দিলাম। আর কী লিখব? লেখার কিছু পাচ্ছি না। ভুল বললাম, লেখার অনেক কিছুই আছে লিখতে ইচ্ছে করছে না। নীরা ম্যাডাম প্রসঙ্গে লিখব? লেখা থাকার অনেক সুবিধা, পরে মিলিয়ে দেখা যায়। স্মৃতির লেখা ঠিক থাকে না। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে লেখাগুলিও আপনা আপনি বদলাতে থাকে।
নীরা ম্যাডাম
আমার জীবন কেটেছে কম বুদ্ধির একজন মহিলার সঙ্গে। তিনি আমার মা। সেই কারণেই মার চেয়ে সামান্য বেশি বুদ্ধির যে কোন মহিলাকে আমার অনেক বেশি বুদ্ধির মহিলা মনে হয়। আমি তাদের বুদ্ধি দেখে অভিভূত হই। আমার একটু বয়স হবার পর অভিভূত হবার প্রবণতা কমে গেল। তবে নীরা ম্যাডাম আমাকে অভিভূত করেছেন। তাঁর বুদ্ধি, তাঁর যুক্তি প্রয়োগের ক্ষমতা এবং নাটকীয় মুহূর্ত তৈরি করার দক্ষতা সবই অভিভূত করার মত। ভদ্রমহিলার নিজের ক্ষমতার উপর আস্থাও প্রবল। এই ব্যাপারটাও তুচ্ছ করার মত নয়। অসম্ভব বুদ্ধিমতীদের নিজেদের উপর আস্থা থাকে না— কারণ তারা জানে মানুষ খুব বিচিত্র প্রাণী সে সব সময় হিসেব মেনে চলে না। যে কোন মুহূর্তে অতি বড় মহাপুরুষও অতি নোংরা পাপ করতে পারেন এবং অতি বড় পাপীও অসাধারণ কোন মহৎ কর্ম করে ফেলতে পারে। শুধুমাত্র বুদ্ধি দিয়ে সব নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।
সেই কারণেই নিজের উপর অতিরিক্ত আস্থাও বোধ হয় এক ধরনের বোকামী। যাই হোক মূল অংশে চলে আসি।
আজ খুব সকালে ঘুম ভেঙ্গেছিল। আমি উঠোনে হাঁটছি। নীরা ম্যাডাম বের হয়ে এলেন। সহজ সরল গলায় বললেন–এসো চা খেয়ে যাও।
আমি বিস্মিত হলাম। গতকাল যে সব কথাবার্তা তিনি বলেছেন তারপর এইভাবে নিজের ঘরে চা খেতে ডাকতে কিছুটা সংকোচ হবার কথা। আমি বললাম, চা খাব না আমি খালি পেটে চা খেতে পারি না।
খালি পেটে খাবে কেন? বিসকিট খেয়ে তারপর চা খাবে। এসো। তোমাদের ডিরেক্টর সাহেব জ্বরে কাতর। তাকে একবার দেখবে না? সবাই কয়েকবার করে দেখে যাচ্ছে, শুধু তুমি বাদ। চলে এসো।
আমি তার পিছু পিছু গেলাম। ডিরেক্টর সাহেব বিছানায় চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন। তাঁর পায়ের কাছে মেয়েটা কুণ্ডুলী পাকিয়ে ঘুমুচ্ছে। নীরা বললেন, এই যে মহান পরিচালক রুমালী তোমাকে দেখতে এসেছে। মুখের উপর থেকে চাদরটা সরাও। ও তোমার কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখবে।
ডিরেক্টর সাহেব মুখের উপর থেকে চাদর সরিয়ে আমার দিকে তাকালেন। আমার ইচ্ছে করল তার বিছানায় বসি এবং সত্যি সত্যি কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখি। নীরা ম্যাডাম সামান্য বাড়াবাড়ি করছেন। এই বাড়াবাড়ির প্রয়োজন ছিল না।
টেবিলে চায়ের পট। চায়ের কাপ। নীরা ম্যাডাম কাপে চা ঢালছেন। আমি তাঁর পাশে বসলাম। নীরা বললেন, মহান পরিচালক সাহেব— তোমাদের এই কিশোরী নায়িকা খুব ভাল গান করে। তোমাকে এখন পর্যন্ত শুনাতে পারে নি কারণ তুমি শুনতে চাও নি। জ্বরের মধ্যে গান শুনতে ভাল লাগবে না। যখন জ্বর ছাড়বে তখন মনে করে রুমালীকে ডেকে তার গান শুনবে।
ডিরেক্টর সাহেব বিছানায় উঠে বসলেন–ক্লান্ত গলায় বললেন, এক কাপ চা দাও।
নীরা ম্যাডাম কাপে চা ঢেলে আমার দিকে ঠেলে দিয়ে বললেন, চা-টা দিয়ে এসো। বলেই অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসলেন। আমি সেই হাসি দেখেও দেখলাম না। সবকিছু দেখতে নেই। নীরা বললেন, ডিরেক্টর সাহেব আপনি এমন চুপ মেরে গেলেন কেন? বেচারী রোগী দেখতে এসেছে। তার সঙ্গে একটু গল্প গুজব করেন।
ডিরেক্টর সাহেব বললেন, নীরা একটা সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে। সিগারেট কি খাব?
খেতে ইচ্ছে করলে অবশ্যই খাবে। তোমার কোন ইচ্ছাতে আমি না বলি নি। তুমি যখন আত্মহত্যা করতে চেয়েছ তখন বলেছি— কর! করলে তোমার মঙ্গল হবে। বলি নি?
উনি সিগারেট ধরালেন। শান্ত ভঙ্গিতে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন। আমার উনার জন্যে অসম্ভব মায়া লাগছে। নীরা ম্যাডাম বললেন, বেচারী রোগী দেখতে এসেছে, তার সঙ্গে একটু গল্প টল্প কর। মুখ ভোতা করে চা খাচ্ছ কেন?
কী গল্প করব?
নতুন একটা ছবির আইডিয়া যে মাথায় এসেছে সেই গল্প কর। রুমালী অভিনয় জগতের মানুষ। তার ভাল লাগবে।
আমি অবাক হয়ে দেখলাম উনি সত্যি সত্যি গল্প শুরু করেছেন। এ রকম পরিস্থিতিতে একজন যে সত্যি গল্প শুরু করতে পারে আমার ধারণা ছিল না। মনে হচ্ছে ক্যাসেট প্লেয়ারে গল্প ক্যাসেট করা। নীরা ম্যাডাম বোতাম টিপে দিলেন, সঙ্গে সঙ্গে গল্প শুরু হল–।
উনি গল্প করছেন আমার দিকে তাকিয়ে। আমাকেই গল্পটা শুনাচ্ছেন। নীরা ম্যাডামের দিকে তাকাচ্ছেনও না। এই ব্যাপারটাও বিস্ময়কর।
রুমালী সিনেমার এই আইডিয়াটা আমি অসুস্থ হবার পর পেয়েছি। বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে মনে হল–এমন একটা গল্প দাঁড় করালে কেমন হয়। পক্ষাঘাত গ্রস্থ একজন মানুষ সে শুধু যে নড়াচড়া করতে পারে না তাই না, কথাও বলতে পারে না। শুধু তার চোখ দুটা বেঁচে আছে–আর সবই মারা গেছে। সে কামুনিকেট করে চোখের ইশারায়। একবার চোখের পাতা ফেলা মানে হা দুবার চোখের পাতা ফেলা মানে না। তার স্ত্রী আছে, একটা কাজের লোক আছে, তিন জনের সংসার। এক সকালের গল্প। স্ত্রী এসে জিজ্ঞেস করল, আজ কেমন আছ? ভাল? সে একবার চোখের পাতা ফেলল–তার মানে হ্যাঁ।
পানি খাবে?
দুবার চোখের পাতা ফেলল— না। তারপর চোখের ইশারায় টেবিলের দিকে দেখাল। টেবিলে সিগারেটের প্যাকেট।
সিগারেট খাবে? একবার চোখের পাতা–অর্থাৎ হ্যাঁ।
স্ত্রী সিগারেট ঠোঁটে দিয়ে দেয়াশলাই দিয়ে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল। কারণ বসার ঘরে এই তরুণীর অনেক দিন আগের পরিচিত একজন মানুষ এসেছেন। কিশোরী বয়সে তার সঙ্গে ভালোবাসাবাসি ছিল। যে কোন কারণেই হোক বিয়ে হয় নি। ভদ্রলোক এসেছেন মেয়েটির অসুস্থ স্বামীকে দেখতে। পুরানো দিনের কিছু কথা আপনাতে উঠে আসছে। দুজনেরই পুরানো কথা বলতে ভাল লাগছে। মেয়েটি ভুলেই গেছে যে সে তার স্বামীর ঠোঁটে সিগারেট ধরিয়ে দিয়ে এসেছে, সিগারেটটা সরিয়ে দেয়া দরকার।
সিগারেটের শেষ অংশ নিতে কেউ আসছে না। ঠোঁট থেকে গড়িয়ে সেই সিগারেট পড়ল— বিছানার চাদরে। সেই চাদরে আগুন ধরল— আগুন তার দিকে এগিয়ে আসছে। আতংক গ্রস্থ হয়ে ভদ্রলোক আগুন দেখছেন— তিনি কিছু করতে পারছেন না। কাউকে ডাকতে পারছেন না। তাকিয়ে আছেন তার নিয়তির দিকে। পাশের ঘর থেকে হালকা হাসির শব্দ ভেসে আসছে। এই হল গল্প। রুমালী তোমার কেমন লাগছে?
গল্পের শেষটা কী?
এটার কোন শেষ নেই। সব গল্পেরই যে শেষ থাকতে হবে এমন কোন কথা নেই। গল্পটা তোমার কাছে কেমন লাগল?
খুব সুন্দর।
এই গল্পটা বেশি ভাল, না যখের গল্প?
দুটা গল্পই সমান সুন্দর।
এই ছবির কাজ শেষ হলেই চিত্রনাট্য তৈরি করে ফেলব। নীরা তোমার কাছে দুটা গল্পের মধ্যে কোনটা বেশি ভাল লাগল।
নীরা বললেন— দুটাতো আসলে একই গল্প। অমোঘ নিয়তির গল্প। নিয়তির গল্প তোমার চেয়ে ভাল কে বলবে? তোমার চেয়ে ভাল কেউ বলতে পারবে না। বলতে পারা উচিতও নয়।
উনি চুপ করে গেলেন। আমার চা খাওয়া হয়ে গেছে। আমি নীরার দিকে তাকিয়ে বললাম, আমি উঠি?
নীরা বললেন, আচ্ছা যাও। আমি ঢাকায় চলে যাব তোমাদের ছবির শেষ পর্যায়ে আবার দেখা হবে।
জ্বি আচ্ছা।
তুমি কি সর্পভুককে দেখতে গিয়েছিলে?
জ্বি না।
আমি আজ একবার দেখতে যাব। তুমি ইচ্ছে করলে আমার সঙ্গে যেতে পার।
আমার ইচ্ছা করছে না।
ইচ্ছা করছে না কেন?
উনাকে দেখলেই সাপ খাবার দৃশ্যটা মনে পড়বে তখন আমার নিজেরই বমি আসবে। পরে দেখা যাবে আমাকেও হাসপাতালে ভর্তি করতে হচ্ছে।
তাহলে না যাওয়াই ভাল।
এই পর্যন্ত লিখে ডাইরি বন্ধ করলাম। এন্টেনা এখনো আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সে বোধ হয় অপেক্ষা করছে আমার দ্বিতীয়বার ভেংচি কাটার দৃশ্য দেখার জন্যে। ভেংচি কাটতে ইচ্ছে করছে না, ঘুম পাচ্ছে।
মা ফিরলেন বিকেলে। আমি ঘুমুচ্ছিলাম। আমাকে ডেকে তুললেন। তার মুখ থমথম করছে। তিনি সহজ ভাবে কথাও বলতে পারছেন না। আমি ঘুম জড়ান গলায় বললাম, কী হয়েছে? মা কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, তোর নামে এইসব কী শুনছি?
কী শুনছ?
ঝড়ের সময় তুই আর মঈন ভাই না-কি একটা ঘরে একা ছিলি?
একা কোথায়? আমি আর উনি— আমরা দুজন।
তোরা কী করছিলি?
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, আমরা কি করছিলাম বলে তোমার ধারণা?
আমার ধারণা খুবই ভয়ঙ্কর।
তোমার ধারণা ঠিকই আছে মা। এর বেশি আর কিছু জানতে চেয়ো না। কষ্ট পাবে।
তার মানে কী? তুই কী বলতে চাচ্ছিস?
আমি জবাব দিলাম না। মার সঙ্গে আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। মা ধরা গলায় বললেন, জালালের মা যা বলেছে তাহলে সেটা ঠিক। আমি এই কথায়ও জবাব দিলাম না। মা ছুটে বাথরুমে ঢুকে গেলেন। তিনি বাথরুমের দরজা বন্ধ করে কাঁদছেন। ছোট বাচ্চাদের মত হাউ মাউ করে কান্না। তার সেই কান্না আমাকে স্পর্শ করছে না।
আমি এবং মা পাশাপাশি শুয়ে আছি। রাত কত জানি না। ইচ্ছা করলে জানা যায়। টেবিলে আমার হাত ঘড়ি পড়ে আছে। হাত বাড়ালেই ঘড়ি। হাত বাড়াতে ইচ্ছা করছে না। বাথরুমের দরজা খোলা। সেখানে বাতি জ্বলছে। খানিকটা আলো তেড়ছা ভাবে আমার পায়ে পড়েছে। সন্ধ্যাবেলায় আলোর তেজ থাকে না, রাত যত বাড়তে থাকে আলোর তেজও বাড়তে থাকে। আলোর তেজ দেখে মনে হচ্ছে অনেক রাত। অঘুমো অবস্থায় চুপচাপ শুয়ে থাকা যায় না। কিছু। না কিছু করতে ইচ্ছে করে—পাশ ফেরা, মাথার নীচের বালিশটা উল্টে দেয়া, একবার গুটিসুটি মেরে শোয়া, একবার লম্বা হয়ে যাওয়া। আমি তার কিছুই করছি না, পাথরের মূর্তির মত পড়ে আছি। মা খুব নড়া-চাড়া করছেন। মাঝে মাঝে খুব অস্পষ্টভাবে বিড়বিড় করছেন। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছেন। মা একসময় বিছানায় উঠে বসে বললেন, চাপা গলায় বললেন, বকু ঘুমাচ্ছিস? আমি বললাম, না। মা আবারো শুয়ে পড়লেন। আমি ভেবেছিলাম তিনি কিছু বলবেন। কিছু বললেন না। হয়ত বুঝতে পারছেন না, কী বলবেন। তাঁর মাথা এলোমেলো হয়ে আছে। কোন বড় সমস্যায় মানুষের মাথা যখন এলোমেলো হয়ে যায় তখন সে আর সমস্যা নিয়ে ভাবতে পারে না। সমস্যার বাইরের তুচ্ছ বিষয় নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতে থাকে। তার খুব কথা বলতে ইচ্ছে করে কিন্তু সে কথা খুঁজে পায় না।
মা আবারো উঠে বসলেন। আবারো আগের মত জিজ্ঞেস করলেন, বকু ঘুমুচ্ছিস? এবারে আমি বললাম, হ্যাঁ ঘুমুচ্ছি। মা শুয়ে পড়লেন। তার মানে আমি কী বলছি না বলছি তাও তাঁর মাথায় ঢুকছে না। মার জন্যে আমার কষ্ট হচ্ছে— তাঁর নিজের জগৎ ভেঙ্গে ছারখার হয়ে গেছে। তিনি এখন ঘোরের মধ্যে চলে গেছেন। এই ঘোর সহজে কাটার না।
বকু?
হুঁ!
কাল থেকে শুটিং পুরোপুরি শুরু হবে?
হুঁ। রাতের কাজের জন্যে জেনারেটার এনেছে। রাতের কাজ হবে।
হুঁ।
পাপিয়ার মেয়েটাকে দেখেছিস— সামনের দুটা দাঁত বড় বড়। মিকি মাউসের মত লাগে।
দেখেছি।
নীরাকে তোর কেমন লাগল?
ভাল।
শুরুতে তাকে যত অহংকারী মনে হয়েছিল—তত অহংকারী কিন্তু সে না।
হুঁ।
তবে কাউকে কিছু না বলে হুট করে চলে গেল। তোকে কিছু বলেছে?
না।
উনার মেয়েটা দেখতে কেমন ফকিরনীর মেয়ের মত না!
হুঁ , ফকিরনীর মেয়ের মত।
হয়ত কোন ফকিরনীর কাছ থেকেই নিয়েছে। এটা তাঁর নিজের মেয়ে না। পালক মেয়ে। জালালের মা বলল।
ও আচ্ছা।
মানুষ কেন যে পালক নেয়। পালা পাখির জ্বালা বেশি। তারপরেও পুষ্যি নেয়। উচিত না।
আমি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললাম। মা তুচ্ছ সব কথা বলে যাচ্ছেন। লক্ষণ ভাল না। একবার এ রকম শুরু হলে চলতেই থাকবে। মা সারারাত নিজের মনে কথা বলতে থাকেন। আমাকে হুঁ দিয়ে যেতে হবে। বাবা আমাদের ছেড়ে যাবার পরও এরকম হল। মার কথা বলা রোগ হল। সারা রাত কথা বলতেন। অর্থহীন সব কথা। আমি ঘুমিয়ে পড়লে আমাকে ঘুম থেকে জাগাতেন। আবার শুরু হত কন্যা।
বকু!
কী মা?
গরম লাগছে। গরমে শরীর জ্বলে যাচ্ছে।
বাথরুমে যাও, হাত মুখ ধুয়ে আস।
মা বাধ্য বালিকার মত উঠলেন। বাথরুমে গিয়ে হাত মুখ ধুলেন। বাথরুম থেকে বের হয়ে গেলেন বারান্দায়। তিনি বারান্দায় হাঁটাহাটি করছেন। স্যান্ডেল পায়ে হাঁটছেন–স্যান্ডেলের শব্দ হচ্ছে। মা এত শব্দ করে হাঁটেন না। আজ কি ইচ্ছা করে শব্দ করছেন? অনিদ্রা রোগ হলে মানুষ শব্দ না করে থাকতে পারে না। মা আবারো বাথরুমে ঢুকলেন। মনে হয় এখন গোসল করছেন। মাথায় মগে করে পানি ঢালা হচ্ছে। ঢালা হচ্ছেতো, ঢালাই হচ্ছে। বাথরুমে পানি থাকে না বলে ড্রাম ভর্তি পানি রাখা হয়। তিনি কি পুরো ড্রাম শেষ করবেন? তার গোসল শেষ হল। তিনি ঘরে ঢুকে কাপড় বদলালেন। চুল আঁচড়ালেন। তারপর টেবিল থেকে আমার হাত ঘড়িটা নিয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রইলেন। হাত থেকে ঘড়ি নামিয়ে রাখার পর আমি বললাম, কটা বাজে মা? মা আবারো ঘড়ি দেখে বললেন— আড়াইটা। তার মানে আগের বার হাতে ঘড়ি নিয়ে তাকিয়েছেন, সময় দেখেন নি। মার জন্যে আমার কষ্ট হচ্ছে। ইচ্ছা করছে কোন একটা মন্ত্র পড়ে তার অস্থিরতা দূর করে দি। সে রকম মন্ত্র আমার অবশ্যি জানা আছে। মন্ত্র পড়ে মাকে সামলে ফেলতে পারব। আমি উঠে বসলাম। শান্ত গলায় বললাম, মা শোন তুমি এত অস্থির হচ্ছ কেন?
মা নিচু গলায় বললেন, অস্থির হবার মত কিছু হয় নি?
আমি বললাম, না।
তিনি হতাশ মুখে তাকিয়ে আছেন। যেন নিতান্ত বাচ্চা একটা মেয়ে যে আমার কাছ থেকে আশা ও আনন্দের কোন কথা শুনতে চায়। কারোর চিন্তা শক্তি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেলে এই অবস্থা হয়। মা আমার সামনে চেয়ারে বসলেন। আমি সহজ গলায় বললাম–মা শোন। আমার যে সমস্যা নিয়ে ভেবে ভেবে তুমি অস্থির হয়েছ সে সমস্যা আমিই দূর করব। তোমাকে কিছু ভাবতে হবে না।
তোর সমস্যা তুই কীভাবে দূর করবি?
সব আমি ভেবে ঠিক ঠাক করে রেখেছি।
সেটা কী?
যেদিন শুটিং শেষ হবে সেদিন আমি সোমেশ্বরী নদীর পারে বেড়াতে যাব। তারপর ঝাপ দিয়ে নদীতে পড়ে যাব। যেহেতু সাঁতার জানি না, মবিলের মত টুক করে চলে যাব নদীর তলায়। সব সমস্যার সমাধান।
কথাগুলি আমি বললাম হেসে হেসে, কাজেই মা আরো এলোমেলো হয়ে গেলেন। তিনি তাকিয়ে আছেন—এখন আর তাঁর চোখে পলক পড়ছে না।
মা।
হু।
তুমি আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসতো।
হাসব কেন?
হাসবে কারণ আমি তোমার সঙ্গে অভিনয় করেছি। তোমাকে ভয় দেখানোর জন্যে ভয়ঙ্কর কিছু কথা বলেছি। এই জাতীয় কিছুই হয় নি।
কিছুই হয় নি?
না।
তুই ঝড়ের সময় উনাকে নিয়ে স্কুল ঘরে যাস নি? মওলানা সাহেবতো বললেন, গিয়েছিলি।
গিয়েছি। তাতে কী হয়েছে? প্রচণ্ড ঝড়ের সময় আমরা কি বাইরে থাকব? বাইরে থাকলে মরে যেতাম।
তাতো ঠিকই।
আমরা দৌড়ে স্কুল ঘরে ঢুকলাম আর তখনই মওলানা সাহেব ঢুকলেন।
হ্যাঁ তাইতো!
নিজের মেয়ের সম্পর্কে তোমার যে কী ধারণা মা। ছিঃ। নিজের মেয়ের উপর তোমার বিশ্বাস নেই?
মা এখনো অপলকে তাকিয়ে আছেন। তবে এখন তাঁর চোখে পানি জমতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে তিনি কাঁদতে শুরু করবেন।
আমার সম্পর্কে তোমার কী ধারণা সেটা টেস্ট করার জন্যেই গল্পটা তোমাকে বানিয়ে বলেছি। আশ্চর্য তুমি পুরোপুরি বিশ্বাস করে ফেলেছ। কর নি?
হুঁ করেছিলাম।
আমি মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, তোমার মনটা কি খুব বেশি খারাপ হয়েছিল মা?
হুঁ।
এখন মন ঠিক হয়েছে?
মা ধরা গলায় বললেন–হ্যাঁ! মন ঠিক হয়েছে।
এসো শুয়ে পড়ি।
না শোব না— আয় গল্প করি।
এসো শুয়ে শুয়ে গল্প করি। এসো।
আমি মাকে নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। মা কেঁদেই যাচ্ছেন। তবে তিনি যে কাঁদছেন তা তিনি বুঝতে পারছেন না। বুঝতে পারলে আঁচলে চোখের পানি মুছতেন। তা মুছছেন না। আমি মাকে জড়িয়ে ধরে খুশি খুশি গলায় বললাম,
জানি না।
আমার মনে হয় তুমি পাগল হয়ে যেতে।
বকু?
হুঁ।
সিনেমা করার দরকার নেই বকুল, চল কাল ভোরে ঢাকায় চলে যাই।
চল যাই।
সত্যি যাবি?
তুমি বললে অবশ্যই যাব।
কিন্তু এরা খুব বিপদে পড়বে।
তাতো পড়বেই। আমার মত একটা মেয়ে জোগাড় করা। তাকে দিয়ে পুরো জিনিসটা রিশুট করা।
এটা ঠিক হবে না বকুল।
তাহলে থাক।
বকু!
হুঁ।
এবার ঢাকায় গিয়ে তোর বাবাকে বলব, ভাল একটা ছেলে দেখে তোর বিয়ে দিয়ে দিতে।
বাবাকে বলতে হবে কেন?
মেয়ের বিয়েতে বাবারাই দেয়।
আমার বিয়ে তুমি দেবে মা–আর কেউ না।
তোর বিয়ের জন্যে আমি টাকা আলাদা করে রেখেছি।
কত টাকা?
চল্লিশ হাজারের মত।
ঢাকায় ফিরলে সেখান থেকে আমাকে দশ হাজার টাকা দিওতো মা।
কী করবি?
কাজ আছে। আমি একটা সিডিপ্লেয়ার কিনব। আমার খুব শখ।
তোর বাবাকে বললেই কিনে দেবে। তোর বিয়ের টাকায় আমি হাত দেব। অসম্ভব।
বাবাকে আমি কিছু বলতে পারব না।
তোর বলতে হবে না। আমি বলব।
ঠিক আছে মা। তুমি বোল। এখন একটু ঘুমাও অনেকক্ষণ গল্প করা হয়েছে।
বকু?
কী মা?
তুই কি উনাকে খুব পছন্দ করিস?
কাকে?
ডিরেক্টর সাহেবকে?
না।
না কেন?
উনার মধ্যে প্রচুর ভান আছে মা। আমার ভান পছন্দ না। মানুষ হবে সহজ সরল। যা ভাববে তাই বলবে, তাই করবে। উনি কখনো তা করেন না। উনি যা ভাবেন কখনো তা বলেন না।
সেলিমকে কি তোর পছন্দ?
এই প্রশ্নের উত্তর দেব না। উত্তর দিলেই তুমি রেগে যাবে।
না রাগব না। বল সেলিমকে তোর পছন্দ কি-না।
পছন্দ।
গাধা টাইপ ছেলেতো। কথা নেই বার্তা নেই সাপ খেয়ে ফেলল।
সাপ খেয়েছে বলেই পছন্দ। কেঁচো খেলে আরো পছন্দ হত।
ফালতু কথা বলবি না। আমি তোর বিয়ে দেব একজন ডাক্তার ছেলের সঙ্গে।
ঠিক আছে দিও।
ফ্যামিলীতে একজন ডাক্তার থাকা ভাল। অসুখ বিসুখে তখন অস্থির হতে হবে না।
মা ঘুমানোর চেষ্টা কর। বিয়ের পর আমি কিন্তু তোদের সঙ্গে থাকব।
অসম্ভব। তুমি হলে শাশুড়ি তুমি জামাইয়ের সঙ্গে থাকবে এটা কেমন কথা! তুমি আমাদের ভালবাসা-বাসি দেখবে, ঝগড়া ঝাটি দেখবে তা হবে না।
আমি তাহলে যাব কোথায়?
সেটাও অবশ্যি একটা কথা। তোমারতো আবার যাবার জায়গা নেই।
বকু!
কী মা?
আমার যেন কেমন লাগছে?
কী রকম লাগছে?
বুঝতে পারছি না। আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না রে বকু।
তুমি কথা বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে থাক। একটা কথাও বলবে না। আমি তোমার মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছি।
মনে হয় জ্বর আসছে।
আসলে আসুক। তুমি ঘুমাও।
মা চুপ করলেন। আমি তার মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছি। মা ঘুমুচ্ছেন। তবে ঘুমের মধ্যেও তাঁর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। একজন মা তার সন্তানের জন্যে এত ভালবাসা ধরে রাখেন? আশ্চর্য! আমার কোলে যদি কখনো কোন বাবু আসে আমিও কি তাকে এত ভালবাসব? এত ভালবাসা কি ঠিক? না ঠিক না। সব ভালবাসাই পরিমিতির মধ্যে থাকা দরকার। এই যে আমি মার মাথার পাশে বসে আছি, তার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছি। মা ঘুমের মধ্যেই কাঁদছেন। তারপরেও যদি এই মুহূর্তে উনি এসে বলেন— রুমালী! চল ঘুরে আসি। আমি সঙ্গে সঙ্গে মাকে ফেলে উঠে আসব। মার দিকে দ্বিতীয়বার ফিরে তাকাব না। মানুষ কেন এমন বদলে যায়? কাউকে পেলে জিজ্ঞেস করতাম। এই বিশেষ ঘটনাটা কি সব মানুষের ক্ষেত্রেই ঘটে না শুধু আমার ক্ষেত্রে ঘটছে? আমি কি আর দশজনের চেয়ে আলাদা, না-কি আমি আর দশজনের মত? এটা কাকে জিজ্ঞেস করব? কে আমার প্রশ্নের উত্তর দেবে?
ছেলেরা কি মেয়েদের মত ভালবাসতে পারে? রাধা শ্রীকৃষ্ণকে যেমন ভালবেসেছিলেন–কৃষ্ণ কি কখনো রাধাকে সেই ভাবে ভালবেসেছেন? ভালবেসে থাকলে তিনি রাধাকে ফেলে চলে যেতে পারতেন না। আর রাধা বাকি জীবন ‘কৃষ্ণ কোথা? কৃষ্ণ কোথা?’ বলে দেশ দেশান্তরে পাখি হয়ে উড়ে বেড়াতে পারত না। অবশ্যি এইসব গল্পগাথা। গল্পে অনেক কিছু হয় বাস্তবে হয় না। আবার বাস্তবেও অনেক কিছু ঘটে যা গল্পে লেখা হয় না। এই যে মোসাদ্দেক স্যার সিলিং ফ্যানের সঙ্গে শাড়ি পেঁচিয়ে মরে গেলেন। যে আভার জন্যে এই কাণ্ডটা করলেন সেই ঘটনায় আর কিছুই হয় নি। তার জীবন সুন্দর মতই এগুচ্ছে। আভার মতো কোন কাণ্ড যদি আমি করে ফেলি তাতেও কারো কিছু হবে না। আমাদের ডিরেক্টর সাহেব আবারো ছবি করতে আসবেন। যখের ছবি, পক্ষাঘাতগ্রস্থ রোগীর ছবি। আমার মত আরেকটি মেয়ে চোখ বড় বড় করে তার গল্প শুনবে। তিনি মিটি মিটি হাসতে হাসতে বলবেন, তারপর খুকী তোমার নাম যেন কী? মেয়েটি লজ্জিত ভঙ্গিতে বলবে, আমার নাম কংকা।
ও আচ্ছা কংকা। খুব সুন্দর নাম। তবে নামটা কিন্তু পেত্নীর।
পেত্নীর নাম?
হা পেত্নীর নাম। ত্রৈলক্যনাথের একটা বই আছে—বইটা কংকাবতীকে নিয়ে লেখা। সেই কংকাবতী হল একটা পেত্নী।
ও আচ্ছা (মেয়েটি অভিভূত হতে শুরু করেছে)।
কংকা, তোমার বুদ্ধি কেমন?
আমার বুদ্ধি খুব কম।
আচ্ছা তোমার আই কিউ টেস্ট করা যাক—তিনটা পিঁপড়া নিয়ে একটা ধাঁধা বলছি দেখি পার কি না।
আমি পারব না। আমার মোটেই বুদ্ধি নেই।
আমার ধারণা তোমার অনেক বুদ্ধি।
এ রকম ধারণা কেন হল?
যাদের বুদ্ধি বেশি তারা তাকানোর সময় খুব সামান্য হলেও ভুরু কুঁচকে তাকায়। কপালে সূক্ষ্ম দাগ পড়ে।
আশ্চর্য জানতাম নাতো। ভুরু কুঁচকে তাকায় কেন?
বুদ্ধিমানরা যে কোন দৃশ্য খুব ভাল ভাবে দেখতে চায়। তা করতে গিয়ে তার ভুরু কুচকে যায়। যারা সহজ সরল মানুষ—কিংবা বোকা মানুষ তারা সরল ভাবে তাকায়। তাদের ভুরু কখনো কুঁচকায় না, বা কপালেও কখনো দাগ পড়ে না। যেমন আমাকে দেখ। আমার কপালে দাগ পড়ে না। আমি তাকানোর সময় ভুরু কুঁচকাই না।
আপনি যদি বোকা হন তাহলে পৃথিবীর সবাই বোকা! আইনস্টাইনও বোকা।
আইনস্টাইনের স্ত্রীর নাম কী বলতো?
জানি না।
কী আশ্চর্য এমন বিখ্যাত একজন মানুষ, তুমি তার স্ত্রীর নাম জান না?
জ্বি না।
এই জন্যে তোমার কি লজ্জিত বোধ করা উচিত না?
জ্বি উচিত। উনার স্ত্রীর নাম কী?
আমি নিজেও জানি না।
আপনি জানেন না?
না।
সত্যি জানেন না?
না সত্যি জানি না।
কংকা নামের মেয়েটা তখন অভিভূত হয়ে তাকিয়ে থাকবে। তার কাছে এই মানুষটাকে তখন খুব কাছের মানুষ বলে মনে হতে থাকবে। আইনস্টাইনের স্ত্রীর নাম তিনি জানেন না বলে নিজেকে চট করে মেয়েটির স্তরে নামিয়ে আনলেন। এই কাজটা তিনি করলেন খুব সূক্ষ্ম ভাবে। শুধু তাই না, আরো কিছু খেলা তিনি খেলবেন—নিজেকে মাঝে মধ্যে মেয়েটির চেয়েও নিচের স্তরে নিয়ে যাবেন। মেয়েটিকে আনন্দিত হবার সুযোগ দেবেন। মেয়েটির যখন দিশেহারা অবস্থা হবে তখন আবার নিজেকে নিজের মধ্যে গুটিয়ে ফেলবেন।
বকু!
আমি চমকে উঠলাম। আশ্চর্য মা ঘুমান নি! জেগে আছেন।
ঘুমাও নি মা?
ঘুমাচ্ছিলাম। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল।
আবার ঘুমিয়ে পড়।
খুব বাজে একটা স্বপ্ন দেখেছি বকু।
বাজে স্বপ্নটা কী?
স্বপ্নে দেখলাম তোর বাবাকে সাপে কেটেছে। বিষে তার শরীর নীল হয়ে গেছে।
দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হবার কিছুই নেই মা। বাবাকে সাপে কাটে নি। সাপ খোপ নিয়ে অনেক কাণ্ড হয়েছে বলেই এমন স্বপ্ন দেখেছ।
এরকম একটা বাজে স্বপ্ন কেন দেখলাম।
আমাকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করছ বলে এ রকম স্বপ্ন দেখেছ। আমাকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করার কিছু নেই।
মা সত্যি বলছিস?
হ্যাঁ সত্যি।
স্কুল ঘরে কিচ্ছু হয় নি তাই না?
শুধু উনার ডান পা মাড়িয়ে দিয়েছিলাম। অন্ধকারে কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম — তাই। পা মাড়িয়ে দেয়া নিশ্চয়ই ভয়ঙ্কর কিছু না। আমি সঙ্গে সঙ্গে সরি বলেছি।
বকু!
কী মা?
আমার খুব অস্থির লাগছে।
অস্থির লাগছে কেন?
আমার মনে হচ্ছে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটতে যাচ্ছে।
ভয়ঙ্কর কিছুই ঘটতে যাচ্ছে না। সকাল হোক—দেখবে তোমার কাছে সব স্বাভাবিক লাগতে শুরু করবে। রাতের বেলা সবকিছুই একটু অস্বাভাবিক লাগে।
তোর বাবাকে খবর দিয়ে নিয়ে এলে কেমন হয়?
বাবাকে খবর দিয়ে নিয়ে আসবে?
হুঁ। তোর শুটিং শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেও থাকল। সোহরাব ভাইকে বললে উনি তোর বাবাকে খবর দেয়ার ব্যবস্থা করবেন।
তোমার ধারণা খবর পেলেই উনি ছুটে আসবেন?
তোর কোন সমস্যা হয়েছে শুনলে সে থাকতে পারবে না। ছুটে চলে আসবে।
আমারতো কোন সমস্যা হয় নি মা।
মা উঠে বসে শান্ত গলায় বললেন, হয়েছে। আমার মন বলছে তুই যে ভয়ঙ্কর ঘটনার কথা বলছিস, সেই ঘটনা ঘটেছে।
আমি খিলখিল করে হেসে উঠলাম। হাসির শব্দে মার অস্থিরতা একটু যেন কমল। তিনিও হাসলেন। আমি বললাম, দেখছ মা, আমি কত ভাল অভিনয় জানি। একটা ঘটনা তোমাকে কেমন বিশ্বাস করিয়ে ফেলেছি। অভিনয় ভাল। জানি না মা?
মা বললেন, হ্যাঁ।
আমি বললাম, মা আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। এতক্ষণ আমি তোমার সেবা করেছি, এখন তুমি আমার সেবা করবে। আমি ঘুমুব তুমি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে।
আচ্ছা ঘুমো।
আমি শুয়ে পড়লাম এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লাম। একটা স্বপ্ন দেখলাম ঘুমের মধ্যে। আমি একটা ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে আছি। ডিরেক্টর সাহেব আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি তাঁর মুখের দিকে তাকাচ্ছি না। আমি তাকিয়ে আছি অন্যদিকে। সেখানে গোলগাল মুখের কোকড়ানো চুলের একটা বাচ্চা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার কোলে একটা ফুটবল ফুটবলটা সে ডলের মত বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে আছে। তিনি বললে, রুমালী তোমার মেয়ের কাণ্ড দেখেছ? ফুটবল কিনে দিয়েছি—একবারও সে ফুটবলটা মাটিতে নামিয়ে কিক দেয় নি। পুতুলের মত কোলে কোলে নিয়ে ঘুরছে। সে মেয়ে বলেই এই কাণ্ডটা করছে। ছেলে হলে এতক্ষণে সে ফুটবল খেলা শুরু করত।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ তাই। মেয়েদের মধ্যে মাতৃভাব প্রবল বলেই সব খেলনাই তাদের কাছে সন্তানের মত। যে কোন খেলনা মেয়েদের হাতে দাও দেখবে খেলনা কোলে নিয়ে তারা ঘুরবে। আমি ভেবেছিলাম তোমার মেয়েটা অন্যদের চেয়ে আলাদা হবে। এটা দেখার জন্যেই তাকে ফুটবল কিনে দিয়েছিলাম।
তোমার মেয়ে তোমার মেয়ে করছ কেন? এই মেয়েটাতো শুধু আমার একার না। তোমারও।
তিনি তৎক্ষণাৎ বললেন-না তো ও আমার হবে কেন? এই মেয়ের সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক?
তখনই আমার ঘুম ভাঙ্গল। বাইরে সকাল হচ্ছে। পাখি ডাকছে।
মা হাত পা এলিয়ে আমার পাশেই শুয়ে ঘুমুচ্ছেন। আমি মার মাথায় হাত রাখলাম। জ্বরে তার গা পুড়ে যাচ্ছে। আজ শুটিং শুরু হচ্ছে। হাত মুখ ধুয়েই আমাকে মেকাপে বসতে হবে। মাকে ফেলে রেখে শুটিং এ চলে যাব। মা একা একা বিছানায় ছটফট করবেন।