সুন্দর ঝকঝকে সকাল
কী সুন্দর ঝকঝকে সকাল!
অঞ্চলটাকে যেন আগের রাতে সাবান দিয়ে মাজা হয়েছে। চকচক করছে চারদিক। চারদিক থেকে সবুজ আভা বের হচ্ছে। কেউ যেন প্রতিটি গাছের পাতার আড়ালে সবুজ বাতি জ্বেলে দিয়েছে। আমি একতলায় নেমে দেখিকেমন উৎসব উৎসব ভাব। সবাই এক সঙ্গে কথা বলছে। কেউ কারো কথা শুনছে বলে মনে হল না। সেলিম ভাই শুধু এক কোণায় একা একা বসে আছেন। মনে হচ্ছে তার মন খুব খারাপ। তিনি আমাকে দেখেই চোখ নামিয়ে নিয়ে কেমন শক্ত হয়ে গেলেন। ডিরেক্টর সাহেব বা তাঁর স্ত্রী কাউকেই দেখলাম না। তাঁরা বোধ হয় ঘুম থেকে ওঠেন নি। উনার স্ত্রীকে দেখার শখ ছিল।
মা খুব উৎসাহের সঙ্গে মওলানা সাহেবের সঙ্গে গল্প করছেন। মার মুখ হাসি হাসি। হাদিস কোরানের গল্প শুনে মার মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত হবার কথা না। নিশ্চয়ই অন্য কোন গল্প। মওলানা সাহেবের কান্ড কারখানাও অদ্ভুত–দিব্যি সিনেমার দলের সঙ্গে মিশে গেছেন। সকালবেলাতেই উপস্থিত। মা আমাকে দেখে এগিয়ে এলেন।
বকুল তোর ঘুম ভেঙ্গেছে?
না ভাঙ্গে নি। এখনো ঘুমুচ্ছি। ঘুমুতে ঘুমুতে নীচে নেমে এসে, এখন তোমার সঙ্গে কথা বলছি।
সব সময় বাঁকা কথা বলিস কেন? মাঝে মাঝে সোজা কথা বললে কী হয়?
ভাল হয়।
এখন কটা বাজে জানিস? দশটা।
তাই না-কি!
আজ নাশতা ছিল তেহারী। এক একজন দুই প্লেট তিন প্লেট করে খেয়ে নাশতা সর্ট ফেলে দিয়েছে। তোরটা আমি আলাদা করে রেখেছি। দাঁড়া গরম করে দিতে বলি।
তোমাকে এমন খুশি খুশি লাগছে কেন মা?
খুশির তুই কী দেখলি?
মা রান্নাঘরের দিকে ছুটে গেলেন। তার আদরের কন্যার নাশতা যেন মিস। হয়। মওলানা সাহেব আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। আচ্ছা মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার ব্যাপারেই কি তার আগ্রহ? আমি তাকে খুব কম সময়ই ছেলেদের সঙ্গে কথা বলতে দেখেছি। সব সময় লক্ষ্য করেছি তিনি মেয়েদের আশেপাশেই আছেন এবং গুট গুট করে মেয়েদের সঙ্গেই কথা বলছেন।
আম্মা কেমন আছেন?
জ্বি ভাল আছি। আপনি ভাল?
আল্লাহপাকের অসীম রহমতে ভাল আছি।
আপনি দেখি একেবারে সিনেমার লোক হয়ে গেছেন। সবই আম্মা আল্লাহপাকের হুকুম। স্যার আমাকে চাকরি দিয়েছেন। মাসিক বেতন দুই হাজার টাকা। আমার জন্য যথেষ্ট। চণ্ডিগড় স্কুলে বেতন ছিল বার শ। হাতে পেতাম ছয় শ। তাও সব মাসে না।
আপনার জন্যেতো ভালই হল। তবে মওলানা মানুষ হয়ে সিনেমার লাইনে চাকরি এইটাই যা কথা।
যে কোন কাজই আম্মা সৎ ভাবে সৎ নিয়তে করা যায়। আল্লাহপাক নিয়তটা দেখেন। আর কিছু দেখেন না।
তা যায়। আপনার কাজটা কী?
স্যার এখনো কিছু বলেন নাই। স্যারের সঙ্গে এইটা নিয়েই কথা বলতে এসেছি। শুনলাম স্যারের শরীর ভাল না। জ্বর এসেছে। জ্বর আসারই কথা কাল যে ভিজা ভিজেছেন। আম্মা আপনার জ্বর আসে নিতো?
জ্বি না।
আলহামদুলিল্লাহ্।
মা প্লেটে করে তেহারী এবং চামচ নিয়ে এসেছেন। ভাব ভঙ্গি দেখে মনে হয় মুখে তুলে খাইয়ে দেবেন। লোকজনের সামনে মা খানিকটা আহ্লাদী হয়ে যান। মেয়েকে মুখে তুলে খাইয়ে দিয়ে তিনি প্রমান করার চেষ্টা করবেন যে তাঁর মেয়ে অন্তপ্রাণ। আমি মার হাত থেকে প্লেট নিয়ে নিলাম।
বকুল আস্তে আস্তে খা। কেয়ামতকে বলেছি শুকনা মরিচ ভেজে দিতে। পেয়াজ আর শুকনা মরিচ ভাজা মাখিয়ে খেয়ে দেখ খুব ভাল লাগবে।
আমার এম্নিতেই ভাল লাগছে।
মা খুশি খুশি গলায় বললেন, কেয়ামত আসলেই ভাল রাধে, আমি তিন প্লেট খেয়ে ফেলেছি।
সেকী?
কেউ বুঝতে পারে নি যে তিন প্লেট খেয়েছি।
বুঝতে পারলেই বা কী—তুমি দু নম্বর নায়িকার মা, তুমি তিন প্লেট খাবে। নাতো কে খাবে?
সব সময় ফাজলামি করবি না বকু। নাশতা খেয়ে মঈন ভাইকে দেখে আয়।
উনার আবার কী হয়েছে?
খুব জ্বর। কাল বৃষ্টিতে ভিজেছেনতো। পায়ে আবার কাটাও ফুটেছে। আমি গিয়ে দেখে এসেছি।
তাঁর স্ত্রীর কী অবস্থা মা, স্বামীর সেবাযত্ন করছেন?
সেজে কুল পায় না স্বামীর সেবা করবে কী! সকাল বেলাতেই লিপস্টিক-টিপস্টিক দিয়ে পরী সেজে বসে আছে। তোর কথা জিজ্ঞেস করছিল।
আমার কথা জিজ্ঞেস করবে কেন? আমার কথা তাকে কে বলেছে?
বলতে হবে কেন? তুই ছবির নায়িকা তোকে চিনবে না? বকু শোন, মঈন ভাইয়ের ঘরে যাবার আগে সেজে গুজে ফিট ফাট হয়ে যাবি। আউলা ঝাউলা অবস্থায় যাবি না।
গেলে ক্ষতি কী?
ভদ্রমহিলা তাকে প্রথম দেখবেন। ফাস্ট ইমপ্রেশনের একটা গুরুত্ব আছে? কথায় বলে না, পহেলা দর্শনধারী তারপরে গুনবিচারি।
আমি নাশতা শেষ করলাম। পর পর দুকাপ চা খেলাম। ঘরে গিয়ে কাপড় পাল্টালাম, চুল বাঁধলাম। ডিরেক্টর সাহেবের ঘরে কিন্তু গেলাম না। একা একা হাঁটতে বের হলাম। আজ আমি সারাদিন হাঁটব। দুপুরে ফিরব না। গেটের কাছে এসে এক ঝলকের জন্যে পেছন দিকে ফিরলাম। মা আমার পালিয়ে যাবার ব্যাপারটা দেখছেন কি-না জানা দরকার। মাকে দেখলাম না–অন্য একজনকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম! ইনিই কি নীরা? আমি এত সুন্দর মানুষ আমার জীবনে দেখি নি। লম্বা ছিপছিপে একজন তরুণী। মাথা ভর্তি কোকড়ানো চুল। হালকা হলুদ রঙের শাড়িতে তাঁকে অবিকল হলুদ পাখির মত লাগছে। তিনি হাত ইশারায় আমাকে থামতে বললেন। তিনি ইশারা না করলেও আমি থামতাম। আমি দাঁড়িয়ে আছি— তিনি এগিয়ে আসছেন। হাঁটার ভঙ্গিটাও অন্য রকম। প্রাচীন কালের রাজকন্যারা কি এমন করে হাঁটতেন? যেন বাতাসের উপর দিয়ে ভেসে আসছেন।
তুমি রুমালী না?
জি।
কী অদ্ভুত নাম— রুমালী।
আপনার মেয়ের নামওতো খুব অদ্ভুত–এন্টেনা।
ওর নাম কিন্তু আসলে এরিয়েল। ওর বাবা রেখেছিলো। যে নৌকায় করে কবি শেলী সমুদ্রে বেড়াতে গিয়ে ডুবে মারা গিয়েছিলেন সেই নৌকাটার নাম ছিল এরিয়েল। এ রকম অপয়া নামতো রাখা যায় না কাজেই এরিয়েল বদলে কাছা কাছি একটা নাম রাখলাম—এন্টেনা।
কী সহজ ভঙ্গিতেই-না মহিলা কথা বলছেন–যেন আমার সঙ্গে তার কতদিনের পরিচয়। পুরানো দুই অসম বয়সের বান্ধবী একসঙ্গে গল্প করছি।
তুমি যাচ্ছ কোথায়?
একটু হাঁটব।
আশেপাশের লোকজনদের বাড়িঘরে গিয়েছ?
জ্বি না একটা বাড়িতেই শুধু গিয়েছি। সেই বাড়িতে অনেক গাছ আছে। বিরাট একটা পুকুরও আছে।
ঐ বাড়িতেই কি যাচ্ছ?
এখনো ঠিক করি নি। যেতে পারি।
আমি যদি সঙ্গে যাই তোমার কি আপত্তি আছে?
ছিঃ ছিঃ কী বলেন–আপত্তি থাকবে কেন? আপনি সঙ্গে গেলে আমার খুব ভাল লাগবে। এন্টেনাকে সঙ্গে নেবেন না?
না ও থাকুক। ও গল্প করুক তার বাবার সঙ্গে। চল আমরা দুজন যাই।
আমরা পথে নামলাম। আমি আরেকবার পেছন দিকে তাকালাম। দলের সবই তাকিয়ে আছে। যেন বিরাট কোন ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। সেই ঘটনা ঘটাতে যাচ্ছি আমরা দুজন। বাকি সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করছে। এটা যদি সিনেমার কোন দৃশ্য হত তাহলে ক্যামেরা আমাদের মুখ থেকে প্যান করে অপেক্ষমান ইউনিটের লোকজনদের মুখে পড়ত। তখন সাসপেন্স জাতীয় আবহ সংগীত হত।
রুমালী।
জ্বি।
অভিনয় করতে কেমন লাগছে?
খুব ভাল লাগছে।
সবার কাছেই শুনেছি তুমি না-কি অসম্ভব ভাল অভিনয় কর।
আমি বুঝতে পারি না।
মঈন তোমার অভিনয়ের প্রশংসা করছিল। আমি অবশ্যি সব সময় ওর প্রশংসাকে গুরুত্ব দেই না। ওর রুচির সঙ্গে আমার রুচি প্রায়ই মেলে না। মঈনকে ডিরেক্টর হিসেবে তোমার কেমন লাগল?
ভাল।
শুধু ভাল?
খুব ভাল। অবশ্যি আমি ডিরেক্টরতো বেশি দেখি নি।
আমার মনে হচ্ছে তুমি খুব সাবধানে কথা বলার চেষ্টা করছ। বি ইজি। সহজ হয়ে কথা বল। মানুষ হিসেবে মঈন কেমন?
তাকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাই নি।
নীরা হেসে ফেললেন। সুন্দর সরল হাসি। শুরু থেকেই আমি সাবধান ছিলাম। এখন আরো সাবধান হয়ে গেলাম। নীরা খুব সহজ মেয়ে না। মনের দরজা জানালা বন্ধ রেখে তার সঙ্গে কথা বলা যাবে না। আবার মনের দরজা জানালা খোলা রেখেও কথা বলা যাবে না।
রুমালী!
জ্বি।
তুমি তার সঙ্গে ভাল মত মেশার সুযোগ পাও নি কথাটা কি ঠিক বললে? তুমিতো ভালই সুযোগ পেয়েছ। তুমি নিজে সুযোগ তৈরি করে। নিয়েছ।
আপনি কী বলতে চাচ্ছেন, আমি বুঝতে পারছি না।
তিনি শান্ত গলায় বললেন, তোমরা কাশবনের শুটিং করতে গেলে। বৃষ্টি নামল। মঈন তার স্বভাবমত বৃষ্টিতে রওনা হল। অসম্ভব বৃষ্টি প্রীতির কারণে যে সে কাজটা করল তা কিন্তু না। তার মধ্যে প্রচুর লোক দেখানোর ব্যাপার আছে। তাকে দেখাতে হবে যে সে আর দশজনের মত না। সে আলাদা। বুঝতে পারছ কী বলছি?
জ্বি।
সে বৃষ্টিতে নেমে গেল, ভিজতে ভিজতে ক্যাম্পে ফিরবে এই হল তার পরিকল্পনা। সে কি তোমাকে বলেছিল, এসো আমার সঙ্গে। আমরা দুজন এক সঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ঘরে ফিরি। বলেছিল?
জ্বি না।
কিন্তু তুমি তার সঙ্গে চলে এলে। কাজটা কি তুমি নিজের ইচ্ছেয় করলে?
জ্বি।
নীরা আবারো আগের ভঙ্গিতে হাসলেন। আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। আমাকে উনি অতল জলের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। কাজটা করছেন খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। তার গলায় কোন রাগ নেই। তিনি ছোট ছোট পায়ে হাঁটছেন। একবার দাঁড়াচ্ছেনও না।
রুমালী।
জ্বি।
তোমার ধারণা তুমি নিজের ইচ্ছেয় বৃষ্টিতে ভেজার জন্যে তার সঙ্গে রওনা হয়েছ। এই ধারণা ঠিক না। তুমি নিজের ইচ্ছায় আস নি। সে তোমাকে আসতে বাধ্য করেছে। সে পরিস্থিতি এমন ভাবে তৈরি করেছে যে তোমার এ-ছাড়া দ্বিতীয় পথ ছিল না।
আমি নিজের ইচ্ছেতেই এসেছি। কাশবনের ওখানে আর কোন মেয়ে ছিল না। আমি একা ছিলাম। যারা ছিলেন তাদের কারো সঙ্গে আমার তেমন পরিচয় নেই। একা থাকতে আমার ভয় ভয় লাগছিল।
তুমি কাউন্টার আমেন্ট ভাল দাঁড় করিয়েছ। মঈনের সঙ্গে ঝড় এবং বৃষ্টিতে হাত ধরাধরি করে আসতে তোমার কি ভাল লাগছিল?
ভাল লাগছিল তবে আমরা হাত ধরাধরি করে আসি নি। আপনি কোথাও একটা ভুল করছেন। আমি উনাকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করি। এর বেশি কিছু না।
তুমি তার প্রেমে পড় নি?।
আপনি খুবই অদ্ভুত কথা বলছেন।
আমি মোটেই অদ্ভুত কথা বলছি না। তুমি অদ্ভুত কথা বলছ। তুমি খুব বুদ্ধিমতী একটা মেয়ে। বেশি বুদ্ধিমতী মেয়েদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে তারা অন্যের বুদ্ধি খাটো করে দেখে। তারা সব সময় ভাবে পুরো পরিস্থিতি তার নিয়ন্ত্রণে। সব সময় তা হয় না। খুব বুদ্ধিমানরাই বড় ধরনের বোকামি করে। তুমি একটা বড় ধরনের বোকামি করেছ।
কোন বোকামি?
এসো ঐ ছাতিম গাছটার নীচে বসি। বসে গল্প করি। হেঁটে টায়ার্ড হয়ে গেছি। মাথায় রোদও লাগছে। ছাতা নিয়ে আসা দরকার ছিল। আমার চায়ের পিপাসা হচ্ছে। তোমার কি হচ্ছে?
জ্বি।
খুব ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি খেয়ে তারপর চা খেতে পারলে ভাল হত। তাই না?
জ্বি। ঠাণ্ডা পানি এবং চা এখনই চলে আসবে।
আমি বিস্মিত হয়ে তাকালাম। নীরা হাসি মুখে বললেন, আমি কোন ভবিষ্যৎ বাণী করছি না। ভবিষ্যৎ বাণীর ক্ষমতা আমার নেই। তোমার সঙ্গে রওনা হবার আগে আমি সোহরাবকে বলে এসেছি যে ছাতিম গাছের নীচে আমি রুমালী মেয়েটিকে নিয়ে বসব তার সঙ্গে গল্প করব। তুমি ঠাণ্ডা পানি এবং চা পাঠাবে।
আমি চুপ করে আছি। ভদ্রমহিলা আমাকে ভালই চমকে দিয়েছেন। তিনি এগুচ্ছেন তাঁর পরিকল্পনা মত। কী করবেন, কী বলবেন সবই মনে হয় ঠিক করা। আমার সঙ্গে যখন বের হয়েছেন তখন বুঝতেই পারি নি তিনি পুরো ব্যাপারটা ছকে ফেলে রেখেছেন। আমরা গাছের নীচে বসে আছি এবং আমি দেখতে পাচ্ছি সোহরাব চাচা আসছেন। তার কাঁধে কাপড়ের ব্যাগ। সেই ব্যাগে নিশ্চয়ই ফ্লাস্কভর্তি বরফ শীতল পানি। এবং অন্য ফ্লাস্কে চা। সুন্দর চায়ের কাপ। চিনির পটে চিনি। কয়েকটা নোনতা বিসকিটও থাকতে পারে।
রুমালী।
জ্বি।
মঈনের চরিত্রের কোন দিকটি তোমাকে আকর্ষণ করেছে?
আমি সেই ভাবে কখনো বিচার করতে চেষ্টা করি নি।
যাকে তুমি এত পছন্দ কর তাকে তুমি নানান ভাবে বোঝার চেষ্টা করবে না? পছন্দের পেছনের কারণগুলি দেখবে না?
আমি কিছু বললাম না, চুপ করে রইলাম। নীরা হালকা গলায় বললেন, ওর সবচে ভাল দিক হচ্ছে ওর ছেলেমানুষী। একটা বাচ্চা ছেলে ওর ভেতর বাস করে। বাচ্চারা কী করে জান? ওদের কিছু খেলনা থাকে। প্রিয়জনদের দেখা পেলেই সে তার খেলনাগুলি বের করে দেখায়। নিজের খেলনায় সে মুগ্ধ হয়ে থাকে এবং চেষ্টা করে অন্যদের মুগ্ধ করতে। তোমাকে করে নি?
কী খেলনার কথা বলছেন?
তার খেলনার বেশির ভাগই হচ্ছে গল্প। যেমন ধর তিনটা পিঁপড়ার গল্প। একজনের পেছনে একজন যাচ্ছে। এই গল্পটি তোমাকে বলে নি?
বলেছেন।
একটা পিঁপড়া এবং হাতির গল্প— এই গল্পটি করেছে?
জ্বি।
যখের গল্প করেছে? যখ নিয়ে সে ছবি বানাতে চায় এই গল্প?
জ্বি করেছেন।
এইসব হচ্ছে তার খেলনা। আশে পাশের মানুষদের মুগ্ধ করার জন্যে এই খেলনা সে ঝুমঝমির মত বাজায় এবং সবাই মুগ্ধ হয়। এক সময় আমিও হয়েছিলাম।
আপনার মুগ্ধতা কি কেটে গেছে?
মুগ্ধতা কেটে গেছে। মুগ্ধতার জায়গায় এখন যা আছে তার নাম করুণা। আমি তার প্রতি প্রবল করুণা বোধ করি। ও সেটা জানে। অন্যের ভালবাসা। যেমন টের পাওয়া যায়, করুণাও টের পাওয়া যায়। অবশ্যি মঈন তেমন বুদ্ধিমান নয়। বুদ্ধিমান নয় বলেই কী পরিমাণ করুণা তাকে করি তা সে বুঝতে পারে না। ওর যে বুদ্ধি কম তা কি তুমি বুঝতে পেরেছ?
যারা নিজের কাজে ডুবে থাকে বাইরে থেকে তাদের বোকা মনে হয়।
মনে হচ্ছে তুমি তাকে বোকা বলতে রাজি নও।
সোহরাব চাচা পানি এবং চা নিয়ে এসেছেন। দৌড়ে এসেছেন বলে তিনি হাঁপাচ্ছেন। নীরা বললেন, তোমার স্যারের ঘুম ভেঙ্গেছে?
জ্বি।
কী করছে?
কিছু করছেন না, শুয়ে আছেন। স্যারের জ্বর মনে হয় বেড়েছে। একজন ডাক্তার আনতে যাব।
যাও ডাক্তার নিয়ে এসো। চা ঢালতে হবে না আমরা ঢেলে নেব।
সোহরাব চাচা চলে গেলেন। নীরা চায়ের কাপে চা ঢালতে ঢালতে বললেন, তুমি আমাকে ভয় পেও না। আমার সঙ্গে সহজ ভাবে কথা বল। আমি ভয়ঙ্কর কেউ না। আমি ভাল মেয়ে। কী পরিমাণ ভাল মেয়ে তা তুমি জান না।
আমি বললাম, আমি সহজ হতে পারছি না। আমার নিজেকে একজন আসামীর মত মনে হচ্ছে। যেন আমি কোন ভয়ঙ্কর অপরাধ করেছি। আমাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে। আর আপনি আমাকে প্রশ্ন করছেন।
তুমি কোন অপরাধ কর নি?
জ্বি না।
আমার নিজের ধারণা তুমি ভয়ংকর একটা অপরাধ করেছ। ঝড় বৃষ্টিতে তোমরা দৌড়ে একটা স্কুল ঘরে আশ্রয় নিলে। তাই না?
জ্বি।
কতক্ষণ ছিলে সেখানে?
খুব অল্প সময় ছিলাম। মওলানা সাহেব প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের খুঁজে পেলেন।
নীরা হাসি মুখে বললেন, আচ্ছা মওলানা সাহেব যদি আরেকটু দেরি করে আসতেন তাহলে কী হত?
আমি চুপ করে আছি। তাকিয়ে আছি তার দিকে। তিনি চায়ে চুমুক দিচ্ছেন। দূর থেকে দেখে যে কেউ বলবে আমরা দুজন চা খেতে খেতে মজা করে গল্প করছি।
তুমি কি তার হাত ধরতে? কিংবা আরো কিছু? চুপ করে আছ কেন? চা খাও। চা ঠাণ্ডা হচ্ছে। চা-টা ভাল হয়েছে। তাই না?
জ্বি।
সিলেটে আমার চাচার একটা চায়ের বাগান আছে। সেই বাগানের চা। কী সুন্দর ফ্লেভার। রুমালী?
জ্বি।
শুনেছি তুমি খুব ভাল গান জান।
গান গাইতে পারি। ভাল কি-না জানি না।
শুনাও, একটা গান শুনাও।
আলোচনা কি অন্য দিকে মোড় নিচ্ছে? মোড় নিলেও লাভ হবে না, তিনি আবারো মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসবেন। এটা সাময়িক বিরতি। আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, কী ধরনের গান শুনতে চান?
এরকম ভাবে বলছ যেন সব ধরনের গানই তুমি জান। মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না। এটা জান?
জ্বি না।
তাহলে তোমার ইচ্ছামত একটা গান কর।
আমি দেরি করলাম না, সঙ্গে সঙ্গে শুরু করলাম—
Down the way
Where the nights are gay
I took a trip
On a sailing ship
And when I reached Jamica I made a stop.
আমি গান করছি, নীরা তীক্ষ্ণচোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। তার ঠোঁটে বিচিত্র হাসি। এখন তিনি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছেন। তিনি তাকিয়ে আছেন আকাশের দিকে। চারদিক কী অপূর্ব সুন্দর। আকাশ ঘন নীল। আমার গান গাইতে ভাল লাগছে।
এই গানের যদি অনেকগুলি অন্তরা থাকত খুব ভাল হত। আমি গেয়ে যেতাম গান ফুরতো না। আমি আপন মনে গাইছি। একবারও নীরার দিকে তাকাচ্ছি না। না তাকিয়েও বুঝতে পারছি–তিনিও আমার দিকে তাকাচ্ছেন না। না দেখেও আমি বলতে পারি কেউ আমার দিকে তাকাচ্ছে কি তাকাচ্ছে না।
এক সময় গান শেষ হল, আমি নীরার দিকে তকিয়ে হাসলাম। উনি এখন কী করবেন? আমাকে কি বলবেন, চল ক্যাম্পে ফিরে যাওয়া যাক। না-কি পুরানো প্রসঙ্গ আবার শুরু করবেন। মহামান্য আদালত একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকবেন। নানান দিক থেকে আক্রমণ করে দুর্গে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করবেন। নীরা যত বুদ্ধিমতীই হোন না কেন আমার দুর্গে ফাটল ধরাতে পারবেন না। ইট-কাঠ-লোহার দুর্গে ফাটল ধরানো যায় ভালবাসার দুর্গে ফাটল ধরানো যায় না।
রুমালী?
জ্বি।
তোমার গানের গলা ভাল।
থ্যাংক য়্যু।
শুধু ভাল বলে ভুল করেছি—খুবই ভাল। তুমি কি মঈনকে তোমার গান শুনিয়েছ?
জ্বি না।
শোনাও নি কেন? সে যেমন তোমাকে মুগ্ধ করার চেষ্টা করছে, তুমিও করবে। সেটাই নিয়ম।
উনি শুনতে চান নি।
কেউ শুনতে না চাইলে তুমি গান শোনাও না?
জি না। কথা নেই, বার্তা নেই আমি হুট করে গান শুরু করব কেন? এইসবতো শুধু সিনেমাতেই হয়।
তুমিতো সিনেমা করতেই এসেছ!
নীরা হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। কথার পিঠে কথা জুড়ে তিনি এগুচ্ছেন। আমার ক্লান্তি লাগছে। আমি কি তাঁকে বলব— কথা কথা খেলা খেলতে ইচ্ছে করছে না। অন্য কোন খেলা খেলতে চাইলে বলুন। পশু-পাখি-ফুল-ফল খেলা খেলবেন? আসুন আমরা পশু-পাখি-ফুল-ফল খেলা খেলি।
রুমালী!
জ্বি।
মঈনের সঙ্গে আমার বিয়ে কী ভাবে হল এই গল্প কি শুনবে? খুব ইন্টারেস্টিং গল্প। শুনলে তোমার ভাল লাগবে।
বলুন শুনব।
নীরা ফ্লাস্ক থেকে আবারো চা নিলেন। তার চা খাবার ব্যাপারটা মজার। ফ্লাস্ক থেকে অল্প অল্প চা কাপে ঢালেন। কাপ শেষ হয় আবারো নেন। তিনি হালকা গলায় বললেন, আমাদের বিয়ে কিন্তু প্রেমের বিয়ে নয়। আমাদের হচ্ছে এরেন্ড ম্যারেজ। তবে এই এরেজুমেন্টের ব্যাপারটি আমার করা। এরেন্ড ম্যারেজে সাধারণত বর কনের কোন ভুমিকা থাকে না। তাদের আত্মীয় স্বজনরাই সব ব্যবস্থা করেন। আমার বিয়ের বেলায় সব ব্যবস্থা আমিই করেছি। আমি বাবাকে গিয়ে বলেছি, বাবা মঈন নামের এই ছেলেটিকে আমি বিয়ে করতে চাই। বাবা তখন কফি খাচ্ছিলেন। আমার কথা শুনে তিনি এতই চমকালেন যে তার হাত থেকে কফির পেয়ালা পড়ে গেল। কার্পেটে কফির দাগ লেগে গেল। সেই দাগ এখনো আছে। তুমি যদি কখনো আমাদের বাড়িতে যাও তোমাকে দেখাব। গল্পের ভূমিকাটা কেমন?
জ্বি ভাল।
আমি যখন আমাদের ধানমণ্ডির বাড়িতে বেড়াতে যাই–তখন একবার হলেও বসার ঘরে যাই। কফির দাগ ভরা কার্পেটটার দিকে তাকিয়ে থাকি আমার খুব মজা লাগে। আচ্ছা এখন গল্পটা শোন।
জ্বি শুনছি।
মঈন তখন সবে মাত্র ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করেছে। চাকরি বাকরির চেষ্টা করছে— পাচ্ছে না। খুবই দুরবস্থা। সব সময় দুবেলা ভাত খাবার মত টাকাও থাকে না। কোনো কাজে যখন কারো বাসায় যায়—দুপুর বেলায় ভাত খাবার সময়ে যায়। তারা যদি ভদ্রতা করেও একবার বলে— ভাত খেয়ে যাও, সে দেরি করে না, সঙ্গে সঙ্গে বলে–জ্বি আচ্ছা। কোথায় হাত পোব? এই হল তার অবস্থা।
নীরা খিলখিল করে হাসছেন। সহজ সরল হাসি। গল্পটা বলতে পেয়ে তার খুব ভাল লাগছে তা বুঝতে পারছি। তিনি যে তার বিয়ের গল্প করবেন, এটিও কি তার পরিকল্পনায় ছিল? গল্পটা হবে ঈশপের গল্পের মত। গল্পের শেষে আমার জন্যে ছোট্ট উপদেশ থাকবে।
রুমালী।
জ্বি।
তারপর শোন–মঈনের অর্থনৈতিক অবস্থা তাকে দেখে বোঝার কোন উপায় কিন্তু ছিল না। কাপড় চোপড়ে সে সব সময় খুব ফিটফাট। নিজেকে মানুষের সামনে সুন্দর করে উপস্থিত করার একটা ব্যাপার তার মধ্যে সব সময় ছিল। এখনো আছে। কী আছে না?
জ্বি আছে।
এক দিন সকালের কথা। ছুটির দিন বাবা বাসায় আছেন। খুবই আশ্চর্যজনক ভাবে তাঁর মেজাজ ভাল। বাসায় যখন থাকেন তাঁর মেজাজ ভাল থাকে না। অকারণে হৈ চৈ করেন। সেই দিন তিনি হাসিমুখে আমার সঙ্গে গল্প করছেন। গল্পের বিষয়বস্তু হল জনৈক পীর সাহেবের আধ্যাত্মিক ক্ষমতা। সেই পীর মানুষকে দেখা মাত্র তার ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান সব হড় হড় করে বলে দিতে পারে। সে বাবার অফিসে এসেছিল। বাবা তার ক্ষমতায় মুগ্ধ ও বিস্মিত। আমার কোথায় বিয়ে হবে, কবে হবে এইসব সে বাবাকে বলেছে। বাবা খুব আগ্রহ করে পীর সাহেবের কথা বলছেন— আমি খুব মুগ্ধ হয়ে শোনার অভিনয় করে যাচ্ছি এমন সময় দারোয়ান এসে বলল–একটা ছেলে দেখা করতে চায়। পাঁচ মিনিট কথা বলবে। নাম মঈন।
এইসব ক্ষেত্রে বাবার জবাব হচ্ছে–না। বাড়িতে তিনি কারো সঙ্গে দেখা করেন না। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে হলে–অফিসে দেখা করতে হবে। সেই দেখা হবার ব্যাপারটাও খুব সহজ না। বাবার পি,এ, প্রথম কথা টথা বলে দেখবে ঘটনা কী। সে যদি মনে করে এপয়েন্টমেন্ট দেয়া যায় তাহলে হবে। সেটাও বেশ জটিল পদ্ধতি। ঐযে তোমাকে বললাম, বাবার মেজাজটা হিল ভাল, ভাল মেজাজের কারণে তিনি বলে ফেললেন আসতে বল।
মঈন এসে ঢুকল। ঝকঝকে চেহারার যুবক। হাসি খুশি ভঙ্গি। জড়তা তেমন নেই। অপরিচিত একটা বাড়ির বিশাল ড্রয়িং রুমে সে ঢুকেছে তা নিয়ে তার সামান্যতম সংকোচও নেই। অপরিচিতা রূপবতী তরুণীর সামনে স্বাভাবিক কারণেই ছেলেদের কিছু সংকোচ থাকার কথা— তাও নেই। সে ঘরে ঢুকেই আমার দিকে তাকিয়ে হেসেছে। সেই হাসির মানে হচ্ছে–কী ভাল আছেন?
বাবা গম্ভীর ভঙ্গিতে বললেন, কী ব্যাপার?
মঈন বলল, স্যার আমি আপনার দশ মিনিট সময় নেব। ঘড়ি দেখে দশ মিনিট। এর বেশি এক সেকেন্ডও না।
বাবা বললেন, তুমি দারোয়ানকে বলেছ পাঁচ মিনিট। এখন দশ মিনিট বলছ কেন?
স্যার–আমি আপনাকে একটা গল্প বলব। গল্পটা বলতে সাত মিনিট লাগবে। গল্পের শেষে তিন মিনিটে আমার বক্তব্য বলব। আমি আপনার কাছে কোন চাকরির জন্যে আসি নি। বা ভিক্ষা করতেও আসি নি। দয়া করে দশটা মিনিট সময় দিন।
বাবা বললেন, বোস। দশ মিনিট অনেক দীর্ঘ সময়। তোমার যা বলার পাঁচ মিনিটে বলে শেষ কর। আমি জরুরি কিছু কাজ করছি।
মঈন তার গল্প শুরু করল। কোন গল্প জান? তার বিখ্যাত যখের গল্প। বাবা ভুরু কুঁচকে গল্প শুনছেন। বাবা পীর ফকির ছাড়া কোন কিছুতেই বিস্মিত হন না। গল্প শুনে বিস্মিত হচ্ছেন না। এমন উদ্ভট গল্প ছেলেটি কেন বলছে তা বের করার চেষ্টা করছেন। আমি অবাক হয়েই গল্প শুনছি। গল্প শেষ হল। বাবা ঘড়ি দেখলেন। তারপর বললেন, তুমি এই গল্প আমাকে কেন বলছ?
মঈন বলল, গল্পটি নিয়ে আমি একটা ছবি বানাতে চাই। থার্টি ফাইভ মিলিমিটারে ফুল লেংথ ফিচার ফিল্ম। আপনি কি আমাকে সাহায্য করবেন?
বাবা দীর্ঘ সময় মঈনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। জীবনে এমন অদ্ভুত প্রস্তাবের মুখোমুখি তিনি সম্ভবত হন নি। মঈন বলল, আপনারতো নানান ধরনের ব্যবসা আছে। ব্যবসায় টাকা খাটাচ্ছেন— ছবির ব্যবসা করে দেখুন। আপনি চাইলে আমি চিত্রনাট্য দিয়ে যাব। আপনি পড়লেই বুঝতে পারবেন খুব সুন্দর গল্প। ভাল মত বানাতে পারলে অপূর্ব হবে। এবং আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন আমি ছবিটা খুব ভাল বানাব। ছবির ব্যবসায় আপনার হয়ত লাভ হবে না। ক্ষতিই হবে তবে দেশ একটা ভাল জিনিস পাবে। সামান্য আর্থিক ক্ষতি আপনার গায়ে লাগবে না।
বাবা বললেন–এই অদ্ভুত প্রস্তাব নিয়ে তুমি কি শুধুই আমার কাছে এসেছ আরো অনেকের কাছে গিয়েছ?
অনেকের কাছে যাই নি। কয়েকজনের কাছে গিয়েছি। বিত্তবানদের বাড়িতে চট করে ঢোকা যায় না। আর যদিও বা ঢোকা যায় তারা কিছু শুনতে চান না।
বাবা বললেন, আমি শুনলাম। তুমি দশ মিনিট সময় চেয়েছিলে— আমি এগারো মিনিট দিলাম। এখন তুমি যেতে পার।
চলে যাব?
অবশ্যই চলে যাবে।
জ্বি আচ্ছা।
তোমার প্রফেশন কি ছবি বানানো?
জ্বি না–এখন পর্যন্ত কোন ছবি বানাই নি। তবে ছবি বানানোর খুব শখ।
পড়াশোনা কী?
আমি দুবছর আগে ফিলসফিতে এম. এ. পাশ করেছি।
চাকরি-বাকরি করছ?
জ্বি না। কোথাও কিছু পাচ্ছি না।
জ্বি না।
আমার একটা উপদেশ শোন। ছবির চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল। চাকরি জোগাড়ের চেষ্টা কর। রেফারেন্সের প্রয়োজন হলে আমি রেফারেন্স দিতে পারি। এখন তুমি যেতে পার।
মঈন উঠে দাঁড়াল।
আমি বললাম, চা খেয়ে যান।
মঈন সঙ্গে সঙ্গে বসে পড়ল। যেন এই কথাটার জন্যেই সে অপেক্ষা করছিল। আমি চা এনে দিলাম। উটকো গেস্টদের জন্যে চায়ের সঙ্গে বাসি চানাচুর দেয়া হয়। তাই দেয়া হল।
বেচারা খুব আগ্রহ করে পিরিচের সব চানাচুর খেয়ে ফেলল। তার খাওয়া দেখে মনে হল সে খুবই ক্ষুধার্ত। আমার এত মায়া লাগল যে বলার না। আমি বললাম, আপনি কি আর কিছু খাবেন? কেক আছে? কেক দেব? মঈন বলল, জ্বি আচ্ছা দিন।
আমি কেক এনে দিলাম। এবং সেদিন বিকেলেই বাবাকে বললাম—বাবা তুমিতো আমাকে কোথায় বিয়ে দেবে এই নিয়ে খুব চিন্তা ভাবনা করছ। এমন কী পীর ফকির পর্যন্ত ধরছ। তোমাকে একটা কথা বলি— মঈন নামের এই মানুষটাকে আমার পছন্দ হয়েছে। বাবার হাত থেকে কফির কাপ পড়ে গেল। এই হল গল্প। গল্প কেমন লাগল?
ভাল।
তোমার কাছে কি গল্পটা সিনেমেটিক মনে হয় নি?
জ্বি না।
নীরা হাসতে হাসতে বললেন, সিনেমেটিকতো বটেই। একদিকে সহায় সম্বলহীন যুবক। অন্যদিকে বড়লোকের আদরের দুলালী। হিন্দী সিনেমার সঙ্গে খুব মিল। তবে একটা অমিল ছিল— হিন্দী সিনেমায় এইসব ক্ষেত্রে মেয়ের বাবা মা বেঁকে বসেন। বাবা রেগে আগুন হয়ে নিজ খান্দান নিয়ে অনেক কথা বলেন। মেয়ে চোখের জল ফেলতে ফেলতে করুণ গান শুরু করে। আমার বেলায় সে সব কিছু হয় নি। বাবা কয়েকদিন খুব গম্ভীর হয়ে রইলেন। মঈনের বাড়ি ঘরের খোঁজ নিলেন, তারপর যথাসময়ে বিয়ে হয়ে গেল। নো ক্লাইমেক্স, নো এন্টি ক্লাইমেক্স। মঈন তার মেস ছেড়ে আমাদের বাড়িতে থাকতে এল। এবং প্রবল উৎসাহে ছবি বানাতে শুরু করল। যখের ছবি না, অন্য ছবি।
ছবি বানাবার টাকা কে দিলেন— আপনার বাবা?
না আমি দিলাম। তার সমস্ত ছবির আমিই প্রযোজক। এখন যে ছবি বানাচ্ছে তার টাকাও আমার দেয়া টাকা দেয়া বন্ধ করলেই ছবি বন্ধ।
নীরা খুব হাসছেন। কেন হাসছেন? একজন মানুষকে টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছেন সেই আনন্দে হাসছেন? নীরা হাসি থামিয়ে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বললেন।
আমি কি খুব বেশি হাসছি?
জ্বি না!
আমারতো মনে হয় বেশি হাসছি। মেয়েরা বেশি হাসলে খুব অস্বাভাবিক লাগে। কাঁদলে স্বাভাবিক লাগে। আমার সমস্যা হচ্ছে আমি কাঁদতে পারি না। তুমি কাঁদ কেন?
আমিও কম কাঁদি।
দ্যাটস গুড। কম কাঁদাই ভাল। চল ওঠা যাক।
নীরা উঠে দাঁড়ালেন। আমি বললাম, ক্যাম্পে যাবেন? নীরা বললেন, না। ক্যাম্পে যাব না। তুমি চলে যাও— আমি একা একা খানিকক্ষণ হাঁটব।
জ্বি আচ্ছা।
রুমালী দাঁড়াও তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছি। মঈন কী তোমাকে তার শৈশবের গল্প করেছে? কী ভাবে সে এতিমখানায় মানুষ হয়েছে। এইসব?
জ্বি না।
ও— তুমি তাহলে এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছ। তার পছন্দের বিশেষ বিশেষ মেয়েদের সে তার ভয়াবহ শৈশবের গল্প করে। সহানুভূতি পাওয়ার জন্যে এটা করে। তোমার সঙ্গেও করবে। এমন ভাবে করবে যে শুনতে শুনতে তোমার চোখে পানি এসে যাবে। বাসর রাতে সে তার ভয়াবহ শৈশবের গল্প আমার সঙ্গে করেছে। আমার চোখে পানি এসে গিয়েছিল।
নীরা আবারো হাসছেন। আমি অবাক হয়ে তার হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে আছি।
হঠাৎ হাসি থামিয়ে গম্ভীর হয়ে বললেন, মঈন তোমাদের সঙ্গে এক ধরনের খেলা খেলছে। অসুস্থ মানুষের অসুস্থ খেলা। সে যে অসুস্থ তা কি তুমি টের পেয়েছ?
জ্বি না।
আমিও বুঝতে পারি নি। যখন বুঝতে পারলাম করুণায় মন ভরে গেল। করুণাও এক ধরনের ভালবাসা। তবে ক্ষতিকারক ভালবাসা। এই ভালবাসা মানুষকে অসুস্থ করে দেয়। আমাকে যেমন করে দিয়েছে। অসুস্থ মানুষের মত তোমার সঙ্গে গল্প করছি। অকারণে হাসছি। এর কোন প্রয়োজন ছিল না। তুমি তার প্রেমে পড়েছ, পড়তেই পার। আমিওতো প্রেমে পড়েছিলাম। জানি না শুনি
একজনকে বিয়ে করার জন্যে পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। তুমি যদি হও তাতে দোষ কী? ভাল কথা–তুমি কী তাকে বিয়ে করতে চাও?
আপনি এসব কী বলছেন?
আকাশ থেকে পড়ার অভিনয় করবে না রুমালী। অভিনয় ভাল হচ্ছে না। আমি তোমার চেয়ে অনেক বড় অভিনেত্রী। তুমি মাঝে মধ্যে অভিনয় করছ আমি সারাক্ষণই করছি। এখন এমন হয়েছে যে আমি কখন অভিনয় করছি কখন করছি না, তা নিজেই জানি না। আমার কথা বুঝতে পারছ?
জ্বি না।
মঈনের মধ্যে প্রায় প্রায়ই স্যুইসাইডের টেনডেনসি দেখা যায়। সে একা একা ছাদে উঠে যায়। ছাদ থেকে নীচে লাফিয়ে পড়বে। এই রকম একটা পরিকল্পনা থাকে। আমি তাকে কী বলি জান? আমি বলি–প্লীজ ডু দ্যাট। একটু সাহস করে লাফ দিয়ে পড়। এটা তোমার জন্যে পরম শান্তির ব্যাপার হবে। আমি ধাক্কা দিয়ে তোমাকে ফেলে দিতে পারলে ভাল হত। আমি তা করব না। এই ব্যাপারটা তোমাকেই করতে হবে।
নীরা নিঃশ্বাস নেবার জন্যে থামলেন। আমি বললাম, এখন যাই?
আচ্ছা যাও। ও, জাস্ট এ মিনিট, তোমাদের এখানে নাকি একজন মহিলা পীর আছেন। মানুষের ভবিষ্যৎ বলে দেন। তিনি নাকি বলেছেন চণ্ডিগড়ে কোন ছবি হবে না। একজন মানুষ মারা যাবে। আমি তার সঙ্গে একটু দেখা করব। যে মানুষটা মারা যাবে সে মঈন কি-না জিজ্ঞেস করব। তুমি কি তার বাড়ি চেন?
জি চিনি।
আমাকে তুমি তার বাড়ি দেখিয়ে দিয়ে যাও।
চলুন।
তুমি মহিলা পীরের কাছে গিয়েছিলে?
জি।
তোমাকে কী বলেছিল?
আমাকে কিছু বলেন নি।
সেকী, তুমি তোমার ভবিষ্যৎ জানতে চাও নি?
জ্বি না।
ভবিষ্যৎ জেনে নেবার এমন সুযোগ হাতছাড়া করলে, এটা ঠিক না। নেক্সট টাইম তাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিও ডিরেক্টর মঈন সাহেব তোমাকে বিয়ে করবেন কি করবেন না।
আমি নিঃশব্দে হাঁটছি। নীরা আমার পেছনে পেছনে আসছেন। আমি তার দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারছি— তার মুখ হাসি হাসি। তিনি খুব মজা পাচ্ছেন।
রুমালী।
জ্বি।
আমার উপর খুব রাগ লাগছে?
জি না।
আমার ধারণা খুব রাগ লাগছে। তুমি শুধু শুধু রাগ করছ। আমি যা বললাম তোমার ভালর জন্যে বলাম। মন্দের জন্যে যে সব কথা বলা হয় সে সব শুনতে খুব ভাল লাগে। ভালর জন্যে বলা কথা শুনতে অসহ্য বোধ হয়।
আমার অসহ্য বোধ হচ্ছে না। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে আপনার কথা শুনছি।
আমি থমকে দাঁড়ালাম। হাত উঁচিয়ে মহিলা পীরের বাড়ি দেখিয়ে দিলাম। নীরা বললেন, থ্যাংক ঝু— এখন তুমি চলে যাও। তোমাদের ডিরেক্টর সাহেবকে বলবে যে আমার ফিরতে সামান্য দেরি হতে পারে। সে যেন অস্থির না হয়। আমি যখন তার আশে পাশে থাকি তখন সে আমার সামান্য অদর্শনে অস্থির হয়ে পড়ে। ডিরেক্টর সাহেবকে আমার খবরটা দিও?
জ্বি আচ্ছা।
তুমি তাকে আপনি করে বল, না তুমি করে বল?
আপনি করে বলি।
সেকী এখনো তুমির লেভেলে নামতে পার নি। তোমার মত অবস্থা যাদের তাদের সবাইতো তাকে তুমি করে বলে। সেটাইতো শোভন। আপনি আপনি করেতো আর প্রেম করা যায় না। প্রেমের জন্যে একই সমতলে নেমে আসতে হয়। তাই না?
আমি দাঁড়িয়ে আছি, নীরা জাহেদার বাড়ির দিকে যাচ্ছেন। কত সহজ ভঙ্গিতেই না যাচ্ছেন, যেন কিছুই হয় নি। নিশ্চয়ই তিনি জাহেদার সঙ্গে অনেক মজার মজার গল্প করবেন। আমার ক্যাম্পে ফিরতে ইচ্ছা করছে না। সোমেশ্বরী নদীটাকে কি একবার দেখে আসব? ভয়ংকর স্রোত কি একটু কমেছে, না বেড়েছে? এই নদীতে ঝাঁপ দিয়ে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে ডুবে যাবার কথাতো না। স্রোত নিশ্চয়ই অনেক দূর পর্যন্ত ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। নদীর পানিতে চিৎ হয়ে শুয়ে থেকে আকাশ দেখতে দেখতে সমুদ্রের দিকে যাত্রা। কেন জানি খুব ঘুম পাচ্ছে। মনে হচ্ছে আমি অনেক দিনের অঘুমো। শান্তিময় ঘুমের তৃষ্ণায় শরীর কাতর হয়ে আছে। ক্যাম্পে গিয়ে বিছানায় এলিয়ে পড়লেই আমি গাঢ় ঘুমে তলিয়ে যাব। কে জানে সেই ঘুম হয়তো কোনদিনও ভাঙ্গবে না।
ডাকবাংলোর সামনে পাপিয়া ম্যাডামের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। তিনি তাহলে চলে এসেছেন। জালালের মাকে দেখতে পাচ্ছি। সেও এসেছে। সোহরাব চাচাকে দেখছি। তিনি বক্তৃতার ভঙ্গিতে কী যেন বলছেন। তাকে ঘিরে কয়েকজন দাড়িয়ে আছে। মন দিয়ে বক্তৃতা শুনছে। তাদের মধ্যে একজন বুড়োমত ভদ্রলোক। তাঁকে আগে দেখি নি। তিনিও বোধহয় আজই এলেন। শুটিং এর দ্বিতীয় পর্যায় তাহলে শুরু হতে যাচ্ছে। শুরু হোক— প্রবল কাজের মধ্যে ডুবে যাওয়াই ভাল। ইউনিটের লোকজন ঝিমিয়ে পড়েছিল। পাপিয়া ম্যাডামকে দেখে ঝিম ভাব কাটবে।
আমি সবার চোখ এড়িয়ে নিজের ঘরে ঢুকে পড়লাম। বিছানায় শোয়ামাত্রই ঘুমে চোখ জড়িয়ে এল। ঘুমিয়ে পড়ছি না অন্য কিছু। খুব শীত লাগছে, গা কাঁপছে। আমার ঘরের পাশেই কারা যেন হাসাহাসি করছে। কারা হাসছে? জালালের মা?
ঘুমের মধ্যেই শুনলাম ঘুঘু ডাকছে। এখন সকাল না, দুপুর? সব এলোমেলো লাগছে। কিছুই বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে সকাল। কেমন নরম আলো। আচ্ছা সকাল বেলা ঘুঘু ডাকছে কেন? ঘুঘু ডাকবে দুপুরে। উল্টা পাল্টা ডাকছে কেন? আমার গানের সার মোসাদ্দেক সাহেব বলতেন— পাখিদের গলায় রাগ রাগিনী আছে। কোন কোন পাখির গলায় আছে ভৈরবী তারা ডাকে সকালে, আবার কারো গলায় দরবারী কানাড়া–এরা ডাকবে দুপুরে যেমন ঘুঘু। যাদের গলায় বেহাগ তারা ডাকবে নিশি রাত্রে যেমন শুশান-কোকিল। মোসাদ্দেক স্যার খুব সুন্দর করে কথা বলতেন। গান শেখাতেনও চমৎকার। আমি প্রথম দিন স্যারকে বললাম, স্যার আমার কি গান হবে? তিনি আমার দিকে একটু ঝুঁকে এসে বললেন, মাগো তোমার গলা দিয়ে কি শব্দ বের হয়?
আমি বললাম, হ্যাঁ।
তিনি মুখ ভর্তি পান নিয়ে বললেন, শব্দ বের হলে গান হবে। গাধা যে প্রাণী সেও গান গায় আর মানুষ গাইবে না সে কেমন কথা?
স্যার, গাধা কি গান গায়?
অবশ্যই গায়। গাধার নিজস্ব রাগিনীও আছে— গর্ধভ রাগিনী। হা হা হা।
মোসাদ্দেক স্যার শিক্ষক হিসেবে চমৎকার ছিলেন, মানুষ হিসেবেও চমত্তার ছিলেন। ছাত্র ছাত্রীদের প্রতি তাঁর মমতার সীমা ছিল না। তিনি প্রায়ই বলতেন, গানের শিক্ষকরা কী করে জানিস? তারা জায়গায় জায়গায় গানের চারাগাছ পুতে। বেশির ভাগ চারাই গরু-ছাগলে খেয়ে ফেলে। কোনটায় অল্প বয়সে পোকা ধরে। আবার কিছু চারাগাছ মহীরুহ হয়ে যায়। ডালপালা ছড়িয়ে দিয়ে হুলুস্থুল কাণ্ড। সে এক দেখার মত দৃশ্য।
এই মোসাদ্দেক স্যার আমার চোখের সামনে তাঁর এক ছাত্রীর প্রেমে পড়ে গেলেন। মেয়েটার নাম আভা। তের চৌদ্দ বছরের বেশি বয়স হবে না। খুবই সাধারণ টাইপ মেয়ে। এই সাধারণের ভেতর স্যার অসাধারণ কী দেখলেন কে জানে। তিনি সবার চোখের সামনে বদলে যেতে শুরু করলেন। নিজের ঘর সংসার ছেলে মেয়ে সব তুচ্ছ হয়ে গেল। কী ভয়ংকর অবস্থা। আভা গান শেখা ছেড়ে দিল। স্যার আভাদের বাসার সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা শুরু করলেন। পাড়ার ছেলেরা তাকে একবার খুব মারল। তাতেও লাভ হল না। তার মধ্যে মস্তিষ্ক বিকৃতির লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করল। সারাক্ষণ বিড় বিড় করতেন। গান সেখানো বন্ধ করে দিলেন। সংসারে চরম অভাব নেমে এল। স্যারের স্ত্রী, পুরানো ছাত্র ছাত্রীদের বাসায় বাসায় গিয়ে ভিক্ষা করা শুরু করলেন।
তারপর একদিন খবর পেলাম সিলিং ফ্যানের সঙ্গে শাড়ি পেঁচিয়ে স্যার ঝুলে পড়েছেন। মানুষ হয়ে জন্মানোর দুঃখ কষ্ট থেকে চিরমুক্তি। কী আশ্চর্য মোসাদ্দেক স্যারের কথা হঠাৎ মনে আসছে কেন? আমি কিছু মনে করতে চাই না। আমি দীর্ঘ সময় শান্তিতে ঘুমুতে চাই। প্লীজ, প্লীজ, প্লীজ।
মোসাদ্দেক স্যারকে কাল রাতে হঠাৎ স্বপ্নে দেখেছি। না না কাল না, পরশু রাতে। বেশ হাসি খুশি চেহারা। মুখ ভর্তি পান। পানের রস গড়িয়ে পাঞ্জাবিতে পড়েছে। স্যারের কোন খেয়াল নেই। আমি বললাম, কেমন আছেন স্যার? স্যার হাসতে হাসতে বললেন, খুব ভাল আছি। তুই কেমন আছিস?
আমি ভাল আছি।
আমি পানি নিয়ে এসে দেখি স্যার নেই। ঘর ফাকা। আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। জেগে দেখি মাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছি। ঘর ভর্তি সিগারেটের গন্ধ। পানের জর্দার গন্ধ। মোসাদ্দেক স্যার সিগারেট খেতেন, জর্দা দিয়ে পান খেতেন। তিনি চলে গেছেন— সিগারেট এবং জর্দার গন্ধ ফেলে রেখে গেছেন। ভয়ে আমার শরীর কেমন করতে লাগল। আমি গুটিশুটি মেরে মার বুকের কাছে চলে গেলাম–তবু আমার ভয় কাটল না। আমি ফিস ফিস করে ডাকলাম, বাবা। বাবা।
খুব ছোটবেলা থেকেই প্রচন্ড ভয় পেলে আমি বাবাকে ডাকি। বাবা যদি একবার বলেন, কী হয়েছে রে? সঙ্গে সঙ্গে ভয় কেটে যায়। অভ্যাস মানুষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে যায়। বাবার কাছ থেকে আমি কতদূরে চলে এসেছি— তারপরেও ভয় পেয়ে তাকেই ডাকলাম। তিনি সাড়া দিলেন না। কিন্তু আমার ভয় কেটে গেল।
আজ আবারো ভয় পাচ্ছি। আমি জানি না এই ভয়ের উৎস কী? আমি জানি না কেন ভয় পাচ্ছি। আমার ঘুম কেটে গেছে। চোখ বন্ধ করে বিছানায় পড়ে আছি। ক্যাম্পের হৈ চৈ কথা বার্তা শুনতে পাচ্ছি। ঠিক বুঝতে পারছি না। বুঝতে চেস্টাও করছি না। নিজেকে খুব আলাদা মনে হচ্ছে।
দরজা খুলে মা ঢুকলেন। আমাকে দেখে হতভম্ব গলায় বললেন, তুই এখানে শুয়ে আছিস? কী আশ্চর্য!
মাকে দেখে আমার ভাল লাগছে— আমি আদুরে গলায় বললাম, আশ্চর্য কেন মা।
তোকে দেখলাম, নীরা ভাবীর সঙ্গে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছিস। তুই কোন ফাঁকে চলে এলি?
কোন ফাঁকে চলে এসেছি আমি নিজেও জানি না মা।
পাপিয়া ম্যাডাম চলে এসেছে জানিস?
জানি।
মেয়েটাকে নিয়ে এসেছে। পাতিলের তলার মত কালো। মানুষ এত কালো হয় এই প্রথম দেখলাম।
মা আমার পাশে একটু বসতো।
তোর কী হয়েছে?
কিছু হয় নি আমি তোমার কোলে মাথা রেখে একটু শুয়ে থাকব।
শরীর খারাপ?
হুঁ।
মা উদ্বিগ্ন মুখে বিছানায় উঠে এলেন। আমার কপালে হাত রাখলেন। আমি তার কোলে মাথা রেখে তার কোমর জড়িয়ে ধরলাম। মা কোমল গলায় বললেন, কই জ্বরতো নেই। শরীর নদীর তলার মত ঠান্ডা।
জ্বর না থাকলেও শরীর ভয়ঙ্কর খারাপ করেছে। তুমি মজার কোন গল্প বলে আমাকে হাসিয়ে দাও।
কী মজার গল্প?
ক্যাম্পে মজার কিছু ঘটে নি?
ও আচ্ছা ঘটেছে–
মা ধাক্কা দিয়ে আমাকে বসিয়ে দিলেন। মজার গল্প মার কোলে মাথা রেখে শোনা যাবে না। বসে বসে শুনতে হবে।
সেলিম গাধাটার ঘরে একটা সাপ ঢুকেছে। গাধাটা সাপটা মেরেছে। সাপ ফেলে দিতে যাচ্ছে কে যেন বলল, ফেলবেন না। গারোদের দিয়ে দিন ওরা : সাপ খায়। তখন সেলিম বলল, ওরা খেলে আমরাও খেতে পারি। সাপটা আমাকে খেতে এসেছিল। এখন আমি সাপটাকে খাব। বাবুর্চিকে বলব ঝাল ঝাল করে রান্না করতে।
সাপ রান্না হয়েছে?
বাবুর্চির কাজ নেই সাপ রান্না করবে। তবে ঐ সেলিম গাধাটার সঙ্গে যোগ দিয়েছে মিজানুর রহমান–মাতালটা। সে বলেছে সেই তোলা উনুনে রান্না করবে। তারপর দুজনে মিলে আজ দুপুরে খাবে।
ভালতো।
মা বিস্মিত গলায় বললেন, সেলিম গাধাটা সরল বোকাসোকা টাইপের ছিল। সে সাপ খাওয়া ধরল কেন? আর কিছু না ফিল্মী লাইনের বাতাস লেগেছে। তুই এই গাধাটার কাছ থেকে পাঁচশ হাত দূরে থাকবি।
আচ্ছা থাকব।
মা উঠে দাঁড়ালেন। আমি বললাম, যাচ্ছ কোথায়? মা বললেন, সাপ সত্যি সত্যি রান্না হচ্ছে কি-না দেখতে যাচ্ছি। তুই যাবি? আমি বললাম, আমাকে না তুমি পাঁচশ হাত দূরে থাকতে বলেছ।
মা একাই সাপ রান্না দেখতে গেলেন।