Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » রুপোর মাছ || Sanjib Chattopadhyay

রুপোর মাছ || Sanjib Chattopadhyay

রুপোর মাছ

অনেকেই বলে মামার বাড়িতে মানুষ হওয়া ভালো নয়। নিজের বাড়ি ছেড়ে মামার বাড়ি কেন? অনেক সময় ছেলেদের বাবা মারা গেলে বা বাবার অবস্থা খারাপ হলে মায়েরা ছেলেকে মামার বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। আমার ব্যাপারটা কিন্তু তা নয়। আমার বড়মামা বিরাট ডাক্তার। মেজোমামা। নাম করা অধ্যাপক। আমার মাসিমাও খুব শিক্ষিতা। একসময়ে একটা ভালো স্কুলে শিক্ষকতাও করেছিলেন কিছুকাল। আমার দুই মামা এবং মাসিমা ঠিকই করেছেন বিয়ে নিয়ে করবেন না। সাবেক আমলের বিশাল বাড়ি। বিরাট জমিদারি। আমার মাকে এসে অনুরোধ করেছিলেন, দিদি, ভাগ্নেটাকে আমাদের দিয়ে দে। তৈরি করে আবার তোর কাছে ফেরত দিয়ে যাব। ওখানে অতবড় জায়গা, খোলামেলা, কাছাকাছি ভালো ইস্কুল। দেখবি ও খুব আনন্দে থাকবে। প্রথমে আমার মনে হয়েছিল কী জানি বাবা, বাবা-মাকে ছেড়ে থাকতে পারব তো! এখন মনে হয় মামাদের আর মাসিকে ছেড়ে আমি কোথাও থাকতে পারব না। লোকে বলে আনন্দ নিকেতন। আমার মামার বাড়িটা সত্যিই তাই। সবসময় একটা হুল্লোড়। যখন একা থাকি তখন ভাবি স্বর্গ তো দেখিনি, দেখতেও চাই না। আমার মামার বাড়িটাই তো স্বর্গ! আমার বড়মামা যেন মহাদেব। মেজোমামাকে দেখলে মনে হয় অর্জুন। আর আমার মাসিমা যেন দ্রৌপদী! ঠিক দ্রৌপদীর মতো দেখতে। দ্রৌপদী কেমন দেখতে ছিলেন জানি না। তবে কল্পনায় দ্রৌপদীর যে ছবি আছে তার সঙ্গে আমার মাসিমার খুব মিল। নামটাও ভারী সুন্দর-কুসী! কুসী বোধহয় একটা নদীর নাম। আবার কচি কচি আমকেও বলে কুসী। সত্যি কথা বলতে কি, আমি আমার মাসিমাকে মায়ের চেয়েও বেশি ভালোবাসি।

সকালবেলা মাসিমা আমাদের একতলার বসার ঘরে একটা দোল খাওয়া চেয়ারে বসে অল্প অল্প দুলছেন আর গান গাইছেন, ‘দিবা নিশি করিয়া যতন হৃদয়েতে রচেছি আসন। কর্তা যিনি খ্যাপা তিনি খ্যাপা মূলাধার। চাকলা ছাড়া চ্যালা দুটোর সঙ্গে অনিবার। আহা গুণের কথা কইবো কার।’ মাসিমা গান গাইছেন আর গান্ধারীদি একা হাতল লাগানো ডাস্টার দিয়ে ছবির ধুলো। ঝাড়ছে। মাসিমার বসে থাকার কারণ এই ধুলো ঝাড়ার কাজটা গান্ধারীদি একটু ফাঁকি দিয়ে সারে। তাই মাসিমা বলেছেন, ‘আমি বসে থাকব, আমার সামনে তুই পরিষ্কার করে সব ঝাড়বি। একটাও ছবি যেন না ভাঙে।‘

গান্ধারীদি একটা ছবি একটু নাড়তেই ছবির পেছন থেকে একটা খাম মেঝের ওপর পড়ল। গান্ধারীদি থেবড়ে বসে খামটা দেখছে। মাসিমা গান থামিয়ে বললেন, ‘কী ওটা?’

‘এই ছবিটার পেছনে থেকে খুটুস করে পড়ে গেল।’

‘পড় না, পেছনে কার নাম লেখা আছে?’

‘কিছু লেখা নেই গো। সাদা খাম। মোটা মতন। যেন পার্শে মাছের ডিম ধরেছে!’

‘টিপে দেখনা।’

‘না বাবা, ভয় করছে! কী-নাকী আছে ভেতরে! মাগো!’

আমি ওপাশের টেবিলে বসে বসে অঙ্ক কষছিলুম। আর একটু পরেই মাস্টারমশাই আসবেন। মাসিমা আমাকে বললেন, ‘বিলে দেখ তো, আমার আলসে লেগে গেছে। উঠতে ইচ্ছে করছে না চেয়ার ছেড়ে।’

আমি উঠে এসে খামটা হাতে নিয়ে খুলতেই ভেতর থেকে কিছু শুকনো বেলপাতা আর ফুল মেঝেতে পড়ে গেল। গান্ধারীদি বললে,

‘ইঃ বাব্বা, ফুল-বেলপাতা। কেউ তুকতাক করেছে গো!’

মাসিমা বললেন, ‘তোর মাথা করেছে।’

গান্ধারীদি বললে, ‘এই দেখোনা সিঁদুর মাখানো বেলপাতা। চন্দন মাখানো জবাফুল। একটা লাল কাপড়ের টুকরো। মেঝেতে যখন পড়ল না বাড়িটা একেবারে কেঁপে উঠল!’

মাসিমা বললেন, ‘কেঁপে উঠল। আমরা কেউ টের পেলুম না।’

‘তুমি তো বসে বসে দুলছিলে আর খ্যাপা খ্যাপা করে গান গাইছিলে। তুমি কী করে টের পাবে! হ্যাঁ, বিলু পেয়েছে। বাড়িটা কেমন কেঁপে উঠল না রে!’

আমি বললুম, ‘অঙ্ক কষতে বসলে আমার কাছে তখন সারা পৃথিবীটাই কাঁপে। আমি অত বুঝতে পারিনি। তা বলছে যখন কেঁপেছে তাহলে কেঁপেছে।’

মাসিমা এক ধমক দিলেন আমাকে, ‘চুপ কর!’

গান্ধারীদি বললে, ‘এই দেখো বিশ্বাস করো না, ওই তো সেবার চৈত্রমাসে আমার মেলোমশাই যার পল্টন বাজারে অত বড় দোকান, এবেলা-ওবেলা হাজার টাকা রোজগার। আর কী খাওয়া! যখন খেতে বসত তখন গোটা একটা ছাগল মাথা বাদ দিয়ে খেয়ে উঠত। খেয়ে উঠে যখন ভেঁকুর তুলত তখন মনে হত রাজবাড়িতে তোপ পড়ল। পাড়ার লোকে ঘড়ি মিলিয়ে নিত—ঠিক আড়াইটে!’

মাসিমা বললেন, ‘তার সঙ্গে ফুল-বেলপাতার কী সম্পর্ক? গান্ধারীদি বললে, ‘আমার মা বলত, গেঁদো যখন বলবি তখন সব গোড়া থেকে বলবি। জেনে রাখ আগে গাছের গোড়া তারপর ডালপালা।’

মাসিমা বললেন, ‘আমার গোড়ার দরকার নেই। তুই ডালপালাটাই বল।’

গান্ধারীদি বললে, ‘পিতা মাতা আর গুরুবাক্য আমি অমান্য করতে পারব না। সে তুমি যাই বলো। আমি গোড়া থেকেই বলব।’

মাসিমা খেপে গিয়ে বললেন, ‘তাহলে তুই মাসিমার জন্ম মেলোমশাইয়ের জন্ম থেকেই বল, সে যবে শেষ হয় হবে।’

গান্ধারীদি খুব মিষ্টি গলায় শান্ত স্বরে বললে, ‘শোনো দিদি, তোমার গুণের কোনও তুলনা নেই। কিন্তু তোমার একটাই দোষ। কথায় কথায় বড় রেগে যাও। আমি কি অতটা গোড়া থেকে বলব বলেছি? আমার কি বুদ্ধিশুদ্ধি নেই! তাহলে তো মা-র সঙ্গে বাবার বিয়ে দিয়ে শুরু করতে হয়। তুমিই বলো যেটা আগে সেটা আগের। যেটা পরে সেটা পরের। আমার বাবা বলত, গাঁদু আগে অ বলবি, তারপর আ বলবি তারপরে হ্রস্বই।’

মাসিমা বললেন, ‘তারপরে দীর্ঘ-ই বলবি, তারপরে হ্রস্ব-উ বলবি, তারপরে দীর্ঘ-উ বলবি তারপর…’ মাসিমা খেপে গিয়ে বলতে লাগলেন ‘ঋ, ৯, ও, ঔ তারপরে ক, খ, গ, ঘ। তারপরে দ্বিতীয় ভাগ তারপরে নবধারাপাত।’

গান্ধারীদি বললে, ‘ওই দেখো, আমি একটা উপমা দিলুম, তুমি কি-না রেগে গিয়ে বর্ণ পরিচয় পড়তে লাগলে। আমার মা কী বলত জানো? মানুষ রেগে অন্ধ হয়ে যায়, অন্ধ! আমার বাবার ডান পা-টা কী করে ভেঙেছিল জানো? রেগে গিয়ে।’

আমি মেঝের একপাশে বসে পড়েছি। থাক অঙ্ক। মাসিমার সঙ্গে গান্ধারীদির লাগলে সে যে কোথায় গিয়ে শেষ হবে!

মাসিমা বললে, ‘রেগে গিয়ে নিজের পা-টা দুমড়ে মটাস করে ভেঙে ফেললে।’

গান্ধারীদি বললে, ‘আরে না গো সে এক কাণ্ড। শোনোনা না! আমার বাবা যে কীরকম রাগি ছিল সে

তুমি না বললে বুঝতে পারবে না। মা বলেই বিয়ে করেছিল আমি হলে করতুম না।’

মাসিমা বললেন, ‘ছি ছি ছি! বাবাকে কেউ বিয়ে করে!’

গান্ধারীদি বললে, ‘দিদি তুমি সবই বোঝো কিন্তু বড় লেটে। দাঁড়াও তোমাকে বোঝাই। ধরো। আমি আমার মা। এবার আমার সম্বন্ধ হল আমার বাবার সঙ্গে। না, এটা তুমি বুঝবে না! আর। একটু খোলসা করি। ধরো আমার সম্বন্ধ হল আমার মায়ের স্বামীর সঙ্গে। কি ক্লিয়ার! খালি তুমি চরিত্রটা পালটে নাও। ধরো গান্ধারী মা তাহলে কী হত? আমি পরিষ্কার বলে দিতুম, এ লোককে আমি বিয়ে করব না।’

মাসিমা বললেন, ‘তার মানে তুই তোর বাবাকে ভালোবাসিস না ঘৃণা করিস।’ গান্ধারীদি ফুঁসে উঠে বললে, ‘সে যদি বলো তো তাই বলো। আমার অবস্থা দেখে তুমি বুঝতে পারো-না-যে আমার বাবা কেমন ছিল?

মাসিমা ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘তার মানে তুই বলতে চাইছিস এই বাড়িতে তোর অবস্থা খুব খারাপ। তাকিয়ে দেখ আমার সঙ্গে তোর তফাত কোথায়! আমি গোটাকতক পাস করেছি তুই করিসনি। যা, তুই আমার সঙ্গে কথা বলবি না। তুমি তোমার মতো থাকো আমি আমার মতো থাকি। তোর হাঁড়িতে তোর চাল ফুটবে আমার হাঁড়িতে আমার চাল!’

গান্ধারীদি কেঁদে ফেলেছে, ‘এই নাও, কী বুঝতে কী বুঝলে! তোমরা ছাড়া আমার আর কে আছে। গো। আমি কি তোমাদের পর? জেনে রাখো পর করলেও পর হচ্ছি না। তুমি সেই চেষ্টাই করছ। আমি কি জানি না!’

মাসিমা বললেন, ‘আমি চেষ্টা করছি!’

গান্ধারীদি এইবার হাপুস কেঁদে বলতে লাগল, ‘তা না হলে তুমি এমন কথা বললে কী করে তোর হাঁড়িতে তোর চাল আমার হাঁড়িতে আমার চাল!’

মাসিমা গান্ধারীদির চোখ মোছাতে মোছতে বললেন, ‘আমার হয়েছে পাগল আর পাগলি নিয়ে কারবার। ভাই দুটো বদ্ধ পাগল আর এই একটা পাগলি। তা বল তোর বাবার ঠ্যাং ভাঙল কী করে? না না ঠ্যাং বলাটা ঠিক হল না। তোর বাবার পা ভাঙল কী করে?

গান্ধারীদি একটু সামলে নিয়ে শুরু করল। ‘রোজ রাত্তিরে এক রাউন্ড পেটাপিটি তো হবেই। সেদিন মা বললে তুমি আমার গায়ে হাত তুলে দেখো তোমার বাপের নাম ভুলিয়ে দেব। তার আগের দিন মা একটা হিন্দি ছবি দেখে এসেছিল। একটা বোতল ভেঙে খোঁচা মতো করে। বাবাকে একবার শুধু ভয় দেখালে আজ তোমার ভুঁড়ি ফাঁসাব। বাবা অমনি ওরে বাবারে বলে। এমন দৌড় লাগাল, দাওয়া থেকে উঠোনে। পড়বি তো পড় গর্তে। সেই মাকেই যেতে হল। সদরে। পায়ে প্লাস্টার করে পড়ে রইল ন-মাস। ব্যবসা লাটে উঠল। দোকান বিক্রি হয়ে গেল। বাবা হয়ে গেল একটা জবুথবু জন্তুর মতো। তারপরে মা বিধবা হল। এই সব দেখে মা আমাকে একটা কথা বলেছিল। সেই কথাটা তোমাকেও বলে রাখি দিদি, মা বলেছিল, বুঝলে গান্ধারী। হিন্দি ছবির কোমর দোলানো মেয়ে হতে যেয়ো না। স্বামী যেমনই হোক দেবতা।’

মাসিমা বললেন, ‘তাই তুই হিন্দি ছবি দেখিস না এতদিন বুঝতে হল?’

গান্ধারীদি বললে, ‘আমার জন্মজন্মের যে বাবা সে তোমার ওই বড় দাদা আমাকে রেলস্টেশন থেকে তুলে নিয়ে এল গো। ছোট ছোট প্যাকেটে বাদাম বিক্রি করতুম। চুলে তেল নেই। পেটে ভাত নেই। ছেড়া ফ্রক। তারপর তুমি সবই তো জানো দিদি।’

মাসিমা বললেন, ‘তুই কি তোর মায়ের মতো হয়েছিস? তোকে কি তোর মায়ের মতো দেখতে রে?’

গান্ধারীদি বললে, ‘ঠিকই বলেছ। একেবারে মায়ের মতো দেখতে। আমাদের যখন অবস্থা ছিল। এখন আমি যেমন দেখতে আমার মাকেও ঠিক ওই রকম দেখতে। কপালে এতখানি একটা লাল টিপ। সুন্দর একটা শাড়ি। মা মন্দিরে যাচ্ছে মনে হচ্ছে যেন রাজরানি।’

মাসিমা বললেন, ‘জানিস তো গান্ধারী মাঝে মাঝে আমার মায়ের কথা বড্ড মনে পড়ে।’

গান্ধারীদি বললে, ‘মনের কথা মনেই রেখোদিদি মন খুলো না। সব মানুষই এখন আনমনা।’

মাসিমা বললেন, ‘বাঃ, চমৎকার একটা শব্দ বললি তো। আনমনা। আন-মাইন্ডফুলের বাংলা। তোর যদি বয়েসটা একটু কম হত আমি তোকে ডক্টরেট করাতুম।’

গান্ধারীদি বললে, ‘না বাবা আমি ডাক্তার হতে চাই না। বড়দাকে দেখে আমার শিক্ষা হয়েছে।’

মাসিমা বললেন, ‘কোথায় ডক্টরেট কোথায় ডাক্তার! এখন বল তোর মেসোমশাইয়ের কী হল?

গান্ধারীদি বললে, ‘মেসোমশাইয়ের বিছানার তলায় শালপাতায় মোড়া লাল জবা, বেলপাতা, মেয়েদের মাথার বড় বড় চুল। একটা লাল কাপড়ের টুকরো। কে না কে ঢুকিয়ে রেখেছিল! মেসোমশাই উদুরি হয়ে মারা গেল।’

মাসিমা বললেন, ‘তা বল পাতার সঙ্গে উদুরির কী সম্পর্ক!’

গান্ধারীদি বললে, ‘তুমি শহরে থাকো তো তাই এসব বুঝবে না। একে বলে তুকতাক। জানো সম্পত্তি হল কালসাপ। না-থাকা সে অনেক ভালো। যদি থাকে অশান্তির একশেষ। জানো তো আমার মেসোমশাইয়ের বড় ভাই এই কাণ্ডটা করেছিল। মা বলত, গেঁদো অনেক খেয়ে দুঃখে থাকার চেয়ে অল্প খেয়ে সুখে থাকা ভালো।’

মাসিমা বললেন, ‘একেবারে সার কথা। আমি তো এদের বলি পূর্বপুরুষরা করে গেছেন, দেখো, তোমরা যেন ভাইয়ে ভাইয়ে অশান্তি করে পুড়িয়ে ফেলোনা।’

গান্ধারীদি বললে, ‘তুমি যখন চুল এলো করে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকো তখন মনে হয় তুমি এই বাড়ির জগদ্ধাত্রী।’

মাসিমা বললে, ‘বাড়াসনি তো। এমনিই মানুষের অহংকার যায় না, সেই আগুনে আর ফু দিস না। এখন বল এগুলোর কী হবে।’

আমি এতক্ষণ শুনছিলুম চুপ করে। এই জগদ্ধাত্রী বলায় আমার মনে হল গান্ধারীদি ঠিকই বলেছে। মাসিমার মধ্যে কী একটা ব্যাপার আছে!

এইবার হল কী বড়মামা আমাদের নগেনকাকাকে নিয়ে হইহই করে ঘরে ঢুকে পড়ল। নগেনকাকার হাতে একটা খ্যাপলা জাল। সেই জালে অন্তত শ-খানেক নানা মাপের রুপোলি মাছ খলবল করছে। সারা ঘরে ছিরছির করে জল পড়ছে।

পুকুরের কিছু শ্যাওলা আর ঝাঁজিও রয়েছে। মাসিমা এক লাফে দোলনা চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠলেন, ‘এ কী একী!’

বড়মামার মুখে উদ্ভাসিত হাসি ‘দেখ দেখ কুসী কী অসাধারণ। কী সুন্দর। তোকে দেখাবার জন্যে দৌড়ে এসেছি। পুবদিকের পুকুরে জাল ফেলা হয়েছিল তো, দু-চোখ ভরে একবার দেখে নে।’ মাসিমা বললেন, ‘সত্যি বড়দা তোমার তুলনা তুমিই।’

নগেনকাকু হাসতে হাসতে বললেন, ‘জলের মাছ তাহলে জলেই ছেড়ে দিয়ে আসি দিদি।’

গান্ধারীদি বললে, ‘আমি একবার কোলে নিয়ে বসব।’

মাসিমা বললেন, ‘নানা না, সারা ঘর জলে জল, তোর কাজ বাড়ল।’

গান্ধারীদি বললে, ‘তা বাড়ুক, বসার ঘরে জ্যান্ত মাছ দেখেছ কখনও?’

বড়মামা হঠাৎ মেঝের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এ কী ছবির পেছন থেকে এগুলোকে কে টেনে বার করলে। কী সর্বনাশ।’

মাসিমা বললেন, ‘কেন, কে রেখেছে?’

বড়মামা বললেন, ‘আমি আমি।’

মাসিমা বললেন, ‘ওখানে রাখার কারণ?

বড়মামা বললেন, ‘মানুষ আঙুলে আংটি পরে কেন। মঙ্গলের জন্যে। তা বাড়িটা কী দোষ। করেছে। বাড়ির তো আর আঙুল নেই, থাকার মধ্যে আছে দেওয়াল। সেই দেয়াল টাচ করিয়ে সিদ্ধেশ্বরী কালীবাড়ির ফুল-বেলপাতা আর মায়ের শাড়ির আঁচল রেখে দিয়েছি। কেউ মাড়ায়নি তো! যা যা ঠিক যেমন ছিল রেখে দে, দেয়াল টাচ করিয়ে। তোকে কে এসব নাড়াচাড়া করতে বলেছে?’

গান্ধারীদি বললে, ‘লে হালুয়া, কাল রাত্তিরেই তো তুমি বললে, তোদের প্রত্যেককে সায়েব বাড়ি ঘুরিয়ে আনা উচিত। বাড়ি কী করে এন্টারটেন করতে হয়…!’

বড়মামা বললেন, ‘উঃ, আবার সেই ভুল ইংরেজি। এন্টারটেন নয়, মেনটেন।’ বলতে বলতে বড়মামা বেরিয়ে গেলেন। পেছন পেছন নগেনকাকু।

ঘরের মেঝেতে থইথই জল। সেই জলে একটা রুপোলি মাছ জাল গলে পড়ে গেছে। সেটা তিরতির করে লাফাচ্ছে। সেইদিকে তাকিয়ে গান্ধারীদি একটা অসাধারণ কথা বললে, ‘দেখো দিদি, এই বাড়ির সুখ এই বাড়ির আনন্দের মতো কীরকম মেঝেতে পড়ে আছে। পুকুরে দিয়ে আসি বলো। সুখটা আরও বড় হোক।’

শাড়ির আঁচলে মাছটা পুরে গান্ধারীদি বেরোতে বেরোতে বললে, ‘বিলু, বিলু আয় আয়। ওই অঙ্কটঙ্ক পরে হবে। এমন সুন্দর রোদ নীল আকাশ শরতের মেঘ। চল চল মাছ দেখি। ফড়িং দেখি। ফুল দেখি। পাখি পাখি…’

আমার আগে আগে গান্ধারীদি ছুটছে। পেছন পেছন আমি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *