Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

০৬.

বাঃ কী সুন্দর জায়গাটা! অনি বলল।

বলেছিলাম না? রিয়া বলল। পিকনিক-এ এলে এরকম জায়গাতেই আসতে হয়।

কী যেন নাম?

চট্টি নদী।

দাঁড়াও একটু আরাম করে বসি। খাওয়া-দাওয়ার কী হবে? ভজুকাকে সঙ্গে নিয়ে এলে বেশ হত।

শুধুমাত্র রান্নার জন্যে ভজুকা শুনলে দুঃখ পাবেন।

সংজ্ঞা বলল।

না। তা নয়। তোমরাই তো বললে একা একা আসতে চাও।

তিনজনে আবার একা একা। তাও দোকা দোকা এলেও বোঝা যেত। সেটা অবশ্য একটু বোকা বোকাও হত।

তোমাদের মধ্যে একজনকে তো বাদ দিতে হত। সেটা কি ভালো হত? কিন্তু কাকে?

সে তুমিই জানো।

সংজ্ঞা বলল, রান্না কিন্তু আমিই করব। মুগের ডাল, চাল, আলু, ডিম সব নিয়ে এসেছি। পুদিনা পাতা-ও। চাটনি বানিয়ে দেব। আর খিচুড়ির মধ্যে সেদ্ধ। খাওয়াটাই তো আসল নয়, আসল আসাটাই। এমন সুন্দর পরিবেশ, নির্জনতা। রান্নার বন্দোবস্তটা করি আগে।

আরে! দাঁড়াও তো রান্না হবেখন। খাওয়ার জন্যেই বাঁচা না বাঁচার জন্যে খাওয়া? আগে একুট গান-টান হোক। রিয়া কী বলছ?

আমাকে কি আর বলার চান্স দিচ্ছ? নিজেই তো প্রশ্ন করছ, নিজেই তার উত্তর দিচ্ছ। এখানে কিন্তু অনেক ভালুক আছে। বছর কয়েক আগে একজন ফোটোগ্রাফার যখন মনোযোগর সঙ্গে ছবি তুলছিলেন এখানকার ছিন ছিনারির তখন গুহা থেকে বেরিয়ে এসে একটা ভীমাকৃতি ভালুক তার পেছন খাবলে প্যান্টের দেড় গিরে কাপড় হাপিস করে দিয়েছিল।

ওরে বাবা! অনি বলল। চারদিকে ভালো করে একটু নজর রাখতে হয় তাহলে। আচ্ছা লোক তো তোমরা! বাড়িতে বন্দুক থাকতেও বন্দুকটা ফেলে এলাম। বলবে তো একবারটি।

বন্দুক সঙ্গে থাকলে তো অবলা নারীও ভালুক মারতে পারে। যদি ভালুক আসে, তুমি তার সঙ্গে কুস্তি লড়তে পারবে না? না পারলে আর কীসের পুরুষমানুষ!

পুরুষমানুষের পৌরুষের একমাত্র নিদর্শন কি কুস্তি লড়া? তা-ও ভালুকের সঙ্গে?

স্থান বিশেষে বটে।

গান-টান হবে কি হবে না? অধৈর্য গলায় বলল অনি।

তুমি গাও। সংজ্ঞা বলল।

এমন একটা গান বাছো যে, আমরা তিনজনে মিলেই যাতে কোরাস গাইতে পারি।

এই সেরেছে। তিনজনেই পুরোটা জানি এমন গান বাছার চেয়ে তো শাড়ি থেকে চোরকাঁটা বাছা সহজ।

অনিরুদ্ধ হেসে বলল, শাড়ি থাকলেই চোর থাকবে। আর চোর থাকলেই কাঁটা। এত কথা না বলে গানটা শুরু করলে হত না?

চলো, শচীনকর্তার একটা গান গাই। নিশ্চয়ই এই গানটা তোমরা সকলেই জানো, বাঁশি শুনে আর কাজ নাই, সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি।

সংজ্ঞাই হঠাৎ-ই ধরে দিল গানটি।

অনিরুদ্ধ হাতে তালি দিয়ে যোগ দিল গানটা জানে না বলে।

হাসিমুখে রিয়াও।

আস্থায়ী শেষ হতে না হতেই রিয়া উঠে পড়ে কোমরে আঁচলটি গুঁজে নিল। গানের সঙ্গে সঙ্গে নাচতে লাগল।

অনিরুদ্ধ মুগ্ধ হয়ে রিয়াকে বলল, বা : কী সুন্দর নাচো তুমি।

সংজ্ঞা বলল, বাঃ। ও যে আমাদের কলেজে শ্যামাতে শ্যামা হয়, মায়ার খেলাতে প্রমদা। দারুণ নাচে যে। কত মেডেল পেয়েছে।

অনিরুদ্ধ বলল, এরপরের বার শ্যামা হলে বোলো, আমি বজ্ৰসেন হয়ে আসব। আমাকে নেবে তো?

নাচ থামিয়ে, হাঁপাতে হাঁপাতে রিয়া বলল, যদিও কো-এড কলেজ। তবে মিস বোস হয়তো একটু গোলমাল করতে পারেন।

তিনি কে?

সংজ্ঞা বলল আমাদের গানের দিদিমণি।

আনিরুদ্ধ বলল, বিয়ে করেননি, খিটখিটে, বদমেজাজি নিশ্চয়ই?

কী করে জানলে? আশ্চর্য!

অনিরুদ্ধ বলল, জানি। সময়মতো বিয়ে না হলেই মেয়েরা এরকম হয়ে যান।

সংজ্ঞা বলল, ছেলেরাও হয়। আমাদের উপাধ্যায় স্যার? বল রিয়া? তা ছাড়া মনমতো মানুষ না পেলে বিয়ে করতেই বা যাবেন কেন?

তা ঠিক, মনের মতো মানুষ আর ক-জন পায়? পেলেও ভুল করে পরে। পরে সে আর মনের মানুষ থাকে না।

তোমার কথার তোড়ে রিয়ার নাচও বন্ধ হয়ে গেল, আর আমাদের গানও।

অনিরুদ্ধ বলল, সরি! ওয়ান-টু-থ্রি, আবার গান।

রিয়া গানের সঙ্গে সঙ্গে নদীর বালির ওপর নেচে চলল।

নাচ আরম্ভ করতেই রিয়া নিজে গান থামাল, দম-এর সুবিধের জন্যে। সংজ্ঞা আর অনি খোলা গলায় গাইতে লাগল দুজনে।

নাচ শেষ হতেই রিয়া একটি পাথরে বসে পড়ে বলল, বাবা :! হাঁপিয়ে গেলাম। নাচার অভ্যেসটাই চলে গেছে।

সাইকেলে চড়ে চড়াইয়ে-উতরাইয়ে আর অভ্যেস নেই কেমন? দম বাড়ে তো সাইকেল চড়লে।

এ অভ্যেস আর ও অভ্যেসে তফাত আছে।

রিয়া আর সংজ্ঞা সমস্বরে বলল, অনিদা এবারে তুমি একটি গান শোনাও আমাদের।

শোনাব। কিন্তু তোমাদের দুজনেরই নাচতে হবে সঙ্গে।

আমি?

সংজ্ঞা চোখ বড়ো বড়ো করে বলল।

কেন? তুমি নও কেন?

আমি কখনো-সখনো মুখে গরম আলু পড়ে গেলে অথবা গরম খিচুড়ি বেশি মুখে নিয়ে ফেললে নাচি। নাচের আমি কিছুই জানি না।

রিয়া বলল, ও নাচতে জানে। আজকাল নাচে না, শুধুই নাচায়।

ভালো হচ্ছে না কিন্তু রিয়া।

এবারে গানটা গাও। অনিকে বলল রিয়া।

অনিরুদ্ধ গান শুরু করল। একলাইন গেয়েই রিয়াকে বলল, নাচ থামলেই কিন্তু গানও থেমে যাবে।

ঠিক আছে।

অনি এবারে পুরো গানটা গাইল। রিয়া নাচল। সংজ্ঞা হাততালি দিল। ওদের নাচ-গানের শব্দ শুনে টিয়ার ঝাঁক এবং আরও লাল পাখি উড়ে গেল নীলাকাশের বুক চিরে।

নাচ ও গান থামলে সংজ্ঞা খুব জোরে অনেকক্ষণ ধরে হাততালি দিয়ে চলল। অনি আর রিয়া হাসছিল খুশিতে। এমন সময় সাইকেল ঠেলে মদন এসে নামল চটি নদীর এক্কেবারে খোলের মধ্যে। ওদের সামনে।

কী ব্যাপার? মদনদা? রিয়া ওকে দেখে বলল একুট নার্ভাস গলায়।

কোনোই বেপার নেই। শিমুল গাছতলায় দিল-ধড়কান, ঝাঁ-চকচক গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে দেখলাম। তারপর নাচনা-গানা-হিহি-হাহা, ফালানা-চামকানার খুশবু পেয়ে ভাবলাম তোমাদের খালখরিয়াত একটু পুছে যাই। সব মজেমে আছ তো?

হ্যাঁ। রিয়া বলল বাঁ-হাত দিয়ে কপালে পড়া অলকচূর্ণ সরিয়ে।

এই হিরো কে?

মদন অনিরুদ্ধর দিকে চেয়ে বলল।

এঁর নাম অনিরুদ্ধ বোস। চাটার্জিসাহেবের বাংলোতে এঁরা বেড়োতে এসেছেন।

ওঃ আর একজন ফসলি বটের। ফসল ফুরোলেই, ঠুকরে ঠুকরে খাওয়া হলেই ফুড়ুত করে উড়ে চলে যাবে।

মদন বলল স্বগতোক্তির মতো।

অনিরুদ্ধ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, নমস্কার। এমন বলছেন কেন, উড়ে নাও তো যেতে পারি।

লেহ লটকা। তাই!

বলেই, মদন হাত না তুলেই বলল, নোমোস্কার। পরণাম।

অনিরুদ্ধ বলল, আসুন আসুন এই পাথরে বসুন। নাচ-গান হচ্ছে।

হামি কী করব? না গান জানি, না লাচ?

খেতে তো অন্তত পারেন? খিচুড়ি হবে। খেয়ে যান আমাদের সঙ্গে মদনবাবু।

আপনি হামার নাম জানলেন কী কোরে?

আপনি যে স্বনামধন্য ব্যক্তি। রিয়া ও সংজ্ঞার কাছে আপনার কথা বহু শুনেছি। হিরো তো হচ্ছেন আপনিই। কথায় কথায় লোককে পেঁদিয়ে তুলো ধুনে দেন!

ওরা বলেছে ই সব?

হ্যাঁ। এই এরাই বলেছে। আপনার অ্যাডমায়ারার তো!

একটুক্ষণ চুপ করে থেকে, একটু ভেবে নিয়ে, মদন বলল, হিরো ছিলুম হয়তো একসোমোয়। এখন দেখছেন তো ভিলেইন বনে গেছি।

ছিঃ ছিঃ। সে কী কথা!

ঠিকই কোথা। তবে আমি এখন চলছি অনিরুধবাবু। একগুহাতে দু-দুইটা মদ্দা বাঘ থাকে না। থাকলেই খ্যাঁকোখেঁকি। ফিন কভি মিলেঙ্গে। আব চলে। নোমোস্কার।

উঠে দাঁড়িয়ে দু-হাত জোড় করে অনি বলল, নমস্কার।

মদন কিছু না বলে একবার রিয়া আর একবার সংজ্ঞার দিকে চেয়ে ডানহাতে সাইকেলের হ্যাঁণ্ডেল ধরে বাঁ-হাতে চিকন গোঁফে একবার চুমকুড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে জঙ্গলে মিলিয়ে গেল সঁড়িপথ বেয়ে। সাইকেলে উঠবে বড়োরাস্তাতে পড়ে।

রিয়া একটু পরে বলল, ছন্দপতন ঘটে গেল।

তা গেল। একেবারেই। সংজ্ঞা বলল।

রিয়া বলল, এই তো সবে পতন। এরপর মূৰ্ছাও যেতে হতে পারে আমাদের। আমাদের কলেজের সব মেয়েদেরই ওরা যেন লোকাল গার্জেন! এই যে দেখে গেল না আমাদের, দেখিস এর জের কতদূর অবধি যায়। এদিকে কী করতে এসেছিল কে জানে!

সংজ্ঞা বলল, সেলফ-অ্যাপয়েন্টেড গার্জেন সব!

গার্জেন না ছাই। যে রক্ষক সে-ই ভক্ষক।

রিয়া বলল।

ওরা মানে? কারা? অনিরুদ্ধ বলল।

এই মদনদা। বীরজু সিং বলে একটি সাংঘাতিক গুণ্ডা আছে। যখন তখন মুরগি জবাই করার মতো করে মানুষের টনসিলের নীচে ছুরি চালিয়ে শ্বাসনালি কেটে দেয়। আর একজনও আছে। নইমুদ্দিন। আরও কত আছে। এদেরই তো দিন এখন। পুলিশ আর পলিটিকাল লিডাররাও এদের তোয়াজ করে। ইলেকশানের সময় কাজে লাগে যে।

সংজ্ঞা বলল, আমাদের মান-সম্ভ্রম সবই ওদের হাতে। সমীহ করে মাথা ঝুঁকিয়ে বেঁচে থাকতে হয়।

অনিরুদ্ধ বলল, কমবেশি মাথা ঝুঁকিয়ে সবাই বাঁচে। মানে, বাঁচতে হয়। মাথা উঁচু করে বাঁচার মত মানুষ এদেশে সত্যিই বড়ো কমে আসছে। ঠাকুরদা এই কথাটা প্রায়ই বলেন। তবু চেষ্টা করা তো সকলেরই উচিত মাথা উঁচু করে বাঁচার। প্রশ্বাস নেওয়া, নিশ্বাস ফেলা আর বেঁচে থাকা তো সমার্থক নয়! কী বলো সংজ্ঞা? রিয়া?

ওরা কথা না বলে অনিরুদ্ধর চোখে চেয়ে রইল বিস্ময়ে।

.

০৭.

অনিরুদ্ধ বিকেলে হাঁটতে বেরিয়েছিল। সংজ্ঞাদের বাড়ির সামনে এসে দেখল সংজ্ঞা গেট ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

কী হল? বেরুচ্ছ, না ফিরলে?

না:। বেরুব। আমি হাঁটি না রিয়ার মতো। তোমাকে দেখেই সাধ হল।

তাহলে চলো, সাধ মেটাবে।

সংজ্ঞা একটা ফলসা-রঙা তাঁতের শাড়ি পরেছে। এলো খোঁপা। গায়ে একটি হলুদ শাল। পায়ে চটি।

ও বলল, বেশিদূর যাব না কিন্তু। চলো, বড়োরাস্তা ছেড়ে দিয়ে এই রাস্তাতে ঢুকি। দেখেছ, তিনটি রাস্তা বেরিয়ে গেছে তিনদিকে। এরকম মোড়ের মাথায় এসে কোন পথে যাব তা নিয়ে বেশ ভাবনা হয়, তাই না? এইটাতেই চলো!

হয়। শুধু বনের পথ নয়; মনের পথেও। বেশ তোমার মনোনীত পথেই চলো।

তারপরই অনি বলল, কী সুন্দর লাগছে জঙ্গলের গায়ের গন্ধ। এই নির্জনতা, এই আবেশ, এই ধোঁয়ো-মুক্ত আবহাওয়া, ইচ্ছে করে থেকে যাই সারাজীবন।

ইচ্ছে করলেও পারবে না।

কেন? পারব না কেন?

লোভ। আরও চাই আরও চাই-এর লোভ। জানো, পরীক্ষায় বসার পরই একটি চাকরির অফার আসে আমার। অ্যাডভার্টাইজমেন্ট কোম্পানি থেকে। তিন হাজার টাকা মাইনে। আমি নেব না ঠিক করছি।

সে কী! কেন? অ্যাডভার্টাইজমেন্ট তো ভবিষ্যৎ পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধিশালী লাইন।

তা হতে পারে। কিন্তু লেখাপড়া শিখে অনেক কিছুই তো করার থাকতে পারে, তেল সাবানের বিজ্ঞাপন লেখার মতো মহৎ কর্ম আমার দ্বারা হবে না। এই টি ভি আসার পর সাধারণ মানুষের লোভ আর চাহিদা কেমন বেড়ো গেছে দেখেছ! সকলেরই সব চাই। কিছুই না হলে কারওরই চলছে না। তা তাদের কেনার সাধ্য থাক আর নাই-ই থাক। সাধ্যের চেয়ে সাধ যেই বেশি হয় অমনি মানুষ তলিয়ে যেতে থাকে। মিথ্যে কথা বলে চোখের পাতা না কাঁপিয়ে ঘুস খায়, রেস খেলে, স্মাগলিং করে। আরও কত কিছু করে। মানুষের মনে এই বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় জিনিসের প্রতি লোভ জাগিয়ে তোলা, সেই জিনিসগুলিকে অবশ্য প্রয়োজনীয় মনে করানোর কৃতিত্বই বিজ্ঞাপনের। তুমি দেখো, বিজ্ঞাপন যেমন ব্যাবসার ভালো করে তেমনই একদিন মানুষের সার্বিক বিপদ ডেকে আনবে। নিজের চাহিদা কমিয়ে আনার মতো সুখ আর নেই। সেই হচ্ছে আসল সুখ।

বাঃ। তোমার কথাগুলি ভেবে দেখার মতো। কিন্তু তুমি যাকে বিয়ে করবে সে যদি অন্যরকম হয়? তবে? আজকাল তোমার মতো মানসিকতা আর ক-জনের?

তেমন মানুষকে বিয়েই করব না। আমার স্বামী এমন মানুষ হবে যে সৎপথে থাকবে, সে যাই এনে দিক না কেন আমি সেটা দিয়েই আমার সংসার সুন্দর করে সাজাব। প্রবল সাচ্ছল্য আর সুখ এককথা নয়। এটাই অনেকে বোঝে না। তাকে দেখব, তার জন্যে নিত্যনতুন রান্না করব। তার দেওয়া সন্তান যত্ন করে মানুষ করব যাতে সেও তার বাবারই মতো সৎ, ঋজু হতে পারে।

বা:। তেমন মনের মানুষ কি পেলে? অনিরুদ্ধ চলতে চলতে দাঁড়িয়ে পড়ে সংজ্ঞার মুখের দিকে চেয়ে বলল।

খুঁজিনি তো। সময় অনেকই আছে। সময় হলে সে-ই এসে আমাকে খুঁজে নেবে। আমার কোনো তাড়া নেই। কিছুতেই তাড়া নেই।

যদি বুঝতে না পারো?

কী?

যদি সে এসে ফিরে যায়?

তা হবে না। বুঝতে ঠিকই পারব। আমাকে কি এতই বোকা ভাবো?

না। বোকা ভাবলে তোমার সঙ্গে একটু সময় কাটাবার জন্যে ছটফট করি কেন?

সে তো রিয়ার সঙ্গে কাটাতেও করো।

জানলে কী করে? তবে একটা কথা বলি যে, রিয়াও বোকা নয়, তবে চালাকেরও নানারকম আছে।

জানি। তবে রিয়া রূপেগুণে আমার চেয়ে অনেক ভালো। হয়তো চালাকিতেও।

তোমার চোখে। আমার চোখে তো নাও হতে পারে।

একথা তুমি রিয়াকেও বলেছ? মানে আমাকে খুশি করার জন্যে যা বললে?

রেগে উঠে অনিরুদ্ধ বলল, তুমি আমাকে কী মনে করো?

মনে করা-করির সময় তো এখনও পেরিয়ে যায়নি। রাগ কোরো না। কথাটা আমি তোমাকে আহত করার জন্যে বলিনি।

তোমাদের মেয়েদের এই দোষ। তোমার সঙ্গে কি আমার কোনো আলাদা কথা হতে পারে না? সবসয়ম রিয়ার প্রসঙ্গ টেনে আনো কেন?

আমার আর রিয়ার সঙ্গে একই দিনে একই সময়ে একই সঙ্গে তোমার আলাপ হয়েছিল বলে।

হলেই বা। সকলকে কি সমান ভালো লাগে?

কী করে তা আমি জানব?

কী বললে জানতে পারবে?

কিছু বলতে হবে না তোমার। বলেই, ডান হাত তুলে অনিরুদ্ধর মুখ চাপা দিল সংজ্ঞা। বলল, কিছু কথা থাকে, যা না বললেই বেশি করে বলা হয়। যে বোঝার, সে বোঝেই, মাইক্রোফোনে মুখ লাগিয়ে চিৎকার করতে হয় না।

তোমাকে আমি বুঝি না।

বোঝবার জন্যে উঠে পড়ে লেগো না। তাহলেই বুঝবে। সময়ে সবই হয়। সময়কে সময় দিতে হয়, বুঝলে বোকা ছেলে।

তোমার পাশে এলে আমার এত ভালো লাগে কেন বলো তো?

আমার পাশে এলে নয়। এটা প্রকৃতিরই গুণ। সেই যে রবীন্দ্রনাথের গান আছে না? ফুলের বনে যার পাশে যায় তারেই লাগে ভালো। সেইরকমই আর কী! কার পাশে আছ সেটাই বড়ো। এই আমারই পাশে তোমাদের কলকাতার চৌরঙ্গিতে হেঁটে দেখো, বমি পাবে। সত্যি! কলকাতায় কেন যে মানুষ থাকে! টাকা! টাকা! টাকা! এত টাকার দরকার কী? এই গামারিয়ার শান্তি কি কলকাতার কোটিপতিরাও কখনো কিনতে পারবে?

না। তা ঠিক। আমার ইচ্ছে করে এখানেই থেকে যাই। কে জানে? ভবিষ্যতে হয়তো থেকেই যাব।

পারবে না। আমি কি রিয়া, কেউই তোমাকে ধরে রাখতে পারব না। তোমার বাবার কত বড়ো ব্যাবসা, তোমরা কত বড়লোক। সেসব বজায় রাখতে তোমার কলকাতাতেই থাকতে হবে, নইলে সবাই বলবে ছেলেটা বকে গেল। এত বড়ো ব্যাবসা নষ্ট করে দিল।

আর নিজে যে নষ্ট হয়ে যাব?

সেটা যদি বিবেকের কথা হয় তো অন্য কথা। জীবনের সব সিদ্ধান্তই নেবার আগে অনেক ভাবতে হয়। মা-বাবা দুঃখ পাবেন, দাদু-দিদা দুঃখ পাবেন যাতে, এমন কাজ কি করা উচিত?

বাঃ রে! আমার জীবন আমার। আমি তো বাবার সম্পত্তি চাইছি না। আমার জীবনটুকুকে আমার খুশিমতো চালাবার স্বাধীনতাই চাইছি মাত্র।

এই চাওয়াটুকু সামান্য চাওয়া নয়। এরজন্যে অনেক দাম দিতে হবে। সেই দাম দেওয়ার জোর অনেকেরই থাকে না। এসব কথা নাটক-নভেলের নায়করা সহজে বলে। সহজেই। জীবনে তা করে দেখানো বড় কঠিন অনি। অত ছটফট কোরো না।

বেলা পড়ে আসছিল।

সংজ্ঞা বলল, চলো ফিরে যাই।

চলো। অনিরুদ্ধ বলল। ফিরে যাবার জন্যেই তো আসা। সব আসা। সর্বত্র আসা। ভাবলেও মন খারাপ হয়ে যায়। তাই না?

সংজ্ঞা উত্তর না দিয়ে শালটা একবার খুলে ভালো করে বুক ও ঘাড় ঢেকে নিল। বলল, আবার আমার জ্বর-জ্বর লাগছে। আমি কেবলই অসুখে ভুগি। মরে যেতে ইচ্ছে করে আমার।

ছিঃ, অমন কথা বোলো না।

সংজ্ঞার বাঁ-হাতের পাতাটি নিজের ডান হাতে নিয়ে অনিরুদ্ধ বলল, আমার সামনে অন্তত বোলো না। আমার কষ্ট হয়।

সংজ্ঞা চকিতে একবার মুখ ঘুরিয়ে অনিরুদ্ধর মুখের দিকে তাকাল। তার মুখের সারল্য ও সততা সংজ্ঞাকে হঠাৎ-ই কিছু করল। নিজের কারণে, অনিরুদ্ধর কারণে বড়ো ভয় করতে লাগল ওর।

.

০৮.

পায়ে গলফ শু, পরনে ফেডেড জিনস। ওপরে হলুদ ফুলশার্ট। তার ওপরে নেভি-ব্লু ফুলহাতা কার্ডিগান। মাথার চুল পনিটেইল করা। হাতে একটি সরু লাঠি। রিয়া হাঁটছিল সকালে।

মা বলেন, পরীক্ষার আগে সারাদিন-রাত বসে বসে পড়া করো, খেলা নেই, ধুলো নেই এক্সারসাইজ বলতে শুধু সপ্তাহে দুবার পান্ডে স্যার আর একবার ইংরিজি স্যারের কাছে সাইকেলে চড়ে যাওয়া তাই।

নির্জন জঙ্গলাকীর্ণ রাস্তা। তখনও শিশিরে ভিজে আছে চারপাশ। শিশির-ভেজা হেমন্ত প্রকৃতির গন্ধ উঠছে চারপাশ থেকে। টিয়ার ঝাঁক ট্যাঁ-ট্যাঁ করতে করতে উড়ে যাচ্ছে মাথার ওপর দিয়ে। তিতির বটের ঘুঘু বনমুরগি ডাকছে থেকে থেকে। ভারি একটা শান্তি এখানে।

অনিরুদ্ধর কথা ভাবতে ভাবতে যাচ্ছিল রিয়া। এমন সময় ওর ভাবনাকে খানখান করে ছিঁড়ে দিয়ে উলটোদিক থেকে একটা মোটর সাইকেল তার কুৎসিত ভটভটানিতে সকালের স্নিগ্ধতার নির্মোক ছিঁড়ে লাফাতে লাফাতে এগিয়ে আসতে লাগল।

আরোহীর পরনে কালো রঙা গরম প্যান্ট আর গায়ে লালরঙা খদ্দরের পাঞ্জাবির ওপরে নীলরঙা র‍্যাপার। মাথায় বাঁদুরে টুপি। গোটানো। মোটা-সোটা দেখতে। দেখলেই মনে হয় লোকটা খারাপ। কাছে আসতেই, চিনতে পারল রিয়া। বীরজু।

রিয়া রাস্তার একপাশে সরে গেল। তার কাছাকাছি আসতেই দেখল পেছনেও একজন আরোহী। তারা দুজনে রিয়ার উদ্দেশেই বলল, বনকি পঞ্ছি খো গয়ি ক্যা? ঘর পঁহুছা দু আপকি?

রিয়া গম্ভীর গলায় বলল, থ্যাঙ্ক ঊ্য! আপলোগ আপনে রাস্তেমে যাইয়ে।

জি মালকিন। বলেই বীরজু সিং হাসল।

তারপর বলল, কোই রোজ হামারা রাস্তা ঔর আপকি রাস্তা মিল যানা চাইয়ে।

তারপরই ফুচুর-ফুচুর করে দুজনে হাসতে হাসতে ঘুসুর ঘুসুর করে কথা বলতে বলতে বলতে ভাঁকের মুখে সিটের উপর লাফাতে লাফাতে হারিয়ে গেল।

ওরা চলে যেতেই দেখা হল অনিরুদ্ধর সঙ্গে। কালো রঙা জগিং স্যুট, সাদা নর্থস্টার জুতো, জগিং করতে করতে আসছে।

থেমে পড়ে বলল, গুড মনিং।

ভেরি গুড মর্নিং। চলো আমার সঙ্গে। আজকাল একা-একা হাঁটাচলা করাও মেয়েদের পক্ষে, বিপজ্জনক। বিহারের এই অঞ্চল আর আগের মতো নেই।

কে, কী হল? আমরাই কি ব্যাড এলিমেন্টস?

হেসে ফেলল রিয়া। বলল, একটু আগেই দেখলে না মোটর সাইকেল?

ওঃ। ওদের কথায় কান দাও কেন! আমাকেও তো বলে গেল।

তোমাকেও? কী বলল?

অবাক গলায় বলল রিয়া।

সুর করে ডুয়েট গাইল, বাবু দেখো, দেখো, চিঞ্জারকো দেখো। অনেকটা সেই ও গোরে। গোরে, ও বাঁকে ছোড়ের মতো সুর করে।

রিয়া হি হি করে হেসে উঠল। অনিরুদ্ধর কথা শুনে।

বাঃ। তোমার দাঁতগুলো কী সুন্দর? অনিরুদ্ধ বলল।

আগে দেখোনি?

তুমি তো হাতি নও যে, সবচেয়ে আগে তোমার দাঁতই চোখে পড়বে। না দেখালে দেখি কী করে?

সে খালি দাঁতই বা কেন? আমরা নিজেরা না দেখালে পুরুষরা কতটুকুই বা দেখতে পায় মেয়েদের?

অনিরুদ্ধ হেসে বলল, তা সত্যি!

তারপর বলল, তুমি কি রোজই হাঁটতে বেরোও নাকি?

প্রায়ই।

আর সংজ্ঞা?

না। ও খুব ভোরে উঠে পড়াশুনো করে। পড়াশুনোয় খুব ভালো তো ও।

আর তুমি?

দুর। বেশি পড়াশুনো করে কী হবে? যদি ইউনিভার্সিটিতে ফাস্ট হতে পারতাম তো অন্য কথা ছিল। নইলে আর কী! গড়িয়ে গড়িয়ে শুয়ে-বসে একটা ফার্স্ট ডিভিশন পেলেই খুশি আমি। আমি তো ব্যাবসা করব। পড়াশোনায় বেশি ভালো হওয়াটা একটা ডিসকোয়ালিফিকেশান সেখানে।

কীসের ব্যাবসা করবে?

ঠিক করিনি। ভাবছি, লাইন নিয়ে। তবে করব ঠিকই। বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী। চাকরিও করব না, বরের রোজগারে ঘরে বসেও খাব না।

আমরা পয়সা চাই, পয়সা। টাকা থাকলে জগৎ বশ।

লিবারেটেড উত্তম্যান একেবারে। তা বরের পয়সায় খেতে এত ভয় কেন?

বদহজমের। কথায় কথায় খোটা শোনার। আমি রোজগার করে বাড়িতে বরকে রেখে দেব। আমার জন্যে বিরিয়ানি রাঁধবে, ফুল সাজাবে, কুকুরকে চান করাবে, পার্টি থাকলে গেস্টদের দেখাশোনা করবে।

আর?

আর রাতে আমার পা টিপে দেবে আর যদি কখনো আমার ইচ্ছে করে, শুনতে পাচ্ছ?

পাচ্ছি।

যদি ইচ্ছে করে আমার; তাহলে আদর করবে। দুধেভাতেই রাখব তাকে লালুছেলে করে। পুজোয় আর পয়লা বৈশাখে নতুন জুতোমোজা জামা কিনে দেব, সুইটি বলে ডাকব তাকে।

হাসছিল অনিরুদ্ধ হো-হো করে রিয়ার কথাতে। হাসি থামিয়ে বলল, তোমার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক। তোমার কল্পনা যেন সত্যি হয় তবে তোমার বর তোমাকেই খুঁজতে বেরুতে হবে। কোনো আত্মসম্মানজ্ঞানসম্পন্ন পুরুষমানুষ তোমাকে বিয়ে করবে না।

ফু:। একজন আত্মসম্মানজ্ঞান সম্পন্ন পুরুষ বাছতে হলে গাঁ কে গাঁই উজাড় হয়ে যাবে। পুরুষগুলোআত্মসম্মান কাকে বলে জানেই না। জানোয়ার; নাইনটি নাইন পার্সেন্ট।

আমিও?

না, তুমি ওই ওয়ান পার্সেন্টের মধ্যে পড়ো।

যাক। বাঁচা গেল। বলেই, বলল, এদিকটাতে জঙ্গল বেশ ঘন, না?

হ্যাঁ। ঘনই তো। ওই দেখো, দূরে দেখা যাচ্ছে ম্যাকলাস্কিজ নোজ। এসো, এসো, দেখো, ঠিক একজন মানুষের নাকের মতো নয়?

সত্যিই তো।

এসো, এখানে একটু বসি।

ওরা বসল।

তোমাকে কিন্তু জিনস পরে বেশ দেখাচ্ছে।

কেন? শাড়ি পরলে কি খারাপ দেখায়?

তা নয়, তোমাকে হয়তো দেখায় না; তবে জিনস সব মেয়েকে মানায় না।

যেন সব ছেলেকেও মানায়। তাদের বেলা দোষ হয় না!

বাঃ তারা যে ছেলে! ছেলেদের ওপর তোমার এত রাগ কেন বলো তো?

এ জন্মে ছেলে হয়ে জন্মাইনি বলে। আর কেন?

ওটা কী গাছ?

দূরে একটি বড়ো গাছ দেখিয়ে অনিরুদ্ধ শুধোল।

কে জানে! তা ছাড়া আমি তো বটানি নিয়ে পড়িনি।

বুদ্ধদেব গুহর বইয়ে নানারকম গাছের বর্ণনা থাকে। তাইতো আমি নাম দিয়েছি গেছো বুদ্ধদেব। রিয়া বলল। বুদ্ধদেব গুহর বই সংজ্ঞার খুব প্রিয়। কেবলির মতো চিঠি লিখেছিল লেখককে। তার ওপর উত্তরও পেয়েছে। যেমন কেবলি পাঠিকা, তেমন ক্যাবলা লেখক। ভালো এবং বড়ো লেখকরা কোনো ফালতু পাঠিকার উত্তর দেন নাকি! দিলে তো প্রমাণিত হয় যে, লেখক ভ্যাগাবণ্ড। কোনো কাজকর্মই নেই।

রবীন্দ্রনাথ বুঝি দিতেন না?

ছাড় তো। বাবার জমিদারি ছিল। খেটে তো খেতে হয়নি। পাগল না হলে কেউ একজীবনে অত চিঠি লিখতে পারেন?

তা ঠিক।

কালকে এই পথেই একটি কোটরা হরিণ দেখেছিলাম।

সেটা কী আবার? হরিণ তো জানি, কোটরা আবার কী?

আহা কোটরা মানে বার্কিং-ডিয়ার। একেবারে অ্যালসেশিয়ানের ডাক বলে মনে হবে। কিন্তু থেমে থেমে ডাকে।

তাদের গায়েও কি ছিট থাকে সাদা সাদা?

না। তাদের গা-টা লাল। ছিট থাকে। তবে মাথার ভেতরে। তোমার যেমন আছে।

তাই?

নেই তো কী! ছিটেল লোকেরাই অন্যদের পাগল ভাবে।

যেই যাকে ভালোবাসে, সেই ভালোবাসার জন প্রথমজনের কাছে সবসময়ই পাগল।

তুমি তো আমাকে ভালোবাসো না।

কী করে জানলে?

যারা মনে করে সব চালোবাসে তারা আসলে নিজেকে ছাড়া আর কাউকেই ভালোবাসে না।

কথাটা বেশ বলেছ। তুমি খুব ভালো কথা বলো।

কথায় ভালো হয়ে লাভ কী? কাজে ভালো হলে তবে না হত।

কথার লোককে কথাই খেয়ে ফেলে শেষকালে। তার কপালে কিছুই জোটে না।

কী জোটার কথা বলছ?

কোনো বিশেষ কিছুর নয়। সব কিছুই।

অনিরুদ্ধ উঠল। বলল, চলো আমাদের বাড়ি ব্রেকফাস্ট করে যাবে।

ও-ও উঠে পড়ে বলল, নাঃ। মা আমার জন্যে দারুণ ব্রেকফাস্ট করে রেখেছিলেন। প্রতিরাতেই রাখেন। তাই খেয়ে এসেছি। মুখ একেবারে ভরে আছে।

কী তা?

চিরতার জল। এখন বাড়ি গিয়ে চান করব। তারপর সবকিছু।

ওরা ফিরতে লাগল।

অনিরুদ্ধ বলল, তোমাকে দেরি করিয়ে দিলাম বলে তুমি কি বিরক্ত হলে?

তাই কি মনে হল তোমার? প্রতিবছরই তো কত চেঞ্জার আসে এখানে কিন্তু তোমার মতো কেউই আসেনি আগে। তোমরা চলে গেলে যে কী হবে। ভারি ফাঁকা ফাঁকা লাগবে।

চলে যাবার জন্যেই তো আসা। কে আর চিরদিনের জন্যে আসে বলো?

আসে তো কেউ কেউ। চিরদিনের মানুষ তো সকলের জীবনেই আসে। আসে নাকি? একদিন না একদিন?

অনি কথার মানে বুঝতে পেরেও না বোঝার ভান করে কথা ঘুরিয়ে বলল, তা ঠিক।

ওরা এগিয়ে চলল।

.

০৯.

পান্ডে স্যারের কোচিং ক্লাস সবে শেষ হল। দশ-পনেরোজন ছেলে-মেয়ে বেরুল ক্লাস থেকে কলকল করতে করতে। বেশিই বিহারি, বাঙালি কম।

পথের ওপরেই পান্ডে স্যারের বাড়ির একটু পরই মস্ত আয়না-বসানো একটি পানের দোকান তেমাথার মোড়ে। তিন দিকে তিনটি পথ বেরিয়ে গেছে। সেখান থেকে। দোকানের সামনে ভিড় লেগেই থাকে। দু-পাশে দুটি বেঞ্চ পাতা। রঙিন প্লাস্টিকের চিরুনি, রাবারের বল, সস্তা প্লাস্টিকের খেলনা, চা, বিস্কুট, পেনসিল, বলপয়েন্ট পেন ইত্যাদি থাকে। তবে মঘাই, কলকাত্তাই মিঠাপাত্তি এবং মাদ্রাজি পানও থাকে এ দোকানে। কাছের ই সি এল,-এর (ইস্টার্ন কোলফিল্ডস লিমিটেড) কলিয়ারির, মাদ্রাজি কেরানিবাবুরাও পান খেতে আসেন এ দোকানে।

কোনো কোনো ছেলে পান-সিগারেট খাবার জন্যে সাইকেলে হেলান দিয়ে দাঁড়াল দোকানের সামনে। দুজন মেয়েও গুটকা খাবার জন্যে। রিকশা করে দুটি মেয়ে চলে গেল। একটি বোরখা পরা মুসলমান মেয়ে নিজস্ব রিকশাতে উঠে পর্দা ফেলে দিয়ে চলে গেল। বোরখা পরেই সে ক্লাস করছিল।

আজ সংজ্ঞা আসেনি ক্লাসে। আগামীকাল দেওয়ালি। সেজন্যে নয়, সংজ্ঞার জ্বর হয়েছে গত দু-দিন থেকে।

রিয়া সাইকেল ঠেলে নিয়ে পান্ডে স্যারের বাড়ির কম্পাউণ্ড থেকে একটু দেরিতেই বেরুল। একটি গুণ্ডা প্রকৃতির ছেলে, রিয়াদের চেয়ে বয়েসে অনেক বড়ো, পানের দোকানের সামনের বেঞ্চে বসেছিল। তার ঠোঁট পানের রসে আর চুনে ফাটা। মুখে সিগারেট। একটি নোংরা পায়জামা ও হাতে বোনা খদ্দরের পাঞ্জাবি পরে সে একটি পা বেঞ্চে তুলে একটি পা মাটিতে তার চটির ওপরে রেখে বসেছিল। তার পাশেই তার ঝিং-চাক লালনীল আলো লাগানো মোটর বাইক দাঁড় করানো আছে। সে-ই বীরজু। সিগারেটে টান দিয়ে ধুয়ে আকাশের দিকে ছুঁড়ে সে বলল, চ্যাটার্জিসাহেব কি বাংলোমে কওন হিরো আয়া?

রিয়া চমকে চাইল বীরজুর দিকে। বীরজুও একসময় পান্ডে স্যারের কোচিং ক্লাসের ছাত্র ছিল তবে ফার্স্ট ইয়ারে উঠেই পড়াশুনো ছেড়ে দিয়ে বাবার বিড়ি পাতার ব্যাবসাতে লেগে গেছিল। এক বছর হল বাবা মারা যাওয়ার পর ব্যাবসা মাথায় তুলে বাবার জমানো টাকাতে বসে খেয়ে রংবাজি করে বেড়ায়। মাস্তানি। সব ছেলে-মেয়েরাই তাই ওকে সমীহ করে চলে যদিও পছন্দ করে না কেউই।

রিয়া বলল, ম্যয় ক্যায়সি জানু?

কাহেলা? তারা আঁখো ছিন লিয়া ক্যা হীরোনে?

রিয়া ওকে পেরিয়ে এগিয়ে যেতেই বীরজু বলল, হুয়া ক্যা? যযা পুছিন ম্যায়, উসকি জবাব দে কর তব যানা।

রিয়া অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে ছিল। বলল, আপ আওরত তো নেহি না হ্যায়। উনকো ঘর যা কর পুছা না চাহিয়ে। ম্যায় হিরোকি প্রাইভেট সেক্রেটারি থোরি হুঁ।

সিক্রেটারি কি বাঁতে মুঝে নেহি মালুম, মগর পেরাইভেট কুছ যে হ্যায়ই হ্যায়, উসমে কোই শক নেহি।

জবান সামহালকর বাতে করনা।

রিয়া উত্তেজিত হয়ে বলল।

কা? কা বোলিন তু নামকিন পনছি? মেরি পেয়ারি? দিখোগি জবান?

এমন সময় মদন এসে হাজির হল অকুস্থলে। হেঁটে হেঁটে। হো ক্যা বীরজু দাদা?

একজন বলল, ভিড়ের মধ্যে থেকে, আজ দোপহরসেই পি রহা হ্যায়।

তেরা বাপকি পয়সাসে থোরিই পি রহা হ্যায় রে। জবান সামহালকে বাতে করনা ছেলেটি বলল।

দিখোগে জবান? বলেই তড়াক করে লাফিয়ে উঠল বেঞ্চ ছেড়ে।

কোচিং ক্লাসের ছেলেরা তাকে ঘিরে ফেলল। একজন বলল, তুম অ্যায়সা করতে রহোগে তো কোতোয়ালিমে বোলনাহি পড়েগা হকরোজ।

কোতোয়ালি মত দিখানা হামে। সারে কোতোয়ালি জেরমে রাখা হুয়া হ্যায়, বহত দিখা হ্যায়। বাহারওয়ালে ছোকরা আ কর হিয়া রংবাজি করে গা ঔর তুমলোগোনে দিখতা রহোগে। অজীব চিড়িয়াঁয়ে সব।

মদন বলল, কী হল? হলটা কী?

বলেই, মদন এগিয়ে এল।

রিয়া ততক্ষণে সাইকেলে উঠে পড়েছে। কিন্তু বীরজুও বেঞ্চ ছেড়ে উঠে পড়ে রিয়ার সাইকেলের ক্যারিয়ার ধরে টান লাগাতেই টাল সামলাতে না পেরে রিয়া প্রায় আছড়ে পড়েই যাচ্ছিল। চলমান সাইকেল থেকে কোনোক্রমে নেমে পড়ল রিয়া।

কী হয়েছে রে রিয়া?

মদন শুধোল গার্জেনের মতো।

ওকেই জিজ্ঞেস করো না।

জিগিস ফিগিস করার কী আছে? ক্যাবে মদন, তু নেহি জানতে কি? তুমহি না বোলা?

কী?

ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন ছেলে বলে উঠল, চ্যাটার্জিসাহাবের বাংলোতে আসা চেঞ্জার। এক ছোকরা এসেছে ভারি হিরো। আজ একে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে গাড়ি করে। কাল অন্যকে। আর এই ছোকরারাও তেমনি।

রিয়া বলল, মুখ সামলে কথা বলতে বলো মদনদা ওদের। ভালো হবে না কিন্তু বলে দিচ্ছি।

বীরজু এসে রিয়ার সামনে দাঁড়াল। দু-কোমরে দু-হাত দিয়ে বলল, ভালো হোবে না মতলব? বলেই এক শায়ের আবৃত্তি করল :

মাহশুম নজার কি ভোলাপন
উও দিল লুভানা ক্যা জানে?
যো খুদ নিশানা বনতি হ্যায়।
উও তির চালানা ক্যা জানে।

বলেই, মাতালের মত্ত হাসি হেসে উঠল।

রিয়া হঠাৎ তার সাইকেলটাকে পথের লাল ধুলোয় শুইয়ে রেখেই নীচু হয়ে ডান পা থেকে চটিটি খুলে নিয়ে ফটাস করে মেরে দিল বীরজুর মুখে।

একটা তুমুল হই-হুঁল্লা শুরু হয়ে গেল। বীরজু ঝাঁপিয়ে পড়তে গেল রিয়ার ওপরে। মদন এবং অন্যান্যরা তাকে আটকে দিল। এই ফাঁকে রিয়া সাইকেলে উঠে জোরে প্যাডেল করে চলে গেল। বীরজু ডান হাত মুঠো করে তুলে বলল, হামারা নাম বীরজু সিং। মুঝকো বে ইজ্জত কিয়া। ম্যায়ভি তুমহারি ইজ্জত লুটেগী। ম্যায় ছোড়ঙ্গা নেহি। আজ ইয়া কাল! স্রিফ ওয়াক্তহি কি বাত।

মদন বলল, বীরজু তুই-ই তো গন্ডগোলটা পাকালি। তা ছাড়া এত লোককে সাক্ষী রেখে কথাটা তুই বললি যে, রিয়ার গায়ে যদি অন্য কেউও হাত দেয় তো সকলেই জানবে তুই-ই দিয়েছিস। এতজন সাক্ষী রেখে কেউ তড়পায় না। এই কথাটা মনে রেখেই তোকে সাবধান হতে বলছি।

ছোড়বে মদন। লেকে কোতোদিন ইয়াদ রাখবে? আর কোচিং কিলাসের এইসব ছেলেরা তো যে যার লাইন পাকড়ে লিবে, নোকরি পাকড়ে লিবে। ক-জন আর থাকবে এখানে পড়ে? কিন্তু হামি থাকব আর ওই রিয়া চিড়িয়াও থাকবে। চাটার্জিসাহেবের বাংলোতে চেঞ্জে আসা ফসলি-বটের তো চলে যাবে দু-দিন পর। তারপর? দেখিস তোরা ও শালির কী হাল করি আমি।

কিছুক্ষণ গুঞ্জরন উঠল মদন আর বীরজুর মধ্যে ব্যাপারটি ঘিরে। পানের দোকানের পথের বিজলি বাতি জ্বলে উঠল। সাইকেলের কিরিং-কিরিং আর সাইকেল রিকশার টুং-টাং শব্দ তুলে ভিড় পাতলা হয়ে গেল আস্তে আস্তে। বীরজুও চলে গেল একটি রিকশাওয়ালাকে জবরদস্তি করে থামিয়ে। সে যেতে চাইছিল না। রিকশাওয়ালা বলল, ম্যায় জিমানুর যায়েগা। সওয়ারি ছোড় কর আয়া।

জাহান্নামমে যানে দো তেরা সওয়ারিকো। মুক্তাটোলী চল আভভি। নেহি তো দাঁত তোড় দুংগা।

রিকশাওয়ালা ঘাড় গোঁজ করে মুঞ্জাটোলির দিকে চলে গেল আস্তে আস্তে। সাইকেল রিকশার ক্যাঁচোর-কোঁচোর শব্দ আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল।

এমন সময় রিয়া ফিরে এসে মদনকে ডাকল, মদনদা একটু শোনো।

কী? বলে মদন দোকান ছেড়ে রিয়ার কাছে গেল।

রিয়া বলল, ওই হিরোর আমার সঙ্গে কিছুই নেই। সব সাগুর সঙ্গে। বীরজুকে বোলো যে, ভুল লোককে তঙ্গ করছে।

হ্যাঁ। বলেই, রিয়া চলে গেল।

কেন বলল, কী করে বলল সেকথা ভাবার মতো মনের জোর রিয়ার আর রইল না। কী করে রিয়া নিজেকে এমন মিথ্যাবাদী, নীচ করতে পারল তাও নিজেই জানে না। রিয়ার মতো অনেক মেয়েরাই নিজেকে জানে না, ভাবে যে জানে।

মদন পানের দোকানি ভরতকে বলল, ভরত, একটা পান দে তো কালা-পিলাপাত্তি জর্দা দিয়ে। চুন কম দিবি। কাল মুখ পুড়ে গেছিল।

এদিক-ওদিক চেয়ে কেউ শুনছে না যে তা দেখে নিয়ে ভরত পানওয়ালা বলল, কী করা যায় মদনবাবু এল তো বীরজুবাবুকে নিয়ে? ওর জন্যে তো আমার দোকানই উঠে যাবে একদিন। রোজই একটা না একটা হামলা লেগেই আছে। কোতোয়ালি থেকে লোক এলে তো সাক্ষী দিতে কাউকেই পাওয়া যাবে না। সবাই বলবে যে, আমি তো জানি না; আমি তো কিছু দেখিনি। কিন্তু আমার যে শালা দোকান। দোকান ফেলে আমি পালাবটা কোথায়? আমাকে তো সাক্ষী মানবেই পুলিশ বা অন্যরা, দোকানের সামনে যাই ঘটুক না কেন। আর যদি সাক্ষী দিই তবে তো বীরজু সিং জবাই করে ফেলে রেখে দিয়ে যাবে পরদিন দোকানের মধ্যেই। ভয়ে আমার জান সবসময় নীল হয়ে থাকে।

মদন কথা না বলে পানটা নিল ভরত পানওয়ালার হাত থেকে। পানটা মুখে দিয়ে নিজের ট্রাউজারের হিপপকেট থেকে একটি হলুদ-রঙা চিরুনি বের করে সটাসট করে কয়েকবার আঁচড়ে নিল। গোঁফে দু-হাত দিয়ে চুমকুড়ি লাগাল। পানের পিক একটু ফেলে দিয়ে বড়ো এক ঢোঁক গিলল। তারপর ভরতের দিকে চেয়ে ফিলসফারের মত বলল, ভয় থাকে বাইরে নয়, নিজের নিজের বুকেরই মধ্যে রে ভরত। ভয় নিয়ে যারা বেঁচে থাকে সে শালারা মানুষ নয়।

অজীব আদমি হেঁ আপ মদনবাবু। বীরজু গুণ্ডা মে ডরেগা না তো ক্যা উসকি দুলহার পেয়ার করেগা? ডর নেহি পাঁতে হেঁ অ্যায়সা আদমি ভি কোই হ্যায় কেয়া?

কুছ তো করনাহি পড়ে গা। ইক-রোজ সাফ সাফ বোলহি দেনা চাহিয়ে বীরজুকো কি দুকানকি সামনামে হল্লা নেহি মাচায়।

হায় রাম! ম্যায় বোলনেহি শখতা থা, তো ইতনাদিন ই বাত বোল নেহি দেতা থা? ভরত বলল।

ইকবরাজ বোলহি পড়েগা। হামারা সামনামে বোলো। ঔর পাঁচ-দশ আদমি যব সামনা রহেঙ্গে উসটাইমপে বোলো তো হামলোগোনেভি উনকো সমঝাকে বোলে গা।

ভরত বলল, লেহ! শোচ-সমঝ রহনেসে কোই গুণ্ডাবাজি করতা হ্যায়? নেহি। আপ সাচ মুচ অজীব আদমি। খ্যয়ের আপভি তো কোই সন্ত নেহি না হ্যায়?

মদন পান চিবোতে চিবোতে, গোঁফে চুমকুড়ি দিয়ে একটু হেসে বলল, নেহি। ম্যায় ভি সন্ত নেহি হুঁ। বাত তো সাহিই বোলা।

সন্ধে নামার সঙ্গে সঙ্গে বেশ ঠাণ্ডা পড়ে যাচ্ছে আজকাল। দেওয়ালি এসে গেছে। কাছে ও দূরের বসতি থেকে পটকা ও বোমার আওয়াজ আসছে। হাওয়াই-এর রোশনাই অ্যাইক জুইক আওয়াজ করে আকাশকে চিরে দিচ্ছে।

পানটা রসিয়ে রসিয়ে খেয়ে মদন বলল, বীরজু যা বলল, তা কি সত্যি?

কী? ভরত পানওয়ালা বলল।

ওই চাটার্জিসাহাবের বাংলোতে হিরো আসার কথা। এক হিরোকে আমি দেখেছি। ছেলেটাকে তো খারাপ বলে মনে হচ্ছে না।

হিরো কি না জানি না। তবে বহতই খাপসুরত নওজোয়ান। ইক মারুতি ঔর ইক কন্টসা গাড়ি লেকর ঘুমতে দিখা।

উও লেড়কি সাথমে থি!

সিতো দুসরি লেড়কি ভি থি।

আচ্ছা! চট করে কী যেন ভাবল মদন। মামলা কেয়া হ্যায় জারা নিগা করকে আনা পড়েগি।

পড়ে-লিখে লেড়কিওনে দুসরা পড়ে-লিখে লেড়কাকি সাথ ঘুমেঙ্গে-ফিরেঙ্গে ইসমে বীরজু সিংকি ক্যা জ্বলতি হ্যায়? রামহি জানে।

হু। চিন্তান্বিত গলায় বলল মদন। ইয়ে বাত ভি সাহি।

বাজারের মধ্যে মদন সেনের একটি ছোট্ট ক্যাসেটের দোকান আছে। মাইক লাগিয়ে সবসময় নানা ধরনের ক্যাসেট বাজানো হয় সেখানে। ছেলে-ছোকরারা যাদের ক্যাসেট প্লেয়ার আছে, এবং রহিস আদমিদেরও কেউ কেউ, যাদের গাড়িতে আছে, তার দোকানে ক্যাসেট কিনতে আসে। মদন সেনের বাবা খ্যাঁদন সেন ও-অঞ্চলের নামকরা তবলচি ছিলেন। বড়ো ক্লাসিকাল ভোকালিস্ট লগুনে খাঁ সাহেব, মুঞ্জিটোলিওয়ালার সঙ্গে উনি তবলা সংগত করতেন। কুস্তিও লড়তেন ভালো। বর্ধমান জেলার কোনো গ্রাম থেকে তাঁর বাবা ইস্ট-ইণ্ডিয়া রেইলওয়ের চাকরি থেকে অবসর নিয়ে এখানে এসে সস্তায় অনেকখানি জমি কিনে ফলের বাগান করে ছোট্ট বাংলোমতো বানিয়ে বসবাস আরম্ভ করেন। সেইসূত্রে মদনের বাড়ির সঙ্গে এখানের সব বাঙালিদেরই জানাশোনা আছে। মদনও একসময় কুস্তি লড়ত। পড়াশোনা ক্লাস এইট অবধি করেছিল। গুণ্ডা বলে তারও কুখ্যাতি আছে বীরজুরই মতো এ অঞ্চলে। হঠাৎ হঠাৎ হাত নিসপিস করলেই খামোখাই লোকের নাক ফাটিয়ে দিত আগে। এখন নেহাত প্ররোচিত না হলে মারামারি করে না। একজন বিহারি ভূমিহার কয়লা ব্যাবসায়ীর মেয়ের সঙ্গে প্রেম করে বিয়ে করেছে। তাতে শ্বশুর মেয়েকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। একটি ছেলেও হয়েছে মদনের। দায়দায়িত্ব পড়েছে ঘাড়ে। আগে দাবা খেলার খুব নেশা ছিল। আজকাল সময় পায় না তবুও মাঝে মাঝে সন্ধের মুখে মুখে গোঁফে আতর লাগিয়ে চুড়িদার কুর্তা কামিজ পরে বচপনকি দোস্ত মিয়া বাহারুদ্দিনের বাড়িতে গিয়ে একহাত দাবা খেলে আসে। গড়গড়া খায়। কখনো কখনো গান বাজনাও হয় একটু। তবলার হাতের একটু প্র্যাকটিসও হয়ে যায় ওই বাহানাতে। দুরন্ত প্রকৃতির ও অসীমসাহসী মদন সেন এখন প্রায় ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে। এবং বাঙালি বলেও তাকে আর মনে হয় না। বাঙালিত্ব বজায় আছে শুধু কিছু কিছু সহবত আর এই খাওয়া-দাওয়ারই।

ভরতের দোকান থেকে মদন একটি সাইকেল রিকশা নিয়ে রিয়াদের বাড়ি যাবে ভাবল। আজ সাইকেলটাও নিয়ে বেরোয়নি।

মদন জর্দার একটা হেঁচকি তুলে বলল, শোচা থা কি রিয়াকি ঘর যাকর জারা বোলকে আয়গা কুছরাজ সামহালকে রহনেকি লিয়ে। মগর আজ সাইকেলভি ছোড়কর আয়া হুঁ। খ্যয়ের ইক হাত শতরঞ্জুহি খেল কর আজ ঘর লওটেঙ্গে। কাল ভি নেহি হোগা। মিয়া বাহারুদ্দিন কুছ খানেপিনে কি ভি ইন্তেকাম কিয়া। তো ম্যায় অব চলে ভরত।

ভরত বলল, ঠিকে হ্যায় দাদা। দিওয়ালিকি পরণাম। মদন হাত কপালে ঠেকিয়ে ভরতকে প্রণাম করল। বলল, রামজি কি! বলেই এগোল।

.

১০.

ঘন জঙ্গলের মধ্যে একটি ভাঁটিখানা। হ্যারিকেন জ্বলছে। মস্ত চওড়া বারান্দা। মোটামোটা শালকাঠের থামওয়ালা। ওপরে খাপরার চাল। বীরজু সিং বারান্দার একটা চেয়ারে বসে অন্ধকার জঙ্গলের দিকে চেয়ে ছিল তুরীয় অবস্থায়। মোটর বাইকটার গায়ে লণ্ঠনের আলো পড়ে ঝিকমিক করছিল। এমন সময় চারটি মোটর বাইক পাশাপাশি এল হেডলাইট জ্বালিয়ে। গাঁকগাঁক শব্দ করতে করতে।

মোটর সাইকেলটা পার্ক করে, নেমে গিরধারী বলল ক্যা খালখরিয়াত বা গুরু? অন্যরাও নামল।

বীরজু বলল, বহত দিন বাদ আয়া তু সব। থা কাহা ইতনা রোজ?

গিরধারী বলল, গৈয়া (গয়া) গ্যায়াথা। হুয়াসে পাটনা। বড়ো চক্কর লাগাকার লোওটা।

বীরজু বলল, কাহে, লা?

গিরধারী বলল, পেট কি ধান্দোমে। ওঁর কাহে?

বীরজু বলল, কওব লোওটা?

গিরধারী বলল, কালহি। সামমে।

বিরজু বলল, আ। বৈঠ।

জগজিৎ বলল, বৈঠেগি ক্যা? পহিলে বোলো, যো সমাচার শুনকর আয়া ঊ্য কা সাচ হ্যায়?

বীরজু বলল, কওসি সমাচার?

রিয়া না ফিয়া কোই ছোঁকরিনে তুমকো জুতিসে পিটিন। মাঠো বলল।

বীরজু বলল, বাত তো সাহিই হ্যায়।

জগদীশ বলল, ঔর অবতক তুম চুপচাপ বৈঠে হুয়ে হ্যায়?

নেহি। কুছ তো করনাহি পড়েগি। বীরজু বলল।

কব?

শোচ রহা হ্যায়।

ইসমে শোচনেকি বাতে ক্যা হ্যায়?

অরভি। অন্যমনস্ক গলায় বীরজু বলল।

নেহি নেহি। ইস ফয়সালা হামলোগোঁ নেই কিয়েগা। গিরধারী বলল।

মাঠো বলল, ইতনা জলদিবাজি নেহি করনা।

কাহে? দের কিস লিয়ে? উত্তেজিত গিরধারী বলল।

বীরজু বলল, ম্যায় পাকড় যাউঙ্গা। বহত আদমি থে না হঁয়া। সবকো সামনামে বোল দিহিন থা কি উসকি ইজ্জত লুটেগি।

জগদীশ বলল, তুমহি না বোলেথে। হামলোগোঁনে তো নেহি বোলিন। ম্যায় তো উসওয়াক্ত টাউন মে থাভি নেহি। হাম লোগোনে মিলকর সামহাল লেঙ্গে উও কাম। তুম মানা মত করো গুরু।

বীরজু বলল, আভভি নেহি। তরিকা শোচনে দো ঠাণ্ডা দিমাগমে। যো ভি করনা বহতই শোচ সমঝকর করনা। আচ্ছা ঘরকি লেড়কি, রাঁচি তক হল্লা মাচ যায়েগি।

গিরধারী বলল, তো? কিতনা রোজতক চুপচাপ রহোগে?

বীরজু বলল, হোগা, হোগা গিরধারী। ঠিক ওয়াক্ত পর বদলা ঠিকই লেনা পড়েগা। বোলই তো রহা ম্যায় সিফ জারা টাইম বিতনে দেনা চাহিয়ে।

মাধো বলল, ইতনা শোচ-সমঝনা হামারা আচ্ছা নেহি লাগতা। না হামহারা না ঔর কোই চেলালোগোঁটি। তুম চুপ রহো। হাম-লোগোনে শিখ লায়েগা উত্ত নামকিন ছোঁকরিকি। মাল বহত হি আচ্ছা হ্যায়। ম্যায় তো আভভি উসকি বাংলা দিখকরই আ রহা হ্যায়। বাংলাকি সামনাকি ঝুলোমে ওহি হিরোকি সাতহি ঝুল রহি থি। মজা আ জায়েগা গুরু। বহত রোজ বাদ অ্যায়সি চিজ দিখা। ই লেড়কি থা কাঁহা ইতনি সাল নিগাহসে ছুপকে? হামলোগ সব অন্ধা হ্যায় বিলকুল। ঔর দের ইকদমহি না করনা চাহিয়ে।

বীরজু বলল, ইয়ে হামারা অর্ডার হ্যায়। বোলা না বদলা তো লেগাহি লেগা, স্রিফ টাইম ঔর থোরা বিতনে দো। ইসওয়াক্ত হামারা টাইম আচ্ছা নেহি জা রাহা হ্যায়। গো-মাতাজিকি রোটি খিলানে পড়েগি পইলে। রামজিকি মন্দিরমে পূজা চড়হানে পড়েগি পইলে। উসকো বাদ। টাইমপর সবহি হোগা। হোগাই হোগা।

একটি অশ্লীল ও ভয়াবহ হাসি ফুটে উঠল বীরজুর মুখে। হ্যারিকেনের আলোয় সে ভয়াবহতা হিংস্র রূপ নিল।

Pages: 1 2 3 4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress