রামায়ণ : আদিকাণ্ড – গঙ্গার জন্ম-বিবরণ ও মর্ত্ত্যলোকে সগরের গঙ্গা আনিতে গমন ও ভগীরথের জন্ম
একদিন গেলোকে বসিয়া নারায়ণ।
চতুর্দ্দিকে আর যত দেব ঋষিগণ।।
সভামাঝে ত্রিলোচন গান পঞ্চমুখে।
দেবঋষি স্বর্গবাসী পুলকিত দেখে।।
শিঙ্গা বলে শ্রীরাম, ডম্বুরে বলে হরি।
পঞ্চমুখে পঞ্চানন গান ত্রিপুরারি।।
লক্ষ্মী সহ বসিয়া আছেন মহাশয়।
শুনিয়া সে গান হইলেন দ্রবময়।।
দ্রবরূপে হইলেন নিজে চক্রপাণি।
সেই গঙ্গা জন্মিলেন পতিতপাবনী।।
সেই জল কমণ্ডলু পূরিয়া আদরে।
রাখিলেন তুলিয়া বিধাতা নিজ ঘরে।।
সেই গঙ্গা যদি পার আনিতে নৃপতি।
তবে সে সগরবংশ পাইবে সদগতি।।
অংশুমান তোমারে দিলাম এই বর।
তব বংশ হেতু গঙ্গা হবেন গোচর।।
ঘোড়া লৈয়া অংশুমান অযোধ্যাতে যায়।
বিবরণ কহে আসি সগরের পায়।।
কপিলের স্থানে পাইলাম অশ্বধনে।
তাঁর কোপাগ্নিতে মরিয়াছে সর্ব্বজনে।।
শুনিয়া সগর রাজা শোকাকুল মন।
পুত্রশোকে নিরবধি করেন ক্রন্দন।।
রাহুর দশায় জন্ম হইল যখন।
সে সবার আশা আমি ছেড়েছি তখন।।
ষাটি হাজার পুত্রে শাপ দিলেন বিশাই।
অল্পকালে মরিল না হইল চিরাই।।
অশুচি হইল যজ্ঞ না হইল সায়।
কি মতে পাবেন মুক্তি ভাবেন উপায়।।
স্বর্গেতে আছেন গঙ্গা করি কি প্রকার।
তাঁহা বিনা কিসে হবে বংশের উদ্ধার।।
অংশমানে রাজ্য রাজা করি সমর্পণ।
গঙ্গারে আনিতে রাজা করিল গমন।।
গঙ্গা না পাইয়া তাঁর নিত্য বাড়ে শোক।
মরিয়া সগর রাজা গেল ব্রহ্মলোক।।
অংশুমান রাজ্য করে অযোধ্যা-নগরে।
তাঁর পুত্র হইল দিলীপ নাম ধরে।।
পুত্রে রাজ্য দিয়া গেল গঙ্গা আনিবারে।
তপ দশ হাজার বৎসর অনাহারে।।
গঙ্গা না পাইয়া গেল স্বর্গের উপর।
তাহারে দেখিয়া তুষ্ট দেব পুরন্দর।।
অপুত্রক রাজা, দুঃখ ভাবেন অন্তরে।
দুই নারী থুয়ে গেল অযোধ্যা-নগরে।।
চলিল দিলীপ রাজা গঙ্গা-অনুসারে।
কঠোর তপস্যা করে থাকি অনাহারে।।
কভু জলাহার করে, কভু অনাহার।
অযুত বৎসর সেবা করিল ব্রহ্মার।।
তথাপি না পায় গঙ্গা না হয় অশোক।
মরিয়া দিলীপ রাজা গেল ব্রহ্মলোক।।
অরাজক হইল রাজ্য অযোধ্য-নগর।
স্বর্গেতে চিন্তিত ব্রহ্মা আর পুরন্দর।।
শুনিয়াছি জন্মিবেন বিষ্ণু সূর্য্যকুলে।
কেমনে বাড়িবে বংশ নির্ম্মূল হইলে।।
ভাবিয়া সকল দেব যুক্তি করি মনে।
অযোধ্যাতে পাঠাইল প্রভু ত্রিলোচনে।।
দিলীপ কামিনী দুই আছিলেন বাসে।
বৃষ আরোহণে শিব গেলেন সকাশে।।
দোঁহাকার প্রতি কহিলেন ত্রিপুরারি।
মম বরে পুতবতী হবে এক নারী।।
দুই নারী কহে শুনি শিবের বচন।
বিধবা আমরা কিসে হইবে নন্দন।।
শঙ্কর বলেন দুই জনে কর রতি।
মম বরে একের হইবে সুসন্ততি।।
এই বর দিয়া গেল দেব ত্রিপুরারি।
স্নান করি গেল দুই দিলীপের নারী।।
সম্প্রীতিতে আছিলেন সে দুই যুবতী।
কতদিনে একজন হৈল ঋতুমতী।।
দোঁহেতে জানিল যদি দোঁহার সন্দর্ভ।
দোঁহে কেলি করিতে একের হৈল গর্ভে।।
দশ মাস হৈল গর্ভ প্রসব সময়।
মাংসপিণ্ড মাত্র পুত্র হৈল উদয়।।
পুত্র কোলে করিয়া কান্দেন দুইজন।
হেন পুত্র-বর কেন দিলা ত্রিলোচন।।
অস্থি নাহি মাংসপিণ্ড চলিতে না পারে।
দেখিয়া হাসিবে লোক সকল সংসারে।।
কোলে করি নিল তাহা চুপড়ি ভিতরে।
ফেলিবারে নিয়া গেল সরয়ূর তীরে।।
হেনকালে দেখিল বশিষ্ঠ তপোধন।
ধ্যানেতে জানিল তার সকল কারণ।।
মুনি বলে থুয়ে যাও পথে শোয়াইয়া।
করুণা কবিবে কেহ আতুর দেখিয়া।।
পুত্র পথে শোয়াইয়া দোঁহে গেল ঘরে।
অষ্টাবক্র মুনি যান স্নান করিবারে।।
আট ঠাই বাঁকা মুনি গমনে কাতর।
বালক তেমনি করে পথের উপর।।
একদৃষ্টে অষ্টাবক্র তার পানে চায়।
মনে ভাবে আমারে এ দেখিয়া ভেঙচায়।।
আমারে দেখিয়া যদি কর উপহাস।
মম ব্রহ্মশাপে হবে শরীর বিনাশ।।
যদি তব দেহ হয় স্বভাবে এমন।
মম বরে তুমি হও মদন-মোহন।।
অষ্টাবক্র মুনি সেই বিষ্ণুর সমান।
যারে বর শাপ দেন কভু নহে আন।।
অষ্টাবক্র মুনির মহিমা চমৎকার।
দাণ্ডাইল উঠিয়া সে রাজার কুমার।।
ধ্যানে জানিলেন অষ্টাচক্র তপোধন।
বটে মহাপুরুষ এ দিলীপ-নন্দন।।
উভয় রাণীকে ডাকি আনে মুনিবর।
পুত্র দিল, হরষিতে দোঁহে গেল ঘর।।
আসিয়া সকল মুনি করিল কল্যাণ।
ভগে ভগে জন্ম হেতু ভগীরথ নাম।।
কৃত্তিবাস পণ্ডিত কবিত্বে বিচক্ষণ।
আদিকাণ্ড গান ভগীরথের জনম।।