রাধিকা সংবাদ
“……রাই জাগো রাই জাগো শুক সারি বলে,
কত নিদ্রা যাও গো রাধে শ্যাম নাগরের কোলে।
রাই জাগো রাই জাগো…….”
ধড়মড় করে উঠে বসে রাধিকা। ‘উঃ মাগো সকাল হয়ে গেছে , বুঝতেই পারিনি!’
কাল সারাটা রাত দুচোখ ভরে শুধু দেখে গেছে, আকাশে গোল থালার মতো চাঁদ , স্নিগ্ধ আলোয় প্লাবিত চরাচর, সেই আলোর প্লাবনে ভেসে যেতে যেতে কত কিছুই না ভেবে গেছে। দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি। ভোরের দিকে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতে পারেনি।
বসন্তে ডালে ডালে আগুন জ্বেলে রাঙা পলাশ হাসে,কৃষ্ণচূড়ারা অনর্গল কথা কয়,শিমূল ফোঁটা ফোঁটা বুকের রক্ত ঢেলে ফুল ফোটায়। আমের মঞ্জরী তার গন্ধ মাখিয়ে দেয় বাতাসে। বাতাস উতলা হয়ে এসে কানে কানে ফিস ফিস করে বলে-“আমি এসে গেছি।” বাতাসের সেই ফিসফিস,ভ্রমরের গুঞ্জরণ, কৃষ্ণচূড়ার অশ্রুত মর্মর ধ্বনি বুকের গভীরে এসে শুনিয়ে যায় প্রেমের মর্ম গাথা ! আকাশে বাতাসে সর্বত্র কেবল বিরহ আর বিরহ! আকাশের বিরহ,পৃথিবীর বিরহ! বসন্ত বিরহের মহাকাব্য যেন ! বিরহ ছাড়া আর বুঝি কিছু হয় না! অব্যক্ত প্রেমের বার্তা অযুত তরঙ্গে আছড়ে পড়ে বুকের ভেতর। তবুও মন বাধ্য হয়ে থাকে নিরাসক্ত, চুপটি করে । নৈঃশব্দ্যের ও যে একটা ভাষা থাকে! সেই ভাষাও যে বুঝতে হয়!এক বসন্তে চলে গেছিল সে।
বসন্ত মিলনের কথকতাও যে শোনায়! রাঙা পলাশের লেলিহান শিখায় হৃদয়ের অব্যক্ত প্রেমের গুঞ্জরণ ঠিক তার পথ খুঁজে নেবে। আজ দোল পূর্ণিমা, সকাল থেকেই কর্মযজ্ঞে মাতোয়ারা সারা গ্রাম, না না আজ কেন গত একমাস ধরে এই কর্মযজ্ঞের আয়োজনে সারা গাঁয়ের মানুষ মেতে ওঠে। শুধু মাত্র এই গ্রামের কথা বললে সত্যের অপলাপ হয়। আশপাশের এলাকা থেকে দলে দলে মানুষ আসছে এই মহাযজ্ঞে সামিল হতে। মৃদঙ্গ ধ্বনি মুখরিত উৎসব প্রাঙ্গণে আনন্দ নৃত্য পরিবেশন করে চলেছে কি যেন এক উন্মাদনায়।
গাঁয়ের মানুষ মেতে উঠেছে,সারি সারি ভাটির মতো সব উনুন জ্বলছে,এক আধটা নয় , তিরিশখানা উনুনে রান্না হচ্ছে। শুধুমাত্র এই গ্রামের নয়, আশপাশের গাঁ গঞ্জের লোকজন যারাই আসবে, প্রসাদ পাবে।
সারা গ্রাম গন্ধে ম ম করছে , রান্নার গন্ধ,অগুরু চন্দনের গন্ধ,ধূপ ধূনা ফুলের গন্ধ সর্বোপরি ভালোবাসা,প্রাণে প্রাণে ভালোবাসার টানের গন্ধ! মহা মিলনের এই পূণ্যভূমি আজকের দিনটিতে যেন বৃন্দাবনের রূপ পরিগ্রহ করেছে।
গাঁয়ের হরি মন্দিরে তুলসী তলায় পূজার আয়োজন,হরির লুটের ফুল-বাতাসা পেতে বাচ্চাগুলোর সে কী আকুলি বিকুলি! হরি মন্দিরে পূণ্য লোভাতুরা উপোসী ব্রতীদের ভিড়।
অন্যদিকে এই মহাযজ্ঞের কর্মকাণ্ডে স্বেচ্ছায় দান করার জন্য লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মানুষগুলো।
প্রতি বছর এই দোল পূর্ণিমায় চলতে থাকা এই মহাযজ্ঞের সেবা কার্যে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মানুষ জন কাজ করতে থাকে সারাক্ষণ। রাধিকার কাছে আজকের দিনটি একটি বিশিষ্ট দিন। বহু প্রতীক্ষিত এই দিনটির জন্যই তার এত অপেক্ষা…..
দোল পূর্ণিমা, মহাপ্রভুর পূণ্য জন্মতিথি,বড়ো পবিত্র দিন আজ। স্নান সেরে শুদ্ধ কাপড়ে গলায় আঁচল দিয়ে আভূমি প্রণত হয়ে হরি মন্দিরে প্রণাম সেরে, ধীরপায়ে এসে দাঁড়িয়েছে সেই বোল গাছটির তলায়।এই সেই পবিত্র পূণ্যভূমি, নীলাচলে যাবার সময় এই বোল গাছটির নীচে বসেই মহাপ্রভু ক্ষণিক বিশ্রাম নিয়েছিলেন । এখানেও গলায় আঁচল দিয়ে ভক্তিভরে প্রণাম সেরে সুগন্ধী ধূপ জ্বালিয়ে দেয় রাধিকা। সাক্ষাৎ লক্ষ্মী প্রতিমার মতো মনে হয় তাকে।
মনটি তার আজ আবেগপূর্ণ,প্রণয়বিহ্বলতায় আপ্লুত হয়ে অপেক্ষা করছে তার দয়িতের জন্য। বছর কয়েক আগের কথা,একপাড়াতেই বাস দুটি পরিবারের। রাধিকা,কিশোরী রাধিকার মন তরুণ অনুভবের প্রতি আকৃষ্ট হতে দেরী হয়নি, যেমন সুঠামদেহী তেমনি পড়াশোনা আর খেলাধূলায় চৌকশ। যদিও পারস্পারিক মন জানাজানির অধ্যায়টুকু অব্যক্তই ছিল।
শরতের এক পড়ন্ত বিকেলে অনুভব সাইকেল নিয়ে আসতে আসতে দেখতে পায় রাধিকা হাঁস ওঠাতে এসে পা পিছলে পুকুরের জলে। সেই আঘাটায় কলমীর দামে জড়িয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে, মুহূর্তের মধ্যে সাইকেল ফেলে অনুভব লাফিয়ে পড়ে রাধিকাকে টেনে তুলল ডাঙায়, ঘটনার আকস্মিকতায়, ভয়ে হতভম্ব রাধিকা চোখ বন্ধ করে ফেলেছে।চোখ খুলতেও তার ভয়। সেই পদ্মের পাপড়ির মতো দুটি চোখের পাতার উপর নেমে এসেছিল… আহ সে এক অপূর্ব শিহরণ! সে কথা মনে হলে আজো লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে। সম্বিত ফিরে পেতেই নিজেকে আবিষ্কার করে দুটি সুকঠিন বাহুবন্ধনের মধ্যে, রাধিকার সলজ্জ দু-চোখের দৃষ্টিতে সমর্পণের আকুল আহ্বান। পড়ন্ত বিকেলের আলোয় রাধিকার দিকে তাকিয়ে অস্ফূটে বলেছিল ‘না না এখন নয়, এখন নয় , অনেক কিছু করতে হবে আমায়, অনেক বড়ো হতে হবে যে! ততদিন পারবে আমার জন্য অপেক্ষা করতে ? কি পারবে তো!’
মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়েছিল রাধিকা। সেই বছরের মাঝামাঝি অনুভবের বাবার বদলির নির্দেশ এলে পুরো পরিবারকে নিয়ে তিনি কলকাতায় চলে যান।
……..স্বপ্নের মাঝে সেই গভীর আলিঙ্গনের পরশটুকু পাবার অদম্য আকাঙ্ক্ষায় পাগল হয়ে ওঠে।
ভাবতে ভালো লাগে ঠোঁটের আলতো ছোঁয়ায় গাঢ় হয়ে উঠবে প্রেম,
চোখের পাতায় ঘন হয়ে আছে স্বপ্ন -মদির ঘোর, সজল চোখের সেই মোহময় আহ্বান
জীবনের সব চাওয়ার পাওয়ার চাহিদা কে পূর্ণ করে তুলবে।
প্রণয় বিহ্বল হয়ে তার এই অপেক্ষা আর কতদিন!
লোকমুখে শুনছে আজ,আজই আসবে সে! সে নাকি জেলা শাসক হয়েছে। চারদিক থেকে দলে দলে যোগ দিতে আসছে এই মহাযজ্ঞে। রঙের মহোৎসব চলছে যেন, পবিত্র মৃদঙ্গ,কত্তালে ধ্বনিত হচ্ছে নাম সংকীর্তনের প্রেমময় আহ্বান। আশপাশের চার পাঁচখানা গ্রাম থেকে মানুষের আগমন ঘটেছে। দোলোৎসব উপলক্ষ্যে সকলেই নিজেদের মতো করে আনন্দ যজ্ঞে যোগ দিচ্ছে, আনন্দে মেতে উঠেছে সমস্ত মানুষ। এ সময় থাকে না ছোটবড়ো ধনী দরিদ্রের ব্যবধান। চলছে হাজার হাজার মানুষের জন্য রান্নার আয়োজন। এখানেই শেষ নয় এরপরেও উৎসব চলতে থাকবে । চৌদ্দদিন ধরে বসবে পালা কীর্তনের আসর। মৃদঙ্গের ধ্বনি সহযোগে মুখরিত হতেই থাকবে রাধাকৃষ্ণের লীলা মাহাত্ম্য। অমর প্রেমগাথা, মাথুর, শ্রী রাধার মানভঞ্জন, রাস, কতরকম নাম এইসব পালার!
রাধিকার মন পড়ে আছে,কখন আসবে অনুভব!
বাইরে গান বাজছে
“আজ হোলি খেলবো শ্যাম তোমার সনে,
একলা পেয়েছি তোমায় নিধু বনে।……”
খেলবে বৈকি, রাধিকাও খেলবে তার অনুভবের সঙ্গে। ভাবতে গিয়েও লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে। এ কী ভাবছে বোকার মতো,তাকে একা পাবেই বা কী করে! অনুভব তো আজ আর তার একার নয়!
রাধামাধবের চরণ-ছোঁয়া সুগন্ধী আবির আর ফুল ছোট্ট একটি পিতলের রেকাবিতে সযত্নে তুলে রেখেছে রাধিকা, তার অনুভবের জন্য। হঠাৎ করেই সাড়া পড়ে যায়, আসছে আ স ছে আঁচলের তলায় ছোট্ট রেকাবির আবিরটুকু সামলে ,দৌড়ে বেরিয়ে আসে রাধিকা। পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে দাঁড়ায় পথের ধারে। দূরে গাড়ীটাকে আসতে দেখে সবাই উৎসুক হয়ে ওঠে। প্রতীক্ষিত মানুষটিকে সম্মান জানাতে ব্যগ্র হয়ে ওঠে সকলে , লাল ধুলো উড়িয়ে গাড়ীটা সোজা এসে দাঁড়িয়ে যায়। লাল ধুলো আছড়ে পড়েছে রাধিকার সর্বাঙ্গে,দুচোখ জ্বালা করতে থাকে। তাকিয়ে থাকে গাড়ীর দিকে গাড়ী থেকে ও কে নামলো , এ তো তার সেই তরুণ কান্তি অনুভব নয়, যে মোহনের বাঁশীর সুরে পাগল রাধিকা,ইনি তো তিনি নন। এই অনুভব যে তার একান্ত অচেনা! ইনি তার সেই অনুভব হতেই পারেন না! বুকের ভেতর পাক দিয়ে ওঠে একটা মোচড়ানো ব্যথার অনুভূতি, সর্বস্ব হারানোর হাহাকার নিয়ে নিঃস্ব রাধিকা শূণ্য মনে, স্খলিত পদক্ষেপে ফিরে চলেছে ।
লাল ধুলোর ঘূর্ণিঝড়ের মাঝে পাক খেতে খেতে তার স্বপ্নগুলো মিলিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ………..