রাধানগর (Radhanagar) : 04
কেকা বলল— থার্ড বেঞ্চ থেকে একটা ছেলে তোর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে।
ম্যাথসের ক্লাস। বোর্ডের ওপর এ. কে. জি. খসখস করে লিখে যাচ্ছেন। ফলো করতে চেষ্টা করছিলাম। ছেলেটাকে আমি দেখেছি। কিন্তু ভাব দেখালাম যেন আকাশ থেকে পড়ছি।
কেকা বলল—তাকাসনি। সেকেন্ড ফ্রম রাইট। এক্কেবারে গবেট টাইপ।
—কী করে জানলি?— আমি হাসি লুকিয়ে বলি— জাস্ট আমার দিকে চেয়ে আছে বলেই! —শুধু কেকা কেন, সব মেয়েই আমার ওপর জেলাস, প্রচণ্ড।
—আজ্ঞে না—কেকা বলল— খাড়া চুল, ভাঁটা চোখ, প্যাতপেতে কান, ন্যাতনেতে শার্ট… গেট-আপ দেখলেই বোঝা যায়।
—অনেক দেখে ফেলেছিস, আমি বলি, এত দেখছিস বলেই ও এদিকে চেয়ে আছে। আমার দিকে নয়, তোর দিকে। ছেলেটা মোটেই গবেট নয়, দেখবি হয়তো তোকে আমাকে মেরে বেরিয়ে যাবে। গুডি-গুডি টাইপ।
—গাঁইয়া!
ছেলেটা ততক্ষণে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে। বুঝতে পেরেছে আমরা ওকে নিয়েই আলোচনা করছি।
দেখছে দেখছে। সে নিয়ে এত আলোচনার কী আছে আমি বুঝি না। ছেলেরা মেয়ে দেখে। মেয়েরা ছেলে দেখে। এ তো স্বাভাবিক স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপার। এমন দিন আমার তো মনে পড়ে না যবে কিছু লোক আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে না দেখেছে। তেমন দিন আসলে যে আমার খুব ভাল লাগবে এমন কথাও আমি বলতে পারছি না। আই ডেফিনিটলি এনজয় অ্যাটেনশন। এতে আমার কনফিডেন্স বাড়ে। সাহস বাড়ে। তবে এ ছেলেটা একেবারে মফঃস্বলী তাতে সন্দেহ নেই। ক্লাস করছি মাস দুয়েক হল ওকে লক্ষ করিনি। সেদিন চার নম্বর রুমে ঢুকছি, আমি একা নয়, অনেকেই ছিল। ও বেরোচ্ছিল। একটা ভিড়ের মাঝখানে ছিল ও। চুলগুলো ভিড়ের মাথায় জেগে ছিল ওর। হঠাৎ চক্ষু ছানাবড়া করে ভিড়ের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল। আমাকে দেখছে। —দ্যাখ বাবা দ্যাখ, এরকমটা দেখিসনি কখনও বুঝতেই পারছি। আমার চেয়ে সুন্দর এ কলেজে কি আর নেই? আছে কয়েকটা আর্টস-এ। কিন্তু আমার মতো গ্ল্যামার বোধহয় আর কারওই নেই। অহংকার করছি না। জাস্ট আ স্টেটমেন্ট অফ ফ্যাক্ট।
অনেকেই তো দেখে! প্রোফেসররা দেখেন চুরি করে। সিনিয়ররা দেখে সোজাসুজি, কেউ কেউ কমেন্ট করে যায়। ‘উরি শাবাস— কী মেখেছিস রে?’ এক সিনিয়র সেদিন বলতে বলতে চলে গেল। আর আমার নিজের ব্যাচ-মেটগুলো? ওগুলোর তো এখনও গোঁফে দুধ লেগে রয়েছে। তবু কতকগুলো গায়ে পড়ে ভাব করতে আসে। অন্যগুলো এখনও অত বোঝেসোজে না। তার মধ্যে ইনি কে তালেবর এলেন, এখনও পিঠে মাস্টারমশাইয়ের বেতের দাগ, আমার যাওয়া-আসার পথে চোখ পেতে দাঁড়িয়ে থাকেন? এটা যদি আমাদের পাড়া হত, আমাকে বলতে হত না, রুডি মাইকেল আসলাম আমার বন্ধুরা ওর ঠ্যাং-ফ্যাং ভেঙে দিত।
দিয়া খুব চেষ্টা করেছিল যেন আমি গার্লস কলেজে যাই। কেন তা জানি না। গার্লস কলেজে গেলেই ছেলেদের সঙ্গে হুজ্জোতি করব না, এ গ্যারান্টি দিয়াকে কে যে দিল! স্কুলিং তো হয়েছে রাম-কনজারভেটিভ স্কুলে, তাতে কি আমার ছেলে বন্ধুর সংখ্যা কিছু কম হয়েছে? যতক্ষণ স্কুলে থাকছি লালপাড় সাদা শাড়ি পরে, খালি পায়ে হাত জোড় করে ক্লাস করেছি, যেন সন্ন্যাসিনী এই হলাম বলে। স্কুল বাসে যাতায়াত, একেবারে এয়ার-টাইট। ওয়াটার-টাইট। তাতে কিছু ইতর বিশেষ হয়েছে? মল্লিকদের বইয়ের দোকানে সন্ধে না হতেই আড্ডাও কমেনি, ওদের সঙ্গে দল বেঁধে সিনেমা কি রেস্টুরেন্ট যাওয়াও বন্ধ থাকেনি। দিয়া অবশ্য মুখ ফুটে বলেনি কিছু, কিন্তু দিয়ার মনের কথাই যদি পড়তে না পারব, তো দিয়ার আঁচল আর স্কার্টের ছায়ায় বড় হলাম কেন?
ক’দিনই সেই গাঁইয়াটা বাড়ি আসার সময়ে আমাকে ফলো করছে। আমার ট্রামে উঠেছিল। দু তিনটে সিট পেছনে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে ছিল, ভেবেছে আমি দেখতে পাইনি। অগত্যা আমায় ফট করে নেমে যেতে হল। ইচ্ছে হয়ে থাকে সোজাসুজি এসে আলাপ কর না বাবা। লুকিয়ে-চুরিয়ে পেছন-পেছন আসা—এ সব আবার কী? মতলব কী কে জানে? পার্ভার্টেড হতে পারে। সাবধান হওয়া ভাল। আজকাল নানারকম অদ্ভুত অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে।
কলেজ স্ট্রিটে নেমে গেলাম। ওমা দেখি, ও-ও নেমেছে। স্টপে দাঁড়িয়ে থাকি। দেখি কী করে। একটু ইতস্তত করল, যেন কিছু বলবে। বল বাবা বলে ফ্যাল, বুকখানা হালকা হয়ে যাবে। নাঃ সরু মতো একটা গলির দিকে পা বাড়াল। কলেজ রো। যাক। ও গলিটাতে ঢুকে যাওয়ার পর আমি হ্যারিসন রোড ক্রস করে বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিটে ঢুকি। বই দেখতে দেখতে চলে যাই ইউনিভার্সিটি ইনস্টিট্যুট পেরিয়ে কলেজ স্কোয়ারের ওদিকে। ও দিক দিয়ে বেরিয়ে আবার ট্রাম ধরব। লেঃ এবার ঘুরে মর। আলাপ করতিস লক্ষ্মী ছেলের মতো তো তোকে নিয়ে কফি-হাউজে ঢুকতাম। চিকেন ওমলেট খাওয়াতাম। ঘণ্টা দুয়েক তো অন্তত গল্প, আড্ডা হতই। কথা-টথা না বলে একটা ব্লাইন্ড লেনে ঢুকে গেলি। বেরিয়ে দেখবি আমি হাওয়া। যতদিন গাড়লের মতো ফলো করবি এমনি পিছলে পিছলে বেরিয়ে যাব। তুই তো চুনো পুঁটি। কত রাঘব বোয়ালকে ঘোল খাইয়ে ছেড়ে দিয়েছি। বাগবাজার থেকে ওয়েলেসলি পর্যন্ত সমস্ত গলিঘুঁজি আমার হাতের পাতার মতো চেনা। যে কোনও মুখ দিয়ে ঢুকে আবার যে কোনও মুখ দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারি। প্রত্যেক পুজোর সময়ে নতুন নতুন আউটলেট বার করি। মাইকেলরা আমাকে বলে বান ফিশ। বান মাছ সাপের মতো দেখতে। মোটা সোটা। আমি নাকি ওই স্বাস্থ্যবান দুরন্ত মাছটার মতো সারা উত্তর কলকাতা মধ্য কলকাতা সাঁতরে বেড়াই।
বাড়ি যাওয়ার দুটো রাস্তা আছে আমার। সার্কুলার রোড দিয়ে ট্রামে করে সোজা চলে যাওয়া যায়। এলিয়ট রোডে নেমে পড়লেই হল। হাতে সময় থাকলে আমার এই আনরোম্যান্টিক পথ ভাল লাগে না। সে ক্ষেত্রে দক্ষিণের মেয়েদের সঙ্গে চলে যাব চৌরঙ্গি। লিন্ডসে দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে ঢুকব। এইখানে চৌরঙ্গি লেন, রিপন স্ট্রিট একটু এগিয়ে রয়েড স্ট্রিট এইসব আমার প্রিয় জায়গা। চা কফি আর ভাজা মাংসের গন্ধে বাতাসটা ভারী। হঠাৎ ঢুকলেই গন্ধটা এসে সোজা নাকে ধাক্কা দেয়। জিভে জল এসে যায়। পেটে খিদে থাকলে তো কথাই নেই। আর ক্লান্ত থাকলে? কফির গন্ধে সঙ্গে সঙ্গে চাঙ্গা।
আমাদের বাড়িটা একটু ভেতর দিকে। ঠিক ট্রাম রাস্তার ওপরে নয়। বাড়িটা দিয়ার। তবে দিয়া বা দিদিমা বলে দিয়ার মানেই আমার। দিয়ার যা কিছু সব আমিই পাব। টাকা পয়সা দিয়ার নেহাত মন্দ নয়। চৌরঙ্গি লেনে একটা রিপন স্ট্রিটে দুটো তিনখানা বাড়ি দিয়ার। আগাপাশতলা ঠাসা ভাড়াটে। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, আপ-কানট্রি মুসলিম, বাঙালি মুসলিম। অনেক দিনের ভাড়াটে সব। আগেকার রেটে ভাড়া। তাই তিনটে বাড়ি শুনতে যতটা, আয় ততটা নয়। তবে দিয়ার যখন অসুখ করেছিল, স্টিফেনের সঙ্গে গিয়ে আমি ওদের কাছে অ্যাপীল করি, ওরা সকলেই প্রায় ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছিল। দোকানগুলো তো বটেই, যারা বসবাস করে তারাও। দেয়নি খালি আকবর আলি, মিসেস ডি-সুজা আর রবিনা পার্কার। আকবর আলি ওখানেই একটা খাবার দোকানে কাজ করে। দুটো বিবি আর সাতটা ছেলে মেয়ে নিয়ে থাকে। ও বেচারা আর কী করে দেবে? বলেছিল— ‘আল্লাহ্ দিলে আমিও বিবিজিকে দেব, ঠকাব না।’ মিসেস ডি-সুজা নিজে থাকেও বটে, একটা মস্ত হলও আছে ওর কাছে। সেই হলে মিসেস ডি-সুজার শাশুড়ির ডান্স-স্কুলে আমার দিয়াও না কি কাজ করেছে একদিন। মিসেস ডি-সুজার আলাদা খাতির দিয়ার কাছে। বন্ধুও তো ছিল দু’জনে। তার ওপরে মিসেস ডি-সুজা এখন পায়ের বাতের জন্য নাচ-স্কুল প্রায় বন্ধই করে দিয়েছে। ওর ছেলে বনি অবশ্য জাহাজে কাজ করে, অনেক মাইনে পায়। কিন্তু সে আছে নিজের তালে। মাকে কিছু দেয় কি না কে জানে! কিন্তু রবিনা পার্কার বেশ শাঁসালো পার্টি। স্টিফেন বলে ওর প্রচুর ইনকাম। স্কুল প্রেমিসেই রিসেসের সময়ে আধঘণ্টা ও বাচ্চাদের হোম টাস্ক করিয়ে দিয়ে রোজগার করে, ছুটির পর এক ঘণ্টা স্কুলের ক্লাসরুমেই পড়ায়। তারপর আবার কাছাকাছি কোনও বাচ্চার বাড়ি মস্ত একখানা ক্লাস করে। তা ও যা ঝগড়াটে! আমাকে তো স্রেফ হাঁকিয়ে দিলে। দিক, এখন দিক। আমি যখন বাড়িগুলোর মালিক হব, তখন দেখব কেমন না দেয়।
তবে এসব বাড়ি মুরগির খাঁচার মতো। আসল বাড়ি হচ্ছে দিয়ার বাড়ি। দাদা যে রুচিশীল মানুষ ছিল সেটা দিয়ার বাড়ি দেখলেই বোঝা যায়।
লাল ইঁটের দোতলা বাড়ি। থামগুলোর ওপরটা সাদা লতাপাতার কারুকাজ করা। সবুজ দরজার পাল্লাদুটোয় তিনটে তিনটে ছটা পদ্ম। পেতলের কড়াগুলো বালার মতো। ঢুকেই উঠোন। সুন্দর কুচি-কুচি পাথর বসানো উঠোন। দিয়ার শখের গাছগুলো টবে করে মাঝখানে থাকে। অ্যারিকা পাম, নানান জাতের ক্রোটন, রবার, বেশ কয়েকরকমের ফার্ন, প্রকাণ্ড একটা টবে শিউলি গাছ আছে একটা, শিউলি নাকি দাদার প্রিয় ফুল ছিল। দাদার দেশের বাড়ির চত্বরে সারা শরৎকাল জুড়ে শিউলির কার্পেট বিছিয়ে থাকত। কলকাতার বাড়িতে দাদা সেই শিউলির জন্যে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলত, তাই দিয়া টবে শিউলিগাছ করেছিল।
আমাদের সিঁড়িগুলো চওড়া, খুব উঁচু ধাপ নয়। মাঝের চাতালটাতে দুদিকে দুটো বড় বড় ছবি আছে একটা কুইন আলেকজান্দ্রার, আরেকটা হেস্টিংসের সময়কার কলকাতার। ফীটনে চড়ে সাহেব মেমসাহেবরা বেড়াতে বেরিয়েছে। ঘোড়ায় চড়ে সৈনিক যাচ্ছে। নতুন তৈরি সব প্রাসাদ, দূরে দূরে। কত ফাঁকা তখন এদিকটা! কী চওড়া রাস্তা!
কুইন আলেকজান্দ্রার ছবির একটা গল্প আছে। গল্পটা খুব মজার। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে এই ছবির গলায় মুক্তোর চোকার দেখে নাকি দিয়া খুব মুগ্ধ হয়ে যায়। দাদা তখন চুপিচুপি ওই রকম চোকার করিয়ে দিয়ার জন্মদিনে উপহার দেয়। তখন দিয়া আবদার করেছিল আলেকজান্দ্রার ওই ছবিটাও তার চাই, দিয়া গলায় চোকার পরে আলেকজান্দ্রার ছবির সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে দেখবে। ভিক্টোরিয়া থেকে ওই ছবি দাদা কত টাকা দিয়ে, কীভাবে কিনেছিল তা জানি না। কিন্তু দিয়ার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়েছিল। ভালই করেছিল দিয়া আবদার করে। ওই চোকার আমি ব্যাংকের লকার থেকে বার করে দেখে এসেছি। দা-রুণ! দিয়ার অন্যান্য গয়না আর টাকা কড়ির মতো ওটাও আমার।
দোতলায় আমাদের চারটে মস্ত বড় বড় শোবার ঘর। দিয়ার পাশের ঘরেই থাকি আমি। আগে আমাদের সব ঘরে ওয়াল-টু-ওয়াল কার্পেট ছিল। সেসব দিয়া তুলে দিয়েছে। যত দিন যাচ্ছে শহর নোংরা দূষিত হয়ে যাচ্ছে, এখন তাই খোলা মেঝে, প্রতিদিন ঝকঝকে করে পরিষ্কার করা হয়। এতটুকু ধুলো ঘরে থাকলে দিয়ার টান বাড়ে, তখন যা কষ্ট পায় বেচারি, অতি বড় শত্রুও দেখলে আহা আহা করবে। তবে দাদার আমলের আসবাব দিয়া একটাও বদলায়নি। আমাদের প্রত্যেক খাট, চেয়ার টেবিল আলমারির নকশা পুরনো ধরনের। ফুল লতাপাতার কারুকাজ-অলা। প্রত্যেকটি আসবাব মেহগনির। কয়েকটা আছে বার্মা টিকের। আমার পড়ার টেবিল কাম দেরাজটা ওয়ল নাটের। এগুলো সব আমাকে চিনতে, যত্ন করতে শিখিয়েছে দিয়া। পুবের বারান্দা ভর্তি আমাদের ফুল গাছ। সব সিজন ফ্লাওয়ার অবশ্য।
এগুলো প্রতি বছর বর্ষায় পোঁতা হয়। শীতে ফুল দিয়ে সব গাছ নেতিয়ে যায়। হলুদ আর ব্রাউনের ভ্যারাইটি করি আমরা। গাঁদা, ডালিয়া, চন্দ্র মল্লিকা, অ্যাসটার, সূর্যমুখী—সব হলুদ আর ব্রাউন। আমাদের অ্যালসেশিয়ানটারও নাম গোল্ডি। গোল্ডির মায়ের নামও ছিল গোল্ডি, তার আগে যে অ্যালসেশিয়ান ছিল তারও নাম গোল্ডি। গোল্ডি ছাড়া দিয়া থাকতে পারে না। গোল্ডি হওয়া চাই, আর অ্যালসেশিয়ান হওয়া চাই। না হলে দিয়ার মন উঠবে না।
দিয়া অবশ্য বলে এই বাড়ির থেকে মুসৌরিতে আমার বাবা-মার বাড়ি অনেক সুন্দর। তার সব জানলা কাচের, মেঝে ওক কাঠের, কী সুন্দর একটা গন্ধ বেরোয় সেই সব মেঝে দরজা-জানলা দিয়ে। কথাটা সত্যি। কিন্তু ওই বাড়ির চারপাশটাও দেখতে হবে। সেখানে এরকম নোংরাও নেই, ঘিঞ্জিও নেই। উপরন্তু চারদিকে দেওদার পাইনের সারি, চমৎকার হাওয়া, আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে নেই কোনও স্কাইস্ক্র্যাপার। এই সব সুবিধেগুলো তো মুসৌরির বাড়ির আছেই।
মুসৌরিতে স্কুলও আছে ভাল। তেমন দরকার হলে দিল্লিতে পড়তে পারতাম। কিন্তু আমি মায়ের কথা শুনিনি। এগারো বারো বছর বয়স অবধি আমি কলকাতার এই গলিতে, দিয়ার কাছেই মানুষ, আমার দিল্লি ভাল লাগে না। মুসৌরি ভাল না লাগার অবশ্য অন্য কারণ আছে। সে যাই হোক, আমার এই এঁদো কলকাতাই ভাল। আমি এঁদো, আমার কলকাতাও এঁদো।
অনেক দিন পর্যন্ত আমার স্কুল ছিল আটটা থেকে একটা। স্কুলের পরে গাড়ি ঘোড়া এড়িয়ে ধর্মতলার ভিড়ের মধ্যে দিয়ে স্টিফেনের সঙ্গে বাড়ি ফিরেছি। ট্রাম চলার শব্দ, বাস চলার ঘষ্ ঘষ্ আওয়াজ, স্রেফ অনেক মানুষের একসঙ্গে চলাফেরার দরুন একটা চাপা আওয়াজ রাস্তা ভরে রাখত, এই আওয়াজ না থাকলে আমি ঘুমোতেই পারতাম না। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরলে খালেদা আমার জন্যে লুচি আর চিংড়িমাছ-পেঁয়াজকলি দিয়ে চচ্চড়ি নিয়ে আসত রুপোর রেকাবিতে, এইগুলো আমার প্রিয় জল-খাবার। কিন্তু, এই সময়ে। স্কুল থেকে ফিরে দুপুরবেলায়। সময়টা যদি বিকেল, বা সন্ধে হয়, চায়ের গন্ধ ওঠে বাড়ির বাতাসে, গলি দিয়ে কফি আর কাবাব-এর খদ্দেরদের আনাগোনা বেড়ে যায়! তখন এই খাবার আর চলবে না। তখন চা-এর সঙ্গে মাফিন, কিংবা পেস্ট্রি, দোকান থেকে কিনে-আনা পসিন্দা কি শামি কাবাব এই হবে আমার টিফিন। সে যাই হোক, দুপুরে বাড়ি ফিরে পেঁয়াজ-কলির চচ্চড়ি দিয়ে লুচি চিবোতে চিবোতে আমি পায়রাদের গান শুনতাম।
সিঁড়িতে বসে বসে সাধারণত আমি স্কুলফেরত বেলাটা পুরোই কাটিয়ে দিতাম। পায়রাদের গান শুনে। এই সময়ে গোল্ডি এসে আমার গা ঘেঁষে বসত। গোল্ডির গায়ে মাথা রেখে আমি ঘুমিয়ে পড়তাম। গোল্ডির গায়ের গন্ধ, পায়রাদের গানের গুব গুব আওয়াজ আর পেঁয়াজকলির চচ্চড়ির স্বাদে ভরা দুপুরবেলা আমি মুসৌরিতে কোথায় পাব?
আমার দিয়া আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ। তাকে ছেড়েই বা আমি অতদিন থাকব কী করে?
দিয়া একটা মোমের পুতুলের মতো। কিংবা একটা মোমবাতির মতো। বাতিদানের ওপরে ক্রিম রঙের মোমবাতিটা বসিয়ে চলে গিয়েছিল কেউ। অনেক দিন ধরে জ্বলছে বাতিটা, মোম গলে বাতিটা ছোট হয়ে গেছে বা অসমান হয়ে গেছে বাতির ওপরটা, গলা মোম জমে জমে আছে বাতিটার গায়ে। তবু বাতিটা জ্বলছে, চারদিকে আভা ছড়াচ্ছে। এই রকম মোমবাতি আমার দিয়া। ক্রিম রঙের শিফন কাপড়ের ওপর প্রচুর লেস দেওয়া নাইট-গাউনটা পরে মেহগনির পালংকে বসে যখন দিয়া প্রে করে শোয়ার আগে হাত দুটো জোড়, চোখ বোজানো, লাল লাল চুলের গুছিগুলো কানের পাশ দিয়ে কাঁধের ওপর এসে পড়ে, তখন এইরকম এক ক্ষয়ে-যাওয়া মোমবাতির সঙ্গে দিয়ার এত মিল পাই যে আমি চোখ ফেরাতে পারি না।
সামনের দেয়ালে যিশুর ক্রুসিফিক্স। সেই দিকে চেয়েই প্রার্থনা করে দিয়া। পাশের দেয়ালে আমার দাদার ছবি। অয়েল পেন্টিং। দাদাকে কিন্তু একটুও জমিদারের মতো দেখতে নয়। মাথার চুলগুলো খুব ঘন, কিন্তু ছোট ছোট করে ছাঁটা। নাকটা চওড়া। পুরু লাল ঠোঁট। চোয়ালের হাড়গুলো উঁচু-উঁচু। গোঁফদাড়ি পরিষ্কার কামানো। সুট পরা, স্ট্রাইপ দেওয়া টাই। হিরের টাইপিন জ্বলজ্বল করছে। গোলগাল জমিদারের চেয়ে মিলিটারি অফিসারের মতোই দেখায় দাদাকে ছবিতে। দাদা বেশ কালো, দেখতে ভাল নয়, আমার কিন্তু মনে হয় দাদার একটা ব্যক্তিত্ব ছিল বটে। দিয়া যদি হয় একটা মোমবাতি, দাদা তা হলে একটা বন্দুক, একটা রাইফল্। বারুদের গন্ধ পাওয়া যায় ছবিটার কাছে গেলেই।
আমি জন্মাবার অনেক আগে দাদা মারা গেছে। মা-ই বোধহয় দাদাকে ভাল করে মনে করতে পারে না। এতদিন আগেকার কথা সে সব। আমার দাদার জন্যে খুব মন কেমন করে। যে দাদাকে কোনওদিন দেখিনি সেই দাদার জন্যে। স্টিফেন দেখেছে দাদাকে, খালেদাও দেখেছে। খালেদা গল্প করে তার হাতের রান্না খেতে দাদা কেমন ভালবাসত। পান্তাভাতের মধ্যে কাঁচা সর্ষের তেল, কাঁচা পেঁয়াজ আর কাঁচা লংকা দিয়ে সপাসপ মেরে দিত দাদা। খালেদা আর স্টিফেনের কাছে ভাগাভাগি করে দিয়া আর দাদার রোমাঞ্চকর প্রেমের গল্পও আমি শুনে নিয়েছি।
ওই যে রিপন আর চৌরঙ্গির গলির তিনটে বাড়ি, ওরই একটাতে, তেরো নম্বরে নাকি থাকত দিয়া, তার বুড়ি দিদিমার সঙ্গে। খালেদা আমাকে সবকিছু খুলে বলতে পারে না, আমি কিন্তু এখন বুঝে গেছি। দিয়ার দিদিমা খুব ভাল চরিত্রের মহিলা ছিল না। এমন কী দিয়া তার নিজের নাতনি কি না এ নিয়েও সন্দেহ ছিল। তখন দিয়ার পনেরো ষোলো বছর বয়স। স্কুলে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। স্টেনোগ্রাফি-টাইপিং শিখছে, আর এসপ্লানেড পাড়া মাতিয়ে বেড়াচ্ছে। যত বাজে ছেলের সঙ্গে আড্ডা। যখন-তখন ওরা এসে ডাকে, দিয়া চলে যায় সিনেমা, চলে যায় রেস্তোরাঁয়, বারে। সে সময়ে মিসেস ডি-সুজার শাশুড়ির নাচের স্কুলেও কমপ্যানিয়নের কাজ করেছে দিয়া। ওখানে নাচ শিখতে আসত বড় ঘরের ছেলেরাও। কত জন দিয়াকে ছেলেমানুষ পেয়ে কত রকমের প্রস্তাব দিয়েছে, দিয়া কোনওটাকে পাত্তা দেয়নি। আমি এখনও চোখ বুজলেই দেখতে পাই আইলিন নামে অপূর্ব সুন্দর সেই হাসিখুশি মেয়েটা লাল স্কার্ট আর পোলকাডটেড টপ পরে ওয়ালজ কি ফক্স-ট্রট নাচছে। ওই সময়কার ছবি আছে দিয়ার অ্যালবামে, বিশ্বাস করা যায় না এত সুন্দর সেই আইলিন।
হেসে হেসে ওই সব জমিদার ব্যবসাদারদের ছেলেদের সঙ্গে ফ্লার্ট করছে আইলিন। ওই ছেলেগুলো ক্যাবলা মেরে যাচ্ছে। পাগল হয়ে যাচ্ছে। খালেদা আমাকে ফিসফিস করে বলত—ওই সব বড়লোকের ছেলেরা আইলিনের সঙ্গে ঘুরতে চাইত, হোটেলে ঘর বুক করে একটা রাতও অন্তত কাটাতে চাইত। চাইত গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়বে শহর থেকে দূরে। অনেক আরাম, ঐশ্বর্য, টাকাপয়সা, গয়নাগাঁটির লোভ দেখাত ওরা। আর লোভ দেখাত ভালবাসার।
—‘আইলিন। আইলিন তোমাকে পেলে আর কিছু চাই না—তুমি আমার হও’—এই রকম গুঞ্জন কানের কাছে করতে থাকলে রক্তে কী রকম দোল লাগে তা তো আমি ভালই জানি। আইলিনেরও নিশ্চয় লাগত। টাকা পয়সা, গয়নাগাঁটির লোভ এড়ানো যায়, ভালবাসার, রোম্যান্সের লোভ এড়ানো খুব শক্ত। তার ওপরে আমরা এই সময়ের মেয়েরা যত প্র্যাকটিক্যাল, যত হিসেবি, আইলিনরা তো তা ছিল না। আইলিন তাই ভেসে যাচ্ছিল। ভাসছিল, আর ভেসে যেতে যেতে বুঝতে পারছিল কত ধানে কত চাল।
বিনয়ভূষণ চৌধুরী এই সময়েই মিসেস ডি-সুজার ডান্স স্কুলে আসে। আইলিনের আর ভেসে যাওয়া হয় না। আমার দাদার অনেক গুণ। আইলিনের জন্যে সে সর্বস্ব পণ করেছিল। কী-ই বা ছিল তখন আইলিন? একটা সতেরো আঠেরো বছরের ফুটফুটে মেয়ে বই তো নয়! বিনয় চৌধুরী তার জন্যে নিজের জমিদারি টাকা পয়সার আশা ছেড়ে দিল। নিজে ব্যবসা করে এখানে এই কলকাতাতেই টাকা পয়সা করল। এই সব বাড়ি ঘর কিনল। আইলিনকে মানুষ করল, ঠিক যেমন মেয়েকে বাবা মানুষ করে। আইলিন বাড়িতে পণ্ডিতের কাছে সংস্কৃত শিখল, বাংলা শিখল। অনেক ভাল ভাল বই পড়ল। গান শিখল, ভজন, কীর্তন, রামপ্রসাদী। শাড়ি-পরা বাংলা মেয়ে, বাংলা বউ হল। মোচার ঘন্ট থোড়ের ছেঁচকি রান্না করতে শিখল, পরীক্ষা দিয়ে দিয়ে গ্র্যাজুয়েট হল। আমার মা যখন হয়েছে তখন আইলিন পুরোদস্তুর এক মিসেস এলা চৌধুরী।
আমি বলি—দিয়া, দাদা তোমাকে অত চেষ্টা-চরিত্র করে বাঙালি বউ বানাল। তা তুমি এই শেষ বয়সে কেন আবার মেম-সাহেব হয়ে যাচ্ছ?
—মেমসাহেব হচ্ছি? হাউ?—দিয়া অবাক হয়ে তাকায়।
আমি বলি—কেন? তোমার চুলের খোঁপা, বিনুনি কোথায় গেল? চুল কেটে ফেলেছ যে!
—চুল কাটিনি, বুলা—চুল পড়ে গেছে সব। অত যত্ন করে লম্বা চুল করেছিলুম। অ্যাত্ত বড় খোঁপা হত, এখন চুল তো নয়! যেন টিকটিকির ল্যাজ!
—আচ্ছা ঠিক আছে, শাড়ি কেন তাহলে পরো না! পরে থাক তো একটা ম্যাক্সি।
—বুলা, বুড়ো শরীরে আর শাড়ি সামলাতে পারি না রে! কত সুন্দর সুন্দর শাড়ি পরেছি এক সময়ে। ঢাকাই, জর্জেট, মাইসোর সিল্ক, শিফন, জামদানি, বেনারসী, আবার টাঙ্গাইল বুটিগুলো, ধনেখালির ডুরেগুলো, শান্তিপুরের কলকা পাড় হাতি পাড় এক রঙা শাড়ি এ সবও তো কত পরেছি। তোলা আছে কত আমার আলমারিতে। এখন সে সব যেন হাতেবহরে আমাকে গিলতে আসে।
সত্যি কথাই, এলা চৌধুরীর সেইসব শাড়িপরা চেহারার ফটোও যেন আমাদের অ্যালবামে আছে। এত সুন্দর করে পরত কে বলবে বাঙালি নয়।
—আজকাল তুমি তো আর চচ্চড়ি, ঘণ্ট, মাছের তেলের বড়া, ইলিশের পাতুরি এ সব খাও না,—আসলে এইগুলো আমি নিজে খুব ভালবাসি। মিস্ করি।
—সহ্য হয় না বুলা, তা নয়তো চচ্চড়ি আমারও খুব ফেভারিট।
—তা হলে কেন রাত্তিরে জিসাসের কাছে প্রার্থনা কর?
—এটা চিরকাল করেছি বুলা। ভক্তির জিনিস, দেবতা, কখনও বদলায় না। ভেতর থেকে কোনও আর্জ না এলে আমি কালী কি কৃষ্ণকে ভগবান বলে প্রণাম করতে পারব না। এ নিয়ে তোর দাদা আমাকে দু-একবার জোর করেছিল। আমি কী বলেছিলুম, জানিস?
—কী?
—বলেছিলুম, দেখো পোশাক, খাদ্য, ভাষা এ সবই বাইরের, তাই এগুলো বদলাতে পেরেছি। কিন্তু যিশাস আমার ভেতরের জিনিস। এটা পাল্টানো যাবে না। পাল্টে গেলে আমি আর আমি থাকব না। তুমি আমায় বিয়ে করলে কেন? একজন ফর্সা-দেখে বাঙালি কালীভক্ত মেয়ে বিয়ে করলেই তো পারতে! বাঙালিদের মধ্যে কি ফর্সা নেই? সুন্দরী নেই?
—কী বলল দাদা?
—চুপ করে গেল। একদম চুপ। আর কোনওদিন এ সব নিয়ে কিছু আমায় বলেনি।
এখন শেষ বয়সে দিয়ার ভেতর থেকে, এলা চৌধুরীর ভেতর থেকে কি আইলিন বার হয়ে আসছে? দিয়া হয়তো নিজেও জানে না, কিন্তু ঘটছে ব্যাপারটা।
যখন মুসৌরি থেকে প্রথম চলে এলুম, তখনই দেখি এই পরিবর্তনটা। রেখে গিয়েছিলাম একজন শাড়ি পরা, পান-খাওয়া, দিয়া। এসে দেখি দিয়া পান খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। রোগা হয়ে গেছে খুব। পায়ের হাতের গাঁটের ব্যথায় ভোগে। আর কাফতান কিংবা ম্যাক্সি পরে থাকে সারাদিন।
যদি বলি দাদার কষ্ট হবে এলা এরকম বদলে যাচ্ছে দেখে, তখন দিয়া কী বলে জানেন? দিয়া বলে বিনয়ভূষণ এখন শেষ বিচারের দিনের জন্য অপেক্ষা করছেন। এখন কে এলা কোথায় কী করল দেখবার অবস্থা তার নেই।
আমি বলি–আঃ দিয়া, কী সব পুরনো পুরনো কথা বলছ, বিনয়ভূষণ এখন অন্য কোথাও জন্মে গেছে। শেষ বিচার টিচার তোমাদের শাস্ত্রের পাতাতেই পাওয়া যায়।
এই নিয়ে আমাদের মধ্যে খুব তর্ক হয়। দিয়া শেষ বিচার আঁকড়ে থাকে, আমি আঁকড়ে থাকি পুনর্জন্ম। দিয়া আঁকড়ে থাকে যিশুকে, আমি বলি যে নিজেকেই বাঁচাতে পারল না সে আবার আমাদের কী বাঁচাবে? নির্ভর করতে হলে কোনও মানুষের ছেলের ওপর করা ভাল? না মানুষের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিমান কোনও অপার্থিব, অলৌকিক সত্তার ওপর করা ভাল?
দিয়া বলে—যেটা ট্রুথ, সেটাই আমাদের মেনে নিতে হবে, বিশ্বাস অবিশ্বাসগুলো আমাদের পছন্দ, আমাদের সুবিধে-অসুবিধে মেনে তো হবে না।
আমি বলি—সত্য কোনটা তুমিও জানো না, আমিও জানি না। আমরা দুজনেই আমাদের পছন্দ, আমাদের সুবিধে-অসুবিধেগুলো অনুযায়ী সত্য সৃষ্টি করছি।
—আমরা হয়তো জানি না, কিন্তু মহাজনরা তো জানেন। —দিয়া বলে— তাঁদের কথাই সত্য।
মহাজনদের ওপর অত ভরসা আমার নেই। আর কে প্রকৃত মহাজন এ নিয়েও তো তর্ক হতে পারে। একজন মহাজন হলে আরেকজন আরও বড় মহাজন হতে পারেন। তাঁর চেয়েও বড় হতে পারেন আরেক জন। কার কথা মানব? তাই নিজের বোধ-বুদ্ধিতে যেটুকু বুঝি, সেইটুকুই আমার আসল ভরসা। আর সেই বোধবুদ্ধি বলে মৃত্যুর পরে কে কোথায় যাবে, এ নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কোনও লাভ নেই, মৃত্যুর আগে এই জীবনটাতে কোথায় যাচ্ছ, কী করছ সেটাই আসল।
আমি যাই বলি, দিয়া সেই বিনয়ভূষণেরই আশায় নিজেকে কখনও এলা, কখনও আইলিন বানায় এ বিষয়ে আমার সন্দেহ নেই। দক্ষিণেশ্বরে পুজো দিতে যায়, আবার সেন্ট পলস-এ ক্রিসমাস, গুড ফ্রাইডেতে প্রার্থনা শুনতেও যায় দিয়া, যাকে বলে ‘মাস।’ আর বিনয়ভূষণের লাইব্রেরি? ঠিক সেই একরকম ভাবে রেখে দিয়েছে দিয়া। ঠিক সেই এক জায়গায় ওয়লনাটের ডেস্ক, চেয়ার, রকিং চেয়ার একটা বেতের। একটা জার্মান সিলভারের পানের বাটা ডেস্কটার বাঁ দিকে। ডান দিকে রাইটিং প্যাড, পেন হোল্ডার। আমি যদি লাইব্রেরিতে পড়তে ঢুকি, হয় দিয়া নিজে নয় তো খালেদা, দিয়ার এক নম্বর স্পাই উঁকি মেরে দেখে যাবে আমি কিছু এদিক-ওদিক করছি কিনা। আইভরির পেনহোল্ডারটা কতদিন চেয়েছি। দিয়া খুব আঘাত পাওয়া চোখে চেয়ে বলে—‘ওটা তো তোর দাদার!’ যেন দাদা এখনও বেঁচে আছে, এখনও ব্যবহার করবে এ সব জিনিস!